অনুসর্গ বা কর্মপ্রবচনীয়বাংলাব্যাকরণের একটি পদ।[১][২] বাংলা ভাষায় যে অব্যয় শব্দগুলো কখনো স্বাধীন পদরূপে, আবার কখনো শব্দ বিভক্তির ন্যায় বাক্যে ব্যবহৃত হয়ে বাক্যের অর্থ প্রকাশে সাহায্য করে, সেগুলোকেই অনুসর্গ বা কর্মপ্রবচনীয় বলা হয়।[২]
অনুসর্গগুলো কখনো প্রাতিপদিকের পরে ব্যবহৃত হয়, আবার কখনো ‘কে’ বা ‘র’ বিভক্তিযুক্ত শব্দের পরে বসে।
এদের মধ্যে দ্বারা, দিয়া, দিয়ে, কর্তৃক (তৃতীয়া বিভক্তি), হইতে, হতে, চেয়ে (পঞ্চমী বিভক্তি), অপেক্ষা, মধ্যে প্রভৃতি কয়েকটি অনুসর্গ বিভক্তিরূপে ব্যবহৃত হয়।
পসর্গ বা আদ্যপ্রত্যয়[১] হলো ভাষায় ব্যবহৃত কিছু অব্যয়সূচক শব্দাংশ যাদের নিজস্ব কোনো “অর্থ নেই, কিন্তু অর্থের দ্যোতনা তৈরির ক্ষমতা আছে”।[২] উপসর্গ শব্দ বা শব্দমূলের শুরুতে বসে নতুন অর্থবহ শব্দ তৈরি করে, শব্দাংশের শুরুতে বসে না।[৩]
উপসর্গ যুক্ত হলে কোনো শব্দের বিপরীত শব্দ তৈরি হয় অথবা অর্থের উৎকর্ষ বা সংকোচন হয়। উপসর্গ সম্পর্কিত আলোচনা ব্যাকরণের রূপতত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত।[১]
ব্যুৎপত্তি ও সংজ্ঞা
‘উপসর্গ’ শব্দটির রূপতত্ত্বগত বিশ্লেষণ – উপ + √সৃজ্ + অ। ‘উপসর্গ’ কথাটির মূল অর্থ ‘উপসৃষ্ট’। “যেসব অর্থহীন অব্যয় পদ নামবাচক বা কৃদান্ত শব্দের পূর্বে যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ গঠন করে এবং অর্থের পরির্বতন সাধন করে, এগুলোকে উপসর্গ বলে।”[২][৪]
“সংস্কৃতে কতগুলো অব্যয় শব্দ আছে, এগুলো ধাতুর পূর্বে বসে এবং ধাতুর মূল ক্রিয়ার গতি নির্দেশ করে এর অর্থের প্রসারণ, সঙ্কোচন বা অন্য পরিবর্তন আনয়ন করে দেয়। এরূপ অব্যয় শব্দকে উপসর্গ বলে।”
“যেসব অব্যয় শব্দ কৃদান্ত বা নামপদের পূর্বে বসে শব্দগুলোর অর্থের সংকোচন, সম্প্রসারণ বা অন্য কোন পরিবর্তন সাধন করে, ঐ সব অব্যয় শব্দকে বাংলা ভাষায় উপসর্গ বলে।”
অনুসর্গ হলো কিছু অব্যয়সূচক শব্দ যেগুলো কখনো স্বাধীন পদরূপে, আবার কখনো শব্দ বিভক্তির মতো বাক্যে ব্যবহৃত হয়ে বাক্যের অর্থ প্রকাশে সাহায্য করে।[৫] উপসর্গ ও অনুসর্গের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। উপসর্গ ধাতু বা নাম-প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি শব্দের মতো আচরণ করলেও অনুসর্গ পূর্বের পদ থেকে পৃথকভাবে আশ্রিত হিসাবে অবস্থান করে।[৩] ‘প্রতি’ ও ‘অতি’ – উপসর্গ দুটি ব্যতীত আর কোনো উপসর্গের স্বতন্ত্র প্রয়োগ নেই, কিন্তু সকল অনুসর্গের স্বতন্ত্র প্রয়োগ আছে।
উপসর্গ ধাতু বা নাম-প্রকৃতির আগে বসে সেই ধাতু বা নাম-প্রকৃতির অর্থ-পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন শব্দ গঠন করে। অন্যদিকে, অনুসর্গ বিশেষ্য ও সর্বনাম পদের পরে বসে শব্দ বিভক্তির কাজ করে।[১]
বাংলা ভাষায় অর্ধশতাধিক উপসর্গ রয়েছে।[২] এই উপসর্গগুলোকে সাধারণত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে:
তৎসম (সংস্কৃত) উপসর্গ: এ ধরনের উপসর্গ সংস্কৃত শব্দের আগে বসে। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত তৎসম উপসর্গ ২০টি, যথা: অতি-, অধি-, অনু-, অপ-, অপি-, অব-, অভি-, আ-, উপ-, উত্-, দুর্-, নি-নির্-/নির-, পরা-, পরি-, প্র-, প্রতি-, বি-, সু- ও সম্-।[৫][৪]
খাঁটি বাংলা উপসর্গ: এ ধরনের উপসর্গ বাংলা শব্দের আগে বসে। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত খাঁটি বাংলা উপসর্গ ২১টি, যথা: অ-, অঘা-, অজ-, অনা-, আ-, আড়্-, আন-, আব-, ইতি-, উন্-, কদ-, কু-, নি-, পাতি-, বি-, ভর-, রাম-, স-, সা-, সু- ও হা-।[৫]
