Category: বাংলাদেশ বিষয়াবলি

Bangladesh Affair

  • ১৯৯২-এ বাংলাদেশ

    ১৯৯২-এ বাংলাদেশ

    ৯৯২ সাল ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২১তম বছর। এটি ছিল খালেদা জিয়া সরকারের প্রথম স্থায়িত্বকালের দ্বিতীয় বছর।

    দায়িত্ব

    প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া

    খালেদা
    জিয়া

    জনসংখ্যা

    মোট জনসংখ্যা১০৭,৯৮৩,৭০৮
    জনসংখ্যার ঘনত্ব (প্রতি কিমি)৮২৯.৬
    জনসংখ্যা বৃদ্ধি (বার্ষিক %)২.২%
    পুরুষ এবং মহিলা অনুপাত (প্রতি ১০০ জন মহিলা)১০৬.৪
    শহুরে জনসংখ্যা (মোট %)২০.৬%
    জন্মহার, অপরিশোধিত (প্রতি ১,০০০ জনে)৩৩.৩
    মৃত্যুর হার, অপরিশোধিত (প্রতি ১,০০০ জনে)৯.৫
    মৃত্যুর হার, ৫ বছরের কম (প্রতি ১,০০০ জীবিত জন্মে)১৩২
    জন্মের সময় আয়ু, মোট (বছর)৫৯.৬
    উর্বরতার হার, মোট (প্রতি মহিলার জন্মে)৪.১

    জলবায়ু

    ১৯৯২-এ বাংলাদেশ-এর আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য
    মাসজানুফেব্রুমার্চএপ্রিলমেজুনজুলাইআগস্টসেপ্টেঅক্টোনভেডিসেবছর
    দৈনিক গড় °সে (°ফা)১৭.৫
    (৬৩.৫)
    ১৯.২
    (৬৬.৬)
    ২৫.৩
    (৭৭.৫)
    ২৮.৩
    (৮২.৯)
    ২৭.৪
    (৮১.৩)
    ২৮.৪
    (৮৩.১)
    ২৭.৭
    (৮১.৯)
    ২৮.১
    (৮২.৬)
    ২৭.৮
    (৮২.০)
    ২৬.৫
    (৭৯.৭)
    ২৩.
    (৭৩)
    ১৮.৩
    (৬৪.৯)
    ২৪.৮
    (৭৬.৬)
    অধঃক্ষেপণের গড় মিমি (ইঞ্চি)৫.৩
    (০.২১)
    ৪৫.
    (১.৮)
    ১৫.৯
    (০.৬৩)
    ৪৩.৪
    (১.৭১)
    ১৯৭.
    (৭.৮)
    ২৮০.
    (১১.০)
    ৪৮৭.২
    (১৯.১৮)
    ৩২৯.১
    (১২.৯৬)
    ৩০৯.৬
    (১২.১৯)
    ১৪৫.৪
    (৫.৭২)
    ৮.৫
    (০.৩৩)
    ৩.৫
    (০.১৪)
    ১,৮৬৯.৯
    (৭৩.৬২)
    উৎস: পূর্ব অ্যাংলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (UEA) এর জলবায়ু গবেষণা ইউনিট (CRU)[২]

    ঘূর্ণিঝড়

    স্যাফির-সিম্পসন স্কেল অনুযায়ী, মানচিত্র ঝড়টির পথ ও তীব্রতা দেখাচ্ছে

    ১৯৯২ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে সাইক্লোন ফরেস্ট নামে একটি শক্তিশালী ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের ৬০০,০০০ মানুষকে উচ্ছেদ করে। ৯ নভেম্বর ক্যারোলাইন দ্বীপপুঞ্জের কাছে বিপর্যস্ত আবহাওয়ার একটি এলাকা থেকে ঘূর্ণিঝড়টির উদ্ভব হয়। ফরেস্টটি তিন দিন পরে দক্ষিণ চীন সাগরের উপরে আসলে একে একটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় নিম্নচাপ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। সাধারণভাবে এটি পশ্চিম অনুসরন করে ছোটে, ১৫ নভেম্বর মালয় উপদ্বীপ বরাবর থাইল্যান্ডে আঘাত করার আগে সিস্টেমটি ক্রমাগতভাবে একটি গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড়ের মধ্যে সংগঠিত হয় এবং দক্ষিণের ভিয়েতনাম অতিক্রম করে। এবার বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে ফরেস্ট ১৭ নভেম্বর উত্তর দিকে মোড় নেয় এবং এর গতি উল্লেখযোগ্যভাবে তীব্র হয়। এটি ২০ নভেম্বরে ২৩০ কিমি/ঘন্টা (১৪৫ mph) বাতাসের বেগসহ সাফির-সিম্পসন হারিকেন স্কেলে ৪-সমমানের ঘূর্ণিঝড় হিসেবে সর্বোচ্চ তীব্রতায় পৌঁছে। আকস্মিকভাবে পূর্ব-উত্তরপূর্ব দিকে মোড় নেয়ার কারনে, ঘূর্ণিঝড়টি শীঘ্রই প্রতিকূল পরিবেশগত পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করে। পরের দিন ভোরে অর্থাৎ ২১ নভেম্বর বিলীন হওয়ার আগে ফরেস্ট একটি দুর্বল সিস্টেম হিসেবে উত্তর-পশ্চিম মিয়ানমাররে স্থলরেখায় আঘাত করে।

    ২০ নভেম্বরে ফরেস্ট যখন তার সর্বোচ্চ তীব্রতায় পৌঁছে, তখন সারা বাংলাদেশে আশঙ্কা দেখা দেয় যে, ১৯৯১ সালের এপ্রিলে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। ফলস্বরূপ, দেশের উপকূলীয় অঞ্চল জুড়ে ব্যাপক উচ্ছেদ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়, যার মধ্যে ১০ লক্ষ পর্যন্ত জনসংখ্যা স্থানান্তরের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু, ঝড়টি আকস্মিকভাবে পূর্ব দিকে মোড় নেয় এবং ৬০০,০০০ বাসিন্দাকে সফলভাবে সরিয়ে নেওয়ার ফলে অসংখ্য জীবন রক্ষা পায়। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সমস্ত বাড়ির প্রায় অর্ধেক ক্ষতিগ্রস্থ হলেও শুধুমাত্র দুটি মৃত্যু নথিভুক্ত করা হয় এবং সামগ্রিক ক্ষতি তুলনামূলক অনেক কম হয়।

    অর্থনীতি

    জাতীয় আয়
    বর্তমান (মার্কিন ডলার)বর্তমান (টাকা)জিডিপি (%)
    জিডিপি$৩১.৭ বিলিয়ন৳১১৯৫.৪ বিলিয়ন
    জিডিপি প্রবৃদ্ধি (বার্ষিক %)৫.৪%
    মাথাপিছু জিডিপি$২৯৩.৬৳১১,০৭০
    কৃষি, মূল্য সংযোজন$৯.৭ বিলিয়ন৳৩৬৪.৮ বিলিয়ন৩০.৫%
    শিল্প, মূল্য সংযোজন$৬.৯ বিলিয়ন৳২৫৯.৬ বিলিয়ন২১.৭%
    সেবা, ইত্যাদি, মূল্য সংযোজন$১৪.১ বিলিয়ন৳৫৩০.৬ বিলিয়ন৪৪.৪%
    পরিশোধের হিসাব
    বর্তমান (মার্কিন ডলার)বর্তমান (টাকা)জিডিপি (%)
    বর্তমান অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স$১৮০.৮ মিলিয়ন.৬%
    পণ্য ও সেবা আমদানি$৪,১৪২.৬ মিলিয়ন৳১৪৭.৬ বিলিয়ন১২.৩%
    পণ্য ও সেবা রপ্তানি$২,৫৮১.২ মিলিয়ন৳৯০.৭ বিলিয়ন৭.৬%
    সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ, নিট প্রবাহ$৩.৭ মিলিয়ন০.০%
    ব্যক্তিগত রেমিটেন্স, প্রাপ্ত$৯১১.৮ মিলিয়ন২.৯%
    বছরের শেষে মোট জমা (স্বর্ণসহ)$১,৮৫৩.৫ মিলিয়ন
    আমদানির মাসে মোট জমা৫.২

    দ্রষ্টব্য: ১৯৯২ সালের জন্য গড় সরকারি বিনিময় হার ছিল BDT প্রতি US$ ৩৮.৯৫।

    ঘটনাবলী

    জাহানারা ইমাম

    • ২৬ মার্চ – ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ঢাকায় জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণ-আদালত নামে পরিচিত মক ট্রায়াল গঠন করে এবং যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ‘দণ্ডাদেশ’ দেয়। [৩]
    • ১০ এপ্রিল – ভারত সীমান্তবর্তী খাগড়াছড়ি জেলার লোগাং গ্রামে লোগাং গণহত্যা সংঘটিত হয়। এই গণহত্যায় বাঙ্গালী বেসামরিক, সীমান্তরক্ষী এবং সেনাবাহিনী জড়িত ছিল। যারা কুড়াল, হ্যাচেট এবং বন্দুক দিয়ে জুম্ম জনগণকে আক্রমণ করে এবং সমস্ত বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। [৪] সরকারি তদন্ত পরিষদ ঘোষণা করে যে, মাত্র ১২ জন মারা গেছে, যেখানে বেসরকারী অনুমান অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা [৫] প্রায় ৪০০তে দাঁড়ায়।
    • ২১ অক্টোবর – ঢাকা বিভাগের গাজীপুর জেলার বোর্ড বাজারে প্রধান ক্যাম্পাসসহ বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। [৬]
    • ৭ ডিসেম্বর – বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতার প্রতিবাদে বাঙালি হিন্দুদের বিরুদ্ধে একের পর এক সহিংসতা হয়। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে হামলা হয়। ঢাকার ভোলানাথ গিরি আশ্রমে হামলা ও লুটপাট করা হয়। [৭] পুরান ঢাকায় হিন্দু মালিকানাধীন জুয়েলারি দোকানে লুট হয়। রায়েরবাজারে হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দেয়া হয়। [৮]
    • ৮ ডিসেম্বর – কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া উপজেলায় হিন্দুদের উপর হামলা হয়। মুসলমানরা ১৪টি হিন্দু মন্দির আক্রমণ করে, তাদের মধ্যে আটটি পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং ছয়টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এগুলোর মধ্যে আলী আকবর ডেলে ৫১টি হিন্দু বাড়ি এবং চৌফলদন্ডীতে আরো ৩০টি বাড়ি বিদ্যমান। [৯]
    • মিয়ানমারের ২৫০,০০০ রোহিঙ্গাদের এক তৃতীয়াংশ বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। [১০]

    পুরস্কার এবং স্বীকৃতি

    আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

    স্বাধীনতা দিবসের পুরস্কার

    প্রাপকএলাকাটীকা
    বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসংগঠন
    কাজী জাকের হোসেনশিক্ষা
    জহির রায়হানসাহিত্যমরণোত্তর

    একুশে পদক

    1. দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ (সাহিত্য)
    2. মোবাশ্বের আলী (সাহিত্য)
    3. এমাজউদ্দিন আহমদ (শিক্ষা)
    4. খান মোহাম্মদ সালেক (শিক্ষা)
    5. গিয়াস কামাল চৌধুরী (সাংবাদিকতা)
    6. আতাউস সামাদ (সাংবাদিকতা)
    7. শাহনাজ রহমতুল্লাহ (সঙ্গীত)
    8. আমজাদ হোসেন (নাটক)
    9. হাশেম খান (চারুকলা)

    খেলাধুলা

    • অলিম্পিক:
    • ঘরোয়া ফুটবল:
    • ক্রিকেট:
      • ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে ১৯৯২-৯৩ সার্ক চতুর্ভুজ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট বাংলাদেশের ঢাকায় ব্যাপক উৎসাহ ও উত্তেজনার মধ্য দিয়ে শুরু হয়। ৪টি দল নিয়ে এটি অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তানশ্রীলঙ্কার ‘এ’ দল এবং স্বাগতিক দেশের পূর্ণাঙ্গ জাতীয় দল এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। উপমহাদেশে উদ্ভুত অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে লিগ পর্যায়ে টুর্নামেন্টটি পরিত্যাগ করতে হয়। সুতরাং, টুর্নামেন্টের কোন বিজয়ী ছিল না।

    জন্ম

    মৃত্যু

    আরও দেখুন

  • বাংলাদেশের ইতিহাস

    বাংলাদেশের ইতিহাস

    একটি জনবহুল ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশটি বিশ্ব মানচিত্রে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়।

    প্রথমে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির আগমন ঘটে ১২০৪ শতকে। এ সময় তিনি বাংলার পশ্চিমে নদীয়া ও উত্তর বাংলার কিছুটা অংশ দখল করেন। তবে,১২০৬ সালে বিহার অভিযানে মারা যান।

    বাংলাদেশের সভ্যতার ইতিহাস চার সহস্রাব্দেরও বেশি সময় ধরে সেই ক্যালকোলিথিক যুগ থেকে চলে আসছে। দেশটির প্রারম্ভিক ইতিহাস হচ্ছে আঞ্চলিক আধিপত্যের জন্য হিন্দুবৌদ্ধ সাম্রাজ্যসমূহের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতার ইতিহাস।

    ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতাব্দীতে এ অঞ্চলে ইসলামের আগমণ ঘটে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বখতিয়ার খিলজীর নেতৃত্বে সামরিক বিজয়ের পাশাপাশি শাহ জালালের মতো সুন্নি দাঈদের নিরলস প্রচেষ্ঠায় ধীরে ধীরে ইসলাম এদেশে প্রভাবশালী ধর্ম হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে মুসলিম শাসকরা মসজিদ নির্মাণ করে ইসলাম প্রচারে অবদান রাখেন। চতুর্দশ শতাব্দী থেকে এই অঞ্চল শাহী বাংলা হিসেবে সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ কর্তৃক শাসিত হয় যা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে এবং আঞ্চলিক সাম্রাজ্যগুলোর উপর সামরিক আধিপত্যের সূচনা করে। ইউরোপীয়রা সেসময় এই শাহী বাংলাকে বাণিজ্যের জন্য সবচেয়ে ধনী দেশ বলে উল্লেখ করেন।[১] পরবর্তীতে এই অঞ্চলটি মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আসে এবং মুঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে ধনী প্রদেশ হিসাবে পরিগণিত হয়। বাংলা সুবাহ গোটা মুঘল সাম্রাজ্যের জিডিপির প্রায় অর্ধেক এবং বিশ্ব জিডিপির ১২% উৎপাদন করে যা সমগ্র পশ্চিম ইউরোপের থেকেও বেশী ছিল।[২][৩][৪][৫] এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি প্রাথমিক শিল্পায়ন যুগের সূচনা করে। এ সময় রাজধানী শহর ঢাকার জনসংখ্যা এক মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়।

    অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর বাংলা নবাবদের অধীনে একটি আধা স্বায়ত্তশাসিত রাস্ট্রে পরিণত হয় যার শাসনভার শেষ পর্যন্ত নবাব সিরাজউদ্দৌলার হাতে ন্যস্ত হয়। তারপর ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ অঞ্চল দখল করে। বাংলা সরাসরি ব্রিটেনের শিল্প বিপ্লবে অবদান রাখে কিন্তু এর ফলে তার নিজের শিল্পায়ন ধ্বংস হয়ে যায়।[৬][৭][৮][৯] পরবর্তীতে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি প্রতিষ্ঠিত হয়।

    ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে বাংলা ও ভারতের পৃথকীকরণের মাধ্যমে আধুনিক বাংলাদেশের সীমানা প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের ফলে এই অঞ্চলটি নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে পরিণত হয়।[১০]

    ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর নয় মাস ব্যাপী সংগঠিত হওয়া রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীনতার পর নতুন রাষ্ট্রটি দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ব্যাপক দারিদ্র্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামরিক অভ্যুত্থানের মত অসংখ্য সমস্যার মুখোখুখি হয়। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পরে দেশটিতে আপেক্ষিক শান্তি স্থাপিত হয় এবং দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মানবসম্পদ ও পোশাকশিল্পে অগ্রগতির মাধ্যমে বর্তমানে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় শীর্ষ অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়ে সমগ্র বিশ্বে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে।[১১][১২]

    বাংলা শব্দের উৎপত্তি

    মূল নিবন্ধ: বঙ্গদেশের নামসমূহ

    ৫৫১ খ্রিস্টাব্দে মহাজনপদবঙ্গ; অধুনা বঙ্গ বা বাংলা ভূমি ইতিহাসে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল , যা সুপ্রাচীন রাজ্য ও জনবসতি থেকে উদ্ভূত হয়।

    ‘বাংলা’ বা ‘বাংগালা’ শব্দটির সঠিক উৎপত্তিটি অজানা রয়েছে। সম্ভবত ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি এ অঞ্চলে বসবাসকারী দ্রাবিড় গোষ্ঠী ‘বঙ’ থেকে ‘বঙ্গ’ শব্দটির উদ্ভব হয়েছে। অন্যান্য সূত্র থেকে ধারণা করা হয় যে অস্ট্রিক জাতির সূর্যদেবতা “বোঙ্গা” থেকে বঙ্গ কথাটির উদ্ভব হয়েছে। মহাভারত, ভারতীয় পুরাণ ও হরিবংশের মতে রাজা বলির বঙ্গ নামে এক ক্ষেত্রজ পুত্র ছিলেন যিনি প্রাচীন ‘বঙ্গ রাজ্য’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।[১৩] রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় গোবিন্দের নেসারী শিলালিপিতে প্রথম ‘বঙ্গলা’ শব্দটির উল্লেখ রয়েছে যেখানে ধর্মপালকে ‘বঙ্গলার রাজা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একাদশ শতাব্দীতে বাংলা আক্রমণকারী চোল সাম্রাজ্যের রাজা প্রথম রাজেন্দ্র চোলার নথি নিশ্চিত করে যে, সে সময় গোবিন্দচন্দ্র বাংলার শাসক ছিলেন। সেই নথিতে বাংলাকে “বাঙ্গালা-দেশ” বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং বাংলার বর্ষাকালের স্পষ্ট বর্ণনাস্বরূপ লিপিবদ্ধ রয়েছে যে,বাঙ্গালা-দেশ যেখানে কখনও বৃষ্টি থামেনা[১৪] সুলতান ইলিয়াস শাহ “শাহ-ই-বাঙ্গালাহ” নামক উপাধি গ্রহণ করেন এবং তারপর থেকে সকল মুসলিম সূত্রেই বাংলাকে বাঙ্গালাহ বলা হয়েছে।[১৫]

    বর্তমান আধুনিক বাংলাদেশের কিছু অংশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশ নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বাংশে বঙ্গ রাজ্য গঠিত হয়েছিল। প্রাচীনকালে বাংলাদেশের দুটি প্রভাবশালী সম্প্রদায় ছিল বঙ্গ ও পুণ্ড্র[১৬]

    প্রাচীন বাংলা

    আরও দেখুন: বাংলার ইতিহাস

    মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত একটি প্রাচীন লিপি

    উয়ারি-বটেশ্বরের ধ্বংসস্তুপ

    প্রাক-ঐতিহাসিক বাংলা

    অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর পূর্বে বাংলা সম্পর্কে কোন ধরণের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়; এ সময় বাংলায় ইন্দো-আর্য, দ্রাবিড় ও মঙ্গোলয়েডদের অবাধ যাতায়াত ছিল এবং তাদেরই মধ্যে একটি সম্প্রদায়ের নাম ছিল বঙ্গ।[১৭]

