ভিন্ডোল্যান্ডা ফলক হচ্ছে ব্রিটেনে প্রাপ্ত প্রাচীনতম হাতে লেখা নথি। এগুলো সম্ভবত রোমান-ব্রিটেনের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তের জীবনাচার সম্পর্কিত তথ্যের সবচেয়ে ভাল উৎস।[১][২]
Philip Howard (১০ এপ্রিল ১৯৭৪)। “Lime-wood records of Agricola’s soldiers”। The Times। পৃষ্ঠা 20। But the most significant discovery was a room littered with writing tablets. Of these eight or nine were the conventional stylus tablets, once covered with wax which was inscribed with a stylus. The rest are unique: very thin slivers of lime wood with writing on them in a carbon-based ink that can be deciphered by infrared photography. They are the first literary evidence from this period of British history, the equivalent of the records of the Roman Army found on papyrus in Egypt and Syria.|সংবাদপত্র= এ বহিঃসংযোগ দেয়া (সাহায্য)
Birley, Anthony (২০০২), Garrison Life at Vindolanda, Stroud, আইএসবিএন978-0-7524-1950-3 Birley, Robin (২০০৫), Vindolanda: extraordinary records of daily life on the northern frontier, Roman Army Museum Publications, আইএসবিএন978-1-873136-97-3 Bowman, Alan K; Thomas, J David (১৯৭৪), The Vindolanda writing tablets, Northern history booklet, no. 47., Graham, আইএসবিএন978-0-85983-096-6 Bowman, Alan K; Thomas, J David (১৯৮৩), Vindolanda: The Latin Writing Tablets, Society for the Promotion of Roman Studies, আইএসবিএন978-0-90776-402-1 Bowman, Alan K (১৯৯৪a), Life and letters on the Roman frontier : Vindolanda and its people, British Museum Press, আইএসবিএন978-0-7141-1389-0 Bowman, Alan K; Thomas, J David (১৯৯৪b), The Vindolanda writing-tablets : (Tabulae Vindolandenses II), British Museum Press, আইএসবিএন978-0-7141-2300-4 Bowman, Alan K; Thomas, J David (২০০৩), The Vindolanda writing-tablets (Tabulae Vindolandenses III), British Museum Press, আইএসবিএন978-0-7141-2249-6 Bowman, Alan K; Thomas, J David; Tomlin, R. S. O. (২০১০), “The Vindolanda Writing- Tablets (Tabulae Vindolandenses IV, Part 1)”, Britannia, 41: 187–224, ডিওআই:10.1017/S0068113X10000176
ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে জঁ-ফ্রঁসোয়া শঁপোলয়োঁ ও থমাস ইয়ং প্রমুখ ইউরোপীয় গবেষকদের রচনার মাধ্যমে প্রাচীন মিশরে ব্যবহৃত লিখন পদ্ধতিরপাঠোদ্ধার করা হয়। হায়ারোগ্লিফ (চিত্রলিপি), হায়রাটিক ও ডেমোটিক লিপি সহ প্রাচীন মিশরীয় লিপিগুলি খ্রিস্টীয় চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে বোধগম্যতা হারিয়ে ফেলে এবং সেগুলির পরিবর্তে ক্রমশ কপটিক বর্ণমালার ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী প্রজন্মগুলির কাছে প্রাচীনতর লিপিগুলির জ্ঞানের ভিত্তি ছিল গ্রিক ও রোমান লেখকদের রচনা; কিন্তু এই লেখকদের বোঝার মধ্যেও ভুল ছিল। এই কারণেই একটি বহুল প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা গড়ে ওঠে যে, মিশরীয় লিপি আগাগোড়াই ভাবমূলক (যে লিপি শব্দের পরিবর্তে ধারণার প্রতিনিধিত্ব করে); এমনকি এও মনে করে হয় যে চিত্রলিপিগুলি ছিল এক প্রকার গুহ্য আধ্যাত্মিক লিপি এবং তা কথ্য ভাষা নথিবদ্ধকরণের কাজে ব্যবহার করা হত না। মধ্যযুগে ও আদি আধুনিক যুগেইসলামি ও ইউরোপীয় গবেষকেরা এই লিপি পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করেন এবং এর মধ্যে ধ্বনিবিজ্ঞান-সংক্রান্ত উপাদান থাকতে পারে বলে মত প্রকাশও করেন। কিন্তু চিত্রলিপি পুরোপুরিই ভাবমূলক – এই বদ্ধমূল ধারণা অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত লিপিটিকে বুঝে ওঠার পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
১৭৯৯ সালে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মিশর অভিযাত্রী দলের সদস্যেরা রোসেটা প্রস্তরফলক আবিষ্কার করেছিলেন। এই ফলকটিতে চিত্রলিপি, ডেমোটিক ও গ্রিক ভাষায় একটি সমান্তরাল পাঠ রয়েছে। মনে করা হয়েছিল, এই মিশরীয় পাঠটিতে মিশরীয় ভাষার সর্বশেষ পর্যায় কপটিক ভাষার প্রমাণ থাকায় এটির গ্রিক অনুবাদের মাধ্যমেই পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হবে। আঁতোইন-ইসাক সিলভেস্তর দে সেসি ও জোহান ডেভিড অকারবল্ড যথেষ্ট সময় নিয়ে এই কাজে এগোলেও কাজটি কঠিন বলেই প্রমাণিত হয়। এই কাজে হাত দিয়ে ইয়ং লক্ষ্য করেন যে ডেমোটিক অক্ষরগুলি চিত্রলিপি থেকেই উৎসারিত। তিনি ডেমোটিকের মধ্যে বেশ কয়েকটি ধ্বনিবিজ্ঞান-সংক্রান্ত চিহ্নও চিহ্নিত করেন। এছাড়া ইয়ং বিদেশি-বংশোদ্ভূত মিশরীয় রাজা পঞ্চম টলেমির নামাঙ্কিত একটি কার্তুশে ধ্বনিবাচক অক্ষর সহ অনেক চিত্রলিপির অর্থও চিহ্নিত করেন। যদিও তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে ধ্বনিবাচক চিত্রলিপিগুলি অ-মিশরীয় শব্দ লেখার কাজেই ব্যবহৃত হত। ১৮২০-এর দশকের গোড়ার দিকে শঁপোলয়োঁ টলেমির কার্তুশটির সঙ্গে অন্যান্যগুলির তুলনা করেন এবং উপলব্ধি করেন যে চিত্রলিপিমূলক লিপিটি আসলে ধ্বনিবাচক ও ভাবমূলক উপাদানের একটি মিশ্রণ। শঁপোলয়োঁর দাবি নিয়ে প্রথমে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছিল এবং অভিযোগ করা হয়েছিল যে তিনি ঋণস্বীকার না করেন ইয়ং-এর ধারণাগুলি ধার করেছেন। কিন্তু ক্রমশ শঁপোলয়োঁর দাবি মান্যতা অর্জন করে। শঁপোলয়োঁ অধিকাংশ ধ্বনিমূলক চিত্রলিপির অর্থ সাদামাটাভাবে চিহ্নিত করেন এবং প্রাচীন মিশরীয় ভাষার ব্যাকরণ ও শব্দভাণ্ডারের অধিকাংশটিই পুনরুদ্ধার করেন। এদিকে ইয়ং রোসেটা প্রস্তরফলক ব্যবহার করে অন্যান্য গ্রিক ও ডেমোটিক সমান্তরাল লিপির সংযোগে ডেমোটিক লিপির বৃহত্তর অংশের পাঠোদ্ধার করেন।
পাঠোদ্ধারের প্রক্রিয়াটি ১৮২৯ সালে ইয়ং-এর মৃত্যু এবং ১৮৩২ সালে শঁপোলয়োঁর মৃত্যুর পরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। কিন্তু ১৮৩৭ সালে কার্ল রিচার্ড লেপসিয়াস দেখিয়ে দেন যে অনেক চিত্রলিপিতেই একটির পরিবর্তে দুই বা তিনটি ধ্বনির মিশ্রণ উপস্থাপিত হয়েছে। ইম্যানুয়েল ডে রুজ প্রমুখ অন্যান্য গবেষকেরা মিশরীয় ভাষা নিয়ে গবেষণার কাজে এতটাই অগ্রসর হতে পেরেছিলেন যে, ১৮৫০-এর দশকের মধ্যেই প্রাচীন মিশরীয় গ্রন্থগুলি সম্পূর্ণ অনুবাদ করা সম্ভবপর হয়। মোটামুটি একই সময়ে কিউনিফর্মের পাঠোদ্ধারের সঙ্গে মিশরীয় লিপির পাঠোদ্ধারকরণ মানব ইতিহাসের প্রাচীনতম পর্যায়ের একদা-অবোধগম্য গ্রন্থগুলিকে বোধগম্য করে তোলে।
প্রাচীন মিশরের ইতিহাসে অধিকাংশ পর্ব জুড়ে রয়েছে দু’টি প্রধান লিখন পদ্ধতি। চিত্রলিপির উদ্ভব ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ অব্দ নাগাদ। এটি চিত্রমূলক চিহ্নের একটি পদ্ধতি, যা প্রধানত আনুষ্ঠানিক লেখগুলির জন্য ব্যবহৃত হত। চিত্রলিপি থেকে উদ্ভূত হায়রাটিক ছিল একটি হস্তলিপি লিখন পদ্ধতি। এটি ব্যবহার করা হত মূলত প্যাপিরাসের উপর লেখালিখির কাজে। এই লিপিটির বয়সও চিত্রলিপির প্রায় সমান। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে হায়রাটিক লিপি থেকে যে তৃতীয় লিপিটির উদ্ভব ঘটে তা বর্তমানে ডেমোটিক নামে পরিচিত। এই লিপিটি এর চিত্রলিপিমূলক পূর্বসূরিটির থেকে এতটাই ভিন্ন যে, চিহ্নগুলির মধ্যে সম্পর্কগুলিকে চিহ্নিত করার কাজটি অত্যন্ত কঠিন ছিল।[Note ১] ডেমোটিক লিপিটি মিশরীয় ভাষা লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা প্রচলিত পদ্ধতিতে পরিণত হয় এবং তার পর থেকে চিত্রলিপি ও হায়রাটিক লিপির ব্যবহার শুধুমাত্র ধর্মীয় ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে মিশরে গ্রিক টলেমীয় রাজবংশের শাসনের সূত্রপাত ঘটে। টলেমীয় শাসনে এবং তারও পরবর্তীকালে রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে মিশরে গ্রিক ও ডেমোটিক উভয় লিপিই পাশাপাশি চলত। চিত্রলিপিগুলি উত্তরোত্তর অচলিত হয়ে পড়ে এবং প্রধানত মিশরীয় পুরোহিতদের দ্বারাই ব্যবহৃত হতে থাকে।[৫]
তিনটি লিপিই ছিল ধ্বনিমূলক চিহ্ন (কথ্য ভাষার শব্দগুলির প্রতিনিধিত্বকারী) এবং ভাবমূলক চিহ্নের (ধারণার প্রতিনিধিত্বকারী) একটি মিশ্রণ। ধ্বনিমূলক চিহ্নগুলির মধ্যে ছিল একাক্ষরী, দ্ব্যক্ষরী ও ত্র্যক্ষরী চিহ্ন, যা যথাক্রমে এক, দুই বা তিনটি ধ্বনির প্রতীক। ধ্বনিমূলক চিহ্নের মধ্যে ছিল সমগ্র শব্দের প্রতিনিধিত্বকারী চিত্রলিপি এবং ধ্বনিমূলক চিহ্নের দ্বারা লিখিত একটি শব্দের অর্থনির্ণায়ক নির্দেশক চিহ্নাবলি।[৬]
অনেক গ্রিক ও রোমান লেখকেরা এই লিপিগুলির কথা লিখেছিলেন। মিশরীয়রা যে দুই বা তিনটি লিখন পদ্ধতি ব্যবহার করেন সে ব্যাপারেও অনেকে অবহিত ছিলেন। কিন্তু সেই সব রচনার মধ্যে যেগুলি পরবর্তীকালে পাওয়া গিয়েছিল সেগুলির কোনওটিতেই এই লিপিগুলি কীভাবে কাজ করত তা সঠিকভাবে বিবৃত হয়নি। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে ডায়োডোরাস সিক্যুলাস মিশরীয় চিত্রলিপিকে স্পষ্টভাবে ভাবমূলক লিপি হিসেবে বর্ণনা করেন। অধিকাংশ ধ্রুপদি গ্রন্থকারই এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত ছিলেন। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে প্লুটার্ক ২৫টি মিশরীয় অক্ষরের কথা উল্লেখ করেন। তিনি সম্ভবত চিত্রলিপি বা ডেমোটিকের ধ্বনিমূলক দিকটির সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। কিন্তু তিনি কী অর্থ করেছিলেন তা স্পষ্ট নয়।[৭] ২০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আলেকজান্দ্রিয়ার ক্লিমেন্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, কোনও কোনও চিহ্ন ধ্বনিমূলক, কিন্তু তা চিহ্নগুলির রূপকার্থ-কেন্দ্রিক। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে প্লন্টিয়াস দাবি করেন যে, চিত্রলিপিগুলি শব্দের প্রতিনিধিত্ব করে না, বরং সেগুলি যেসব বস্তুকে চিত্রিত করে তার প্রকৃতির দৈব-অনুপ্রাণিত মৌলিক অন্তর্দৃষ্টির পরিচায়ক মাত্র।[৮] খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে আম্মিয়ানাস মার্সেলিনাস একটি ওবেলিস্কে খোদিত চিত্রলিপিমূলক লেখটি অন্য এক লেখকের অনুবাদ থেকে প্রতিলিপি করেন। কিন্তু অনুবাদটি এতটাই অপকৃষ্ট ছিল যে তা থেকে লিখন ব্যবস্থার নিয়মাদি সঠিক বোঝা সম্ভব হয়নি।[৯] সে যুগের যে বইগুলিতে চিত্রলিপিগুলি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে তার মধ্যে হায়ারোগ্লিফিকা বইটিই আধুনিক কালে সুলভ। সম্ভবত খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে রচিত এই বইটি হোরাপোলো নামে এক ব্যক্তির রচনা হিসেবে পরিচিত। এই বইতে এক-একটি চিত্রলিপির স্বতন্ত্র অর্থ আলোচনা করা হয়েছে, তবে কীভাবে এই চিহ্নগুলি ব্যবহার করে শব্দবন্ধ বা বাক্য গঠন করা হত তা বলা হয়নি। এই গ্রন্থে প্রদত্ত কয়েকটি অর্থ অর্থ সঠিক, কিন্তু তার চেয়েও বেশি অর্থ ভুল এবং সবই রূপকার্থ হিসেবে ব্যাখ্যাত হয়ে ভুল পথে চালনা করে। উদাহরণস্বরূপ, হোরাপোলো বলেছেন যে, হাঁসের চিত্রটির অর্থ “পুত্র”, কারণ কথিত আছে হাঁসেরা অন্যান্য পশুপাখির চেয়ে অধিকতর সন্তানবৎসল। বাস্তবে হাঁস চিত্রলিপিটি ব্যবহারের কারণ ছিল মিশরীয় ভাষায় “হাঁস” ও “পুত্র” উভয় শব্দেই একই ব্যঞ্জনবর্ণ প্রযুক্ত হত।[১০]
খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দী থেকে চিত্রলিপি ও ডেমোটিক লিপি উভয়েই অন্তর্হিত হতে শুরু করে।[১১] মন্দির-ভিত্তিক পৌরোহিত্য প্রথার অবসান ঘটে এবং মিশর ক্রমে ক্রমে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। মিশরীয় খ্রিস্টানরা গ্রিক-উদ্ভূত কপটিক বর্ণমালা ব্যবহার করত বলে সেই বর্ণমালাই ডেমোটিক লিপিকে প্রতিস্থাপিত করে। ৩৯৪ খ্রিস্টাব্দে শেষ চিত্রলিপিমূলক লেখটির রচয়িতা ছিলেন ফিলেরআইসিস মন্দিরের পুরোহিতের এবং সর্বশেষ ডেমোটিক লিপি উৎকীর্ণ হয়েছিল ৪৫২ খ্রিস্টাব্দে।[১২] খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের পূর্ববর্তী ইতিহাসের অধিকাংশ নথিবদ্ধ হয়েছিল মিশরীয় লিপিগুলিতে অথবা মেসোপটেমিয়ার লিখন ব্যবস্থা কিউনিফর্মে। এই লিপিগুলি সম্পর্কিত জ্ঞান অবলুপ্ত হওয়ায় সুদূর অতীতের একমাত্র নথিগুলি সীমাবদ্ধ এবং বিকৃত সূত্রে পরিণত হয়।[১৩] এই জাতীয় সূত্রের প্রধান মিশরীয় উদাহরণটি ছিল ইজিপশিয়াকা। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে মানেথো নামে এক মিশরীয় পুরোহিতের দ্বারা রচিত সেই দেশের ইতিহাস এটি। মূল গ্রন্থটি হারিয়ে গিয়েছে, শুধুমাত্র রোমান লেখকদের দ্বারা কৃত সারসংক্ষেপ ও উদ্ধৃতিগুলির মধ্যে এটির খণ্ডিতাংশ রক্ষিত আছে।[১৪]
আরব পণ্ডিতেরা কপটিক ও প্রাচীন মিশরীয় ভাষার সংযোগের বিষয়টির সম্পর্কে অবহিত ছিলেন এবং ক্ষেত্র বিশেষে মনে করা হয় যে, ইসলামি যুগে কপটিক সন্ন্যাসীরা প্রাচীন লিপি পড়তে পারতেন।[১৬] কথিত আছে, খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত জাবির ইবন হায়ান ও আইয়ুব ইবন মাসলামা সহ বেশ কয়েকজন আরব পণ্ডিতও চিত্রলিপি পড়তে পারতেন।[১৭] যদিও এই বিষয়ে উক্ত পণ্ডিতদের রচনাবলি অবলুপ্ত হওয়ায় এই-সংক্রান্ত দাবিগুলি যাচাই করা যায়নি।[১৮] নবম ও দশম শতাব্দীতে ধুল-নুন আল-মিশরি ও ইবন ওয়াহ্শিয়া চিত্রলিপি সহ যে বহু-সংখ্যক লিপি ইসলামি বিশ্বে পরিচিত ছিল তার উপর গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেন। এই বইগুলিতে চিত্রলিপির অর্থস সারণি আকারে দেওয়া হয়েছিল। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীতে আবু আল-কাশিম আল-ইরাকি প্রাচীন মিশরীয় লেখগুলির অনুলিপি করেন এবং বেশ কয়েকটি চিত্রলিপিতে ধ্বনিসূচক মান আরোপ করেন। মিশরতত্ত্ববিদ ওকাশা এল-ডালি মনে করেন যে, ইবন ওয়াহ্শিয়া ও আবু আল-কাশিমের গ্রন্থাবলিতে প্রদত্ত চিত্রলিপির সারণিতে অনেক চিহ্নের অর্থই সঠিকভাবে দেওয়া হয়েছিল।[১৯] অন্যান্য গবেষকেরা অবশ্য ইবন ওয়াহ্শিয়ার লিপি পাঠোদ্ধারের দাবি সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেন। মধ্যযুগীয় ইসলামি বিশ্ব-বিষয়ক গবেষক তারা স্টিফেন বলেছেন যে, এল-ডালি “ইবন ওয়াহ্শিয়ার যথার্থতার উপর মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করেছেন”।[২০] ইবন ওয়াহ্শিয়া ও আবু আল-কাশিম অবশ্য এমন এক যুগে চিত্রলিপিগুলির ধ্বনিমূলক ও প্রতীকী কার্যকারিতার দিকটি চিহ্নিত করেছিলেন যা ইউরোপে তার বহু শতাব্দী পরেও অজ্ঞাত থেকে গিয়েছিল।[২১][২২]
পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী
আথেনাসিয়াস কার্শারেরওবেলিসকার প্যাপফিলিয়াস (১৬৫০) গ্রন্থের একটি পৃষ্ঠা। এটিতে রোমে স্থিত একটি ওবেলিস্কের গায়ে খোদাই করা চিত্রলিপি ও চিত্রগুলির একটি উদ্ভট অনুবাদ দেওয়া হয়েছে।
রেনেসাঁর যুগে ইউরোপীয়রা চিত্রলিপির বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এই আগ্রহের সূচনা ১৪২২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ, যখন ক্রিস্টোফোরো বুওনদেলমন্টি গ্রিসে হোরাপোলোর হায়ারোগ্লিফিকা-র একটি প্রতিলিপি আবিষ্কার করেন এবং সেটির প্রতি নিকোলো ডে’ নিকোলি ও পোগিও ব্রাসিওলিনির মতো প্রত্নবস্তুবিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। রোমান যুগে ইউরোপে যে সব ওবেলিস্ক ও অন্যান্য মিশরীয় শিল্পসামগ্রী আমদানি করা হয়েছিল সেগুলির গায়ে যে চিত্রলিপিমূলক লেখ খোদিত আছে তা চিহ্নিত করেন পোগিও। কিন্তু প্রত্নবস্তুবিদেরা সেই সময় সেই সব লিপি পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করেননি।[২৩] হোরাপোলো ও প্লন্টিয়াসের অনুপ্রেরণায়[২৪] তাঁরা এই চিত্রলিপিগুলিকে কথ্য ভাষা নথিবদ্ধকরণের পদ্ধতি হিসাবে নয়, বরং নিছকই এক বিশ্বজনীন চিত্র-ভিত্তিক যোগাযোগরক্ষার উপায় হিসেবেই দেখেছিলেন।[২৩] এই বিশ্বাস থেকেই হোরাপোলো বর্ণিত চিত্রকল্পের ছায়া অবলম্বনে অস্পষ্ট প্রতীকবাদ ব্যবহার করে রেনেসাঁ যুগের একটি শিল্প পরম্পরার সৃষ্টি হয়, যার অগ্রদূত ছিল ফ্রান্সেসকো কোলোনারহিপনারোটোমাশিয়া পোলিফিলি (১৪৯৯) গ্রন্থখানি।[২৫]
ইউরোপীয়রা কপটিক সম্পর্কেও অজ্ঞ ছিল। গবেষকদের হাতে মাঝে মাঝে কপটিক পুথিপত্র এসে পৌঁছাতো। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীতে যখন তাঁরা একাগ্রভাবে এই ভাষাটি অধ্যয়ন করতে শুরু করেছিলেন, তখন এই লিপি পাঠোদ্ধারের ক্ষমতা সম্ভবত কপটিক সন্ন্যাসীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই সন্ন্যাসীরা কখনও মিশরের বাইরে যেতেন না বলে কোনও ইউরোপীয়ই সেই যুগে সরাসরি তাঁদের থেকেই এই ভাষা শিক্ষা করার সুযোগ পাননি।[২৬][Note ২] কপটিক প্রাচীন মিশরীয়দের ভাষা থেকে উদ্ভূত কিনা সে বিষয়েও গবেষকেরা নিশ্চিত ছিলেন না; অনেকে আবার এটিকে তার পরিবর্তে প্রাচীন নিকট প্রাচ্যের অন্যান্য ভাষাগুলির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করতেন।[২৯]
সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে জার্মান জেসুইট ও বহুবিদ্যাজ্ঞআথেনাসিয়াস কার্শারই প্রথম ইউরোপীয় যিনি কপটিক ভাষার অর্থোদ্ধার করেছিলেন।[৩০]পিয়েত্রো দেলা ভেল নামে এক ইতালীয় পর্যটক কর্তৃক মিশর থেকে আহরিত আরবি ভাষায় লেখা কপটিক ব্যাকরণ ও অভিধানের ভিত্তিতে রচিত নিজ গ্রন্থে কার্শার ১৬৩০-এর ও ১৬৪০-এর দশকে কপটিক ভাষার যে অনুবাদ ও ব্যাকরণের বর্ণনা দিয়েছিলেন তা ত্রুটিপূর্ণ হলেও এই কাজে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। তিনি অনুমান করেছিলেন যে কপটিক ভাষাটি প্রাচীন মিশরীয়দের ভাষা থেকে উদ্ভূত এবং এই বিষয়ে তাঁর কাজটি ছিল তাঁর সর্বোচ্চ লক্ষ্য অর্থাৎ চিত্রলিপিমূলক লিপির পাঠোদ্ধারকরণের পূর্বপ্রস্তুতি।[৩১]
দ্য স্ট্যান্ডার্ড বায়োগ্রাফিক্যাল ডিকশনারি অফ ইজিপ্টোলজি-র মতে, “হয়তো অন্যায্যভাবেই কার্শার হয়ে ওঠেন মিশরীয় চিত্রলিপির পাঠোদ্ধারকরণের কাহিনিতে যা কিছু উদ্ভট ও অলীক তার প্রতীক”।[৩২] কার্শার ভেবেছিলেন যে, মিশরীয়রা এক প্রাচীন ধর্মতাত্ত্বিক পরম্পরায় বিশ্বাসী ছিল, যে পরম্পরা ছিল খ্রিস্টধর্মের পূর্ববর্তী এই পরম্পরা তথা খ্রিস্টধর্মের পূর্বলক্ষণ ঘোষণাকারীও। তাঁর আশা ছিল যে চিত্রলিপির মাধ্যমে তিনি সেই পরম্পরাটিকে বুঝতে পারবেন।[৩৩] রেনেসাঁ-যুগের পূর্বসূরি গবেষকদের মতো কার্শারও বিশ্বাস করতেন যে, চিত্রলিপিগুলি কোনও ভাষা নয়, বরং যোগাযোগের এক বিমূর্ত মাধ্যম এবং একটি স্ব-সঙ্গতিপূর্ণ পদ্ধতিতে এই ধরনের যোগাযোগমাধ্যমের অনুবাদ করা অসম্ভব।[৩৪] এই কারণে ওয়েডিপাস এজিপশিয়াকাস (১৬৫২-১৬৫৫) প্রভৃতি চিত্রলিপি-সংক্রান্ত গ্রন্থে কার্শার প্রাচীন মিশরীয় ধর্মবিশ্বাস যেমন বুঝতেন তার ভিত্তিতে অনুমানের মাধ্যমে অগ্রসর হয়েছিল। ধর্মবিশ্বাস-সম্পর্কে এই জ্ঞানও তিনি আহরণ করেছিলেন পঠিত কপটিত গ্রন্থাবলি এবং সেই সকল প্রাচীন গ্রন্থাবলি থেকে যেগুলিকে তিনি মিশরীয় ধর্মবিশ্বাস-সংক্রান্ত তথ্যে সমৃদ্ধ মনে করতেন।[৩৫] কার্শারের অনুবাদে অল্প কিছু চিত্রলিপিমূলক চিহ্ন-সম্বলিত ছোটো ছোটো লেখগুলি পরিণত হয়েছিল গুহ্য ধ্যানধারণা-সংক্রান্ত দীর্ঘ বাক্যে।[৩৬] পূর্ববর্তী ইউরোপীয় গবেষকেরা বুঝতে না পারলেও কার্শার কিন্তু উপলব্ধি করেছিলেন যে চিত্রলিপিগুলির ধ্বনিমূলক সত্ত্বাও থাকতে পারে।[৩৭] যদিও এই কার্যকারিতাকে তিনি পরবর্তীকালের বিবর্তন বলেই ধরে নিয়েছিলেন।[৩৬] এছাড়া তিনি একটি চিত্রলিপিকে (𓈗) ‘জল’ শব্দের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং এইভাবে জলের কপটিক প্রতিশব্দ mu এবং সেই সঙ্গে “ম” ধ্বনির ধ্বনিব্যঞ্জনাটি ধরে ফেলেন। তিনিই ছিলেন প্রথম ইউরোপীয় যিনি প্রথম সঠিকভাবে একটি চিত্রলিপির ধ্বনিব্যঞ্জনা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।[৩৮]
কার্শারের মূল অনুমানগুলির সম্পর্কে সমসাময়িককালের গবেষকেরা একমত হলেও অধিকাংশ গবেষকই কার্শের অনুবাদগুলি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, এমনকি উপহাসও করেছিলেন।[৩৯] তা সত্ত্বেও, কপটিক ভাষাটি যে প্রাচীন মিশরীয় ভাষা থেকে উদ্ভূত – কার্শারের এই তত্ত্বটি বহুলভাবে স্বীকৃত হয়।[৪০]
অষ্টাদশ শতাব্দী
অ্যানে ক্লড ডে কেলাসেররিকুয়েইল ডি’অ্যান্টিকুইটেস ইজিপ্টিয়েনেস (১৭৫২) গ্রন্থের একটি পৃষ্ঠা। এই গ্রন্থে চিত্রলিপিগুলিকে অন্যান্য মিশরীয় লিপির অনুরূপ চিহ্নগুলির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
চিত্রলিপি-পাঠোদ্ধার বিষয়ে কার্শারের শেষ গ্রন্থটি প্রকাশের পর কয়েক দশক কেউ এই কাজে হাত দেননি বললেই চলে। যদিও এই সময়ের মধ্যে কোনও কোনও গবেষক এই লিপি সম্পর্কে এমন কিছু তত্ত্ব উপস্থাপনা করেন, যা সঠিক বলে প্রমাণিত হয়।[৪০]উইলিয়াম ওয়ারবার্টন রচিত ধর্ম-বিষয়ক আলোচনা-গ্রন্থ দ্য ডিভাইন লিগেশন অফ মোজেস-এ (প্রকাশকাল: ১৭৩৮-১৭৪১) চিত্রলিপি ও লিখন পদ্ধতির বিবর্তন বিষয়ে একটি দীর্ঘ আলোচনা পাওয়া যায়। এই আলোচনায় বলা হয়েছিল যে, ধর্মীয় গুহ্যতত্ত্ব সংকেতে আবদ্ধ করার জন্য চিত্রলিপিগুলি উদ্ভূত হয়নি, বরং অন্যান্য লিখন পদ্ধতির মতো এগুলিরও ব্যবহারিক উদ্দেশ্য ছিল। তিনি আরও বলেন যে, আলেকজান্দ্রিয়ার ক্লিমেন্ট কর্তৃক উল্লিখিত ধ্বনিমূলক মিশরীয় লিপি তা থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল।[৪১] ওয়ারবার্টনের দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি ধর্মতত্ত্বমূলক হলেও[৪২] তা চিত্রলিপিগুলিকে উপলব্ধি করার যে নির্মাণকাঠামো দান করে তা এই শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত গবেষকদের মধ্যে প্রাধান্য বজায় রেখেছিল।[৪৩]
অষ্টাদশ শতাব্দীতে মিশরের সঙ্গে ইউরোপীয়দের যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। অধিকতর সংখ্যায় ইউরোপীয়েরা এই সময় মিশরে যান এবং প্রাচীন শিলালিপিগুলিকে চাক্ষুষ করেন।[৪৪] এই ইউরোপীয়েরা প্রত্নসামগ্রী সংগ্রহ করতে শুরু করে অধ্যয়নের জন্য লেখও অধিকতর সংখ্যায় পাওয়া সম্ভব হয়।[৪৫]জ্যঁ-পিয়ের রিগর ছিলেন প্রথম ইউরোপীয় যিনি ১৭০৪ সালে একটি অ-চিত্রলিপিমূলক প্রাচীন মিশরীয় লেখ চিহ্নিত করেন। ১৭২৪ সালে বার্নার্ড ডে মন্টফুকোঁ এই ধরনের লেখের একটি বিরাট সংকলন প্রকাশ করেন।[৪৬] ১৭৫২ থেকে ১৭৬৭ সালের মধ্যে প্রচুর সংখ্যায় মিশরীয় শিলালিপি জ্যঁ-জ্যাক বার্থেলেমির সহায়তায় অ্যানে ক্লড ডে কেলাস কর্তৃক সংগৃহীত ও প্রকাশিত হয়। এই রচনাগুলি দৃষ্টে অনুমিত হয় যে অ-চিত্রলিপিমূলক মিশরীয় লিপিগুলি চিত্রলিপি থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল। বার্থেলেমি আরও দেখিয়েছিলেন যে, ডিম্বাকার বলয়গুলি (যেগুলি পরে কার্তুশ নামে পরিচিত হয়) অনেক চিত্রলিপিমূলক লেখেই চিহ্নের ছোটো ছোটো গুচ্ছকে সংগ্রথিত করেছিল এবং ১৭৬২ সালে তিনি এই তত্ত্ব প্রস্তাব করেন যে কার্তুশগুলিতে রাজাদের বা দেবতাদের নাম পাওয়া যায়। ১৭৬০-এর দশকে মিশর ভ্রমণকারী কার্স্টেন নেইবার পৃথক পৃথক চিত্রলিপিমূলক চিহ্নের একটি তালিকা প্রস্তুত করেন। কাজটি অসম্পূর্ণ হলেও এটিই ছিল প্রথম নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে এই ধরনের তালিকা প্রস্তুতের কাজ। তিনি চিত্রলিপিমূলক লেখ ও সেগুলির সঙ্গে চিত্রিত অলংকরণগুলির পার্থক্যও প্রতিপাদন করেন। পূর্ববর্তী গবেষকেরা এই দুইয়ের ব্যাপারে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন।[৪৭]জোসেফ ডে গাইগনেস সহ সে যুগের বেশ কয়েকজন গবেষক প্রাচীন মিশরের সঙ্গে চীনের এক ঐতিহাসিক যোগাযোগের কথা অনুমান করেন। এই গবেষকেরা মনে করতেন যে, চীনা লিখন পদ্ধতি আসলে মিশরীয় চিত্রলিপি থেকেই উদ্ভূত। ১৭৮৫ সালে গাইগনেস কার্তুশের ব্যাপারে বার্থেলেমির প্রস্তাবনাটি পুনরুল্লেখ করে সেটিকে সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্যকে পার্শ্ববর্তী রচনা থেকে পৃথকভাবে লেখার একটি চীনা প্রথার সঙ্গে তুলনা করেন।[৪৮]
