নক্রচরিত

নক্রচরিত হল নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় রচিত একটি বিখ্যাত ছোটগল্প[১][২][৩] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন বাংলার গ্রামীণ সমাজের পটভূমিতে রচিত এই ছোটগল্পের মুখ্যচরিত্র নিশিকান্ত কর্মকার একজন গ্রামীণ মহাজন। চরিত্রে সে সত্যি সত্যিই নক্র (কুমীর) স্বরূপ। বাইরে তার ভেক পরম বৈষ্ণবের, অথচ ভিতরে ভিতরে টাকার জন্য সে করে না এমন কাজ নেই। লেখকের মরমী কলমে তীব্র ব্যঙ্গের সাথে এই গল্পে নিশিকান্তের কাহিনীর মধ্য দিয়ে পরতে পরতে উঠে এসেছে মজুতদার ব্যবসায়ীদের কীর্তিকলাপ ও চরিত্র। ‘৪২ থেকে ‘৪৫ সালের বাংলার ভয়াবহ মন্বন্তরের চিত্রও ধরা পড়েছে এই গল্পের পটভূমিতে, মতি পাল ও তার বউ-এর মৃত্যু ও তাকে কেন্দ্র করে চৌকিদারের কথাবার্তায়। এই মন্বন্তরের কারণ হিসেবে মজুতদারী ও ব্যবসায়ীদের মুনাফালোভ যে কী ভূমিকা পালন করেছিল, তারও ঈঙ্গিতবাহী এই গল্প। গল্প যত শেষের দিকে এগোয়, ততই নিশিকান্তর মনে চেপে বসে এক অজানা আতঙ্ক, মুনাফার লোভে তার ঘৃণ্য কীর্তিকলাপ তলে তলে কোন্‌ সামাজিক প্রতিহিংসার জন্ম দিয়ে চলেছে, সেই আতঙ্কে তার অবচেতন হয়ে ওঠে শিহরিত। সুস্পষ্ট বামপন্থী সমাজচেতনায় ঋদ্ধ এই গল্পটি ছোটগল্পকার হিসেবে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের এক অন্যতম উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।

লেখনী ও প্রকাশনার ইতিহাস[উৎস সম্পাদনা]

এই ছোটগল্পটির পটভূমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন মন্বন্তরের মুখোমুখি দাঁড়ানো অস্থির গ্রামীণ বঙ্গসমাজ। গল্পটি লেখাও হয়েছিল যতদূরসম্ভব এই সময়েই, ‘৪২ সাল বা তারপর।[৪] গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় যুগান্তর পত্রিকায়;[৫] পরবর্তীকালে গল্পটি লেখকের ভাঙাবন্দর ছোটগল্পগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়।

চরিত্রাবলী[উৎস সম্পাদনা]

এই ছোট গল্পে আলাদা হয়ে উঠে আসা চরিত্রের সংখ্যা ছয়টি। এদের মধ্যে মূল চরিত্র নিশিকান্ত কর্মকার। এছাড়া আরও দু’টি প্রধান চরিত্র বিশাখা ও ইব্রাহিম দারোগা। আরও তিনটি তুলনামূলক অপ্রধান চরিত্র হল মদনযোগী ও চৌকিদার। এদের সম্পর্কে নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল –

মুখ্য চরিত্র[উৎস সম্পাদনা]