    বাংলা বদ্বীপটি কয়েক সহস্রাব্দ ধরে ঘন জঙ্গল ও জলাভূমির দ্বারা গঠিত হয়েছে। এই অঞ্চলের একটি বড় অংশ সুদীর্ঘ সময় ধরে এভাবেই স্থায়ী ছিল। এরপর মানুষের পদচারণায় জঙ্গলের ক্ষতি সাধিত হয়। তবে মানুষ ঠিক কবে প্রথম বাংলায় প্রবেশ করে সে ব্যপারে গবেষকদের মধ্যে ঐকমত্য নেই। একদল গবেষক দাবি করেন যে, মানুষ ৬০,০০০ বছর আগে চীন থেকে বাংলায় প্রবেশ করেছিল। অন্য আরেকটি দলের মতে; ১০০,০০০ বছর আগে এখানে একটি স্বতন্ত্র আঞ্চলিক সংস্কৃতির উদ্ভব হয়েছিল। এই অঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের উপস্থিতির প্রমাণ খুবই দুর্বল।[১৮] এখানে নিওলিথিক ও ক্যালকোলিথিক যুগের মানুষের উপস্থিতির খুব একটা প্রমাণ মেলে না। ধারণা করা হয় যে, এই প্রমাণ না থাকার পেছনে নদীর গতিপ্রকৃতি পরিবর্তনই দায়ী।[১৭] বাংলাদেশের জলবায়ু ও ভৌগোলিক অবস্থান স্পৃশ্য প্রত্নতাত্ত্বিক অবশিষ্টাংশের জন্য উপযুক্ত নয়। পাথরের অভাবে প্রাচীন বাংলার মানুষ সম্ভবত কাঠ ও বাঁশের মতো উপকরণ ব্যবহার করত যা সময়ের সাথে সাথে টিকে থাকতে পারে নি। তাই দক্ষিণ এশিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিকরা বাংলাকে ব্যতিরেকে উপমহাদেশের অন্যান্য অংশের উপর চর্চা করছিলেন। আর যেসব প্রত্নতাত্ত্বিকরা বাংলার ব্যপারে আগ্রহী ছিলেন, তারাও প্রাচীন নয়, বরং বাংলার সাম্প্রতিক ইতিহাসের দিকে মনোনিবেশ করেন।[১৮]

    বাংলা বদ্বীপে যে প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলো পাওয়া গিয়েছে তার পুরোটাই এই বদ্বীপের চারপাশের পাহাড়গুলো থেকে। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের পূর্ব ভূখণ্ড বাংলার প্রাচীন লোকদের ব্যপারে তথ্য সরবরাহের সর্বোত্তম উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। লালমাই, সীতাকুণ্ড এবং চাক্লাপুঞ্জিতে জীবাশ্ম কাঠ তৈরীর ব্লেড, স্ক্র্যাপার ও কুঠার আবিষ্কৃত হয়েছে যা বার্মা ও পশ্চিমবঙ্গে প্রাপ্ত আবিষ্কারের অনুরূপ। এছাড়া উত্তর পূর্ব বাংলাদেশে বড় বড় প্রাগৈতিহাসিক পাথর পাওয়া গেছে। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের পূর্ব থেকেই এ অঞ্চলে কৃষিকাজের প্রচলন ছিল। পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ী কৃষি সমাজের প্রাচীনতম প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।[১৮]

    কৃষিক্ষেত্রে সাফল্য খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে একটি স্থির সংস্কৃতির জন্ম দেয়। ফলে একদিকে যেমন শহর-নগর গড়ে উঠে, অন্যদিকে সামুদ্রিক বাণিজ্য ও প্রাচীন রাজনীতিরও উদ্ভব হয়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা উয়ারী-বটেশ্বরে একটি বন্দর আবিষ্কার করেছেন যা প্রাচীন রোম ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে ব্যবসা বাণিজ্য করত। তারা সেখানে মুদ্রা, মৃৎশিল্প, লোহার তৈরী প্রত্নসম্পদ, ইটের রাস্তা ও একটি দুর্গ আবিষ্কার করেছেন। আবিষ্কারগুলো প্রমাণ করে যে, অঞ্চলটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র, যেখানে লোহা গলানো এবং মূল্যবান পাথরের পুঁতির মতো শিল্প ছিল। স্থানটিতে মাটির ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। মাটি ও ইট প্রাচীর নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত হত। মাটির তৈরি সবচেয়ে বিখ্যাত পোড়ামাটির ফলকগুলো চন্দ্রকেতুগড় থেকে এসেছে এবং তা দেবতা, প্রকৃতি ও সাধারণ জীবনের দৃশ্য চিত্রিত করেছে। উয়ারি-বটেশ্বর এবং চন্দ্রকেতুগড়ে (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) আবিষ্কৃত প্রাচীন মুদ্রাগুলোয় নৌকা চিত্রিত রয়েছে।[১৮]

    বাংলাদেশে সংগঠিত প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজগুলি ভারতীয় উপমহাদেশের NBPW যুগের (৭০০২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) নিদর্শন প্রকাশ করে। ভারতীয় উপমহাদেশে লৌহ যুগের সংস্কৃতি প্রায় ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শুরু হয় এবং ৫০০৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। উত্তর ভারতের ১৬টি মহা রাজ্য বা মহাজনপদের উত্থান এবং মৌর্য সাম্রাজ্যের পরবর্তী উত্থানের মধ্যবর্তী সময়ে এই যুগ বিরাজমান ছিল।[১৯] প্রাচীন ভারতের পূর্বাঞ্চল, বর্তমান সময়ের বাংলাদেশ বা প্রাচীণ বঙ্গ রাজ্য এই মহাজনপদগুলির অংশ ছিল, যা ষষ্ঠ শতকে সমৃদ্ধ হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।[২০]

    ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাম্রলিপ্তি (বর্তমান তমলুক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত), মহাস্থান এবং ময়নামতীর মতো উন্নত শহর গড়ে উঠে। এক্ষেত্রে প্রধান প্রধান শহরগুলো সমুদ্রতীরের পরিবর্তে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠতে দেখা যায়।[১৭] মহাস্থান থেকে বাংলাদেশের প্রাচীনতম লেখা একটি পাথরের শিলালিপি আবিস্কৃত হয় যা থেকে বোঝা যায় যে, স্থানটি মৌর্য সাম্রাজোর একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল। মহাস্থান তখন একটি প্রাদেশিক কেন্দ্র ছিল বলে ধারণা করা হয়। প্রাকৃত ভাষায় লেখা এই শিলালিপিতে জরুরী পরিস্থিতিতে সরবরাহ মজুত করার আদেশ রয়েছে। শিলালিপিটির নাম মহাস্থান ব্রাহ্মী শিলালিপি। বাংলা ছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমান্ত। সে সময় পশ্চিমবঙ্গের তাম্রলীপ্তি ছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দর।[১৮]

    বাংলার প্রাচীন অঞ্চলগুলো হচ্ছে ভাগীরথী-হুগলী অববাহিকা, হরিকেল, সমতট, বঙ্গবরেন্দ্র[২১] বঙ্গ ছিল বাংলার মধ্যাঞ্চল, হরিকেল ও সমতট বাংলার পূর্বাঞ্চল এবং বরেন্দ্র ছিল বাংলার উত্তরাঞ্চল। স্থানগুলোর নাম এই ইঙ্গিত দেয় যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তিব্বতী-বার্মান, অস্ট্রো-এশীয় এবং দ্রাবিড় ভাষায় কথা বলতেন। ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে এখানে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা লক্ষণীয় হয়ে উঠে।[১৮]

    ভাষাগতভাবে, এই ভূখণ্ডের প্রাচীনতম জনগোষ্ঠী হয়তো দ্রাবিড় ভাষায় কথা বলত যেমন কুরুক্স, বা সম্ভবত অস্ট্রো-এশীয় ভাষায় কথা বলত যেমন সাঁওতাল। পরবর্তীকালে, তিব্বতী-বার্মানের মতো অন্যান্য ভাষা পরিবারের লোকেরা বাংলায় বসতি স্থাপন করে। সপ্তম খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল মগধের অংশ হিসেবে ইন্দো-আর্য সভ্যতার অংশ হয়ে উঠেছিল। নন্দ রাজবংশ হচ্ছে প্রথম ঐতিহাসিক রাষ্ট্র যা ভারতী-আর্য শাসনের অধীনে বাংলাদেশকে একত্রিত করেছিল। পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্মের উত্থানের পর অনেক পুরোহিত ধর্ম বিস্তারের জন্য এখানে বসতি স্থাপন করেছিল এবং মহাস্থানগড়ের মতো অনেক স্তম্ভ স্থাপন করেছিল।

    প্রথমদিকের উপনিবেশায়ন

    বাঙ্গালী জাতি প্রাচীন ভারতের একটি পরাক্রমশালী সমুদ্র অভিযাত্রী জাতি ছিল। শুধু বাঙ্গালী জাতিই নয়, প্রাচীনকালে ভারতের পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জাতি, যেমন বাঙ্গালী, কলিঙ্গী, তামিল প্রভৃতি জাতি দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় নানা উপনিবেশ গড়ে তুলতেন। তারা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে এরকম একটি বিরাট সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। এটি শ্রী বিজয় সাম্রাজ্য নামে পরিচিত। ভিয়েতনামের ইতিহাসে উল্লেখ আছে ভারতবর্ষের বন-লাং (বাংলা) নামক দেশ থেকে লাক লোং (লক্ষণ?) নামক এক ব্যক্তি ভিয়েতনামে গিয়ে “বন-লাং” নামে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই বন-লাং যে ভারতবর্ষের বাংলা সে ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। এই বাঙালীদের রাজ্য খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।[২২] অপরদিকে শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে উল্লেখ আছে বঙ্গ দেশ থেকে আগত বিজয় সিংহ নামে এক ব্যক্তি স্থানীয় দ্রাবিড় রাজাদের পতন ঘটিয়ে সিংহল (সিংহ বংশীয়) নামে একটি নতুন রাজ্যের পত্তন করেন। বিজয় সিংহকে সিংহলী জাতির পিতা হিসেবে পরিগণিত করা হয়। বিজয় সিংহকে নিয়ে শ্রীলঙ্কায় একটি মহাকাব্যও রয়েছে যা “মহাবংশ” নামে পরিচিত।[২৩]

    নন্দ সাম্রাজ্য

    মূল নিবন্ধ: নন্দ সাম্রাজ্য

    নন্দ সাম্রাজ্য ছিল বাংলার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় যুগ। এই যুগে বাংলার শক্তিমত্তা ও প্রাচুর্য শীর্ষে আরোহণ করে। এই যুগে বাংলা সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়। নন্দ রাজাদের জন্ম হয়েছিল বাংলায়। তারা বাংলা থেকে মগধ (বিহার) দখল করে এবং উভয় রাজ্যকে ঐক্যবদ্ধ করে বঙ্গ-মগধ নামে একটি নতুন সাম্রাজ্যের পত্তন করে। প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসে বাংলাকে গঙ্গারিডাই এবং মগধকে প্রাসি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। গ্রিক ইতিহাসে এই সংযুক্ত রাজ্যকে গঙ্গারিডাই ও প্রাসি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

    মহাপদ্ম নন্দ ছিলেন নন্দ বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট। তিনি সমগ্র ভারতবর্ষ ব্যাপী ব্যাপক সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি কোশল (উত্তর প্রদেশ), কুরু (পূর্ব পাঞ্জাব), মৎস্য (রাজপুতানা), চেদী (মধ্য প্রদেশ ও বিহারের মধ্যস্থিত জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চল),অবন্তী (মধ্য প্রদেশ) প্রভৃতি অঞ্চল জয় করেন। দিগ্বিজয়ার্থে মহাপদ্ম এক বিশাল সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করেন। তৎকালীন ইতিহাস অনুসারে মহাপদ্মের অধীনে ২,০০,০০০ পদাতিক, ২০,০০০ অশ্বারোহী, ৪,০০০ যুদ্ধরথ ও ২,০০০ হস্তীবাহিনী ছিল। মতান্তরে তার নিকট ২,০০,০০০ পদাতিক, ৮০,০০০ অশ্বারোহী, ৮,০০০ যুদ্ধরথ ও ৬,০০০ হস্তীবাহিনী ছিল।

    “কথাসরিৎ সাগর” থেকে জানা যায় তিনি দক্ষিণ ভারতেরও বিরাট অংশ জয় করেছিলেন। তিনি দক্ষিণ ভারতের কলিঙ্গ ও অশ্মক এ রাজ্য দুটো জয় করেছিলেন। অশ্মক হচ্ছে মহারাষ্ট্রের পূর্ব অংশে একটি প্রাচীন রাজ্যের নাম। এটি দক্ষিণ ভারতে আর্যদের একটি বিখ্যাত উপনিবেশ ছিল। কলিঙ্গ হচ্ছে উড়িষ্যার প্রাচীন নাম। কলিঙ্গের হস্তিগুম্ফ শিলালিপি থেকে জানা যায় মহাপদ্ম কলিঙ্গে জল সেচের জন্য একটি বিরাট জল প্রণালী নির্মাণ করেছিলেন। তিনি কলিঙ্গ থেকে একটি জৈন তীর্থঙ্করের মূর্তিও রাজধানীতে নিয়ে যান। মহাপদ্ম ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথমবারের মত একটি বৃহৎ সাম্রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হন। সমগ্র ভারতবর্ষ জয় করে তিনি একরাট উপাধি গ্রহণ করেন। পরে তাকে অনুসরণ করে পশ্চিম ভারতের রাজারা বিরাট ও দক্ষিণ ভারতের রাজারা সম্রাট উপাধি গ্রহণ করে।

    মহাপদ্ম নন্দের পর ক্ষমতায় আসীন হন তার পুত্র ধননন্দ বা উগ্রনন্দ। ধননন্দের সময় রাজ্যে ব্যাপক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেখা দেয়। ধননন্দের সময়ে পাটলিপুত্রে পাঁচটি ধর্মস্তূপ নির্মিত হয়েছিল। প্রাচীণ ভারতের বিভিন্ন ইতিহাসে ধননন্দকে অর্থপিপাসু রূপে উল্লেখ করা হয়েছে।

    উগ্রনন্দের বা ধননন্দের সময় গ্রিক সম্রাট আলেকজাণ্ডার ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন। কিন্তু উগ্রনন্দ একটি বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে আলেকজাণ্ডারের মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হন। প্লুতার্ক বলেছেন, রাজা পুরুষোত্তমের (পোরাস) সাথে যুদ্ধের পর মেসিডোনিয়ার সৈন্যরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, এবং ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে আরও প্রবেশের জন্য অনিচ্ছুক হয়ে পড়ে। তারা জানতে পারে গঙ্গা নদী যা ২৩০ স্টেডিয়া বিস্তৃত ছিল এবং ১০০০ ফুট গভীর ছিল, তার পাশের সমস্ত তীর সশস্ত্র যোদ্ধা, ঘোড়া এবং হাতি দ্বারা সম্পূর্ণভাবে আবৃত ছিল। গঙ্গারিডাই ও প্রাসি এর রাজা তার (আলেকজান্ডার) জন্য ২,০০,০০০ পদাতিক, ৮০,০০০ অশ্বারোহী বাহিনী, ৮,০০০ যুদ্ধরথ ও ৬,০০০ হস্তিবাহিনী নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন।[২৪]

    মৌর্য সাম্রাজ্য

    মূল নিবন্ধ: মৌর্য সাম্রাজ্য

    মৌর্য সাম্রাজ্যেরশাসনকালে মহাস্থান (পুণ্ড্রনগর) কেন্দ্রীয় অঞ্চল ছিল বলে ধারণা করা হয়। তৃতীয় মৌর্য সম্রাট অশোকের ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা শিলালিপি এখানে পাওয়া গিয়েছে।

    কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে (মৌর্য শাসনকালীন গ্রন্থ) বলেছেন, পুণ্ড্রের কৌষেয় বস্ত্র মরকত মণির মতো মসৃণ। একে পৌণ্ড্রিকা বলা হয়েছে।[২৫] এ ধরনের বস্ত্র শুধু মগধ ও পুণ্ড্রে উৎপন্ন হতো বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ গ্রন্থে বঙ্গের এক প্রকার বস্ত্রকে “বাঙ্গিকা” বলা হয়েছে যা শ্বেত বর্ণের হতো।[২৬] সর্বোপরি এ গ্রন্থে বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পের প্রশংসা করা হয়েছে।

    ধ্রুপদী যুগ

    গৌড় সাম্রাজ্য

    মূল নিবন্ধ: গৌড়

    ষষ্ঠ শতকের মধ্যে উত্তর ভারত শাসনকারী বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্য বিভিন্ন খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এগুলোর মধ্যে মগধ (বিহার) ও মালব (মধ্য প্রদেশ) এ রাজ্য দুটি গুপ্ত বংশের দুটি শাখা দ্বারা শাসিত ছিল। অপর দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য ছিল উত্তর প্রদেশের মৌখরী রাজ্য এবং পাঞ্জাবের পুষ্যভূতি রাজ্য। শশাঙ্ক ছিলেন মগধের গুপ্ত সম্রাট মহাসেন গুপ্তের একজন সীমান্তবর্তী মহাসামন্ত। মহাসেন গুপ্তের পর তিনি বাংলার ক্ষমতা দখল করেন এবং গৌড়ের কর্ণসূবর্ণে তার রাজধানী স্থাপন করেন। শশাঙ্ক ৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে উড়িষ্যা আক্রমণ করেন এবং সেখানকার শৈলোদ্ভব বংশীয় রাজাকে পরাজিত করে উড়িষ্যা দখল করেন । এ সময় উত্তর ভারত দখলের জন্য বিভিন্ন সাম্রাজ্যের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দিতা শুরু হয়। মালবের রাজা দেবগুপ্ত মৌখরী রাজা গ্রহবর্মণকে পরাজিত করে কনৌজ দখল করেন। কিন্তু একই সময় পুষ্যভূতির রাজা রাজ্যবর্ধন দেবগুপ্তকে আক্রমণ করে তাকে পরাজিত করেন। এ সময় শশাঙ্ক কনৌজ আক্রমণ করেন। তিনি কনৌজের অধিকারী রাজ্যবর্ধনকে পরাজিত ও নিহত করে ক্ষমতা দখল করেন। রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তার ভাই ও উত্তরাধিকারী হর্ষবর্ধন এক বিপুল বাহিনী গঠন করেন। শশাঙ্ক হর্ষবর্ধনের সাথে সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করেন। কিন্তু হর্ষবর্ধন ছিলেন অত্যধিক শক্তিশালী যোদ্ধা। ছয় বৎসর ধরে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করার পর শশাঙ্ক শেষ পর্যন্ত পরাজিত হন। হর্ষবর্ধন বাংলার রাজধানী গৌড় দখল করে নেন। এভাবে বাংলার ক্ষণস্থায়ী গৌড় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।

    পাল রাজবংশ

    মূল নিবন্ধ: পাল সাম্রাজ্য

    পাল সাম্রাজ্যের যুগ ছিল বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল যুগ। এ সময় বাংলার ইতিহাসে আবার দিগ্বিজয়ের সূচনা হয়। পাল রাজাগণ জন্মগ্রহণ করেছিলেন উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্র অঞ্চলে। একারণে পাল শিলালিপিতে বরেন্দ্রকে জনকভূ বা রাজ্যাম পিত্রাম বলা হয়েছে। পাল সাম্রাজ্যের রাজাগণ ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। পাল রাজাগণ ছিলেন প্রথমত বৌদ্ধধর্মের মহাযান ও পরবর্তীতে তান্ত্রিক শাখার অনুসারী। পাল বংশীয় রাজাগণ উত্তর ভারতের রাজনৈতিক কেন্দ্রভূমি কনৌজ দখলের জন্য রাজপুতানার গুর্জর এবং দক্ষিণ ভারতের রাষ্ট্রকূটদের সাথে এক প্রচণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হন। এই ভয়ঙ্কর ও ত্রিপক্ষীয় যুদ্ধ পরবর্তী দুই শত বৎসর অব্যাহত থাকে।

    পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা গোপাল। তিনি ৭৭০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৭৯০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা দেশ শাসন করেন। গোপালের আগমনের পূর্বে বাংলাদেশ পাচটি খণ্ডে বিভক্ত ছিল যথা- অঙ্গ, বঙ্গ, গৌড়, সুহ্মসমতট। গোপাল এই সমস্ত খণ্ডকে ঐক্যবদ্ধ করেন ও বাংলাদেশে শান্তি শৃঙ্খলা আনয়ন করেন।[২৭] গোপাল বিহার, উড়িষ্যা ও কামরূপও দখল করেন। এরপর গোপাল উত্তর ভারতের রাজধানী কনৌজ অক্রমণ করেন। তিনি কনৌজের আয়ুধ বংশীয় রাজা বজ্রায়ুধকে পরাজিত করে কনৌজ দখল করেন। কিন্তু গুর্জর রাজা বৎসরাজের নিকট তিনি পরাজিত হন। বৎসরাজ পরবর্তীতে রাষ্ট্রকূট রাজা ধ্রুব ধারাবর্ষের নিকট পরাজিত হন। ফলে গোপাল তার সাম্রাজ্য রক্ষা করতে সক্ষম হন।

