Category: বাংলা ভাষা ও সাহিত্য

Bengali language and literature

  • বাংলা ব্যাকরণ

    এই নিবন্ধের যাচাইযোগ্যতার জন্য অতিরিক্ত তথ্যসূত্র প্রয়োজন। অনুগ্রহ করে নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র সংযোজন করে নিবন্ধটির মান উন্নয়নে সহায়তা করুন। তথ্যসূত্রবিহীন বিষয়বস্তুসমূহ পরিবর্তন কিংবা অপসারণ করা হতে পারে।
    উৎস খুঁজুন: “বাংলা ব্যাকরণ” – সংবাদ · সংবাদপত্র · বই · স্কলার · জেস্টোর(মার্চ ২০২১)

    কাশ্মীরে প্রাপ্ত বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ধর্মকীর্তি কর্তৃক ১৬৬৩ সালে প্রতিলিপিকৃত পাণিনির সংস্কৃত ব্যাকরণ গ্রন্থের উপর ভিত্তি করে বার্চ গাছের ছালে লিখিত পাণ্ডুলিপি।

    বাংলা ব্যাকরণ বাংলা ভাষার রূপমূলতত্ত্ববাক্যতত্ত্বের আলোচনা। বাংলা একটি দক্ষিণ এশীয় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা

    ইতিহাস

    এই নিবন্ধটিতে কোনো উৎস বা তথ্যসূত্র উদ্ধৃত করা হয়নি। দয়া করে নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে তথ্যসূত্র প্রদান করে এই নিবন্ধটির মানোন্নয়নে সাহায্য করুন। তথ্যসূত্রবিহীন বিষয়বস্তুসমূহ পরিবর্তন করা হতে পারে এবং অপসারণ করাও হতে পারে।উৎস খুঁজুন: “বাংলা ব্যাকরণ” – সংবাদ · সংবাদপত্র · বই · স্কলার · জেস্টোর

    প্রাচীন ও মধ্যযুগে বঙ্গদেশে প্রধানত সংস্কৃত ব্যাকরণেরই চর্চা হয়েছে; খুব সামান্য হয়েছে প্রাকৃত ব্যাকরণের চর্চা। এখানে পাণিনির (আনু. খ্রি.পূ পঞ্চম শতক) অষ্টাধ্যায়ীর সূত্রের সংক্ষিপ্ত রূপান্তরই বেশি জনপ্রিয় ছিল। বাংলাদেশে অষ্টাধ্যায়ীর রূপান্তরগুলির মধ্যে কাতন্ত্র (=ক্ষুদ্র তন্ত্র বা গ্রন্থ), বোপদেবের মুগ্ধবোধব্যাকরণ (মুগ্ধবোধ= মুগ্ধ অর্থাৎ মূঢ় বা অল্পজ্ঞদের বোধের নিমিত্ত রচিত ব্যাকরণ) এবং ক্রমদীশ্বরের (১৩শ শতক) সংক্ষিপ্তসার ও মহারাজ জুমরনন্দীকৃত (১৪শ শতক) এর বৃত্তি রসবতী বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল। প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাঙালির ব্যাকরণ চর্চা বলতে মোটামুটি এ ধরনের টীকাভাষ্য রচনাই বোঝায়। আর এগুলি রচনার কাজ সপ্তম শতকের দিকে শুরু হয়ে আধুনিক কালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ব্যাকরণকৌমুদী (১৮৫৩), চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কারের কাতন্ত্রছন্দঃপ্রক্রিয়া (১৮৯৬) প্রভৃতির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ও প্রায়-অবসিত হয়েছে।[১]

    বাংলা ভাষার ব্যাকরণ প্রথম রচনা করেন ইউরোপীয় পণ্ডিতরা। শুধু বাংলা ভাষার ব্যাকরণই নয়, নব্যভারতীয় প্রাদেশিক ভাষাগুলির অধিকাংশেরই ব্যাকরণ রচনার সূত্রপাত তাদের হাতে। বিদেশীরা নানা প্রয়োজনে ভারতবর্ষের আঞ্চলিক ভাষাসমূহ শিখতে ও সহগামীদের শেখাতে বাধ্য হয়েছিল। ফলে তাদের প্রয়োজনই বাংলাসহ অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষার ব্যাকরণ রচনায় তাদেরকে উৎসাহিত করেছিল। আর এরকম প্রয়োজনের তাগিদেই পর্তুগিজ ধর্মযাজক মানোএল দা আস্‌সুম্পসাঁউ (Manoel da Assumpcam) পর্তুগিজ ভাষায় প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন।[২]

    মনোএল ভাওয়ালের একটি গির্জায় ধর্মযাজকের দায়িত্ব পালনকালে ১৭৩৪-৪২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে Vocabolario em idioma Bengalla, e Potuguez dividido em duas partes শীর্ষক গ্রন্থটি রচনা করেন। গ্রন্থটি দুটি অংশে বিভক্ত: প্রথম অংশ বাংলা ব্যাকরণের একটি সংক্ষিপ্তসার এবং দ্বিতীয় অংশ বাংলা-পর্তুগিজ ও পর্তুগিজ-বাংলা শব্দাভিধান। গ্রন্থটি পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে রোমান হরফে মুদ্রিত হয়।[৩][৪] এর কাঠামোগত আদর্শ গৃহীত হয়েছে লাতিন ব্যাকরণ থেকে, তাই এতে বর্ণিত হয়েছে লাতিন ভাষার ধাঁচে। আর এতে শুধু রূপতত্ত্ববাক্যতত্ত্বই আলোচিত হয়েছে, ধ্বনিতত্ত্ব সম্পর্কে কোনো আলোচনা নেই।

    বাংলা ভাষার দ্বিতীয় ব্যাকরণ রচয়িতা ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড কর্তৃক ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ পুস্তকের স্ক্যান করা প্রচ্ছদ

    বাংলা ভাষার দ্বিতীয় ব্যাকরণ রচয়িতা  ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড । তার আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রকাশিত হয় ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে।[৩] হ্যালহেড ভাল সংস্কৃত জানতেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন, বাংলা ভাষার উদ্ভব সংস্কৃত থেকে। তাই তার ব্যাকরণে সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রভাব লক্ষণীয়। হ্যালহেডের ব্যাকরণের বিষয়বিন্যাস সেকালের ইংরেজি ব্যাকরণের অনুরূপ হলেও মাঝে মাঝে তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণের মূল সূত্রগুলিও ব্যাখ্যা করেছেন। মনোএল যেমন বাংলা ভাষাকে লাতিন ব্যাকরণের ছাঁচে ফেলে তার গ্রন্থ প্রণয়নের চেষ্টা করেছেন, হ্যালহেড তেমনি অনেকাংশেই বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের ছাঁচে ফেলে বিশ্লেষণ করেছেন। একারণে অনেক ক্ষেত্রেই তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণের পারিভাষিক শব্দকে বাংলা ব্যাকরণের পারিভাষিক শব্দ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন।

    হ্যালহেডের ব্যাকরণ সম্পূর্ণ ইংরেজিতে রচিত হলেও এতেই প্রথম বাংলা হরফ মুদ্রিত হয়, এ কারণে বাংলা মুদ্রণ শিল্পের ইতিহাসে গ্রন্থটি মূল্যবান। চার্লস উইলকিনসন এবং পঞ্চানন কর্মকার যৌথ প্রচেষ্টায় ছাপাখানার জন্য যে বাংলা হরফ (font) প্রবর্তন করেন, তার সাহায্যেই হ্যালহেডের গ্রন্থে বাংলা উদাহরণগুলি মুদ্রিত হয়েছে। এমনকি বেশ কিছু দীর্ঘ কবিতার উদাহরণও বাংলা হরফে মুদ্রিত হয়েছে।

    আঠারো শতকে রচিত বাংলা ব্যাকরণের এ দুটি নমুনা ছাড়া আর কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি। উনিশ শতকে অবশ্য বাংলা ব্যাকরণ রচনার প্রাচুর্য লক্ষ করা যায়। এ শতকের প্রথমার্ধে রচিত বাংলা ব্যাকরণগুলি দুটি ধারায় বিভক্ত। প্রথম ধারার গ্রন্থগুলি বিদেশীদের (ব্যতীত) দ্বারা ইংরেজি ভাষায় রচিত। এগুলির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিদেশীদের বাংলা ভাষা শেখানো। (১৭৬১-১৮৩৪), হটন, ইয়েটস ও ওয়েঙ্গার এই ধারার ব্যাকরণবিদদের মধ্যে প্রধান। দ্বিতীয় ধারার রচয়িতারা ছিলেন প্রধানত বাঙালি এবং তাদের রচনার ভাষা বাংলা। এ ধারার পাঠক শ্রেণী ছিল এদেশের পাঠশালা ও ইংরেজি স্কুলগুলির ছাত্রছাত্রীরা। প্রায় সব ক্ষেত্রেই এ ধরনের ব্যাকরণের লেখক ছিলেন টোল বা চতুষ্পাঠীর সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতগণ; ফলে তারা বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত ব্যাকরণের আদর্শে বিচার করে এক ধরনের প্রেসক্রিপটিভ ব্যাকরণ রচনা করেন। রামমোহন রায় এই দুই ধারার ব্যাকরণ রচয়িতাদের মধ্যে ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী। তিনি বিদেশী বা টোল-চতুষ্পাঠীর পণ্ডিতদের মতো বাংলা-সংস্কৃতের সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে বাংলা ভাষার নিজস্ব উপাদান ও স্বাতন্ত্র্যের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।

    উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রথমার্ধের দুটি ধারারই সম্প্রসারণ ঘটে। কিছু কিছু ব্যাকরণে (শ্যামাচরণ সরকার, ডানকান ফোর্বস, জন বীম্স্ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য) বাংলার সংস্কৃত-ঘনিষ্ঠ শিষ্ট রূপটির পাশাপাশি কথ্য রূপের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ সময়েই দেশী-বিদেশী ভাষাবিজ্ঞানীদের (বীম্স্, হর্নলে, রামকৃষ্ণ গোপাল ভান্ডারকর) উদ্যোগে তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ব্যাকরণের গোড়াপত্তন হয়। তাছাড়া সৃষ্টিশীল সাহিত্যিকদের ( শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায়, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ) ভাষাবিষয়ক রচনার মাধ্যমে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা ভাষার স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষিত হয়েছে।

    উনিশ শতকের প্রথমেই রচিত হয় উইলিয়ম কেরীর বাংলা ব্যাকরণ A Grammar of the Bengali Language (১৮০১)। হ্যালহেডের ব্যাকরণের অনুকরণে কেরীর গ্রন্থটি প্রণীত, তবে হ্যালহেড যেসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করেননি, যেমন বিশেষ্য, ক্রিয়াপদ বা পার্টিকেল ব্যবহারের ক্ষেত্র, কেরী তার রচনায় ওই সব ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।

    হেলিবেরির তৎকালীন ইস্ট-ইন্ডিয়া কলেজের সংস্কৃত ও বাংলার অধ্যাপক জি.সি হটন (Graves Chamney Haughton: ১৭৮৮-১৮৪৯) লন্ডন থেকে ১৮২১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশ করেন Rudiments of Bengali Grammar। মূলত হেলিবেরি কলেজের বাংলা ভাষার শিক্ষার্থীদের জন্য হটন তার ব্যাকরণটি রচনা করেছিলেন। বাংলাদেশে দেশি-বিদেশী বৈয়াকরণেরা যে ধরনের ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন, সেগুলির বিষয়বস্ত্তকেই কিঞ্চিৎ পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে হটন তার ব্যাকরণটি রচনা করেন।

    যথার্থ ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন রেভারেন্ড ডব্লিউ ইয়েটস (Rev. W Yates: ১৭৯২-১৮৪৫)। তার ব্যাকরণটির নাম Introduction to the Bengali Language (১৮৪৭)। ইয়েটসের ব্যাকরণ দুটি খণ্ডে পরিকল্পিত: প্রথম খণ্ডে আলোচিত হয়েছে বাংলা ব্যাকরণ এবং দ্বিতীয় খণ্ডে সংকলিত হয়েছে বাঙালি কবিদের কবিতা ও সাময়িক সাহিত্যের অংশবিশেষ। ইয়েটস তার ব্যাকরণের বিষয় বিন্যাসে প্রায় সম্পূর্ণই নির্ভর করেছেন কেরীর ব্যাকরণের ওপর; তবে বাংলা ভাষার শুদ্ধতার ব্যাপারে তিনি কেরীর চেয়ে অনেক বেশি রক্ষণশীলতার পরিচয় দিয়েছেন।

    রেভারেন্ড জে  কীথ (Rev. J  Keith) রচিত A Grammar of the Bengalee Language গ্রন্থে ছাত্র-শিক্ষকদের ব্যাকরণ সম্পর্কিত সাধারণ বিষয়গুলি প্রশ্নোত্তর আকারে সন্নিবেশিত হয়েছে। প্রশ্নগুলি উত্তরের দিক থেকে রচিত হওয়ায় খুব একটা কৌতূহলোদ্দীপক নয়। দ্বিতীয়ত উত্তরগুলি আকারে সংক্ষিপ্ত, ফলে ব্যাকরণের খুঁটিনাটি বিষয়গুলি এতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

    রামমোহন রায়ের ইংরেজিতে রচিত ব্যাকরণ গ্রন্থ Bengali Grammar in the English Language প্রকাশিত হয় ১৮২৬ সালে, কলকাতার ইউনিটারিয়েন প্রেস থেকে। রামমোহন কেরী বা হটনের মতো সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলার সম্পর্ককে বড় করে দেখেননি। তিনি বাংলা ভাষার একটি মূল প্রবণতা লক্ষ্য করেছিলেন। তাই তিনিই প্রথম ব্যাকরণের বিভিন্ন প্রকরণ (বিশেষ্য, বিশেষণ, কারক ইত্যাদি) সম্পর্কে শুধু দৃষ্টান্ত নয়, খানিকটা তাত্ত্বিক আলোচনাও পাঠকের জন্য প্রয়োজনীয় বলে বিবেচনা করেছেন। রামমোহন তার আলোচনায় কোথাও সর্বজনবিদিত সংস্কৃত ব্যাকরণের সংজ্ঞার্থ ও পরিভাষা ব্যবহার করেছেন, আবার কোথাও বাংলা ভাষার প্রকৃতির প্রয়োজনে নতুন সংজ্ঞার্থ ও পরিভাষা রচনা করেছেন। ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে তিনি তার গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে যে আলোচনা করেছেন, কালের দিক থেকে তা ছিল সম্পূর্ণ বিপ্লবাত্মক। তিনি ব্যাকরণকে কোনো ঔচিত্যমূলক শাস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করেননি, বরং ব্যাকরণকে তিনি দেখেছেন ভাষার বিশ্লেষণ বা বর্ণনামূলক শাস্ত্র হিসেবে। পদ ও পদের বিভাজন, সন্ধি, সমাস, বিশেষত case ও case-এর শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে রামমোহনের ধারণা সমকালের সকল ব্যাকরণবিদদের ধারণার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন, অভিনব ও বাংলা ভাষার মূল প্রবণতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

    আসসুম্পসাঁউ থেকে হটন, বিদেশীদের রচিত এসকল ব্যাকরণের মাধ্যমেই বাংলা ব্যাকরণ ক্রমশ নিজস্বরূপ লাভ করছিল। তবে এর সঙ্গে যুক্ত হয় আরও কয়েকটি সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এ দেশে বেশ কিছু সংখ্যক ইংরেজি-বাংলা বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য পাঠ্য ব্যাকরণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এতকাল বাংলা ব্যাকরণ রচিত হয়েছিল মূলত বিদেশীদের বাংলা ভাষা শিক্ষাদানের কথা বিবেচনা করে। এবার এই নতুন প্রয়োজন মেটাবার জন্য পাঠ্য ব্যাকরণ রচিত হতে শুরু করে। কিন্তু এগুলি মূলত হয়ে ওঠে সংস্কৃত ব্যাকরণের বাংলা রূপান্তর। বিদেশীরা বাংলা ভাষার নিজস্ব প্রকৃতি যতটুকু বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন বা রামমোহন যেভাবে বাংলা ভাষার মূল প্রকৃতিকে শনাক্ত করতে চেয়েছিলেন, স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণগুলিতে তার সবকিছুই বর্জিত হয় এবং বহুদিন পর্যন্ত সেগুলিতে সংস্কৃতের প্রভাব রক্ষিত হয়। এর প্রধান কারণ তখন বিদ্যালয়ের প্রায় সকল শিক্ষকই ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত। তাছাড়া তখন স্কুল সোসাইটির অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন, যিনি বিশ্বাস করতেন সংস্কৃতজ্ঞান ছাড়া বাংলা ভাষার শুদ্ধ লিখন, পঠন ও কথন সম্ভব নয়। ফলে বাংলা ব্যাকরণের মূল প্রবণতা সংস্কৃত ব্যাকরণের সূত্রে আবদ্ধ হয়ে যায়।

    বাঙালি কর্তৃক বাংলা ভাষায় ব্যাকরণ রচনার প্রথম প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয় রাধাকান্ত দেবের বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থে (দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৮২১)। এটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ নয়, অন্যান্য শিক্ষণীয় বিষয়ের সঙ্গে বাংলা বর্ণমালা, বর্ণের উচ্চারণ স্থান ও সংখ্যা, শব্দ, সন্ধি ইত্যাদি বিষয় সংক্ষিপ্তভাবে সংস্কৃত ব্যাকরণের রীতি অনুযায়ী এতে বিবৃত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মগুলিই যথাসম্ভব সংক্ষিপ্তভাবে পুনর্বিন্যস্ত করে বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থে লেখক উপস্থাপন করেছেন। বাংলা ভাষায় বাঙালির লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ রামমোহনের। স্কুল সোসাইটির অনুরোধে ১৮৩০ সালে তিনি এটি রচনা করেন, যা ১৮৩৩ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।[৫] এতে তিনি কোনো নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেননি বটে, তবে ব্যাকরণের পরিভাষা নির্মাণের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত পূর্ণতার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলা ব্যাকরণ রচনায় রামমোহনের মৌলিকত্ব এবং ভাষার প্রকৃতি বিচারে তার বিশ্লেষণ ক্ষমতা অত্যন্ত সঙ্গত ও যথাযথ। কিন্তু পরবর্তীকালের ব্যাকরণ রচয়িতারা তাকে অনুসরণ না করে বরং সংস্কৃতমুখী বাংলা ব্যাকরণ রচনার প্রতি অধিক মনোযোগী হয়েছেন।

    গৌড়ীয় ব্যাকরণ প্রকাশের পর উনিশ শতকের তিরিশের দশকে বাঙালির লেখা আরও কয়েকটি বাংলা ব্যাকরণ প্রকাশিত হয়েছিল। সেসবের মধ্যে গোপালচন্দ্র চূড়ামণির ব্যাকরণ সংগ্রহ (১৮৩৬), তারকনাথ রায়ের ব্যাকরণ সার (প্রকাশকাল অনুল্লিখিত) এবং পূর্ণচন্দ্র দে’র ব্যাকরণ (১৮৩৯) উল্লেখযোগ্য।[৫]

