নিকারাগুয়া হ্রদ

নিকারাগুয়া হ্রদ

নিকারাগুয়া হ্রদ (স্পেনীয়: Lago de Nicaragua, Lago Cocibolca, Mar Dulce, Gran Lago, Gran Lago Dulce, অথবা Lago de Granada উচ্চারণ: লাগো দ্য নিকারাগুয়া, এছাড়াও লাগো কোকিবোলকা, মার দুলথে, গ্রান লাগো বা লাগো দ্য গ্রানাদা নামেও পরিচিত) হল মধ্য আমেরিকার একটি মিষ্ট জলের হ্রদ। আয়তনের বিচারে এটি মধ্য আমেরিকার বৃহত্তম হ্রদ। নিকারাগুয়ায় অবস্থিত এই হ্রদটি আয়তনে বিশ্বে ১৯তম। এর আয়তন ৮০০১ বর্গ কিলোমিটার।[১] উত্তরে তিপিতাপা নদীর মাধ্যমে এটি লেক মানাগুয়ার সাথে যুক্ত। অন্য দিকে রিও সান হুয়ান নদী এই হ্রদ থেকে বেরিয়ে দক্ষিণে কোস্তা রিকা-নিকারাগুয়া সীমান্ত বরাবর পুবমুখে প্রবাহিত হয়ে ক্যারিবীয় সাগর‘এ পড়েছে। সমুদ্রতল থেকে এই হ্রদের উচ্চতা প্রায় ৩২ মিটার। নিকারাগুয়া হ্রদ থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের দূরত্ব কম, কিন্তু এ মহাসাগরের সাথে তার কোনও সংযোগ নেই। কিন্তু অতলান্তিক মহাসাগরের সাথে এর দূরত্ব বেশি হলেও রিও সান হুয়ান নদীপথে এই মহাসাগরের সাথে তার সংযোগ রয়েছে।
মধ্য আমেরিকার এই হ্রদটি ভ্রমণার্থীদের খুব প্রিয় একটি স্থান। প্রতি বছরই বহু পর্যটক এই হ্রদের তীরে এবং মধ্যবর্তী বিভিন্ন হাল্কা জনবসতিযুক্ত দ্বীপে ছুটি কাটাতে আসেন।

ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য

৮০০১ বর্গ কিলোমিটার উপরিতলের ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট লেক নিকারাগুয়া মধ্য আমেরিকার বৃহত্তম ও টিটিকাকা হ্রদের পরে লাতিন আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম হ্রদ। এর জল মিষ্ট বা স্বাদু। এই হ্রদের জলে প্রায় ৪০০ ছোটবড় দ্বীপের দেখা পাওয়া যায়। এর মধ্যে হ্রদের উত্তরভাগে জাপাতেরা (স্পেনীয় উচ্চারণ ‘থাপাতেরা’) ও মধ্যভাগে অবস্থিত ওমেতেপে দ্বীপদু’টি বৃহত্তম। এই দ্বীপগুলি মূলত আগ্নেয়গিরিজাত। শুধুমাত্র ওমেতেপে দ্বীপটিতেই দুটি আগ্নেয়গিরি দেখতে পাওয়া যায়। এর মধ্যে কনসেপসিওন পর্বতটির উচ্চতা ১৬১০ মিটার, অন্যদিকে মাদেরাস পর্বতটির উচ্চতা ১৩৪০ মিটার। ভূতাত্ত্বিকদের মতে আদতে এই দ্বীপটি ছিল দু’টি পৃথক আগ্নেয়গিরিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা দু’টি পৃথক দ্বীপ। কিন্তু পরবর্তী কালে দুই আগ্নেয়গিরি সঞ্জাত লাভাপ্রবাহের দ্বারা দু’টি দ্বীপ পরস্পর যুক্ত হয়ে আজকের ওমেতেপে দ্বীপটি গঠিত হয়।
হ্রদের মধ্যে অবস্থিত অসংখ্য দ্বীপের মধ্যে দক্ষিণপ্রান্তে কোস্তা রিকা সীমানার কাছাকাছি সোলেনটিনামে দ্বীপপুঞ্জ বোধহয় সবচেয়ে পরিচিত। সান কার্লোস শহরের ১০-৩০ কিলোমিটার পশ্চিমে চারটি বড় দ্বীপ, (পশ্চিম থেকে পূর্বে) মানসারানসিতো, মানসারন, সান ফের্নান্দোলা ভেনাদা এবং আরও ৩২টি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই দ্বীপপুঞ্জটি শিল্পী ও যাজক এর্নেস্তো কার্দেনাল‘এর বাসস্থান হিসেবে ৬০’এর দশকের মাঝামাঝি থেকে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। হ্রদের মধ্যে অবস্থিত অন্যান্য দ্বীপের মতো এই দ্বীপগুলোও আগ্নেয়গিরিজাত।[৩]

