ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে জঁ-ফ্রঁসোয়া শঁপোলয়োঁ ও থমাস ইয়ং প্রমুখ ইউরোপীয় গবেষকদের রচনার মাধ্যমে প্রাচীন মিশরে ব্যবহৃত লিখন পদ্ধতির পাঠোদ্ধার করা হয়। হায়ারোগ্লিফ (চিত্রলিপি), হায়রাটিক ও ডেমোটিক লিপি সহ প্রাচীন মিশরীয় লিপিগুলি খ্রিস্টীয় চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে বোধগম্যতা হারিয়ে ফেলে এবং সেগুলির পরিবর্তে ক্রমশ কপটিক বর্ণমালার ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী প্রজন্মগুলির কাছে প্রাচীনতর লিপিগুলির জ্ঞানের ভিত্তি ছিল গ্রিক ও রোমান লেখকদের রচনা; কিন্তু এই লেখকদের বোঝার মধ্যেও ভুল ছিল। এই কারণেই একটি বহুল প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা গড়ে ওঠে যে, মিশরীয় লিপি আগাগোড়াই ভাবমূলক (যে লিপি শব্দের পরিবর্তে ধারণার প্রতিনিধিত্ব করে); এমনকি এও মনে করে হয় যে চিত্রলিপিগুলি ছিল এক প্রকার গুহ্য আধ্যাত্মিক লিপি এবং তা কথ্য ভাষা নথিবদ্ধকরণের কাজে ব্যবহার করা হত না। মধ্যযুগে ও আদি আধুনিক যুগে ইসলামি ও ইউরোপীয় গবেষকেরা এই লিপি পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করেন এবং এর মধ্যে ধ্বনিবিজ্ঞান-সংক্রান্ত উপাদান থাকতে পারে বলে মত প্রকাশও করেন। কিন্তু চিত্রলিপি পুরোপুরিই ভাবমূলক – এই বদ্ধমূল ধারণা অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত লিপিটিকে বুঝে ওঠার পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
১৭৯৯ সালে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মিশর অভিযাত্রী দলের সদস্যেরা রোসেটা প্রস্তরফলক আবিষ্কার করেছিলেন। এই ফলকটিতে চিত্রলিপি, ডেমোটিক ও গ্রিক ভাষায় একটি সমান্তরাল পাঠ রয়েছে। মনে করা হয়েছিল, এই মিশরীয় পাঠটিতে মিশরীয় ভাষার সর্বশেষ পর্যায় কপটিক ভাষার প্রমাণ থাকায় এটির গ্রিক অনুবাদের মাধ্যমেই পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হবে। আঁতোইন-ইসাক সিলভেস্তর দে সেসি ও জোহান ডেভিড অকারবল্ড যথেষ্ট সময় নিয়ে এই কাজে এগোলেও কাজটি কঠিন বলেই প্রমাণিত হয়। এই কাজে হাত দিয়ে ইয়ং লক্ষ্য করেন যে ডেমোটিক অক্ষরগুলি চিত্রলিপি থেকেই উৎসারিত। তিনি ডেমোটিকের মধ্যে বেশ কয়েকটি ধ্বনিবিজ্ঞান-সংক্রান্ত চিহ্নও চিহ্নিত করেন। এছাড়া ইয়ং বিদেশি-বংশোদ্ভূত মিশরীয় রাজা পঞ্চম টলেমির নামাঙ্কিত একটি কার্তুশে ধ্বনিবাচক অক্ষর সহ অনেক চিত্রলিপির অর্থও চিহ্নিত করেন। যদিও তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে ধ্বনিবাচক চিত্রলিপিগুলি অ-মিশরীয় শব্দ লেখার কাজেই ব্যবহৃত হত। ১৮২০-এর দশকের গোড়ার দিকে শঁপোলয়োঁ টলেমির কার্তুশটির সঙ্গে অন্যান্যগুলির তুলনা করেন এবং উপলব্ধি করেন যে চিত্রলিপিমূলক লিপিটি আসলে ধ্বনিবাচক ও ভাবমূলক উপাদানের একটি মিশ্রণ। শঁপোলয়োঁর দাবি নিয়ে প্রথমে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছিল এবং অভিযোগ করা হয়েছিল যে তিনি ঋণস্বীকার না করেন ইয়ং-এর ধারণাগুলি ধার করেছেন। কিন্তু ক্রমশ শঁপোলয়োঁর দাবি মান্যতা অর্জন করে। শঁপোলয়োঁ অধিকাংশ ধ্বনিমূলক চিত্রলিপির অর্থ সাদামাটাভাবে চিহ্নিত করেন এবং প্রাচীন মিশরীয় ভাষার ব্যাকরণ ও শব্দভাণ্ডারের অধিকাংশটিই পুনরুদ্ধার করেন। এদিকে ইয়ং রোসেটা প্রস্তরফলক ব্যবহার করে অন্যান্য গ্রিক ও ডেমোটিক সমান্তরাল লিপির সংযোগে ডেমোটিক লিপির বৃহত্তর অংশের পাঠোদ্ধার করেন।
পাঠোদ্ধারের প্রক্রিয়াটি ১৮২৯ সালে ইয়ং-এর মৃত্যু এবং ১৮৩২ সালে শঁপোলয়োঁর মৃত্যুর পরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। কিন্তু ১৮৩৭ সালে কার্ল রিচার্ড লেপসিয়াস দেখিয়ে দেন যে অনেক চিত্রলিপিতেই একটির পরিবর্তে দুই বা তিনটি ধ্বনির মিশ্রণ উপস্থাপিত হয়েছে। ইম্যানুয়েল ডে রুজ প্রমুখ অন্যান্য গবেষকেরা মিশরীয় ভাষা নিয়ে গবেষণার কাজে এতটাই অগ্রসর হতে পেরেছিলেন যে, ১৮৫০-এর দশকের মধ্যেই প্রাচীন মিশরীয় গ্রন্থগুলি সম্পূর্ণ অনুবাদ করা সম্ভবপর হয়। মোটামুটি একই সময়ে কিউনিফর্মের পাঠোদ্ধারের সঙ্গে মিশরীয় লিপির পাঠোদ্ধারকরণ মানব ইতিহাসের প্রাচীনতম পর্যায়ের একদা-অবোধগম্য গ্রন্থগুলিকে বোধগম্য করে তোলে।
মিশরীয় লিপিসমূহ ও সেগুলির অবলুপ্তি
হায়রাটিক থেকে ডেমোটিকের (ডানদিকে) বিভিন্ন স্তরে চিত্রলিপি চিহ্নগুলির (বাঁদিকে) বিবর্তনের সারণি।