নিশিকান্ত কর্মকার – গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। সমগ্র গল্পটি একে ঘিরেই আবর্তিত হয়। তার নামই (নিশিকান্ত = নিশির মতো কান্ত যাহার) তার চরিত্রের ঈঙ্গিতবাহী। সে একাধারে কাপড়ের ও সোনারূপার ব্যবসায়ী, চালের আড়ৎদার, মজুতদার, গোলাপাড়া হাটের জাঁদরেল মহাজন; আবার একই সাথে গোলাপাড়া ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টও সে। বাহ্যিক আচারে সে পরম বৈষ্ণব। কিন্তু রাতের আঁধারে ডাকাতদলের লুঠের মালের গোপন ক্রেতাও সেই। এমনকী তাদেরকেও ঠকাতে তার হাত কাঁপে না। আসল সোনাকে গিলটি বলে বেমালুম সে তাদেরকেও অনেক কম টাকা দেয়। বুঝেও কিছু করার থাকে না দুর্দান্ত ডাকাতদেরও। কারণ তাদের লুঠের মালের এমন নিশ্চিন্ত ও বিশ্বস্ত ক্রেতা খুঁজে পাওয়া ভার। তারউপর সদর থানার ইব্রাহিম দারোগার সাথে নিশির বিশেষ খাতিরের কথাও তাদের ভালো মতোই জানা। পঞ্চাশের মন্বন্তর। সামান্য খাবারের অভাবে যেখানে মতি পাল বা তার বউ’এর মতো অসংখ্য মানুষ মারা পড়ছে, সেখানেও তার আড়ৎ’এ আটশ মণ চাল মজুত। বারো টাকা মণের চাল বর্ষার সময় অন্তত চল্লিশ টাকা দরে ছাড়ার পরিকল্পনা নিশির। যুদ্ধের বাজারে অত দাম দিয়েও চাল কেনার দালালের যে অভাব নেই তাও তার বিলক্ষণ জানা। কিন্তু এতদ্‌সত্ত্বেও রাতের অন্ধকার তার অস্বস্তির কারণ। ঘুমোতে পারে না সে সারারাত। গাছের পাতার সামান্য খসখস শব্দও তাকে সতর্ক করে তোলে। তার লোহার সিন্দুকের ঝকঝকে হাতল ও হবসের তালা অন্ধকারের মধ্যেও প্রতিমুহূর্তে তার চোখে ঝিকিয়ে ওঠে। বরং দিনের আলো তার কাছে অনেক বেশি নিশ্চিন্তির আশ্রয়। প্রাকপ্রত্যুষের নামগান ও কীর্তনের আসর তার ভক্তিভাবকে জাগিয়ে তোলে। তবু ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাকে সে ভাবময় কীর্তনের আসর ছেড়েও বিরক্তিকর কর্তব্যের খাতিরে চৌকিদারের সাথে যেতে হয় না খেয়ে মরা মতি পাল ও তার বউএর মৃতদেহ দেখতে। যেকোনও অপঘাতে মৃত্যুর সদরে সরেজমিন রিপোর্ট পাঠানোর দায়িত্ব যে তারই। কিন্তু পরনের একমাত্র কাপড় পেঁচিয়ে আত্মঘাতী মতি পালের বউএর ঝুলন্ত উলঙ্গ মৃতদেহ দেখে শিউরে ওঠে সে; বিবমিষা জাগ্রত হয়; ফিরে আসার সমগ্র পথটা তার মনে হতে থাকে, এই বুঝি হাজারে হাজারে নিরন্ন শীর্ণকায় প্রেতাত্মা তাকে ঘিরে ধরে কৈফিয়ৎ দাবি করে বসে। তার মানসচক্ষে ভেসে ওঠে একটা গরুর পচা গলিত শব আগলে বসে থাকা একটা ঘেয়ো কুকুরের তারস্বরে চিৎকার – এই গা রি রি করা ঘৃণ্য ইমপ্রেশনটি তুলে ধরেই গল্পটি পৌঁছয় তার উপসংহারে।

অন্যান্য প্রধান চরিত্র[উৎস সম্পাদনা]