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে কপটিক ভাষা-বিষয়ে সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ গবেষক জর্জ জোয়েগা প্রাচীন মিশর বিষয়ে জ্ঞানের সংক্ষিপ্তসার De origine et usu obeliscorum (১৭৯৭) গ্রন্থে চিত্রলিপি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি চিত্রলিপিমূলক চিহ্নগুলির তালিকা প্রস্তুত করেন এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে একটি একক শব্দের জন্য খুব অল্পসংখ্যক পৃথক চিহ্নই ব্যবহার করা হত এবং তার ফলে একটি পূর্ণাঙ্গ শব্দভাণ্ডার তৈরি করতে নিশ্চয়ই সেই চিহ্নগুলির উপর একাধিক অর্থ অথবা সেগুলিকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করে ভিন্ন অর্থ আরোপ করা হত। তিনি লক্ষ্য করেন যে চিহ্নগুলির অভিমুখ যে দিকে সেই অভিমুখেই বাক্যগুলিকে পড়তে হয় এবং তিনি বলেন যে কয়েকটি চিহ্ন ধ্বনিমূলক। জোয়েগা লিপিগুলি পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করেননি। তিনি মনে করতেন যে, সেটা করতে হলে যে পরিমাণ প্রমাণের প্রয়োজন হবে তা তৎকালীন ইউরোপে প্রাপ্তব্য নয়।[৪৯]
চিহ্ন শনাক্তকরণ
রোসেটা প্রস্তরফলক
তিনটি ভুক্তির প্রতিটি অক্ষত অবস্থায় রোসেটা প্রস্তরফলকের পুনর্নির্মাণ। ফলকটি সম্ভবত মূলে এই রকম দেখতে ছিল।
১৭৯৮ সালে যখন নেপোলিয়ন বোনাপার্টের অধীনে ফরাসি বাহিনী মিশর অভিযান চালায়, তখন সেই দেশ ও তার প্রাচীন স্মারকগুলি নিয়ে গবেষণার জন্য বোনাপার্ট সঙ্গে বিজ্ঞানী ও গবেষকদের একটি দল নিয়ে যান। এই বিশেষজ্ঞদের স্যাভেন্ট বলা হত।[৫০] ১৭৯৯ সালের জুলাই মাসে রোসেটা শহরের কাছে ফরাসি বাহিনী কর্তৃক একটি মামলুক দুর্গ (ফরাসি নামকরণে ফোর্ট জুলিয়েন) পুনর্নির্মাণের সময় লেফট্যানেন্ট পিয়ের-ফ্রাঁসোয়া বোকার্ড লক্ষ্য করেন যে দুর্গের ধ্বংসকৃত দেওয়ালের মধ্যে একটি পাথরের গায়ে কিছু লিপি উৎকীর্ণ রয়েছে। এই পাথরটি ছিল একটি প্রাচীন মিশরীয় লিপিফলক। উৎকীর্ণ লেখটি তিনটি ভুক্তিতে বিভক্ত। ফলকটির নিচের ডানদিকের কোণ এবং উপরের ভুক্তির বেশিরভাগ অংশই ভাঙা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। উৎকীর্ণ লেখটি লেখা হয়েছিল তিনটি লিপিতে: উপরের ভুক্তিতে মিশরীয় চিত্রলিপি, নিচের ভুক্তিটিতে গ্রিক অক্ষরে এবং মধ্যের ভুক্তিটি একটি অশনাক্তকৃত লিপিতে।[৫১][৫২] লেখটি ছিল খ্রিস্টপূর্ব ১৯৭ অব্দে পঞ্চম টলেমির জারি করা একটি অধ্যাদেশ; এই অধ্যাদেশ বলে তিনি মিশরের পুরোহিতদের অনুগ্রহ দেখিয়েছিলেন। লিপির অন্তে বলা হয়েছে যে “পবিত্র, স্থানীয় ও গ্রিক অক্ষরে” এই অধ্যাদেশের প্রতিলিপি করে মিশরের প্রধান মন্দিরগুলিতে স্থাপন করতে হবে।[৫৩] গ্রিক অভিলিখনে এই পংক্তিটি পড়ে ফরাসিরা উপলব্ধি ক্রএছিলেন যে প্রস্তরফলকটি একটি সমান্তরাল লেখ, যার উপর খোদিত গ্রিক অনুবাদটির মাধ্যমে মিশরীয় লিপিটির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হতে পারে।[৫৪] স্যাভেন্টরা সাগ্রহে প্রস্তরফলকটি অন্য খণ্ডাংশগুলির এবং সেই সঙ্গে গ্রিক ও মিশরীয় ভাষায় খোদিত অন্যান্য লেখেরও অনুসধান করেন। কিন্তু ফলকটির অন্য কোনও টুকরো পাওয়া যায়নি। তাছাড়া স্যাভেন্টরা অন্য যে দ্বিভাষিক লেখগুলি আবিষ্কার করেছিলেন সেগুলিও বেশিরভাগই ছিল অপাঠযোগ্য। সেই কারণে সেগুলির পাঠোদ্ধার করাও সম্ভব হয়নি।[৫২][৫৫] তবে স্যাভেন্টরা রোসেটা প্রস্তরফলকটি নিয়ে কাজ করে কিছুটা অগ্রসর হতে পেরেছিলেন। জ্যঁ-জোসেফ মার্সেল বলেছিলেন যে, মধ্যবর্তী লিপিটি ছিল “প্রাচীন মিশরীয় ভাষার হস্তলিপিমূলক অক্ষর” এবং তিনি প্যাপিরাসের লেখ্যপড়ে অন্য যে অক্ষর দেখেছিলেন তার অনুরূপ। তিনি এবং লুই রেমি রেইজ এই ভুক্তির লিপিটির সঙ্গে গ্রিক লিপিটির তুলনা করতে শুরু করেন এবং এই যুক্তিতে উপনীত হন যে চিত্রলিপিমূলক পাঠটির অধিকাংশই হারিয়ে গিয়েছে বলে মধ্যবর্তী ভুক্তিটির পাঠোদ্ধারের কাজেই এই তুলনা অধিকতর ফলপ্রসূ হবে। স্যাভেন্টরা মধ্যবর্তী ভুক্তিতে সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্যগুলির অবস্থান অনুমান করেন গ্রিক পাঠে সেই নামগুলির অবস্থানের ভিত্তিতে এবং Ptolemy নামের ‘p’ ও ‘t’ অক্ষর দু’টিকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু তার বেশি অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি।[৫৬]
১৮০০ সালে ফলকের লেখটির প্রথম প্রতিলিপিগুলি ফ্রান্সে প্রেরণ করা হয়। ১৮০১ সালে ওটোমান ও ব্রিটিশ বাহিনী মিশরে ফরাসি বাহিনীকে অবরুদ্ধ করে এবং ফরাসি বাহিনীও আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের শর্ত হিসেবে রোসেটা প্রস্তরফলক ব্রিটিশদের হস্তগত হয়। ফলকটি ব্রিটেনে এসে পৌঁছানোর পরে সোসাইটি অফ অ্যান্টিক্যুয়ারিজ অফ লন্ডন লেখটির প্রতিলিপি করে তা সারা ইউরোপের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করে।[৫৭]
নেপোলিয়নের অভিযানের প্রতিবেদনগুলি ইউরোপে প্রাচীন মিশর-সম্পর্কে এক বাতিকের সৃষ্টি করে। ফরাসি ও ব্রিটিশ বাহিনী যখন মিশর ত্যাগ করে তখন মিশরের পরিস্থিতি বিশৃঙ্খল ছিল। কিন্তু ১৮০৫ সালে মুহাম্মদ আলি সেই দেশের শাসনভার গ্রহণ করলে ইউরোপীয় সংগ্রাহকেরা মিশরে আসেন এবং অসংখ্য প্রত্নসামগ্রী সে দেশ থেকে নিয়ে যান। শিল্পীরাও অনেক লেখের প্রতিলিপি অঙ্কন করেন।[৫৮] এই শিল্পসামগ্রীগুলির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট কেউই জানতেন না,[৫৯] কিন্তু সেগুলি থেকে প্রচুর পরিমাণে লিখিত উপাদান পাওয়া যায়, যেগুলি লিখন পদ্ধতি পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করতে গিয়ে গবেষকেরা তুলনা করে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন।[৬০]
ডে সাসি, অকারবল্ড ও ইয়ং
বিশিষ্ট ফরাসি ভাষাবিজ্ঞানী আঁতোয়া-ইসাক সিভেস্ত্রে ডে সাসি ১৭৮৭ সালে পারস্যের পাহলভি লিপির পাঠোদ্ধার করেছিলেন। প্রস্তরফলকটি নিয়ে প্রথম কাজ করা ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যে ইনি অন্যতম। মার্সেল ও রেইগের মতো তিনিও গ্রিক পাঠটির সঙ্গে মধ্যবর্তী ভুক্তির ডেমোটিক পাঠের সম্পর্কের উপরে মনোযোগ নিবদ্ধ করেন। প্লুটার্কের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তিনি অনুমান করেন যে, এই লিপিতে ২৫টি ধ্বনিসূচক চিহ্ন রয়েছে।[৬১] ডে সাসি ডেমোটিক পাঠটির মধ্যে গ্রিক নামবাচক পদগুলি চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু টলেমি, আলেকজান্ডার ও আর্সিনোয়ের নামগুলি ছাড়া বিশেষ অগ্রসর হতে পারেননি। তিনি উপলব্ধি করেন যে ডেমোটিকে ২৫টির বেশি চিহ্ন রয়েছে এবং ডেমোটিক লেখটি সম্ভবত গ্রিক লেখটির আক্ষরিক অনুবাদ নয়। এই কারণেই কাজটি আরও কঠিন হয়ে ওঠে। ১৮০২ সালে নিজের গবেষণার ফলাফল প্রকাশের পর তিনি প্রস্তরফলকটি নিয়ে কাজ করা বন্ধ করে দেন।[৬২]
সেই বছর ডে স্যাসি প্রস্তরফলকটিতে উৎকীর্ণ লিপির একটি প্রতিলিপি দিয়েছিলেন নিজের প্রাক্তন ছাত্র জোহান ডেভিড অকারবল্ডকে। অকারবল্ড ছিলেন এক সুইডিশ কূটনীতিবিদ ও শখের ভাষাবিজ্ঞানী। অকারবল্ড কিন্তু প্রভূত সাফল্য অর্জন করেন। ডে সাসি যে চিহ্ন-গুচ্ছ নিয়ে কাজ করেছিলেন সেগুলি নিয়ে কাজ করে অকারবল্ড অধিকতর সংখ্যায় চিহ্ন সঠিকভাবে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।[৬২] ডে সাসিকে লেখা একটা চিঠিতে অকারবল্ড ২৯টি ডেমোটিক বর্ণের একটি বর্ণমালা প্রস্তাব করেন (যার অর্ধেকই পরে সঠিক বলে প্রমাণিত হয়) এবং নিজের কপটিক ভাষা-জ্ঞানের ভিত্তিতে তিনি উৎকীর্ণ লিপির পাঠের মধ্যে বেশ কয়েকটি ডেমোটিক শব্দও শনাক্ত করেন।[৬৩] ডে সাসি অকারবল্ডের ফলাফল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। অকারবল্ড নিজেও হাল ছেড়ে দেন।[৬২] অন্যান্য গবেষকদের চেষ্টা সত্ত্বেও পরবর্তী এক দশকেরও বেশি সময়ে এই নিয়ে কাজ বিশেষ এগোয়নি। তারপরই থমাস ইয়ং এই ক্ষেত্রে প্রবেশ করেন।[৬৪]
ব্রিটিশ বহুবিদ্যাজ্ঞ ইয়ং পদার্থবিজ্ঞান, ঔষধিবিজ্ঞান ও ভাষাবিজ্ঞান সহ বিভিন্ন বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। মিশরের দিকে মনোনিবেশ করার আগেই তিনি সমকালীন সমাজে একজন অগ্রণী বুদ্ধিজীবী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।[৬৪] ১৮১৪ সালে তিনি রোসেটা প্রস্তরফলক নিয়ে ডে সাসির সঙ্গে পত্রালাপ শুরু করেন। কয়েক মাস পরে তিনি উক্ত প্রস্তরফলকে মিশরীয় চিত্রলিপি ও ডেমোটিক লিপির অনুবাদ নামে একটি রচনা প্রকাশ করেন। প্রকৃতপক্ষে এই লেখাটি ছিল কোথায় কোথায় মিশরীয় পাঠটির সঙ্গে গ্রিক পাঠের সাদৃশ্য ঘনিষ্ঠ সেই জায়গাগুলিকে খুঁজে বেরার জন্য লেখটির চিহ্নগুলিকে চিহ্নগুচ্ছে বিন্যাসের একটি প্রয়াস মাত্র। এই প্রয়াসটির উপযোগিতা ছিল সীমায়িত, কারণ রোসেটা প্রস্তরফলকের তিনটি লিপি ঠিক পরস্পরের হুবহু অনুবাদ ছিল না।[৬৫][৬৬] ইয়ং অন্যান্য মিশরীয় লিপিগুলি অনুলিপিকরণে বেশ কয়েক মাস সময় অতিবাহিত করেন। এর ফলে তিনি চিহ্নগুলির মধ্যে এমন কিছু ধাঁচ লক্ষ্য করেন যা অন্যান্য গবেষকদের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল।[৬৭] জোয়েগার মতো তিনিও শনাক্ত করেন যে, একটি শব্দের এককভাবে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য খুব কম চিত্রলিপিই ছিল এবং তিনি বলেন যে শব্দগুলি দু’টি বা তিনটি চিত্রলিপি দ্বারা গঠিত হত।[৬৬]
ইয়ং চিত্রলিপি ও ডেমোটিক চিহ্নগুলির মধ্যে সাদৃশ্য লক্ষ্য করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে চিত্রলিপিমূলক চিহ্নগুলিই বিবর্তিত হয়ে ডেমোডিক চিহ্নে পরিণত হয়েছে। তিনি যুক্তি দেন যে, তাই যদি হয় তবে ডেমোটিক বিশুদ্ধভাবে ধ্বনিমূলক লিপি হতে পারে না, চিত্রলিপির থেকে উদ্ভূত কিছু ভাবমূলক চিহ্নও তাতে থাকা সম্ভব। ১৮১৫ সালে নিজের এই চিন্তাভাবনার কথা তিনি ডে সাসিকে লিখে জানান।[৬৬][Note ৩] তিনি চিত্রলিপিমূলক হরফে ধ্বনিমূলক চিহ্ন খুঁজে পাওয়ার আশা রাখলেও, যে বহু বৈচিত্র্যময় ধ্বনিমূলক বানান ও লিপি ব্যবহৃত হয়েছিল তার দ্বারা কাজ ব্যাহত হয়েছিল। তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে একটি প্রধান ব্যতিক্রম ছাড়া ধ্বনিমূলক চিত্রলিপির অস্তিত্ব ছিল না।[৬৯] ১৮০২ সালে প্রকাশিত একটি লেখায় ডে সাসি বলেন যে, বিদেশি শব্দ লিপিবদ্ধ করার সময় চিত্রলিপিগুলি ধ্বনিমূলক দিকটি বজায় রাখলেও রাখতে পারে।[৬৩] চীনা লিখন পদ্ধতিতে একটি অনুরূপ প্রথার কথা জানার পর[৭০] ১৮১১ সালে তিনি বলেন যে, একটি কার্টুশে একটি শব্দটি ধ্বনিমূলক দিক থেকে লেখা হত—যেমন হয়েছে টলেমির মতো অ-মিশরীয় শাসকের নামের ক্ষেত্রে।[৭১] এই ধারণাগুলি ইয়ং রোসেটা প্রস্তরফলকের কার্টুশগুলির উপর প্রয়োগ করেন। কয়েকটি কার্টুশ ছিল ছোটো, আটটি চিহ্ন-বিশিষ্ট; অন্যদিকে কয়েকটি কার্টুশে একই চিহ্ন ব্যবহারের পর আরও অনেকগুলি চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছিল। ইয়ং অনুমান করেন যে, দীর্ঘ কার্টুশগুলিতে গ্রিক লিপিকে টলেমিকে প্রদত্ত উপাধিটির মিশরীয় রূপটি লেখা আছে: “চিরজীবী, [দেবতা] প্টাহ্-এর প্রিয়”। সেই কারণে প্রথম আটটি চিহ্ন টলেমির নামের গ্রিক রূপ Ptolemaios-এর অনুরূপ মনে করে তিনি সেগুলির উপরেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। অকারবল্ড প্রস্তাবিত কয়েকটি ধ্বনিমূলক মান গ্রহণ করে ইয়ং আটটি চিত্রলিপিমূলক চিহ্নকে সেগুলির ডেমোটিক প্রতিরূপের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন এবং বলেন যে, কয়েকটি চিহ্ন একাধিক ধ্বনিমূলক মান বহন করে, আবার কয়েকটি মাত্র একটি মানই বহন করে।[৭২] তারপর তিনি সেই ফলাফলগুলি টলেমির রানি বেরেনিসের একটি কার্টুশে প্রয়োগ করেন, কিন্তু বিশেষ সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হন। যদিও তিনি এমন এক জোড়া চিত্রলিপিমূলক চিহ্ন শনাক্ত করতে পেরেছিলেন যেগুলি একটি স্ত্রীলিঙ্গবাচক নামের শেষাংশকে নির্দেশ করে।[৭৩] এই গবেষণার ফলে চিত্রলিপি ও ডেমোটিক চিহ্নগুলির তেরোটি ধ্বনিসূচক মানের একটি গুচ্ছ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ছয়টি সঠিক, তিনটি অংশত সঠিক ও চারটি ভুল প্রমাণিত হয়েছিল।[৭২]