উল্লেখ্য, আ-, নি-, বি-, সু- — এই চারটি উপসর্গ সংস্কৃত ও বাংলা উভয় ভাষাতে ব্যবহৃত হয়। ব্যবহারের উপর নির্ভর করে নির্ধারণ করা হয় এরা খাঁটি বাংলা না সংস্কৃত উপসর্গ।[৫][৪]
বিদেশি উপসর্গ: এ ধরনের উপসর্গ বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যথা: আম-, কার-, বে-, ফুল-, সাব- ইত্যাদি।
উপসর্গে হাইফেন
উপসর্গে কখনো কখনো হাইফেন ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে যখন হাইফেনবিহীন বানান অন্য কোনো শব্দের অনুরূপ হয়ে যায় অথবা যখন উপসর্গ যোগ করলে সাধিত শব্দটি ভুল ব্যাখ্যাযোগ্য, অস্পষ্ট বা একরকম “আজব” বলে মনে হয় (উদাহরণস্বরূপ, যেভাবে ‘ঐ’ দ্বারা যেন বর্ণ না বোঝায় তাই বিভ্রান্তি এড়াতে বাক্যে ‘ওই’ ব্যবহার করা হয়)। যাইহোক, শব্দগঠনে সাধারণত হাইফেনহীন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে তখন, যখন সাধিত শব্দটি বিভিন্ন প্রসঙ্গে ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে তুলনামূলকভাবে পরিচিত বা জনপ্রিয় হয়ে উঠে। প্রচলিত নিয়মে হাইফেনের অভাবে কোনো সাধিত শব্দের অর্থের স্পষ্টতা বিঘ্নিত না হওয়া পর্যন্ত উপসর্গের পর হাইফেন দেওয়া হয় না।
সাধারণত বিদেশি উপসর্গের ক্ষেত্রে, স্বরধ্বনি দ্বারা শুরু হওয়া শব্দ ও উপসর্গকে পৃথক করে বোঝাতে বা অর্থের ভুল উচ্চারণ রোধে উপসর্গের পর হাইফেন ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন- ইংরেজি subunit (সাবিউনিট) এর পরিবর্তে sub-unit (সাব-ইউনিট)। কোনো শব্দ অধিক প্রচলিত হয়ে গেলে হাইফেন ব্যবহৃত হয় না, যেমন হেড-মাস্টার এর পরিবর্তে হেডমাস্টার।
হালেদের এই বই প্রকাশের পূর্বে কিছু বাংলা পদ্য বইয়ের সন্ধান পাওয়া গেলেও কোনো গদ্যের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তৎকালীন সময়ের পূর্বে বঙ্গদেশে গদ্যের চর্চা হতো না। এ কারণে হালেদ এই বইয়ে কোনো গদ্যের উদ্ধৃতি রাখেননি। তবে তিনি কাশীরাম দাসের মহাভারত-এর অনুবাদ, মহাপ্রভুর লীলাময় বৈষ্ণব গ্রন্থসমূহ এবং ভারতচন্দ্র রায়েরবিদ্যাসুন্দর প্রভৃতি বই থেকে উদাহরণ সংগ্রহ করেছিলেন। মূলতঃ ইংরেজিতে লিখিত হলেও এতে বাংলায় লেখা অনেক অক্ষর, শব্দ, বাক্য, পদ্যাংশ ও শ্লোক বাংলা হরফেই মুদ্রিত হয়েছিল ; কয়েকটি স্থানে কিছু ফারসি লিপিও ছিল। মূলত প্রাচ্য ভাষার সাথে পশ্চিমাদের পরিচিত করে তোলাই বই রচনায় মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। হালেদ এই বইয়ে বাংলার ক্যাক্সটন নামে খ্যাত চার্লস উইলকিন্সের তৈরি বাংলা হরফ ব্যবহার করেন।[৩][৪]
বর্ণনা
ইংরেজি ভাষায় লেখা বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ A Grammar Of The Bengal Language গ্রন্থটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৪৮। মূল গ্রন্থভাগ শুরু হয়েছে প্রথম ত্রিশ পৃষ্ঠার পর। প্রথমাংশের শিরোনাম-পৃষ্ঠার পর রয়েছে পঁচিশ পৃষ্ঠাব্যাপী লেখকের ভূমিকা এবং পরবর্তী পাঁচ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে সূচীপত্র এবং সংশোধন ও সংযোজনের বিজ্ঞাপন ইত্যাদি। গ্রন্থটি আকারে হালের A4 মাপের কিছু ছোট–যাকে বলা হতো Crown আকারের কাগজ–তার এক-অষ্টমাংশ। মুদ্রিত এলাকার পরিমাপ কমবেশি ৬.৫ x ৪.