  1. বিশাখা – হাঁড়ির মেয়ে, কিন্তু ফরসা ও অসামান্য রূপসী। আসল নাম কষ্টবালা। নিশিকান্ত তার গলায় কন্ঠী পরিয়ে তাকে বোষ্টমী করে নিয়েছে। তার নূতন নাম দিয়েছে বিশাখা। তার যৌবনের এই প্রাক্তন লীলাসঙ্গিনীকে সে এখন অন্য কাজে ব্যবহার করে। দাপুটে ইব্রাহিম দারোগা এই বিশাখার সূত্রেই এখন নিশির হাতে বাঁধা। বিশাখা নিজেও সে বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। পারস্পরিক স্বার্থের টানই যে তার ও নিশির সম্পর্কের আসল রসায়ন, তা পরিষ্কার হয়ে যায় তারই কথায়। “মহামান্য অতিথি ও মূল্যবান প্রেমিক”[৬] ইব্রাহিম দারোগার প্রতি তার দরদ দেখে সাময়িকভাবে হলেও নিশি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়লে তাকে মনে করিয়ে দিতে ভুল হয় না তার – “এত হিংসে কেন? এ নইলে অনেক আগেই যে হাতে দড়ি পড়ে যেত, সেটা খেয়াল নেই বুঝি।”[৭]
  2. ইব্রাহিম দারোগা – বিশাখার সূত্রে নিশিকান্তর হাতে বাঁধা পড়া জেলার দাপুটে দারোগা। তার নিজের দু’টো বউ রয়েছে। তারউপর রয়েছে একাধিক বাঁদীও। তারপরেও বিশাখার আকর্ষণে সে এসে ধরা দেয় নিশির পাতা ফাঁদে। একটা সাইকেলে চেপে সে ঘুরে বেড়ায় সারা থানা। এলাকায় ডাকাতি বাড়লে তার কর্তব্য শুধু নিশিকে সাবধান করা – “একটু সামলে চালাও কর্মকার। তোমার জন্যে কি আমার চাকরিটা যাবে?”[৬] নিশির আড়তে যে এই মন্বন্তরের বাজারেও বেআইনিভাবে পাঁচশ’ মণ চাল মজুত আছে, সে খবরও সে রাখে। তবে সেই খবর সে ব্যবহার করে শুধু প্রয়োজনে নিশিকে হুমকি দিয়ে নিজের সুবিধেটুকু আদায় করতে। তার সাথে নিশির আসলে এক লেনদেনের সম্পর্ক, ক্ষমতা ও অর্থ যার সাথে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যে গ্রমের আর সকলে এদের নিয়ে চর্চা করতেও ভয় পায়। তাকে হাতে রেখে নিশি যেমন তার কাজকর্ম নিশ্চিন্তে চালিয়ে যেতে পারে, ইব্রাহিম দারোগারও মনে হয়, “ভারতবর্ষের প্রান্তে প্রান্তে নিশি কর্মকারের মতো বিবেচক আর বুদ্ধিমান লোক পাওয়া যাবে। এ নইলে আর পুলিসে চাকরি করে সুখ ছিল কী।”[৬] অসৎ সরকারি আধিকারিক, কালোবাজারি ব্যবসায়ী ও অপরাধীদের মধ্যে অশুভ আঁতাত কীভাবে মানুষের ঘাড়ে চেপে বসে সমাজজীবনকে পুতিগন্ধময় করে তোলে তার জীবন্ত উদাহরণ এই গল্পে নিশিকান্ত ও ইব্রাহিম দারোগা

অপ্রধান চরিত্র[উৎস সম্পাদনা]