প্রাচীন মিশরের ইতিহাসে অধিকাংশ পর্ব জুড়ে রয়েছে দু’টি প্রধান লিখন পদ্ধতি। চিত্রলিপির উদ্ভব ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ অব্দ নাগাদ। এটি চিত্রমূলক চিহ্নের একটি পদ্ধতি, যা প্রধানত আনুষ্ঠানিক লেখগুলির জন্য ব্যবহৃত হত। চিত্রলিপি থেকে উদ্ভূত হায়রাটিক ছিল একটি হস্তলিপি লিখন পদ্ধতি। এটি ব্যবহার করা হত মূলত প্যাপিরাসের উপর লেখালিখির কাজে। এই লিপিটির বয়সও চিত্রলিপির প্রায় সমান। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে হায়রাটিক লিপি থেকে যে তৃতীয় লিপিটির উদ্ভব ঘটে তা বর্তমানে ডেমোটিক নামে পরিচিত। এই লিপিটি এর চিত্রলিপিমূলক পূর্বসূরিটির থেকে এতটাই ভিন্ন যে, চিহ্নগুলির মধ্যে সম্পর্কগুলিকে চিহ্নিত করার কাজটি অত্যন্ত কঠিন ছিল।[Note ১] ডেমোটিক লিপিটি মিশরীয় ভাষা লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা প্রচলিত পদ্ধতিতে পরিণত হয় এবং তার পর থেকে চিত্রলিপি ও হায়রাটিক লিপির ব্যবহার শুধুমাত্র ধর্মীয় ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে মিশরে গ্রিক টলেমীয় রাজবংশের শাসনের সূত্রপাত ঘটে। টলেমীয় শাসনে এবং তারও পরবর্তীকালে রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে মিশরে গ্রিক ও ডেমোটিক উভয় লিপিই পাশাপাশি চলত। চিত্রলিপিগুলি উত্তরোত্তর অচলিত হয়ে পড়ে এবং প্রধানত মিশরীয় পুরোহিতদের দ্বারাই ব্যবহৃত হতে থাকে।[৫]
তিনটি লিপিই ছিল ধ্বনিমূলক চিহ্ন (কথ্য ভাষার শব্দগুলির প্রতিনিধিত্বকারী) এবং ভাবমূলক চিহ্নের (ধারণার প্রতিনিধিত্বকারী) একটি মিশ্রণ। ধ্বনিমূলক চিহ্নগুলির মধ্যে ছিল একাক্ষরী, দ্ব্যক্ষরী ও ত্র্যক্ষরী চিহ্ন, যা যথাক্রমে এক, দুই বা তিনটি ধ্বনির প্রতীক। ধ্বনিমূলক চিহ্নের মধ্যে ছিল সমগ্র শব্দের প্রতিনিধিত্বকারী চিত্রলিপি এবং ধ্বনিমূলক চিহ্নের দ্বারা লিখিত একটি শব্দের অর্থনির্ণায়ক নির্দেশক চিহ্নাবলি।[৬]
অনেক গ্রিক ও রোমান লেখকেরা এই লিপিগুলির কথা লিখেছিলেন। মিশরীয়রা যে দুই বা তিনটি লিখন পদ্ধতি ব্যবহার করেন সে ব্যাপারেও অনেকে অবহিত ছিলেন। কিন্তু সেই সব রচনার মধ্যে যেগুলি পরবর্তীকালে পাওয়া গিয়েছিল সেগুলির কোনওটিতেই এই লিপিগুলি কীভাবে কাজ করত তা সঠিকভাবে বিবৃত হয়নি। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে ডায়োডোরাস সিক্যুলাস মিশরীয় চিত্রলিপিকে স্পষ্টভাবে ভাবমূলক লিপি হিসেবে বর্ণনা করেন। অধিকাংশ ধ্রুপদি গ্রন্থকারই এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত ছিলেন। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে প্লুটার্ক ২৫টি মিশরীয় অক্ষরের কথা উল্লেখ করেন। তিনি সম্ভবত চিত্রলিপি বা ডেমোটিকের ধ্বনিমূলক দিকটির সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। কিন্তু তিনি কী অর্থ করেছিলেন তা স্পষ্ট নয়।[৭] ২০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আলেকজান্দ্রিয়ার ক্লিমেন্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, কোনও কোনও চিহ্ন ধ্বনিমূলক, কিন্তু তা চিহ্নগুলির রূপকার্থ-কেন্দ্রিক। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে প্লন্টিয়াস দাবি করেন যে, চিত্রলিপিগুলি শব্দের প্রতিনিধিত্ব করে না, বরং সেগুলি যেসব বস্তুকে চিত্রিত করে তার প্রকৃতির দৈব-অনুপ্রাণিত মৌলিক অন্তর্দৃষ্টির পরিচায়ক মাত্র।[৮] খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে আম্মিয়ানাস মার্সেলিনাস একটি ওবেলিস্কে খোদিত চিত্রলিপিমূলক লেখটি অন্য এক লেখকের অনুবাদ থেকে প্রতিলিপি করেন। কিন্তু অনুবাদটি এতটাই অপকৃষ্ট ছিল যে তা থেকে লিখন ব্যবস্থার নিয়মাদি সঠিক বোঝা সম্ভব হয়নি।[৯] সে যুগের যে বইগুলিতে চিত্রলিপিগুলি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে তার মধ্যে হায়ারোগ্লিফিকা বইটিই আধুনিক কালে সুলভ। সম্ভবত খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে রচিত এই বইটি হোরাপোলো নামে এক ব্যক্তির রচনা হিসেবে পরিচিত। এই বইতে এক-একটি চিত্রলিপির স্বতন্ত্র অর্থ আলোচনা করা হয়েছে, তবে কীভাবে এই চিহ্নগুলি ব্যবহার করে শব্দবন্ধ বা বাক্য গঠন করা হত তা বলা হয়নি। এই গ্রন্থে প্রদত্ত কয়েকটি অর্থ অর্থ সঠিক, কিন্তু তার চেয়েও বেশি অর্থ ভুল এবং সবই রূপকার্থ হিসেবে ব্যাখ্যাত হয়ে ভুল পথে চালনা করে। উদাহরণস্বরূপ, হোরাপোলো বলেছেন যে, হাঁসের চিত্রটির অর্থ “পুত্র”, কারণ কথিত আছে হাঁসেরা অন্যান্য পশুপাখির চেয়ে অধিকতর সন্তানবৎসল। বাস্তবে হাঁস চিত্রলিপিটি ব্যবহারের কারণ ছিল মিশরীয় ভাষায় “হাঁস” ও “পুত্র” উভয় শব্দেই একই ব্যঞ্জনবর্ণ প্রযুক্ত হত।[১০]
খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দী থেকে চিত্রলিপি ও ডেমোটিক লিপি উভয়েই অন্তর্হিত হতে শুরু করে।[১১] মন্দির-ভিত্তিক পৌরোহিত্য প্রথার অবসান ঘটে এবং মিশর ক্রমে ক্রমে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। মিশরীয় খ্রিস্টানরা গ্রিক-উদ্ভূত কপটিক বর্ণমালা ব্যবহার করত বলে সেই বর্ণমালাই ডেমোটিক লিপিকে প্রতিস্থাপিত করে। ৩৯৪ খ্রিস্টাব্দে শেষ চিত্রলিপিমূলক লেখটির রচয়িতা ছিলেন ফিলের আইসিস মন্দিরের পুরোহিতের এবং সর্বশেষ ডেমোটিক লিপি উৎকীর্ণ হয়েছিল ৪৫২ খ্রিস্টাব্দে।[১২] খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের পূর্ববর্তী ইতিহাসের অধিকাংশ নথিবদ্ধ হয়েছিল মিশরীয় লিপিগুলিতে অথবা মেসোপটেমিয়ার লিখন ব্যবস্থা কিউনিফর্মে। এই লিপিগুলি সম্পর্কিত জ্ঞান অবলুপ্ত হওয়ায় সুদূর অতীতের একমাত্র নথিগুলি সীমাবদ্ধ এবং বিকৃত সূত্রে পরিণত হয়।[১৩] এই জাতীয় সূত্রের প্রধান মিশরীয় উদাহরণটি ছিল ইজিপশিয়াকা। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে মানেথো নামে এক মিশরীয় পুরোহিতের দ্বারা রচিত সেই দেশের ইতিহাস এটি। মূল গ্রন্থটি হারিয়ে গিয়েছে, শুধুমাত্র রোমান লেখকদের দ্বারা কৃত সারসংক্ষেপ ও উদ্ধৃতিগুলির মধ্যে এটির খণ্ডিতাংশ রক্ষিত আছে।[১৪]
মিশরীয় ভাষার সর্বশেষ রূপ কপটিক ভাষা ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে আরবদের মিশর বিজয়ের পূর্বে অধিকাংশ মিশরীয়ের দ্বারা কথিত হত। কিন্তু ক্রমশ তা আরবি ভাষার কাছে জমি হারায়। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী নাগাদ কপটিকের অবলুপ্তির সূচনা ঘটে এবং তারপর থেকে এটি শুধুমাত্র কপটিক চার্চের গণ-প্রার্থনার বিধিসংক্রান্ত ভাষা হিসেবেই টিকে থাকে।[১৫]
আদি প্রয়াস
মধ্যযুগীয় ইসলামি বিশ্ব

ইবন ওয়াশিয়ার চিত্রলিপি অনুবাদ প্রয়াস
আরব পণ্ডিতেরা কপটিক ও প্রাচীন মিশরীয় ভাষার সংযোগের বিষয়টির সম্পর্কে অবহিত ছিলেন এবং ক্ষেত্র বিশেষে মনে করা হয় যে, ইসলামি যুগে কপটিক সন্ন্যাসীরা প্রাচীন লিপি পড়তে পারতেন।[১৬] কথিত আছে, খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত জাবির ইবন হায়ান ও আইয়ুব ইবন মাসলামা সহ বেশ কয়েকজন আরব পণ্ডিতও চিত্রলিপি পড়তে পারতেন।[১৭] যদিও এই বিষয়ে উক্ত পণ্ডিতদের রচনাবলি অবলুপ্ত হওয়ায় এই-সংক্রান্ত দাবিগুলি যাচাই করা যায়নি।[১৮] নবম ও দশম শতাব্দীতে ধুল-নুন আল-মিশরি ও ইবন ওয়াহ্শিয়া চিত্রলিপি সহ যে বহু-সংখ্যক লিপি ইসলামি বিশ্বে পরিচিত ছিল তার উপর গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেন। এই বইগুলিতে চিত্রলিপির অর্থস সারণি আকারে দেওয়া হয়েছিল। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীতে আবু আল-কাশিম আল-ইরাকি প্রাচীন মিশরীয় লেখগুলির অনুলিপি করেন এবং বেশ কয়েকটি চিত্রলিপিতে ধ্বনিসূচক মান আরোপ করেন। মিশরতত্ত্ববিদ ওকাশা এল-ডালি মনে করেন যে, ইবন ওয়াহ্শিয়া ও আবু আল-কাশিমের গ্রন্থাবলিতে প্রদত্ত চিত্রলিপির সারণিতে অনেক চিহ্নের অর্থই সঠিকভাবে দেওয়া হয়েছিল।[১৯] অন্যান্য গবেষকেরা অবশ্য ইবন ওয়াহ্শিয়ার লিপি পাঠোদ্ধারের দাবি সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেন। মধ্যযুগীয় ইসলামি বিশ্ব-বিষয়ক গবেষক তারা স্টিফেন বলেছেন যে, এল-ডালি “ইবন ওয়াহ্শিয়ার যথার্থতার উপর মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করেছেন”।[২০] ইবন ওয়াহ্শিয়া ও আবু আল-কাশিম অবশ্য এমন এক যুগে চিত্রলিপিগুলির ধ্বনিমূলক ও প্রতীকী কার্যকারিতার দিকটি চিহ্নিত করেছিলেন যা ইউরোপে তার বহু শতাব্দী পরেও অজ্ঞাত থেকে গিয়েছিল।[২১][২২]
পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী

আথেনাসিয়াস কার্শারেরওবেলিসকার প্যাপফিলিয়াস (১৬৫০) গ্রন্থের একটি পৃষ্ঠা। এটিতে রোমে স্থিত একটি ওবেলিস্কের গায়ে খোদাই করা চিত্রলিপি ও চিত্রগুলির একটি উদ্ভট অনুবাদ দেওয়া হয়েছে।
রেনেসাঁর যুগে ইউরোপীয়রা চিত্রলিপির বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এই আগ্রহের সূচনা ১৪২২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ, যখন ক্রিস্টোফোরো বুওনদেলমন্টি গ্রিসে হোরাপোলোর হায়ারোগ্লিফিকা-র একটি প্রতিলিপি আবিষ্কার করেন এবং সেটির প্রতি নিকোলো ডে’ নিকোলি ও পোগিও ব্রাসিওলিনির মতো প্রত্নবস্তুবিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। রোমান যুগে ইউরোপে যে সব ওবেলিস্ক ও অন্যান্য মিশরীয় শিল্পসামগ্রী আমদানি করা হয়েছিল সেগুলির গায়ে যে চিত্রলিপিমূলক লেখ খোদিত আছে তা চিহ্নিত করেন পোগিও। কিন্তু প্রত্নবস্তুবিদেরা সেই সময় সেই সব লিপি পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করেননি।[২৩] হোরাপোলো ও প্লন্টিয়াসের অনুপ্রেরণায়[২৪] তাঁরা এই চিত্রলিপিগুলিকে কথ্য ভাষা নথিবদ্ধকরণের পদ্ধতি হিসাবে নয়, বরং নিছকই এক বিশ্বজনীন চিত্র-ভিত্তিক যোগাযোগরক্ষার উপায় হিসেবেই দেখেছিলেন।[২৩] এই বিশ্বাস থেকেই হোরাপোলো বর্ণিত চিত্রকল্পের ছায়া অবলম্বনে অস্পষ্ট প্রতীকবাদ ব্যবহার করে রেনেসাঁ যুগের একটি শিল্প পরম্পরার সৃষ্টি হয়, যার অগ্রদূত ছিল ফ্রান্সেসকো কোলোনার হিপনারোটোমাশিয়া পোলিফিলি (১৪৯৯) গ্রন্থখানি।[২৫]