৫ ইঞ্চি। পাতার শীর্ষভাগে (Header) গ্রন্থের নাম ও পৃষ্ঠা নম্বর মুদ্রিত ছিল। বেজোড় সংখ্যক পৃষ্ঠার শীর্ষভাগে বাম প্রান্তে পৃষ্ঠা সংখ্যা এবং জোড় সংখ্যক পৃষ্ঠার ডান প্রান্তে পৃষ্ঠা সংখ্যা উল্লিখিত হয়েছিল। শীর্ষভাগে গ্রন্থনাম দুই অংশে মুদ্রিত হয়েছিল: বেজোড় সংখ্যক পাতার শীর্ষে A GRAMMAR OF THE এবং জোড়সংখ্যক পাতার শীর্ষে BENGAL LANGUAGE মুদ্রিত হয়েছিল। পাঠক লক্ষ্য করবেন গ্রন্থের নামপত্রে চারটি অংশ রয়েছে। মধ্য ভাগে লেখা গ্রন্থের নাম ও লেখকের নাম : A GARMMAR OF THE BENGAL LANGUAGE BY NATHANIEL BRASSEY HALHED
যার অর্থ হলো যে, হালেদ ফিরিঙ্গিদের উপকার সাধনে এই গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন।
বাঙ্গালায় নিযুক্ত ব্রিটিশ রাজকর্মচারি ও বণিকদের জন্য–যারা বাঙলা ভাষা শিক্ষায় আগ্রহী–হালেদ সাহেব গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। ইংরেজি Grammar শব্দের তিনি বঙ্গার্থ করেছিলেন “শব্দশাস্ত্র”। নামপত্রের তৃতীয়ভাগে অর্থাৎ গ্রন্থ ও গ্রন্থাকারের নামের পরে লিখিত ছিল: ইন্দ্রাদয়োপি যস্যান্ত নয়যুঃ শব্দবারিধেঃ। প্রক্রিয়ান্তস্য কৃৎস্নস্য ক্ষমোবক্তু নরঃ কথ।। যার অর্থ হলো : ইন্দ্র ইত্যাদি (দেবতারা)ও যে শব্দসমুদ্রের কুলকিনারা পেলেন না, সেই শব্দবারিধির কলাকৌশল মানুষের পক্ষে কী ক’রে বলা সম্ভব! নামপত্রের শেষভাগে মুদ্রণস্থল এবং প্রকাশবর্ষের কথা নিম্নরূপ উল্লিখিত ছিল: PRINTED AT HOOGLY IN BENGAL M DCC LXXVIII.
অর্থাৎ গ্রন্থটি বাঙ্গালা দেশের হুগলিতে মুদ্রিত এবং ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে (বাঙলা ১১৮৫ সন) প্রকাশিত। মুদ্রকের নাম উল্লেখ করা হয় নি ; তবে আমরা জানি মুদ্রাঙ্কনে যার প্রধান ভূমিকা ছিল তিনি চার্লস উইলকিনস সাহেব (১৭৪৯-১৮৩৬)–যিনি লোহা খোদাই ক’রে, ছাঁচে সীসা ঢালাই ক’রে মুদ্রণ কাজে ব্যবহার্য সচল বাংলা অক্ষর বা টাইপ তৈরি করেছিলেন। হালেদের গ্রন্থে ব্যবহৃত বাংলা অক্ষরের উচ্চতা প্রায় আধা ইঞ্চি। জন ক্লার্ক মার্শম্যানের (১৭৯৪-১৮৭৭) সূত্রে আমরা জেনেছি হুগলিতে অবস্থিত অ্যান্ড্রুজ সাহেবের ছাপাখানায় মুদ্রিত হয়েছিল A Grammar Of The Bengal Language গ্রন্থটি। এর জন্য উন্নতমানের কাগজ ও কালি আমদানি ক’রে নিয়ে আসা হয়েছিল ব্রিটেন থেকে।[৪]
বাংলাদেশ সংস্করণ ২০১৮
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা থেকে ‘‘অ্যা গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল লেঙ্গুয়েজ’’ বইটির একটি ফ্যাকসিমিলি সংস্করণ মুদ্রিত হয়। এটি প্রকাশ করে জার্নিম্যান বুক্স, ইস্টার্ন প্লাজা, ঢাকা। প্রচ্ছদ করেন তারিক সুজাত। মূল্য রাখা হয় ৭৫০ টাকা। আইএসবিএন: 978 984 92914 97[৪][৫]
কাঠামো
হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থে আটটি অধ্যায় রয়েছে। তাঁর দীর্ঘ ভূমিকার পর একটি বিষয়সূচী রয়েছে ভাষান্তরক্রমে যা নিম্নরূপ দাঁড়ায় :
১ম অধ্যায়: ভাষার উপাদান / পৃ: ১
২য় অধ্যায়: বিশেষ্য পদ / পৃ: ১৬
৩য় অধ্যায়: সর্বনাম / পৃ: ৭৫
৪র্থ অধ্যায়: ক্রিয়াপদ / পৃ: ১০০
৫ম অধ্যায়: শব্দবিশেষণ ও শব্দযোগ / পৃ: ১৪৩
৬ষ্ঠ অধ্যায়: সংখ্যা লিখন / পৃ: ১৫৯
৭ম অধ্যায়: বাক্যে পদ সংস্থাপনের ক্রম / পৃ: ১৭৭
৮ম অধ্যায়: উচ্চারণ ও ছন্দপ্রকরণ / পৃ: ১৯০
উপর্যুক্ত ৮টি পৃথক অধ্যায়ের পর রয়েছে ‘সংযোজনী’ অংশ (Appendix)। সূচীপত্রের পর রয়েছে শুদ্ধিপত্র। ভূমিকায় তিনি লিখেছেন—