    উনিশ শতকের চল্লিশের দশকে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বাংলা ব্যাকরণ রচিত হয়েছিল। সেগুলির মধ্যে ভগবচ্চন্দ্র বিশারদের সাধু ভাষার ব্যাকরণসার সংগ্রহ (১৮৪০), ব্রজকিশোর গুপ্তের বঙ্গভাষা ব্যাকরণ (১৮৪০), রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের শিশুসেবধি (১৮৪০), ক্ষেত্রমোহন দত্তের গৌড়ীয় ব্যাকরণ (১৮৪১) এবং জন রবিনসনের বঙ্গ ভাষার ব্যাকরণ ও ধাতু সংগ্রহ (১৮৪৬) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভগবচ্চন্দ্রের ব্যাকরণ সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুকরণে রচিত এবং তার ভাষাও সংস্কৃত মিশ্রিত জটিল বাংলা। ব্রজকিশোর গুপ্তের ব্যাকরণও সংস্কৃত ব্যাকরণের ছায়ামাত্র। ক্ষেত্রমোহনের ব্যাকরণ রামমোহন রায়ের গৌড়ীয় ব্যাকরণের পুনর্লিখন। আর রবিনসনের ব্যাকরণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উইলিয়ম কেরীর A Grammar of the Bengali Language-এর বাংলা অনুবাদ।

    উনিশ শতকের প্রথমার্ধের মতো দ্বিতীয়ার্ধেও ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলা ব্যাকরণ রচিত হয়েছে। ইংরেজিতে শ্যামাচরণ সরকার (১৮১৪-৮২) রচিত Introduction to the Bengalee Language (১৮৫০) বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাকরণটির একটি বাংলা সংস্করণও (বাঙ্গালা ব্যাকরণ) প্রকাশিত হয়েছে ১৮৫২ সালে। এ গ্রন্থটির বিশেষত্ব হচ্ছে, এতে রামমোহনের অনুকরণে বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত আদর্শের পরিবর্তে তার স্বরূপে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যা সমকালীন অন্য কেউ করেননি। তাছাড়া শ্যামাচরণই প্রথম বাংলা ভাষার শিষ্টরূপের পাশাপাশি লৌকিক কথ্যরূপেরও পরিচয় দিয়েছেন এবং বাংলা ভাষায় দেশজ ও বিদেশী (আরবি, ফারসিইত্যাদি) শব্দের প্রয়োজনীয়তা ও তাৎপর্য নির্দেশ করেছেন।

    ডানকান ফোর্বস (Duncan Forbes: ১৭৯৮-১৮৬৮) রচিত A Grammar of the Bengali Language to which added a selection of easy phrases and useful dialogues প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালের জুলাই মাসে। গ্রন্থটিতে তিনি হটনের অনুসরণে ব্যাকরণের প্রতিষ্ঠিত পুরাতন সূত্রগুলিকেই ছাত্রদের উপযোগী করে পুনর্বিন্যাস করেছেন। বিভাষী ছাত্রদের কথা বিবেচনা করে আরেকজন বিদেশী জি.এফ নিকল (GF Nicholl) রচনা করেন Manual of the Bengali Language, Comprising a Bengali Grammar and Lessons, with various appendices including an Assamese Grammar (১৮৮৫)।

    জন বীম্স (১৮৩৭-১৯০২) ছিলেন প্রধানত একজন ভাষাতাত্ত্বিক। তাই বর্ণনামূলক ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে রচিত তার The Oxford Oriental Series Grammar of the Bengali Language Literary and Colloquial (১৮৯১, ১৮৯৪) গ্রন্থে সমকালীন বাংলা ভাষার রূপ বিশ্লেষিত হয়েছে। যেহেতু বিদেশীদের কথ্য বাংলা শেখানোই ছিল ব্যাকরণটির প্রধান উদ্দেশ্য, সেহেতু কথ্য বাংলার রূপ ও ভাষাতাত্ত্বিক পরিচয় প্রদানের ব্যাপারেই বীম্সের প্রধান আগ্রহ লক্ষ করা যায়।

    উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, প্রথমার্ধের মতোই বাংলা ভাষায় বেশ কিছু স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণ রচিত হয়, যদিও সেগুলির স্বতন্ত্র কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল না। দুএকজন ব্যাকরণবিদ প্রচলিত রীতি ভঙ্গ করে গদ্যের পরিবর্তে পদ্যে (নন্দকুমার রায়, ব্যাকরণ দর্পণ, ১৮৫২) এবং প্রশ্নোত্তরের ভঙ্গিতে (রাজেন্দ্রলাল মিত্র, ব্যাকরণ প্রবেশ, ১৮৬২) ব্যাকরণ রচনা করেন।

    উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে অর্ধশতাধিক উল্লেখযোগ্য ব্যাকরণগ্রন্থ রচিত হয়েছে। রচয়িতাদের মধ্যে একজন ছিলেন বিদেশী (, ধাতুমালা, ১৮৫৭), বাকিরা বাঙালি। বাঙালিদের মধ্যে আবার অধিকাংশই ছিলেন কলকাতার। কলকাতার বাইরে শ্রীরামপুর, কৃষ্ণনগর, হুগলি, শান্তিপুর, ঢাকা, বরিশাল, ময়মনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চলের পণ্ডিতরাও ছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন শ্যামাচরণ সরকার (বাঙ্গালা ব্যাকরণ, ১৮৫২), নন্দকুমার রায় (ব্যাকরণ দর্শন, ১৮৫২), রাজেন্দ্রলাল মিত্র (ব্যাকরণ প্রবেশ, ১৮৬২), কৃষ্ণকিশোর বন্দ্যোপাধ্যায় (সরল ব্যাকরণ, ১৮৭৭), হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (বাঙ্গালা ব্যাকরণ, ১৮৮২) প্রমুখ।

    উনিশ শতকের মধ্যভাগে স্কুলপাঠ্য হিসেবে যেসব বাংলা ব্যাকরণ রচিত হয়, সেসবের অধিকাংশই ছিল সংস্কৃত ব্যাকরণের বঙ্গানুবাদ; বাংলা ভাষার স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য সেগুলিতে বিশ্লেষিত হয়নি। কিন্তু বীমস্, হর্নলে বা ভান্ডারকর এ সময়ে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব চর্চার যে সূত্রপাত করেন, তাতে বেশ কিছু ব্যাকরণবিদ নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলা ব্যাকরণ রচনার তাগিদ অনুভব করেন। তাদের মধ্যে চিন্তামণি গঙ্গোপাধ্যায় (বাঙ্গালা ব্যাকরণ, ১৮৮১), নকুলেশ্বর বিদ্যাভূষণ (ভাষাবোধ বাঙ্গালা ব্যাকরণ, ১৮৯৮) ও হূষিকেশ শাস্ত্রী (বাঙ্গালা ব্যাকরণ, ১৯০০) রচিত ব্যাকরণ উল্লেখযোগ্য। এঁরা বাংলা ব্যাকরণ রচনায় সম্পূর্ণরূপে সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রভাবমুক্ত ছিলেন না বটে, কিন্তু সংস্কৃত ব্যাকরণের বিষয়গুলি প্রথমে আলোচনা করে পরে বাংলা ভাষার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলি তাতে যুক্ত করেন।

    বাংলা ব্যাকরণ রচনার ক্ষেত্রে উনিশ শতকের তুলনায় বিশ শতক বহুমাত্রায় বৈচিত্র্যপূর্ণ। উনিশ শতকে এ বিষয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলেও কোন অনুসরণীয় আদর্শ তৈরি করা সম্ভব হয়নি। বিশ শতকে ভাষার আদর্শের মতো ব্যাকরণ রচনারও একটি আদর্শ রূপ ও পদ্ধতির অনুসন্ধানে বেশ কিছু প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে। সেগুলির মধ্যে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ এবং বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলা ভাষা চর্চায় পরিষদের নিরন্তর উৎসাহ প্রদান এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর পাঠ্য তালিকায় বাংলা ব্যাকরণ অন্তর্ভুক্তকরণের ফলে বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া গ্রিয়ারসনের The Linguistic Survey of India-য় বাংলা ভাষার স্বরূপ ও প্রকৃতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সন্নিবেশিত হওয়ায় এবং নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় (১৯১৩) বাংলা ভাষা বিদেশেও পরিচিতি লাভ করে। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগভাষা আন্দোলন (১৯৪৮-৫২) এবং সেই প্রেরণায় বাংলা একাডেমীর প্রতিষ্ঠা (১৯৫৫) বাংলা ভাষা চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি (১৯৮৫) বাংলা ভাষা চর্চায় যে গুরুত্ব দিয়েছে তার প্রভাব বাংলা ব্যাকরণ চর্চার ক্ষেত্রেও পড়েছে। এ শতকে একাডেমিক ব্যাকরণ রচনার চেষ্টা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় এবং ব্যাকরণ প্রণয়নে ভাষা বিজ্ঞানের কলাকৌশলও প্রয়োগ করা হয়।

    বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের একটি সভায় (১৯০১) পঠিত ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ প্রবন্ধে সমগ্র উনিশ শতকের ব্যাকরণকে মূলত দুই ধরনের ‘প্যাটেন্টে’ চিহ্নিত করেছিলেন: মুগ্ধবোধ প্যাটেন্ট এবং হাইলি-প্যাটেন্ট। প্রথম ধরনের লেখকরা ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত, আর দ্বিতীয় ধরনের লেখকরা ছিলেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক। এছাড়া তৃতীয় এক ধরনের প্যাটেন্ট ব্যাকরণের কথাও তিনি বলেছিলেন, যাতে এই দুই ধরনের রচনার মিশ্রণ ঘটেছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী উক্ত প্রবন্ধে বাংলা ভাষার প্যাটেন্ট ব্যাকরণ রচনার পরিবর্তে প্রকৃত বাংলা ব্যাকরণ রচনার পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। তার নির্দেশনাকে যথার্থ অর্থে কর্মে প্রয়োগ করেছেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

    রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বাংলা ব্যাকরণ বিষয়ে কোনো সম্পূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেননি, তবে তার শব্দকথা (১৩২৪) গ্রন্থে সংকলিত প্রবন্ধগুলিতে বাংলা ব্যাকরণ রচনা ও তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাকরণ সম্পর্কে তার রচিত প্রবন্ধগুলির মধ্যে রয়েছে ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ (১৩০৮), ‘বাঙ্গালা কৃৎ ও তদ্ধিত’ (১৩০৮), ‘কারক প্রকরণ’ (১৩১২), ‘না’ (১৩১২) ও ‘ধ্বনিবিচার’ (১৩১৪)। ব্যাকরণ রচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনিই প্রথম বলেন, ব্যাকরণশাস্ত্রের উদ্দেশ্য ভাষার মধ্যকার প্রচ্ছন্ন নিয়ম-শৃঙ্খলাগুলি আবিষ্কার করা, ভাষাকে শুদ্ধরূপে লিখতে, বলতে বা পড়তে শেখানো নয়।

    বাংলা শব্দতত্ত্ব সম্পর্কে তরুণ বয়স থেকেই যে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তার শব্দতত্ত্ব (১৩৪২) গ্রন্থে সংকলিত ভাষাবিষয়ক প্রবন্ধগুলিতে। আর বাংলা ভাষা সম্পর্কে তার ধারণার পরিচয় পাওয়া যায় তার বাংলাভাষা পরিচয় (১৯৩৮) গ্রন্থে। এতে তিনি বাংলা ভাষার চলিত রূপের পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কারণ তার কাছে ভাষা হচ্ছে সচল সমাজমনের নিত্য প্রবহমান অভিব্যক্তি; আর এই অভিব্যক্তি সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ে চলিত ভাষায়। চলিত বাংলা রূপের পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি একাধিকবার বলেছেন, বাংলা হচ্ছে ভঙ্গিপ্রধান ভাষা এবং এই ভঙ্গির পরিচয়ই তিনি ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্ব এই তিন দিক থেকে উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছেন।

    উনিশ শতকের শেষে এবং বিশ শতকের শুরুতে বাংলা ব্যাকরণের রূপ ও প্রকৃতি নিয়ে যে তর্ক জমে ওঠে, ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৬৮-১৯২৯) তার মধ্যে একটি সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করেন। তার ‘ব্যাকরণ বিভীষিকা’ (১৯১১), ‘সাধুভাষা বনাম চলিত ভাষা’ (১৯১৩), ‘বানান-সমস্যা’ (১৯১৩), ‘অনুপ্রাস’ (১৯১৩), ‘ক-কারের অহংকার’ (১৯১৫) প্রভৃতি রচনা তার ওই চেতনারই বহিঃপ্রকাশ।

    বিশ শতকের শুরু থেকেই বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ চর্চার আরেকটি প্রবণতা পরিস্ফুট হতে থাকে, যার সঙ্গে আধুনিক ইউরোপীয় ভাষাচর্চার সম্পর্ক অত্যন্ত স্পষ্ট। বর্তমানেও এ ধরনের ব্যাকরণচর্চা চলছে এবং অব্যাহত গতিতে তা এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে দুই বাংলার ভাষা গবেষণায় যে প্রধান ধারাগুলি দেখা যায় সেগুলি হচ্ছে: ১. তুলনামূলক ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান, ২. সাংগঠনিক ও রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ এবং ৩. উপভাষা তত্ত্ব। বিশ শতকের শুরুতেই প্রকাশিত হয় শ্রীনাথ সেনের ভাষাতত্ত্ব (১৯০০) গ্রন্থটি। এটিকেই, নানা অসঙ্গতি ও ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও, বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক ব্যাকরণ রচনার প্রথম নিদর্শন বলে বিবেচনা করা হয়। সমসাময়িককালে ঐতিহাসিক ব্যাকরণ রচনার আরেকটি নিদর্শন হচ্ছে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির (১৮৫৯-১৯৫৬) বাঙ্গালা ভাষা (১৯১২)। শ্রীনাথের তুলনায় যোগেশচন্দ্রের ভাষাতাত্ত্বিক জ্ঞান ও ইতিহাস দৃষ্টি অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন ও সমৃদ্ধ। বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক ব্যাকরণের অপর নিদর্শন হচ্ছে বিজয়চন্দ্র মজুমদারের (১৮৬১-১৯৪২) The History of the Bengali Language (১৯২০)। তিনিই প্রথম ঐতিহাসিকভাবে বাংলা ভাষায় বিদেশী উপাদানগুলি চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। এ গ্রন্থটি প্রকাশের পর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের Journal of the Department of Letters (Vol. III, ১৯২০)-এ ‘Outlines of an Historical Grammar of the Bengali Language’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেন, যা পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক ব্যাকরণ রচনার আদর্শ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।  (১৮৯০-১৯৭৭) রচিত The Origin and Development of the Bengali Language’ ‘(ODBL, ১৯২৬) নামক অদ্বিতীয় গবেষণা গ্রন্থে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বাংলা ভাষার উপাদানগুলো চিহ্নিত ও বিশ্লেষিত হয়েছে। এ গ্রন্থের মাধ্যমে বাঙালির মাতৃভাষা চর্চার যে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে পরবর্তী অনেকের ভাষাচর্চার সৌধ।

    বাংলা ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে বাংলায় প্রথম টেক্সট বই রচনার কৃতিত্ব হেমন্তকুমার সরকারের। তার গ্রন্থের নাম ভাষাতত্ত্ব ও বাংলা ভাষার ইতিহাস (১৯২৩)। তবে টেক্সট বইগুলির মধ্যে সুকুমার সেন রচিত ভাষার ইতিবৃত্ত (১৯৩৯) সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। বাংলা ভাষার ইতিহাস বিষয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ টেক্সট বই হচ্ছে পরেশচন্দ্র মজুমদারের বাঙলা ভাষা পরিক্রমা (১৩৬৩)। ঐতিহাসিক ব্যাকরণের সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ মুহম্মদ শহীদুল্লা বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত। সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানের ধারা ক্রমশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠায় ঐতিহাসিক ব্যাকরণ চর্চার ধারা বর্তমানে ক্ষীণ এবং প্রায় অবসিত হয়ে উঠেছে।

    বাংলা ভাষায় আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে ইংল্যান্ডে তিনি বাংলা নাসিক্য ধ্বনি ও নাসিক্যীভবন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন (A Phonetic and Phonological Study of Nasasl and Nasalization in Bengali, ১৯৬০)। দেশে ফিরে তিনি রচনা করেন ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব (১৯৬৪) গ্রন্থ। এর মাধ্যমেই বাংলা ভাষায় ভাষাতত্ত্ব চর্চার গতি পরিবর্তিত হয়। পরবর্তীকালে ইংল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আধুনিক ভাষাতত্ত্বে শিক্ষাগ্রহণ ও গবেষণা করেন কাজী দীন মুহম্মদ (Verbal piece in colloquial Bengali: A Phonological Study, ১৯৬১), মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (Some suprasegmental phonological features of Bengali, ১৯৫৯),  (The Phonemes of Bengali, ১৯৬১, ফার্গুসনের সঙ্গে যৌথভাবে), আমিনুল ইসলাম (A phonetic study of inter-word relations in Bengali, ১৯৬১), রফিকুল ইসলাম (Bengali Graphemics, ১৯৬০), আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ (A study of Standard Bengali and the Noakhali Dialect, ১৯৭৫), হুমায়ুন আজাদ (Pronominalisation in Bengali, ১৯৭৬) প্রমুখ। এঁদের মধ্যে হুমায়ুন আজাদের বাক্যতত্ত্ব (১৯৮৪) গ্রন্থটি চমস্কি সূচিত ভাষাবিজ্ঞানের ধারণাকে বাংলা ভাষায় সংযোজিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

    পশ্চিমবঙ্গে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের চর্চা শুরু হয় বাংলাদেশে তা সমৃদ্ধি অর্জনের অনেক পরে। সেখানে যাঁরা সাংগঠনিক ব্যাকরণ নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করেছেন তাদের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রনাথ বসু (বাংলা ভাষার আধুনিক তত্ত্ব ও ইতিকথা), সুহাস চট্টোপাধ্যায়, শিশিরকুমার দাশ, দীপঙ্কর দাশগুপ্ত, অনিমেষ কান্তি পাল, মঞ্জুলী ঘোষ, পৃথ্বীশ চক্রবর্তী, সমীর ঘোষ, সুকুমার বিশ্বাস, রামেশ্বর শ্ব’ প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদের মধ্যে প্রবাল দাশগুপ্ত (হালের পশ্চিমী ব্যাকরণতত্ত্ব, ১৯৭৪), পবিত্র সরকার (The Generative Phonological Component of the Grammar of Bengali, ১৯৭৫), উদয়নারায়ণ সিংহ (চর্যাবাক্যব্যবচ্ছেদবিষয়ক প্রস্তাব: ১ ক্রিয়াপদ, গাঙ্গেয়পত্র, ১৯৭৯; নোম চম্‌স্কি: সঞ্জননী ব্যাকরণবিপ্লব, ভাষা, ১৯৮৩), রামেশ্বর শ্ব’ (সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা, ১৯৮৪) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