চিত্রলিপি
ইয়ং-এর পাঠ
P
T
অপ্রয়োজনীয়
LO বা OLE
MA বা M
I
OSH বা OS
“ইজিপ্ট” প্রবন্ধে ইয়ং নিজের কাজের সারসংক্ষেপ প্রদান করেছিলেন। ১৮১৯ সালে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা-র একটি সম্পূরণী হিসেবে লেখক নাম ছাড়াই নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল। এই নিবন্ধে ২১৮টি ডেমোটিক ও ২০০টি চিত্রলিপিমূলক শব্দের অনূমানমূলক অনুবাদ দেওয়া হয়েছিল এবং সংশ্লিষ্ট ডেমোটিক চিহ্নের সঙ্গে প্রায় ৮০টি চিত্রলিপিমূলক চিহ্নের সম্পর্ক সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল।[৭৪] ১৯২২ সালে মিশরতত্ত্ববিদ ইয়ং-এর কাজের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বলেন যে, ইয়ং-এর ফলাফলের মধ্যে “অনেক ভুল অনুবাদ মিশে গিয়েছিল, কিন্তু যে পদ্ধতি তিনি অবলম্বন করে তা অব্যর্থভাবে ইতিবাচক পাঠোদ্ধারকরণের দিকে চালিত করে।” [৭৫] যদিও ইয়ং প্রাচীন মিশরীয় লেখগুলির বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না। লিখন পদ্ধতিটিকে তিনি একধরনের বৌদ্ধিক ধাঁধা হিসেবে গ্রহণ করে সেই বিষয়েই আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ইয়ং-এর আগ্রহ থাকায় তিনি পাঠোদ্ধারকরণের কাজে ঠিকঠাক মনোনিবেশ করতে পারতেন না। পরবর্তী কয়েক বছরে তিনি এই বিষয়ে অল্পই অগ্রসর হতে পেরেছিলেন।[৭৬]
পাদটীকা
মিশরীয় লিপির পাঠোদ্ধারকারী গবেষকদের মধ্যে এই লিপিটিকে কী বলা যায় তা নিয়ে মতভেদ ছিল। রোসেটা প্রস্তরফলকের গ্রিক পাঠে এই লিপিটিকে নির্দেশকারী শব্দবন্ধটির ভিত্তিতে থমাস ইয়ং “enchorial” শব্দটি ব্যবহার করেন: ενχωριοις, অর্থাৎ “দেশের”, “স্বদেশীয়”,[১] বা “স্থানীয়”।[২] জঁ-ফ্রঁসোয়া শঁপোলয়োঁ ব্যবহার করেন এই লিপির হেরোডোটাস-কর্তৃক ব্যবহৃত নামটি: δημοτική বা “demotic”;[৩] এটি একটি গ্রিক শব্দ, যার অর্থ “সাধারণভাবে প্রচলিত”।[৪] শঁপোলয়োঁর ব্যবহৃত পরিভাষাটি কালক্রমে রীতিসম্মত নামে পরিণত হয়।[৪] চতুর্দশ শতাব্দীর পরে নতুন গ্রন্থ রচনার কাজে আর লিখিত কপটিক ব্যবহার করা হয়নি, তবে সন্ন্যাসীদের দ্বারা কপটিক গ্রন্থের প্রতিলিপিকরণের কাজ ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।[২৭] চার্চের আচার-অনুষ্ঠানের বাইরে কপটিকের ব্যবহার সম্ভবত দ্বাদশ শতাব্দীতেও কোনও কোনও উচ্চ মিশরীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে অব্যাহত ছিল।[২৮] ইয়ং ও অন্যান্য গবেষকেরা হায়রাটিক লিপিকে চিত্রলিপি ও ডেমোটিকের মধ্যবর্তী স্তর হিসেবে শনাক্ত করেছিলেন। কিন্তু হায়রাটিকের সঠিক প্রকৃতিটি কী এবং তাকে ডেমোটিকের থেকে পৃথক একটি লিপি হিসেবে গণ্য করা উচিত কিনা তা যে যুগে ইয়ং ও শঁপোলয়োঁ কাজ করছিলেন সে যুগে আগাগোড়াই বিতর্কিত ছিল।[৬৮]
প্রাচীন গ্রিক হল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের একটা ভাষা যা বিস্তারনের সময় আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৯ম-৬ষ্ঠ শতাব্দী মধ্যে (অতি পরিচিত আর্কইক গ্রিস), আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ-৫ম শতাব্দী মধ্যে (ক্লাসিক্যাল) এবং আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী-৬ষ্ঠ খ্রিষ্টাব্দ (হেলেনিস্টিক যুগ) পর্যন্ত প্রাচীন গ্রিস এবং ধ্রুপদি সভ্যতার কথ্য ভাষা ছিল। হেলেনিস্টিক পর্যায়ের ভাষা অতি পরিচিত ছিল কোইন (সাধারণ) বা বাইবেলের গ্রিক হিসাবে, যখন শেষের দিকে সময়ের মধ্যযুগীয় গ্রিকের ভাষা সাথে তেমন কোন পার্থক্য ছিল না। কোইন গ্ৰিককে তার নিজস্ব একটা পৃথক ঐতিহাসিক পর্যায় হিসেবে গণ্য করা হয়, যদিও তার প্রাথমিক গঠন অনেকটা ক্লাসিক্যালের মনে হয়। কোইন যুগের পূর্বে, ক্লাসিক গ্রিক এবং তার পূর্ব যুগে বিভিন্ন আঞ্চলিক উপভাষায় অন্তর্ভুক্ত ছিল।
আত্তীয় উপভাষা হচ্ছে গ্রিকদের প্রধান উপভাষা যেটা প্রাচীন আত্তীকাতে প্রচলিত ছিলো, আত্তীয় ভাষা ব্যবহারকারীদের মধ্যে এথেন্স ও অন্তর্ভুক্ত।[১] প্রাচীন উপভাষাসমূহের মধ্যে এটি আধুনিক গ্রিক এর সাথে যথেষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ন এবং এটি প্রাচীন গ্রিক এর ভাষা শিক্ষার সাথে মানসম্মত ভাষার উদাহরণ হিসেবে চর্চা করানো হয়। আত্তীয় গ্রিক মধ্যে আয়োনিক উপভাষাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আত্তীয় এবং আয়োনিক উপভাষাকে আধুনিক গ্রিক ভাষার অণুপ্রেরনা হিসেবে মনে করা হয়।[১]
আত্তীক ভাষার বর্নমালা সমূহ
উৎপত্তি এবং বিস্তার
গ্রিক হচ্ছে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার একটি শাখা যার মধ্যে ইংরেজিও অন্তর্ভুক্ত। ঐতিহাসিক সময়ে গ্রিক ভাষা কয়েকটি উপভাষার মধ্যে ব্যবহৃত হতো যার মধ্যে আত্তীক উপভাষা অন্যতম।
প্রাচীন আরামাইক লিপি ফিনিশীয় লিপি থেকে উৎপত্তি লাভ করে খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতক থেকে স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে। তখন আরামাইক ভাষা লিখতে এটি ব্যবহৃত হয় এবং হিব্রু ভাষা লেখার জন্য ব্যবহৃত পালেও-হিব্রু লিপিকে প্রতিস্থাপিত করে এটি। সব বর্ণই ব্যঞ্জনবর্ণের প্রতিনিধিত্ব করে তবে কিছু বর্ণ দীর্ঘ স্বরবর্ণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
আরামাইক বর্ণমালা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আধুনিক মধ্যপ্রাচ্যের লেখনি ব্যবস্থার মূলে রয়েছে এটি। এছাড়াও আরামাইক লিপি অনেক অ-চীনা কেন্দ্রীয় ও পূর্ব এশিয়ার লেখার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছে অথবা অভিযোজিত হয়েছে। ব্যাপক ব্যবহারের জন্য এটি লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ও সরকারি ভাষার লিপিতে পরিণত হয় নতুন অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যে ও তার উত্তরাধিকারী আখমেনীয় সাম্রাজ্যে। আধুনিক হিব্রু বর্ণমালা খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীর আরামাইক লিপির সাথে সম্পর্ক বহন করে আসছে। অধিকাংশ বর্ণের আকারে মিল লক্ষ্য করা করা যায়।
লিখন পদ্ধতিতে ব্যঞ্জনবর্ণ নির্দেশিত হয় কিন্তু বেশিরভাগ স্বরবর্ণ নির্দেশিত হয় না(আরামাইকের মত) অথবা তাদেরকে ডায়াক্রিটিক্যাল চিহ্ন দিয়ে নির্দেশ করা হয় যাকে পিটার টি ড্যানিয়েল ‘আবজাদ’ বলে অভিহিত করেন। গ্রিক বর্ণমালা স্বরবর্ণগুলোকে আরো সুশৃঙ্খলভাবে প্রতিনিধিত্ব করে যা আরামাইক করে নি।
ইতিহাস
উৎপত্তি
দ্বিভাষিক গ্রিক এবং আরামাইক শিলালিপি মৌর্য সম্রাট অশোক কর্তৃক, কান্দাহার, আফগানিস্তান , খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী
প্রাচীনকালেরর শিলালিপি থেকে বোঝা গেছে আরামাইক ভাষা লিখতে ব্যবহৃত হতো ফিনিশীয় বর্ণমালা ।[১] সময়ের সাথে সাথে বর্ণমালা বিকশিত হওয়ার ছক নিচে দেখানো হয়েছে। আরামাইক ভাষা ধীরে ধীরে Lingua Franca হয়ে ওঠে। এভাবে আরামাইক লিপি সারা মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং আসিরীয় কিউনিফর্ম লিপিকে প্রতিস্থাপন করে হয়ে ওঠে উদীয়মান লেখার পদ্ধতি।
আখেমেনীয় যুগে
প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ শতাব্দীতে, দারাউসের অধীনে ফার্সিদের আখেমেনীয় বিজয়ের পথ ধরে মেসোপটেমিয়ায় বিজয়ের পর, ইরান প্রাচীন আরামাইক লিপিকে গ্রহণ করে কারণ ফার্সি সাম্রাজ্যকে বিভিন্ন অঞ্চলের জাতির সাথে লিখিত যোগাযোগ করতে হতো। এটি একটি একক সরকারি ভাষায় পরিণত হয় যা আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের ভাষা এবং আখমেনীয় আরামাইক হিসেবে অভিহিত হয়। [২]
ইম্পেরিয়াল আরামাইক ছিল অত্যন্ত আদর্শমানের; এর বনানরীতি ছিল কথ্যভাষা নির্ভর নয় বরং ঐতিহ্য নির্ভর এবং অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রাচীন ফার্সি দ্বারা প্রভাবিত ছিল। আরামাইক বর্ণ তখন প্রধান দুটি শৈলীতে বিভক্ত হয়ে যায়, একটি “পাথুরে” শৈলী যেটি পাথরের পৃষ্ঠতলে লিখিত হতো, অপরটি “জড়ানো” শৈলী যা পাথুরে শৈলীকে বেশি রক্ষণশীল করে তোলে (এটির সাথে প্রাচীন আরামাইক ও ফিনিশীয় লিপির সাদৃশ্য ছিল)। দুটিই আখমেনীয় ফার্সি যুগে । যদিও জড়ানো লেখাগুলো পাথরের উপর অটল ছিল তবু এগুলো ৩য় শতকে (বিসি) লুকানোই ছিল।
খাড়াভাবে বসানো পাথরের খণ্ডে সাল্ম দেবতার উদ্দেশ্যে লেখা আরামাইক লিপির প্রার্থনা। বেলেপাথর, খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতক। চার্লস হবার তায়মাতে খুঁজে পান এটিকে ১৮৮৪সালে। এখন এটি ল্যুভরে আছে।
আরামাইক থেকে উৎপন্ন লিপিসমূহ
যেহেতু ফিনিশীয় থেকে আরামাইক বিবর্তিত হয় এক ধীর প্রক্রিয়ায় তাই বিশ্বের লিপিগুলো ফিনিশীয় থেকে সরাসরি বিবর্তিত হয়েছে অথবা আরামাইক দ্বারা ফিনিশীয় থেকে কিছুটা কৃত্রিম হয়ে বিবর্তিত হয়েছে। সাধারণত ভূমধ্য অঞ্চলের লিপিগুলো (আনাতোলিয়া, গ্রিস, ইতালি) ফিনিশীয় হিসেবে শ্রেণীভুক্ত হয়েছে, বিবর্তিত হয় ৮ম শতকে (বিসিই), পূর্বাঞ্চলের লিপিগুলো (লেভ্যান্ট, ইরান, মধ্য এশিয়া ও ভারত) আরামাইক থেকে উদ্ভূত স্বীকৃতি পেয়েছে, বিবর্তিত হয় ৬ষ্ঠ শতকে (বিসিই) আখমেনীয় সাম্রাজ্যের আরামাইক লিপি থেকে।
হিব্রু ও নাবাতাইন লিপি যেহেতু রোমান যুগে বিকাশলাভ করে তাই এগুলো আরামাইক সাম্রাজ্যের লিপি থেকে কিছুটা বদলে গেছিল।
একটি জড়ানো হিব্রু ধরনের লেখার উদ্ভব হয়েছিল কিন্তু এটি আর টিকে থাকতে পারে নি। অন্যদিকে নাবাতাইন লিপি জড়িয়ে লেখায় উন্নতি সাধন করে অল্প সময়ের মধ্যেই এটি আরবী লেখার আদর্শ ধরনে রূপন্তরিত হয়। আরবী লিপি ইসলাম প্রচারের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়ে।
আরামাইক লিপির জড়ানো শৈলীর বিকাশ সিরীয়, পালমিরিন ও মান্দাইক লিপি তৈরিতে সাহায্য করে। এই লিপিগুলো মধ্য এশিয়ার কিছু লিপি যেমন সোগদীয় ও মঙ্গোলীয় লিপির ভিত্তি গড়ে দেয়।
প্রাচীন তুর্কি লিপি স্বাভাবিকভাবেই আরামাইক থেকে বিবর্তিত এটা স্বীকৃতি পায়, বিশেষভাবে যদি হয় তবে পাহলাবি অথবা সোগদীয় (ভি. থমসেনের মতে), অথবা সম্ভবত খরোষ্ঠী দ্বারা। (সিএফ., আইজাক শিলালিপি)।
আরামাইককে ব্রাহ্মীলিপির অতি সম্ভাব্য উৎস বিবেচনা করা হয়, যেটি দেবনাগরীসহ ব্রাহ্মী লিপি পরিবারের পূর্বপুরুষ।
আরামাইক বর্ণমালা
আজকে, বাইবেলের আরামাইক, ইহুদিদের নিও-আরামাইক উপভাষা ও আরামাইক ভাষায় লিখিত ধর্মীয় আইন গ্রন্থ হিব্রু বর্ণমালায় লিখিত হয়েছে। সিরীয় ও খ্রিস্টান নিও-আরামাইক উপভাষাগুলো সিরীয় বর্ণমালায়। মান্দাইক ভাষা মান্দাইক বর্ণমালায় লিখিত আছে। যেহেতু আরামাইক ও শাস্ত্রীয় হিব্রু দেখতে প্রায় এক রকম তাই আরামাইক লিপি আদর্শ হিব্রুর সাথে মিশে পাণ্ডিত্যপূর্ণ সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়েছে।
বর্ণের নাম
আরামাইক লেখায় ব্যবহার
বর্ণ
সমোচ্চারিত বর্ণ
আইপিএ
সিরীয় লিপি
সাম্রাজীয় আরামাইক লিপি
হিব্রু
আরবী
ব্রাহ্মী
নাবাতায়েন
খরোষ্ঠী
Ālap
𐡀
א
ا
/ʔ/; /aː/, /eː/
Bēth
𐡁
ב
ب
/b/, /v/
Gāmal
𐡂
ג
ج
/ɡ/, /ɣ/
Dālath
𐡃
ד
د،ذ
/ð/, /d/
Hē
𐡄
ה
ه
?
?
/h/
Waw
𐡅
ו
و
/w/; /oː/, /uː/
Zain
𐡆
ז
ز
?
?
/z/
Ḥēth
𐡇
ח
ح،خ
?
?
/ħ/ /χ~x/
Ṭēth
𐡈
ט
ط،ظ
emphatic /tˤ/
Yodh
𐡉
י
ي
/j/; /iː/, /eː/
Kāp
𐡊
כ ך
ك
/k/, /x/
Lāmadh
𐡋
ל
ل
/l/
Mem
𐡌
מ ם
م
/m/
Nun
𐡍
נ ן
ن
/n/
Semkath
𐡎
ס
س
/s/
ʿĒ
𐡏
ע
ع، غ
?
?