ইউরোপীয়রা কপটিক সম্পর্কেও অজ্ঞ ছিল। গবেষকদের হাতে মাঝে মাঝে কপটিক পুথিপত্র এসে পৌঁছাতো। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীতে যখন তাঁরা একাগ্রভাবে এই ভাষাটি অধ্যয়ন করতে শুরু করেছিলেন, তখন এই লিপি পাঠোদ্ধারের ক্ষমতা সম্ভবত কপটিক সন্ন্যাসীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই সন্ন্যাসীরা কখনও মিশরের বাইরে যেতেন না বলে কোনও ইউরোপীয়ই সেই যুগে সরাসরি তাঁদের থেকেই এই ভাষা শিক্ষা করার সুযোগ পাননি।[২৬][Note ২] কপটিক প্রাচীন মিশরীয়দের ভাষা থেকে উদ্ভূত কিনা সে বিষয়েও গবেষকেরা নিশ্চিত ছিলেন না; অনেকে আবার এটিকে তার পরিবর্তে প্রাচীন নিকট প্রাচ্যের অন্যান্য ভাষাগুলির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করতেন।[২৯]
সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে জার্মান জেসুইট ও বহুবিদ্যাজ্ঞ আথেনাসিয়াস কার্শারই প্রথম ইউরোপীয় যিনি কপটিক ভাষার অর্থোদ্ধার করেছিলেন।[৩০] পিয়েত্রো দেলা ভেল নামে এক ইতালীয় পর্যটক কর্তৃক মিশর থেকে আহরিত আরবি ভাষায় লেখা কপটিক ব্যাকরণ ও অভিধানের ভিত্তিতে রচিত নিজ গ্রন্থে কার্শার ১৬৩০-এর ও ১৬৪০-এর দশকে কপটিক ভাষার যে অনুবাদ ও ব্যাকরণের বর্ণনা দিয়েছিলেন তা ত্রুটিপূর্ণ হলেও এই কাজে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। তিনি অনুমান করেছিলেন যে কপটিক ভাষাটি প্রাচীন মিশরীয়দের ভাষা থেকে উদ্ভূত এবং এই বিষয়ে তাঁর কাজটি ছিল তাঁর সর্বোচ্চ লক্ষ্য অর্থাৎ চিত্রলিপিমূলক লিপির পাঠোদ্ধারকরণের পূর্বপ্রস্তুতি।[৩১]
দ্য স্ট্যান্ডার্ড বায়োগ্রাফিক্যাল ডিকশনারি অফ ইজিপ্টোলজি-র মতে, “হয়তো অন্যায্যভাবেই কার্শার হয়ে ওঠেন মিশরীয় চিত্রলিপির পাঠোদ্ধারকরণের কাহিনিতে যা কিছু উদ্ভট ও অলীক তার প্রতীক”।[৩২] কার্শার ভেবেছিলেন যে, মিশরীয়রা এক প্রাচীন ধর্মতাত্ত্বিক পরম্পরায় বিশ্বাসী ছিল, যে পরম্পরা ছিল খ্রিস্টধর্মের পূর্ববর্তী এই পরম্পরা তথা খ্রিস্টধর্মের পূর্বলক্ষণ ঘোষণাকারীও। তাঁর আশা ছিল যে চিত্রলিপির মাধ্যমে তিনি সেই পরম্পরাটিকে বুঝতে পারবেন।[৩৩] রেনেসাঁ-যুগের পূর্বসূরি গবেষকদের মতো কার্শারও বিশ্বাস করতেন যে, চিত্রলিপিগুলি কোনও ভাষা নয়, বরং যোগাযোগের এক বিমূর্ত মাধ্যম এবং একটি স্ব-সঙ্গতিপূর্ণ পদ্ধতিতে এই ধরনের যোগাযোগমাধ্যমের অনুবাদ করা অসম্ভব।[৩৪] এই কারণে ওয়েডিপাস এজিপশিয়াকাস (১৬৫২-১৬৫৫) প্রভৃতি চিত্রলিপি-সংক্রান্ত গ্রন্থে কার্শার প্রাচীন মিশরীয় ধর্মবিশ্বাস যেমন বুঝতেন তার ভিত্তিতে অনুমানের মাধ্যমে অগ্রসর হয়েছিল। ধর্মবিশ্বাস-সম্পর্কে এই জ্ঞানও তিনি আহরণ করেছিলেন পঠিত কপটিত গ্রন্থাবলি এবং সেই সকল প্রাচীন গ্রন্থাবলি থেকে যেগুলিকে তিনি মিশরীয় ধর্মবিশ্বাস-সংক্রান্ত তথ্যে সমৃদ্ধ মনে করতেন।[৩৫] কার্শারের অনুবাদে অল্প কিছু চিত্রলিপিমূলক চিহ্ন-সম্বলিত ছোটো ছোটো লেখগুলি পরিণত হয়েছিল গুহ্য ধ্যানধারণা-সংক্রান্ত দীর্ঘ বাক্যে।[৩৬] পূর্ববর্তী ইউরোপীয় গবেষকেরা বুঝতে না পারলেও কার্শার কিন্তু উপলব্ধি করেছিলেন যে চিত্রলিপিগুলির ধ্বনিমূলক সত্ত্বাও থাকতে পারে।[৩৭] যদিও এই কার্যকারিতাকে তিনি পরবর্তীকালের বিবর্তন বলেই ধরে নিয়েছিলেন।[৩৬] এছাড়া তিনি একটি চিত্রলিপিকে (𓈗) ‘জল’ শব্দের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং এইভাবে জলের কপটিক প্রতিশব্দ mu এবং সেই সঙ্গে “ম” ধ্বনির ধ্বনিব্যঞ্জনাটি ধরে ফেলেন। তিনিই ছিলেন প্রথম ইউরোপীয় যিনি প্রথম সঠিকভাবে একটি চিত্রলিপির ধ্বনিব্যঞ্জনা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।[৩৮]
কার্শারের মূল অনুমানগুলির সম্পর্কে সমসাময়িককালের গবেষকেরা একমত হলেও অধিকাংশ গবেষকই কার্শের অনুবাদগুলি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, এমনকি উপহাসও করেছিলেন।[৩৯] তা সত্ত্বেও, কপটিক ভাষাটি যে প্রাচীন মিশরীয় ভাষা থেকে উদ্ভূত – কার্শারের এই তত্ত্বটি বহুলভাবে স্বীকৃত হয়।[৪০]
অষ্টাদশ শতাব্দী

অ্যানে ক্লড ডে কেলাসেররিকুয়েইল ডি’অ্যান্টিকুইটেস ইজিপ্টিয়েনেস (১৭৫২) গ্রন্থের একটি পৃষ্ঠা। এই গ্রন্থে চিত্রলিপিগুলিকে অন্যান্য মিশরীয় লিপির অনুরূপ চিহ্নগুলির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