জলবায়ু

নিরক্ষরেখার বেশ কাছে অবস্থিত এই হ্রদ ও সন্নিহিত অঞ্চলের আবহাওয়া মূলত উষ্ণ। কিন্তু তাপমাত্রা ঋতুভেদে যথেষ্টই ওঠানামা করে। নিকারাগুয়া হ্রদের জলে, বাতাসের গতিবেগ যখন থাকে পূর্ব থেকে যখন পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে, তখন খুব বড় বড় ঢেউ’এর সৃষ্টি হয়। এই হ্রদ অঞ্চল মাঝে মাঝে প্রবল ঝড়ের জন্যও যথেষ্ট পরিচিত। সে সব সময় এই হ্রদে নৌ-চালনা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

হ্রদ বাস্তুতন্ত্র

নিকারাগুয়া হ্রদের একটি দৃশ্য

যদিও লেক নিকারাগুয়া মিষ্ট জলের হ্রদ, বেশ কিছু বৃহৎ নোনা জলের মাছ এই হ্রদে দেখতে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে করাতমাছ (common sawfish), তারপন মাছ ও নিকারাগুয়া হাঙর উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে করাতমাছের সংখ্যা ১৯৭০’এর দশকের পর থেকে ভীষণভাবে কমে গেছে। অন্যদিকে ১৯৬১ সালে নমুনা পরীক্ষা করে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, নিকারাগুয়া হাঙর বলে আলাদা কোনও প্রজাতির হাঙর নেই। লেক নিকারাগুয়ায় দেখতে পাওয়া হাঙ্গরগুলি বাস্তবে ষাঁড় হাঙ্গর (Bull Shark, বিজ্ঞানসম্মত নাম Carcharhinus leucas) প্রজাতির।[৪] ১৯৬৮-৬৯ সালে নেব্রাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়‘এর গবেষকরা লেক নিকারাগুয়ার জলে প্রায় ২২০০ হাঙরের দেখা পান।[৪] এখন খুব স্বাভাবিকভবেই প্রশ্ন ওঠে, নোনা জলের স্বাভাবিক বাসিন্দা এই হাঙর এই অন্তর্দেশীয় হ্রদে প্রবেশ করলো কীভাবে? গবেষকদের মতে এর সম্ভাব্য উত্তর হলো, এই হ্রদ থেকে উৎপন্ন রিও সান হুয়ান নদী সম্পূর্ণ নাব্য। ক্যারিবীয় সাগর থেকে এই নদী পথেই এই হাঙরেরা এই হ্রদে প্রবেশ করে। বর্তমানে তাদের এই যাত্রাপথের প্রমাণও পাওয়া গেছে। বেশ কিছু হাঙর, যেগুলি আগে হ্রদের জলে ধরা পড়েছিল, ছেড়ে দেবার ৭-১১ দিন পর তারা আবার খোলা সমুদ্রে ধরা পড়ে। আবার খোলা সমুদ্রে প্রথমে ধরা পড়া হাঙর পড়ে আবার রিও সান হুয়ান নদীতে বা নিকারাগুয়া হ্রদে ধরা পড়েছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে।[৪] ষাঁড় হাঙরদের এইভাবে সমুদ্র থেকে মিষ্ট জলের নদীতে প্রবেশ করে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ার নজির আগেও পাওয়া যায়।[৫] তবে প্রায় ৩ মিটার লম্বা এই ধরনের হাঙরের দেখাও এখন লেকের জলে লক্ষণীয়ভাবেই কমে এসেছে। এর কারণ হিসেবে প্রথমে ভাবা হয়েছিল, মিষ্ট জল এই ধরনের হাঙরের বসবাসের পক্ষে অনুপযুক্ত হওয়ার কারণেই তাদের সংখ্যা কমে আসছে। কিন্তু এখন ব্যাপকহারে চোরাশিকার ও দূষণকেই এর আসল কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে। এই কারণেই বর্তমানে নিকারাগুয়ায় হ্রদ বা নদীর জলে নিকারাগুয়া হাঙর ও করাতমাছ শিকার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।[৬] এছাড়াও আরও বহু প্রজাতির মাছ এই হ্রদের জলে দেখতে পাওয়া যায়।
এই হ্রদের তীর ও মধ্যবর্তী বিভিন্ন দ্বীপগুলিতে ক্রান্তীয় অঞ্চলের স্বাভাবিক উদ্ভিদের চিরসবুজ বনানী দেখতে পাওয়া যায়। এই অঞ্চলের বনে নানারকম পাখি (যেমন ঈগল, ম্যাকাও, টার্কি), নানা প্রজাতির বাঁদর, হরিণ, ইগুয়ানা ও তাপিরেরও দেখা মেলে।[৭]
তবে শেষ তিন-চার দশকে প্রবল দূষণের কারণে হ্রদের বাস্তুতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে নানা মহল থেকে বারে বারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ১৯৮১ সালে আই আর ই এন এ(নিকারাগুয়ান ইনস্টিটিউট অফ ন্যাচারাল রিসোর্সেস অ্যান্ড দ্য এনভাইরনমেন্ট)’র পক্ষ থেকে হ্রদের জল ও তার বাস্তুতন্ত্র নিয়ে যে ব্যাপক নমুনা সমীক্ষা চালানো হয়, তাতে খুবই উদ্বেগজনক তথ্য উঠে আসে। দেখা যায়, হ্রদের জলে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন বসতি ও কারখানা থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩২ টন বর্জ্য পদার্থ নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। এর মধ্যে হ্রদের তীরবর্তী পেনভাল্ট কেমিকাল করপোরেশন‘এর বর্জ্যই ছিল সবচেয়ে বেশি দূষণ সৃষ্টিকারী।[৮] কিন্তু নিকারাগুয়ার দুর্বল অর্থনীতির কারণে এই দূষণ প্রতিরোধে উপযুক্ত ব্যবস্থা ঠিকমতো নিয়ে ওঠা যায়নি।

