ঘোড়া ও রথ

বেশ কয়েকটি প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারকে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের পূর্বে বৈশিষ্টসূচক ইন্দো-আর্য প্রত্নসামগ্রীর প্রমাণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। উদাহরণের মধ্যে রয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের পূর্ববর্তীকালের ঘোড়ার হাড় হিসেবে ব্যাখ্যাকৃত পশুর হাড়[note ১৭] এবং রথ হিসেবে ব্যাখ্যাত সিনাউলি শকট-সমাধি।[web ১৩][web ১৪][web ১৫][note ১৮] ঘোড়ার দেহাবশেষ ও সম্পর্কিত প্রত্নসামগ্রী পরবর্তীকালীন হরপ্পা (খ্রিস্টপূর্ব ১৯০০-১৩০০ অব্দ) প্রত্নক্ষেত্রগুলিতে পাওয়া যায়। তার থেকে এই ইঙ্গিত মেলে যে পরবর্তীকালীন হরপ্পা যুগেও ঘোড়া বিদ্যমান ছিল।[১১১] তবে হরপ্পা সভ্যতায় ঘোড়া সম্ভবত কোনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত না,[১১২] যা করত বৈদিক যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-৫০০ অব্দ)।[১১৩][note ১৯] দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম অবিতর্কিত ঘোড়ার দেহাবশেষ পাওয়া যায় গান্ধার সমাধি সংস্কৃত বা সোয়াট সংস্কৃতি (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০-৮০০ অব্দ) থেকে,[১১৩] যা ইন্দো-আর্যদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।[১১৪]

হরপ্পা প্রত্নক্ষেত্র সুরকোটাডা (খ্রিস্টপূর্ব ২৪০০-১৭০০ অব্দ) থেকে প্রাপ্ত ঘোড়ার দেহাবশেষকে এ. কে. শর্মা ইক্যুয়াস ফেরাস ক্যাবালাস (Equus ferus caballus) হিসেবে শনাক্ত করেন।[note ২০][note ২১] যদিও মিডো (১৯৯৭) প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদ এই মতের বিরোধী। তাঁরা মনে করেন ইক্যুয়াস ফেরাস ক্যাবালাস-এর দেহাবশেষকে ইক্যুয়াস এসিনাস (গাধা) বা ইক্যুয়াস হেমিওনাস (ওনাগার) অন্যান্য ইক্যুইড প্রজাতির থেকে পৃথক করা কঠিন।[১১৫]

২০১৮ সালে সিনাউলিতে ব্রোঞ্জ যুগের নিরেট-চাকতির চাকাবিশিষ্ট শকট আবিষ্কৃত হয়। এগুলি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-১৮০০ অব্দের গিরিমাটি রঙের মৃৎশিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।[১১৬] কেউ কেউ এগুলিকে অশ্ব-কেন্দ্রিক ইন্দো-আর্য জাতিগোষ্ঠীর আবির্ভাবের পূর্ববর্তীকালের ঘোড়ায় টানা রথ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।[১১৭][১১৬][web ১৩][web ১৪][web ১৫][note ১৮] পারপোলার মতে, শকটগুলি ছিল ষাঁড়ে-টানা গাড়ি এবং এগুলি ভারতীয় উপমহাদেশে ইন্দো-ইরানীয় অভিপ্রয়াণের প্রথম তরঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত।[১১৬] উল্লেখ্য, গিরিমাটি রঙের মৃৎশিল্প সংস্কৃতির (খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-১৫০০ অব্দ) সঙ্গে পরবর্তীকালীন হরপ্পা সংস্কৃতি ও বিভিন্ন স্তেপ-সংস্কৃতির সাদৃশ্য লক্ষিত হয়।[১১৬]

সরস্বতী নদী

ঋগ্বেদে সরস্বতীকে এক মহতী নদী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। স্বাদেশিকতাবাদীরা এই বর্ণনাগুলিকে এক বাস্তব নদীর প্রেক্ষিতে গ্রহণ করেছেন এবং সরস্বতী নদীকে শনাক্ত করেছেন সিন্ধু নদের পূর্ব দিকের উপনদী ঘগ্গর-হাকরা হিসেবে। ঘগ্গর-হাকরা নদী খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ নাগাদ শুকিয়ে যাওয়ায়, স্বাদেশিকতাবাদীদের মতে বৈদিক জাতিগোষ্ঠী তারও আগে থেকে এই অঞ্চলে উপস্থিত ছিল।[৬৭]