চিত্রলিপি-পাঠোদ্ধার বিষয়ে কার্শারের শেষ গ্রন্থটি প্রকাশের পর কয়েক দশক কেউ এই কাজে হাত দেননি বললেই চলে। যদিও এই সময়ের মধ্যে কোনও কোনও গবেষক এই লিপি সম্পর্কে এমন কিছু তত্ত্ব উপস্থাপনা করেন, যা সঠিক বলে প্রমাণিত হয়।[৪০] উইলিয়াম ওয়ারবার্টন রচিত ধর্ম-বিষয়ক আলোচনা-গ্রন্থ দ্য ডিভাইন লিগেশন অফ মোজেস-এ (প্রকাশকাল: ১৭৩৮-১৭৪১) চিত্রলিপি ও লিখন পদ্ধতির বিবর্তন বিষয়ে একটি দীর্ঘ আলোচনা পাওয়া যায়। এই আলোচনায় বলা হয়েছিল যে, ধর্মীয় গুহ্যতত্ত্ব সংকেতে আবদ্ধ করার জন্য চিত্রলিপিগুলি উদ্ভূত হয়নি, বরং অন্যান্য লিখন পদ্ধতির মতো এগুলিরও ব্যবহারিক উদ্দেশ্য ছিল। তিনি আরও বলেন যে, আলেকজান্দ্রিয়ার ক্লিমেন্ট কর্তৃক উল্লিখিত ধ্বনিমূলক মিশরীয় লিপি তা থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল।[৪১] ওয়ারবার্টনের দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি ধর্মতত্ত্বমূলক হলেও[৪২] তা চিত্রলিপিগুলিকে উপলব্ধি করার যে নির্মাণকাঠামো দান করে তা এই শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত গবেষকদের মধ্যে প্রাধান্য বজায় রেখেছিল।[৪৩]
অষ্টাদশ শতাব্দীতে মিশরের সঙ্গে ইউরোপীয়দের যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। অধিকতর সংখ্যায় ইউরোপীয়েরা এই সময় মিশরে যান এবং প্রাচীন শিলালিপিগুলিকে চাক্ষুষ করেন।[৪৪] এই ইউরোপীয়েরা প্রত্নসামগ্রী সংগ্রহ করতে শুরু করে অধ্যয়নের জন্য লেখও অধিকতর সংখ্যায় পাওয়া সম্ভব হয়।[৪৫] জ্যঁ-পিয়ের রিগর ছিলেন প্রথম ইউরোপীয় যিনি ১৭০৪ সালে একটি অ-চিত্রলিপিমূলক প্রাচীন মিশরীয় লেখ চিহ্নিত করেন। ১৭২৪ সালে বার্নার্ড ডে মন্টফুকোঁ এই ধরনের লেখের একটি বিরাট সংকলন প্রকাশ করেন।[৪৬] ১৭৫২ থেকে ১৭৬৭ সালের মধ্যে প্রচুর সংখ্যায় মিশরীয় শিলালিপি জ্যঁ-জ্যাক বার্থেলেমির সহায়তায় অ্যানে ক্লড ডে কেলাস কর্তৃক সংগৃহীত ও প্রকাশিত হয়। এই রচনাগুলি দৃষ্টে অনুমিত হয় যে অ-চিত্রলিপিমূলক মিশরীয় লিপিগুলি চিত্রলিপি থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল। বার্থেলেমি আরও দেখিয়েছিলেন যে, ডিম্বাকার বলয়গুলি (যেগুলি পরে কার্তুশ নামে পরিচিত হয়) অনেক চিত্রলিপিমূলক লেখেই চিহ্নের ছোটো ছোটো গুচ্ছকে সংগ্রথিত করেছিল এবং ১৭৬২ সালে তিনি এই তত্ত্ব প্রস্তাব করেন যে কার্তুশগুলিতে রাজাদের বা দেবতাদের নাম পাওয়া যায়। ১৭৬০-এর দশকে মিশর ভ্রমণকারী কার্স্টেন নেইবার পৃথক পৃথক চিত্রলিপিমূলক চিহ্নের একটি তালিকা প্রস্তুত করেন। কাজটি অসম্পূর্ণ হলেও এটিই ছিল প্রথম নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে এই ধরনের তালিকা প্রস্তুতের কাজ। তিনি চিত্রলিপিমূলক লেখ ও সেগুলির সঙ্গে চিত্রিত অলংকরণগুলির পার্থক্যও প্রতিপাদন করেন। পূর্ববর্তী গবেষকেরা এই দুইয়ের ব্যাপারে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন।[৪৭] জোসেফ ডে গাইগনেস সহ সে যুগের বেশ কয়েকজন গবেষক প্রাচীন মিশরের সঙ্গে চীনের এক ঐতিহাসিক যোগাযোগের কথা অনুমান করেন। এই গবেষকেরা মনে করতেন যে, চীনা লিখন পদ্ধতি আসলে মিশরীয় চিত্রলিপি থেকেই উদ্ভূত। ১৭৮৫ সালে গাইগনেস কার্তুশের ব্যাপারে বার্থেলেমির প্রস্তাবনাটি পুনরুল্লেখ করে সেটিকে সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্যকে পার্শ্ববর্তী রচনা থেকে পৃথকভাবে লেখার একটি চীনা প্রথার সঙ্গে তুলনা করেন।[৪৮]
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে কপটিক ভাষা-বিষয়ে সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ গবেষক জর্জ জোয়েগা প্রাচীন মিশর বিষয়ে জ্ঞানের সংক্ষিপ্তসার De origine et usu obeliscorum (১৭৯৭) গ্রন্থে চিত্রলিপি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি চিত্রলিপিমূলক চিহ্নগুলির তালিকা প্রস্তুত করেন এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে একটি একক শব্দের জন্য খুব অল্পসংখ্যক পৃথক চিহ্নই ব্যবহার করা হত এবং তার ফলে একটি পূর্ণাঙ্গ শব্দভাণ্ডার তৈরি করতে নিশ্চয়ই সেই চিহ্নগুলির উপর একাধিক অর্থ অথবা সেগুলিকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করে ভিন্ন অর্থ আরোপ করা হত। তিনি লক্ষ্য করেন যে চিহ্নগুলির অভিমুখ যে দিকে সেই অভিমুখেই বাক্যগুলিকে পড়তে হয় এবং তিনি বলেন যে কয়েকটি চিহ্ন ধ্বনিমূলক। জোয়েগা লিপিগুলি পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করেননি। তিনি মনে করতেন যে, সেটা করতে হলে যে পরিমাণ প্রমাণের প্রয়োজন হবে তা তৎকালীন ইউরোপে প্রাপ্তব্য নয়।[৪৯]
চিহ্ন শনাক্তকরণ