বাংলা ভাষার শব্দগৌরব অসীম। বাংলা ভাষায় সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাসাদি যে-কোন বিষয় রচিত হতে পারে। কিন্তু বাঙ্গালিরা এ বিষয়ে যত্নশীল নন।
বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার তৎসম,অর্ধতৎসম,তদ্ভব, দেশি ও বিদেশি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে। কিন্তু এমন অনেক শব্দ রয়েছে যার মূল নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি অর্থাৎ তা দেশি না বিদেশি শব্দ থেকে আগত নাকি আংশিক পরিবর্তিত হয়েছে; কোনো কিছুই সঠিকভাবে বলা যায় না। এদের বাংলা ভাষার পণ্ডিতগণ অজ্ঞাতমূল শব্দ রূপে চিহ্নিত করেছেন।
সংযোজক পদ বা যোজক পদ হলো সে সকল শব্দ, যা পদ, বর্গ বা বাক্যকে সংযুক্ত করে।[১] বৃহৎ অর্থে এটি বাংলা অব্যয় পদের অংশ, তাই একে সংযোজক অব্যয়ও বলে।
বিভিন্ন প্রকার সংযোজক
সাধারণ সংযোজক
সংযোজক পদের মধ্যে এটিই হলো প্রধান ও প্রাথমিক পদ। এই ধরনের সংযোজক পদ দুটি শব্দ বা বাক্যকে যুক্ত করে। যেমন- ও, এবং।[১]
উদাহরণ: রহিম ও করিম এই কাজটি করেছে। জলদি দোকানে যাও এবং পাউরুটি কিনে আনো।
বিকল্প সংযোজক
এই ধরনের সংযোজক পদ একাধিক শব্দ বা বাক্যের মধ্যে বিকল্প নির্দেশ করে। এ ধরনের পদ সাধারণত না-বাচক হয়। যেমন- বা, অথবা, না-কি (নাকি), না-হয় (না হয়), আর।[১]
উদাহরণ: লাল বা নীল কলমটা আনো। চা না-হয় কফি খান।
বিরোধ সংযোজক
এই ধরনের সংযোজক পদ বাক্যের দুটি অংশের সংযোগ ঘটায় এবং প্রথম বাক্যের বক্তব্যের সঙ্গে বিরোধ তৈরি করে। যেমন- কিন্তু, তবে, তবু, তবুও, যদি, যত, তত, সুতরাং, অতএব।[১]
উদাহরণ: এত পড়লাম, কিন্তু পরীক্ষায় ভালো করতে পারলাম না। তাকে আসতে বললাম, তবু এল না।
কারণ সংযোজক
এই ধরনের সংযোজক পদ বাক্যের এমন দুটি অংশের মধ্যে সংযোগ ঘটায়, যার একটি অন্যটির কারণ হয়। যেমন- কারণ, তাই, এভাবে, ফলে।[১]
উদাহরণ: জিনিসের দাম বেড়েছে, কারণ চাহিদা বেশি। বসার সময় নেই, তাই যেতে হচ্ছে।
সাপেক্ষ সংযোজক
এ ধরনের সংযোজক পদ একে অন্যের পরিপূরক হয়ে বাক্যে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত দুটি বিরোধ সংযোজক পদ বাক্যের দুই স্থানে ব্যবহৃত হয়েও একই আচরণ করলে তা সাপেক্ষ সংযোজক হয়। যেমন- যদি…তবে, যত…তত।[১]
উদাহরণ: যদি রোদ ওঠে, তবে রওনা দেবো। যত পড়ছি, ততই নতুন করে জানছি।
বিভক্তি: ক্রিয়ার কাল নির্দেশের জন্য এবং কারক বোঝাতে পদের সঙ্গে যেসব শব্দাংশ যুক্ত থাকে, সেগুলোকে বিভক্তি বলে। বিভক্তি দুই প্রকার: ক্রিয়া-বিভক্তি ও কারক-বিভক্তি। ‘করলাম’ ক্রিয়াপদের ‘লাম’ শব্দাংশ হলো ক্রিয়া-বিভক্তি এবং ‘কৃষকের’ পদের ‘এর’ শব্দাংশ কারক-বিভক্তির উদাহরণ।
নির্দেশক: যেসব শব্দাংশ পদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পদকে নির্দিষ্ট করে, সেগুলোকে নির্দেশক বা পদাশ্রয়ী নির্দেশক বলে। ‘লোকটি’ বা ‘ভালোটুকু’ পদের ‘টি’ বা ‘টুকু’ হলো নির্দেশকের উদাহরণ।
বচন: যেসব শব্দাংশ পদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পদের সংখ্যা বোঝায়, সেগুলোকে বচন বলে। ‘ছেলেরা’ বা ‘বইগুলো’ পদের ‘রা’ বা ‘গুলো’ হলো বচনের উদাহরণ।
বলক: যেসব শব্দাংশ পদের সঙ্গে যুক্ত হলে বক্তব্য জোরালো হয়, সেগুলোকে বলক বলে। ‘তখনই’ বা ‘এখনও’ পদের শেষাংশের ‘ই’ বা ‘ও’ হলো বলকের উদাহরণ।