ঋগ্বেদে এক বাস্তব নদীর যে উল্লেখ পাওয়া যায় তা থেকে এমন ইঙ্গিত মেলে যে সরস্বতী নদী “ততদিনে তার জলের প্রধান উৎসটিকে হারিয়েছিল এবং নিশ্চিতই একটি সমুদ্রে গিয়ে মিশেছিল,”[১১৮] “যা বর্তমান যুগের পরিস্থিতিটিকে বর্ণনা করে, কারণ সরস্বতী তার জলের অধিকাংশই হারিয়ে ফেলেছে।”[১১৮][note ২২] “সরস্বতী” নদী হিসেবে দক্ষিণ আফগানিস্তানের হেলমান্দ নদীটিকেও শনাক্ত করা যেতে পারে।[১২০] বৈদিক জাতিগোষ্ঠী পাঞ্জাবে এসে বসতি স্থাপনের পর এই নদীর নামই সম্ভবত সেটির সংস্কৃত রূপে ঘগ্গর-হাকরা নদীর নাম হিসেবে পুনরায় ব্যবহৃত হয়েছিল।[১২০][১২১][note ২৩] ঋগ্বেদের সরস্বতী নদী বলতে সম্ভবত দু’টি স্বতন্ত্র নদীকেও বোঝাতে পারে, শাখান্তর্গত মণ্ডলগুলিতে এই নামে হেলমান্দ নদীকে এবং অধিকতর সাম্প্রতিককালে রচিত দশম মণ্ডলে এই নামে সম্ভবত ঘগ্গর-হাকরা নদীকে বুঝিয়েছে।[১২০]

হরপ্পা সভ্যতাকে বৈদিক সভ্যতা হিসেবে চিহ্নিতকরণ

স্বাদেশিকতাবাদীরা ভারতের এক অবিরাম সাংস্কৃতিক বিবর্তনের পক্ষে মত প্রকাশ করেন বলে হরপ্পা ও বৈদিক যুগের সভ্যতার মধ্যে পার্থক্যের বিষয়টি অস্বীকার করে[১২২][৬৫] সিন্ধু সভ্যতার জাতিগোষ্ঠীটিকে বৈদিক জাতিগোষ্ঠী বলে চিহ্নিত করেন।[২] কাকের মতে, “ভারতীয় সভ্যতাকে অবশ্যই দেখতে হবে সিন্ধু-সরস্বতী পরম্পরার আদিতম পর্যায় (খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ বা ৮০০০ অব্দ) থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলে আসা এক পরম্পরা হিসেবে।”[৯][note ২৪][৬৫] এই দাবির কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক, ভাষাবৈজ্ঞানিক ও বংশানুবিদ্যা-সম্বন্ধীয় প্রমাণ না থাকায় তা মূলধারার গবেষকেদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।[২৯]

