পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপ থলিEarth’s internal heat pockets পৃথিবীর তাপীয় ইতিহাসের মৌলিক অংশ। অনুমান করা হয় পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে পৃষ্ঠতলের তাপের প্রবাহ ৪৭±২ টেরাওয়াট।[১] এবং প্রায় সমান পরিমাণে দুটি প্রধান উৎস থেকে এই তাপ আসে। এর একটি হল ম্যান্টল এবং ভূপৃষ্ঠে অবস্থিত সমস্থানিকগুলির তেজস্ক্রিয় বিকিরণ দ্বারা উৎপাদিত তেজস্ক্রিয় উত্তাপ, এবং অপরটি পৃথিবীর গঠনের সময় উৎপন্ন আদ্য তাপ যার কিছু পরিমান এখনো থেকে গেছে।[২]
পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপ অধিকাংশ ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াগুলিকে শক্তি প্রদান করে[৩] এবং ভূত্বকীয় পাত গুলিকে চালনা করে।[২] এর ভূতাত্ত্বিক তাৎপর্য থাকা সত্ত্বেও, আসলে পৃথিবীর মোট তাপ থলির মাত্র ০.০৩% তাপশক্তি পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে ভূপৃষ্ঠে আসে, সেই জায়গায় সৌর বিকিরণ থেকে নির্গত হয় ১৭৩,০০০ টেরাওয়াট তাপশক্তি।[৪] এই সৌর বিকিরণ, প্রতফলনের পরে যা অবশেষে ভূপৃষ্ঠে এসে পৌঁছোয়, প্রতিদিনের চক্রে কেবল কিছু দশক সেন্টিমিটার এবং বার্ষিক চক্রের কিছু দশক মিটার পর্যন্ত পৃথিবী পৃষ্ঠে প্রবেশ করতে পারে। সুতরাং অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াগুলির জন্য সৌর বিকিরণের বিশেষ কোন তাৎপর্য নেই।[৫]
Earth’s internal heat pockets
তাপ-প্রবাহের ঘনত্বের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী তথ্যগুলি সংগ্রহ ও সংকলন করে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ সিসমোলজি অ্যান্ড ফিজিক্স অফ দ্য আর্থ’স ইন্টেরিয়র এর আন্তর্জাতিক হিট ফ্লো কমিশন।[৬]

তাপ এবং পৃথিবীর বয়সের প্রাথমিক অনুমান
Earth’s internal heat pockets
পৃথিবীর শীতলীভবনের হারের গণনার উপর ভিত্তি করে (পৃথিবীর অভ্যন্তরে ধ্রুবক পরিবাহিতা অনুমান করে নিয়ে), ১৮৬২ সালে উইলিয়াম থমসন, (পরে লর্ড কেলভিন) পৃথিবীর বয়স অনুমান করেছিলেন ৯৮ মিলিয়ন বছর,[৭] কিন্তু তেজষ্ক্রিয়তা সময় নির্ণয় করে পাওয়া গেছে পৃথিবীর বয়স ৪.৫ বিলিয়ন বছর। সুতরাং এই দুটি সময় একেবারেই মেলেনি।[৮] ১৮৯৫ সালে জন পেরি প্রস্তাব করে বলেছিলেন[৯] পৃথিবীর অভ্যন্তরে পরিবর্তনশীল পরিবাহিতা পৃথিবীর গণনা করা বয়সকে কোটি কোটি বছর বাড়িয়ে তুলতে পারে, তেজষ্ক্রিয়তা সময় নির্ণয় দিয়ে এটি পরে নিশ্চিত করা গিয়েছিল। থমসনের যুক্তির স্বাভাবিক উপস্থাপনার বিপরীতে, তাপের উৎস হিসাবে তেজস্ক্রিয়তাকে যোগ করে পর্যবেক্ষণ করে পাওয়া পৃথিবীর ভূত্বকের তাপীয় নতি ব্যাখ্যা করা যাবে না। আরও উল্লেখযোগ্যভাবে, পৃথিবীর মধ্যে যে তাপ পরিবাহিত হয় সেটি ম্যান্টল পরিচলন ক্রিয়া দ্বারা পরিবর্তিত হয়। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে থমসনের অনুমান,-শুধুমাত্র পরিবহনের মাধ্যমে শীতলতা- এই যুক্তি অসিদ্ধ হয়ে যায়।
বৈশ্বিক অভ্যন্তরীণ তাপ প্রবাহ

পৃথিবীর প্রস্থচ্ছেদে দেখা যাচ্ছে এর প্রধান বিভাগ এবং পৃথিবীর মোট অভ্যন্তরীণ তাপ প্রবাহে তাদের আনুমানিক অবদান, এবং পৃথিবীর মধ্যে প্রধান তাপ পরিবহন প্রক্রিয়া
পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে পৃথিবী পৃষ্ঠ পর্যন্ত মোট তাপ প্রবাহের আনুমানিক মাপ ৪৩ টেরাওয়াট থেকে ৪৯ টেরাওয়াটের (টেরাওয়াট হল ১০১২ ওয়াট) মধ্যে থাকে।[১০] একটি সাম্প্রতিক অনুমান হল ৪৭ টেরাওয়াট,[১] যেটি গড় ৯১.৬ মিলিওয়াট/মি২ তাপ প্রবাহের সমতুল্য, এবং ৩৮,০০০ এর বেশি পরিমাপের উপর ভিত্তি করে এটই নির্দিষ্ট হয়েছে। মহাদেশীয় এবং মহাসাগরীয় ভূত্বকের তাপ প্রবাহ হল যথাক্রমে ৭০.৯ এবং ১০৫.৪ মিলিওয়াট/মি২।[১]
যখন পৃথিবীর মোট অভ্যন্তরীণ তাপের প্রবাহ ভূত্বকে সেভাবে পৌঁছোয় না, পৃথিবীর তাপের দুটি মূল উৎস,- তেজষ্ক্রিয় এবং আদ্য তাপ-এদের আপেক্ষিক অবদান অত্যন্ত অনিশ্চিত। কারণ এগুলি সরাসরি পরিমাপ করা কঠিন। রাসায়নিক এবং ভৌত পরীক্ষা অনুযায়ী এই তাপ অবদানের আনুমানিক পরিসর তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ জনিত উত্তাপ থেকে ১৫–৪১ টেরাওয়াট এবং আদ্য তাপ থেকে ১২–৩০ টেরাওয়াট।[১০]
Earth’s internal heat pockets
পৃথিবীর কাঠামো হ’ল বাইরে একটি শক্ত ভূত্বক, যার মধ্যে মহাদেশীয় ভূত্বক হল তুলনামূলকভাবে পুরু এবং মহাসাগরীয় ভূত্বক হল পাতলা, তবে দুটিই কঠিন। এর নিচে আছে কঠিন কিন্তু বহতা ম্যান্টল, তার নিচে তরল বহির্মজ্জা, এবং শেষে একটি কঠিন অন্তর্মজ্জা। কোনও উপাদানের বহমানতা তার তাপমাত্রার সমানুপাতিক; তাই, পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপ প্রবাহের অভিব্যক্তি হিসাবে শক্ত ম্যান্টল এখনও তাপমাত্রার ক্রিয়াকলাপে দীর্ঘ সময়ের হিসেবে প্রবাহিত হতে পারে।[২] পৃথিবীর অন্তস্থল থেকে কিভাবে তাপমুক্ত হচ্ছে তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে ম্যান্টল পরিচলন ঘটে। অধিক উত্তপ্ত ভাসমান ম্যান্টল ওপর দিকে ওঠে এবং তুলনামূলক ভাবে কম উত্তপ্ত ঘনতর ম্যান্টল নিচের দিকে চলে যায়। ম্যান্টলের এই পরিচলন প্রবাহ পৃথিবীর অশ্মমণ্ডল পাতের চলাচলকে নিয়ন্ত্রিত করে। এইভাবে, ভূত্বকীয় পাতের ক্রিয়াকলাপের জন্য নিম্ন ম্যান্টলে তাপের অতিরিক্ত ভাণ্ডারটি গুরুত্বপূর্ণ এবং নিম্ন ম্যান্টলে যে তেজস্ক্রিয় উপাদানগুলি জমা আছে তাদের সমৃদ্ধকরণের সম্ভাব্য উৎস।[১১]