ইতিহাস

লেক নিকারাগুয়ার তীরে জনবসতির ইতিহাস সেখানে ইউরোপীয়দের আগমনের থেকেও অনেক পুরোনো। এই অঞ্চলে আগে থেকেই বেশ কিছু স্থানীয় আমেরিন্ডিয়ান উপজাতির বসতি ছিল, যাদের কথা স্পেনীয় কঙ্কুইস্তাদোরদের কথাতেও বারে বারে উঠে এসেছে।

প্রচলিত কাহিনী

এই হ্রদ ও তার মধ্যবর্তী দ্বীপগুলির উদ্ভব নিয়ে কিছু সুন্দর গল্পকথা প্রচলিত আছে। তার মধ্যে একটি এ’রকম – নাগরান্দো নামে এক যুবক ছিল। সে ওমেতেপতল বলে এক যুবতীকে খুব ভালোবাসতো। কিন্তু এই যুবতী ছিল নাগরান্দোদের গ্রামের শত্রু গ্রামের প্রধানের মেয়ে। দুই গ্রামের মধ্যে শত্রুতা ছিল এমন পর্যায়ে যে দুই গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে কোনোরকম বিয়েশাদী ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রেম আর কবে বারণ শুনেছে। ফলে নাগরান্দো আর ওমেতেপতল কিছুদিনের মধ্যেই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে একটি সুন্দর উপত্যকায় আশ্রয় নিল। কিন্তু সেখানেও তাদের সুখের ঘরের কথা গোপন রইলো না। খবর পেয়ে তাদের ধরতে দুই গ্রাম থেকেই মাতব্বররা লোকলস্কর নিয়ে রওনা দিল। তাদের আসার খবর পেয়ে নাগরান্দো আর ওমেতেপতল দেখল, পালানোর আর কোনও জায়গা নেই। পরস্পর থেকে বিচ্ছেদের আশঙ্কায় ও হতাশায় তখন তারা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিল। হাতের শিরা কেটে তারা আত্মহত্যা করে। ওমেতেপতল সেখানেই চিত হয়ে পড়ে যায়। নাগরান্দো টলমল করতে করতে কিছুটা পিছনে সরে এসে পড়ে যায় আরও নিচে। তাদের হাতের কাটা শিরা দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এসে এরপর তাদের দেহগুলি ঢেকে ফেলে। সেই রক্তই আজকের নিকারাগুয়া হ্রদ। আর ওমেতেপে দ্বীপটি তার দুই পর্বতশিখরসহ হল ওমেতেপতলের বুক। আর নাগরান্দোর শরীরের যেটুকু এখনও দেখা যায়, সেটাই হল আজকের জাপাতেরা দ্বীপ।[৯]