  1. মদন – ডাকাত দলের নেতা। পুরোদস্তুর নিশাচর। লুঠের সময় সময় বাঁচাতে মেয়েদের কান প্রয়োজনে ছিঁড়েও দুল ছিনতাই করতে হাত কাঁপে না তার। খুব ভালোভাবেই সে বোঝে, নিশিকান্ত তাদেরকেও ঠকায়। কিন্তু সব বুঝেও নিরুপায় সে, কারণ জানে লুঠের মাল হস্তান্তর করার এমন নিরাপদ ক্রেতা আর খুঁজে পাওয়া ভার। তারউপর পুলিশও তার হাতে। তাই যতই তার ইচ্ছে করুক, “লোহার বড় হাতুড়িটা তুলে মাথাটা ফাটিয়ে চৌচির করে দিই ওর”[৮], কার্যত নিশির বিরুদ্ধে অক্ষম রাগের অমার্জিত প্রকাশ ভিন্ন আর কিছু করার নেই তার। চরিত্রটির সাথে মুখ্য চরিত্রের সম্পর্কের মধ্যে যথেষ্ট দ্বন্দ্ব থাকলেও মূলত অজটিল একমাত্রিক চরিত্র মদন
  2. যোগী – ডাকাত দলের অপেক্ষাকৃত কমবয়সী নতুন সদস্য। চরিত্রচিত্রণ অনেক বেশি জটিল। দুলের লোভে কান ছিঁড়ে নেওয়া মেয়েটির যন্ত্রণা এখনও তার মনে রেখাপাত করে – “উঃ, কী রকম কাঁদছিল মেয়েটা। ওভাবে কেড়ে না নিলেই-“[৯]; এইভাবে লুটপাট কতটা জোয়ানের কাজ, তাই নিয়ে এখনও সংশয় দেখা দেয় তার মনে। বোঝা যায়, অপরাধের পথে পুরোদস্তুর নেমে পড়লেও, ভিতরের মানুষটা এখনও সম্পূর্ণ মরে যায়নি তার। তবে চরিত্রটির বিকাশের আরও সুযোগ থাকলেও, গল্পের পরিসরে তার চিত্রণ নিয়ে খুব বেশি অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি লেখকের।
  3. চৌকিদার – গ্রামবাংলার নিরন্ন মানুষজনের কথা এর মাধ্যমেই পৌঁছয় আমাদের কাছে। হাটের হরিসভার কীর্তনের আসরে মাঝরাতে মূর্তিমান রসভঙ্গের চেহারায় আবির্ভূত হয় সে, মতি পাল ও তার বউ’এর খবর নিয়ে। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নিশিকে সে জানায়, “মতি পালের বৌ গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে বাবু। একবার যেতে হবে।”[১০] কেন মরল, কীভাবে মরল, এ’সব প্রশ্নের উত্তরে একরাশ সমবেদনা ও ক্ষোভের সাথে সে যোগ করে – “বাঁচবে কী করে বাবু? … না খেয়ে মরেছে। আগে ভিক্ষে করত, তিরিশ টাকা চালের বাজারে কে ভিক্ষে দেবে এখন? বৌটাও আর পেটের জ্বালা সইতে পারেনি, তাই গলায় দড়ি দিয়েই ঝামেলা মিটিয়েছে।”[১১] তার মুখ থেকেই আমরা আরও খবর পাই, “এরকম চললে দু’ মাসে দেশ উজাড় হয়ে যাবে। যে আগুন চারদিকে জ্বলছে, কারো রেহাই পাবার জো আছে !”[১১] নিজে একমাত্রিক চরিত্র হলেও সমগ্র গল্পের চরিত্র পালটে যায় তার উপস্থিতিতে। সেই হিসেবে গল্পের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সে।

বিষয়বস্তু[উৎস সম্পাদনা]

অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য কথাসাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেছেন, “[তিনি] সমসাময়িক যুগের প্রতিনিধিস্থানীয় শিল্পী। … মহাযুদ্ধ ও মন্বন্তরের পটভূমিতে তাঁর বিকাশ।”[১২] ১৩৬২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প-এর ভূমিকায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের একাধিক ছোট গল্পের পটভূমি ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে তিনি লিখেছেন –

"সেদিন সর্বগ্রাসী যুদ্ধের তাণ্ডবে ভেঙে পড়েছে জীবনের খেলাঘর। ... সঙ্গে সঙ্গে শবলুব্ধ গৃধ্রদের ঊর্ধ্বস্বর বীভৎস চিৎকারে মুখরিত হয়ে উঠেছে আকাশ-বাতাস; একদিকে যুদ্ধের জুয়াখেলায় কাগজিমুদ্রার ছিনিমিনি, অন্যদিকে চোরাকারবার আর কালোবাজারের নারকীয় অনাচারে পর্যুদস্ত দিনযাত্রা; সারা বাংলা জুড়ে নিরন্ন বিবস্ত্র নরনারীর গগনভেদী হাহাকার, আর তারই বুকে বসে মুনাফাশিকারী মজুতদার আর ব্যবসায়ীদের দানবীয় অট্টহাসি। মহাপ্রলয়ের সন্ধিলগ্নে যেন নরক গুলজার।"[১২]