    গোপালের পুত্র ধর্মপাল (৭৯০-৮১০) ছিলেন একজন সুদক্ষ ও পরাক্রমশালী সম্রাট। তিনি উত্তর ভারতে আক্রমণ করেন এবং গুর্জর রাজা নাগভট্টকে পরাজিত করে কনৌজ দখল করেন। তিনি সমগ্র উত্তর ভারতব্যাপী বিশাল সামরিক অভিযান প্রেরণ করেছিলেন। খালিমপুর তাম্রশাসন থেকে জানা যায় তিনি মদ্র (পাঞ্জাব), গান্ধার (খাইবার প্রদেশ), মৎস্য ([[রাজস্থান|রাজপুতানা), যদু(গুজরাত), অবন্তী (মধ্য প্রদেশ) প্রভৃতি অঞ্চল বিজয় করেছিলেন।[২৮] কিন্তু এ অঞ্চলগুলো তিনি শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেন নি। ধর্মপাল সেনাপতি লাউসেনের নেতৃত্বে রাষ্ট্রকূট রাজাকে পরাজিত করে উড়িষ্যা পুনর্দখল করতে সক্ষম হন। এই ঘটনাটি তৎকালীন বিখ্যাত মহাকাব্য ধর্ম মঙ্গলে উল্লেখ আছে।

    ধর্মপালের সুযোগ্য পুত্র দেবপাল (৮১০-৮৫০) পুনরায় সমগ্র ভারতব্যাপী তার অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি উত্তর-পূর্ব ভারতে কম্বোজ (কাশ্মীর) পর্যন্ত তার সমরাভিযান পরিচালনা করেন। দেবপাল গুর্জর রাজা রামভদ্রকে পরাজিত করে তাকে করদ রাজ্যে পরিণত করেন। বিন্ধ্যা পার্বত্য অঞ্চল বিজয় করে তিনি মালব ও গুজরাত দখল করেন।[২৯] কিন্তু এ অঞ্চলগুলো পরবর্তীতে তিনি মিহির ভোজ|মিহির ভোজের কাছে হারিয়ে ফেলেন। দেবপালের দাক্ষিণাত্য অভিযান সফল হয়েছিল। তার নির্দেশে ভ্রাতা জয়পাল রাষ্ট্রকূট রাজা অমোঘবর্ষকে পরাজিত করে উড়িষ্যা পুনর্দখল করেন। এরপর উড়িষ্যা চিরস্থায়ীভাবে পাল সাম্রাজ্যের শাসনাধীনে ছিল।

    পাল সম্রাটগণ বহু বৌদ্ধবিহার ও ধর্মীয় পীঠস্থান নির্মাণ করেছিলেন। বিক্রমশীল, ওদন্তপুরী ও জগদ্দল প্রভৃতি বৃহদায়তন মহাবিহার পাল স্থাপত্যের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। পাল সম্রাটগণ প্রথমত “মহাযান” বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন। পরবর্তীতে পালগণ হিন্দুদের বৌদ্ধধর্মে আকৃষ্ট করার জন্য তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তন করেন। বহু হিন্দু দেবদেবীকে এই ধর্মে স্থান দেওয়া হয়। পাল সম্রাটগণ সংস্কৃত বা পালি ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। পাল রাজাদের সময়ই বাংলা সাহিত্যের প্রাচীণতম নিদর্শন চর্যাপদসমূহ রচিত হয়। তাই পাল রাজবংশকে অনেক সময় বাংলা সাহিত্যের জনক মনে করা হয়।

    সেন রাজবংশ

    মূল নিবন্ধ: সেন রাজবংশ

    সেন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিজয়সেন প্রাথমিক জীবনে পাল রাজাদের অধীনে দক্ষিণবঙ্গের এক সামন্তপ্রভু ছিলেন। পরে তিনি নিজ বাহুবলে সাম্রাজ্য বিস্তার করে পূর্ববঙ্গের বর্মণ রাজাদের পরাজিত করেন। তিনি উত্তরবঙ্গের এক যুদ্ধে পাল সম্রাট মদনপালকে পরাজিত করে রাজধানী গৌড় দখল করেন। তিনি ত্রিহুত (উত্তর বিহার) ও কামরূপও (পশ্চিম আসাম) জয় করে নেন। তবে তিনি দক্ষিণ বিহার জয় করতে ব্যর্থ হন। পাল রাজাগণ এখানে গাহড়বাল সাম্রাজ্যের সহায়তায় নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। বিজয়সেন শৈব ধর্মের ধর্মের অনুসারী ছিলেন। তার সময় কনৌজ, অযোধ্যা ও হরিদ্বার থেকে যেসমস্ত কায়স্থ এদেশে আসেন তারাই মূলত বাঙালী কায়স্থদের আদিপুরুষ।

    বল্লাল সেন বিজয়সেনের পর বাংলার সিংহাসনে আসীন হন। বল্লাল সেন তার রাজ্যের প্রায় ১,০০০ ব্রাহ্মণকে চিহ্নিত করেন। এদেরকে রাজ পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে সংবদ্ধ করা হয় এবং এদের উচ্চ পদ মর্যাদা প্রদান করা হয়। এই মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ রাজ্যে কুলীন নামে পরিচিত হয়। বল্লাল সেন একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি দানসাগর ও অদ্ভুতসাগর নামে দুইটি গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থ দুটো থেকে তার অভূতপূর্ব প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। বল্লাল সেনের সময় বঙ্গদেশে শৈব, বৈষ্ণব, তান্ত্রিক প্রভৃতি বিভিন্ন মতবাদ দেখা দেয়। বল্লালসেন ব্যক্তিগতভাবে তান্ত্রিক মতের পৃষ্ঠপোষকতা করেন, যদিও তার পিতা বিজয়সেন শৈব মতের অনুসারী ছিলেন।

    বল্লাল সেনের পর তার পুত্র লক্ষণ সেন সিংহাসনে আসীন হন। পিতার মত লক্ষণ সেনও সাহিত্য ও বিদ্যানুরাগী ব্যক্তি ছিলেন। তার সময়ে রাজ্যে বহু প্রতিভাবান কবির আবির্ভাব হয়। যেমন শরণ, হলায়ুধ, উমাপতিধর প্রমুখ। ধর্মীয় মতের দিক থেকে লক্ষণ সেন ছিলেন বৈষ্ণব। আনুলিয়ায় প্রাপ্ত তাম্র শাসনে লক্ষণ সেনকে পরমবৈষ্ণব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। লক্ষণ সেনের সময় বখতিয়ার খিলজী বাংলা আক্রমণ করেন। এসময় লক্ষণ সেন নদীয়ার একটি তীর্থকেন্দ্রে অবস্থান করছিলেন। ১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজী অতর্কিতে নদীয়া আক্রমণ করেন যার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। লক্ষণ সেন পূর্ব বঙ্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন, মুসলমানরা পূর্ববঙ্গ জয় করতে ব্যর্থ হয়।

    দেব রাজত্ব

    মূল নিবন্ধ: দেব রাজবংশ

    দেব রাজ্য ছিল বাংলার দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে আরাকানের দান্যবতী বংশের একটি রাজ্য। এই রাজ্যটি বিস্তৃত ছিল আরাকান হতে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এবং এর রাজধানী ছিল চট্টগ্রামে। কিন্তু স্থানীয় বাঙালী প্রভাবে দেব রাজাগণ বাঙ্গালী ও হিন্দু হয়ে পড়ে। এই রাজবংশের প্রথম শাসক ছিলেন পুরুষোত্তম দেব, যিনি প্রথম জীবনে একজন সাধারণ গ্রামিক (গ্রাম প্রধান) ছিলেন এবং পরবর্তীতে তিনি সেন সম্রাটদের অধীনে দক্ষিণাঞ্চলের প্রাদেশিক শাসনকর্তার পদে উন্নীত হন। তার পুত্র মধুসূদন দেব প্রথম সেন সাম্রাজ্যের হাত থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে নৃপতি উপাধি ধারণ করেন। দামোদর দেব এই রাজবংশের একজন শক্তিশালী শাসক ছিলেন। তার রাজত্ব বর্তমান কুমিল্লা-নোয়াখালী-চট্টগ্রাম অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।[৩০]

    এই রাজবংশের পরবর্তী শাসক দশরথ দেব এই বংশের সবচেয়ে পরাক্রমশালী শাসক ছিলেন। তিনি সেন সাম্রাজ্যের অবসান ঘটান এবং সমগ্র পূর্ববঙ্গ ( ঢাকা-ময়মনসিংহ-খুলনা) অঞ্চল দখল করে নেন। তিনি দিল্লীর সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের সাথে মিত্রতা করে আগ্রাসনকারী মুঘীসউদ্দীন তুঘরলকে পরাজিত করেন এবং বাংলার হিন্দু সাম্রাজ্যের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করেন। এ উপলক্ষে তিনি দনুজ মর্দন দেব উপাধি গ্রহণ করেন। গিয়াসউদ্দীন বলবনের ইতিহাসে তাকে দনুজ রায় বলে অভিহিত করা হয়েছে। দেব বংশ আরও কিছুকাল তার স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। যদিও এই সময়কার রাজাদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। অবশেষে বাংলার মাহমুদ শাহী সুলতান ফিরোজ শাহের আক্রমণে দেব রাজবংশের পতন হয়।

    মধ্যযুগ এবং ইসলামী শাসন

    সপ্তম শতাব্দীতে আরব মুসলিম ব্যবসায়ী ও সুফি ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে বাংলায় প্রথম ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছিল। দ্বাদশ শতকে মুসলিমরা বাংলায় বিজয় লাভ করে এবং তারা ঐ অঞ্চলে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১২০২ সালের শুরুর দিকে দিল্লী সালতানাত থেকে একজন সামরিক অধিনায়ক বখতিয়ার খিলজী বাংলা ও বিহারকে পরাজিত করেছিলেন। প্রথমদিকে বাংলা তুর্কী জাতির বিভিন্ন গোত্র দ্বারা শাসিত হয়েছিল। পরবর্তীতে আরব, পারসীয়, আফগান, মুঘল প্রভৃতি অভিযানকারী জাতি দ্বারা বাংলা শাসিত হয়। মুসলিম শাসকদের অধীনে বাংলা একটি নতুন যুগে প্রবেশ করেছিল। কারণ শহরগুলো উন্নত হয়েছিল; প্রাসাদ, দুর্গ, মসজিদ, সমাধিসৌধ এবং বাগান; রাস্তা এবং সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল; এবং নতুন বাণিজ্য পথগুলো সমৃদ্ধি ও নতুন সাংস্কৃতিক জীবন বয়ে নিয়ে এসেছিল।

    খিলজী শাসন

    মূল নিবন্ধ: খিলজী শাসন

    বখতিয়ার খিলজী ১১৯৯ খ্রিষ্টাব্দে বিহার আক্রমণ করেন। তিনি বিহারের পাল রাজবংশের অবশিষ্টাংশের পতন ঘটিয়ে বিহার দখল করেন। বখতিয়ার খিলজী এরপর বাংলা আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি ১২০৪ সালে ১৭ সৈন্যের এক দুর্ধর্ষ অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে তীর্থকেন্দ্র নদীয়ায় আক্রমণ করেন। লক্ষণ সেন পলায়ন করেন এবং তিনি পূর্ব বঙ্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। মুসলমানদের কোন নৌবাহিনী না থাকায় তারা পূর্ববঙ্গ দখল করতে পারেনি। উচ্চাভিলাষী বখতিয়ার এরপর তিব্বত আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১২০৬ সালে এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে তিনি তিব্বতে আক্রমণ করেন। এবং তিব্বতের কারামাত্তান নগর পর্যন্ত অগ্রসর হন। কিন্তু প্রচণ্ড শীত ও রসদপত্রের অভাবে বখতিয়ার খিলজীর এ অভিযান শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।[৩১]

    বখতিয়ার খিলজীর মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলার উদ্ভব হয়। বখতিয়ারের অন্যতম সহকারী শিরণ খিলজী নিজেকে বাংলার সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন। কিন্তু সিংহাসনের অপর দাবিদার মর্দান খিলজী শিরণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। শিরণ মর্দানকে পরাজিত ও বন্দি করেন। মর্দান খিলজী দিল্লীর সম্রাট কুতুবউদ্দিন আইবেককে বাংলা আক্রমণের জন্য আহ্বান জানান। আইবেকের সেনাপতি কায়েমাজ রূমী শিরণকে পরাজিত করে বাংলা দখল করেন, এবং মর্দান খিলজীকে বাংলার গভর্নর নিয়োগ করা হয়।[৩২] মর্দান প্রথমত দিল্লীর অধীনস্থ থাকেন, কিন্তু কুতুবউদ্দীন আইবেকের মৃত্যুর পর তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মর্দান ক্রমশ অত্যাচারী হয়ে উঠলে খিলজী অমাত্যগণ তাকে হত্যা করেন এবং ইওয়াজ খিলজীকে বাংলার সুলতান মনোনীত করেন।

    ইওয়াজ খিলজী একজন সুদক্ষ ও রণকুশলী সম্রাট ছিলেন। তিনি একটি নৌবাহিনী গঠন করেন এবং এই নৌবাহিনীর সাহায্যে তিনি বঙ্গ দখল করেন। তিনি বিহার, উড়িষ্যা ও কামরূপও (পশ্চিম আসাম) দখল করেন। কিন্তু ইওয়াজ এইসমস্ত রাজ্য সরাসরি রাজ্যভুক্ত করেননি, তিনি এই রাজ্যগুলোকে সামন্ত রাজ্যের মর্যাদা প্রদান করেন।[৩২] ইওয়াজের এই রাজ্য বিস্তারের ফলে ১২২৫ সালে দিল্লীর সুলতান শামসউদ্দীন ইলতুতমিশ তার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। যুদ্ধে ইওয়াজ পরাজিত হন। কিন্তু ইলতুতমিশ দিল্লী প্রত্যাবর্তন করলে ইওয়াজ পুনরায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এবার যুদ্ধে ইলতুতমিশের পুত্র মাহমুদ নেতৃত্ব দেন, এবং যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ইওয়াজের পরাজয় ও মৃত্যু ঘটে।

    মামলুক শাসন

    মূল নিবন্ধ: মামলুক শাসন (বাংলা)

    মামলুকগণ ছিলেন তুর্কী জাতির একটি বিশেষ ধরনের ভাড়াটে সেনাবাহিনী। দিল্লীতে এই সময় মামলুকগণই অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং দিল্লী কর্তৃক নিয়োগকৃত বাংলার সকল গভর্নরগণও ছিলেন মামলুক। বাংলার মামলুক সুলতান তুগরল তুগান খান ১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীর বিরুেদ্ধ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি শুধু বাংলার উপরই আধিপত্য বিস্তার করলেন না, তদুপরি এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে পশ্চিমাঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করেন এবং বিহারবদায়ুন অঞ্চল নিজের শাসনাধীনে আনেন।[৩৩] যাই হোক দিল্লীর শাসনকর্তা তমর খানের নির্দেশে এক সেনাবাহিনী বাংলার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। তুঘান খান পরাজিত হন এবং শেষ পর্যন্ত দিল্লীর শাসন মেনে নেন।

    ১২৫১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার গভর্নর মুগীসউদ্দীন ইউজবাক স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ইউজবাক বাংলার দক্ষিণ দিক হতে আগত উড়িষ্যার একটি আক্রমণ প্রতিহত করেন। তিনি উড়িষ্যার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এর রাজধানী লুণ্ঠন করেন এবং একটি শ্বেত হস্তীও লাভ করেন। তুঘানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইউজবাক বিহারআউয়াধ দখল করেন।[৩৪] এর ফলে তিনি পূর্ব ভারতব্যাপী এক বিরাট সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে পড়েন। ইউজবাক যতদিন জীবিত ছিলেন দিল্লীর সম্রাট ততদিন পর্যন্ত তাকে পরাজিত করতে পারেননি। ইউজবাক উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আসামও দখল করেন। কিন্তু আসামের একটি বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে তিনি নিহত হন।

    দিল্লীর সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের সময় বাংলার গভর্নর মুগীসউদ্দীন তুঘরল বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি সমগ্র বাংলাবিহারের ওপর আধিপত্য স্থাপন করে উড়িষ্যা আক্রমণ করেন এবং তা তার সাম্রাজ্যভূক্ত করেন। সম্রাট বলবন মালিক তুরমতীকে এক বিরাট বাহিনী দিয়ে বাংলার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। কিন্তু তিনি মুঘিসউদ্দীন তুঘরলের হাতে পরাস্ত হন। বলবন এবার দ্বিতীয় অভিযান প্রেরণ করেন সেনাপতি শিহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে। কিন্তু তিনিও তুঘরলের হাতে পরাজিত হন।[৩৪] এর ফলে বলবন ১২৮০ সালে এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে স্বয়ং বাংলা অভিযান করেন। তুঘরল প্রবল পরাক্রমের সাথে যুদ্ধ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন।

    মাহমুদ শাহী রাজবংশ

    মূল নিবন্ধ: মাহমুদ শাহী রাজবংশ

    সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের মৃত্যুর পর তার পুত্র বুঘরা খান বাংলা দেশে একটি স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন। তিনি মাহমুদ শাহ উপাধি গ্রহণ করেন, এজন্য তার বংশ মাহমুদ শাহী বংশ নামে পরিচিত হয়ে থাকে। দিল্লীর সম্রাট ছিলেন মাহমুদ শাহের পুত্র কায়কোবাদ। কিন্তু তিনি দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী নিজামউদ্দীনের হাতের ক্রীড়ানক হয়ে পড়েন। মাহমুদ শাহ তার পুত্রকে উদ্ধারের জন্য এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে দিল্লীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। দিল্লীর উজির নিজামউদ্দীন এক বিরাট বাহিনী নিয়ে সরযু নদীর তীরে তার গতিরোধ করেন।[৩৫] যাই হোক বাংলা ও দিল্লীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ না হয়ে উভয়পক্ষের মধ্য সমঝোতা হয়। মাহমুদ শাহ তার বাহিনী নিয়ে লখনৌতিতে ফিরে আসেন ও সগৌরবে রাজত্ব করতে থাকেন। অপরদিকে দিল্লীতে তার নির্দেশে সুলতান কায়কোবাদ মন্ত্রী নিজামউদ্দীনকে পদচ্যুত করে রাষ্ট্রকে নিষ্কণ্টক করেন।

    মাহমুদ শাহের পর তার পুত্র রুকুনউদ্দীন কায়কাউস বাংলার সিংহাসনে আসীন হন। রুকুনউদ্দীন কায়কাউসের সময় দিল্লীর সুলতান ছিলেন আলাউদ্দীন খিলজী। ১৩০১ সালে আলাউদ্দীন খিলজী বাংলা আক্রমণ করেন। যুদ্ধে কায়কাউস পরাজিত ও নিহত হন। খিলজী কায়কাউসের ভাই ফিরোজ শাহকে তার গভর্নর হিসেবে বাংলার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেন। ফিরোজ শাহ একজান খ্যাতিমান বিজেতা ছিলেন। তিনি খিলজীর নির্দেশে পূর্ববঙ্গ আক্রমণ করেন এবং দেব বংশকে সমূলে উৎখাত করেন। এর ফলে পূর্ববঙ্গ চিরস্থায়ী ভাবে মুসলিন শাসনাধীনে চলে আসে।[৩৬] তার সময়েই বিখ্যাত আউলিয়া শাহ জালাল বঙ্গদেশে আগমন করেছিলেন এবং সিলেট জয় করেছিলেন। আলাউদ্দীন খিলজীর মৃত্যুর পরে তিনি স্বাধীনতা অর্জন করেন এবং কিছুদিন স্বাধীনভাবে রাজকার্য করার পর মৃত্যুবরণ করেন।

