প্রিন্স ক্যাস্পিয়ান

প্রিন্স ক্যাস্পিয়ান (মূলত প্রিন্স ক্যাস্পিয়ান: দ্য রিটার্ন টু নার্নিয়া নামে প্রকাশিত হয়) ১৯৫১ সালে জিওফ্রি ব্লেস প্রকাশিত শিশুদের জন্য লেখা সি. এস. লিউইসে একটি কল্প-উপন্যাস। এটি দ্য ক্রনিকলস্ অব নার্নিয়া (১৯৫০-১৯৫৬) ধারার সাতটি উপন্যাসের দ্বিতীয় বই। লিউইস বইটি ১৯৪৯ সালে লেখা সম্পন্ন করেন।[৪] অন্যসবগুলোর মত এই বইটিরও অলঙ্করণ করেছেন পউলিন বেইনিস[১][৩]

প্রিন্স ক্যাস্পিয়ান পেভেনসি ভাইবোনদের নার্নিয়ায় পুনরায় প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে রচিত। প্রথম যাত্রার এক বছর পর কিন্তু নার্নিয়ার তেরোশ বছর পর তারা তাদের দ্বিতীয় এই ভ্রমণ করে। দ্য ক্রনিকলস্ অব নার্নিয়া ধারার এটিই একমাত্র বই যেখানে নার্নিয়ায় বসবাসকারীদের মধ্যে মানুষের আধিক্য দেখা যায় এবং কথা বলা জন্তু ও পৌরাণিক প্রাণীরা তাদের দ্বারা নির্যাতিত হয়। পেভেনসিরা নার্নিয়ার কিংবদন্তি শাসক এবং তাদেরকে রাজকুমার ক্যাস্পিয়ান জাদুবলে পুনরায় আহ্বান জানায় এবং তারা পুর্বের শিশুরুপে আগমন করে।

কাহিনী-সংক্ষেপ

একটি ব্রিটিশ রেলওয়ে স্টেশনে দাড়িয়ে থাকার সময় পিটার, সুজান, এডমন্ড এবং লুসি পেভেনসি জাদুবলে এক ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদের নিকট সমুদ্র তীরে এসে পৌঁছায়। তারা বুঝতে পারে এটিই কেইর প্যারাভেল, যেখানে তারা নার্নিয়ার রাজা ও রানি হিসেবে শাসন করেছিল, এবং তারা একটি ধনভান্ডার খুজে পায় যেখানে পিটারের ঢাল ও তলোয়ার, সুজানের তীর-ধনুক, আর লুসির জাদুর নিরাময়ী রাখা ছিল। কিন্তু নার্নিয়া থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার সময় জঙ্গলে রেখে যাওয়ায় সেখানে সুজানের শিঙ্গা ছিলনা। যদিও ইংল্যান্ডে একবছর সময়কাল অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু নার্নিয়ায় ১৩০০ বছর পার হয়ে গিয়েছে।[ক]

সমুদ্র তীরে পেভেনসিরা বামুণ ট্রাম্পকিনকে কয়েকজন সৈনিকের হাত থেকে রক্ষা করে, যারা তাকে ডুবিয়ে মারার উদ্দ্যেশ্যে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। ট্রাম্পকিন পেভেনসিদের তাদের চলে যাওয়ার পর থেকে নার্নিয়ার ইতিহাস বলে: টেলমেরিনরা নার্নিয়া দখল করে নিয়েছে, এখন নার্নিয়া শাসন করছে রাজা মিরাজ এবং তার স্ত্রী রাণী প্রুনাপ্রিসমিয়া, কিন্তু ন্যায়সঙ্গত রাজা হলো মিরাজের ভাতিজা রাজকুমার ক্যাস্পিয়ান, যে প্রাচীন নার্নিয়ানদের সমর্থন অর্জন করেছে।