এক পৌরাণিক কালপঞ্জিকে স্বতঃসিদ্ধ বলে গ্রহণ

“আর্য-স্বাদেশিকতাবাদ” ধারণাটি ধর্মীয় ইতিহাসের প্রথাগত হিন্দু ধারণার সঙ্গে খাপ খায়। কারণ, এই ধারণা অনুযায়ী, হিন্দুধর্মের উৎপত্তি স্মরণাতীত কালে এবং বৈদিক আর্যরা সুপ্রাচীনকাল থেকেই ভারতে বসবাস করছেন।[note ২৫] স্বাদেশিকতাবাদীদের ধারণার মূলে রয়েছে রামায়ণ, মহাভারতপুরাণ সাহিত্যের কালপঞ্জি, যেখানে রাজাদের নামের তালিকা ও বংশলতিকা পাওয়া যায়।[১২৩][১২৪] প্রাচীন ভারতের প্রথাসম্মত কালপঞ্জি গঠনে এই তালিকাই ব্যবহৃত হয়।[১২৫] “স্বাদেশিকতাবাদীরা” অনুসরণ করেন এক “পৌরাণিক অ্যাজেন্ডা”,[১২৬] যাতে বলা হয় যে, এই তালিকাগুলির সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দ পর্যন্ত। জানা যায় যে, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ নাগাদ পাটলিপুত্রের মৌর্য রাজসভায় উপস্থিত গ্রিক রাজদূত মেগাস্থিনিস ১৫৩ জন রাজার এক প্রথাসম্মত তালিকার কথা শুনেছিলেন। এই তালিকার রাজাদের রাজত্বকাল ৬,০৪২ বর্ষব্যাপী, যা খ্রিস্টপূর্ব ৩১০২ সালে কলিযুগের শাস্ত্রসম্মত সূচনাকালেরও পূর্ববর্তী।[১২৩] এই রাজতালিকার ভিত্তি সূত চারণকবি প্রথা এবং এই তালিকা যা থেকে উৎসারিত তা মুখে মুখে প্রচারিত হত এবং অবিরাম পরিমার্জিত হত।[১২৩]

এই তালিকাগুলির সঙ্গে জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়ে থাকে, যার মাধ্যমে ঋগ্বেদের এক প্রাচীনতর তারিখ অনুমান করা হয়।[১২৭] এরই সঙ্গে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ও ঘটনাবলির পুনঃতারিখায়নের কাজও চলে। বুদ্ধের তারিখ নির্ধারিত হয় খ্রিস্টপূর্ব ১১০০ অব্দ বা খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ অব্দ এবং চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ) স্থলাভিষিক্ত হয় গুপ্ত রাজা চন্দ্রগুপ্ত।[১২৮][note ২৬] ভারত যুদ্ধের (কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ) তথা কলিযুগের আরম্ভের তারিখ নির্ধারিত হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩১৩৯-৩৮ অব্দ।[note ২৭]

আর্য-স্বাদেশিকতাবাদী দৃশ্যকল্প

কাজানাসের মতানুসারে ইন্দো-আর্য অভিপ্রয়াণ[১২৯]

মাইকেল উইটজেল “স্বদেশীয় আর্য” দৃশ্যকল্পের তিনটি প্রধান ধরনকে চিহ্নিত করেছেন:[১৩০]

১. একটি “নরমপন্থী” মত, যেখানে বলা হয়েছে যে ঋগ্বৈদিক আর্যরা ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলেরই আদি বাসিন্দা। অরবিন্দ ঘোষদয়ানন্দ এই মতে বিশ্বাস করতেন।;[note ২৮]

২. “ভারত থেকে বহির্গমন” মতে বিশ্বাসীরা মনে করেন যে, ভারতই হল প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় স্বভূমি। এই মতবাদটি প্রথম প্রস্তাবিত হয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। পরবর্তীকালে হিন্দুত্ব-অনুরাগী[১৩২] কোয়েনরাড এস্ট (১৯৯৯) এটির পুনরুজ্জীবন ঘটান। হিন্দু জাতীয়তাবাদে শ্রীকান্ত তালাগেরি (২০০০) কর্তৃক এটি আরও জনপ্রিয়তা লাভ করে।[১৩৩];[১৩১][note ২৯]

৩. ভারত থেকেই বিশ্বের সকল ভাষা ও সভ্যতা উৎসারিত হয়েছে, এই মতবাদ। ডেভিড ফ্রলি প্রমুখ এই মতের প্রবক্তা।

কাজানাস একটি চতুর্থ দৃশ্যকল্পও যোগ করেছেন:

৪. খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০০ অব্দেরও পূর্বে আর্যরা সিন্ধু উপত্যকায় প্রবেশ করে এবং হরপ্পাবাসীর সঙ্গে মিশে যায় অথবা তারাই ছিল হরপ্পার অধিবাসী।[২৬]