/ʕ/
Pē
𐡐
פ ף
ف
/p/, /f/
Ṣādhē
,
𐡑
צ ץ
ص، ض
emphatic /sˤ/
Qop
𐡒
ק
ق
/q/
Rēsh
𐡓
ר
ر
/r/
Shin
𐡔
ש
ش
/ʃ/
Taw
𐡕
ת
ت، ث
/t/, /θ/
ইউনিকোড
সিরীয় আরামাইক বর্ণমালাকে ১৯৯৯সালে ইউনিকোড আদর্শ সংস্করণ ৩.০ তে যোগ করা হয়।
সিরীয় পূর্ণরূপ (ঊর্ধ্বরেখার একটি রূপ) বিশেষ নিয়ন্ত্রক চিহ্ন “সিরীয় পূর্ণরূপ চিহ্ন(U+070F)” কে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। সিরীয় আরামাইকের ইউনিকোড ব্লক হচ্ছে U+0700 থেকে U+074F:
সাম্রাজ্যীয় আরামাইক বর্ণমালা ২০০৯সালের অক্টোবরে ইউনিকোড আদর্শ সংস্করণ ৫.২তে যুক্ত করা হয়েছে।
সাম্রাজ্যীয় আরামাইক লিপির ইউনিকোড ব্লক হচ্ছে U+10840 থেকে U+1085F:
পৌরাণিক কালপঞ্জির ভিত্তিতে প্রথাগত ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিটিরই[৩] প্রতিফলন ঘটিয়ে স্বাদেশিকতাবাদীরাবৈদিক যুগের যে তারিখ প্রস্তাব করেন তা সাধারণভাবে স্বীকৃত মতের তুলনায় প্রাচীনতর। শুধু তাই নয়, তাঁরা সিন্ধু সভ্যতাকেও বৈদিক সভ্যতা মনে করেন। এই মতে, “ভারতীয় সভ্যতাকে নিশ্চিতভাবেই দেখতে হবে সিন্ধু-সরস্বতী প্রথার প্রাচীনতম যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ বা ৮০০০ অব্দ) থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলে আসা একটি ধারা হিসেবে।”[৯]
ইন্দো-আর্যদের উৎস-সংক্রান্ত প্রামাণ্য মতটি হল ইন্দো-আর্য অভপ্রয়াণ তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, ইন্দো-আর্যরা খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ নাগাদ উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রবেশ করেছিল।[৬]পৌরাণিক কালপঞ্জি অর্থাৎ রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণ সাহিত্যে বর্ণিত প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের ঘটনাগুলোর যে সময়রেখা, তা বৈদিক সংস্কৃতির আরও প্রাচীনতর এক কালপঞ্জির কথা প্রস্তাব করে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বেদ প্রকাশিত হয় বহু সহস্র বছর আগে এবং বর্তমান কল্পেরমনু তথা মানবজাতির আদিপুরুষ বৈবস্বত মনুর রাজত্ব শুরু হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৭৩৫০ অব্দ নাগাদ।[১৬]ভগবদ্গীতার পশ্চাৎপট কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ সম্ভবত আর্যাবর্তের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে সংঘটিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।[১৭][১৮] আর্য-স্বাদেশিকতাবাদীদের মতে এই যুদ্ধের সময়কাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০ অব্দ।
আর্য-স্বাদেশিকতাবাদীরা ইতিহাস ও ধর্ম বিষয়ে প্রথাগত ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটিয়ে[৩] এই মত প্রচার করেন যে, আর্যরা ভারতেরই আদি বাসিন্দা। প্রামাণ্য দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য এই মতের বিরোধিতা করে।[৬] ১৯৮০-এর দশকে ও ১৯৯০-এর দশকে স্বাদেশিকতাবাদীরা সাধারণ বিতর্কসভায় নিজেদের মত উত্থাপন করতে শুরু করেন।[১৯]
ভারতীয় স্বভূমি ও আর্য অভিপ্রয়াণ তত্ত্ব
উনবিংশ শতাব্দীর ইন্দো-ইউরোপীয় বিদ্যায়ঋগ্বেদের ভাষাই ছিল গবেষকদের কাছে পরিচিত সবচেয়ে প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা। বাস্তবিকই এই গ্রন্থটিই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় লেখা একমাত্র নথি যা যুক্তিগতভাবে ব্রোঞ্জ যুগের ভাষা হিসেবে দাবি রাখতে পারে। সংস্কৃত ভাষার এই প্রাধান্যের কারণেই ফ্রেডরিখ শ্লেগেল প্রমুখ গবেষক অনুমান করেছিলেন যে প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় উৎসভূমির সঠিক অবস্থানটি ছিল ভারতে এবং অন্যান্য উপভাষাগুলো ঐতিহাসিক অভিপ্রয়াণকালে পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে।[২০][২১] বিংশ শতাব্দীতে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার ব্রোঞ্জযুগীয় প্রত্যয়নগুলোর (আনাতোলীয়, মাইসোনীয় গ্রিক) আবিষ্কারের ফলে বৈদিক সংস্কৃত প্রাচীনতম পরিচিত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা হওয়ার বিশেষ মর্যাদাটি হারায়।[২০][২১]
১৯৫০-এর দশকে ম্যাক্স মুলার দুই আর্য জাতির ধারণাটি প্রস্তাব করেন। তাঁর মধ্যে পশ্চিমের আর্য জাতি ককেশাস থেকে ইউরোপে এবং পূর্বের আর্য জাতি ককেশাস থেকে ভারতে অভিপ্রয়াণ করেছিল। এইভাবে মুলার আর্য জাতিকে দুই শাখায় ভাগ করে পশ্চিমের শাখাটির উপর অধিকতর গুরুত্ব ও মূল্য আরোপ করেন। যদিও এই “আর্যদের পূর্বের শাখাটি প্রাচ্যের আদিম অধিবাসীদের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল এবং তাদের সহজেই জয় করেছিল।”[২২] ১৯৮০-এর দশকে মুলারের ধারণাটি বর্ণবাদী নৃতত্ত্ববিদেরা গ্রহণ করেন। উদাহরণস্বরূপ, বর্ণ বিজ্ঞানের প্রবক্তা তথা ঔপনিবেশিক প্রশাসক হারবার্ট হোপ রিসলে (১৮৫১-১৯১১) নাকের প্রস্থ থেকে উচ্চতার ভিত্তিতে ভারতীয়দের আর্য, দ্রাবিড় সহ সাতটি জাতিতে ভাগ করেছিলেন।[২৩][২৪]
আর্য “অনুপ্রবেশ”-এর ধারণাটি আরও ইন্ধন পায় সিন্ধু (হরপ্পা) সভ্যতার আবিষ্কারের মাধ্যমে। এই সভ্যতার পতন ইন্দো-আর্য অভিপ্রয়াণের প্রায় সমসাময়িক কালের ঘটনা হওয়ায় তা থেকে এক ধ্বংসাত্মক অনুপ্রবেশের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে প্রত্নতত্ত্ববিদ মর্টিমার হুইলার মহেঞ্জোদাড়োর উপরের স্তরগুলোতে আবিষ্কৃত অসমাহিত অনেক মৃতদেহের উপস্থিতিকে সংঘর্ষের শিকার বলে ব্যাখ্যা করে এই মতটি প্রস্তাব করেন। সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের জন্য তিনি বৈদিক দেবতা ইন্দ্রকে দায়ী করে যে বক্তব্যটি রেখেছিলেন তা অত্যন্ত খ্যাতিলাভ করে।[২৫] সেই সময় থেকেই গবেষকেরা মনে করে আসছেন যে, হুইলার প্রমাণগুলোর ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং প্রাগুক্ত কঙ্কালগুলোকে গণহত্যার অসমাহিত শিকার না বলে তাড়াহুড়ো করে সমাহিত করা মৃতদেহ বলাই সঙ্গত।[২৫]
অ্যান্ড্রোনোভো সংস্কৃতির আনুমানিক সর্বাধিক প্রসার, সঙ্গে সিনতাশতা-পেত্রোভকা সংস্কৃতি (লাল), সর্বপ্রথম পাখি-যুক্ত চাকার রথের প্রাপ্তিস্থান (নীলচে লাল) এবং সন্নিহিত ও পরস্পর-প্রাবৃত অ্যাফানাসেভো, স্রুবনা ও ব্যাকট্রিয়া-মার্জিয়ানা প্রত্ন চত্বর সংস্কৃতির (সবুজ) অবস্থান।
১৯৮০-এর দশক থেকে “অনুপ্রবেশ”-এর ধারণাটি মূলধারার গবেষকদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হতে শুরু করে।[২৬] তার পরিবর্তে আসে অধিকতর পরিশীলিত এক ধারণা,[২৭][note ১] যা ইন্দো-আর্য অভিপ্রয়াণ তত্ত্ব নামে পরিচিত। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, ইন্দো-ইউরোপীয়-ভাষী জাতিগোষ্ঠী পন্টিক স্তেপে তাদের উরহেইমাত (আদি স্বভূমি) থেকে মধ্য ইউরোপীয় দড়ির ছাপযুক্ত মৃৎসামগ্রী সংস্কৃতি ও পূর্ব ইউরোপীয়/মধ্য এশীয় সিনতাশতা সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে মধ্য এশিয়ার মধ্য দিয়ে লেভান্ট মিতান্নি), দক্ষিণ এশিয়া ও অভ্যন্তরীণ এশিয়া (ওউসুন ও ইউয়েঝি) অঞ্চলে অভিপ্রয়াণ করলে দক্ষিণ এশিয়ায় ইন্দো-আর্য ভাষাগুলো প্রচলন লাভ করে।[note ২] এই তত্ত্বটি কুরগান প্রকল্পনা/সংশোধিত স্তেপ তত্ত্বেরই একটি অংশ, যা আরও বর্ণনা করে কীভাবে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলো ইন্দো-ইউরোপীয়-ভাষী জাতিগোষ্ঠীর অভিপ্রয়াণের ফলে পশ্চিম ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল।
ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান এই তত্ত্বের মূল ভিত্তিটির জোগান দেয়, ভাষাগুলোর বিকাশ ও পরিবর্তন বিশ্লেষণ করে এবং বিভিন্ন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার বিকাশের সময়কাল সহ সেগুলোর মধ্যবর্তী সম্পর্কটিকে প্রতিষ্ঠা করে। ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান বণ্টিত শব্দাবলি, ইন্দো-ইউরোপীয়ের উৎসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ক্ষেত্র এবং নির্দিষ্ট অঞ্চলের নির্দিষ্ট শব্দভাণ্ডার সম্পর্কে তথ্যেরও জোগান দেয়।[৭][২৯][৩০] ভাষাবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও তথ্যের সঙ্গে প্রত্নতাত্ত্বিক ও বংশগতিবিদ্যা-সংক্রান্ত তথ্য[৩১][৩২][note ৩] এবং সেই সঙ্গে নৃতাত্ত্বিক মতবাদগুলো মিলিয়ে একটি যে সুস্পষ্ট তত্ত্বটি উপস্থাপনা করা হয়েছে,[৭][৩১] সেইটিই বর্তমানে বহুলভাবে স্বীকৃত।[৪৩]
এই তত্ত্বে দেখা যায়, ইন্দো-ইউরোপীয়দের প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষ হল ইয়াম্নায়া সংস্কৃতি, [৭] যার থেকে উৎসারিত হয় মধ্য ইউরোপীয় দড়ির ছাপযুক্ত মৃৎসামগ্রী সংস্কৃতি, যেটি আবার পূর্বদিকে প্রসারিত হয়ে সৃষ্টি করে প্রত্ন-ইন্দো-ইরানীয়সিনতাশতা সংস্কৃতি (খ্রিস্টপূর্ব ২১০০-১৮০০ অব্দ), যার থেকে বিকাশলাভ করে অ্যান্ড্রোনোভো সংস্কৃতি (খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০-১৪০০ অব্দ)। খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ অব্দ নাগাদ ইন্দো-আর্য জাতি ইরানীয় শাখা থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এবং ব্যাকট্রিয়া-মার্জিয়ানা প্রত্ন চত্বর অঞ্চলে অভিপ্রয়াণ করে (খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০-১৭০০ অব্দ),[৪৪] এবং সেখান থেকে পরে লেভান্ট, উত্তর ভারত ও সম্ভবত অভ্যন্তরীণ এশিয়াতেও চলে যায়।[৪৫]
সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা ও অভিযোজনা
উত্তর ভারতে অভিপ্রয়াণ অবশ্যম্ভাবীরূপে বৃহৎ সংখ্যায় ঘটেনি। সম্ভবত ছোটো ছোটো গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে আর্যরা এই অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করে।[৪৬] এই আর্যেরাই নিজেদের গবাদি পশুর জন্য চারণভূমির অনুসন্ধান করার সময় নতুন অঞ্চলে নিজেদের ভাষা ও সমাজব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটায়।[৪৭] তারপর বৃহত্তর গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সেই ভাষা ও সমাজব্যবস্থা ছড়িয়ে পড়ে।[৪৮][note ৪][note ৫] এই সকল গোষ্ঠী নতুন ভাষা ও সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে।[৫২][৫৩][note ৬] উইটজেল আরও উল্লেখ করেছেন যে, “এখনও সিন্ধু সমভূমি এবং আফগান ও বালুচি উচ্চভূমির মধ্যে ছোটো-আকারে প্রায়-বার্ষিক মানব আনাগোনা অব্যাহত রয়েছে।”[৫০]
…[স্বাদেশিকতাবাদীরা] একযোগে অভিযোগ করেন যে, ইন্দো-আর্য-ভাষী জাতিগোষ্ঠীর উৎস ভারতীয় উপমহাদেশের বহিরাঞ্চল এই তত্ত্ব ঠুনকো বা ভ্রান্ত পূর্বধারণা ও অনুমানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই গবেষকদের মতে, ইন্দো-আর্য জাতির বহুর্ভারতে উৎপত্তির কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ এখনও পাওয়া যায় নি […] আর্য অনুপ্রবেশ ও অভিপ্রয়াণ তত্ত্বের বিরোধিতার পন্থাই তাঁরা অবলম্বন করেছেন—এই কারণেই এই মতটি আর্য-স্বাদেশিকতাবাদ নামে পরিচিত।[১]
“স্বাদেশিকতাবাদী মতবাদ” আকার গ্রহণ করতে শুরু করে বেদের পূর্ববর্তীকালের হরপ্পা সভ্যতার আবিষ্কারের পর থেকে।[৫৪] এই বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা হয় যে, আর্যরা ভারতেরই আদি নিবাসী,[২] সিন্ধু সভ্যতা হল বৈদিক সভ্যতা,[২] খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের আগেই বেদ রচিত হয়,[৫৫] ভারতের ইন্দো-ইউরোপীয় অংশ (উত্তর ভারত) ও দ্রাবিড় অংশের (দক্ষিণ ভারত) মধ্যে কোনও ভেদ নেই,[৫৫] এবং ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলো ভারতের একটি উৎসভূমি থেকেই সেগুলোর বর্তমান অবস্থানে ছড়িয়ে পড়েছে।[২] ব্রেসনানের মতে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে এক মহত্তর আর্যজাতি কর্তৃক স্থানীয় ভারতীয়দের শাসন করার যে ধারণাটির কথা ছড়িয়ে পড়েছিল, এই মতবাদ তারই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। উক্ত ধারণাটির মাধ্যমে সূক্ষ্মভাবে ঔপনিবেশিক যুগে ইউরোপীয় বহিরাক্রমণকারীদের জাতিগত মহত্তরত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছিল, “স্বদেশীয় এক বিকাশের মাধ্যমে বেদের উৎপত্তি-সংক্রান্ত কোনও মত” প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য এই ধারণার ছিল না।[৫৬]
স্বাদেশিকতাবাদীর প্রধান বক্তব্য
“স্বদেশীয় আর্য” ধারণাটির সমর্থনে প্রত্নতাত্ত্বিক, বংশগতি-সম্বন্ধীয় ও ভাষাবৈজ্ঞানিক তথ্যের নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা এবং ঋগ্বেদের আক্ষরিক ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়।[৫৭][১১][web ৩] “স্বদেশীয় আর্য” তত্ত্বের সমর্থনে এবং মূলধারার ইন্দো-আর্য অভিপ্রয়াণ তত্ত্বের বিরোধিতায় প্রামাণ্য বক্তব্যগুলো হল:
ইন্দো-আর্য অভিপ্রয়াণ তত্ত্বের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ:
ইন্দো-আর্য অভিপ্রয়াণ তত্ত্বটিকে “ইন্দো-আর্য অনুপ্রবেশ” তত্ত্ব হিসেবে ব্যাখ্যা করা,[৫৮][note ৭] যেটিকে ঊনবিংশ শতাব্দীর ঔপনিবেশিকতাবাদীরা ভারতীয়দের দমন করার জন্য আবিষ্কার করেছিল;[৫৯]
ভাষাবৈজ্ঞানিকদের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন;[৬০][৬১][৬২]
এক স্বদেশীয় সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার পক্ষে মতপ্রকাশ, উত্তর-পশ্চিম ভারতে ইন্দো-আর্যদের প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষের অভাব-সংক্রান্ত যুক্তির উত্থাপন;[৬১]
ছোটো ছোটো গোষ্ঠী কর্তৃক বৃহত্তর ক্ষেত্রে সংস্কৃতি ও ভাষার পরিবর্তন সাধনের সম্ভাবনার তত্ত্বের বিরোধিতা;[web ৩]
একটি বৈদিক-পৌরাণিক কালপঞ্জিকে স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়ে ভারতের ইতিহাসের তারিখগুলোর পুনর্মূল্যায়ন:[৬৩]
সংস্কৃত ভাষার এক প্রাচীন, স্থানীয় উৎস নির্দেশ,[৬৪][৬১] ঋগ্বেদ ও বৈদিক জাতির সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দ বা তারও পূর্ববর্তী বলে উল্লেখ;[৫৫][৬৫][৬৬][৬২] এর মধ্যে রয়েছে:
ঋগ্বেদে এক মহতী নদী হিসেবে কথিত সরস্বতী নদীটিকেঘগ্গর-হকরা নদী হিসেবে চিহ্নিতকরণ, নদীটি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ নাগাদ শুকিয়ে যাওয়ায় ঋগ্বেদের এক প্রাচীনতর তারিখায়ন সম্ভবপর হয়;[৬৭]
খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের আগে ঘোড়া ও ঘোড়ায় টানা রথের অস্তিত্বের কথা উপস্থাপনা;
বৈদিক জাতিকে হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে একীকরণের প্রয়াস;[২][৬৫]