    বাংলা উপভাষা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত ঘটে আঞ্চলিক শব্দ সংগ্রহ ও তার অভিধান প্রণয়নের মধ্য দিয়ে। এ ক্ষেত্রে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি যে অসীম ধৈর্য ও শ্রমে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান (১৯৬৫) প্রণয়ন করেছেন তা অতুলনীয়। পরবর্তীকালে তাকে অনুসরণ করে প্রকাশিত হয় কামিনীকুমারের লৌকিক শব্দকোষ (১৯৬৮)। এরই অনুষঙ্গে অনেকেই আঞ্চলিক শব্দ ও তার বিবরণ সংগ্রহে এগিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে অনিমেষ কান্তি পাল, মনিরুজ্জামান, রাজীব হুমায়ুন প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিদেশীদের মধ্যে অন্তত দুজনের নাম এখানে উল্লেখ করার মতো যাঁরা বাংলা উপভাষা নিয়ে গবেষণা করেছেন। তারা হলেন জ্যাক এ ড্যাবস (পূর্ববঙ্গ উপভাষা, ১৯৬৫) ও নোরিহিকো উচিদা (চট্টগ্রামী উপভাষা, ১৯৬৯)।

    উপভাষা চর্চার পাশাপাশি সমাজ ভাষাবিজ্ঞান নিয়েও অনেকের আগ্রহ ও মূল্যবান কাজ ইদানীং সুধীমহলে আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। তাদের মধ্যে নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (খুলনা জেলার মাঝির ভাষা, ১৯২৪), সুকুমার সেন (Women’s dialect in Bengali, ১৯২৯; The caste dialects of the Muchis in South-western Burdwan, ১৯৬৫), পৃথ্বীশ চক্রবর্তী (Dialects of Ranakamars of Birbhum, ১৯৬৫), নির্মল দাশ (উত্তরবঙ্গের নারীর ভাষা, ১৯৭০), ভক্তিপ্রসাদ মল্লিক (অপরাধ জগতের ভাষা, ১৯৭২), আফিয়া দিল (Hindu-Muslim Dialects in Bengali, ১৯৭২), পবিত্র সরকার (বাংলা গালাগালির ভাষাতত্ত্ব, ১৯৭২; ভাষা-দেশ-কাল, ১৯৮৫); মনিরুজ্জামান (শিশুর ভাষা, ১৯৭৬), মনসুর মুসা (ভাষা পরিকল্পনার সমাজ ভাষাতত্ত্ব, ১৯৮৫), মৃণাল নাথ (সমাজ ভাষাবিজ্ঞানের রূপরেখা, ১৯৮৯), রাজীব হুমায়ুন (সমাজ ভাষাবিজ্ঞান, ১৯৯৩), সত্রাজিৎ গোস্বামী (বাংলা অকথ্য ভাষা ও শব্দকোষ, ২০০০) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

    উনিশ শতকের মতো বিশ শতকেও বেশ কিছু বাংলা ব্যাকরণ বিভিন্ন বিদেশী ভাষায় রচিত হয়েছে, যেগুলির প্রধান পাঠক বিদেশি-বিভাষী বাংলা শিক্ষার্থী। এগুলি উনিশ শতকে রচিত ব্যাকরণগুলির তুলনায় খুব বেশি নতুনত্বের দাবিদার নয়। তবে এগুলিতে বাংলা ভাষার স্বরূপ ও প্রকৃতি সম্পর্কে পূর্বাপেক্ষা অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাকরণের তুলনায় গ্রন্থগুলি স্বশিখনের সহায়ক গ্রন্থ হয়ে উঠেছে। ইংরেজি, জার্মান, রুশ, জাপানিচেক ভাষায় রচিত এ ধরনের অন্তত ২৫ খানা গ্রন্থের কথা জানা যায়। এগুলির কোনো কোনোটির রচয়িতা বাঙালি, আবার কোনো কোনোটি বাঙালি-অবাঙালির যৌথ রচনা। এ ধরনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো: ইংরেজি Introduction to Bengali: Edward C Dimock, Jr. Somdev Bhattacharji and Suhas Chatterjee, Chicago University, ১৯৫৯; Bengali Language Handbook: Punyaslok Roy, Washington, DC, ১৯৬৬, পুনর্মুদ্রণ পশ্চিমবঙ্গ  বাংলা আকাদেমি, ১৯৯৮;  An Introduction to Colloquial Bengali: Walter Sutton Page, Cambridge, ১৯৩৪; Learn Bengali Yourself: Bidhubhusan Dasgupta, 2nd ed, Calcutta, ১৯৪৮; Colloquial Bengali: Mufazzal Haider Choudhuri, Bangla Academy, Dacca, ১৯৬৩; জর্মন Praktische grammatik der Bengalischen umgangsprache: Biren Banerji, Vienna-leipzig, ১৯২৩; জাপানি Bengarugo nyummon: Tsuyoshi Nara Tokyo, ১৯৭৫; রুশ Uchebnik Danilchuk: D Litton and others, Uchebnik Bengalskogo Yazyka, Moscow, ১৯৫৯; চেক Ucebnico Bengalistiny: Dusan Zbavitel, Prag, ১৯৫৩ ইত্যাদি।

    বিশ শতকে যাঁরা বাংলায় ছাত্রপাঠ্য ব্যাকরণ রচনা করেছেন তাদের অধিকাংশই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বা নতুন কোনো ব্যাকরণিক সত্য আবিষ্কারের পরিবর্তে কেবল প্রচলিত পাঠ্যসূচির নির্দেশ অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে এর বাইরেও কেউ কেউ সমসাময়িক ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনার প্রতি দৃষ্টি রেখে ব্যাকরণ রচনায় উদ্যোগী হয়েছেন। এই শতকের প্রথম থেকে শেষ দশক পর্যন্ত বহু ব্যাকরণগ্রন্থ রচিত হয়েছে। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: ভাষা প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ (সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৯৩৯), ব্যবহারিক বাঙ্গালা ব্যাকরণ (বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৯৪৪), অভিনব ব্যাকরণ (কাজী দীন মুহম্মদ ও সুকুমার সেন, ঢাকা, ১৯৪৮), ব্যাকরণ মঞ্জরী (মুহম্মদ এনামুল হক, রাজশাহী, ১৯৫১), ব্যাকরণ পরিচয় (মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ঢাকা, ১৯৫৩), বাংলা ভাষার ব্যাকরণ (মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীইব্রাহিম খলিল, ঢাকা, ১৯৭২) ইত্যাদি।

    এ শতকের ব্যাকরণগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভাষা প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ। এটি স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণ হলেও মূলত তার ওডিবিএল অনুসরণেই রচিত।    ফলে প্রচলিত ব্যাকরণ কাঠামো ভেঙ্গে সেখানে জায়গা করে নিয়েছে আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি। সুনীতিকুমারই প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রচনার ক্ষেত্রে সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মগুলি নির্বিচারে গ্রহণ না করে ইতিহাস ও উপযোগিতার সূত্রে সেগুলিকে গ্রহণ-বর্জন করেছেন। এ ব্যাকরণে তার উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষার জন্য কোনো নিয়ম প্রতিষ্ঠা ও নিয়ম আরোপ করা নয়, বরং ভাষার অন্তর্নিহিত নিয়ম আবিষ্কার ও তার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা। বাংলা ব্যাকরণ রচনার এই দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় এখনও নতুন নতুন ব্যাকরণগ্রন্থ রচিত হচ্ছে, কিন্তু সেগুলির কোনোটিই নিরঙ্কুশ বাংলা ভাষার ব্যাকরণের মর্যাদা পায়নি; সংস্কৃত ব্যাকরণের প্রভাব এখনও অনেকাংশে রয়ে গেছে।

    উৎপত্তি

    পর্তুগিজ ধর্মযাজক মানুয়েল দা আস্‌সুম্পসাঁউ (Manoel da Assumpcam) বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ রচনা করেন। ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগালের লিসবন শহর থেকে রোমান হরফে মুদ্রিত তার লেখা Vocabolario em idioma Bengalla, e Portuguez dividido em duas partes শীর্ষক গ্রন্থটির প্রথমার্ধে রয়েছে একটি সংক্ষিপ্ত, খন্ডিত ও অপরিকল্পিত বাংলা ব্যাকরণ। এর দ্বিতীয়াংশে রয়েছে বাংলা-পর্তুগিজ ও পর্তুগিজ-বাংলা শব্দাভিধান। মানোএল ভাওয়ালের একটি গির্জায় ধর্মযাজকের দায়িত্ব পালনের সময় নিজের ও ভবিষ্যৎ ধর্মযাজকদের প্রয়োজনে এই ব্যাকরণ রচনা করেন; বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটানো তার লক্ষ্য ছিল না। লাতিন ভাষার ধাঁচে লেখা এই ব্যাকরণটিতে শুধু রূপতত্ত্ববাক্যতত্ত্ব আলোচিত হযেছে, কিন্তু ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে কোনো আলোচনা করা হয় নি। এছাড়া পুরো আঠারো ও উনিশ শতকে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকায় এই গ্রন্থটি বাঙালি ও বাংলা ভাষার কোনো উপকারেও আসেনি তখন।

    বাংলা ভাষার দ্বিতীয় ব্যাকরণটি রচনা করেন ইংরেজ প্রাচ্যবিদ ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড (Nathaniel Brassey Halhed)। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের (Warren Hastings) অনুরোধে তরুণ লেখক হ্যালহেড বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনায় হাত দেন। তার লেখা A Grammar of the Bengal Language গ্রন্থটি ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত হয়। এ ব্যাকরণটি অনেক কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পূর্বের পর্তুগিজ ধর্মযাজকদের মতো নিজ প্রয়োজনে নয়, নিঃস্বার্থ বুদ্ধিজীবী হ্যালহেডের ইচ্ছা ছিল বাংলা ভাষাকে একটি বিকশিত ভাষাতে পরিণত করা।

    বাংলা ব্যকরণের ক্রমবিকাশ

    উনিশ শতকে নিম্ন বর্ণিত ব্যক্তিগণ ইংরেজি ভাষায় বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন ।