ঔপনিবেশিক ও পরবর্তী ইতিহাস

যদিও লেক নিকারাগুয়া ভৌগোলিক দিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের কাছে (এতটাই কাছে, যে ওমেতেপে দ্বীপের পাহাড়চূড়াদু’টি থেকে সহজেই প্রশান্ত মহাসাগর দেখতে পাওয়া যায়।), কিন্তু হ্রদ থেকে উৎপন্ন সম্পূর্ণ নাব্য নদী রিও সান হুয়ান ক্যারিবীয় সাগরে পড়েছে। এর ফলে প্রথম থেকেই স্পেনীয় অভিযাত্রী ও অভিবাসীদের জাহাজ সহজেই এই নদী পথে সমুদ্র থেকে অনেকটা ভিতরে চলে এসে হ্রদের নিরাপদ, শান্ত তীরে আশ্রয় নিতে পারত। তাই হ্রদের তীরে গ্রানাদা শহর প্রথমে একটি অন্তর্দেশীয় বন্দর হিসেবেই গড়ে ওঠে। ক্যারিবীয় জলদস্যুরাও অন্তত তিনবার ঐ একই নদীপথে হানা দিয়ে গ্রানাদা শহর লুঠ করে।[১০]পানামা খাল খননের আগে রিভাসের সংকীর্ণ যোজক পথ ধরে একটি স্টেজকোচ লাইন চালু ছিল। কর্নেলিয়াস ভান্ডেরবিল্ট’স অ্যাকসেসরি ট্র্যানজিট কোম্পানি ছিল এর মালিক। আতলান্তিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে যাওয়ার এটাই ছিল তখন সহজতম পথ। হ্রদ থেকে রিও সান হুয়ান নদী যেখানে বেরিয়েছে, সেখানে এক জায়গায় নদী থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের দূরত্ব মাত্র ২৪ কিলোমিটার। তখন পরিকল্পনা করা হয় এই অংশটুকু একটি খাল খনন করে যুক্ত করে দিলেই তা দুই মহাসাগরের মধ্যে যাতায়াত সহজ করে তুলবে। যাইহোক, শেষপর্যন্ত পানামা খাল খনন করা হলে এই পরিকল্পনা তখনকার মতো পরিত্যক্ত হয়। পরবর্তীকালে ১৯১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও নিকারাগুয়ার মধ্যে সাক্ষরিত ব্রায়ান-চামোরো চুক্তি অনুযায়ী এই আন্তর্মহাসাগরীয় খালের পরিকল্পনা আবার সামনে আসে। যাইহোক, বারে বারে এই খালের পরিকল্পনা হলেও নানা কারণে (যেমন, উদাহরণস্বরূপ পানামা খালের মোট দৈর্ঘ্য ৭৭ কিলোমিটার, সেখানে প্রস্তাবিত নিকারাগুয়া খালের মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ১৩০ কিলোমিটার। অর্থাৎ এই খাল দিয়ে আন্তর্মহাসাগরীয় যাতায়াত ও পরিবহনের খরচ অনেকটাই বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা।) এখনও পর্যন্ত তা কখনোই রূপায়িত হয়নি।