“নক্রচরিত” এই পটভূমিতেই রচিত একটি গল্প। গোপাদত্ত ভৌমিকের ভাষায় “কীভাবে মানুষের দুর্নিবার লোভ লেলিহান শিখায় জ্বলে উঠে দুর্ভিক্ষকে ভয়ংকর আকৃতি দিল” তারই এক খণ্ড কিন্তু জীবন্ত চিত্র ধরা পড়েছে এই ছোটগল্পের পরিসরে। “গ্রামের ক্ষমতার কেন্দ্রে কারা, কীভাবে গড়ে ওঠে তাদের শক্তির ভিত, নিশি কর্মকার সেই চিরকালের আর্কিটাইপ[১২]। একদিকে আমরা এইগল্পে পাই, মুনাফাখোর কালোবাজারি-অপরাধী-পুলিশের ত্র্যহস্পর্শ্ব কীভাবে গ্রামবাংলায় এক দুর্নীতিপরায়ণ কিন্তু সর্বগ্রাসী ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ে তোলে, যা স্বাভাবিক জনজীবনের ভিতকেই টলিয়ে দেয়, অথচ তার বিরুদ্ধে সব জেনেও মুখ খোলার সাহস কারোর নেই; অন্যদিকে একইসাথে এই গল্প চিত্রিত করে এই অপরাধী চক্রের নিজস্ব মনোজগত – যেখানে একদিকে যেমন কাজ করে সীমাহীন লোভ-লালসা-অর্থলিপ্সা, অন্যদিকে একই সাথে কাজ করে কুটিল সন্দেহ ও আপাত অমূলক এক ভয়, যা পর্যুদস্ত করে তোলে তাদের নিজেদেরও। তারা এই অপরাধচক্রে পরস্পরের সহযোগী, কিন্তু সে সহযোগিতার মূল নিহিত রয়েছে তাদের নিজস্ব ব্যক্তিস্বার্থ ও নিরুপায়তার মধ্যেই। নাহলে পরস্পরের বিরুদ্ধে ফণা তুলতে ভাববে না তারা একমুহূর্তও। মদন তাই নিশির উপর রাগে দাঁত কিড়িমিড় করে ওঠে, নিশি চোরের উপর বাটপারির তত্ত্ব আউড়ে তাকে বেমালুম ঠকায়, ইব্রাহিম দারোগা নিশির গুদামে বেআইনি চাল মজুত থাকার খবর যে তার জানা, তার উল্লেখ করে নিশির কাছ থেকে নোটের তাড়া আদায় করে, বিশাখা নিশিকে মনে করিয়ে দেয়, ইব্রাহিম দারোগার সাথে তার নিরুপদ্রব সম্পর্কের জোরেই নিশির হাতে এখনও দড়ি ওঠেনি। আবার পাশাপাশি ডাকাতদলে নতুন নাম লেখানো যোগীর চরিত্র তুলে এনে লেখক নিশির মতো কালোবাজারের কারবারিদের মুখে একধরনের তুলনামূলক আলোকপাতও করেন। আমরা সেখানে দেখি, এমনকী যোগীর মতো রক্তলোলুপ সরাসরি ডাকাতের মধ্যেও যেটুকু মনুষ্যাবেগে্র অবশেষ রয়ে গেছে, নিশিদের মতো মুনাফাখোরদের মধ্যে সেটুকুও আর অবশিষ্ট নেই।

আঙ্গিক[উৎস সম্পাদনা]

গল্পকথন[উৎস সম্পাদনা]