বৈদিক-পৌরাণিক কালপঞ্জির ভিত্তিতে ভারতীয় ইতিহাসের তারিখের পুনর্মূল্যায়ন।[৬৮]
আর্য অভিপ্রয়াণ ধারণা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন
“আর্য অনুপ্রবেশ” তত্ত্বের ব্যবহার
ইন্দো-আর্য অভিপ্রয়াণতত্ত্বটিকে আক্রমণ করার জন্য সেকেলে “আর্য অনুপ্রবেশ” ধারণাটিকে এক কাল্পনিক বিরোধী পক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো হয়।[৫৮][note ৭] উইটজেলের মতে, আর্য-স্বাদেশিকতাবাদীরা অনুপ্রবেশের তত্ত্বটির সমালোচনা করেন ঔপনিবেশিক শাসনের স্বপক্ষে উত্থাপিত যুক্তি হিসেবে:[৫৮]
ইন্দো-আর্য-ভাষী আর্যদের অনুপ্রবেশের তত্ত্বটিকে (“আর্য অনুপ্রবেশ”) সাধারণভাবে দেখা হয় একটি ব্রিটিশ নীতি হিসেবে, যার মাধ্যমে তারা ভারতে তাদের অনুপ্রবেশের পক্ষে এবং তারপর ঔপনিবেশিক শাসনের স্বপক্ষে যুক্তি উত্থাপন করত: উভয় ক্ষেত্রেই এক “শ্বেতাঙ্গ জাতি”কে স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ অধিবাসীদের দমন করতে দেখা যায়।
যে তত্ত্বের ভাষাবৈজ্ঞানিক প্রমাণ আমরা আলোচনা করতে চলেছি, তা “আর্য অনুপ্রবেশ তত্ত্ব” নামেই সমধিক পরিচিত। আমি এই পরিভাষাটিই ব্যবহার করব, যদিও কোনও কোনও গবেষক এটির প্রতি আপত্তি জানিয়ে “অনুপ্রবেশ” শব্দের পরিবর্তে “অভিপ্রয়াণ” শব্দটি ব্যবহার করতে চান… উত্তর ভারতের ভাষাবৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপট দু’টি মাত্র সম্ভাব্য ব্যাখ্যার দরজা খোলা রাখে: হয় ইন্দো-আর্যরা স্থানীয়, অথবা এরা অনুপ্রবেশ করেছিল।[note ৮]
ভাষাবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি
স্বাদেশিকতাবাদীরা ভাষাবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন।[৬০][৬১][৬২] ব্রায়ান্টের মতে,[৭০] স্বাদেশিকতাবাদীদের ভাষাবিজ্ঞান-সংক্রান্ত জ্ঞান সামান্যই। তাঁরা হয় ভাষাতাত্ত্বিক প্রমাণ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেন এবং সেগুলোকে অতিমাত্রায় অনুমানমূলক ও অনির্ণায়ক বলে খারিজ করে দেন,[note ৯] অথবা সেগুলোকে নৈরাশ্যজনকভাবে অপর্যাপ্ত গুণাবলির সাহায্যে সমাধানের চেষ্টা করেন; এই মনোবৃত্তি ও উপেক্ষাই অধিকাংশ অভিপ্রয়াণবাদী গ্রন্থাবলির মূল্য গুরুত্বপূর্ণভাবে হ্রাস করে দেয়।[৭১][৭২]
১৯৬০-এর দশকে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রত্নতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা অভিপ্রয়াণ তত্ত্ব থেকে ঘুরে যায় পরিবর্তনের অভ্যন্তরীণ কারণগুলোর দিকে।[৪১] ইন্দো-আর্যদের প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষের অভাবের প্রেক্ষিতে জিম জি. শ্যাফার ১৯৮০-এর দশকের ও ১৯৯০-এর দশকের লেখালিখিতে হরপ্পা ও হরপ্পা-পরবর্তীকালের জনবসতিগুলোর মধ্যে এক স্থানীয় সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার কথা প্রস্তাব করেন।[৭৩][৭৪] শ্যাফারের মতে, হরপ্পার নগর সংস্কৃতির পতনের সময় বা তার পরে উত্তরপশ্চিম ভারতে আর্য অভিপ্রয়াণের কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক ইঙ্গিত পাওয়া যায় না।[৭৪][note ১০] পরিবর্তে শ্যাফার “স্থানীয় সাংস্কৃতিক বিকাশকে প্রতিফলনকারী সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের এক ধারাবাহিকতা”-র পক্ষপাতী ছিলেন।[৭৫] শ্যাফারের মতে, ভাষাবৈজ্ঞানিক পরিবর্তনকে ভুলক্রমে জনগোষ্ঠীর অভিপ্রয়াণের কারণবশত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[৭৬][note ১১] অনুরূপভাবে এরডোসিও অভিপ্রয়াণের প্রমাণাভাবের কথা উল্লেখ করেন এবং বলেন যে “ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলো অভিপ্রয়াণের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় ভালোভাবে ছড়িয়ে গিয়ে থাকতে পারে”,[৮২] কিন্তু ঋগ্বৈদিক আর্যগণ এক শ্রেণির নির্দিষ্ট ধ্যানধারণার অনুগামী এক বিশেষ জাতি-ভাষাকেন্দ্রিক নৃগোষ্ঠী হিসেবে[৮৩][note ১২] সম্ভবত স্থানীয় অধিবাসী ছিলেন, যাঁদের ধ্যানধারণাগুলো অনতিকালের মধ্যেই ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল।[৮২][৮৫]
১৯৯০-এর দশক থেকে মনোযোগ এক ব্যাখ্যাকারী তত্ত্ব হিসেবে আবার অভিপ্রয়াণ তত্ত্বের দিকেই ফিরে আসে।[৪১] পশুচারক সমাজগুলোকে প্রত্নতাত্ত্বিক নথি থেকে শনাক্ত করা কঠিন। কারণ তারা ছোটো ছোটো গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ায় এবং খুব কম চিহ্নই ফেলে যায়।[web ৬] ১৯৯০ সালে ডেভিড অ্যান্টনি অভিপ্রয়াণ তত্ত্বের সপক্ষে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন।[৪১] এছাড়া দ্য হর্স, দ্য হুইল, অ্যান্ড ল্যাংগুয়েজ (২০০৭) গ্রন্থে তিনি ইউরেশীয় স্তেপ ও মধ্য এশিয়া জুড়ে ইন্দো-ইউরোপীয় জাতিগোষ্ঠীর প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষের এক বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করেন।[৭] ২০১০-এর দশকের গোড়ার দিকে[৩৪][৮৬] বংশগতি-সংক্রান্ত গবেষণায় “বৈপ্লবিক”[৩৩][৩৪][৮৬] উন্নতির ফলে এই পরিবর্তন আবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কারণ এই গবেষণার মাধ্যমে ইতিপূর্বে অপ্রাপ্তব্য তথ্যও পাওয়া সম্ভব হয়েছে এবং দেখা গিয়েছে যে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বড়ো আকারের অভিপ্রয়াণ চলে আসছে।[৪১]
স্বাদেশিকতাবাদের সমর্থকেরা বংশগতিবিদ্যা-সংক্রান্ত গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলগুলো নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন।[web ৪][web ৫][web ৭] কয়েকটি পুরনো ডিএনএ-গবেষণায় ইন্দো-আর্য অভিপ্রয়াণের তত্ত্বটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।[৮৭][৮৮] ২০১৫ সাল থেকে যদিও বংশগতিবিদ্যা গবেষণা “বৈপ্লবিক”[৩৩][৩৪] উন্নতসাধন করেছে এবং নিশ্চিত করেছে যে স্তেপ পশুচারকেরা পশ্চিম ইউরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ায় অভিপ্রয়াণ করেছিল[৩৮][৩১][৩৯][৪০][৪১][note ১৩] এবং “অনেক বিজ্ঞানী যাঁরা ব্রোঞ্জ যুগে ভারতে গুরুত্বপূর্ণ অভিপ্রয়াণ নিয়ে সংশয়ী বা নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করতেন তাঁরাও মত পরিবর্তন করেন।”[৩৮][note ১৪]
সাংস্কৃতিক পরিবর্তন
ছোটো ছোটো গোষ্ঠী বৃহত্তর ক্ষেত্রে সংস্কৃতি ও ভাষার পরিবর্তন সাধন করতে পারে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন স্বাদেশিকতাবাদীরা।[web ৩] মূলধারার গবেষকদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এটি হয়েছিল অভিজাতদের আধিপত্য বিস্তার ও ভাষা স্থানান্তরণের মাধ্যমে।[৯০][৯১][৯২] ছোটো ছোটো গোষ্ঠীও একটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রকে পরিবর্তিত করতে পারে,[৯৩][৭] যখন এক অভিজাত পুরুষ গোষ্ঠী ছোটো ছোটো স্থানীয় গোষ্ঠীর মধ্যে মিশে যায় এবং সেই সব ক্ষুদ্রতর গোষ্ঠী অভিজাত গোষ্ঠীটির ভাষা গ্রহণ করে। এই ঘটনার ফলে উত্তর ভারতে এক ভাষা স্থানান্তরণের ঘটনা ঘটেছিল।[৯৪][৯৫][৯৬] এরপর সংস্কৃতকরণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বৈদিক-ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির প্রসারের মাধ্যমে ইন্দো-আর্য ভাষাগুলি আরও ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রক্রিয়ায় স্থানীয় পরম্পরাগুলি (“ছোটো পরম্পরাসমূহ”) ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মের “মহৎ পরম্পরা”-র সঙ্গে একাত্মীভূত হয়ে যায়।[৯৭] এর ফলে সারা ভারতে ও ভারতের বাইরেও সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থ ও ব্রাহ্মণ্যবাদী ধ্যানধারণাগুলি ছড়িয়ে পড়ে।[৯৮] এর ফলে হিন্দু সংশ্লেষণও ত্বরান্বিত হয়,[৯৯][৯৮][৯৭] যার মাধ্যমে ব্রাহ্মণ্যবাদী পরম্পরা “আচার-অনুষ্ঠান ও ধ্যানধারণার স্থানীয় জনপ্রিয় পরম্পরাগুলি”কে আত্মীভূত করেছিল।[৯৯]
ভারতীয় ইতিহাসের পুনঃ-তারিখায়ন
ঋগ্বেদ ও ঋগ্বৈদিক জাতিগোষ্ঠীর পুনঃ-তারিখায়ন
সংস্কৃত
মূলধারার গবেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় সংস্কৃত ভাষার উদ্ভব ঘটেছিল খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে ইন্দো-আর্য জাতিগোষ্ঠী কর্তৃক ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহের প্রচলন ঘটানোর পরে।[১০০][১০১][note ২] সংস্কৃত ভাষার সবচেয়ে পুরনো রূপটি হল ঋগ্বেদে প্রাপ্ত বৈদিক সংস্কৃত। ঋগ্বেদ রচিত হয়েছিল খ্রিটপূর্ব ১৫০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে।[১০২][১০৩][note ১৫]
“হিন্দু জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক উপকথা”-র সূত্র ধরে[৬৪][২৯] স্বাদেশিকতাবাদীরা সংস্কৃত ভাষার এক প্রাচীন ও স্থানীয় উৎসের পক্ষে মত প্রকাশ করেন।[৬৪][৬১][note ১১] তাঁরা মনে করেন, ঋগ্বেদ ও বৈদিক জাতিগোষ্ঠীর সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দ বা তারও পূর্ববর্তী।[৫৫][৬৫][৬৬][১০৪][২৬][note ১৬]সুভাষ কাকের মতে, খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম সহস্রাব্দকে আর্যদের আগমন কাল ধরে একটি জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক নিয়মের মাধ্যমে ঋগ্বেদের সূক্তগুলিকে বিন্যস্ত করা যায়। যাতে দেখে যায় “খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ বা ৪০০০ অব্দের ঘটনাগুলির মধ্যে পরিশীলিত পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি প্রথা গড়ে উঠেছিল
বেশ কয়েকটি প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারকে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের পূর্বে বৈশিষ্টসূচক ইন্দো-আর্য প্রত্নসামগ্রীর প্রমাণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। উদাহরণের মধ্যে রয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের পূর্ববর্তীকালের ঘোড়ার হাড় হিসেবে ব্যাখ্যাকৃত পশুর হাড়[note ১৭] এবং রথ হিসেবে ব্যাখ্যাত সিনাউলি শকট-সমাধি।[web ১৩][web ১৪][web ১৫][note ১৮] ঘোড়ার দেহাবশেষ ও সম্পর্কিত প্রত্নসামগ্রী পরবর্তীকালীন হরপ্পা (খ্রিস্টপূর্ব ১৯০০-১৩০০ অব্দ) প্রত্নক্ষেত্রগুলিতে পাওয়া যায়। তার থেকে এই ইঙ্গিত মেলে যে পরবর্তীকালীন হরপ্পা যুগেও ঘোড়া বিদ্যমান ছিল।[১১১] তবে হরপ্পা সভ্যতায় ঘোড়া সম্ভবত কোনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত না,[১১২] যা করত বৈদিক যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-৫০০ অব্দ)।[১১৩][note ১৯] দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম অবিতর্কিত ঘোড়ার দেহাবশেষ পাওয়া যায় গান্ধার সমাধি সংস্কৃত বা সোয়াট সংস্কৃতি (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০-৮০০ অব্দ) থেকে,[১১৩] যা ইন্দো-আর্যদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।[১১৪]
হরপ্পা প্রত্নক্ষেত্র সুরকোটাডা (খ্রিস্টপূর্ব ২৪০০-১৭০০ অব্দ) থেকে প্রাপ্ত ঘোড়ার দেহাবশেষকে এ. কে. শর্মা ইক্যুয়াস ফেরাস ক্যাবালাস (Equus ferus caballus) হিসেবে শনাক্ত করেন।[note ২০][note ২১] যদিও মিডো (১৯৯৭) প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদ এই মতের বিরোধী। তাঁরা মনে করেন ইক্যুয়াস ফেরাস ক্যাবালাস-এর দেহাবশেষকে ইক্যুয়াস এসিনাস (গাধা) বা ইক্যুয়াস হেমিওনাস (ওনাগার) অন্যান্য ইক্যুইড প্রজাতির থেকে পৃথক করা কঠিন।[১১৫]
২০১৮ সালে সিনাউলিতেব্রোঞ্জ যুগের নিরেট-চাকতির চাকাবিশিষ্ট শকট আবিষ্কৃত হয়। এগুলি আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-১৮০০ অব্দের গিরিমাটি রঙের মৃৎশিল্প সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।[১১৬] কেউ কেউ এগুলিকে অশ্ব-কেন্দ্রিক ইন্দো-আর্য জাতিগোষ্ঠীর আবির্ভাবের পূর্ববর্তীকালের ঘোড়ায় টানা রথ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।[১১৭][১১৬][web ১৩][web ১৪][web ১৫][note ১৮] পারপোলার মতে, শকটগুলি ছিল ষাঁড়ে-টানা গাড়ি এবং এগুলি ভারতীয় উপমহাদেশে ইন্দো-ইরানীয় অভিপ্রয়াণের প্রথম তরঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত।[১১৬] উল্লেখ্য, গিরিমাটি রঙের মৃৎশিল্প সংস্কৃতির (খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-১৫০০ অব্দ) সঙ্গে পরবর্তীকালীন হরপ্পা সংস্কৃতি ও বিভিন্ন স্তেপ-সংস্কৃতির সাদৃশ্য লক্ষিত হয়।[১১৬]
সরস্বতী নদী
ঋগ্বেদে সরস্বতীকে এক মহতী নদী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। স্বাদেশিকতাবাদীরা এই বর্ণনাগুলিকে এক বাস্তব নদীর প্রেক্ষিতে গ্রহণ করেছেন এবং সরস্বতী নদীকে শনাক্ত করেছেন সিন্ধু নদের পূর্ব দিকের উপনদী ঘগ্গর-হাকরা হিসেবে। ঘগ্গর-হাকরা নদী খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ নাগাদ শুকিয়ে যাওয়ায়, স্বাদেশিকতাবাদীদের মতে বৈদিক জাতিগোষ্ঠী তারও আগে থেকে এই অঞ্চলে উপস্থিত ছিল।[৬৭]
ঋগ্বেদে এক বাস্তব নদীর যে উল্লেখ পাওয়া যায় তা থেকে এমন ইঙ্গিত মেলে যে সরস্বতী নদী “ততদিনে তার জলের প্রধান উৎসটিকে হারিয়েছিল এবং নিশ্চিতই একটি সমুদ্রে গিয়ে মিশেছিল,”[১১৮] “যা বর্তমান যুগের পরিস্থিতিটিকে বর্ণনা করে, কারণ সরস্বতী তার জলের অধিকাংশই হারিয়ে ফেলেছে।”[১১৮][note ২২] “সরস্বতী” নদী হিসেবে দক্ষিণ আফগানিস্তানেরহেলমান্দ নদীটিকেও শনাক্ত করা যেতে পারে।[১২০] বৈদিক জাতিগোষ্ঠী পাঞ্জাবে এসে বসতি স্থাপনের পর এই নদীর নামই সম্ভবত সেটির সংস্কৃত রূপে ঘগ্গর-হাকরা নদীর নাম হিসেবে পুনরায় ব্যবহৃত হয়েছিল।[১২০][১২১][note ২৩] ঋগ্বেদের সরস্বতী নদী বলতে সম্ভবত দু’টি স্বতন্ত্র নদীকেও বোঝাতে পারে, শাখান্তর্গত মণ্ডলগুলিতে এই নামে হেলমান্দ নদীকে এবং অধিকতর সাম্প্রতিককালে রচিত দশম মণ্ডলে এই নামে সম্ভবত ঘগ্গর-হাকরা নদীকে বুঝিয়েছে।[১২০]
হরপ্পা সভ্যতাকে বৈদিক সভ্যতা হিসেবে চিহ্নিতকরণ
স্বাদেশিকতাবাদীরা ভারতের এক অবিরাম সাংস্কৃতিক বিবর্তনের পক্ষে মত প্রকাশ করেন বলে হরপ্পা ও বৈদিক যুগের সভ্যতার মধ্যে পার্থক্যের বিষয়টি অস্বীকার করে[১২২][৬৫] সিন্ধু সভ্যতার জাতিগোষ্ঠীটিকে বৈদিক জাতিগোষ্ঠী বলে চিহ্নিত করেন।[২] কাকের মতে, “ভারতীয় সভ্যতাকে অবশ্যই দেখতে হবে সিন্ধু-সরস্বতী পরম্পরার আদিতম পর্যায় (খ্রিস্টপূর্ব ৭০০০ বা ৮০০০ অব্দ) থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলে আসা এক পরম্পরা হিসেবে।”[৯][note ২৪][৬৫] এই দাবির কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক, ভাষাবৈজ্ঞানিক ও বংশানুবিদ্যা-সম্বন্ধীয় প্রমাণ না থাকায় তা মূলধারার গবেষকেদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।[২৯]
