পঠনবিকার একটি দীর্ঘস্থায়ী স্নায়বিক বিকার যাতে আক্রান্ত ব্যক্তি স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কোনও কিছু পড়তে বা বানান করতে অক্ষম হয় বা এসব কাজ করতে বড় ধরনের ঝামেলার শিকার হয়।[১][৬] একে ইংরেজি পরিভাষায় ডিসলেক্সিয়া (Dyslexia) বা রিডিং ডিজর্ডার (Reading disorder) বলে। পঠনবিকারের মাত্রা একেকজন আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য একেক রকম হয়[৩] এতে আক্রান্ত ব্যক্তি চিত্রলৈখিক প্রতীক, বিশেষ ভাষিক প্রতীক যেমন বর্ণ, অক্ষর, ইত্যাদি শনাক্ত করতে ও মস্তিষ্কে প্রক্রিয়াজাত করতে বাধাগ্রস্ত হয়। অত্যন্ত নিম্নমানের পঠন দক্ষতা, শব্দের বানান করতে সমস্যা, স্বাভাবিক দ্রুতিতে পঠনে অক্ষমতা, লেখার সময় শব্দ ও বর্ণের ক্রম উলটে ফেলা, অপাঠ্য হাতের লেখা, মনে মনে শব্দ উচ্চারণ করায় অপারগতা, উচ্চস্বরে পড়ার সময় উচ্চারণে সমস্যা, পঠিত বিষয়বস্তুর অর্থ না বোঝা, ইত্যাদি এই বিকারের কিছু লক্ষণ,[৩][৭] যেগুলি সাধারণত প্রাথমিক শৈশবকালীন বছরগুলিতে বিদ্যালয়ে প্রকাশ পায়।[২]
পঠনবিকার অনৈচ্ছিক, এই বিকারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শেখার স্বাভাবিক আগ্রহ থাকে।[৩] পঠনবিকারগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে স্বাভাবিকের চেয়ে উচ্চহারে মনোযোগের অভাবজনিত অতিসক্রিয়তা বিকার (Attention deficit hyperactivity disorder, সংক্ষেপে ADHD), বিকাশমূলক ভাষাবিকার (Developmental language disorder), ও সংখ্যা গণনায় সমস্যা (Dyscalculia) পরিলক্ষিত হয়।[২][৮][৯]
বংশাণুগত ও পরিবেশগত উপাদানসমূহের মধ্যকার আন্তঃক্রিয়ার কারণে পঠনবিকার ঘটে বলে বিশ্বাস করা হয়।[২] কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই বিকারটি বংশানুক্রমে উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জিত হতে পারে।[৩] এর বিপরীতে যদি কোনও চোটজনিত মস্তিষ্ক জখম (traumatic brain injury), সন্ন্যাসরোগ (stroke), বা চিত্তভ্রংশের (dementia) কারণে পঠনবিকার ঘটে, তাহলে সেটিকে “অর্জিত পঠনবিকার” (Acquired dyslexia) বলে।[১] পঠনবিকারগ্রস্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের পঠন-সংক্রান্ত ও ভাষিক প্রক্রিয়াজাতকরণ সংক্রান্ত স্নায়ুপথগুলিতে অস্বাভাবিকতার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।[৩] স্মৃতি, দৃষ্টিশক্তি, বানান ও পঠনদক্ষতার উপরে ধারাবাহিক কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে পঠনবিকার নির্ণয় করা হয়।[৪] শ্রুতি সমস্যা বা দৃষ্টি সমস্যা, অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ বা সুযোগের অভাবের কারণে সৃষ্ট পঠনে অসুবিধা থেকে পঠনবিকার পৃথক একটি বৈকল্য।[২]
আগেভাগে শনাক্ত হলে এবং পঠন শিক্ষণে বিশেষায়িত দৃষ্টিভঙ্গির সহায়তা নিলে বেশিরভাগ পঠনবিকারগ্রস্ত শিশুকেই পঠন শেখানো সম্ভব। এজন্য পঠনবিকারগ্রস্ত ব্যক্তিটির চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষণ পদ্ধতিতে অভিযোজন ঘটাতে হয় (খাপ খাইয়ে নিতে হয়)।[১] যদিও এতে পঠনবিকারের মূলগত কারণের সমাধা হয় না, তা সত্ত্বেও এর ফলে এ-সংক্রান্ত উপসর্গগুলির মাত্রা বা ক্ষতি হ্রাস পেতে পারে।[১০] দৃষ্টিকে লক্ষ্য করে প্রদত্ত চিকিৎসাগুলি কার্যকর হয় না।[১১] পঠনবিকার অতিসাধারণ একটি শিখন প্রতিবন্ধিতা (learning disability) যা বিশ্বের সর্বত্র বিরাজমান।[১২] যেকোনও জনসমষ্টির ৩-৭% ব্যক্তি এর শিকার হয়ে থাকে।[২][৫] তবে কোনও জনসম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ২০% (প্রতি ৫ জনে ১ জন) কোনও না কোনও মাত্রায় পঠনবিকারজনিত লক্ষণ-উপসর্গ প্রকাশ করতে পারে।[১৩] পুরুষদের মধ্যে পঠনবিকার বেশী ধরা পড়লেও[২] বিশেষজ্ঞদের মতে এটি পুরুষ ও নারী উভয়কেই সমভাবে আক্রান্ত করে।[১২] কারও কারও মতে পঠনবিকারকে বৈকল্য বা বিকার হিসেবে গণ্য না করে একটি ভিন্ন উপায়ে শিখন হিসেবে গণ্য করাই শ্রেয়, যার সুবিধা-অসুবিধা দুই=ই বিদ্যমান।[১৪][১৫]
যখন কোনও অতীতে স্বাভাবিকভাবে পঠনক্ষম ব্যক্তি পঠনক্ষমতা হারায়, তখন তাকে “শব্দান্ধতা” বা “শব্দবোধহীনতা” (ইংরেজি: Alexia অ্যালেক্সিয়া) বলে।[৩]
আরও দেখুন
- গণনাবিকার (Dyscalculia), সংখ্যা ও গণিত অনুধাবনে অসুবিধা
- পড়তে শেখা
- অর্টন-গিলিংহাম