    ফিরোজ শাহের পর তার পুত্র ও উত্তরাধিকারী বাহাদুর শাহ সমগ্র বাংলার অধিপতি হন। কিন্তু এ সময় দিল্লীর তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠাতা গিয়াসউদ্দীন তুঘলক বাংলাদেশে সমরাভিযান করেন। ষড়যন্ত্রকারী ভ্রাতা নাসিরউদ্দীন ইব্রাহীমের সহায়তায় রাজধানী লখনৌতি আক্রমণ করেন এবং বাহাদুর শাহ পরাজিত হন। গিয়াসউদ্দীন তুঘলক বাংলাকে সাতগাও, লখনৌতি ও সোনারগাঁও এই তিন ভাগে ভাগ করেন এবং এই তিন ভাগকে তিনজন পৃথক শাসকের হাতে নিযুক্ত করেন। কিন্তু গিয়াসউদ্দীন তুঘলক প্রত্যাবর্তন করলে বাহাদুর শাহ পুনরায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সাতগাওয়ের শাসনকর্তা বাহরাম খান তার বিরুদ্ধে সমরাভিযান করেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন।

    ইলিয়াস শাহী রাজবংশ

    মূল নিবন্ধ: ইলিয়াস শাহী রাজবংশ

    ইলিয়াস শাহ বাংলাদেশে ইরানের সিজিস্তান হতে আগত এক উদ্বাস্তু ছিলেন। তিনি প্রাথমিক জীবনে বাংলায় নিযুক্ত দিল্লীর গভর্নর আলী শাহের সিলাহদার ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে ক্ষমতা দখল করে নিজেকে বাংলার সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন। ইলিয়াস শাহ বাংলা, বিহারউড়িষ্যা দখল করে ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে এক বিশাল সাম্রাজ্য কায়েম করেন । তিনি উত্তর প্রদেশনেপালেরও বিরাট অংশ দখল করে নেন।[৩৭] এর ফলে দিল্লীর সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। ১৫৫৩ সালে তিনি বাংলা আক্রমণ করেন। ইলিয়াস শাহ বিহার ও উড়িষ্যা অঞ্চল দুটো হারিয়ে ফেলেন কিন্তু তিনি বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করতে সক্ষম হন।

    ইলিয়াস শাহের পরে সিকান্দার শাহ বাংলার সিংহাসনে আসীন হন। ইতঃপূর্বে ফিরোজ শাহ তুঘলক বাংলা অক্রমণ করে বাংলা প্রদেশটি দখল করতে ব্যর্থ হন। ফলে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তিনি পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন। সুদীর্ঘ দুই বৎসর ফিরোজ শাহ বাংলা অবরোধ করে রাখেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিকান্দার শাহের হাতে পরাজিত হন।[৩৮] সিকান্দার শাহ সাহিত্য ও স্থাপত্যের একজন একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার সময়ে বিশেষ করে স্থাপত্য ও ইমারত শিল্প ব্যাপক উন্নতি লাভ করে। তার অমর কীর্তি হচ্ছে বিখ্যাত আদিনা মসজিদ নির্মাণ করা। এই মসজিদটি তৎকালীন ভারতবর্ষের বৃহত্তম মসজিদ (দিল্লীর চেয়েও বৃহৎ) ছিল।

    সিকান্দার শাহের পর আজম শাহ সিংহাসনে আসীন হন। তার শাসনকাল ছিল শান্তিপূর্ণ এবং এ সময় তেমন যুদ্ধ বিগ্রহের ঘটনা ঘটেনি। তার সময়ে চীনের রাষ্ট্রদূত মা হুয়ান বাংলাদেশে আগমণ করেন। তিনি ইরানের বিখ্যাত কবি হাফিজকে বাংলায় আগমনের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি রওয়ানাও হয়েছিলেন কিন্তু পথিমধ্যে মারা যান। ইলিয়াস শাহী সুলতানগণ বাংলার হিন্দুদের ক্ষমতায়িত করতে চেয়েছিলেন। বিপুল সংখ্যক হিন্দুকে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হয়। এবং হিন্দুদের বিভিন্ন অঞ্চলে সামন্তপ্রভু হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু এতে হিন্দুরা অত্যন্ত ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা দখল করে বাংলার ইলিয়াস শাহী বংশের অবসান ঘটান।

    গণেশীয় রাজবংশ

    মূল নিবন্ধ: গনেশীয় রাজবংশ

    রাজা গণেশ প্রাথমিক জীবনে দিনাজপুরের ভাতুরিয়া অঞ্চলের জমিদার ছিলেন। তিনি বাংলার এক আমির বায়েজীদ শাহকে ইলিয়াস শাহী বংশের শেষ সুলতানকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করতে উৎসাহিত করেন। পরে বায়েজীদ শাহকে সরিয়ে তিনি নিজেই ক্ষমতা দখল করেন। গণেশ বাংলাদেশে সত্যপীর নামক এক নতুন পূজার উদ্ভাবন করেন। সত্যপীর একইসঙ্গে মুসলিম পীর ও হিন্দু দেবতার প্রতিভূ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। গণেশের পূর্বে বাংলার হিন্দুগণ মুসলমান শাসকদের প্রভাবে ব্যাপক মাত্রায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছিলেন। এই ধর্মান্তর রোধ করার জন্য তিনি এই নতুন সত্যপীর প্রথার প্রচলন করেন।

    রাজা গণেশ নিজ পুত্র জিতেন্দ্রদেবের পরিবর্তে মহেন্দ্রদেবকে পরবর্তী রাজা হিসেবে নিয়োগ করেন। এতে জিতেন্দ্রদেব অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং মুসলিম আমিরদের সহায়তায়, জালালউদ্দীন মুহাম্মাদ শাহ নাম নিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন। মুহাম্মাদ শাহ একজন বিখ্যাত বিজেতা ছিলেন। তিনি পার্শ্ববর্তী জৌনপুর রাজ্য আক্রমণ করেন। এবং তাদের কাছ থেকে বিহার প্রদেশটি ছিনিয়ে নেন। মুহাম্মাদ শাহের সময় আরাকান রাজ মেং তি মুন বার্মার হাত থেকে রক্ষার জন্য মুহাম্মাদ শাহের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং মুহাম্মাদ শাহ তাকে উদ্ধার করেন। এরপর থেকে আরাকান বাংলার একটি সামন্ত রাজ্যে পরিণত হয়।[৩৯]

    মুহাম্মাদ শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র ও উত্তরাধিকারী আহমাদ শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন। তার ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের মতামত বিভ্রান্তিকর। ফেরেশতার মতে, তিনি তার মহান পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন এবং ন্যায়পরায়ণতার আদর্শ প্রাণপণে রক্ষা করেন। অপরপক্ষে গোলাম হোসেন বলেন, তিনি অত্যাচারী ও রক্তপিপাসু ছিলেন। তিনি বিনা কারণে রক্তপাত করতেন এবং অসহায় নারী-পুরুষদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাতেন। যাই হোক তিনি জাউনপুরের কাছে পরাজিত হন। এবং বিহার প্রদেশটি হারিয়ে ফেলেন। সাদী খান ও নাসির খান নামক দুইজন ক্রীতদাস, যারা তার অমাত্য পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন তাকে হত্যা করেন এবং বাংলার সিংহাসন দখল করেন।

    পরবর্তী ইলিয়াস শাহী রাজবংশ

    সাদী খান ও নাসির খান নামক ক্ষমতা দখলকারী আমীরদের সরিয়ে মাহমুদ শাহ নামক ইলিয়াস শাহী বংশের একজন বংশধর বাংলার ক্ষমতা দখল করেন। এর ফলে বাংলায় ইলিয়াস শাহী রাজবংশ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। সুলতান মাহমুদ শাহের সময় বাংলার ইমারত ও স্থাপত্য শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটে। তিনি বাংলার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের ইমারত নির্মাণ করে একে সুসজ্জিত করেন। এসব ইমারতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ, ঢাকার বিনত বিবির মসজিদ, গৌড়ের বাইশগজী প্রাচীর প্রভৃতি।[৪০] এজন্য অনেক ঐতিহাসিক তার যুগকে অগাস্টান যুগ বলে অভিহিত করে থাকেন।

    মাহমুদ শাহের মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য পুত্র বরবক শাহ বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। বরবক শাহ জৌনপুরকে পরাজিত করে বিহার দখল করে নেন এবং কেদার রায় নামক তার একজন হিন্দু সেনাপতিকে এই অঞ্চলের গভর্নর নিয়োগ করেন। বরবক শাহের একজন সেনাপতি ইসমাইল গাজী আসামের রাজাকে পরাজিত করে কামরূপ (পশ্চিম আসাম) দখল করে নেন।[৪১] বরবক শাহের শাসনামলে বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক হাবশী ক্রীতদাসের আগমন ঘটে। বরবক শাহ এদের অনেককে সামরিক ও বেসামরিক উচ্চপদে নিয়োগ করেন। এই হাবশীরা পরে সাম্রাজ্যের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাড়ায়।

    সুলতান ইউসুফ শাহ একজন দানশীল, ন্যায়পরায়ণ ও ধার্মিক শাসক ছিলেন। তিনি ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তিনি দরবারে জ্ঞানী-গুণী, আলেম ও বিচারকদের আহ্বান করতেন। পরবর্তী সুলতান ফতেহ শাহও একজন দয়ালু, কর্মঠ ও ক্ষমতাশালী সম্রাট ছিলেন। তিনি সুবিচার ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে রাজ্য শাসন করতেন। তার সময়ে হাবশী ক্রীতদাসগণ অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তিনি এই হাবশী সেনাবাহিনী ভেঙ্গে দিতে উদ্যত হন। ফলে হাবশী সেনাবাহিনী বিদ্রোহ করে এবং তাকে হত্যা করে বাংলার শাসনক্ষমতা দখল করে। এর ফলে বংলার ইলিয়াস শাহী রাজবংশের পতন ঘটে।

    হোসেন শাহী রাজবংশ

    মূল নিবন্ধ: হোসেন শাহী রাজবংশ

    সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ জোরদখলকারী হাবশী শাসকদের সরিয়ে বাংলার ক্ষমতা দখল করেন। তিনি প্রাথমিক জীবনে আরব দেশের ইয়েমেন থেকে বাংলাদেশে আগত এক উদ্বাস্তু ছিলেন। হোসেন শাহ বাংলার সীমান্তবর্তী রাজ্যসমূহ যেমন কামরূপ (পশ্চিম আসাম), ত্রিহুত (উত্তর বিহার) ও চট্টগ্রাম (আরাকানের হাত থেকে) জয় করেন।[৪২] তবে তিনি দক্ষিণ বিহার জয় করতে ব্যর্থ হন কারণ দিল্লীর সম্রাট সিকান্দার লোদী তার পূর্বেই উক্ত অঞ্চল দখল করে নেন। হোসেন শাহের শাসন আমলে সাহিত্য ও স্থাপত্য কলার ব্যাপক বিকাশ ঘটে। তিনি ছিলেন হিন্দু মুসলিম সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক। অনেক ঐতিহাসিক তার যুগকে বাংলার স্বর্ণযুগ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন।

    হোসেন শাহের পর তার পুত্র নুসরাত শাহ বাংলার সিংহাসনে আসীন হন। পিতার মত তিনিও জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। পিতার আমলে সাহিত্যকলা ও স্থাপত্য শিল্পের যে বিকাশ ঘটে তা তার সময়ও অব্যাহত থাকে। নসরত শাহের সময় ভারতবর্ষে আফগান শাসনের অবসান হয় ও মুঘল শাসনের পত্তন ঘটে। বিপুল সংখ্যক আফগান আমীর পলায়ন করে বাংলাদেশে আসেন। নসরত শাহ সম্রাট মাহমুদ লোদী ও জালাল খানের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুঘল আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য অগ্রসর হন। কিন্তু ঘাগরার যুদ্ধে মিত্রবাহিনী পরাজিত হয়।[৪৩] নসরত শাহ বাবরের সাথে একটি সন্ধিচুক্তি করে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করেন।

    নসরত শাহের পর তার পুত্র ফিরোজ শাহ বাংলার সিংহাসনে আসীন হন। কিন্তু তার খুল্লতাত মাহমুদ শাহ তাকে হত্যা করে ক্ষমতায় বসেন। এর ফলে রাজপরিবারে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। ত্রিহুতের শাসনকর্তা মখদুম আলম স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসেন। কিন্তু মাহমুদ শাহ তাকে পরাজিত করতে সক্ষম হন। এসময় বিহারের শাসনকর্তা জালাল খান তার অভিভাবক শের খানের শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে মাহমুদ শাহকে বিহার আক্রমণের জন্য আহ্বান জানান। মাহমুদ শাহ বিহার আক্রমণ করেন কিন্তু তিনি পরাজিত হন। অতঃপর ১৫৩৮ সালে শেরশাহ বাংলার রাজধানী গৌড় দখল করে নেন।[৪৪] ফলে বাংলার হোসেন শাহী রাজবংশের পতন ঘটে।

    পাখতুন শাসন

    পাখতুনগণ ছিলেন আফগানিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তু এবং তারা পাঠান নামেও পরিচিত ছিলেন। পাখতুনগণ ছিলেন ভারতবর্ষের অধিশ্বর এবং তারা ভারতে লোদী বংশ নামে একটি শক্তিধর রাজবংশ স্থাপন করেন। পরবর্তীতে পানিপথের যুদ্ধে মুঘলদের হাতে তাদের পরাজয় হয় এবং তারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

    সূরী রাজবংশ

    মূল নিবন্ধ: সুরি সাম্রাজ্য

    সূরী বংশের প্রতিষ্ঠাতা শের শাহ সূরী প্রাথমিক জীবনে বিহারের সাসারাম অঞ্চলের এক ক্ষুদ্র জায়গীরদার ছিলেন। পরে নিজ প্রতিভাবলে তিনি বিহারের শাসনকর্তা বিহার খানের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন এবং বিহারের উপ প্রশাসকের পদে নিযুক্ত হন। ১৫৩৬ সালে শের শাহ বাংলার শাসনকর্তা মাহমুদ শাহের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে মাহমুদ শাহ কিউল থেকে সিকরিগলি পর্যন্ত অঞ্চলটি শের শাহকে সমর্পণ করেন। ১৫৩৭ সালে শের শাহ দ্বিতীয়বার বাংলা আক্রমণ করেন এবং এবার সম্রাট মাহমুদ শাহকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে বাংলা দখল করেন। শের শাহ নিজেকে বাংলার সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন এবং ফরিদউদ্দীন শের শাহ উপাধি ধারণ করেন।[৪৫]

    শেরশাহ বাংলা ও বিহারের বিরাট ভূখণ্ডের অধিকারী হয়ে বসলে মুঘল সম্রাট হুমায়ুন চুনার দখল করে বাংলা আক্রমণ করেন। সুচতুর শেরশাহ সম্মুখ সমরে লিপ্ত না হয়ে বাংলাদেশ পরিত্যাগ করেন এবং পরোক্ষভাবে বারানসী, রোটাস ও জৌনপুর দখল করে কনৌজের দিকে অগ্রসর হন। হুমায়ুন আগ্রার পথে যাত্রা করলে বক্সারের নিকট চৌসা নামক স্থানে শের শাহ তাকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। ১৫৪০ সালের ১৭ই মে কনৌজ এর বিলগ্রামের যুদ্ধে শের শাহ হুমায়ুনকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন। এর ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে সূরী বংশের সার্বভৌমত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।[৪৬] শের শাহ হচ্ছেন বাংলার একমাত্র মুসলিম সম্রাট যিনি উত্তর ভারত জুড়ে সাম্রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

    শেরশাহের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রের সেনাধ্যক্ষগণ জ্যেষ্ঠ্যপুত্র আদিল খানের পরিবর্তে ইসলাম শাহকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন, কারণ ইসলাম শাহ রাজপুত্র অবস্থায় অধিকতর সামরিক প্রতিভা প্রদর্শন করেছিলেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আদিল খান ইসলাম শাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। আদিল খান তার বাহিনী নিয়ে আগ্রার দিকে অগ্রসর হন, কিন্তু ইসলাম শাহের হাতে পরাজিত হন।[৪৭] ইসলাম শাহের সময় মুঘল সম্রাট হুমায়ুন রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য তার নিকট প্রার্থনা জানান। কিন্তু তিনি এ আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। ইসলাম শাহের শাসনকাল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ছিল এবং এ সময় তেমন কোন যুদ্ধবিগ্রহের ঘটনা ঘটেনি।

    ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর সূরী সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলার উদ্ভব হয়। ইসলাম শাহের পর তার পুত্র ফিরোজ শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু শীঘ্রই তিনি আদিল শাহ সূরী (এই আদিল শাহ পূর্ববর্তী আদিল শাহ হতে পৃথক) কর্তৃক পদচ্যূত হন। অদিল শাহ পরবর্তীতে ইব্রাহীম শাহ সূরী নামক সূরী বংশীয় অপর একজন দাবীদারের কছে পরাজিত হন এবং তিনি দিল্লী ও আগ্রা দখল করে বসেন। ইব্রাহীম শাহ অবার সিকান্দার শাহ সূরী কর্তৃক পরাজিত হন এবং সিকান্দার শাহ নিজেকে ভারতবর্ষের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন। এভাবে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে সূরী সাম্রাজ্য বিপর্যস্ত হয় এবং শেষ পর্যন্ত ধ্বংসের পথে ধাবিত হয়।

    কররানী রাজবংশ

    মূল নিবন্ধ: কররানী রাজবংশ

    ১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তাজ খান কররানী বাংলার দুর্বল সুলতান গিয়াসউদ্দীনকে পরাজিত করে সিংহাসন দখল করেন। তাজ খান দিল্লীর সূরী বংশীয় সম্রাট ইসলাম শাহের একজন বিশ্বস্ত অনুচর ছিলেন। কিন্তু তার পরে আদিল শাহ অনৈতিকভাবে সিংহাসন দখল করলে তাজ খান বাংলায় পলায়ন করেন এবং এখান থেকেই তিনি আদিল শাহের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। এখানে তিনি বাহাদুর শাহের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন এবং তার নেতৃত্বে আদিল শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকেন।[৪৮] তাজ খান বাংলার মাটিতে তার ক্ষমতার বীজ শক্তভাবে প্রোথিত করেন। পরবর্তীতে সুলতান গিয়াসউদ্দীনকে পরাজিত করে তিনি বাংলার সিংহাসন দখল করেন।

    তাজ খানের পর তার ভাই সুলায়মান খান কররানী বাংলার মসনদে অসীন হন। দিল্লীতে হুমায়ুন কর্তৃক মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবার পর দলে দলে আফগান অভিবাসীগণ বাংলায় এসে বসবাস শুরু করে। ফলে সুলায়মানের আধিপত্য ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সুলায়মানের সাথে উড়িষ্যার সম্রাট মুকুন্দ হরিচন্দনের বিরোধের সূত্রপাত ঘটে। বিরোধের কারণ বাংলার সিংহাসনের অন্যতম দাবীদার ইব্রাহীম সূরীকে আশ্রয় প্রদান করা। ১৫৬৭ খ্রিষ্টাব্দে সুলায়মান তার পুত্র বায়েজীদ খান ও সেনাপতি কালাপাহাড়কে এক বিশাল সেনাবাহিনী সহ উড়িষ্যায় প্রেরণ করেন। রাজা হরিচন্দন মুসলিম বাহিনীর নিকট পরাজয় বরণ করেন। পুরীসহ সমস্ত উড়িষ্যা কররানী রাজ্যের অধীনস্থ হয়।[৪৯]

    সুলতান দাউদ খান কররানী সুলায়মান খান অপেক্ষা অধিকতর স্বাধীনচেতা ও আগ্রাসী মনোভাবসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। মুঘল সম্রাট আকবর সেনাপতি মুনিম খানকে বাংলা আক্রমণের জন্য প্রেরণ করেন। কিন্তু মুঘল সেনাপতি পরাজিত হন। ১৫৭৪ সালে সম্রাট আকবর স্বয়ং পাটনা অবরোধ করেন। ফলে দাউদ খান পরাজিত হন। ১৫৭৬ সালে মুঘলবাঙ্গালী সেনাবাহিনী রাজমহলের প্রান্তরে একটি চূড়ান্ত যদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধের প্রথমদিকে বাঙ্গালী বাহিনী বিজয় অর্জন করে। কিন্তু পরবর্তীতে সেনাপতি কতলু খান ও বিক্রমাদিত্য বিশ্বাসঘাতকতা করলে তারা পরাজিত হয়।[৫০] ফলে বাংলা, বিহারউড়িষ্যাসহ সমগ্র পূর্ব ভারত মুঘল সাম্রাজ্যের পদানত হয়।