“আর্য-স্বাদেশিকতাবাদ” ধারণাটি ধর্মীয় ইতিহাসের প্রথাগত হিন্দু ধারণার সঙ্গে খাপ খায়। কারণ, এই ধারণা অনুযায়ী, হিন্দুধর্মের উৎপত্তি স্মরণাতীত কালে এবং বৈদিক আর্যরা সুপ্রাচীনকাল থেকেই ভারতে বসবাস করছেন।[note ২৫] স্বাদেশিকতাবাদীদের ধারণার মূলে রয়েছে রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণ সাহিত্যের কালপঞ্জি, যেখানে রাজাদের নামের তালিকা ও বংশলতিকা পাওয়া যায়।[১২৩][১২৪] প্রাচীন ভারতের প্রথাসম্মত কালপঞ্জি গঠনে এই তালিকাই ব্যবহৃত হয়।[১২৫] “স্বাদেশিকতাবাদীরা” অনুসরণ করেন এক “পৌরাণিক অ্যাজেন্ডা”,[১২৬] যাতে বলা হয় যে, এই তালিকাগুলির সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দ পর্যন্ত। জানা যায় যে, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ নাগাদ পাটলিপুত্রেরমৌর্য রাজসভায় উপস্থিত গ্রিক রাজদূত মেগাস্থিনিস ১৫৩ জন রাজার এক প্রথাসম্মত তালিকার কথা শুনেছিলেন। এই তালিকার রাজাদের রাজত্বকাল ৬,০৪২ বর্ষব্যাপী, যা খ্রিস্টপূর্ব ৩১০২ সালে কলিযুগের শাস্ত্রসম্মত সূচনাকালেরও পূর্ববর্তী।[১২৩] এই রাজতালিকার ভিত্তি সূত চারণকবি প্রথা এবং এই তালিকা যা থেকে উৎসারিত তা মুখে মুখে প্রচারিত হত এবং অবিরাম পরিমার্জিত হত।[১২৩]
এই তালিকাগুলির সঙ্গে জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়ে থাকে, যার মাধ্যমে ঋগ্বেদের এক প্রাচীনতর তারিখ অনুমান করা হয়।[১২৭] এরই সঙ্গে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ও ঘটনাবলির পুনঃতারিখায়নের কাজও চলে। বুদ্ধের তারিখ নির্ধারিত হয় খ্রিস্টপূর্ব ১১০০ অব্দ বা খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ অব্দ এবং চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ) স্থলাভিষিক্ত হয় গুপ্ত রাজা চন্দ্রগুপ্ত।[১২৮][note ২৬] ভারত যুদ্ধের (কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ) তথা কলিযুগের আরম্ভের তারিখ নির্ধারিত হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩১৩৯-৩৮ অব্দ।[note ২৭]
মাইকেল উইটজেল “স্বদেশীয় আর্য” দৃশ্যকল্পের তিনটি প্রধান ধরনকে চিহ্নিত করেছেন:[১৩০]
১. একটি “নরমপন্থী” মত, যেখানে বলা হয়েছে যে ঋগ্বৈদিক আর্যরা ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলেরই আদি বাসিন্দা। অরবিন্দ ঘোষ ও দয়ানন্দ এই মতে বিশ্বাস করতেন।;[note ২৮]
২. “ভারত থেকে বহির্গমন” মতে বিশ্বাসীরা মনে করেন যে, ভারতই হল প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় স্বভূমি। এই মতবাদটি প্রথম প্রস্তাবিত হয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। পরবর্তীকালে হিন্দুত্ব-অনুরাগী[১৩২]কোয়েনরাড এস্ট (১৯৯৯) এটির পুনরুজ্জীবন ঘটান। হিন্দু জাতীয়তাবাদে শ্রীকান্ত তালাগেরি (২০০০) কর্তৃক এটি আরও জনপ্রিয়তা লাভ করে।[১৩৩];[১৩১][note ২৯]
৩. ভারত থেকেই বিশ্বের সকল ভাষা ও সভ্যতা উৎসারিত হয়েছে, এই মতবাদ। ডেভিড ফ্রলি প্রমুখ এই মতের প্রবক্তা।
কাজানাস একটি চতুর্থ দৃশ্যকল্পও যোগ করেছেন:
৪. খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০০ অব্দেরও পূর্বে আর্যরা সিন্ধু উপত্যকায় প্রবেশ করে এবং হরপ্পাবাসীর সঙ্গে মিশে যায় অথবা তারাই ছিল হরপ্পার অধিবাসী।[২৬]
অরবিন্দের আর্য বিশ্ববোধ
অরবিন্দের মতে, “আর্য”রা কোনও নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর সদস্য নয়, বরং যে ব্যক্তি “আত্ম-সংস্কৃতির, অন্তর্মুখী ও বহির্মুখীর প্রথার, আদর্শবাদের, মহাপ্রাণতার একটি নির্দিষ্ট ধরন গ্রহণ করেন”, তিনিই আর্য।[১৩৫] অরবিন্দ আর্যদের শক্তিমত্তা ও চারিত্রিক দৃঢ়তার পুনরুত্থান ঘটিয়ে ভারতের শক্তি বৃদ্ধি করতে চেয়েছিলেন।[১৩৬] ভারতে “আর্য অনুপ্রবেশকারী” ও এক কৃষ্ণাঙ্গ স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে জাতিগত বিভাজনের ঐতিহাসিকতা তিনি অস্বীকার করেন। অবশ্য তিনি প্রাচীন ভারতে দুই প্রকার সংস্কৃতির কথা স্বীকার করেন। যথা: উত্তর ও মধ্য ভারত ও আফগানিস্তানের আর্য সংস্কৃতি এবং পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের অনার্য সংস্কৃতি। এইভাবেই তিনি ইউরোপীয় ইতিহাসবিদদের দ্বারা কথিত সাংস্কৃতিক বিভাজনের ধারণাটি গ্রহণ করেছিলেন।[১৩৭]
সিন্ধু উপত্যকা থেকে প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহের প্রসারের মানচিত্র। তারিখ নির্ধারিত হয়েছে এলস্টের “উদীয়মান অ-অনুপ্রবেশবাদী মডেল” অনুযায়ী।
“ভারত থেকে বহির্গমন” (ইংরেজি: Out of India theory, সংক্ষেপে: OIT) বা “ভারতীয় উরহেইমত তত্ত্ব” হল এমন একটি মতবাদ যা মনে করে, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারেরউৎসউত্তর ভারত এবং সেখান থেকে অন্যান্য ইন্দো-ইউরোপীয় অঞ্চলে অনুপ্রবেশের একাধিক পর্যায়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।[web ৩] এই তত্ত্ব অনুযায়ী, হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরা ভাষাগত দিক থেকে ইন্দো-আর্য।[৫৭]
তাত্ত্বিক পরিদর্শন
“উদীয়মান বিকল্প”
ডেভিড ফ্রাওলি
ঔপনিবেশিক শাসন এবং হিন্দু রাজনীতির জন্য তাৎপর্য
আর্য-স্বাদেশিকতাবাদের পক্ষে আর্য আক্রমণ তত্ত্ব হিন্দু জাতীয়তাবাদে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।[১৩৮] ঔপনিবেশিকতার পটভূমিতে এবং ভারতে জাতি গঠনের পরবর্তী কাজকে বোঝাতে হবে।
ঔপনিবেশিক ভারত
হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদ এবং জাতীয়তাবাদ
মূলধারার দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে, হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন আর্য বহিরাগমণ উৎসকে অস্বীকার করে। আর্য সমাজ (আর্যদের সমাজ) এর প্রতিষ্ঠাতা দয়ানন্দ সরস্বতী মতে বেদ হচ্ছে সমস্ত জ্ঞানের উৎস যা আর্যদের নিকট প্রকাশিত হয়েছিল। তিব্বতে প্রথম মানুষ (একজন আর্য) সৃষ্টি হয়েছিল এবং সেখানে কিছুকাল বসবাস করে আর্যরা নেমে এসে ভারতে বসতি স্থাপন করেছিল, যা আগে শূন্য ছিল।[১৩৯]
থিওসফিক্যাল সোসাইটি মতে আর্যরা ছিল ভারতের প্রাচীন নিবাসী, কিন্তু তারা ইউরোপীয় সভ্যতার পূর্বপুরুষও ছিল। সোসাইটি ভারতের আধ্যাত্মবাদ এবং ইউরোপের বস্তুবাদের মধ্যে একটি দ্বিধাবিভক্তি দেখেছিল।[১৪০]
রোমিলা থাপারের মতে, সাভারকর এবং গোলওয়ালকরের নেতৃত্বে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা, জাতির জন্য একটি হিন্দু পরিচয় তৈরি করতে আগ্রহী, তারা মনে করে যে, আদি হিন্দুরা ছিল আর্য এবং তারা ভারতের প্রাচীন নিবাসী। ভারতের জনগণের মধ্যে আর্যদের কখনো কোনো আগ্রাসন হয়নি এবং কোনো বিরোধ ছিল না। আর্যদের ভাষা ছিল সংস্কৃত এবং পরবর্তীতে ভারত থেকে পশ্চিমে আর্য সভ্যতা ছড়িয়ে পড়ে।[১৪০]
উইটজেল সাভারকর এবং গোলওয়ালকরের লেখায় “স্বাদেশিক আর্য” ধারণার সন্ধান করেছেন। গোলওয়ালকার (১৯৩৯) উপমহাদেশে “আর্যদের” কোনো অভিবাসন অস্বীকার করেছিলেন, জোর দিয়েছিলেন যে সমস্ত হিন্দু সর্বদা “মাটির সন্তান”। উইটজেলের মতে এই ধারণাটি সমসাময়িক ফ্যাসিবাদের রক্ত আর মাটির কথা মনে করিয়ে দেয়। যেহেতু এই ধারণাগুলো আন্তর্জাতিকতাবাদী এবং সমাজমুখী নেহেরু-গান্ধী সরকারের দ্বারপ্রান্তে আবির্ভূত হয়েছিল, সেগুলো কয়েক দশক ধরে সুপ্ত ছিল এবং শুধুমাত্র ১৯৮০-এর দশকে তা প্রাধান্য পায়।[১৪১]
বার্গন্ডার একইভাবে গোলওয়ালকারকে “স্বাদেশিক আর্য” ধারণার প্রবর্তক এবং গোয়েলের ভয়েস অফ ইন্ডিয়াকে এর উল্লেখযোগ্যতার উত্থানের উপকরণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন:[১৪২]
আর্য অভিবাসন তত্ত্ব প্রথমে হিন্দু জাতীয়তাবাদে কোনো বিশেষ যুক্তিপূর্ণ ভূমিকা পালন করেনি। […] উদাসীনতার এই ছাপ পরিবর্তিত হয়, তবে মাধব সদাশিব গোলওয়ালকরের (১৯০৬-১৯৭৩) সাথে, যিনি ১৯৪০ সাল থেকে তার মৃত্যু পর্যন্ত চরমপন্থী আধাসামরিক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এর নেতা ছিলেন। […] তাদের অন্যান্য প্রকাশ্য আক্রমণাত্মক শিক্ষার বিপরীতে, হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা আর্য অভিবাসনের প্রশ্নকে জনসাধারণের বক্তৃতার বাইরে রাখতে বা পরিবর্তন করার চেষ্টা করেনি; বরং, হিন্দুদের আদিবাসীত্বের তত্ত্বকে সর্বজনীন স্বীকৃতি অর্জনে সাহায্য করার প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। এর জন্য প্রকাশক সীতা রাম গোয়েলের (জন্ম ১৯২১) উদ্যোগ ছিল সিদ্ধান্তমূলক। গোয়েলকে সবচেয়ে কট্টরপন্থী মনে করা যেতে পারে, কিন্তু একই সাথে হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শীদের মধ্যে অন্যতম বুদ্ধিজীবীও। […] ১৯৮১ সাল থেকে গোয়েল ‘ভয়েস অফ ইন্ডিয়া’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা চালাচ্ছেন যা ইংরেজিতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী সাহিত্য প্রকাশ করে এমন কয়েকটির মধ্যে একটি যা একই সাথে ‘বৈজ্ঞানিক’ দাবি করে। যদিও কোনও অফিসিয়াল সংযোগ নেই, ‘ভয়েস অফ ইন্ডিয়া’-এর বইগুলি – যা অসামান্য টাইপোগ্রাফিক মানের এবং একটি ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি হয় – সঙ্ঘ পরিবারের নেতাদের মধ্যে বিস্তৃত। […] ১৯৯০-এর দশকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক প্রভাবের ফলে আর্য অভিবাসন তত্ত্ব সংশোধন করার প্রচেষ্টাও একাডেমিক জনসাধারণের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে।
বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক তাৎপর্য
লার্স মার্টিন ফস “আর্য স্বাদেশিকতাবাদ” এর রাজনৈতিক তাৎপর্য উল্লেখ করেছেন।[১৩৮] তিনি উল্লেখ করেন যে “আর্য স্বাদেশিকতাবাদ” হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা তাদের মতাদর্শের একটি অংশ হিসাবে গ্রহণ করেছে, যা এটিকে একটি পণ্ডিত সমস্যা ছাড়াও একটি রাজনৈতিক বিষয় করে তোলে।[১৩৮] আদিবাসী আর্যবাদের প্রবক্তারা অগত্যা পশ্চিমা ভারতবিদ্যার “নৈতিক অযোগ্যতার” সাথে জড়িত, যা বেশিরভাগ আদিবাসী সাহিত্যে একটি পুনরাবৃত্ত থিম। আদিবাসী সাহিত্যে এবং অর্গানাইজারের মতো হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রকাশনাগুলোতে একই অলঙ্কার ব্যবহার করা হচ্ছে।[১৩৮]
অভিজিৎ রবিনুতলার মতে, ভারতে হিন্দুত্বের একচেটিয়া দাবির জন্য প্রাচীন নিবাসীদের অবস্থান অপরিহার্য:[১৪৩]
বিজেপি হিন্দুত্ব বা “হিন্দুত্ব” সম্পর্কে পার্টির ধারণার জন্য ইন্দো-আর্যদের মৌলিক বলে মনে করে: ভারত শুধুমাত্র হিন্দুদের এবং তাদের জন্য একটি জাতি। যারা ভারতকে তাদের পবিত্র ভূমি মনে করে তারাই জাতিতে থাকবে। বিজেপির দৃষ্টিকোণ থেকে, ইন্দো-আর্য জনগণ ভারতের প্রাচীন নিবাসী ছিল এবং তাই তারাই প্রথম ‘প্রকৃত হিন্দু’। তদনুসারে, এই দৃষ্টিকোণ থেকে ‘ভারতীয়’ পরিচয়ের একটি অপরিহার্য অংশ হল ভূমির প্রাচীন নিবাসী হওয়া।
…ভারতে আর্য উৎস বিতর্কের একটি ইঙ্গিত প্রদান করে, … আদালতকে ‘স্বাদেশিক আর্য’ দাবির পক্ষে না পড়ার জন্য বলেছিল কারণ এটি ‘মুসলিম ও খ্রিস্টানদের বিদেশী হিসাবে বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে গেছে এবং ভারতীয় সংস্কৃতিতে অ-হিন্দুদের অবদান’ প্রায় অস্বীকার করেছে।
থাপারের মতে, মোদির সরকার এবং বিজেপি “পৌরাণিক কাহিনী এবং স্টেরিওটাইপগুলোকে ছড়িয়ে দিয়েছে,” যেমন “আর্যদের একক অভিন্ন সংস্কৃতি, হিন্দুদের পূর্বপুরুষ, উপমহাদেশে বিরাজমান, অন্য সকলকে অন্তর্ভুক্ত করার” উপর জোর দেওয়া সত্ত্বেও ভারতে পরিযাণের জন্য পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রমাণ, যা “প্রাথমিক ইতিহাসের হিন্দুত্ব নির্মাণের প্রতি অশ্লীলতা।”
Wikipedia offers several templates for proper display of IPA transcriptions.
আইপিএ ফন্ট
In general, IPA symbols on a page should be enclosed in the {{IPA}} template, which formats the text in an IPA-producing font. If a substantial portion of a page uses IPA, it is customary to post notice of that fact with {{IPA notice}}, though each token still requires the {{IPA}} template for proper formatting.
If there are not enough occurrences to warrant a notice, then consider a template that links to an IPA key for the first instance of the IPA on a page or section.
ইংরেজি শব্দ
For English words, in a broad, non-regional transcription, as when giving the pronunciation of a key word in an article, use {{IPAc-en}}, which links to Help:IPA/English, a chart of the subset of the IPA that is relevant to English, and automates the conversion to IPA, so that {{IPAc-en|'|w|3:r|d}} appears as /ˈwɜːrd/. This provides mouse-over links to the symbols, and is now the preferred template.
For a specific transcription in a regional variety, use {{IPA-endia}} or {{IPA-all}}.
বিদেশী শব্দ
For words that are not assimilated into English, regional pronunciations of English words, and non-standard English dialects, use templates linking to the more general Help:IPA chart, containing all major IPA symbols:
For specific languages, there may be dedicated IPA keys for standardized transcription. There are several options for their display. The first cell includes the ISO code of the language; the second is the transcription; the third keys an introductory phrase; and the fourth is space for a sound file. Using the French word eau [o] as an example, we have the default format:
Templates have been created for languages which do not yet have dedicated key pages. Transcriptions which use these templates will link to Help:IPA for the time being; when a language-specific key is created the templates will be linked accordingly. For example, you can use {{IPA-jv|word}} for Javanese, but for the moment it will link to Help:IPA, producing আধ্বব: [word].
Languages and language extensions (IPA-xx) with links to Help:IPA
The template {{x2i}} takes X-SAMPA symbols (ASCII equivalents of IPA symbols) and converts them to IPA.