    উনিশ শতকে বাংলা ব্যাকরণ যারা বাংলা ভাষাতে রচনা করেন তারা হলেনঃ –

    বিশ শতকে প্রণীত বাংলা ব্যাকরণসমুহের প্রকৃতি-প্রণালীতে পূর্বের শতকের বৈশিষ্ট্য অনুসরণ পরিলক্ষিত হয় । ভাষা-সমালোচকদের কেউ কেউ বাংলা ব্যাকরণ চর্চার ক্ষেত্রে সংস্কৃত ব্যাকরণকেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছেন । পরবর্তী কালে বাংলা ব্যাকরণের আলোচিত বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা উপস্থাপন করেছেন বিশিষ্ট ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তার রচিত ” The Origin and Development of the Bengali Language ” গ্রন্থে বাংলা ভাষার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ আলোচিত হয়েছে ।

    বিশ শতকে উল্লেখযোগ্য কতিপয় ভাষাবিদ যারা বাংলা ব্যাকরণ রচনায় প্রয়াস পান তারা হলেনঃ –

    বাংলা ভাষারীতি

    কথ্য, চলিত ও সাধু রীতি

    বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলের জনগণ নিজ নিজ অঞ্চলের ভাষায় কথা বলে। এগুলো আঞ্চলিক কথ্য ভাষা বা উপভাষা। পৃথিবীর সব ভাষায়ই উপভাষা আছে। এক অঞ্চলের জনগণের মুখের ভাষার সঙ্গে অপর অঞ্চলের জনগণের মুখের ভাষার যথেষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। ফলে এমন হয় যে, এক অঞ্চলের ভাষা অন্য অঞ্চলের লোকের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাধারণের কথ্য ভাষা দিনাজপুর বা রংপুরের লোকের পক্ষে খুব সহজবোধ্য নয়। এ ধরনের আঞ্চলিক ভাষাকে বলার ও লেখার ভাষা হিসেবে সর্বজনীন স্বীকৃতি দেওয়া সুবিধাজনক নয়। কারণ, তাতে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাভাষীদে মধ্যে ভাবের আদান-প্রদানে অন্তরায় দেখা দিতে পারে। সে কারণে, দেশের শিক্ষিত ও পণ্ডিতসমা একটি আদর্শ ভাষা ব্যবহার করেন। বাংলা ভাষাভাষী শিক্ষিত জনগণ ও আদর্শ ভাষাতেই পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা ও ভাবের আদান-প্রদান করে থাকেন। বিভিন্ন অঞ্চলের উপভাষার কথ্য রীতি সমন্বয়ে শিষ্টজনের ব্যবহৃত এই ভাষাই আদর্শ চলিত ভাষা। 

    বাংলা, ইংরেজি, আরবি, হিন্দি প্রভৃতি ভাষার মৌখিক বা কথ্য এবং লৈখিক বা লেখ্য এই দুটি রূপ দেখা যায়। ভাষার মৌখিক রূপের আবার রয়েছে একাধিক রীতি : একটি চলিত কথ্য রীতি অপরটি আঞ্চলিক কথ্য রীতি।  

    বাংলা ভাষার লৈখিক বা লেখ্য রূপেরও রয়েছে দুটি রীতি : একটি চলিত রীতি অপরটি সাধু রীতি।

    সাধু ও চলিত রীতির পার্থক্য

    ১. সাধু রীতি

    • বাংলা লেখ্য সাধু রীতি সুনির্ধারিত ব্যকরণের নিয়ম অনুসরণ করে চলে এবং এর পদবিন্যাস সুনিয়ন্ত্রিত ও সুনির্দিষ্ট। 
    • এ রীতি গুরুগম্ভী ও তৎসম শব্দবহুল।
    • সাধু রীতি নাটকের সংলাপ ও বক্তৃতার অনুপযোগী।
    • এ রীতিতে সর্বনাম ও ক্রিয়াপদ এক বিশেষ গঠন পদ্ধতি মেনে চলে।

    ২. চলিত রীতি 

    • চলিত রীতি পরিবর্তনশীল। একশ বছর আগে যে চলিত রীতি সে যুগের শিষ্ট ও ভদ্রজনের কথিত ভাষা বা মুখের বুলি হিসেবে প্রচলিত ছিল, কালের প্রবাহে বর্তমানে তা অনেকটা পরিবর্তিত রূপ লাভ করেছে।
    • এ রীতি তদ্ভব শব্দবহুল। 
    • চলিত রীতি সংক্ষিপ্ত ও সহজবোধ্য এবং বক্তৃতা, আলাপ-আলোচনা ও নাট্যসংলাপের জন্য বেশি উপযোগী।
    • সাধু রীতিতে ব্যবহৃত সর্বনাম ও ক্রিয়াপদ চলিত রীতিতে পরিবর্তিত ও সহজতর রূপ লাভ করে। বহু বিশেষ্য ও বিশেষণের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটে। 

    ৩. আঞ্চলিক কথ্য রীতি

    সব ভাষারই আঞ্চলিক রূপের বৈচিত্র্য থাকে, বাংলা ভাষারও তা আছে। বিভিন্ন অঞ্চলে কথিত রীতির বিভিন্ন লক্ষিত হয়; আবার কোথাও কোথাও কারো কারো উচ্চারণে বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষার মিশ্রণও লক্ষ্য করা যায়। 

    সাধু ও চলিত রীতির উদাহরণ 

    ক. সাধু রীতি

    পরদিন প্রাতে হেডমাস্টার সাহেবের প্রস্তুত লিস্ট অনুসারে যে তিনজন শিক্ষক সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিবার অনুমতি পাইয়াছিলেন, তাঁহারা আটটায় পূর্বেই ডাক-বাংলায় উপস্থিত হইলেন। একটু পরে আবদুল্লাহ আসিয়া হাজির হইল। তাহাকে দেখিয়া একজন শিক্ষক জিজ্ঞাসা করিলেন- আপনি যে! আপনার নাম তো হেডমাস্টার লিস্টে দেন নাই। – কাজী ইমদাদুল হক[৭]

    খ. চলিত রীতি

    পুল পেরিয়ে সামনে একটা বাঁশ বাগান পড়ল। তারি মধ্য দিয়ে রাস্তা। মচমচ করে শুকনো বাঁশ পাতার রাশ ও বাঁশের খোসা জুতোর নিচে ভেঙে যেতে লাগল। পাশে একটা ফাঁকা জায়গায় বুনো গাছপালা লতা ঝোপের ঘন সমাবেশ। সমস্ত ঝোপটার মাথাজুড়ে সাদা সাদা তুলোর মতো রাধালতার ফুল ফুটে রয়েছে।  -বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় [৮]

    সর্বনাম

    বাংলা সর্বনামগুলির সঙ্গে ইংরাজি সর্বনামগুলির কিছুটা সাদৃশ্য আছে । এখানে প্রথম পুরুষ, দ্বিতীয় পুরুষ এবং তৃতীয় পুরুষের (নাম পুরুষ) ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা শব্দ ব্যবহার হয়। এই রীতি একবচন ও বহুবচন, এই দুইয়ের ক্ষেত্রেও শব্দগুলির ইংরাজি প্রতিরূপগুলির মত লিঙ্গভেদে পার্থক্য হয় না। অর্থাৎ, সে(পুং) বা সে(স্ত্রী) এই দুই ক্ষেত্রে একই সর্বনাম ব্যবহার হয়, কিন্তু নৈকট্যর জন্য, তৃতীয় পুরুষের ব্যবহার বিভিন্ন হয় ।