    মুঘল যুগ

    এংগাস মেডিসনের হিসাব অনুযায়ী অর্থনীতির দিক দিয়ে প্রধান অঞ্চলগুলোর ১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০০৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিশ্বের জিডিপি এর ক্ষেত্রে অবদান।[৫১] অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত জিডিপির ক্ষেত্রে ভারত ছিল এক বৃহত্তম অর্থনীতি, যার অর্ধেক মান মুঘল বাংলা থেকে এসেছিলো।

    বাংলার পশ্চিমাংশ ও উত্তরাংশ ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের সময় মুঘল সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত হয়। আফগান কররানী বংশের শাসক দাউদ কররানীকে হত্যার মাধ্যমে মুঘল শাসনের সূত্রপাত ঘটে।[৫২] কিন্তু বারো ভূঁইয়াদের পরাজয়ের মাধ্যমে প্রকৃত মুঘল আধিপত্য আরম্ভ হয়। বাংলার বিভিন্ন সুবাদারগণ বাংলার বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং বাংলার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হন। এদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সুবাদার ছিলেন ইসলাম খান, মীর জুমলা, শায়েস্তা খান প্রমুখ।

    ইসলাম খান

    মূল নিবন্ধ: ইসলাম খাঁ

    মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় ১৬০৮ সালে ইসলাম খান বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি রাজধানী ঢাকা থেকে বাংলার শাসন কাজ পরিচালনা করতেন, যার নামকরণ করা হয়েছিল জাহাঙ্গীর নগর। বিদ্রোহী রাজা, বারো-ভূঁইয়া, জমিদার ও আফগান নেতাদের নিয়ন্ত্রণ করাই ছিল তার প্রধান কাজ। তিনি বারো ভূঁইয়াদের নেতা মুসা খানের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন এবং ১৬১১ সালের শেষের দিকে মুসা খান পরাজিত হন।[৫৩] ইসলাম খান যশোরের প্রতাপাদিত্য, বাকলার রামচন্দ্র এবং ভুলুয়া রাজ্যের অনন্ত মানিক্যকে পরাজিত করেছিলেন। এরপর তিনি কোচবিহার, কোচ হাজো এবং কাছাড় রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন, এইভাবে চট্টগ্রাম ব্যতীত সমগ্র বাংলায় আধিপত্য স্থাপন করেছিলেন।

    মীর জুমলা

    মূল নিবন্ধ: মীর জুমলা

    মীর জুমলা বাংলার একজন বিখ্যাত সুবাদার ছিলেন। তিনি প্রাথমিক জীবনে গোলকুণ্ডায় একজন হীরক ব্যবসায়ী হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করেন। এ সময়ই তিনি কোহীনুর নামে বিখ্যাত হীরক খণ্ডের অধিকারী হন। এ হীরক খণ্ডটি পরে তিনি সম্রাট শাহজাহানকে উপহার দেন। তার সময়ে কোচবিহার (পশ্চিম আসাম) ও আসামে (পূর্ব আসাম) মুঘল অভিযান প্রেরিত হয়। গহীন জঙ্গল পার হয়ে কোচবিহারে মুঘল বাহিনী প্রবেশ করলে প্রাণভয়ে রাজা প্রাণনাথ রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে যান। কোচবিহার দখলের পর মীর জুমলা আসামে অভিযান পরিচালিত করেন। মুঘল বাহিনী অনায়াসে কামতা, গোয়ালপাড়া, গোহাটী প্রভৃতি সীমান্তবর্তী শহর দখল করে নেয়। শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত যুদ্ধে রাজধানী ঝাড়গাও দখলকৃত হয় এবং রাজা জয়ধ্বজ নারায়ণ আত্মসমর্পণ করেন।[৫৪]

    শায়েস্তা খান

    মূল নিবন্ধ: শায়েস্তা খাঁ

    ১৬৬৩ সালে শায়েস্তা খান বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি বাংলার দীর্ঘতম গভর্নর ছিলেন। তার সময়ে বাংলার সুখ ও শান্তি চরমে ওঠে। কথিত রয়েছে তার সময় টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। শায়েস্তা খানের বিখ্যাত কীর্তি আরাকানের জলদস্যুদের হাত থেকে চট্টগ্রামের পুনর্দখল করা। ১৬৬৫ সালে শায়েস্তা খান নিজ পুত্র বুজুর্গ উমেদ খানকে অধিনায়ক মনোনীত করে আরাকানে সৈন্য প্রেরণ করেন। ১৬৬৬ সালের ২৩ ও ২৪ জানুয়ারী সংঘটিত কাঠালিয়ার যুদ্ধে মগ বাহিনী সম্পূর্ণ রূপে বিধ্বস্ত হয়। পরে তারা কর্ণফুলী নদীতে প্রতিরোধ গড়ে তুললে মুঘল নৌবহরের কামানের সামনে পরাস্ত হয়। চট্টগ্রামে পুনরায় মুঘল আধিপত্য স্থাপিত হয়।[৫৫] শায়েস্তা খান এর নতুন নামকরণ করেন ইসলামাবাদ। চট্টগ্রাম দখল করে মগদের হাতে বন্দী অসংখ্য নর নারীকে মুক্তি দেওয়া হয়।

    বাংলার নবাব

    মূল নিবন্ধ: বাংলা ও মুর্শিদাবাদের নবাবগণ

    মুর্শিদকুলী খান ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর সুবাহ বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি রাজধানী মাখসুদাবাদে স্থানান্তর করেন যা তার নাম থেকে মুর্শিদাবাদে নামকরণ হয়। তিনি একজন ধর্মনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ ও প্রজাদরদী শাসক ছিলেন। তিনি ইসলামী শরীয়ত অনুসারে কঠোরভাবে দেশ শাসন করতেন। তিনি সপ্তাহে দুবার স্বয়ং বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। তার সময়ে দেশে ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। বাংলা তুর্কী, পারসী, মাজাপাহী, ইংরেজ, ফরাসী প্রভৃতি জাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়।[৫৬] তার সময়ে বাংলার হুগলী একটি বিখ্যাত আন্তর্জাতিক বন্দরে পরিণত হয়।

    মুর্শিদকুলী খানের পর তার জামাতা সুজাউদ্দিন খান বাংলার নবাব হন। তিনি ত্রিপুরা আক্রমণ করেন এবং ত্রিপুরা বাংলার একটি করদ রাজ্যে পরিণত হয়। তিনি বীরভূমের শাসক বদিউজ্জামানের বিদ্রোহ দমন করেন। তিনি কঠোরভাবে ইউরোপীয় বণিকদের দস্তক প্রথা ও শুল্ক ফাঁকি বন্ধ করেন। তার সময়ে ইংরেজ, ফরাসিপর্তুগিজ বণিকগণ কোনরূপ শুল্ক ফাঁকি দিতে পারতেন না। উপরন্তু নবাবকে ইউরোপীয় বণিকদের নজরানা দিয়ে সবসময় সন্তুষ্ট রাখতে হত। কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির অধ্যক্ষ নবাবকে তুষ্ট করার জন্য তিন লক্ষ টাকা নজরানা দেন।[৫৭]

    নবাব আলীবর্দী খানের সময় বাংলায় রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তার সময়ে মারাঠাগণ বাংলা আক্রমণ করে। তবে আলীবর্দী খান একজন বিখ্যাত মহাবীর ছিলেন। তিনি সুদীর্ঘ দশ বছর মারাঠাদের সাথে সংগ্রামে লিপ্ত থাকেন। এবং বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করতে সক্ষম হন। তবে তিনি উড়িষ্যা প্রদেশটি মারাঠাদের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।[৫৮] নবাব আলীবর্দী খানের পরে সিরাজ-উদ-দৌলা বাংলার নবাব হন। তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। প্রথমদিকে কলকাতার যুদ্ধে ইংরেজদের পরাজিত করলেও শেষ পর্যন্ত পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের হাতে পরাজিত হন। ফলে বাংলার নবাবী সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।

    ঔপনিবেশিক শাসন

    বাংলায় ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের আগমন ঘটে পঞ্চদশ শতকের শেষভাগ থেকে। ধীরে ধীরে তাদের প্রভাব বাড়তে থাকে। ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে বাংলার শাসনক্ষমতা দখল করে [৫৯] , pp. 23–28)। ১৮৫৭ খ্রীস্টাব্দের সিপাহী বিপ্লবের পর কোম্পানির হাত থেকে বাংলার শাসনভার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে আসে। ব্রিটিশ রাজার নিয়ন্ত্রণাধীন একজন ভাইসরয় প্রশাসন পরিচালনা করতেন। (Baxter[৫৯], pp. 30–32) ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে অনেকবার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এর মধ্যে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত ১৭৭০ খ্রীস্টাব্দের দুর্ভিক্ষে আনুমানিক ৩০ লাখ লোক মারা যায়।[৬০]

    ১৯০৫ হতে ১৯১১ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গের ফলশ্রুতিতে পূর্ববঙ্গ ও আসামকে নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠিত হয়েছিল, যার রাজধানী ছিল ঢাকায়। (Baxter[৫৯], pp. 39–40) তবে কলকাতা-কেন্দ্রিক রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের চরম বিরোধিতার ফলে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যায় ১৯১১ সালে। ভারতীয় উপমহাদেশের দেশভাগের সময় ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে আবার বাংলা প্রদেশটিকে ভাগ করা হয়। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অংশ হয়, আর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অংশ হয়। ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গের নাম পাল্‌টে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়। [৬১]

    পাকিস্তান আমল (১৯৪৭-১৯৭১)

    ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত করে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয় যথা ভারত ও পাকিস্তান। মুসলিম আধিক্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সীমানা চিহ্নিত করা হয় যার ফলে পাকিস্তানের মানচিত্রে দুটি পৃথক অঞ্চল অনিবার্য হয়ে ওঠে যার একটি পূর্ব পাকিস্তান এবং অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল প্রধানত পূর্ব বাংলা নিয়ে যা বর্তমানের বাংলাদেশ। পূর্ব পাস্তিানের ইতিহাস মূলত: পশ্চিম পাকিস্তানিদ শাসকদের হাতে নিগ্রহ ও শোষণের ইতিহাস যার অন্য পিঠে ছিল ১৯৫৮ থেকে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সামরিক শাসন।

    ১৯৫০ খ্রীস্টাৎব্দে ভূমি সংস্কারের অধীনে জমিদার ব্যবস্থা রদ করা হয়।(Baxter[৫৯], p. 72) কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যাগত গুরুত্ব সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানিদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯৫২ খ্রীস্টাব্দের ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সংঘাতের প্রথম লক্ষণ হিসাবে প্রকাশ পায়। (Baxterউদ্ধৃতি ত্রুটি: শুরুর <ref> ট্যাগটি সঠিক নয় বা ভুল নামে রয়েছে, pp. 62–63) পরবর্তী দশক জুড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে নেয়া নানা পদক্ষেপে পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ মানুষের মনে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে।

    পাকিস্তানি প্রভাব ও স্বৈর দৃষ্টিভঙ্গীর বিরূদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ ছিল মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে এই দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের যুক্তফ্রন্ট নিবার্চনে বিজয় এবং ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক জেনারেল আইয়ুব খানকে পরাজিত করার লক্ষ্য নিয়ে সম্মিলিত বিরোধী দল বা ‘কপ’-প্রতিষ্ঠা ছিল পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরূদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বমূলক আন্দলোনের মাইলফলক। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকারের প্রশ্ন ১৯৫০-এর মধ্যভাগ থেকে উচ্চারিত হতে থাকে।

    স্বাধীনতা আন্দোলন

    ভাষা আন্দোলন

    মূল নিবন্ধ: বাংলা ভাষা আন্দোলন

    ভাষা আন্দোলন ছিল পূর্ব বাংলার ইতিহাসে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন যার উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আদায়। পাকিস্তানের সরকারী কর্মকাণ্ডে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য এ আন্দোলন পরিচালিত হয়। মুফতি নাদিমুল কামার আহমেদ এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করেন। [৬২] ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষের বিভাজনের মাধ্যমে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র সংগঠিত হয়; তার দুটি অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান এর মধ্যে ব্যাপক সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক এবং ভাষাগত পার্থক্য বজায় ছিল। এ পার্থক্য পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক জীবনে ব্যাপক মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করে।

    ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি, পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রের একমাত্র জাতীয় ভাষা হিসেবে উর্দুকে ঘোষণা করে, এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী জনগণের মধ্যে ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। নতুন আইন প্রনয়ণের সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় এবং গণ বিরোধিতার সম্মুখীন হয়ে, সরকার সকল ধরনের গণ সমাবেশ ও প্রতিবাদ আন্দোলন বেআইনি ঘোষণা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মীরা এই আইন অমান্য করে এবং ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে একটি বিরাট আন্দোলন সংগঠিত করে।[৬৩] ঐদিনে বহু ছাত্র বিক্ষোভকারীদের পুলিশ হত্যা করে এবং এই আন্দোলন তার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে।

    এই হত্যাকাণ্ডের পরে সারা দেশব্যাপী ব্যাপক বিক্ষোভ ও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ যার পরবর্তীতে নামকরণ করা হয় আওয়ামী লীগ। কয়েক বৎসর ব্যাপী সংঘর্ষ চলার পর, কেন্দ্রীয় সরকার অবশেষে পরাজয় স্বীকার করে এবং ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর, ইউনেস্কো, ২১ ফেব্রুয়ারিকে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।[৬৪] বাংলাদেশে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন দিবস, একটি জাতীয় দিবস হিসাবে পরিগণিত হয়। শহীদ মিনার স্মৃতিস্তম্ভটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে আন্দোলন ও তার শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়।

    রাজনীতিঃ ১৯৫৪-১৯৭০

    পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ধীরে ধীরে বিরাট পার্থক্য গড়ে ওঠে। পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার একটি সংখ্যালঘু অংশ ছিল, কিন্তু রাজস্ব বরাদ্দ, শিল্প উন্নয়ন, কৃষি সংস্কার ও নাগরিক প্রকল্পসমূহের বৃহত্তম অংশের ভাগীদার ছিল তারাই । পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক পরিষেবাগুলো মূলত পাঞ্জাবি জাতি দ্বারা অধিকৃত ছিল।[৬৫]পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে শুধুমাত্র একটি রেজিমেন্ট ছিল বাঙ্গালীদের। অনেক বাঙ্গালী পাকিস্তানিদের কাশ্মীর ইস্যুতে স্বভাবজাত উৎসাহ বোধ করেনি , কারণ তারা মনে করত এটি পূর্ব পাকিস্তানকে আরও বেশি ঝুঁকির মুখে ফেলবে এবং এটি শেষ পর্যন্ত তার অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হয়ে দেখা দেবে।

    ১৯৬৮ সালের গোড়ার দিকে শেখ মুজিব ও অন্যান্য ৩৪ জন নেতার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ ভারতবর্ষের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার পরিকল্পনা করছিল। যাইহোক এই বিচারের ফলে একটি গণ আন্দোলন সংগঠিত হয় এবং সকল বন্দীদের মুক্ত করার আহ্বান জানানো হয়। ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কারাগারে একজন বিদ্রোহী, জহুরুল হককে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর ফলে আন্দোলন আরও বেগবান হয় এবং পরবর্তীতে ২২ ফেব্রুয়ারি সরকার মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। গণআন্দোলন পরবর্তীকালে ‘৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানে রূপ লাভ করে।[৬৬]

    ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ আইয়ুব খান জেনারেল ইয়াহিয়া খান কে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। পরবর্তীকালে নতুন রাষ্ট্রপতি দেশের সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থগিত করে দেন। যাইহোক কিছু সংখ্যক ছাত্র গোপনীয়তার সাথে আন্দোলন বজায় রাখে। সিরাজুল আলম খান এবং কাজী আরেফ আহমেদের নেতৃত্বাধীন ‘১৫ ফেব্রুয়ারি বাহিনী’ নামে একটি নতুন দল গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে, ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের ৫ই অক্টোবরের জন্য একটি নতুন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন।[৬৭] পশ্চিমের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে সাফল্যজনক নেতৃত্ব পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগকে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দলে পরিণত করে।

    স্বাধীনতার প্রস্তুতি

    আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের বেশিরভাগ অংশে ১৯৭০-৭১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং পাকিস্তান সরকার সাংবিধানিক প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সাথে আলোচনা শুরু করে। কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রদেশগুলোর মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন হয়, সেইসাথে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা হয়। তবে ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেন, যা পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক বিক্ষোভের সূচনা করে।[৬৮] ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের এক ছাত্র নেতা আ স ম আবদুর রবের নির্দেশে বাংলাদেশের নতুন (জাতীয় পতাকা উত্থাপিত হয়।

    আন্দোলনকারী ছাত্রনেতারা দাবী করে যে শেখ মুজিবুর রহমান অবিলম্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করুন, কিন্তু মুজিবুর রহমান এই দাবীতে সম্মত হতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। বরং তিনি ৭ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য একটি জনসভায় তার পরবর্তী পদক্ষেপ ঘোষণা করবেন বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ৩রা মার্চ ছাত্রনেতা শাহজাহান সিরাজ স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের নির্দেশে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সামনে স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠ করেন।[৬৯] ৭ মার্চ তারিখে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি জনসাধারণের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর চলমান স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রসরতা সম্পর্কে জন সাধারণকে উদ্বুদ্ধ করেন।

    আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পরবর্তীতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ৭ই মার্চ এর ভাষণে, পাকিস্তানি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে একটি আসন্ন যুদ্ধের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে প্রস্তুত থাকার জন্য আহ্বান জানান।[৭০] যদিও তিনি সরাসরি স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করেননি, কারণ তখনও আলোচনা চলছিল, তিনি তার শ্রোতাদেরকে কোনও এক সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত থাকার জন্য আহ্বান জানান। শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল চাবিকাঠি বলে মনে করা হয়, এবং এ ভাষণের বিখ্যাত উক্তি ছিল: এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।

    স্বাধীনতার যুদ্ধ

    মূল নিবন্ধ: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ

    ২৬ মার্চের প্রথমার্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক সামরিক অভিযান শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয় এবং রাজনৈতিক নেতারা বহুবিভক্ত হয়ে যান। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ার আগে, শেখ মুজিবুর রহমান একটি স্বাক্ষরিত নোট প্রেরণ করেন যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। এই নোটটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস এর বেতার ট্রান্সমিটার দ্বারা প্রচারিত হয়। বাংলাদেশী আর্মি অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট রেডিও স্টেশন দখল করেন এবং ২৭ মার্চ সন্ধ্যার দিকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। [৭১]

    সামরিক উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে ১১ জন কমান্ডারের অধীনে ১১ টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়।[৭২] এই আঞ্চলিক বাহিনীগুলোর সাথে সাথে যুদ্ধের জন্য আরও তিনটি বিশেষ বাহিনী গঠন করা হয়ঃ জেড ফোর্স, এস ফোর্স এবং কে ফোর্স। এই তিনটি বাহিনীর নাম উক্ত বাহিনীর কমান্ডারদের নামের প্রথম অক্ষর থেকে উদ্ভূত হয়েছে। মেহেরপুর সরকার কর্তৃক প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র ও গোলাবারুদ সহ বেশিরভাগ অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছিল, যা ভারত কর্তৃক সমর্থিত ছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং বাংলার মুক্তি বাহিনী এর মধ্যে যুদ্ধের সময় আনুমানিক এক কোটি বাঙালী, প্রধানত হিন্দু, ভারতের আসাম, ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে আশ্রয় নেয়। ভারত বাংলাদেশকে নানাভাবে সাহায্য করে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের অবদান অপরিসীম।

    পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি ভারতের সহানুভূতি ছিল এবং ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশীদের পক্ষে যুদ্ধ অংশগ্রহণ করে। এর ফলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দুই সপ্তাহের একটি সংক্ষিপ্ত এবং ব্যাপক বিধ্বংসী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজী এবং পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত পাকিস্তানি সেনাধ্যক্ষগণ ভারত ও বাংলাদেশের মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণকালে শুধুমাত্র কয়েকটি দেশ নতুন রাষ্ট্রকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদান করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৯০ হাজারেরও বেশি পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করে।[৭৩][৭৪]

    গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ

    প্রাথমিক সরকার ব্যবস্থা

    অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

    অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম সরকার। এই সরকার দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা জারি করে, অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে সংবিধান প্রণয়ন করে এবং মৌলিক নীতিমালা হিসাবে সমতা, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের নীতি প্রতিষ্ঠা করে। এর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ এবং সামরিক সর্বাধিনায়ক ছিলেন এম এ জি ওসমানী। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং মুহাম্মদ মনসুর আলী। নবনির্মিত বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস এর সদস্যগণ এবং পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিসের স্বপক্ষত্যাগী সদস্যদের সমন্বয়ে এই সরকার গঠিত হয়। এই সরকারে আবু সাঈদ চৌধুরী, হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী এবং রেহমান সোবহান এর নেতৃত্বে এটি একটি সুদক্ষ কূটনৈতিক সংগঠনও ছিল। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এগারোটি সেক্টর কমান্ডারের মধ্যে বিভক্ত ছিল; যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশারফ,কে.এম. শফিউল্লাহ প্রমুখ।[৭৫][৭৬] অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য ভারত আন্তরিকভাবে সকল ধরনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা প্রদান করে। নির্বাসিত এই সরকারের রাজধানী ছিল কলকাতা। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারত চূড়ান্ত যুদ্ধের দুই সপ্তাহের মধ্যে হস্তক্ষেপ করে পাক সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ নিশ্চিত করে।

    শেখ মুজিব প্রশাসন

    বামপন্থী দল আওয়ামী লীগ যারা ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে জিতেছিল, বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর প্রথম সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১লা জানুয়ারী বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধাণমন্ত্রী হিসেবে অধিষ্ঠিত হন এবং ব্যাপকভাবে দেশটির স্বাধীনতার নায়ক এবং জাতির পিতা হিসেবে গণ্য হন।[৭৭] তার শাসনামলে বাঙালী জাতীয়তার গঠন ছিল মূলত ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে। ১৯৭২ সালে কামাল হোসেন এর রচিত সংবিধানটি মূলত একটি উদার গণতান্ত্রিক সংসদীয় প্রজাতন্ত্র গঠন করে, যার ওপর সমাজতন্ত্রের কিছুটা প্রভাব ছিল।

    আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, মুজিব এবং ভারতীয় প্রধাণমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৫-বছর মেয়াদী ইন্দো-বাংলাদেশী বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও শান্তি চুক্তির স্বাক্ষর করেন। আমেরিকান ও সোভিয়েত নেতাদের সাথে আলোচনা করার জন্য ওয়াশিংটন ডিসি ও মস্কোতে মুজিবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ১৯৭৪ সালের দিল্লী চুক্তিতে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং শান্তির জন্য কাজ করার অঙ্গীকার করে।[৭৮] এই চুক্তিটি পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালী কর্মকর্তাদের এবং তাদের পরিবারদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পথ প্রশস্ত করে। তার পাশাপাশি ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের পথ প্রশস্ত করে।

    স্থানীয়ভাবে, মুজিবের শাসনামলে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা ক্রমবর্ধমান হয়ে ওঠে। প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ এর একটি বিদ্রোহ ছিল, পাশাপাশি বাণিজ্যগোষ্ঠী এবং রক্ষণশীল শক্তিবর্গের একটি আন্দোলন ছিল, যারা মনে করত আওয়ামী লীগ সমগ্র মুক্তি আন্দোলনের মুনাফা একচেটিয়াভাবে গ্রহণ করে। বিক্ষোভ দমনের জন্য তিনি ১৯৭৪ সালে তিন মাসের জরুরী অবস্থা জারি করেন। তিনি জাতীয় রক্ষী বাহিনী গঠন করেন, যা মানবাধিকার অপব্যবহারের ব্যাপারে অভিযুক্ত হয়েছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনেকেও জাতীয় রক্ষী বাহিনী দ্বারা অসন্তুষ্ট হয়েছিল। [৭৮]

    সামরিক অভ্যুত্থান ও প্রেসিডেন্সিয়াল শাসন

    প্রথম সামরিক আইন এবং জিয়া প্রশাসন

    জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল বিচারপতি সায়েমের কাছ থেকে রাষ্ট্রপতি এবং সিএমএলএ এর পদ গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের জুন মাসে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পরে জিয়া তার রাষ্ট্রপতিত্ব ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষকে গণতান্ত্রিক রূপ প্রদানের জন্য একটি রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন। দেশীয় মুসলিম ঐতিহ্যের উপর জোর দিয়ে জিয়া একটি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ধারণার প্রথাকে তুলে ধরেন।[৭৯] ১৯৭৯ সালে সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বিএনপি ভূমিধ্বসের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং আওয়ামী লীগ প্রধান বিরোধী দল হিসেবে পরিণত হয়।

    রাষ্ট্রপতি জিয়া সংবিধানে মুক্ত বাজার অর্থনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন, সমাজতন্ত্রকে “অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার” হিসেবে পুনঃসংজ্ঞায়িত করেন এবং একটি বৈদেশিক নীতিমালা প্রণয়ন করেন যা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার সাথে সহযোগিতার ওপর জোর প্রদান করে। প্রেসিডেন্ট জিয়ার অধীনে দেশে দ্রুত অর্থনীতি ও শিল্পায়নের উদ্যোগ বৃদ্ধি পায়। সরকার দেশের প্রথম রপ্তানী প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল গুলো তৈরি করে, একটি জনপ্রিয় খাদ্য-কর্মসূচী পরিচালনা করে, খামারগুলোকে বিকেন্দ্রীকরণ করা হয় এবং বেসরকারী খাতের উন্নয়নকে উৎসাহিত করা হয়। [৭৯]

    জিয়া তার সরকারের বিরুদ্ধে একুশটি অভ্যুত্থানের মোকাবিলা করেছিলেন, যার মধ্যে একটি ছিল বিমানবাহিনী দ্বারা। তার এক সময়কার সহকারী কর্নেল আবু তাহেরকে দেশদ্রোহের চেষ্টায় গ্রেফতার করা হয় এবং মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। সশস্ত্র বাহিনীতে তার অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে অনেকেরই এই রকম পরিণতি দেখা যায়। তবে চূড়ান্ত অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টায় ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড ঘটে। মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর -এর প্রতি বিশ্বস্ত সৈন্যদের হাতে জিয়া নিহত হন, যখন ১৯৮১ সালের ৩০ মে তারা চট্টগ্রামে তার সরকারী বাসভবনে হানা দেন।[৮০] সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এই বিদ্রোহকে দমন করেন।

    সাত্তার প্রশাসন

    জিয়াউর রহমানের পর রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন উপরাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার। আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত হন, যদিও তার প্রতিদ্বন্দ্বী কামাল হোসেন তাকে কারচুপির জন্য অভিযুক্ত করেন। ক্ষমতাসীন বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের কারণে সাত্তারের প্রেসিডেন্সী মন্ত্রিসভার পুনর্বিন্যাসন করে ও উপরাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন মির্জা নূরুল হুদা[৮১] উত্তরপূর্ব ভারতে বিদ্রোহ এবং বার্মায় মুসলিম সহিংসতাগুলোর প্রেক্ষাপটে একটি জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করা হয়। আবদুস সাত্তার বয়স্কতার কারণে স্বাস্থ্য সমস্যার ভোগেন। ১৯৮২ সালের সামরিক অভ্যুত্থান রাষ্ট্রপতি সাত্তার এবং তার বেসামরিক সরকারকে বহিষ্কার করে। বাংলাদেশের সামরিক অভ্যুত্থানের পিছনে কারণ হিসাবে খাদ্য সংকট, দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক অপব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

    দ্বিতীয় সামরিক আইন এবং এরশাদ প্রশাসন

    সাত্তারকে প্রধান বিচারপতি এ এফ এম আহসানউদ্দিন চৌধুরী পদচ্যুত করেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সামরিক আইন ঘোষণা করেন এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন। তিনি মন্ত্রিপরিষদের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ডেপুটি মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসাবে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী প্রধানদের নিয়োগ করেন। এরশাদের মার্শাল ল’ শাসনের অধীনে রাজনৈতিক নিপীড়ন ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। যাইহোক, সরকার প্রশাসনিক সংস্কারের ক্ষেত্রে একটি সুসংঘবদ্ধ কাঠামো প্রণয়ন করে। দেশের উনিশ জেলাকে ৬৪ টি জেলায় বিভক্ত করা হয়। দেশে উপজেলা ব্যবস্থাও প্রবর্তন করা হয়।[৮২]

    এরশাদ সোভিয়েত বিরোধী জোটের পক্ষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি আরও জোরদার করেন। ১৯৮৩ সালে এরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। তার প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে ছিল মূলত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অর্থনীতি (৭০% পর্যন্ত শিল্প রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছিল) এবং হালকা উৎপাদন, কাঁচামাল এবং সংবাদপত্র সহ ভারী শিল্পে ব্যক্তিগত বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা। বিদেশী কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশের শিল্পে বিনিয়োগ করতে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং উৎপাদন রক্ষা করার জন্য কঠোর ও সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।[৮৩] দুর্নীতি ও রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্য জন্য মৃত্যুদণ্ডের আইন জারি করা হয় এবং সমস্ত রাজনৈতিক দল ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়।

    এরশাদ সংসদ ভেঙে দেন এবং ১৯৮৮ সালের মার্চ মাসে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেন। সব প্রধান বিরোধী দল এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে এবং দাবী করে যে সরকার স্বাধীন ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে অসমর্থ হয়েছে। ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টি ৩০০ টি আসনের মধ্যে ২৫১ টি আসন লাভ করে। ১৯৮৮ সালের জুন মাসে সংসদ সহস্রাধিক বিল পাস করে, একটি সংশোধনীতে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম এবং ঢাকার বাইরের শহরগুলিতে উচ্চ আদালতের বেঞ্চ গঠন করতে বিধান জারি হয়। যদিও ইসলাম রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে বজায় থাকে, তবে ঢাকার বাইরের শহরগুলোতে হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণের বিধান সুপ্রীম কোর্টের রায় কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়। [৮৪]

    গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও বর্তমান যুগ

    প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার (১৯৯০-১৯৯১)

    এরশাদ সামরিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলন সমগ্র দেশকে আচ্ছাদিত করে এবং এতে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত উভয় শ্রেণীর জনগণ অংশগ্রহণ করে। প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন এবং দেশে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন।[৮৫] শাহাবুদ্দিন এরশাদকে গ্রেফতার করেন এবং ১৯৯১ সালে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে সক্ষম হন।

    খালেদা প্রশাসন (১৯৯১-১৯৯৬)

    মধ্য ডানপন্থী দল বিএনপি বহুসংখ্যক আসনে জয়লাভ করে এবং ইসলামী দল জামায়াত-ই-ইসলামির সমর্থনে সরকার গঠন করে, জিয়াউর রহমানের বিধবা স্ত্রী খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত করা হয়। জাতীয় পার্টি-এর প্রতিষ্ঠাতা সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে বন্দী ছিলেন। খালেদা জিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।[৮৬] সংবিধানে আরও বেশি পরিবর্তন এনে সাংসদরা সম্মিলিতভাবে একটি সংসদীয় পদ্ধতি পুনর্নির্মাণ করেন এবং বাংলাদেশ ১৯৭২ সালের মৌলিক সংবিধান অনুযায়ী আবার প্রধানমন্ত্রী শাসিত শাসন ব্যবস্থায় ফিরে আসে।

    অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান একটি উদার অর্থনৈতিক সংস্কারের ধারাবাহিকতা শুরু করেন, যা দক্ষিণ এশিয়ায় একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এবং ভারত, পাকিস্তানশ্রীলঙ্কায় একটি মডেল হিসেবে দেখা হয়। [৮৭] মার্চ ১৯৯৪ সালে একটি সংসদীয় উপনির্বাচনে বিতর্ক দেখা দেয়, যাতে বিরোধী দল দাবী করে যে সরকার অবৈধ উপায়ে ক্ষমতায় এসেছে। সমগ্র বিরোধী দল অনির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত সংসদ বয়কট করে। বিরোধীদল এও দাবী করে যে খালেদা জিয়ার সরকার পদত্যাগ করুক এবং তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি সাধারণ নির্বাচনের জন্য, বার বার সাধারণ হরতালের একটি কর্মসূচি প্রনয়ণ করে।

    কমনওয়েলথ সচিবালয়ের সহায়তায় বিতর্কের মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে আরেকটি সমঝোতা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে সংসদ থেকে বিরোধী দল পদত্যাগ করে। তারপর সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করার জন্য তারা মিছিল, বিক্ষোভ ও হরতালের প্রচারণা চালায়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনকে বয়কটের অঙ্গীকার করে। ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ার পর, সংসদ একটি সংবিধান সংশোধন করে, একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক ক্ষমতা গ্রহণ এবং নতুন সংসদীয় নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য অনুমতি প্রদান করে।[৮৮]

    দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার (১৯৯৬)

    প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান দেশের সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রথম প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অভিষিক্ত হন। এই সময়ে, রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিমকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য বরখাস্ত করেন, যার ফলে সেনাবাহিনীর মধ্যে আকস্মিক অভ্যুত্থান দেখা দেয়।[৮৮] বরখাস্ত সেনা প্রধান নাসিম বগুড়া, ময়মনসিংহ ও যশোরের সৈন্যদলসহ ঢাকায় যাওয়ার জন্য তার অনুগত বাহিনীকে নির্দেশ দেন।

    তবে সাভারের সামরিক কমান্ডার দেশের রাষ্ট্রপতির পক্ষে যোগদান করেন এবং রাজধানী ও তার আশেপাশের মহাসড়কে ট্যাংক মোতায়েন করেন, এবং অভ্যুত্থান বাহিনীকে দমন করার জন্য অপারেশনের অংশ হিসেবে ফেরী চলাচল বন্ধ করে দেন। পরে লেঃ জেনারেল নাসিমকে ঢাকা সেনানিবাসে গ্রেপ্তার করা হয়।[৮৯] প্রধান উপদেষ্টা সফলভাবে ১৯৯৬ সালের ১২ই জুন তারিখে একটি স্বাধীন ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন। আওয়ামী লীগ সংসদে ১৪৬ টি আসনে জয়লাভ করে এবং একক বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। বিএনপি ১১৬ টি আসন এবং জাতীয় পার্টি ৩২ টি আসন লাভ করে।

    হাসিনা প্রশাসন (১৯৯৬-২০০১)

    শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের জুন মাসে “জাতীয় ঐকমত্যের সরকার” নামক একটি সরকার গঠন করেন, যার মধ্যে ছিল জাতীয় পার্টির একজন মন্ত্রী এবং জাতীয় সামাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এর একজন মন্ত্রী।[৯০] জাতীয় পার্টি কোনও আনুষ্ঠানিক জোটে প্রবেশ করেনি এবং পার্টির প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদ ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে লীগ সরকারের কাছ থেকে তার সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে কেবল তিনটি দলেরই ১০ জনের অধিক সদস্য নির্বাচিত হয়: এই তিনটি দল হচ্ছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদকে ১৯৯৭ সালের জানুয়ারীতে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়।

    আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীন নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মতে, ১৯৯৬ সালের জুন নির্বাচন মুক্ত এবং ন্যায্য ছিল এবং শেষ পর্যন্ত বিএনপি এই নতুন সংসদে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়। হাসিনা প্রশাসন পরিবেশগত ও আন্তঃজাতিগত চুক্তির ক্ষেত্রে মাইলফলক কৃতিত্ব অর্জন করে। এগুলো হল ভারতের সাথে গঙ্গার পানি ভাগ চুক্তি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত বিদ্রোহীদের সাথে শান্তি চুক্তি[৯১] ১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় এক বিরল ও অভূতপূর্ব ত্রিপক্ষীয় সম্মেলনের আয়োজন করেন, যাতে অংশগ্রহণ করেন- ১. পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ, ২. ভারতের প্রধানমন্ত্রী আই. কে. গুজরাল এবং ৩.আমেরিকার রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন

    ১৯৯৯ সালের জুন মাসে বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলো আবার সংসদে উপস্থিত হতে বিরত থাকে। ১৯৯৭ সালে “ছয় দিনের” হরতাল থেকে শুরু করে ১৯৯৯ সালে “২৭ দিনের” হরতাল পর্যন্ত; বিরোধীদলের পক্ষ থেকে ব্যাপক সংখ্যক হরতালের সৃষ্টি হয়।[৯২] ১৯৯৯ সালের শুরুতে গঠিত চার-দলীয় বিরোধী জোট ঘোষণা করে যে, নির্বাচনী বৈষম্য দূর করার জন্য সরকারী নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে কার্যকরী পদক্ষেপ না পাওয়া পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না। সরকার এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি এবং এর ফলে বিএনপি পরবর্তীতে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ সালে পৌর পরিষদের নির্বাচন, বেশ কয়েকটি সংসদীয় উপনির্বাচন এবং ২০০০ সালের চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বর্জন করে।

    তৃতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার (২০০১)

    প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সহিংসতা দমনের ক্ষেত্রে সাফল্যের পরিচয় দেয়। ২০০১ সালের ১লা অক্টোবর তারিখে সংসদীয় সাধারণ নির্বাচন সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিএনপি-নেতৃত্বাধীন জোটের বিপুল বিজয় দেখা দেয়, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল জামায়াত-ই-ইসলামী এবং ইসলামী ঐক্য জোট। বিএনপি ১৯৩ টি লাভ করে এবং জামায়াত ১৭ টি আসনে জয়লাভ করে। [৯৩]

    খালেদা প্রশাসন (২০০১-২০০৬)

    ২০০১ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার দেওয়া প্রতিশ্রুতি এবং নির্বাচন পরিদর্শক দলের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে ঘোষণা সত্ত্বেও, শেখ হাসিনা বিগত নির্বাচনের নিন্দা করেন এবং সংসদ বর্জন করেন। ২০০২ সালে তিনি অবশ্য তার দলকে জাতীয় সংসদে নেতৃত্ব দেন, কিন্তু আওয়ামী লীগ আবার ২০০৩ সালের জুন মাসে একজন রাষ্ট্রীয় মন্ত্রী এবং সংসদীয় স্পিকারের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকা এবং সেই সাথে অপমানজনক মন্তব্যের প্রতিবাদ জানায়।[৯৪] জুন ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগ তাদের দাবী পূরণ না হওয়া সত্ত্বেও সংসদে ফিরে আসে। ২০০৫ সালের বাজেট অধিবেশনের সময় সামগ্রিক বয়কটের ঘোষণা দেবার আগে তারা অনিয়মিতভাবে সংসদে উপস্থিত ছিলেন।

    খালেদা জিয়ার প্রশাসন উন্নত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সেই সাথে দুর্নীতির অভিযোগ এবং দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ও রক্ষণশীল শক্তির মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষের দ্বারা চিহ্নিত হয়। উইকিলিকস কর্তৃক মুক্তিপ্রাপ্ত আমেরিকান কূটনৈতিক মিডিয়াগুলোতে তার ছেলে তারেক রহমানকে “গোপনীয়তার জন্য বিখ্যাত এবং বারংবার সরকারি ক্রয়কর্ম ও রাজনৈতিক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে ঘুষের জন্য” বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। [৯৫] আফগানিস্তানে তালেবানদের উৎখাত হওয়ার পর বাংলাদেশ ত্রাণ তৎপরতার ক্ষেত্রে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায়, যার মধ্যে “ব্র্যাক” যুদ্ধবিমুখ দেশটির বৃহত্তম উন্নয়ন সংস্থায় পরিণত হয়।

    হাই প্রোফাইলের একটি সিরিজ গুপ্তঘাতক গোষ্ঠী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলীয় নেতাদের হত্যার হুমকি প্রদান করে। ২০০৪ সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সামান্যর জন্য ঢাকায় গ্রেনেড হামলা থেকে রক্ষা পান। ২০০৫ সালে জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলা চালায়।[৯৬] লীগ বিএনপি ও জামায়াতকে জঙ্গীবাদের উত্থানের সাথে জড়িত থাকার দায়ে অভিযুক্ত করে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চচলীয় বিদ্রোহীদের বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছে, এমন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ভারতের সাথে সম্পর্ক প্রকট আকার ধারণ করে। খালেদা জিয়া চীনের সাথে কৌশলগত অংশীদারত্ব প্রকাশ করেন এবং বেইজিংয়ের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