Earth’s internal heat pockets
পৃথিবীর তাপ পরিবহন ঘটে পরিবহন, ম্যান্টল পরিচলন, জলবাহী সংবহন, এবং আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণের মাধ্যমে।[১২] পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপ প্রবাহের যতটা ভূ-পৃষ্ঠে আসে তার ৮০% ম্যান্টল পরিচলনের মাধ্যমে হয়। বাকি তাপের বেশিরভাগই পৃথিবীর ভূত্বকে উদ্ভূত হয়।[১৩] আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুপাত, ভূমিকম্প এবং পর্বতমালা সৃষ্টির কারণে প্রায় ১% এর মত তাপ আসে।[২] সুতরাং, পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপের প্রায় ৯৯% ভূত্বকে পরিবহনের মাধ্যমে ক্ষয় হয়, এবং ম্যান্টল পরিচলন এই তাপ পরিবহনে প্রধান ভূমিকা নেয়। পুরু মহাদেশীয় ভূত্বক থেকে বেশিরভাগ তাপ প্রবাহ অভ্যন্তরীণ তেজস্ক্রিয় বিকিরণের জন্য হয়; বিপরীতে পাতলা মহাসাগরীয় ভূত্বকে অভ্যন্তরীণ তেজস্ক্রিয় বিকিরণের তাপ মাত্র ২%।[২] উপরিভাগে অবশিষ্ট তাপ প্রবাহ ম্যান্টল পরিচলনের থেকে ভূত্বকের তলদেশীয় উত্তাপের কারণে হয়। তাপের প্রবাহ শিলার বয়সের সাথে ব্যাস্তানুপাতিকভাবে সম্পর্কিত,[১] মধ্য-মহাসাগর শৈলশিরার নবীনতম শৈল থেকে সর্বোচ্চ তাপ প্রবাহ হয়, এটি দেখা গেছে পৃথিবীর তাপ প্রবাহের বৈশ্বিক মানচিত্র থেকে।[১]
তেজস্ক্রিয় তাপ

সময়ের সাথে সাথে পৃথিবীর তেজস্ক্রিয় তাপ প্রবাহ
পৃথিবীর ম্যান্টল এবং ভূত্বকে তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের ফলে পরবর্তী সমস্থানিকের জন্ম হয় এবং জিওনিউট্রিনো ও তাপশক্তি বা তেজস্ক্রিয় তাপ নিসৃত হয়। অন্যান্য তেজস্ক্রিয় সমস্থানিকের তুলনায় চারটি প্রধান তেজস্ক্রিয় সমস্থানিক তেজস্ক্রিয় তাপের সিংহভাগের জন্য দায়ী। সেগুলি হল: ইউরেনিয়াম-২৩৮ (২৩৮ইউ), ইউরেনিয়াম-২৩৫ (২৩৫ইউ), থোরিয়াম-২৩২ (২৩২থো), এবং পটাসিয়াম-৪০ (৪০কে)।[১৪] ২০০ কিলোমিটার গভীরতা থেকে শিলা নমুনাপ্রাপ্তির অসম্ভাব্যতার কারণে, পুরো ম্যান্টলে জুড়ে নির্দিষ্টভাবে তেজস্ক্রিয় তাপ নির্ধারণ করা শক্ত,[১৪] যদিও কিছু অনুমান পাওয়া যায়।[১৫] পৃথিবীর মজ্জাংশে, ভূ-রসায়ন অধ্যয়ন ইঙ্গিত দেয় যে ওই অঞ্চলে তেজস্ক্রিয় উপাদানগুলির কম ঘনত্বের কারণে তাদের তেজস্ক্রিয় তাপের উল্লেখযোগ্য উৎস হওয়ার সম্ভাবনা নেই।[১৬] ম্যান্টলে তেজস্ক্রিয় তাপ উৎপাদন বিষয়টি ম্যান্টল পরিচলনের কাঠামোর সাথে যুক্ত। ধারণা করা হয় যে নিম্ন ম্যান্টলের কাঠামোতে উচ্চ ঘনত্বের স্তরযুক্ত তেজস্ক্রিয় তাপ উৎপাদনকারী উপাদান থাকতে পারে, অথবা সমস্ত ম্যান্টল জুড়ে ছোট ছোট তেজস্ক্রিয় পদার্থের ভাণ্ডার থাকতে পারে।[১৭]