মিরাজ তার ভাই এবং ক্যাস্পিয়ানের বাবা রাজা দশম ক্যাস্পিয়ানকে হত্যা করে সিংহাসন নিজের করায়ত্তে আনে। মিরাজ তার নিজের সন্তানের জন্ম হওয়া পর্যন্ত ক্যাস্পিয়ানকে উত্তরাধিকারি হিসাবে সহ্য করে। তার চাচার কৃতকর্ম জানার পর ক্যাস্পিয়ান তার গৃহশিক্ষক ডক্টর কর্নেলিয়াসের সহায়তায় মিরাজের প্রাসাদ থেকে পালিয়ে যায়। কর্নেলিয়াস ক্যাস্পিয়ানকে প্রাচীন নার্নিয়ানদের সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছিল এবং সে তাকে রাণী সুজানের শিঙ্গা দেয়। ক্যাস্পিয়ান জঙ্গলে পালিয়ে যাওয়ার সময় ঘোড়া থেকে পড়ে অচেতন হয়ে যায়। সে জ্ঞান ফিরে পায় এক কথা বলা ব্যাজার ও দুই বামুণ নিকাব্রিক ও ট্রাম্পকিনের কুঠরিতে, যারা ক্যাস্পিয়ানকে তাদের রাজা হিসেবে গ্রহণ করে।

ব্যাজার ও বামুণেরা ক্যাস্পিয়ানকে অন্য প্রাচীণ নার্নিয়ানদের সাথে দেখা করাতে নিয়ে যায়। ডান্সিং লনে মধ্যরাতের এক পরামর্শ সভায় ডক্টর কর্নেলিয়াস এসে তাদের মিরাজ ও তার সৈন্যবাহীনির অগ্রসর হওয়ার বিষয়ে সাবধান করে দেয়। সে তাদের বলে কেইর প্যারাভালের নিকট মহাজঙ্গলের মধ্যে স্টোন টেবিলে পালিয়ে যেতে বলে। টেলমেরিনরা নার্নিয়ানদের স্টোন টেবিল পর্যন্ত ধাওয়া করে এবং কিছু বিচ্ছিন্ন লড়াইয়ের পর নার্নিয়ানরা প্রায় পরাজয়ের কাছাকাছি অবস্থায় চলে আসে। দ্বিতীয় যুদ্ধকালীন পরামর্শ সভায়, তারা রাণী সুজানের শিঙ্গা বাজানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এই আশায় যে, আসলান অথবা নার্নিয়ার স্বর্ণযুগের কিংবদন্তি রাজা রাণীদের কাছ থেকে সাহায্য আসবে।

ট্রাম্পকিন আর পেভেনসিরা ক্যাস্পিয়ানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। তাদের যাত্রাপথ ছিল কঠিন, কিন্তু আসলান লুসির সামনে আসে এবং তাকে নির্দেশ দেয় অন্যদের নিয়ে তার পেছনে আসতে। আসলান পিটার, এডমন্ড এবং ট্রাম্পকিনকে বিশ্বাঘাতকতা দমন করতে স্টোন টেবিলে পাঠায় এবং তার সাথে সুজান ও লুসিকে নিয়ে যায়।

পিটার, এডমন্ড, এবং ট্রাম্পকিন সেখানে পৌঁছে ক্যাস্পিয়ানকে হুমকির মুখে ফেলা জন্তুদের হত্যা করার পর পিটার মিরাজকে একক লড়াইয়ে আহ্বান জানায়। এই দন্দ যুদ্ধে বিজেতার সেনারা যুদ্ধে বিজয়ী বলে বিবেচিত হবে। মিরাজ লর্ড গ্লজেল্লি ও লর্ড সোপেসফিয়ানের প্ররোচনায় এই প্রস্তাবে রাজী হয়। লড়াইয়ে মিরাজ পরাজিত হয়, কিন্তু গ্লজেল্লি আর সোপেসফিয়ান ঘোষণা করে যে, নার্নিয়ানরা প্রতারণা করেছে এবং তাদের রাজা পড়ে যাওয়ার পর তার পিঠে ছুরি চালিয়েছে। তারা টেলমেরিন সৈন্যদের নার্নিয়ানদের আক্রমণের আদেশ দেয় এবং এই গোলমালের ভেতর গ্লজেল্লি মাটিতে পড়ে থাকা মিরাজের পিঠে ছুরি চালায়। লুসি ও সুজানের সাথে থাকা আসলান বাচ্চুস এবং সিলেনাসের সাহায্য নিয়ে আসে। তারা টেলমেরিনদের হামলা করে এবং তাদের পালাতে বাধ্য করে। টেলমেরিনরা যখন বুঝতে পারে বাচ্চুস সেতু ধ্বংস করার ফলে তারা মহানদীতে আটকা পড়েছে, তখন তারা আত্মসমর্পণ করে।