    চতুর্থ তত্ত্বাবধায়ক সরকার (২০০৬-২০০৮)

    বিএনপির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর একটি বড় রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়, কারণ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার জন্য নিরপেক্ষ প্রার্থীকে দাবী করে। বহু সপ্তাহ ব্যাপী হরতাল, বিক্ষোভ এবং অবরোধের কারণে দেশটি পঙ্গু হয়ে যায়। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, কিন্তু একটি সম্ভাব্য রক্তক্ষয়ী নির্বাচনের ভীতি দূর করতে ব্যর্থ হন। ১১ জানুয়ারী ২০০৭ তারিখে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন। তিনি সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ এর চাপের মুখে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। [৯৭]

    সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি দুর্নীতি বিরোধী অভিযান শুরু করে, যার মধ্যে ১৬০ জন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং আমলাকে গ্রেফতার করা হয়। এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাসহ খালেদা জিয়ার দুই ছেলেকে গ্রেফতার করা হয়।[৯৮] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিক্ষোভকারীগণ ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবী জানায়, কিন্তু কারফিউ দ্বারা আন্দোলন দমন করা হয়। ২০০৮ সালে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা মুক্তি পান। জরুরী অবস্থা দুই বছর ধরে অব্যাহত থাকে। ডিসেম্বর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট বিপুল ব্যবধানে জয়লাভ করে, যার মধ্যে জাতীয় পার্টি

    হাসিনা প্রশাসন (২০০৯-বর্তমান)

    কার্যনির্বাহী সভার দুই মাসের মধ্যে শেখ হাসিনার সরকারকে বিডিআর বিদ্রোহের মোকাবেলা করতে হয়, যা সেনা বিভাগের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহীদের হিংস্রতা ও ক্রুদ্ধ ব্যক্তিদের মোকাবেলা করে শেখ হাসিনার ব্যাপক সফলতার পরিচয় দেন।[৯৯] ১৯৭১ সালে গণহত্যার অন্যতম কারিগর পাকিস্তানপন্থী নেতাদের বিচারের জন্য তিনি বিতর্কিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন। ট্রাইব্যুনাল তার সুুষ্ঠুতা ও নিরপেক্ষতার ব্যাপারে সমালোচনার সম্মুখীন হয়। জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের মধ্যে অধিকাংশ জ্যেষ্ঠ নেতা, বাংলাদেশ দলের স্বাধীনতার বিরোধিতা ও গণহত্যার সময় পাকিস্তানকে সহায়তার অভিযোগে অভিযুক্ত।

    ২০১০ সালে সংবিধানের মৌলিক নীতি হিসেবে বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্ট ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে জনমত পরিচালিত করে, যা প্রকাশিত হয় মার্চ ২০১৩ শাহবাগ প্রতিবাদের মাধ্যমে। মে ২০১৩ সালে হেফাজত-ই-ইসলামের নেতৃত্বে একটি ইসলামপন্থী সংগঠনও পাল্টা বিরাট সমাবেশ পরিচালনা করে। ২০১৩ সালে এবং ২০১৫ সালে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর এবং পাশ্চাত্যবাসী, ব্লগার, প্রকাশকনাস্তিকদের ওপর ব্যাপক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ট অনেক গুলো হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে, যদিও হাসিনা সরকার স্থানীয়দের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে দায়ী করেন।[১০০] ২০২১ সালের মোদি বিরোধী বিক্ষোভ এর মধ্যে অন্যতম।

    আওয়ামী লীগ ও বিনপির মধ্যে সংঘাতকে প্রায়ই বেগমদের যুদ্ধ নামে অভিহিত করা হয়। হাসিনা সরকার বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন বিলুপ্ত করেন। বিএনপির পক্ষ থেকে একে নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে আওয়ামী লীগের পক্ষে দুর্নীতিযুক্ত করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়। লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় সাধারণ জীবনে সহিংসতা বেড়ে যায়। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে হিংস্রতম নির্বাচন।[১০১] ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনকে বিএনপি বয়কট করে ; যেখানে জামায়াতকে নির্বাচন থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক মিডিয়ায় নির্বাচনের সমালোচনা করা হয়। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তৃতীয় মেয়াদে শপথ নেন।

  • বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন

    বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন

    বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন বাংলাদেশের বিচারকগণের সংগঠন। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী গঠিত বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসে কর্মরত সকল বিচারকগণের সমন্বয়ে এই এসোসিয়েশন গঠিত হয়েছে।

    ইতিহাস

    ১৯৪৭ সালের ১৩ অক্টোবর গৃহীত গঠনতন্ত্রের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে ‘ইস্ট পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস (জুডিসিয়াল) এসোসিয়েশন’। পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জুডিসিয়াল ক্যাডার বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত হয়। সংগঠনের নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় ‌’বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (জুডিসিয়াল) এসোসিয়েশন’। ১৯৯০ সালের ২৮ ডিসেম্বর সংগঠনের সদস্যদের বার্ষিক সাধারণ সভায় পূর্বের গঠনতন্ত্র বাতিলপূর্বক নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন ও গ্রহণ করা হয়। মাসদার হোসেন মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের রায়ে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ২০০২ সালের বার্ষিক সাধারণ সভায় সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন’। [২]

    লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

    অরাজনৈতিক ও কল্যাণমুখী সংগঠন হিসাবে এই এসোসিয়েশনের কার্যবিধি নিম্নবর্ণিত উদ্দেশ্য সাধনের পরিচালিত হয়।

    ক) এসোসিয়েশনের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও একাত্ববোধ জাগ্রতকরণ এবং বিচার বিভাগের সুমহান ঐতিহ্য ও মান মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য সদস্যদের দেশ ও জাতির কল্যাণে দেশপ্রেম, কর্তব্যনিষ্ঠা, সততা, নিরপেক্ষতা ও একাগ্রতার সঙ্গে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে উদ্বুদ্ধকরণ,

    খ) সদস্যদের আইনানুগ ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার যথা- চাকরির কাঠামো, বেতন, পদমর্যাদা ইত্যাদি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সকল দাবীসমূহ ন্যায় নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা গ্রহণ,

    গ) সংগঠনের স্বার্থে এবং সদস্যদের কল্যাণের জন্য তহবিল গঠন, অস্থাবর ও স্থাবর সম্পত্তি অর্জন,

    ঘ) সংগঠনের স্বার্থে সভা, সম্মেলন ও সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি জাতীয় কার্যক্রম গ্রহণ,

    ঙ) বিচার ও বিচার প্রশাসনের উন্নয়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের অনুমতিক্রমে সম্পর্ক স্থাপন ও বিস্তার এবং

    চ) উল্লিখিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়ক সকল কার্যক্রম গ্রহণ। [২]

    আরও দেখুন

  • ২০১৩ বাংলাদেশ গেমস

    ২০১৩ বাংলাদেশ গেমস

    ২০১৩ বাংলাদেশ গেমস হচ্ছে বাংলাদেশ গেমসের ৮ম আসর যেটি ২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল[১] থেকে ২৮ এপ্রিল[২] পর্যন্ত ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। মোট ৩১টি বিষয়ে ২১টি ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতার প্রতিপাদ্য ছিলোঃ ‘হদয়ে খেলার স্পন্দন’।[৩

    ২০১৩ বাংলাদেশ গেমস
  • ২০১১ কমনওয়েলথ যুব গেমসে জিব্রাল্টার

    ২০১১ কমনওয়েলথ যুব গেমসে জিব্রাল্টার

    ৭ থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ তে আইল অব ম্যান-এ অনুষ্ঠিত ২০১১ কমনওয়েলথ যুব গেমস-এ (আনুষ্ঠানিকভাবে চতুর্থ কমনওয়েলথ যুব গেমস হিসাবে পরিচিত) অংশ নেন। এটা কমনওয়েলথ যুব গেমস তাদের দ্বিতীয় বার উপস্থিতি হওয়া। জিব্রাল্টারের ব্রিটিশ উপনিবেশ কমনওয়েলথ গেমস এসোসিয়েশন অফ জিব্রাল্টারের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব করে, যা কমনওয়েলথ গেমস এবং জিব্রাল্টারে কমনওয়েলথ যুব গেমসের জন্য দায়িত্বপূর্ণ। এসোসিয়েশন পাঁচজন পুরুষ প্রতিযোগীর একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন করে, যারা এগারটি ইভেন্টের তিনটি ভিন্ন খেলাধুলায় নেন। কোন ক্রীড়াবিদ একটি পদকও জেতেননি। জেরাই তোরেস ২০০ মিটার স্প্রিন্টের সেমিফাইনালে পৌঁছান,যেখানে তিনি সবার পরে থেকে দৌড় শেষ করেন। অন্য দুই অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগী,শেন কলাডো এবং কার্ল বালদাছিনো,তাদের নিজ নিজ ইভেন্টের প্রাথমিক পর্যায়ে পার হতে ব্যর্থ হন। সাইকেলিস্ট ফ্রাঙ্ক ওয়ারউইক ট্রায়াল ইভেন্টে ৩৫তম এবং রোড রেস ইভেন্টে ৩৭তম স্থান অর্জন করেন। জেমস স্যান্ডারসন সাঁতার এর পাঁচটি ভিন্ন ইভেন্টে –বাটারফ্লাই এর দুইটি এবং ফ্রিস্টাইলের তিনটি ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেন,তিনি পাঁচটি কোনোটিও ফাইনালে পৌঁছাতে পারেননি।

    ২০১১ কমনওয়েলথ যুব গেমসে জিব্রাল্টার

    পটভূমি

    জিব্রাল্টার ১৯৫৪ সালে কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ভ্যাঙ্কুভারে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ গেমসে সর্বপ্রথম অংশগ্রহণ করে। তারপর থেকে দেশটি প্রতিযোগিতাটির প্রতিটি আসরেই অংশগ্রহণ করেছে।[২] জিব্রাল্টার কমনওয়েলথ গেমস এসোসিয়েশন জিব্রাল্টার কমনওয়েলথ ও কমনওয়েলথ যুব গেমস এর দায়িত্ব নেয়।[৩] জিব্রাল্টার কমনওয়েলথ যুব গেমসের প্রথম দুই সংস্করণ এডিনবরা (২০০০) এবং বেন্ডিগো(২০০৪) এর জন্য কোন প্রতিনিধি পাঠায়নি।[৪][৫] জিব্রাল্টার থেকে সাত ক্রীড়াবিদের একটি প্রতিনিধিদল পুনেতে ২০০৮ কমনওয়েলথ যুব গেমসে অংশ নেয়।[৬] সাত ক্রীড়াবিদের কেউই কোন পদক জেতেননি ।[৭] ৭ থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর আইল অব ম্যানের ব্রিটিশ ক্রাউন ডিপেনসিতে অনুষ্ঠিত ২০১১ কমনওয়েলথ যুব গেমসে অংশগ্রহণকারী ৬৩ টি দেশের মধ্যে একটি হল জিব্রাল্টার, এটি ছিল কমনওয়েলথ যুব গেমসে তাদের দ্বিতীয় আসর।[৮] কমনওয়েলথ গেমস এসোসিয়েশন অফ জিব্রাল্টার পাঁচজন প্রতিযোগীর একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন করে। প্রতিনিধিদলে শুধু পুরুষ ক্রীড়াবিদ ছিলেন এবং তারা অ্যাথলেটিক্স, সাইক্লিং এবং সাঁতার এর এগারটি ভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেন।[৯]

    শরীরচর্চা

    আরও দেখুন: ২০১১ কমনওয়েলথ যুব গেমসে অ্যাথলেটিক্স

    শরীরচর্চায়,কমনওয়েলথ গেমস এসোসিয়েশন অফ জিব্রাল্টার তিন জন প্রতিযোগীর নিবন্ধন করিয়েছিল: শেন কলাডো, জেরাই তোরেস এবং কার্ল বালদাছিনো। তিন ক্রীড়াবিদের সবাই দুইটি ইভেন্টে অংশ নেন (২০০ মিটার এবং ৪০০মিটার স্প্রিন্ট রেস)। জেরাই তোরেস উভয় ইভেন্টে অংশ নেন এবং ২০০ মিটার দৌড়ের সেমিফাইনালে পৌঁছান। তিনি দৌড় শেষ করতে ২৩.২৫ সেকেন্ড সময় নেন যার ফলে তিনি তালিকার তলানিতে স্থান পান, যা তার চূড়ান্ত দৌড়ে অংশ নেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না। শেন কলাডো এবং কার্ল বালদাছিনো উভয়েই তাদের নিজ নিজ পর্ব থেকে বিদায় নিতে নেন।[১০][১১]

    ক্রীড়াবিদইভেন্টহেটসেমিফিনালফাইনাল
    ফলমর্যাদাক্রমফলমর্যাদাক্রমফলমর্যাদাক্রম
    শেন কলাডো২০০ মি. স্প্রিন্ট২৫.৩৬৮মঅগ্রসর হতে পারেননি
    জেরাই তোরেস২০০ মি. স্প্রিন্ট২২.৮৩৪য২৩.২৫৫মঅগ্রসর হতে পারেননি
    ৪০০  মি. স্প্রিন্ট৫৩.১১৫মঅগ্রসর হতে পারেননি
    কার্ল বালদাছিনো৪০০  মি. স্প্রিন্ট৫৩.৯৭৫মঅগ্রসর হতে পারেননি
    • য= পরের রাউন্ডের জন্য যোগ্য

    সাইক্লিং

    আরও দেখুন: ২০১১ কমনওয়েলথ যুব গেমসে সাইক্লিং

    ফ্রাঙ্ক ওয়ারউইক ছিলেন জিব্রাল্টার প্রতিনিধিদলের একমাত্র সাইক্লিস্ট। তিনি টাইম ট্রায়াল এবং রোড রেস উভয় সাইক্লিং ইভেন্টে অংশ নেন। তিনি দুটি ইভেন্টের কোনটিতেই পদক পাননি।[১২][১৩]

    ক্রীড়াবিদইভেন্টসময়মর্যাদাক্রম
    ফ্রাঙ্ক ওয়ারউইকটাইম ট্রায়াল১১.০৮৩৫
    রোড রেস@ ৫ ল্যাপ৩৫

    সাঁতার

    আরও দেখুন: ২০১১ কমনওয়েলথ যুব গেমসে সাঁতার

    জেমস স্যান্ডারসন সাঁতার এর পাঁচটি বিভিন্ন ইভেন্টে জিব্রাল্টারের প্রতিনিধিত্ব করেন -৫০ মিটার বাটারফ্লাই, ২০০ মিটার ফ্রিস্টাইল, ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল, ১০০ মিটার বাটারফ্লাই এবং ৫০মিটার ফ্রিস্টাইল। তার সেরা ফল ছিল ৫০ মিটার বাটারফ্লাই ইভেন্টে, যেখানে তিনি চূড়ান্ত তালিকায় দ্বাদশ স্থান অর্জন করেন।[১৪]

    ক্রীড়াবিদইভেন্টহিটফাইনাল
    ফলমর্যাদাক্রমফলমর্যাদাক্রম
    জেমস স্যান্ডারসন৫০ মি বাটারফ্লাই২৬.৬৩১২তমঅগ্রসর হতে পারেননি
    ২০০ মি ফ্রিস্টাইল১:৫৬.৩৯১৬তমঅগ্রসর হতে পারেননি
    ১০০ মি ফ্রিস্টাইল৫৩.৭৮১৬তমঅগ্রসর হতে পারেননি
    ১০০ মি বাটারফ্লাই৫৮.৫৭১৩তমঅগ্রসর হতে পারেননি
    ৫০ মি ফ্রিস্টাইল২৪.৮৪১৫তমঅগ্রসর হতে পারেননি
  • আমার সোনার বাংলা

    আমার সোনার বাংলা

    আমার সোনার বাংলা হলো বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত[১][২] বঙ্গমাতা সম্পর্কে এই গানটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক ১৯০৫ সালে রচিত হয়। বাউল গায়ক গগন হরকরার গান “আমি কোথায় পাব তারে” থেকে এই গানের সুর ও সঙ্গীত উদ্ভূত।

    আমার সোনার বাংলা

    ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এই গানটি রচিত হয়েছিল। ১৩ জানুয়ারি, ১৯৭২ তারিখে মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে এ গানটির প্রথম দশ চরণ সদ্যগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত হয়।[৩]

    ব্যুৎপত্তি

    সোনা শব্দটির অর্থ “স্বর্ণ“, আর সোনার শব্দটির আক্ষরিক অর্থ “স্বর্ণের অন্তর্গত”, বা “স্বর্ণ দিয়ে তৈরি” এবং “আর” দখল করে। এটি “প্রিয়” অর্থপ্রিয় পরিভাষা হিসাবে ব্যবহৃত, কিন্তু গানের মধ্যে সোনার বাংলা শব্দটি বাঙালির মূল্যবোধ প্রকাশ করতে পারে বা ফসল তোলার আগে ধানক্ষেতের রঙের তুলনা বোঝানো হয়েছে।

    ইতিহাস

    রচনা ও সুরারোপ

    আমার সোনার বাংলা গানটি রচিত হয়েছিল ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। গানটির পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি, তাই এর সঠিক রচনাকাল জানা যায় না।[৪] সত্যেন রায়ের রচনা থেকে জানা যায়, ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে আয়োজিত একটি প্রতিবাদ সভায় এই গানটি প্রথম গীত হয়েছিল। এই বছরই ৭ সেপ্টেম্বর (১৩১২ বঙ্গাব্দের ২২ ভাদ্র) সঞ্জীবনী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরে  গানটি মুদ্রিত হয়। এই বছর বঙ্গদর্শন পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যাতেও গানটি মুদ্রিত হয়েছিল। তবে ৭ আগস্ট উক্ত সভায় এই গানটি গীত হওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।[৪] বিশিষ্ট রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পালের মতে, আমার সোনার বাংলা ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে অবস্থা ও ব্যবস্থা প্রবন্ধ পাঠের আসরে প্রথম গীত হয়েছিল।[৪]

    আমার সোনার বাংলা গানটি রচিত হয়েছিল শিলাইদহের ডাকপিয়ন গগন হরকরা রচিত আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে গানটির সুরের অণুষঙ্গে।[৪] সরলা দেবী চৌধুরানী ইতিপূর্বে ১৩০৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে তার শতগান সংকলনে গগন হরকরা রচিত গানটির স্বরলিপি প্রকাশ করেছিলেন। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের বঙ্গভঙ্গ-সমসাময়িক অনেক স্বদেশী গানের সুরই এই স্বরলিপি গ্রন্থ থেকে গৃহীত হয়েছিল।[৪] যদিও পূর্ববঙ্গের বাউলদের ভিডমিডভাটিয়ালি সুরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি ইতঃপূর্বেই হয়েছিল বলে জানা যায়। ১৮৮৯-১৯০১ সময়কালে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদারির কাজে ভ্রমণ ও বসবাসের সময় বাংলার লোকজ সুরের সঙ্গে তার আত্মীয়তা ঘটে। তারই অভিপ্রকাশ রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী আন্দোলনের সমসাময়িক গানগুলি, বিশেষত আমার সোনার বাংলা

    যেভাবে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত

    ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ গঠিত হয় স্বাধীন বাংলার কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ। পরে ৩ মার্চ তারিখে ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভা শেষে ঘোষিত স্বাধীনতার ইশতেহারে এই গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে এই গান প্রথম জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গাওয়া হয়।

    গানের কথা

    মূল কবিতা

    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সম্পূর্ণ আমার সোনার বাংলা গানটি এখানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই গানের প্রথম দশ চরণ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃত।

    আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
    চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি॥
    ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
    মরি হায়, হায় রে—
    ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি॥

    কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—
    কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
    মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
    মরি হায়, হায় রে—
    মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি॥

    তোমার এই খেলাঘরে শিশুকাল কাটিলে রে,
    তোমারি ধুলামাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি।
    তুই দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে,
    মরি হায়, হায় রে—
    তখন খেলাধুলা সকল ফেলে, ও মা, তোমার কোলে ছুটে আসি॥