বিশেষ্য[টীকা ১] (বাংলা উচ্চারণ: [বিশেষ্য] (শুনুন)) বাংলা ব্যাকরণের একটি পদ।[টীকা ২] সাধারণ বিচারে বাক্যমধ্যে ব্যবহৃত যে সমস্ত পদ দ্বারা কোনো ব্যক্তি, জাতি, সমষ্টি, বস্তু, স্থান, কাল, ভাব, কর্ম বা গুণের নাম বোঝানো হয় তাদের বিশেষ্য বলে।[১] কোনো কিছুর নামকে বিশেষ্য পদ বলে। একে নামপদও বলা হয়।[২] যেমন: মারিয়া, মহানবী, ভারতবর্ষ, বাঞ্ছারামপুর, উলুকান্দী [৩]
সংজ্ঞা
সাধারণভাবে এর সংজ্ঞা হিসাবে বলা হয়, কোন কিছুর নামকেই বিশেষ্য বলে। বাংলা ব্যাকরণ মতে, বাক্যে ব্যবহৃত যে প্রকার পদ (শব্দ-ধ্বনি) দ্বারা কোন কিছুর নাম বোঝানো হয় তাকেই বিশেষ্য পদ বলে। যেমনঃ মাহবুবা, নারায়ণগঞ্জ, তিতাস ইত্যাদি। [টীকা ৩] যা গুণ প্রকাশ করে না, যা অন্য পদের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় না, যা কোনো কাজ করাকে প্রকাশ করে না এবং নিজে অপরির্তিত থেকে অন্য পদকে সমন্বিত করে না−তাই বিশেষ্য পদ। [৩]
যেসব বিশেষ্য পদ দ্বারা কোনো নির্দিষ্ট স্থান, নদী, পর্বত, সমুদ্র, প্রসিদ্ধ গ্রন্থ বা ব্যক্তির নাম বোঝায়, তাকে সংজ্ঞাবাচক বা নামবাচক বিশেষ্য বলা হয়। যেমন: মাহবুবা, মুস্তাফিজ, ঢাকা, পদ্মা, মেঘনা, তাজমহল, আল-কোরান, প্রথম আলো ইত্যাদি।[৪]
শ্রেণিবাচক / জাতিবাচক বিশেষ্য
যে বিশেষ্য পদের সাহায্যে কোনো প্রাণী বা বস্তুর সামগ্রিক নাম বোঝায়, তাকে জাতিবাচক বিশেষ্য বলে। যেমন: মানুষ, নদী, বই, বাঙালি, হিন্দু, রাজা, ধনীরা ইত্যাদি।
বস্তুবাচক বা দ্রব্যবাচক বিশেষ্য
যে বিশেষ্য পদের সাহায্যে কোনো বস্তু বোঝায় এবং যার সংখ্যা নির্দেশ করা যায় না, শুধু পরিমাণ নির্দেশ করা যায়, তাকে বস্তুবাচক বিশেষ্য বলে। যেমন: চাল, তেল, দুধ, পানি, বালি, লবণ ইত্যাদি।[৪]
সমষ্টিবাচক বিশেষ্য
যে বিশেষ্য পদে সমষ্টি বোঝায়, তাকে সমষ্টিবাচক বিশেষ্য বলে। যেমন: কমিটি, মাহফিল, জনতা, সমিতি,মিছিল, সভা, দল ইত্যাদি।[৪]
ভাববাচক (ক্রিয়াবাচক) বিশেষ্য
যে বিশেষ্য পদে কোনো ক্রিয়ার ভাব বা কাজের ভাব প্রকাশিত হয়, তাকে ভাববাচক বিশেষ্য বলে। যেমনঃ গমন (যাওয়ার ভাব বা কাজ)। দর্শন (দেখার কাজ) ভোজন (খাওয়ার কাজ) আনন্দ,বেদনা,ক্রোধ,শয়ন,দেখা,শোনা প্রভৃতি। ভাববাচক শব্দের শেষে (আ বা অন) হয়।[৪]
গুনবাচক বিশেষ্য
যে বিশেষ্য পদে কোনো গুণ, অবস্থা ও ভাবের নাম বোঝায়, তাকে গুণবাচক বিশেষ্য বলে। যেমন: সুখ, দুঃখ, দয়া,প্রেম, বীরত্ব,অহংকার,সৌন্দর্য,মধুরতা,তারল্য,তিক্ততা,তারুণ্য প্রভৃতি।[৫][৬]
টীকা: জাতিবাচক বিশেষ্যের সাথে বস্তুবাচক এর পার্থক্য এই যে জাতিবাচকের বহুবচন হয়; কিন্তু বস্তুবাচকের হয় না।[৭]
বানান বিশ্লেষণ: ব্+ই+শ্+এ+ষ্+য্+অ। রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ: বি (অতিশায়িত)- শিষ্ (শেষ থাকা, শেষ রাখা) + য (ণ্যৎ), কর্মবাচ্য। উচ্চারণ: bi.ʃeʃ.ʃo (বি.শেশ্.শো) বি.শেশ্.শো [বি একাক্ষর হিসেবে উচ্চারিত হবে। ষ্য -এর জন্য দ্বিত্ব শ্.শ ধ্বনি তৈরি করে। শে ধ্বনির সাথে ষ্য-এর বিভাজিত ধ্বনির শ্ যুক্ত হয়ে শেশ্ ধ্বনি তৈরি করে। অবশিষ্ট শো ধ্বনি একাক্ষর হিসেবে উচ্চারিত হয়।] ব্যাকরণগত বিশ্লেষণ: একটি শব্দ কোন্ পদের পর্যায়ে পড়বে, তা নির্ভর করবে বাক্যে শব্দটি কিভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তার বৈশিষ্ট্যের উপর। এই বিচারে প্রাথমিক ভাবে কোন শব্দটি বিশেষ্য হবে তা নিশ্চিত করা যায় না। উদাহরণ হিসাবে একটি শব্দ সবুজ। যদি বলি এই রঙটি সবুজ। তার অর্থ হলো− কোনো সুনির্দিষ্ট রঙের নাম বলা হচ্ছে। তাই এখানে সবুজ শব্দটি বিশেষ্য। কিন্তু যদি বলা যায় “‘সবুজ পতাকা”। এই বাক্যে সবুজ শব্দটি পতাকাকে বিশেষিত করছে। এই অর্থে সবুজ এখানে বিশেষণ।