Other language-specific templates allow you to enter ordinary letters (or conventional ASCII equivalents) in place of IPA characters, and they will be automatically converted to the phonetic symbols that are used to transcribe the language. The templates that are currently available are shown below, with examples:
সংস্কৃত (সংস্কৃত উচ্চারণ: [ˈsɐ̃skr̩t̪ɐm] संस्कृतम् সংস্কৃতম্, সঠিক নাম: संस्कृता वाक्, সংস্কৃতা বাক্, পরবর্তীকালে প্রচলিত অপর নাম: संस्कृतभाषा সংস্কৃতভাষা, “পরিমার্জিত ভাষা”) হল একটি ঐতিহাসিক ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা এবং হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মেরপবিত্র দেবভাষা। এটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর প্রধান দুই বিভাগের একটি “শতম” ভুক্ত ভাষা। [note ১] বর্তমানে সংস্কৃত ভারতের ২২টি সরকারি ভাষার অন্যতম[১৫] এবং উত্তরাখণ্ড রাজ্যের অন্যতম সরকারি ভাষা।
বহুধাবিভক্ত ভারত ছোটো ছোটো রাজ্যে কেবলই কাড়াকাড়ি হানাহানি করেছে, সাধারণ শত্রু যখন দ্বারে এসেছে সকলে এক হয়ে বিদেশীর আক্রমণ ঠেকাতে পারে নি। এই শোচনীয় আত্মবিচ্ছেদ ও বহির্বিপ্লবের সময়ে ভারতবর্ষে একটিমাত্র ঐক্যের মহাকর্ষশক্তি ছিল, সে তার সংস্কৃত ভাষা।[১৬]
সংস্কৃতের প্রাক-ধ্রুপদি রূপটি বৈদিক সংস্কৃত নামে পরিচিত। এই ভাষা ঋগ্বেদের ভাষা এবং সংস্কৃতের প্রাচীনতম রূপ। এর সর্বাপেক্ষা প্রাচীন নিদর্শনটি প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে রচিত।[১৮] এই কারণে ঋগ্বৈদিক সংস্কৃত হল প্রাচীনতম ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগুলির অন্যতম এবং ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবারের (ইংরেজি ও অধিকাংশ ইউরোপীয় ভাষা যে পরিবারের সদস্য) আদিতম সদস্য ভাষাগুলির অন্যতম।[১৯] বৈদিক সংস্কৃতের সঙ্গে প্রাচীন এবং ধ্রুপদী লাতিন,গথিক, প্রাচীন নর্স, প্রাচীন আবেস্তী ও নবতর আবেস্তীর সম্পর্ক অনেকটা দূরের। এর আরও নিকট-আত্মীয় হলো নুরিস্তানি ভাষাগুলো।
সংস্কৃত সাহিত্যের ভাণ্ডার কাব্য ও নাটকের ঐতিহ্যশালী ধারাদুটি ছাড়াও বৈজ্ঞানিক, কারিগরি, দার্শনিক ও হিন্দু শাস্ত্রীয় রচনায় সমৃদ্ধ। হিন্দুদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে সংস্কৃত হল আনুষ্ঠানিক ভাষা। এই ধর্মে স্তোত্র ও মন্ত্র সবই সংস্কৃতে লিখিত। কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে আজও কথ্য সংস্কৃতের ব্যবহার প্রচলিত রয়েছে এবং সংস্কৃত ভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করার নানা প্রচেষ্টাও করা হয়ে থাকে।
সংস্কৃত ক্রিয়া বিশেষণসংস্কৃত- কথাটির আক্ষরিক অর্থ “সংযুক্ত করা”, “উন্নত ও সম্পূর্ণ আকারপ্রাপ্ত”, “পরিমার্জিত” বা “সুপ্রসারিত”।[২০] শব্দটি সংস্কার ধাতু থেকে উৎসারিত; যার অর্থ “সংযুক্ত করা, রচনা করা, ব্যবস্থাপনা করা ও প্রস্তুত করা”।[২১]সং শব্দের অর্থ “সমরূপ” এবং “(স্)কার” শব্দের অর্থ “প্রস্তুত করা”। এই ভাষাটিকে সংস্কৃত বা পরিমার্জিত ভাষা মনে করা হয়। এই কারণে এই ভাষা একটি “পবিত্র” ও “অভিজাত” ভাষা। প্রাচীন ভারতে ধর্মীয় ও শিক্ষাদান-সংক্রান্ত উদ্দেশ্যে লোকপ্রচলিত প্রাকৃত (“প্রাকৃতিক, শিল্পগুণবর্জিত, স্বাভাবিক ও সাধারণ”) ভাষার পরিবর্তে এই ভাষা ব্যবহৃত হত। এই ভাষাকে “দেবভাষা” বলা হত; কারণ প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এই ভাষা ছিল “দেবগণ ও উপদেবতাগণের ভাষা”।
সংস্কৃত ও অন্যান্য ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করতে গিয়ে গবেষকগণ একটি অনুপ্রবেশ তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, বর্তমানে যে ভাষাটি সংস্কৃত ভাষায় পরিণত হয়েছে, তার আদি ভাষাভাষীগণ খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম ভাগে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পথে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে।[২৪] এই তত্ত্বের প্রমাণস্বরূপ বাল্টিক ও স্লাভিক ভাষার সঙ্গে ইন্দো-ইরানীয় ভাষার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, অ-ইন্দো-ইউরোপীয় ফিনো-আগরিক ভাষাসমূহের সঙ্গে শব্দভাণ্ডার আদানপ্রদান, এবং উদ্ভিদ ও জীবজগতের নামসংক্রান্ত ইন্দো-ইউরোপীয় প্রামাণ্য শব্দগুলিকে তুলে ধরা হয়।[২৫]
সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রাচীনতম প্রামাণ্য রচনা হল হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মধ্য থেকে শেষ ভাগের মধ্যবর্তী সময়ে এই গ্রন্থ রচিত হয়। এই সময়কার কোনো লিখিত নথি পাওয়া যায় না। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, এই গ্রন্থের মৌখিক প্রচলনটি বিশ্বাসযোগ্য। কারণ, এই জাতীয় গ্রন্থগুলির সঠিক উচ্চারণকে ধর্মীয় কারণেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হত।[২৬]
ঋগ্বেদ থেকে পাণিনি (খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী) পর্যন্ত সংস্কৃত ভাষার বিকাশ লক্ষিত হয় সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ, ব্রাহ্মণ এসব গ্রন্থগুলিতে। এই সময় থেকে এই ভাষার মর্যাদা, ধর্মীয় ক্ষেত্রে এর ব্যবহার, এবং এর সঠিক উচ্চারণ সংক্রান্ত বিধিনিষেধগুলি এই ভাষার বিবর্তনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।[২৭]
পাণিনিরঅষ্টাধ্যায়ী প্রাচীনতম সংস্কৃত ব্যাকরণ, যা আজও বর্তমান রয়েছে। এটি মূলত একটি প্রামাণ্য ব্যাকরণ। এটি বর্ণনামূলক নয়, নির্দেশমূলক প্রামাণ্য গ্রন্থ। যদিও পাণিনির সময় বেদের কয়েকটি অচলিত হয়ে পড়া কয়েকটি বাক্যবন্ধের বর্ণনাও এখানে রয়েছে।
“সংস্কৃত” শব্দটির দ্বারা অন্যান্য ভাষা থেকে পৃথক একটি ভাষাকে বোঝাত না, বরং বোঝাত একটি পরিমার্জিত কথনরীতিকে। প্রাচীন ভারতে সংস্কৃত শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষিত উচ্চসমাজে স্থান পাওয়া যেত। সাধারণত উচ্চবর্ণের মধ্যেই পাণিনির ব্যাকরণ তথা সংস্কৃত ভাষার চর্চা প্রচলিত ছিল। প্রাচীন ভারতে সংস্কৃত ছিল বিদ্যাচর্চার ভাষা। লোকসাধারণে প্রচলিত প্রাকৃত ভাষার সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতও সমাজে প্রচলিত ছিল। উল্লেখ্য কথ্য প্রাকৃত ভাষা থেকেই পরবর্তীকালের আধুনিক ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলির উৎপত্তি হয়।
বৈদিক সংস্কৃত হলো ধ্রুপদী সংস্কৃতের পূর্বসূরী। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দীর মধ্য বা শেষ দিকে রচিত হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ হলো এর সবচেয়ে প্রাচীন লিখিত রূপ। ঋগ্বেদের পূর্বেও যদি এ ভাষার লিখিত রূপ থেকেও থাকে তবুও তার কোনো প্রমাণ নেই। প্রাচীন ভারতের ভিন্ন ভিন্ন স্থানের লেখকগণ ভিন্ন ভিন্ন সময়ে একে লিপিবদ্ধ করেন। যেমন: ঋগ্বেদের দ্বিতীয়-সপ্তম মণ্ডল রচনাকালের দিক দিয়ে প্রাচীন এবং প্রথম ও দশম মণ্ডল নবতর। কিন্তু ফরাসি বিশেষজ্ঞ লুই রেনু বলেছেন, এতদ্সত্ত্বেও এরা কোনো উপভাষাগত বৈচিত্র্য দেখায়নি।[২৮]
বৈদিক সংস্কৃত ভাষায় রচিত ঋগ্বেদ ছাড়াও বর্তমানে বিদ্যমান অন্য গ্রন্থগুলো হলো সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ , ব্রাহ্মণ , আরণ্যক এবং কিছু প্রাচীন উপনিষদ। মাইকেল উইটজেলের মতে, বৈদিক সংস্কৃত অর্ধ-যাযাবর আর্যদের কথ্য ভাষা ছিল।[২৯]ঋগ্বেদে প্রাপ্ত বৈদিক সংস্কৃতের ভাষা অন্যান্য বৈদিক গ্রন্থের ভাষা থেকে অনেক সেকেলে।আবার ঋগ্বেদের ভাষা প্রাচীন আবেস্তী ভাষার জরথুস্ত্রীয় গাথা এবং গ্রিক কবি হোমারেরমহাকাব্য ইলিয়াস (Ἰλιάς) ও ওদিসিয়ার (Ὀδύσσεια) সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল।[৩০] ঋগ্বেদের অনুবাদের জন্য পরিচিত ভারতবিদ স্টেফানি জেমিসন ও জোয়েল ব্রেরেটন বলেছেন যে বৈদিক সাহিত্য সেই সময়ের ইন্দো-ইরানি ও ইন্দো-ইউরোপীয় সামাজিক কাঠামোর অনুসরণে রচিত হতো। যেমন: অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সমাজে পুরোহিত বা কবিদের ভূমিকা ও অন্যান্য বিষয়। কথাবার্তার ধরন এমনকি কাব্যের মাত্রাও ইন্দো-ইউরোপীয় অন্য ভাষার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
ধ্রুপদী সংস্কৃত
প্রায় ২০০০ বছর ধরে একটি সাংস্কৃতিক প্রবাহ দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার কিয়দংশকে প্রভাবিত করে।[৩১] বেদোত্তর সংস্কৃত ভাষার প্রধান রূপটি পরিলক্ষিত হয় হিন্দু মহাকাব্যরামায়ণ ও মহাভারতে। এই দুই মহাকাব্যে পাণিনির ব্যাকরণ থেকে যে চ্যূতি লক্ষিত হয়, তার কারণ প্রাক-পাণিনীয় প্রভাব নয়, বরং প্রাকৃত প্রভাব।[৩২] প্রাচীন সংস্কৃত পণ্ডিতগণ এই চ্যূতিকে বলেছেন আর্ষ (आर्ष) বা ঋষির দ্বারা উক্ত। কোথাও কোথাও একে ধ্রুপদি সংস্কৃত না বলে প্রাকৃতবাদ বলা হয়েছে। বৌদ্ধ সংকর সংস্কৃত ভাষা হল একটি মধ্য ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা, যা বিভিন্ন দিক থেকে ধ্রুপদি সংস্কৃত ভাষার অনুরূপ প্রাকৃত ভাষায় লেখা বৌদ্ধদের আদি ধর্মগ্রন্থগুলি রচনার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।[৩৩]
তিওয়ারির (১৯৫৫) মতে, ধ্রুপদি সংস্কৃতের চারটি প্রধান উপভাষা ছিল: পশ্চিমোত্তরী (উত্তর-পশ্চিম, উত্তর বা পশ্চিম নামেও পরিচিত ছিল), মধ্যদেশী (মধ্য অঞ্চল), পূর্বী (পূর্বাঞ্চল) ও দক্ষিণী (দক্ষিণাঞ্চল, ধ্রুপদি যুগে উদ্ভূত)। প্রথম তিনটি উপভাষার উৎস বৈদিক ব্রাহ্মণ। এগুলির মধ্যে প্রথমটিকে শুদ্ধতম মনে করা হয়। (কৌষিতকী ব্রাহ্মণ, ৬.৭)
অবক্ষয়
কথ্য সংস্কৃত সংক্রান্ত একাধিক সমাজভাষাবৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে জানা যায়, কথ্য সংস্কৃত সীমাবদ্ধ এবং এর বিবর্তন ঘটে না।[৩৪] এই পরিপ্রেক্ষিতে কেউ কেউ সংস্কৃতকে “মৃত” বলেন। কিন্তু “মৃত” ভাষালাতিনের সঙ্গে এর পার্থক্যটি স্পষ্ট নয়। পোলক (২০০১) লিখেছেন:[৩৫]
Both died slowly, and earliest as a vehicle of literary expression, while much longer retaining significance for learned discourse with its universalist claims. Both were subject to periodic renewals or forced rebirths, sometimes in connection with a politics of translocal aspiration… At the same time… both came to be ever more exclusively associated with narrow forms of religion and priestcraft, despite centuries of a secular aesthetic.
দু’জনেই আস্তে আস্তে অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল এবং সাহিত্যের প্রকাশের বাহন হিসাবে প্রাচীনতম, যদিও এর সর্বজনীনবাদী দাবী নিয়ে শিখার বক্তৃতাটির জন্য দীর্ঘকালীন তাত্পর্য বজায় ছিল। উভয়ই পর্যায়ক্রমিক পুনর্নবীকরণ বা জোরপূর্বক পুনর্জন্মের বিষয় ছিল, কখনও কখনও ট্রান্সলোকাল আকাঙ্ক্ষার রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত … একই সাথে … উভয়ই একাধিক শতাব্দী ধর্মনিরপেক্ষ নন্দনতত্ব সত্ত্বেও ধর্ম এবং পুরোহিতশৈলীর সংকীর্ণ রূপগুলির সাথে আরও বিশেষভাবে যুক্ত হয়ে উঠেছিল।
ভৌগোলিক বিস্তার
৩০০-১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে সংস্কৃত ভাষার উপস্থিতি
সংস্কৃত ভাষা ভারতবর্ষে বিকশিত হলেও শাসনগত, ধর্মীয় এবং প্রভাবশালী ভাষা হওয়ার কারণে তা এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। তীর্থযাত্রী ,ব্যবসায়ী ও ধর্মগুরুদের মাধ্যমে প্রথম সহস্রাব্দীতে (খ্রিস্টাব্দ) সংস্কৃত ভাষা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্য এশিয়ায় প্রবেশ করে।[৩৬][৩৭] বৌদ্ধধর্মের কারণে সংস্কৃত পূর্ব এশিয়াতেও পরিচিতি লাভ করে।
সংস্কৃত ভাষার সাহিত্যকে বিস্তৃতভাবে বৈদিক সংস্কৃত এবং পরবর্তী ধ্রুপদী সংস্কৃতে রচিত গ্রন্থে ভাগ করা যায়।[৪০] বৈদিক সংস্কৃত হল বৈদিক ধর্মের ব্যাপক লিটারজিকাল কাজের ভাষা, [খ] যা চারটি বেদ ছাড়াও ব্রাহ্মণ এবং সূত্র অন্তর্ভুক্ত করে।[৪২][৪৩][৪৪]
যে বৈদিক সাহিত্য টিকে আছে তা সম্পূর্ণরূপে একটি ধর্মীয় রূপ, যেখানে ধ্রুপদী সংস্কৃতের রচনাগুলি মহাকাব্য, গীতিকার, নাটক, রোমান্স, রূপকথা, উপকথা, ব্যাকরণ, নাগরিক ও ধর্মীয় আইন, রাজনীতির বিজ্ঞান এবং ব্যবহারিক সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদ্যমান। জীবন, প্রেম এবং যৌনতার বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষশাস্ত্র এবং গণিত এবং বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে মূলত ধর্মনিরপেক্ষ।[৪৫][৪৬]
যদিও বৈদিক সাহিত্য মূলত আত্মায় আশাবাদী, যেখানে মানুষকে এখানে এবং পরকালের উভয় ক্ষেত্রেই পরিপূর্ণতা খুঁজে পেতে শক্তিশালী এবং ক্ষমতাবান হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে, পরবর্তী সাহিত্যগুলি হতাশাবাদী, মানুষকে ভাগ্যের শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হিসাবে জাগতিক সুখ-দুঃখের কারণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। মনোবিজ্ঞানের এই মৌলিক পার্থক্যগুলি বৈদিক যুগে কর্ম এবং পুনর্জন্মের মতবাদের অনুপস্থিতির জন্য দায়ী করা হয়, ধারণাগুলি পরবর্তী সময়ে খুব প্রচলিত।[৪৭]
সংস্কৃত সাহিত্য সূচিত হয় বেদ রচনার মাধ্যমে। পরবর্তী কালে লৌহযুগীয় ভারতে রচিত সংস্কৃত মহাকাব্য ও ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্যের সুবর্ণযুগ থেকে আদি মধ্যযুগ (মোটামুটি খ্রিষ্টীয় তৃতীয় থেকে অষ্টম শতাব্দী) পর্যন্ত চরম উৎকর্ষ লাভ করে। ১১০০ খ্রিষ্টাব্দে অবক্ষয় যুগ শুরু হওয়ার পূর্বেও একাদশ শতকে এই সাহিত্য আর একবার বিকশিত হয়ে ওঠে। বর্তমান কালে সংস্কৃত পুনরুদ্ধারের যে চেষ্টা চলছে তার অঙ্গ হিসেবে ২০০২ সাল থেকে সর্বভারতীয় সংস্কৃত উৎসব চালু হয়েছে। এই উৎসবের লক্ষ্য সংস্কৃত সাহিত্যকে উৎসাহ দান করা।
হিন্দুধর্মের প্রধান গ্রন্থগুলি সবই সংস্কৃতে লেখা। ভারতের আধুনিক ভাষাগুলিও হয় সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন অথবা সংস্কৃত দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। এই কারণে ভারতীয় সংস্কৃতিতেও সংস্কৃত সাহিত্যের প্রভাব অত্যন্ত গভীর।
Sanskrit Documents Collection: Documents in ITX format of Upanishads, Stotras etc, and a metasite with links to translations, dictionaries, tutorials, tools and other Sanskrit resources.