Earth’s internal heat pockets
সমস্থানিক | তাপমুক্তি ওয়াট/কিগ্রা সমস্থানিক | অর্দ্ধায়ু বছর | ম্যান্টলের গড় ঘনত্ব কিগ্রা সমস্থানিক/কিগ্রা ম্যান্টল | তাপমুক্তি ওয়াট/কিগ্রা ম্যান্টল |
---|---|---|---|---|
২৩২থো | ২৬.৪×১০−৬ | ১৪.০×১০৯ | ১২৪×১০−৯ | ৩.২৭×১০−১২ |
২৩৮ইউ | ৯৪.৬×১০−৬ | ৪.৪৭×১০৯ | ৩০.৮×১০−৯ | ২.৯১×১০−১২ |
৪০কে | ২৯.২×১০−৬ | ১.২৫×১০৯ | ৩৬.৯×১০−৯ | ১.০৮×১০−১২ |
২৩৫ইউ | ৫৬৯×১০−৬ | ০.৭০৪×১০৯ | ০.২২×১০−৯ | ০.১২৫×১০−১২ |
জিওনিউট্রিনো শনাক্তকারী ২৩৮ইউ এবং ২৩১থো এর ক্ষয় শনাক্ত করতে পারে এবং এইভাবে বর্তমান তেজস্ক্রিয় তাপ থলিতে তাদের অবদান অনুমানের করা যায়, কিন্তু ২৩৫ইউ এবং ৪০কে – এদের শনাক্ত করা যায় না। তবুও, মনে করা হয় ৪০কে এর অবদান ৪ টেরাওয়াট তাপশক্তি।[১৮] তবে সংক্ষিপ্ত অর্ধায়ুর কারণে ২৩৫ইউ এবং ৪০কে এর ক্ষয় প্রথম অবস্থার পৃথিবীতে তেজস্ক্রিয় তাপ প্রবাহে বড় অবদান রেখেছিল। বর্তমানের চেয়ে সেই সময় পৃথিবী অনেক বেশি উত্তপ্ত ছিল।[১১] পৃথিবীর মধ্য থেকে তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের মাধ্যমে মুক্ত জিওনিউট্রিনোর পরিমাপের প্রাথমিক ফলাফল, তেজস্ক্রিয় তাপের একটি প্রতিনিধিত্বকারী সংখ্যা, অনুমান দিয়েছিল যে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ মোট তাপ উৎসের অর্ধেক হল তেজস্ক্রিয় তাপ[১৮] এবং এটি পূর্ববর্তী অনুমানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।[১৭]

আদ্য তাপ
Earth’s internal heat pockets
আদ্য তাপ হল পৃথিবী তার আসল গঠন থেকে ক্রমশ শীতল হতে থাকায় যে তাপ হারিয়েছে, এবং এটি এখনও সক্রিয়ভাবে উৎপাদিত তেজস্ক্রিয় উত্তাপের বিপরীতে। পৃথিবীর মজ্জার তাপ প্রবাহ—মজ্জা ত্যাগ করে তা ওপরে অবস্থিত ম্যান্টলের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে—এটি আদ্য তাপের কারণে বলেই মনে করা হয়, এবং অনুমান করা হয় এর পরিমান ৫–১৫ টেরাওয়াট।[১৯] ম্যান্টলের আদ্য তাপ হ্রাসের পরিমানের অনুমান ৭ থেকে ১৫ টেরাওয়াটের মধ্যে। এটি গণনা করা হয় মূল তাপ প্রবাহ এবং পৃষ্ঠের তাপ প্রবাহ থেকে পাওয়া মোট তেজস্ক্রিয় উত্তাপের ব্যবকলন করে।[১০]