আসলান টেলমেরিনদের সুযোগ দেয় ক্যাস্পিয়ানের অধিনে নার্নিয়ায় থাকার অথবা তাদের প্রকৃত বাসভূমি পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার। পৃথিবীতে ফেরত আসতে ইচ্ছুক প্রথম ব্যক্তি আসলানের তৈরী জাদুর দরজায় প্রবেশ করে অদৃশ্য হয়ে গেলে পেভেনসিরা অন্যান্য টেলমেরিনদের আশ্বস্ত করার জন্য দরজায় প্রবেশ করে। এর আগে পিটার এবং সুজান এডমন্ড এবং লুসিকে জানায় বড় হয়ে যাওয়ায় তারা আর নার্নিয়ায় ফেরত আসতে পারবে না। পেভেনসিরা পুনরায় সেই রেলওয়ে স্টেশনে নিজেদের দেখতে পায়।

চরিত্রসমূহ

  • লুসি পেভেনসি, পেভেনসিদের মধ্যে সবার ছোট, এবং সে-ই প্রথমবার আসলানকে পুনরায় দেখে।
  • এডমন্ড পেভেনসি হলো পেভেনসিদের মধ্যে বয়সে তৃতীয়। নার্নিয়ায় তাদের প্রথমবার ভ্রমণে লুসির সঠিক হওয়া ও তার বোকা বনে যাওয়ার কথা স্মরণ করে তার অন্য দুই ভাই-বোন লুসির আসলানকে দেখার কথা বিশ্বাস না করলেও সে বিশ্বাস করে।
  • পিটার পেভেনসি, পেভেনসিদের মধ্যে সবার বড়। সে নার্নিয়ার মহারাজা।
  • সুজান পেভেনসি দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ পেভেনসি। সে তীর ও ধনুক ব্যবহার করে।
  • রাজকুমার ক্যাস্পিয়ান, ন্যায়সঙ্গত টেলমেরিন রাজা, যে পরে সিংহাসনে বসে। তাকে পরবর্তী দুইটি বই দ্য ভয়েজ অব দ্য ডন ট্রেডার এবং দ্য সিলভার চেয়ারে দেখা যায় এবং দ্য লাস্ট ব্যাটলে তার সংক্ষিপ্ত উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
  • আসলান, মহান সিংহ, যে নার্নিয়া তৈরী করেছে।
  • মিরাজ, ক্যাস্পিয়ানের চাচা। সে টেলমেরিনের সিংহাসন দখল করে রেখেছে। যতদিন মিরাজের কোন পুত্রসন্তান ছিলনা, ততদিন সে ক্যাস্পিয়ানকে উত্তরাধিকারী হিসেবে জীবিত রাখে। কিন্তু তার পুত্রসন্তান জন্ম নেওয়ার পর সে ক্যাস্পিয়ানকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে ক্যাস্পিয়ামকে সমর্থন করা প্রাচীণ নার্নিয়ানদের সাথে লড়াই করে এবং পিটারের সাথে দ্বন্দযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু দ্বন্দযুদ্ধের পর লর্ড গ্লজেল্লি প্রতারণা করে তাকে হত্যা করে।
  • ট্রাম্পকিন, এক লাল বামুণ, যে মিরাজকে পরাজিত করতে ক্যাস্পিয়ানকে সাহায্য করে। মিরাজের সৈন্যরা যখন তাকে আটক করে ডুবিয়ে মারার জন্য কেইর প্যারাভালে নিয়ে যায় তখন পেভেনসিরা তাকে উদ্ধার করে এবং সে তাদের ক্যাস্পিয়ানের নিকট নিয়ে যায়। উপন্যাসের শুরুর দিকে সে আসলান ও প্রাচীন রাজা-রাণীদের অস্তিত্বের বিষয়ে সন্দিহান ছিল। কিন্তু গল্পে তার যাত্রাপথে সে তাদের সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জানতে থাকে।
  • ডক্টর কর্নেলিয়াস, আধা বামুণ এবং আধা মানুষ, হলেন ক্যাস্পিয়ানের গৃহ শিক্ষক। তিনি টেলমেরুনদের পরাজিত করতে নার্নিয়ানদের সহায়তা করেন।
  • রিপিসিপ, এক কথা বলা ইদুর (কথা না বলা ইদুরদের উত্তরপুরুষ, যারা পুর্ববর্তী বইয়ে আসলানকে শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে। এরপর তাদের কথা বলার ক্ষমতা দেওয়া হয়) যে একজন নির্ভিক তলোয়ারবাজ এবং আসলান ও ক্যাস্পিয়ানের অনুগত সমর্থক।
  • নিকাব্রিক, ক্যাস্পিয়ানের সেনাবাহিনীর এক কালো বামুণ। সে ক্যাস্পিয়ানের পক্ষে লড়াই করতে অস্বীকৃতি জানায়। সে এক শুকর ও এক নেকড়েকে সাথে নিয়ে টেলমেরিনদের বিরুদ্ধে হোয়াইট উইচকে জাগ্রত করার পরিকল্পনা করে, কিন্তু তাদের তিনজনকেই ক্যাস্পিয়ান ও তার মিত্ররা হত্যা করে।
  • ট্রাফলহান্টার, এক কথা বলা ব্যাজার। সে আসলান ও প্রাচীন নার্নিয়ার ব্যাপারে আস্থাশীল। মিরাজের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সে ক্যাস্পিয়ানকে সাহায্য করে।
  • লর্ড সোফেস্পিয়ান এবং লর্ড গ্লজেল্লি, হলেন টেলমারের দুইজন লর্ড। মিরাজের কাছে অপমানিত হওয়ার পর তারা পিটারের সাথে মিরাজকে দ্বন্দ যুদ্ধে অংশ নিতে রাজী করায়। যুদ্ধে মিরাজ মাটিতে পড়ে গেলে নার্নিয়ানরা প্রতারণা করেছে বলে তারা চিৎকার করে এবং গ্লজেল্লি মিরাজের পিঠে গোপনে ছুরি বসায়। দুই পক্ষ পূর্ণ শক্তি নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে পিটার সোফেস্পিয়ানের শিরশ্ছেদ করে। কিন্তু গ্লজেল্লির পরিণতির বিষয়ে লিউইস কিছুই বলেননি।