রোসেটা প্রস্তরফলক

তিনটি ভুক্তির প্রতিটি অক্ষত অবস্থায় রোসেটা প্রস্তরফলকের পুনর্নির্মাণ। ফলকটি সম্ভবত মূলে এই রকম দেখতে ছিল।
মূল নিবন্ধ: রোসেটা প্রস্তরফলক
১৭৯৮ সালে যখন নেপোলিয়ন বোনাপার্টের অধীনে ফরাসি বাহিনী মিশর অভিযান চালায়, তখন সেই দেশ ও তার প্রাচীন স্মারকগুলি নিয়ে গবেষণার জন্য বোনাপার্ট সঙ্গে বিজ্ঞানী ও গবেষকদের একটি দল নিয়ে যান। এই বিশেষজ্ঞদের স্যাভেন্ট বলা হত।[৫০] ১৭৯৯ সালের জুলাই মাসে রোসেটা শহরের কাছে ফরাসি বাহিনী কর্তৃক একটি মামলুক দুর্গ (ফরাসি নামকরণে ফোর্ট জুলিয়েন) পুনর্নির্মাণের সময় লেফট্যানেন্ট পিয়ের-ফ্রাঁসোয়া বোকার্ড লক্ষ্য করেন যে দুর্গের ধ্বংসকৃত দেওয়ালের মধ্যে একটি পাথরের গায়ে কিছু লিপি উৎকীর্ণ রয়েছে। এই পাথরটি ছিল একটি প্রাচীন মিশরীয় লিপিফলক। উৎকীর্ণ লেখটি তিনটি ভুক্তিতে বিভক্ত। ফলকটির নিচের ডানদিকের কোণ এবং উপরের ভুক্তির বেশিরভাগ অংশই ভাঙা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। উৎকীর্ণ লেখটি লেখা হয়েছিল তিনটি লিপিতে: উপরের ভুক্তিতে মিশরীয় চিত্রলিপি, নিচের ভুক্তিটিতে গ্রিক অক্ষরে এবং মধ্যের ভুক্তিটি একটি অশনাক্তকৃত লিপিতে।[৫১][৫২] লেখটি ছিল খ্রিস্টপূর্ব ১৯৭ অব্দে পঞ্চম টলেমির জারি করা একটি অধ্যাদেশ; এই অধ্যাদেশ বলে তিনি মিশরের পুরোহিতদের অনুগ্রহ দেখিয়েছিলেন। লিপির অন্তে বলা হয়েছে যে “পবিত্র, স্থানীয় ও গ্রিক অক্ষরে” এই অধ্যাদেশের প্রতিলিপি করে মিশরের প্রধান মন্দিরগুলিতে স্থাপন করতে হবে।[৫৩] গ্রিক অভিলিখনে এই পংক্তিটি পড়ে ফরাসিরা উপলব্ধি ক্রএছিলেন যে প্রস্তরফলকটি একটি সমান্তরাল লেখ, যার উপর খোদিত গ্রিক অনুবাদটির মাধ্যমে মিশরীয় লিপিটির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হতে পারে।[৫৪] স্যাভেন্টরা সাগ্রহে প্রস্তরফলকটি অন্য খণ্ডাংশগুলির এবং সেই সঙ্গে গ্রিক ও মিশরীয় ভাষায় খোদিত অন্যান্য লেখেরও অনুসধান করেন। কিন্তু ফলকটির অন্য কোনও টুকরো পাওয়া যায়নি। তাছাড়া স্যাভেন্টরা অন্য যে দ্বিভাষিক লেখগুলি আবিষ্কার করেছিলেন সেগুলিও বেশিরভাগই ছিল অপাঠযোগ্য। সেই কারণে সেগুলির পাঠোদ্ধার করাও সম্ভব হয়নি।[৫২][৫৫] তবে স্যাভেন্টরা রোসেটা প্রস্তরফলকটি নিয়ে কাজ করে কিছুটা অগ্রসর হতে পেরেছিলেন। জ্যঁ-জোসেফ মার্সেল বলেছিলেন যে, মধ্যবর্তী লিপিটি ছিল “প্রাচীন মিশরীয় ভাষার হস্তলিপিমূলক অক্ষর” এবং তিনি প্যাপিরাসের লেখ্যপড়ে অন্য যে অক্ষর দেখেছিলেন তার অনুরূপ। তিনি এবং লুই রেমি রেইজ এই ভুক্তির লিপিটির সঙ্গে গ্রিক লিপিটির তুলনা করতে শুরু করেন এবং এই যুক্তিতে উপনীত হন যে চিত্রলিপিমূলক পাঠটির অধিকাংশই হারিয়ে গিয়েছে বলে মধ্যবর্তী ভুক্তিটির পাঠোদ্ধারের কাজেই এই তুলনা অধিকতর ফলপ্রসূ হবে। স্যাভেন্টরা মধ্যবর্তী ভুক্তিতে সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্যগুলির অবস্থান অনুমান করেন গ্রিক পাঠে সেই নামগুলির অবস্থানের ভিত্তিতে এবং Ptolemy নামের ‘p’ ও ‘t’ অক্ষর দু’টিকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু তার বেশি অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি।[৫৬]
১৮০০ সালে ফলকের লেখটির প্রথম প্রতিলিপিগুলি ফ্রান্সে প্রেরণ করা হয়। ১৮০১ সালে ওটোমান ও ব্রিটিশ বাহিনী মিশরে ফরাসি বাহিনীকে অবরুদ্ধ করে এবং ফরাসি বাহিনীও আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের শর্ত হিসেবে রোসেটা প্রস্তরফলক ব্রিটিশদের হস্তগত হয়। ফলকটি ব্রিটেনে এসে পৌঁছানোর পরে সোসাইটি অফ অ্যান্টিক্যুয়ারিজ অফ লন্ডন লেখটির প্রতিলিপি করে তা সারা ইউরোপের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করে।[৫৭]
নেপোলিয়নের অভিযানের প্রতিবেদনগুলি ইউরোপে প্রাচীন মিশর-সম্পর্কে এক বাতিকের সৃষ্টি করে। ফরাসি ও ব্রিটিশ বাহিনী যখন মিশর ত্যাগ করে তখন মিশরের পরিস্থিতি বিশৃঙ্খল ছিল। কিন্তু ১৮০৫ সালে মুহাম্মদ আলি সেই দেশের শাসনভার গ্রহণ করলে ইউরোপীয় সংগ্রাহকেরা মিশরে আসেন এবং অসংখ্য প্রত্নসামগ্রী সে দেশ থেকে নিয়ে যান। শিল্পীরাও অনেক লেখের প্রতিলিপি অঙ্কন করেন।[৫৮] এই শিল্পসামগ্রীগুলির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট কেউই জানতেন না,[৫৯] কিন্তু সেগুলি থেকে প্রচুর পরিমাণে লিখিত উপাদান পাওয়া যায়, যেগুলি লিখন পদ্ধতি পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করতে গিয়ে গবেষকেরা তুলনা করে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন।[৬০]
ডে সাসি, অকারবল্ড ও ইয়ং