অরবিন্দের আর্য বিশ্ববোধ

অরবিন্দের মতে, “আর্য”রা কোনও নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর সদস্য নয়, বরং যে ব্যক্তি “আত্ম-সংস্কৃতির, অন্তর্মুখী ও বহির্মুখীর প্রথার, আদর্শবাদের, মহাপ্রাণতার একটি নির্দিষ্ট ধরন গ্রহণ করেন”, তিনিই আর্য।[১৩৫] অরবিন্দ আর্যদের শক্তিমত্তা ও চারিত্রিক দৃঢ়তার পুনরুত্থান ঘটিয়ে ভারতের শক্তি বৃদ্ধি করতে চেয়েছিলেন।[১৩৬] ভারতে “আর্য অনুপ্রবেশকারী” ও এক কৃষ্ণাঙ্গ স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে জাতিগত বিভাজনের ঐতিহাসিকতা তিনি অস্বীকার করেন। অবশ্য তিনি প্রাচীন ভারতে দুই প্রকার সংস্কৃতির কথা স্বীকার করেন। যথা: উত্তর ও মধ্য ভারত ও আফগানিস্তানের আর্য সংস্কৃতি এবং পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের অনার্য সংস্কৃতি। এইভাবেই তিনি ইউরোপীয় ইতিহাসবিদদের দ্বারা কথিত সাংস্কৃতিক বিভাজনের ধারণাটি গ্রহণ করেছিলেন।[১৩৭]

“ভারত থেকে বহির্গমন” তত্ত্ব

চিত্র:OIT map.jpg
সিন্ধু উপত্যকা থেকে প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহের প্রসারের মানচিত্র। তারিখ নির্ধারিত হয়েছে এলস্টের “উদীয়মান অ-অনুপ্রবেশবাদী মডেল” অনুযায়ী।

“ভারত থেকে বহির্গমন” (ইংরেজি: Out of India theory, সংক্ষেপে: OIT) বা “ভারতীয় উরহেইমত তত্ত্ব” হল এমন একটি মতবাদ যা মনে করে, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের উৎস উত্তর ভারত এবং সেখান থেকে অন্যান্য ইন্দো-ইউরোপীয় অঞ্চলে অনুপ্রবেশের একাধিক পর্যায়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।[web ৩] এই তত্ত্ব অনুযায়ী, হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরা ভাষাগত দিক থেকে ইন্দো-আর্য।[৫৭]

তাত্ত্বিক পরিদর্শন

“উদীয়মান বিকল্প”

ডেভিড ফ্রাওলি

ঔপনিবেশিক শাসন এবং হিন্দু রাজনীতির জন্য তাৎপর্য

আর্য-স্বাদেশিকতাবাদের পক্ষে আর্য আক্রমণ তত্ত্ব হিন্দু জাতীয়তাবাদে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।[১৩৮] ঔপনিবেশিকতার পটভূমিতে এবং ভারতে জাতি গঠনের পরবর্তী কাজকে বোঝাতে হবে।

ঔপনিবেশিক ভারত

হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদ এবং জাতীয়তাবাদ

মূলধারার দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে, হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন আর্য বহিরাগমণ উৎসকে অস্বীকার করে। আর্য সমাজ (আর্যদের সমাজ) এর প্রতিষ্ঠাতা দয়ানন্দ সরস্বতী মতে বেদ হচ্ছে সমস্ত জ্ঞানের উৎস যা আর্যদের নিকট প্রকাশিত হয়েছিল। তিব্বতে প্রথম মানুষ (একজন আর্য) সৃষ্টি হয়েছিল এবং সেখানে কিছুকাল বসবাস করে আর্যরা নেমে এসে ভারতে বসতি স্থাপন করেছিল, যা আগে শূন্য ছিল।[১৩৯]

থিওসফিক্যাল সোসাইটি মতে আর্যরা ছিল ভারতের প্রাচীন নিবাসী, কিন্তু তারা ইউরোপীয় সভ্যতার পূর্বপুরুষও ছিল। সোসাইটি ভারতের আধ্যাত্মবাদ এবং ইউরোপের বস্তুবাদের মধ্যে একটি দ্বিধাবিভক্তি দেখেছিল।[১৪০]