পরিভাষায় ব্যাকরণ বলতে সাধারণত ভাষার কাঠামোর, বিশেষ করে শব্দ ও বাক্যের কাঠামোর, গবেষণাকে বোঝায়। এ অর্থে ব্যাকরণ হল কোন ভাষার রূপমূলতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্বের আলোচনা। কখনও কখনও আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে ব্যাকরণ পরিভাষাটি দিয়ে কোন ভাষার কাঠামোর সমস্ত নিয়মকানুনের বর্ণনাকে বোঝানো হয়, এবং এই ব্যাপকতর সংজ্ঞার ভেতরে ঐ ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব ও প্রয়োগতত্ত্বের আলোচনাও চলে আসে।
উপরে দেওয়া ব্যাকরণের সংজ্ঞাগুলি মূলত উচ্চতর ভাষাবিজ্ঞানী মহলে প্রচলিত এবং এ ধরনের ব্যাকরণকে বর্ণনামূলক ব্যাকরণও বলা হয়। অন্যদিকে স্কুল কলেজে পাঠ্য ব্যাকরণগুলিতে ভাষার সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক বর্ণনা থাকে না, বরং এগুলিতে সাধারণত মান ভাষার কাঠামোর কিছু বিবরণের পাশাপাশি আদর্শ বা মান ভাষাতে লেখার বিভিন্ন উপদেশমূলক নিয়ম বিধিবদ্ধ করে দেওয়া থাকে। এগুলিকে বলা হয় বিধানবাদী ব্যাকরণ।
ব্যুৎপত্তি ও সংজ্ঞা
ব্যাকরণ শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ হলো “বিশ্লেষণ” (বি + আ + ক্রি + অন) বিশেষ এবং সম্যকরূপে বিশ্লেষণ। ভাষার সংজ্ঞা প্রসঙ্গে নানান সাহিত্যিক নানান মতামত লক্ষ্য করা যায় তবে যে সমস্ত মতামতগুলি গ্রহণযোগ্য তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এর মতে, যে শাস্ত্রে কোনো ভাষাকে বিশ্লেষণ করে তার স্বরূপ আকৃতি ও প্রয়োগের নীতি বুঝিয়ে দেওয়া হয়, সেই শাস্ত্র কে বলে সেই ভাষার ব্যাকরণ।
ইতিহাস
প্রথম বাংলা ব্যাকরণ প্রকাশিত হয় ১৭৪৩ সালে পর্তুগিজ ভাষায়। এর লেখক ছিলেন মানোয়েল দা আসুম্পসাঁও। তাঁর বাংলা-পর্তুগিজ অভিধানের ভূমিকা অংশ হিসেবে তিনি এটি রচনা করেন। এরপর ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত হয় নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড প্রণীত ইংরেজি ভাষায় রচিত পূর্ণাঙ্গ একটি বাংলা ব্যাকরণ।
বিশেষণ (উচ্চারণ: biʃeʃɔn (বি.শে.শন্))[নোট ১][নোট ২] (ইংরেজি adjective (ল্যাটিনadjicere> adjectivus>ফরাসিadjectif> ইংরেজি adjective)) [নোট ৩] হচ্ছে বাংলা ব্যাকরণের একটি পদ যা বাক্যের অন্য কোন পদের (বিশেষ্য, সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের) দোষ, গুণ, অবস্থা, সংখ্যা, পরিমাণ ইত্যাদি প্রকাশ করে।[১]
সংজ্ঞা
যে পদ বিশেষ্য, সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের দোষ, গুণ, অবস্থা, সংখ্যা, পরিমাণ ইত্যাদি প্রকাশ করে, তাকে বিশেষণ পদ বলে।[২]
বাংলা ব্যাকরণ মতে– বাক্যে ব্যবহৃত যে পদ, বিশেষ্য, সর্বনাম ও ক্রিয়াপদকে বিশেষিত করে, তাকেই বিশেষণ বলে। [নোট ৪] যেমন— *বিশেষ্যের বিশেষণ – লাল রক্ত; *সর্বনামের বিশেষণ – করুণাময় তুমি; *ক্রিয়ার বিশেষণ – আস্তে যাও।
প্রকারভেদ
বিশেষণ পদ প্রধানত দুইভাগে বিভক্ত- নাম বিশেষণ এবং ভাব বিশেষণ।
নাম-বিশেষণ:
বিশেষণ পদের উদাহরণ
যে সকল শব্দ (বিশেষণ পদ) সর্বনাম ও বিশেষ্যকে বিশেষায়িত করে, তাকেই নাম বিশেষণ বলা হয়। যেমন— সুস্থ সবল দেহকে কে না ভালোবাসে?