    ধেনু-চরা তোমার মাঠে, পারে যাবার খেয়াঘাটে,
    সারা দিন পাখি-ডাকা ছায়ায়-ঢাকা তোমার পল্লীবাটে,
    তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে,
    মরি হায়, হায় রে—
    ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই, ও মা, তোমার রাখাল তোমার চাষি॥

    ও মা, তোর চরণেতে দিলেম এই মাথা পেতে—
    দে গো তোর পায়ের ধুলা, সে যে আমার মাথার মানিক হবে।
    ও মা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে,
    মরি হায়, হায় রে—
    আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা, তোর ভূষণ ব’লে গলার ফাঁসি

    জনপ্রিয়তা

    শ্রোতাদের পছন্দানুসারে বিবিসি বাংলার তৈরি সেরা বিশটি বাংলা গানের তালিকায় এই গানটি প্রথম স্থান দখল করে।[৫]

    বিশ্ব রেকর্ড

    ২০১৪ সালের ২৬ মার্চ, জাতীয় প্যারেড ময়দান, ঢাকা, বাংলাদেশে একসঙ্গে ২৫৪,৫৩৭ জন জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার মাধ্যমে গিনেস বিশ্ব রেকর্ড করে।[৬]

    চলচ্চিত্রায়ন

    বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীকসমূহ
    পতাকালাল-সবুজ
    প্রতীকশাপলা
    সঙ্গীতআমার সোনার বাংলা
    পশুরয়েল বেঙ্গল টাইগার
    পাখিদোয়েল
    ফুলসাদা শাপলা
    বৃক্ষআমগাছ
    ফলকাঁঠাল
    খেলাকাবাডি
    পঞ্জিকাবঙ্গাব্দ

    চলচ্চিত্রকার শহীদ জহির রায়হান ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তার বিখ্যাত জীবন থেকে নেওয়া কাহিনীচিত্রে এই গানের চলচ্চিত্রায়ন করেন।

  • বাংলাদেশের আইন

    বাংলাদেশের আইন

    বাংলাদেশ একটি সাধারণ আইনের দেশ। এটির আইনগত পদ্ধতি বিকাশিত হয়েছে ব্রিটিশ ভারতের উপর তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের সময় ব্রিটিশ নিয়মে। ব্রিটিশ ও মোগল আমলে বাংলাদেশ বঙ্গ নামে পরিচিত ছিল এবং এর আগে আগে বাংলাদেশের আরও কিছু নাম ছিল। যদিও আমাদের প্রায় পূর্ব ঐতিহাসিক যুগ থেকেই বাংলাদেশে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উপকরণ ও প্রতিষ্ঠান ছিল। মুঘলরা প্রথমে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে এগুলি শনাক্ত ও প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল। কিং জর্জ ১ প্রদত্ত ১৭২৬-এর সনদে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে মাদ্রাজ, বোম্বাই এবং কলকাতায় মেয়রের আদালত প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়া হয় এবং ব্রিটিশ ভারতের জন্য সেটাকে প্রথম সংহিতাবদ্ধ আইন হিসাবে স্বীকৃত হয়। তখনকার ব্রিটিশ ভারতের অংশ হিসাবে তৎকালীন বাংলার জন্যেও এটি প্রথম সংহিতাবদ্ধ আইন ছিল। একাত্তরের স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের সংসদ কর্তৃক প্রণীত সংবিধিবদ্ধ আইন আইন গঠনের প্রাথমিক রূপ। [১]

    বাংলাদেশের আইন

    ইতিহাস

    মৌলিক অধিকার আইন

    বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় অংশে মৌলিক অধিকারের অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ।

    1. মৌলিক অধিকারের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইন বাতিল করা হবে (ধারা-২৬)
    2. আইনের সামনে সমতা (ধারা-২৭)
    3. ধর্ম, ইত্যাদির ভিত্তিতে বৈষম্য (ধারা-২৮)
    4. সরকারি চাকরিতে সুযোগের সমতা (ধারা-২৯)
    5. বিদেশী উপাধি, ইত্যাদি নিষিদ্ধকরণ (ধারা-৩০)
    6. আইন রক্ষার অধিকার (ধারা-৩১)
    7. জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার সুরক্ষা (ধারা-৩২)
    8. গ্রেফতার ও আটকের জন্য সুরক্ষা ব্যবস্থা (ধারা-৩৩)
    9. জোরপূর্বক শ্রম নিষিদ্ধকরণ (ধারা-৩৪)
    10. বিচার ও শাস্তির ক্ষেত্রে সুরক্ষা (ধারা-৩৫)
    11. চলাফেরার স্বাধীনতা (ধারা-৩৬)
    12. সমাবেশের স্বাধীনতা (ধারা-৩৭)
    13. সংগঠনের স্বাধীনতা (ধারা-৩৮)
    14. চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ-৩৯)
    15. পেশা বা পেশার স্বাধীনতা (ধারা-৪০)
    16. ধর্মের স্বাধীনতা (ধারা-৪১)
    17. সম্পত্তির অধিকার (ধারা-৪২)
    18. বাড়ি এবং চিঠিপত্রের সুরক্ষা (ধারা-৪৩)
    19. মৌলিক অধিকারের প্রয়োগ (ধারা-৪৪)
    20. শৃঙ্খলা আইনের ক্ষেত্রে অধিকারের পরিবর্তন (ধারা-৪৫)
    21. ক্ষতিপূরণ প্রদানের ক্ষমতা (ধারা-৪৬)
    22. কিছু আইনের জন্য সংরক্ষণ (ধারা-৪৭)
    23. নির্দিষ্ট নিবন্ধের অপ্রযোজ্যতা (ধারা-৪৭.ক)

    মামলা আইন

    বিচারিক নজির বাংলাদেশের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

    বাংলাদেশী আদালত সাংবিধানিক আইনের মতো ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিচারিক নজির প্রদান করেছে, যেমন বাংলাদেশ ইতালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস লিমিটেড বনাম বাংলাদেশ সরকার, যা সামরিক আইনকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব বনাম মাসদার হোসেনের রায়ে ক্ষমতা পৃথকীকরণ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে।

    অরুণা সেন বনাম বাংলাদেশ সরকার, সুপ্রিম কোর্ট বেআইনি আটক ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে নজির স্থাপন করেছে। আদালত আব্দুল লতিফ মির্জা বনাম বাংলাদেশ সরকারের রায়ে প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের নীতি নিশ্চিত করেছে । দুটি রায় বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ এর অধীনে বেশিরভাগ আটককে অবৈধ করার নজির ছিল ।

    বাংলাদেশের আইনে বৈধ প্রত্যাশার মতবাদ বিচারিক নজির দ্বারা বিকশিত হয়েছে।

    কোডিফিকেশন এবং ভাষা

    তথ্য স্বাধীনতা আইন

    ফৌজদারি আইন

    কোম্পানি আইন

    চুক্তি আইন

    ধর্মীয় আইন

    কর প্রদান আইন

    শ্রমিক আইন

    সম্পত্তি আইন

    মেধাসত্ত্ব আইন

    বিচার বিভাগ

    বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা

    বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি

    আইনি পেশা

  • প্রধান বিচারপতি

    প্রধান বিচারপতি

    প্রধান বিচারপতি (ইংরেজি: Chief Justice) হল বিচারর বিভাগ রয়েছে এমন বেশ কিছু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতের প্রিজাইডিং সদস্যের পদ। ইংরেজি সাধারণ আইন অনুসারে এই পদটি গঠন করা হয়। এই ধরনের সর্বোচ্চ আদালত বিশিষ্ট কিছু দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বাংলাদেশ, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, আইয়ারল্যন্ড, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি; তবে যুক্তরাজ্যে এই বিচারব্যবস্থা কিছুটা ব্যতিক্রম।

    প্রধান বিচারপতি

    নিয়োগ প্রক্রিয়া

    প্রধান বিচারপতি নির্ধারন এক একটি অঞ্চলে এক এক প্রক্রিয়ায় করা হয়ে থাকে। বেশিরভাগ রাষ্ট্রেই এই পদটি আদালতের সর্বাপেক্ষা প্রবীন ব্যক্তিকে দেয়া হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে এই পদটির জন্য রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক মনোনয়ন দিয়ে থাকেন যেটি পরবর্তিতে সিনেট কর্তৃক অনুমদিত হতে হয়।

  • টর্ট

    টর্ট

    টর্ট এর উদ্ভব মূলত ল্যাটিন শব্দ Toram থেকে, যার অর্থ দাঁড়ায় ভুল, অর্থাৎ যে দেওয়ানি ভুল আমল যোগ্য। বাংলাদেশে টর্ট কি, তা সম্পর্কে যথাযথভাবে কোথাও, অর্থাৎ সংবিধানে বা কোন আইনে উল্লেখ করা নেই। তবে, বাংলাদেশ সহ আমদের এই ভারতীয় উপমাহাদেশের যতগুলো দেশ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল, সকল দেশের আইন ব্যাবস্থায় কমন ল-এর প্রভাব দেখা যায়। বাংলাদেশ-ও এর ব্যাতিক্রম নয়। টর্ট এর উৎপত্তি ইংল্যান্ডে, তাই এর সরাসরি উল্লেখ বাংলাদেশের সংবিধান বা কোন আইনে না থাকলেও, এখতিয়ারভুক্ত আদালতে এর আমলযোগ্যতা রয়েছে।

    টর্ট

    টর্ট সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা এখনো পর্যন্ত দেওয়া সম্ভব হয়নি। এটি মুলত ধারণা এবং লিগ্যাল ম্যাক্সিমের উপর ভিত্তি করে বর্তমান রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত স্যালমন্ডের অভিমতটি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত, যেখানে তিনি বলেছেন,

    Tort is a civil wrong for which the remedy in common law action for unliquidated damages, and which is not exclusively the breach of a contrat, or, the breach of a trust, or, other merely equitable obligation.

    যার অর্থ দাঁড়ায়,

    টর্ট এমন এক প্রকারের প্রতিকার যা দেওয়ানি ক্ষতিসাধনের দরুন প্রদান করা হয়; যা পারতপক্ষে চুক্তিভঙ্গ, বিশ্বাসভঙ্গ বা এই জাতীয় ন্যায়সম্মত দায়ের অন্তর্গত নয়।

  • জাতীয় শিশু নীতি ২০১১ (বাংলাদেশ)

    জাতীয় শিশু নীতি ২০১১ (বাংলাদেশ)

    জাতীয় শিশু নীতি ২০১১ হলো বাংলাদেশে শিশু অধিকার বাস্তবায়নের একটি আইন। শিশুদের সুরক্ষা ও তাদের জীবন বিকাশের সরকার 2011 সালে আইন প্রণয়ন করেছে। এ আইনে শিশুদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সুদূরপ্রসারী রূপকল্প বহন করা হয়েছে। এনীতিতে শিশু বলতে 18 বছরের কম বয়সী এবং কিশোর বলতে 14 থেকে 18 বছর বয়সীদের বুঝায়। জবরদস্তিমূলক ভারি ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের ব্যবহার করা এই আইনে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।পথশিশু ও বিপথগামী শিশুদের বিকাশে পৃথক ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে ।[১]

    জাতীয় শিশু নীতি ২০১১ (বাংলাদেশ)

    প্রেক্ষাপট

    বাংলাদেশ সংবিধানে ২৮(৪) অনুচ্ছেদে শিশুদের অগ্রগতির বিশেষ বিধান প্রণয়নের উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে শিশুদের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামুলক প্রাথমিক শিক্ষাসহ মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এ লক্ষে ১৯৭৪ সালে শিশুদের সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও অধিকার প্রতিষ্ঠারলক্ষে প্রণীত হয় “শিশু আইন ১৯৭৪”। বহুমাত্রিক উন্নয়নের সাথে সঙ্গতি রেখে এ আইনের যুগোপযোগীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ ১৯৮৯ এ স্বাক্ষর ও অনুসমর্থনকারী প্রথম রাষ্ট্রসমুহের মধ্যে বাংরাদেশ অন্যতম হওয়ায় ১৯৯৪ সালে জাতীয় শিশুনীতি প্রণয়ন করা হয়। ২০০৬ সালে প্রতিবন্ধী শিশুদের অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেশ হিসাবে বাংলাদেশ জাতিসংঘ সনদে স্বাক্ষর করেছে। শিশু নির্যাতন বন্ধ করা, বিশেষ করে কন্যা শিশুদের প্রতি সকল বৈষম্য ও নির্যাতন বন্ধ ও তাদের প্রতি নিরাপত্তা বিধান করা অন্যতম লক্ষ্য ধরা হয়। জাতীয় শিশু অধিকার কমিটির সুপারিশমালার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৪ সালে প্রণীত জাতীয় শিশু নীতিকে আবারও যুগোপযোগী করার জন্য জাতীয় শিশু নীতি ২০১১ প্রণয়ন করে।[১]

    জাতীয় শিশু নীতি ২০১১ এর বিভিন্ন দিক

    সংজ্ঞা : এ নীতিতে শিশু বলতে আঠারো বছরের কম বয়সী ব্যক্তি এবং কিশোর বলতে ১৪ থেকে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের বুঝায়।

    পরিধি : এ নীতি বাংলাদেশের নাগরিক সকল শিশুর ক্ষেত্রে বৈষম্যহীনভাবে বুঝায়।

    মূলনীতি :

    1. বাংলাদেশের সংবিধান, শিশু আইন ও আন্তর্জাতিক সনদসমূহের আলোকে শিশু অধিকার নিশ্চিতকরণ।
    2. শিশু দারিদ্র বিমোচন।
    3. শিশুর প্রতি সকল প্রকাল নির্যাতন ও বৈষম্য দূরীকরণ।
    4. কন্যা শিশুর প্রতি সকল প্রকার নির্যাতন ও বৈষম্য দূরীকরণ।
    5. শিশুর সার্বিক সুরক্ষা ও সর্বোত্তম স্বার্থ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়ে শিশুদের অংগ্রহণ ও মতামত গ্রহণ।

    লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

    1. শিক্ষা, স্বাস্থ, পুষ্টি, নিরাপত্তা, বিনোদন ও অন্যান্য অধিকারের ক্ষেত্রে বয়স, লিঙ্গগত, ধর্মীয়, জাতিগত, পেশাগত, সামাজিক, আঞ্চলিক ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টির পরিচয় নির্বিশেষে সকল শিশু ও কিশোর কিশোরীর জন্য মানসম্পন্ন প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের মাধ্যমে তাদের সর্বোত্তম উন্নয়ন ও বিকাশ নিশ্চিত করা।
    2. কন্যা শিশু এবং প্রতিবন্ধী ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের প্রয়োজন অনুযায়ী সুবিধা প্রদানের বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা।
    3. শিক্ষা ও শিশু বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে শিশুদের দেশ সম্পর্কে আগ্রহী ও সচেতন করে গড়ে তোলা যাতে তারা সৎ, দেশপ্রেমিক ও দায়িত্বশীল নাগরিক রূপে বিকাশ লাভ করতে পারে।
    4. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে শিক্ষার অপরিহার্য বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে শিশুদের একটি বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম হিসেবে গড়ে তোলা যাতে তারা ভবিষ্যতে দেশ ও বিশ্বের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম হয়।
    5. শিশুদের জন্য অনুকূল পারিবারিক পরিবেশ সৃষ্টির বিষয়টি নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা।
    6. শিশু ও কিশোর কিশোরীর জীবনকে প্রভাবিত করে এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পরিকল্পনা প্রণয়নে তাদের মতামত প্রতিফলনের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
    7. শিশু অধিকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইন ও বিধি-বিধান প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

    এভাবে এ নীতিতে শিশু অধিকার বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ, শিশুর নিরাপদ জন্ম ও সার্বিক বিকাশ নিশ্চিতকরণ, শিশুর দারিদ্র বিমোচন, শিশু স্বাস্থ্য, শিশুর বিকাশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা (৩ – ৫ বছর), শিশু শিক্ষা, শিশুর বিনোদন ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, শিশুর সুরক্ষা, প্রতিবন্ধী শিশুর জন্য বিশেষ কার্যক্রম, অটিস্টিক শিশুর জন্য বিশেষ কার্যক্রম, শিশুর জন্ম নিবন্ধন, সংখ্যালঘু ও নৃতাত্ত্বিক শিশুর জন্য বিশেষ কার্যক্রম, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে শিশুর সুরক্ষা, শিশুর অধিকার ও উন্নয়নের সাথে সংশ্লিষ্ট সংস্থা/প্রতিষ্ঠানে শিশুর উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে গৃহীত সকল কার্যক্রমে তাদের মতামত ও অংশগ্রহণের উপর গুরুত্ব প্রদান করা, কিশোর কিশোরীদের উন্নয়ন করা, শিশুশ্রম নিরসনে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা ও বাস্তবায়ন কৌশলসূহ উল্লেখ আছে।[১]

    পরবর্তীতে শিশু আইন

    বাংরাদেশ সরকার পরবর্তীকালে ২০১৩ সালে শিশু আইন প্রণয়ন করে। এ আইনের ধারা ২৬। (১) এ বলা হয়েছে বিচারকালীন শিশুকে নিরাপদ হেফাজতে রাখতে হবে যার মেয়াদ হবে যথাসম্ভব স্বল্পতম সময়ের জন্য। উপধারা (৩) এ বলা হয়েছে শিশুকে নিরাপদ হেফাজতে রাখা একান্ত প্রয়োজন হলে শিশু-আদালত, সংশ্লিষ্ট শিশুকে উক্ত আদালত হতে যুক্তিসঙ্গত দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত কোনো প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করবার জন্য আদেশ প্রদান করবে : তবে শর্ত থাকে যে, এই উপ-ধারার অধীনে কোনো শিশুকে প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করা হলে উক্ত প্রতিষ্ঠানে অবস্থানকারী অধিক বয়স্ক শিশুদের হতে প্রেরিত শিশুকে পৃথক করে রাখতে হবে। ধারা ৫৯। (১) এ বলা হয়েছে সরকার, বিচার প্রক্রিয়ায় আটকাদেশপ্রাপ্ত শিশু এবং বিচারের আওতাধীন শিশুর আবাসন, সংশোধন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে, লিঙ্গভেদে, প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। (২) উপধারা (১) এর প্রাসঙ্গিকতাকে ক্ষুণ্ণ না করিয়া সরকার, যে কোনো সময়, এর যে কোনো ইনস্টিটিউট বা প্রতিষ্ঠানকে শিশু অপরাধীদের অবস্থানের জন্য উপযুক্ত মর্মে প্রত্যয়ন করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে শর্ত রয়েছে- ধারা ৬৩। (৩) দণ্ডবিধির ধারা ৮২-এর উদ্দেশ্যপূরণকল্পে ৯ (নয়) বছর বয়সের কম বয়সী কোনো শিশুকে কোনো প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠানে রাখা যাবে না : তবে শর্ত থাকে যে, কোনো কারণে ৯ (নয়) বছর বয়সের কম বয়সী অভিভাবকহীন কোনো শিশুকে কোথাও পাওয়া গেলে তাকে অধিদফতর বা উহার নিকটস্থ কোনো কার্যালয়ে প্রেরণ করতে হবে এবং অধিদফতর বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বোর্ডের গোচরীভূত করত: সংশ্লিষ্ট শিশুকে সুবিধাবঞ্চিত শিশু গণ্যে, ক্ষেত্রমতো, ধারা ৮৪ বা ধারা ৮৫-এর বিধান অনুযায়ী পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।[২]

    সুপারিশ

    বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ ২০১৭ সালের ২৭ শে আগস্ট জাতীয় প্রেস ক্লাবে শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধে এক লটেবিল বৈঠকে কিছু সুপারিশ করে। যেমন রাষ্ট্রকে শিশুর প্রতি সব ধরণের সহিংসতা বন্ধে সহনশীলতার (জিরো টলারেন্স) নীতি গ্রহণ ও প্রচলিত আইনের কার্যকর বাস্তÍবায়ন এর লক্ষ্যে রাজনৈতিক অঙ্গিকার প্রদান করা। এভাবে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা যাতে সবাই শিশুদের প্রতি মানবিক দৃষ্টি রাখে। ইত্যাদি।[৩]