রোমিলা থাপারের মতে, সাভারকর এবং গোলওয়ালকরের নেতৃত্বে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা, জাতির জন্য একটি হিন্দু পরিচয় তৈরি করতে আগ্রহী, তারা মনে করে যে, আদি হিন্দুরা ছিল আর্য এবং তারা ভারতের প্রাচীন নিবাসী। ভারতের জনগণের মধ্যে আর্যদের কখনো কোনো আগ্রাসন হয়নি এবং কোনো বিরোধ ছিল না। আর্যদের ভাষা ছিল সংস্কৃত এবং পরবর্তীতে ভারত থেকে পশ্চিমে আর্য সভ্যতা ছড়িয়ে পড়ে।[১৪০]

উইটজেল সাভারকর এবং গোলওয়ালকরের লেখায় “স্বাদেশিক আর্য” ধারণার সন্ধান করেছেন। গোলওয়ালকার (১৯৩৯) উপমহাদেশে “আর্যদের” কোনো অভিবাসন অস্বীকার করেছিলেন, জোর দিয়েছিলেন যে সমস্ত হিন্দু সর্বদা “মাটির সন্তান”। উইটজেলের মতে এই ধারণাটি সমসাময়িক ফ্যাসিবাদের রক্ত আর মাটির কথা মনে করিয়ে দেয়। যেহেতু এই ধারণাগুলো আন্তর্জাতিকতাবাদী এবং সমাজমুখী নেহেরু-গান্ধী সরকারের দ্বারপ্রান্তে আবির্ভূত হয়েছিল, সেগুলো কয়েক দশক ধরে সুপ্ত ছিল এবং শুধুমাত্র ১৯৮০-এর দশকে তা প্রাধান্য পায়।[১৪১]

বার্গন্ডার একইভাবে গোলওয়ালকারকে “স্বাদেশিক আর্য” ধারণার প্রবর্তক এবং গোয়েলের ভয়েস অফ ইন্ডিয়াকে এর উল্লেখযোগ্যতার উত্থানের উপকরণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন:[১৪২]

আর্য অভিবাসন তত্ত্ব প্রথমে হিন্দু জাতীয়তাবাদে কোনো বিশেষ যুক্তিপূর্ণ ভূমিকা পালন করেনি। […] উদাসীনতার এই ছাপ পরিবর্তিত হয়, তবে মাধব সদাশিব গোলওয়ালকরের (১৯০৬-১৯৭৩) সাথে, যিনি ১৯৪০ সাল থেকে তার মৃত্যু পর্যন্ত চরমপন্থী আধাসামরিক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এর নেতা ছিলেন। […] তাদের অন্যান্য প্রকাশ্য আক্রমণাত্মক শিক্ষার বিপরীতে, হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা আর্য অভিবাসনের প্রশ্নকে জনসাধারণের বক্তৃতার বাইরে রাখতে বা পরিবর্তন করার চেষ্টা করেনি; বরং, হিন্দুদের আদিবাসীত্বের তত্ত্বকে সর্বজনীন স্বীকৃতি অর্জনে সাহায্য করার প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। এর জন্য প্রকাশক সীতা রাম গোয়েলের (জন্ম ১৯২১) উদ্যোগ ছিল সিদ্ধান্তমূলক। গোয়েলকে সবচেয়ে কট্টরপন্থী মনে করা যেতে পারে, কিন্তু একই সাথে হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শীদের মধ্যে অন্যতম বুদ্ধিজীবীও। […] ১৯৮১ সাল থেকে গোয়েল ‘ভয়েস অফ ইন্ডিয়া’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা চালাচ্ছেন যা ইংরেজিতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী সাহিত্য প্রকাশ করে এমন কয়েকটির মধ্যে একটি যা একই সাথে ‘বৈজ্ঞানিক’ দাবি করে। যদিও কোনও অফিসিয়াল সংযোগ নেই, ‘ভয়েস অফ ইন্ডিয়া’-এর বইগুলি – যা অসামান্য টাইপোগ্রাফিক মানের এবং একটি ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি হয় – সঙ্ঘ পরিবারের নেতাদের মধ্যে বিস্তৃত। […] ১৯৯০-এর দশকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক প্রভাবের ফলে আর্য অভিবাসন তত্ত্ব সংশোধন করার প্রচেষ্টাও একাডেমিক জনসাধারণের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে।

বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক তাৎপর্য

লার্স মার্টিন ফস “আর্য স্বাদেশিকতাবাদ” এর রাজনৈতিক তাৎপর্য উল্লেখ করেছেন।[১৩৮] তিনি উল্লেখ করেন যে “আর্য স্বাদেশিকতাবাদ” হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা তাদের মতাদর্শের একটি অংশ হিসাবে গ্রহণ করেছে, যা এটিকে একটি পণ্ডিত সমস্যা ছাড়াও একটি রাজনৈতিক বিষয় করে তোলে।[১৩৮] আদিবাসী আর্যবাদের প্রবক্তারা অগত্যা পশ্চিমা ভারতবিদ্যার “নৈতিক অযোগ্যতার” সাথে জড়িত, যা বেশিরভাগ আদিবাসী সাহিত্যে একটি পুনরাবৃত্ত থিম। আদিবাসী সাহিত্যে এবং অর্গানাইজারের মতো হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রকাশনাগুলোতে একই অলঙ্কার ব্যবহার করা হচ্ছে।[১৩৮]

অভিজিৎ রবিনুতলার মতে, ভারতে হিন্দুত্বের একচেটিয়া দাবির জন্য প্রাচীন নিবাসীদের অবস্থান অপরিহার্য:[১৪৩]

বিজেপি হিন্দুত্ব বা “হিন্দুত্ব” সম্পর্কে পার্টির ধারণার জন্য ইন্দো-আর্যদের মৌলিক বলে মনে করে: ভারত শুধুমাত্র হিন্দুদের এবং তাদের জন্য একটি জাতি। যারা ভারতকে তাদের পবিত্র ভূমি মনে করে তারাই জাতিতে থাকবে। বিজেপির দৃষ্টিকোণ থেকে, ইন্দো-আর্য জনগণ ভারতের প্রাচীন নিবাসী ছিল এবং তাই তারাই প্রথম ‘প্রকৃত হিন্দু’। তদনুসারে, এই দৃষ্টিকোণ থেকে ‘ভারতীয়’ পরিচয়ের একটি অপরিহার্য অংশ হল ভূমির প্রাচীন নিবাসী হওয়া।

ক্যালিফোর্নিয়ার হিন্দু পাঠ্যপুস্তক মামলার সাথে আর্য উৎস সম্পর্কে মতবিরোধের প্রতিক্রিয়া ক্যালিফোর্নিয়ার আদালতে পৌঁছেছে, যেখানে দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া ইতিহাসবিদ এবং ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেসের সভাপতি, দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝা সুপিরিয়রের কাছে একটি “গুরুত্বপূর্ণ হলফনামা” অনুসারে ক্যালিফোর্নিয়া আদালত:

…ভারতে আর্য উৎস বিতর্কের একটি ইঙ্গিত প্রদান করে, … আদালতকে ‘স্বাদেশিক আর্য’ দাবির পক্ষে না পড়ার জন্য বলেছিল কারণ এটি ‘মুসলিম ও খ্রিস্টানদের বিদেশী হিসাবে বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে গেছে এবং ভারতীয় সংস্কৃতিতে অ-হিন্দুদের অবদান’ প্রায় অস্বীকার করেছে।

থাপারের মতে, মোদির সরকার এবং বিজেপি “পৌরাণিক কাহিনী এবং স্টেরিওটাইপগুলোকে ছড়িয়ে দিয়েছে,” যেমন “আর্যদের একক অভিন্ন সংস্কৃতি, হিন্দুদের পূর্বপুরুষ, উপমহাদেশে বিরাজমান, অন্য সকলকে অন্তর্ভুক্ত করার” উপর জোর দেওয়া সত্ত্বেও ভারতে পরিযাণের জন্য পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রমাণ, যা “প্রাথমিক ইতিহাসের হিন্দুত্ব নির্মাণের প্রতি অশ্লীলতা।”

মূলধারার বৃত্তি দ্বারা প্রত্যাখ্যান

আরও দেখুন

পাদটীকা