বিশিষ্ট ফরাসি ভাষাবিজ্ঞানী আঁতোয়া-ইসাক সিভেস্ত্রে ডে সাসি ১৭৮৭ সালে পারস্যের পাহলভি লিপির পাঠোদ্ধার করেছিলেন। প্রস্তরফলকটি নিয়ে প্রথম কাজ করা ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যে ইনি অন্যতম। মার্সেল ও রেইগের মতো তিনিও গ্রিক পাঠটির সঙ্গে মধ্যবর্তী ভুক্তির ডেমোটিক পাঠের সম্পর্কের উপরে মনোযোগ নিবদ্ধ করেন। প্লুটার্কের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তিনি অনুমান করেন যে, এই লিপিতে ২৫টি ধ্বনিসূচক চিহ্ন রয়েছে।[৬১] ডে সাসি ডেমোটিক পাঠটির মধ্যে গ্রিক নামবাচক পদগুলি চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু টলেমি, আলেকজান্ডার ও আর্সিনোয়ের নামগুলি ছাড়া বিশেষ অগ্রসর হতে পারেননি। তিনি উপলব্ধি করেন যে ডেমোটিকে ২৫টির বেশি চিহ্ন রয়েছে এবং ডেমোটিক লেখটি সম্ভবত গ্রিক লেখটির আক্ষরিক অনুবাদ নয়। এই কারণেই কাজটি আরও কঠিন হয়ে ওঠে। ১৮০২ সালে নিজের গবেষণার ফলাফল প্রকাশের পর তিনি প্রস্তরফলকটি নিয়ে কাজ করা বন্ধ করে দেন।[৬২]
সেই বছর ডে স্যাসি প্রস্তরফলকটিতে উৎকীর্ণ লিপির একটি প্রতিলিপি দিয়েছিলেন নিজের প্রাক্তন ছাত্র জোহান ডেভিড অকারবল্ডকে। অকারবল্ড ছিলেন এক সুইডিশ কূটনীতিবিদ ও শখের ভাষাবিজ্ঞানী। অকারবল্ড কিন্তু প্রভূত সাফল্য অর্জন করেন। ডে সাসি যে চিহ্ন-গুচ্ছ নিয়ে কাজ করেছিলেন সেগুলি নিয়ে কাজ করে অকারবল্ড অধিকতর সংখ্যায় চিহ্ন সঠিকভাবে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।[৬২] ডে সাসিকে লেখা একটা চিঠিতে অকারবল্ড ২৯টি ডেমোটিক বর্ণের একটি বর্ণমালা প্রস্তাব করেন (যার অর্ধেকই পরে সঠিক বলে প্রমাণিত হয়) এবং নিজের কপটিক ভাষা-জ্ঞানের ভিত্তিতে তিনি উৎকীর্ণ লিপির পাঠের মধ্যে বেশ কয়েকটি ডেমোটিক শব্দও শনাক্ত করেন।[৬৩] ডে সাসি অকারবল্ডের ফলাফল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। অকারবল্ড নিজেও হাল ছেড়ে দেন।[৬২] অন্যান্য গবেষকদের চেষ্টা সত্ত্বেও পরবর্তী এক দশকেরও বেশি সময়ে এই নিয়ে কাজ বিশেষ এগোয়নি। তারপরই থমাস ইয়ং এই ক্ষেত্রে প্রবেশ করেন।[৬৪]

থমাস ইয়ং, ১৮২২
ব্রিটিশ বহুবিদ্যাজ্ঞ ইয়ং পদার্থবিজ্ঞান, ঔষধিবিজ্ঞান ও ভাষাবিজ্ঞান সহ বিভিন্ন বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। মিশরের দিকে মনোনিবেশ করার আগেই তিনি সমকালীন সমাজে একজন অগ্রণী বুদ্ধিজীবী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।[৬৪] ১৮১৪ সালে তিনি রোসেটা প্রস্তরফলক নিয়ে ডে সাসির সঙ্গে পত্রালাপ শুরু করেন। কয়েক মাস পরে তিনি উক্ত প্রস্তরফলকে মিশরীয় চিত্রলিপি ও ডেমোটিক লিপির অনুবাদ নামে একটি রচনা প্রকাশ করেন। প্রকৃতপক্ষে এই লেখাটি ছিল কোথায় কোথায় মিশরীয় পাঠটির সঙ্গে গ্রিক পাঠের সাদৃশ্য ঘনিষ্ঠ সেই জায়গাগুলিকে খুঁজে বেরার জন্য লেখটির চিহ্নগুলিকে চিহ্নগুচ্ছে বিন্যাসের একটি প্রয়াস মাত্র। এই প্রয়াসটির উপযোগিতা ছিল সীমায়িত, কারণ রোসেটা প্রস্তরফলকের তিনটি লিপি ঠিক পরস্পরের হুবহু অনুবাদ ছিল না।[৬৫][৬৬] ইয়ং অন্যান্য মিশরীয় লিপিগুলি অনুলিপিকরণে বেশ কয়েক মাস সময় অতিবাহিত করেন। এর ফলে তিনি চিহ্নগুলির মধ্যে এমন কিছু ধাঁচ লক্ষ্য করেন যা অন্যান্য গবেষকদের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল।[৬৭] জোয়েগার মতো তিনিও শনাক্ত করেন যে, একটি শব্দের এককভাবে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য খুব কম চিত্রলিপিই ছিল এবং তিনি বলেন যে শব্দগুলি দু’টি বা তিনটি চিত্রলিপি দ্বারা গঠিত হত।[৬৬]
ইয়ং চিত্রলিপি ও ডেমোটিক চিহ্নগুলির মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষ্য করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে চিত্রলিপিমূলক চিহ্নগুলিই বিবর্তিত হয়ে ডেমোডিক চিহ্নে পরিণত হয়েছে। তিনি যুক্তি দেন যে, তাই যদি হয় তবে ডেমোটিক বিশুদ্ধভাবে ধ্বনিমূলক লিপি হতে পারে না, চিত্রলিপির থেকে উদ্ভূত কিছু ভাবমূলক চিহ্নও তাতে থাকা সম্ভব। ১৮১৫ সালে নিজের এই চিন্তাভাবনার কথা তিনি ডে সাসিকে লিখে জানান।[৬৬][Note ৩] তিনি চিত্রলিপিমূলক হরফে ধ্বনিমূলক চিহ্ন খুঁজে পাওয়ার আশা রাখলেও, যে বহু বৈচিত্র্যময় ধ্বনিমূলক বানান ও লিপি ব্যবহৃত হয়েছিল তার দ্বারা কাজ ব্যাহত হয়েছিল। তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে একটি প্রধান ব্যতিক্রম ছাড়া ধ্বনিমূলক চিত্রলিপির অস্তিত্ব ছিল না।[৬৯] ১৮০২ সালে প্রকাশিত একটি লেখায় ডে সাসি বলেন যে, বিদেশি শব্দ লিপিবদ্ধ করার সময় চিত্রলিপিগুলি ধ্বনিমূলক দিকটি বজায় রাখলেও রাখতে পারে।[৬৩] চীনা লিখন পদ্ধতিতে একটি অনুরূপ প্রথার কথা জানার পর[৭০] ১৮১১ সালে তিনি বলেন যে, একটি কার্টুশে একটি শব্দটি ধ্বনিমূলক দিক থেকে লেখা হত—যেমন হয়েছে টলেমির মতো অ-মিশরীয় শাসকের নামের ক্ষেত্রে।