মাহবুবা মারিয়া যেমনি রূপবান, তেমনি গুণবান।
ভাব বিশেষণ
যে সকল শব্দ বাক্যের বিশেষ্য বা সর্বনাম পদ ব্যতীত অন্যপদগুলোকে বা বাক্যকে বা উভয়ের অর্থকে বিশেষিত করে, তাকে ভাব-বিশেষণ বলে। ভাব বিশেষণকে চারভাগে ভাগ করা যায়-
যে পদ ক্রিয়া সংঘটনের ভাব, কাল বা রূপ নির্দেশ করে, তাকে ক্রিয়া বিশেষণ বলে। যেমন- পরে একবার এসো। ক্রিয়া বিশেষণের বিভিন্ন ধরনের গঠন নিন্মেরূপ-
বিভক্তিহীন শব্দযোগেঃ ভাবজ্ঞাপক – সে অবশ্য আসবে। সময়জ্ঞাপক – ক্রমাগত ভুল করো না। স্থানবাচক – হেথা আর এসো না।
এ-বিভক্তি যোগেঃ সুখে থাকতে চাই। পরিস্থিতি চরমে উঠেছে।
-পূর্বক, -ভাবে -রূপে, -সহকারে, সহিত, সাথে সমাসবদ্ধ হয়ে নতুন ধরনের ক্রিয়া- বিশেষণ তৈরি হয়। যেমনঃ যত্নপূর্বক কাজটি করো। এরূপ- ভালোভাবে, ভালোরূপে, মনোযোগ-সহকারে, আদবের সহিত, আদবের সাথে।
তঃ, থা, ধা, শ, বত্, মত, মতন প্রত্যয়ান্ত শব্দ বিশেষণ হয়। যেমনঃ তঃ – সম্ভবতঃ তিনি আসবেন। ধা – জলস্রোতটি শতধায় বিভক্ত।শ – ক্রমশ বিষয়টি পরিষ্কার হলো। ত্র – ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান। মত – ঠিকমত কাজ করো। মতন – ঠিকমতন কাজ করো।
করে – অসমাপিকা ক্রিয়াপদ যোগে: ভালো করে জেনে আস।
মাত্র – যোগে: ট্রেনটি চলামাত্র আনিকা ঘুমিয়ে পড়লো
যে পদ নাম বিশেষণ অথবা ক্রিয়া বিশেষণকে বিশেষিত করে, তাকে বিশেষণের বিশেষণ বলে। যেমনঃ সামান্য একটুদুধ দাও। রকেট অতি দ্রুত চলে।
অব্যয়ের বিশেষণ
যে ভাব-বিশেষণ অব্যয়পদ অথবা অব্যয় পদের অর্থকে বিশেষিত করে তাকে অব্যয়ের বিশেষণ বলে। যেমনঃ ধিক্ তারে শত ধিক্ নির্লজ্জ যে জন।
বাক্যের বিশেষণ
কখনো কখনো কোনো বিশেষণ পদ একটি সম্পূর্ণ বাক্যকে বিশেষিত করতে পারে তখন তাকে বাক্যের বিশেষণ বলা হয়। যেমন—দুর্ভাগ্যক্রমে দেশ আবার নানা সমস্যাজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।[৪][নোট ৫]
বিশেষণের গঠনরীতি
কয়টি শব্দের মাধ্যমে বিশেষণটি তৈরি হতে পারে, তার উপর ভিত্তি করে বিশেষণকে দুটি ভাগ ভাগ করা যায়।
এক পদময় বিশেষণ
এটি মৌলিক বিশেষণ (একটির বেশি শব্দ নিয়ে তৈরি নয়): ছোট মাছ অল্প পানিতে লাফায় বেশি।
কৃদন্ত প্রত্যয় দ্বারা তৈরি বিশেষণ : চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে নামলেন।
তদ্ধিত প্রত্যয় দ্বারা তৈরি বিশেষণ : শক্তিমান পুরুষ।
এটি একাধিক পদ দ্বারা গঠিত বিশেষণ। এক্ষেত্রে পদগুলো পৃথকভাবে সজ্জিত থাকতে পারে, কিম্বা সমাস বা সন্ধিযোগে যুক্ত অবস্থায়ও থাকতে পারে।
পদ পৃথক অবস্থায় : দশ দিনের পথ।
সন্ধি বা সমাস-সিদ্ধ অবস্থায় : ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন।
বিশেষণের অতিশায়ন
বিশেষণ পদ যখন দুই বা ততোধিক বিশেষ্য পদের মধ্যে গুণ, অবস্থা পরিমাণ প্রভৃতি বিষয়ে তুলনায় একের উৎকর্ষ বা অপকর্ষ বুঝিয়ে থাকে তখন তাকে বিশেষণের অতিশায়ন বলে। যেমনঃ যমুনা একটি দীর্ঘ নদী, পদ্মা দীর্ঘতর, কিন্তু মেঘনা বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদী। বিশেষণের অতিশায়নের ক্ষেত্রে দুটি ব্যাকরণগত পরিভাষা ব্যবহার করা হয়, উপমান এবং উপমেয়।
উপমান: যার সাথে তুলনা করা হয়।
উপমেয়: যাকে তুলনা করা হয়।
যেমনঃ রূপার চেয়ে সোনা দামী। এখানে রূপা উপমান এবং সোনা উপমেয়। [৫] অতিশায়ন দুইভাবে হতে পারে-
দুয়ের মধ্যে অতিশায়ন: চেয়ে, চাইতে, হতে, অপেক্ষা প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়। যেমন ‘‘গরুর চেয়ে ঘোড়ার দাম বেশি।’’