নক্রচরিত গল্পে গল্পকথনের ক্ষেত্রে লেখক সাধারণভাবে প্রচলিত ধারারই অনুসারী। গল্পকথক এখানে এক সর্বজ্ঞ দৃষ্টির অধিকারী, যার নিজের অবস্থান গল্পের বাইরে। সেই নিরপেক্ষ, নির্মোহ অবস্থান থেকেই সে চরিত্র ও ঘটনাবলীর বিবরণ আমাদের সরবরাহ করে, তার সেই চোখ দিয়েই আমরাও দেখি। তার দৃষ্টির সর্বজ্ঞগামিতার কারণেই কখনও কখনও আমরা চরিত্রদের মনেও প্রবেশের সুযোগ পাই, বিশেষ করে মুখ্য চরিত্র নিশিকান্ত কর্মকারের ক্ষেত্রে এ’ কথা বিশেষভাবে সত্য (এছাড়া যোগী বা ইব্রাহিম দারোগার মতো পার্শ্বচরিত্রদের ক্ষেত্রেও অবশ্য এর উদাহরণ আমরা দেখতে পাই)। কিন্তু সাধারণভাবে তার দৃষ্টি বহির্জগতেই সীমাবদ্ধ থাকে, আমরা বিভিন্ন চরিত্র ও ঘটনাবলীকে বাইরে থেকেই অবলোকন করার সুযোগ পাই, তাদের কথোপকথন ও কাজকর্ম দেখেই আমরা তাদের মনের গহনের খবর আঁচ করি। রাতের অতিথি মদন ও তার দলবলকে দরজা খুলে দিয়ে একবার ট্রাঙ্ক আর পুঁটলির দিকে তাকিয়ে নিশি প্রশ্ন করে “আজকের শিকার?”[১৩] তার শান্তভাব ও প্রশ্নর ধরন শুধু এই ভয়ঙ্কর লোকগুলোর সাথে তার পূর্ব পরিচয়ের কথাই আমাদের কাছে ফাঁস করে না, তার প্রকৃত চরিত্রের উপরও বেশ কিছুটা আলোকপাতও করে। বিশাখা ও ইব্রাহিম দারোগার বাইরের বিবরণ ও কথাবার্তাই চরিত্রদু’টোকে আমাদের সামনে জীবন্ত করে তোলে।

কিন্তু সর্বদাই গল্পকথকের এই অবস্থান নিরপেক্ষ ও নির্মোহ থাকে না, স্থানে স্থানে তাকে অতিক্রমও করে যায় – ” – হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে – আসরের চারিদিকে ঘিরে ঘিরে চলছে অসংলগ্ন কীর্তন। অল্পবিস্তর পা টলছে দু-একজনের, শুধু গাঁজা নয়, ভাবের সাগরে নিঃশেষে তলিয়ে যাওয়ার জন্যে কেউ কেউ তাড়িও টেনে এসেছে। একজন এমনভাবে খোলের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে যে, দেখে মনে হয় ওটা সে যেমন করে হোক ভাঙবেই – এই তার স্থির সংকল্প। আর একজন ঊর্ধ্ববাহু হয়ে আকাশের দিকে লম্ফপ্রদান করছে, যেন ওপর থেকে কী একটা পেড়ে নামাবে; বোধহয় ভক্তিবৃক্ষের মুক্তিফল।”[১৪] হরিসভার এই বর্ণনায় কথকের তীব্র শ্লেষ পাঠকের চোখ এড়ায় না।

চিত্রকল্প[উৎস সম্পাদনা]