    আরও দেখুন

    তথ্যসূত্র

  • বাংলা উপসর্গের তালিকা

    এই নিবন্ধটি বাংলা উপসর্গের তালিকা সংক্রান্ত।

    বাংলা ভাষায় তৎসম, খাঁটি বাংলা ও বিদেশি – এই তিন ধরনের উপসর্গ দেখা যায়।

    তৎসম উপসর্গ

    উপসর্গযে অর্থে ব্যবহৃতউদাহরণ
    প্র-প্রকৃষ্ট/ সম্যকপ্রভাব, প্রচলন, প্রস্ফুটিত
    খ্যাতিপ্রসিদ্ধ, প্রতাপ, প্রভাব
    আধিক্যপ্রগাঢ়, প্রচার, প্রবল, প্রসার
    গতিপ্রবেশ, প্রস্থান
    ধারা-পরম্পরা বা অনুগামিতপ্রপৌত্র, প্রশাখা, প্রশিষ্য
    পরা-আতিশয্যপরাকাষ্ঠা, পরাক্রান্ত, পরায়ণ
    বিপরীতপরাজয়, পরাভব
    অপ-বিপরীতঅপমান, অপকার, অপচয়, অপবাদ
    নিকৃষ্টঅপসংস্কৃতি, অপকর্ম, অপসৃষ্টি, অপযশ, অপব্যয়
    স্থানান্তরঅপসারণ, অপহরণ, অপনোদন
    বিকৃতিঅপমৃত্যু
    সম্-সম্যক রূপেম্পূর্ণ, মৃদ্ধ, সমাদর
    সম্মুখেসমাগত, সম্মু
    নি-নিষেধনিবৃত্তি
    নিশ্চয়নিবারণ, নির্ণয়
    আতিশয্যনিদাঘ, নিদারুণ, নিগূঢ়
    অভাবনিষ্কলুষ, নিষ্কাম
    অব-হীনতা, প্রতিকূলঅবজ্ঞা, অবমাননা
    সম্যকভাবেঅবরোধ, অবগাহন, অবগত
    নিম্নে, অধোমুখিতাঅবতরণ, অবরোহণ, অবলম্বন
    অল্পতাঅবশেষে, অবসান, বেলা
    অনু-পশ্চাৎঅনুশোচনা, অনুগামী, অনুজ, অনুচর, অনুতাপ, অনুকরণ
    সাদৃশ্যঅনুবাদ, অনুরূপ, অনুকার
    পৌনঃপুনঅনুক্ষণ, অনুদিন, অনুশীলন
    সঙ্গেঅনুকূল, অনুকম্পা
    নির-/নিঃ-অভাবনিরক্ষর, নিরব, নির্জীব, নিরহঙ্কার, নিরাশ্রয়, নির্ধ
    নিশ্চয়নির্ধারণ, নির্ণয়, নির্ভ
    বাহির, বহির্মুখিতানির্গত, নিঃসরণ, নির্বাসন
    দুর-মন্দদুর্ভাগ্য, দুর্দশা, দুর্না
    কষ্টসাধ্যদুর্লভ, দুর্গম, দুরতিক্রম্য, দুর্মূল্য
    বি-বিশেষ রূপেবিধৃত, বিশুদ্ধ, বিজ্ঞান, বিবস্ত্র, বিশুষ্ক
    অভাববিনিদ্র, বিবর্ণ, বিশৃঙ্খল, বিফল
    গতিবিচরণ, বিক্ষেপ
    অপ্রকৃতস্থবিকার, বিপর্যয়
    সু-উত্তমসুকণ্ঠ, সুকৃতি, সুচরিত্র, সুপ্রিয়, সুনীল
    সহজসুগম, সুসাধ্য, সুলভ
    আতিশয্যসুচতুর, সুকঠিন, সুধীর, সুনিপুণ, সুতীক্ষ্ণ
    উৎ-ঊর্ধ্বমুখিতাউদ্যম, উন্নতি, উৎক্ষিপ্ত, উদগ্রীব, উত্তোলন
    আতিশয্যউচ্ছেদ, উত্তপ্ত, উৎফুল্ল, উৎসুক, উৎপীড়ন
    প্রস্তুতিউৎপাদন, উচ্চারণ
    অপকর্ষউৎকোচ, উচ্ছৃঙ্খল, ৎকট
    অধি-আধিপত্যঅধিকার, অধিপতি, অধিবাসী
    উপরিঅধিরোহণ, অধিষ্ঠান
    ব্যাপ্তিঅধিকার, অধিবাস, অধিগত
    পরি-বিশেষ রূপেপরিপক্ব, পরিপূর্ণ, পরিবর্তন
    শেষপরিশেষ, পরিসীমা
    সম্যক রূপেপরিশ্রান্ত, পরীক্ষা, পরিমাণ
    চতুর্দিকপরিভ্রমণ, পরিমণ্ডল, পরিক্রমণ
    প্রতি-সদৃশপ্রতিমূর্তি, প্রতিধ্বনি
    বিরোধপ্রতিবাদ, প্রতিদ্বন্দ্বী
    পৌনঃপুনপ্রতিদিন, প্রতিমাস
    অনুরূপ কাজপ্রতিঘাত, প্রতিদান, প্রত্যুপকার
    উপ-সামীপ্য অর্থেউপকূল, উপকণ্ঠ
    সদৃশউপদ্বীপ, উপবন
    ক্ষুদ্রউপগ্রহ, উপসাগর, উপনেতা
    বিশেষউপনয়ন, উপভোগ
    অভি-সম্যকঅভিব্যক্তি, অভিজ্ঞ, অভিভূত
    গমনঅভিযান, অভিসার
    সম্মুখ বা দিকঅভিমুখ, অভিবাদন
    অতি-আতিশয্যঅতিকায়, অত্যাচার, অতিশয়
    অতিক্রমঅতিমানব, অতিপ্রাকৃত
    আ-পর্যন্তকণ্য, মরণ, সমুদ্র
    ঈষৎরক্ত, ভাস
    বিপরীতদান, গমন
    অপি-যদিপিচ [প্রাচীন বাংলায় ব্যবহৃত], অপিনিহিতি

    খাঁটি বাংলা উপসর্গ

    উপসর্গঅর্থদ্যোতকতাউদাহরণ
    অ-নিন্দিতকেজো, চেনা, পয়া
    অভাবচিন, জানা, থৈ
    ক্রমাগতঝোর, ঝোরে
    অঘা-বোকাঅঘারাম, অঘাচণ্ডী
    অজ-নিতান্তঅজপাড়া, অজমূর্খ, অজপুকুর
    অনা-অভাবঅনাবৃষ্টি, অনাদর
    ছাড়াঅনাছিষ্টি, অনাচার
    অশুভঅনামুখো
    আ-অভাবকাঁড়া, ধোয়া, লুনি
    বাজে/নিকৃষ্টকাঠা, গাছা
    আড়-বক্রআড়চোখে, আড়নয়নে
    অর্ধেক/প্রায়আড়ক্ষ্যাপা, আড়মোড়া, আড়পাগলা
    বিশিষ্টআড়কোলা, আড়গড়া, আড়কাঠি
    আন-নেতিবাচকআনকোরা
    বিক্ষিপ্তআনচান, আনমনা
    আব-অস্পষ্টতাআবছায়া, আবডাল
    ইতি-এরইতিকর্তব্য, ইতিপূর্বে
    পুরনোইতিকথা, ইতিহাস
    ঊন- (ঊনু-/ঊনা-)কমঊনপাঁজুরে, উনিশ [উন+বিশ], ঊনাভাত
    কদ্-নিন্দিতকদবেল, কদর্য, কদাকার
    কু-কুৎসিত, অপকর্ষকুঅভ্যাস, কুপ্রথা, কুনজর, কুসঙ্গ
    নি-নেতিবাচক/নেইনিখুঁত, নিখোঁজ, নিলাজ, নিভাঁজ, নিরেট
    পাতি-ক্ষুদ্রপাতিহাঁস, পাতিশিয়াল, পাতিলেবু, পাতকুয়ো
    বি-ভিন্নতা/নেই/নিন্দনীয়বিভূঁই, বিফল, বিপথ
    ভর-পূর্ণতাভরপেট, ভরঃ’সাঁঝ, ভরপুর, ভরদুপুর, ভরসন্ধ্যা
    রাম-বড়;উৎকৃষ্টরামছাগল, রামদা, রামশিঙ্গা, রামবোকা
    স-সঙ্গেরাজ, রব, ঠিক, জোর, পাট
    সা-উৎকৃষ্টসাজিরা, সাজোয়ান
    সু-উত্তমসুনজর, সুখবর, সুদিন, সুনাম, সুকাজ
    হা-অভাবহাপিত্যেশ, হাভাতে, হাঘরে

    বিদেশি উপসর্গ

    ফার্সি উপসর্গ

    উপসর্গফার্সি রূপযে অর্থে প্রযুক্তউদাহরণ
    কার্-کارকাজকারখানা, কারসাজি, কারচুপি, কারবার, কারদানি
    দর্-درমধ্যস্থ, অধীনদরপত্তনী, দরপাট্টা, দরদালান, দরখাস্ত
    না-ناনেতিবাচকনাচার, নারাজ, নামঞ্জুর, নাখোশ, নালায়েক
    নিম্-نیمঅর্ধেকনিমরাজি, নিমখুন, নিমমোল্লা
    ফি-فیপ্রতিফি-রোজ, ফি-হপ্তা, ফি-বছর, ফি-সন, ফি-মাস
    বদ্-بدমন্দবদমেজাজ, বদরাগী, বদমাশ, বদহজম, বদনাম, বজ্জাত, বদহাল, বদবখ্ত
    বে-بیনেতিবাচক/নয়বেআদব, বেআক্কেল, বেকসুর, বেকায়দা, বেহায়া, বেনজির, বেগতিক, বেতার, বেকার, বেশরম, বেতমিজ
    বর্-برবাইরে, মধ্যেবরখাস্ত, বরদাস্ত, বরখেলাপ, বরবাদ
    ব্-بসহিতমাল, নাম, কলম, হাল
    কম্-کمস্বল্পকমজোর, কমবখ্ত, কমআক্কেল, কমপোখ্ত
    দস্ত-دستনিজদস্তখত
    সে-سهতিনটি (৩)সেতার, সেপায়া

    আরবি উপসর্গ

    উপসর্গআরবি রূপযে অর্থে প্রযুক্তউদাহরণ
    আম্-عامসাধারণআমদরবার, আমমোক্তার
    খাস্-خاصবিশেষখাসমহল, খাসখবর, খাসদরবার, খাসদখল
    লা-لاনেতিবাচক/নেইলাজবাব, লাখেরাজ, লাওয়ারিশ, লাপাত্তা
    গর্-غيرঅভাবগরমিল, গরহাজির, গররাজি
    বাজেبعضবিবিধ অপ্রয়োজনীয়বাজে খরচ, ‘বাজে কথা, বাজে জমা
    খয়েরخيرভালোখয়ের খাঁ

    ইংরেজি উপসর্গ

    উপসর্গইংরেজি রূপযে অর্থে প্রযুক্তউদাহরণ
    ফুল-Fullপূর্ণফুল-হাতা, ফুল-শার্ট, ফুল-বাবু, ফুল-প্যান্ট, ফুল-মোজা
    হাফ-Halfঅর্ধেকহাফ-হাতা, হাফ-টিকেট, হাফ-স্কুল, হাফ-প্যান্ট, হাফ-নেতা
    হেড-Headপ্রধানহেড-মাস্টার, হেড-অফিস, হেড-পণ্ডিত, হেড-মৌলভি
    সাব-Subঅধীনসাব-অফিস, সাব-জজ, সাব-ইন্সপেক্টর

    হিন্দুস্তানি উপসর্গ

    উপসর্গহিন্দুস্তানি রূপযে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছেউদাহরণ
    হর-حر
    हर
    প্রত্যেকহররোজ, হরমাহিনা, হরকিসিম, হরহামেশা, হরেক, হরতাল