[৭১] এই ধারণাগুলি ইয়ং রোসেটা প্রস্তরফলকের কার্টুশগুলির উপর প্রয়োগ করেন। কয়েকটি কার্টুশ ছিল ছোটো, আটটি চিহ্ন-বিশিষ্ট; অন্যদিকে কয়েকটি কার্টুশে একই চিহ্ন ব্যবহারের পর আরও অনেকগুলি চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছিল। ইয়ং অনুমান করেন যে, দীর্ঘ কার্টুশগুলিতে গ্রিক লিপিকে টলেমিকে প্রদত্ত উপাধিটির মিশরীয় রূপটি লেখা আছে: “চিরজীবী, [দেবতা] প্টাহ্-এর প্রিয়”। সেই কারণে প্রথম আটটি চিহ্ন টলেমির নামের গ্রিক রূপ Ptolemaios-এর অনুরূপ মনে করে তিনি সেগুলির উপরেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। অকারবল্ড প্রস্তাবিত কয়েকটি ধ্বনিমূলক মান গ্রহণ করে ইয়ং আটটি চিত্রলিপিমূলক চিহ্নকে সেগুলির ডেমোটিক প্রতিরূপের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন এবং বলেন যে, কয়েকটি চিহ্ন একাধিক ধ্বনিমূলক মান বহন করে, আবার কয়েকটি মাত্র একটি মানই বহন করে।[৭২] তারপর তিনি সেই ফলাফলগুলি টলেমির রানি বেরেনিসের একটি কার্টুশে প্রয়োগ করেন, কিন্তু বিশেষ সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হন। যদিও তিনি এমন এক জোড়া চিত্রলিপিমূলক চিহ্ন শনাক্ত করতে পেরেছিলেন যেগুলি একটি স্ত্রীলিঙ্গবাচক নামের শেষাংশকে নির্দেশ করে।[৭৩] এই গবেষণার ফলে চিত্রলিপি ও ডেমোটিক চিহ্নগুলির তেরোটি ধ্বনিসূচক মানের একটি গুচ্ছ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ছয়টি সঠিক, তিনটি অংশত সঠিক ও চারটি ভুল প্রমাণিত হয়েছিল।[৭২]
![]() ![]() ![]() ![]() ![]() ![]() ![]() ![]() ![]() ![]() | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
চিত্রলিপি | ![]() | ![]() | ![]() | ![]() | ![]() | ![]() ![]() | ![]() |
ইয়ং-এর পাঠ | P | T | অপ্রয়োজনীয় | LO বা OLE | MA বা M | I | OSH বা OS |
“ইজিপ্ট” প্রবন্ধে ইয়ং নিজের কাজের সারসংক্ষেপ প্রদান করেছিলেন। ১৮১৯ সালে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা-র একটি সম্পূরণী হিসেবে লেখক নাম ছাড়াই নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল। এই নিবন্ধে ২১৮টি ডেমোটিক ও ২০০টি চিত্রলিপিমূলক শব্দের অনূমানমূলক অনুবাদ দেওয়া হয়েছিল এবং সংশ্লিষ্ট ডেমোটিক চিহ্নের সঙ্গে প্রায় ৮০টি চিত্রলিপিমূলক চিহ্নের সম্পর্ক সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল।[৭৪] ১৯২২ সালে মিশরতত্ত্ববিদ ইয়ং-এর কাজের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বলেন যে, ইয়ং-এর ফলাফলের মধ্যে “অনেক ভুল অনুবাদ মিশে গিয়েছিল, কিন্তু যে পদ্ধতি তিনি অবলম্বন করে তা অব্যর্থভাবে ইতিবাচক পাঠোদ্ধারকরণের দিকে চালিত করে।” [৭৫] যদিও ইয়ং প্রাচীন মিশরীয় লেখগুলির বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না। লিখন পদ্ধতিটিকে তিনি একধরনের বৌদ্ধিক ধাঁধা হিসেবে গ্রহণ করে সেই বিষয়েই আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ইয়ং-এর আগ্রহ থাকায় তিনি পাঠোদ্ধারকরণের কাজে ঠিকঠাক মনোনিবেশ করতে পারতেন না। পরবর্তী কয়েক বছরে তিনি এই বিষয়ে অল্পই অগ্রসর হতে পেরেছিলেন।[৭৬]
পাদটীকা
মিশরীয় লিপির পাঠোদ্ধারকারী গবেষকদের মধ্যে এই লিপিটিকে কী বলা যায় তা নিয়ে মতভেদ ছিল। রোসেটা প্রস্তরফলকের গ্রিক পাঠে এই লিপিটিকে নির্দেশকারী শব্দবন্ধটির ভিত্তিতে থমাস ইয়ং “enchorial” শব্দটি ব্যবহার করেন: ενχωριοις, অর্থাৎ “দেশের”, “স্বদেশীয়”,[১] বা “স্থানীয়”।[২] জঁ-ফ্রঁসোয়া শঁপোলয়োঁ ব্যবহার করেন এই লিপির হেরোডোটাস-কর্তৃক ব্যবহৃত নামটি: δημοτική বা “demotic”;[৩] এটি একটি গ্রিক শব্দ, যার অর্থ “সাধারণভাবে প্রচলিত”।[৪] শঁপোলয়োঁর ব্যবহৃত পরিভাষাটি কালক্রমে রীতিসম্মত নামে পরিণত হয়।[৪] চতুর্দশ শতাব্দীর পরে নতুন গ্রন্থ রচনার কাজে আর লিখিত কপটিক ব্যবহার করা হয়নি, তবে সন্ন্যাসীদের দ্বারা কপটিক গ্রন্থের প্রতিলিপিকরণের কাজ ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।[২৭] চার্চের আচার-অনুষ্ঠানের বাইরে কপটিকের ব্যবহার সম্ভবত দ্বাদশ শতাব্দীতেও কোনও কোনও উচ্চ মিশরীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে অব্যাহত ছিল।[২৮] ইয়ং ও অন্যান্য গবেষকেরা হায়রাটিক লিপিকে চিত্রলিপি ও ডেমোটিকের মধ্যবর্তী স্তর হিসেবে শনাক্ত করেছিলেন। কিন্তু হায়রাটিকের সঠিক প্রকৃতিটি কী এবং তাকে ডেমোটিকের থেকে পৃথক একটি লিপি হিসেবে গণ্য করা উচিত কিনা তা যে যুগে ইয়ং ও শঁপোলয়োঁ কাজ করছিলেন সে যুগে আগাগোড়াই বিতর্কিত ছিল।[৬৮]