এই গল্পে গল্পকথনের আরেক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন চিত্রকল্পের প্রতীকি ব্যবহার।[৪] গল্পের একেবারে শুরুতেই আমরা প্রায় অন্ধকার এক ঘরে দেখা পাই নিশি কর্মকারের, শকুনের মতো তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সে প্রদীপের আলো কমিয়ে রেখে একরকম ইচ্ছাকৃত প্রায়ান্ধকারে বসে জমাখরচের হিসেব মেলাতে ব্যস্ত, আর তার কপালে ফুটে ওঠা সরীসৃপ রেখা। গল্প আরেকটু এগোতেই পাঠকের উপলব্ধি টের পায় এই প্রায়ান্ধকার পরিবেশ, শকুনের মতো তীক্ষ্ণদৃষ্টি, বা কপালের সরীসৃপ রেখা – এসবই প্রতীকি, নিশি কর্মকারের প্রকৃত চরিত্রের ঈঙ্গিতবাহী। রাতের অন্ধকার ভেদ করে বিনিদ্র নিশির কানে আসা গাছের পাতার খসখস শব্দ, ঘাসের মধ্যে দিয়ে সাপের চলার শব্দ বা অন্ধকারের মধ্যেও তার চোখে জ্বলতে থাকা সিন্দুকের ঝকঝকে হাতল ও ভারী হবসের তালা এমনই আরও ক’টি প্রতীকি চিত্রকল্পের উদাহরণ। গল্পটি শেষও হয় এমনই একটি চিত্রকল্পেরই মাধ্যমে, যার তীব্র কষাঘাত পাঠকের মনে এক গা রি রি করে ওঠা ঘৃণার অনুভূতি ছড়িয়ে দিয়ে গল্পটির চূড়ান্ত অভিঘাত সৃষ্টি করে।

ছোটগল্প হিসেবে সার্থকতা[উৎস সম্পাদনা]

ছোটগল্পের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নিজেই বলেছেন –

"ছোট গল্প হচ্ছে প্রতীতি (Impression)-জাত একটি সংক্ষিপ্ত গদ্যকাহিনী যার একতম বক্তব্য কোনো ঘটনা বা কোনো পরিবেশ বা কোনো মানসিকতাকে অবলম্বন করে ঐক্য-সংকটের মধ্য দিয়ে সমগ্রতা লাভ করে।[১৫] 

এর কতগুলো উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল দ্রুত সূচনা, মিতভাষিতা, ভাবের একমুখিতা ও ইঙ্গিতপূর্ণ ব্যঞ্জনাময় পরিসমাপ্তি।[১৫] সেই হিসেবে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের “নক্রচরিত” অবশ্যই একটি সার্থক ছোটগল্প। এর সূচনা আকস্মিক, শুরুতেই গভীর রাতে প্রায়ান্ধকার ঘরে গভীর মনোযোগের সাথে জমাখরচের হিসেবে রত নিশিকে এনে দাঁড় করায় তা ফোকাসে। এরপরে নিশিকে ঘিরেই আবর্তিত হয়ে চলে কাহিনী, অন্যান্য চরিত্ররা আসে, তবে পার্শ্বচরিত্র হিসেবেই, পাঠকের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু থেকে যায় নিশিই। তার লোভ, সন্দেহ, ঈর্ষা, হতাশা, মুনাফাসর্বস্বতা, ধর্মের মেকি মুখোশ – সবমিলে তাকে কেন্দ্র করেই এগিয়ে চলে গল্প তার ক্লাইম্যাক্সের দিকে, যা আসে গল্পের একেবারে শেষে, একটি ইঙ্গিতপূর্ণ ব্যঞ্জনাময় চিত্রকল্পেরই মাধ্যমে। একটি গরুর গলা শবকে আগলে বসে থাকা একটি ঘেয়ো কুকুরের তারস্বরে চিৎকারের গা ঘিনঘিনে চিত্রকল্পটিতে আমরা স্বতস্ফূর্তভাবেই চিনে নিতে পারি দুর্ভিক্ষের বাজারেও আড়তে গোপনে চাল মজুত করে রেখে দাম বাড়ার আশায় তা পচিয়ে নষ্ট করা কালোবাজারিদের প্রতিনিধি নিশিকে। লেখকের কলম থেমে যায় এখানে এসেই, কিন্তু এই প্রতীতির অভিঘাতটা হয়ে ওঠে এতটাই তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী যে, ঠিক এই বিন্দু থেকেই পাঠকের মনে সঞ্চারিত হয়ে চলে গল্পটি; তার ভাবের একমুখিনতা, মন্বন্তরের আসল কারিগর কালোবাজারি ব্যবসায়ীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা সঞ্চারিত হয় পাঠক মনেও।