থিম

গল্পের মূল দুইটি থিম হলো সাহস এবং বিরত্ব এবং যেমনটা লিউইস নিজেই এক মার্কিন শিশুকে একটি চিঠিতে বলেছিলেন, “অবিচারের পর সত্য ধর্মের প্রতিষ্ঠা”।[৫]

টেলমেরিনদের নার্নিয়া দখলের সাথে ঐতিহাসিকভাবে নরমম্যানদের ইংল্যান্ড দখলের সাথে মিল রয়েছে। যদিও এর সাথে গল্পের কোন ঘটনার নিখুঁত ও সমান্তরাল কোন মিল নেই। গল্পের শেষ পরিণতি ” প্রাচীন নার্নিয়ান” ও টেলমেরিনদের একই জাতি হিসেবে শান্তিতে বসবাসের সাথে স্যাক্সন ও নরম্যানদের একক ইংরেজ জাতি হিসেবে বসবাসের সাথে মিল রয়েছে।

উন্নয়ন

বিবিসি ১৯৮৯ সালে দ্য ক্রনিকলস্ অব নার্নিয়া টেলিভিশন ধারাবাহিক সিরিজের জন্য দুই পর্বের প্রিন্স ক্যাস্পিয়ান ধারাবাহিক নির্মাণ করে।

ওয়াল্ট ডিজনি পিকচার্স এবং ওয়াল্ডেন মিডিয়া কর্তৃক চলচ্চিত্র ধারাবাহিকের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র দ্য ক্রনিকলস অব নার্নিয়া: প্রিন্স ক্যাস্পিয়ান শিরোনামে ২০০৮ সালের ১৬ই মে যুক্তরাষ্ট্রে এবং একই বছরের ২৬ জুন যুক্তরাজ্য মুক্তি পায়।

উপন্যাসটি পিশের বিলি ব্রিথস অ্যালবামের একই নামের গানের অনুপ্রেরণা ছিল।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

উপন্যাসটিকে নিয়ে ইরিনা কারাদাস একটি নাটক লেখেন যেটি ২০০৭ সালে প্রথম মঞ্চস্থ করা হয়।[৬]