বহুর মধ্যে অতিশায়ন: সবচাইতে, সবচেয়ে, সবথেকে, সর্বাপেক্ষা, সর্বাধিক প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়। যেমন: ‘‘তিমি সবচেয়ে বড় প্রাণী।’’
বানান বিশ্লেষণ: ব্+ই+শ্+এ+ষ্+অ+ণ্+অ। শব্দ-উৎস: সংস্কৃত विशेषणम् (বিশেষণম্) > বাংলা বিশেষণ। বাংলা ব্যাকরণের বিশেষণের সাথে ইংরেজিadjective -এর সামান্য পার্থক্য আছে। ইংরেজি পদপ্রকরণে adverb নামক একটি পৃথক পদ আছে। বাংলাতে এর সমার্থ পদ হলো- ক্রিয়া-বিশেষণ। বাংলাতে ক্রিয়া-বিশেষণ হলো বিশেষণের একটি প্রকরণ। বিশেষিত অর্থঃ দোষ, গুণ, অবস্থা, সংখ্যা, পরিমাণ ইত্যাদি প্রকাশ করা। উদ্দেশ্য-বিধেয় এবং নির্ধারক এর বিচারে ভাব বিশেষণের আরও দুইটি ভাগ রয়েছে।
বিধেয়-বিশেষণঃ বাক্যের বিধেয় অংশে অবস্থিত বিশেষণকে বলা হয় বিধেয়-বিশেষণ। যেমনঃ “ছেলেটি ভালো বটে” এখানে ছেলেটি উদ্দেশ্য এবং ভালো বটে। এই বিচারে ভালো বিধেয়-বিশেষণ।
নির্ধারক বিশেষণঃ দ্বিরুক্ত শব্দ যখন আধিক্য বা অল্পত্ব প্রকাশকে নির্দেশিত করে, তখন তাকে নির্ধারক বিশেষণ বলা হয়। যেমনঃ ছোট ছোট মাছ, বড় বড় পুকুর
ধ্বন্যাত্মক বিশেষণঃ কিছু কিছু শব্দ দুইবার উচ্চারিত হয়ে ধ্বন্যাত্মক ধ্বনির সৃষ্টি করে এবং তা বিশেষ্যকে বিশেষিত করে। এই জাতীয় শব্দকে ধ্বন্যাত্মক বিশেষণ বলা হবে। যেমনঃ কলকল ধ্বনি, ছলছল চোখ
বিধেয়” শব্দটি ভাষাবিজ্ঞান ও এর উপক্ষেত্রগুলোতে দুইভাবে উপস্থাপন করা হয়। প্রথম সংজ্ঞা মতে, বাক্যে উদ্দেশ্য ব্যতীত বাকি সবকিছুকে বিধেয় বলে। দ্বিতীয় সংজ্ঞা মতে, বিধেয় হলো বাক্যের শুধুমাত্র মূল ক্রিয়াপদ অথবা বাক্যাংশের বিধেয়সূচক অভিব্যক্তি। “সুমন বল খেলে” উদাহরণটিতে প্রথম সংজ্ঞামতে “বল খেলে” অংশটি বিধেয় আর দ্বিতীয় সংজ্ঞামতে একই বাক্যের ক্রিয়াপদ “খেলে” শব্দটি বিধেয়, যেখানে “সুমন” ও “বল” হলো বাক্যের সূচি। এই দুটি সংজ্ঞার মধ্যে পার্থক্য বিভ্রান্তির কারণ হতে পারে।
বিধেয় বাক্যের কর্তৃপদ তথা উদ্দেশ্যের উপর নির্ভরশীল। বিধেয় সাধারণত বাক্যের শেষের দিকে বসে। তবে উদ্দেশ্য ও বিধেয়ের অবস্থান বদলে যেতে পারে। চিনি বা শর্করা এইসব মিলিয়ে তৈরি হয়।
এই বাক্যকে এভাবেও লেখা যেতে পারে- এইসব মিলিয়ে তৈরি হয় চিনি বা শর্করা।
উপরের মোটা কালির অংশটি উদ্দেশ্য, যার অবস্থান পরিবর্তিত হয়েছে দ্বিতীয় উদাহরণে, ফলে বিধেয়ের অবস্থানও পরিবর্তিত হয়েছে।
বিভিন্ন অংশ
পূরক
বিধেয় অংশে সাধারণত ক্রিয়াপদ থাকে। বিধেয় ক্রিয়াপদের বিশেষ্য অংশকে বলা হয় পূরক।
বাক্য দীর্ঘতর হলে বিধেয়ের সঙ্গে নানা ধরনের শব্দ ও বর্গ যুক্ত হতে পারে। বিধেয়কে এইসব শব্দ ও বর্গ প্রসারিত করে বলে এগুলোর নাম বিধেয়ের প্রসারক। সাধারণত উদ্দেশ্যের পূর্বে উদ্দেশ্যের প্রসারক এবং বিধেয়ের পূর্বে বিধেয়ের প্রসারক বসে। তবে বিধেয়ের স্থান ও কাল সংক্রান্ত প্রসারক উদ্দেশ্যের পূর্বেও বসতে পারে। যেমন- “১৯৫২ সালে ঢাকার রাজপথে বাঙালি জাতির অহংকার রফিক-সালাম-বরকত-জব্বার মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।”
এই বাক্যে উদ্দেশ্য হলো ‘রফিক-সালাম-বরকত-জব্বার’, উদ্দেশ্যের প্রসারক হলো ‘বাঙালি জাতির অহংকার’। মূল ক্রিয়াপদ হলো ‘উৎসর্গ করেছিলেন’, বিধেয়ের পূরক হলো ‘জীবন’। অন্যদিকে ‘১৯৫২ সালে’, ‘ঢাকার রাজপথে’, এবং ‘মাতৃভাষার জন্য’ – এই তিনটি অংশ হলো বিধেয়ের প্রসারক।