    আরও দেখুন

  • বর্গ (বাংলা ব্যাকরণ)

    বাক্যের বর্গ বা সংক্ষেপে বর্গ বলতে বাক্যের মধ্যে একাধিক শব্দ দিয়ে গঠিত বাক্যাংশকে বোঝায়। বৰ্গকে বাক্যের একক বলা হয়।[১]

    উদাহরণ: “মালা ও মায়া খুব সকালে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা স্কুল বাসে উঠে পড়লো।”

    এই বাক্যে ‘মালা ও মায়া’, ‘খুব সকালে’, ‘বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা’, ‘স্কুল-বাসে’, ‘উঠে পড়লো’ শব্দগুচ্ছ এক একটি বর্গ।

    কোনো একটি বর্গ বাক্যের মধ্যে যে পদের মতো আচরণ করে, সেই পদের নাম অনুযায়ী বর্গের নাম হয়।

    বিশেষ্যবর্গ

    বিশেষ্য পদের আগে এক বা একাধিক বিশেষণ বা সম্বন্ধপদ যুক্ত হয়ে বিশেষ্য বর্গ তৈরি হয়।[১] যেমন – অসুস্থ ছেলেটি আজ স্কুলে আসেনি। আমার ভাই পড়তে বসেছে।

    সংযোজক পদ দ্বারা দুইটি বিশেষ্য যুক্ত হয়েও বিশেষ্যবর্গ তৈরি হয়। যেমন – রহিম ও করিম বৃষ্টিতে ভিজছে।

    বিশেষণবর্গ

    বিশেষণবর্গ হচ্ছে বিশেষণজাতীয় শব্দের গুচ্ছ।[১] যেমন – আমটা দেখতে ভারি সুন্দর। ভদ্রলোক সত্যিকারের নির্লোভ। পোকায় খাওয়া কাঠ দিয়ে আসবাব বানানো ঠিক নয়।

    ক্রিয়াবিশেষণবর্গ

    ক্রিয়াবিশেষণবর্গ হলো সেসব শব্দগুচ্ছ যা বাক্যে একত্রে ক্রিয়াবিশেষণ হিসাবে কাজ করে।[১] যেমন– সকাল আটটার সময়ে সে রওনা হলো। তারপর আমরা দশ নম্বর প্লাটফর্মে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমি সকাল থেকে বসে আছি। বেঁচে থাকার মতো সামান্য কয়টা টাকা বেতন পাই। সে খেয়ে আর ঘুমিয়ে কাটাচ্ছে।

    ক্রিয়াবৰ্গ

    বাক্যের বিধেয় অংশের ক্রিয়াপদ ক্রিয়াবর্গ তৈরি করে।[১] যেমন– অস্ত্রসহ সৈন্যদল এগিয়ে চলেছে। সে লিখছে আর হাসছে। সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বসে পড়লো। বাচ্চাটা অনেকক্ষণ ধরে চিৎকার করছে।

  • প্রকৃতি-প্রত্যয়

    ব্যাকরণ শাস্ত্রে, এক বা একাধিক ধ্বনি দিয়ে তৈরি শব্দকে প্রকৃতি বলে।[১] প্রত্যয় হলো এই প্রকৃতির পর যুক্ত হওয়া কিছু অর্থহীন শব্দাংশ, যা নতুন শব্দ তৈরি করে। মূলত প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত অর্থহীন শব্দাংশই প্রকৃতি-প্রত্যয়। প্রত্যয় ক্রিয়ামূলশব্দের সাথে যুক্ত হয়।

    প্রত্যয়ের নিজস্ব কোনো অর্থ নেই। তবে প্রত্যয় যুক্ত হওয়ার পরে অনেক সময়ে শব্দের অর্থ ও শ্রেণিপরিচয় বদলে যায়।

    প্রকারভেদ

    প্রত্যয় দুই প্রকার: ১.তদ্ধিত প্রত্যয়, ২.কৃৎ প্রত্যয়।

    • শব্দের পরে যেসব প্রত্যয় যুক্ত হয়, সেগুলোকে তদ্ধিত প্রত্যয় বলে। তদ্ধিত প্রত্যয় দিয়ে সাধিত শব্দকে বলে তদ্ধিতান্ত শব্দ। উদাহরণ: পঠ+অক=পাঠক, দিন+ইক = দৈনিক। এখানে, ‘অক’ ও ইক’ তদ্ধিত প্রত্যয় এবং ‘পাঠক’ ও ‘দৈনিক’ হলো তদ্ধিতান্ত শব্দ।
    • ক্রিয়ামূল বা ধাতুর পরে যেসব প্রত্যয় যুক্ত হয়, সেগুলোকে কৃৎ প্রত্যয় বলে। কৃৎ প্রত্যয় দিয়ে সাধিত শব্দকে বলে কৃদান্ত শব্দ। উদাহরণ: দুল্‌+অনা = দোলনা, কৃ+তব্য = কর্তব্য। এখানে, ‘অনা’ ও ‘তব্য’ হলো কৃৎ প্রত্যয় এবং ‘দোলনা’ ও ‘কর্তব্য’ হলো কৃদন্ত শব্দ।
  • পূরক

    পূরক হলো একটি বাক্য বা বাক্যাংশের বিধেয় অংশের ক্রিয়াপদকে সাহায্যকারী বিশেষ্য পদ।[১] এটি বিশেষ্য পদের একটি প্রকারভেদ।

    তবে বাচ্যের পরিবর্তনের কারণে পূরক পদের বদল হতে পারে। “টম রসায়ন পড়ছে” এই উদাহরণটিতে ‘টম’ উদ্দেশ্য হলে ‘রসায়ন’ হবে পূরক। কিন্তু বাচ্যের পরিবর্তনের ফলে পরবর্তী উদাহরণটিতে ‘রসায়ন’ যখন বাক্যের প্রথমে এসেছে, তখন এটিই উদ্দেশ্যে পরিণত হয়েছে এবং ‘টম’ পূরক হয়ে গেছে।

    উদ্ধৃতি

    1. বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি। নবম-দশম শ্রেণি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা, বাংলাদেশ। নভেম্বর ২০২০। পৃষ্ঠা ৮৮।
    এই নিবন্ধটি অসম্পূর্ণ। আপনি চাইলে এটিকে সম্প্রসারিত করে উইকিপিডিয়াকে সাহায্য করতে পারেন।
  • ধাতুগণ

    বাংলা ব্যাকরণে, ধাতুর গণ বলতে ধাতু বা ক্রিয়ামূলগুলোর বানানের ধরনকে বোঝায়।[১] এক্ষেত্রে “গণ” শব্দের অর্থ হলো শ্রেণি।

    ধাতুর গণ নির্ধারণ করতে দুইটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ রাখা হয়-
    (ক) ধাতুর অক্ষর সংখ্যা। এবং
    (খ) ধাতুর প্রথম বর্ণে সংযুক্ত স্বরবর্ণ

    উদাহরণ: ‘লওয়া’ ক্রিয়ার ধাতু ল (ল + অ)। ‘ল’ একাক্ষর ধাতু অবং প্রথম বর্ণ ল্-এর সাথে স্বরবর্ণ ‘অ’ সংযুক্ত আছে। সুতরাং, হ-আদিগণের মধ্যে ল্-ধাতু (ক্রিয়াপদ- লওয়া) পড়বে।

    ধাতুর গণসমূহ

    বাংলা ভাষার সমস্ত ধাতুকে ২০টি গণে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো:

    ক্রমিক নংধাতুগণউদাহরণ
    হ-আদিগণহ (হওয়া), ল (লওয়া) ইত্যাদি।
    খা-আদিগণখা (খাওয়া), ধা (ধাওয়া), পা (পাওয়া), যা (যাওয়া) ইত্যাদি।
    দি-আদিগণদি (দেওয়া), নি (নেওয়া) ইত্যাদি।
    শু-আদিগণচু (চোঁয়ানো), নু (নোয়ানো), ছু (ছোঁয়া) ইত্যাদি।
    কর্-আদিগণকর্ ( করা), কম্ (কমা), গড় (গড়া), চল (চলা) ইত্যাদি।
    কহ্-আদিগণকহ্ (কহা), সহ্ (সহা), বহ্ (বহা) ইত্যাদি।
    কাট্-আদিগণগাঁথ্, চাল্, আক্, বাঁধ্, কাঁদ্ ইত্যাদি।
    গাহ্-আদিগণচাহ্, বাহ্, নাহ্ (নাহান>স্নান) ইত্যাদি।
    লিখ্-আদিগণকিন্, ঘির্, জিত্, ফির্, ভিড়্, চিন্ ইত্যাদি।
    ১০উঠ্-আদিগণউড়্, শুন্, ফুট্, খুঁজ্, খুল্, ডুব্, তুল্ ইত্যাদি।
    ১১লাফা-আদিগণকাটা, ডাকা, বাজা, আগা (অগ্রসর হওয়া) ইত্যাদি।
    ১২নাহা-আদিগণগাহা ইত্যাদি।
    ১৩ফিরা-আদিগণছিটা, শিখা, ঝিমা, চিরা ইত্যাদি।
    ১৪ঘুরা-আদিগণউঁচা, লুকা, কুড়া (কুড়াচ্ছে) ইত্যাদি।
    ১৫ধোয়া-আদিগণশোয়া, খোঁচা, খোয়া, গোছা, যোগা ইত্যাদি।
    ১৬দৌড়া-আদিগণপৌঁছা, দৌড়া ইত্যাদি।
    ১৭চটকা-আদিগণসমঝা, ধমকা, কচলা ইত্যাদি।
    ১৮বিগড়া-আদিগণহিচড়া, ছিটকা, সিটকা ইত্যাদি।
    ১৯উলটা-আদিগণদুমড়া, মুচড়া, উপচা ইত্যাদি।
    ২০ছোবলা-আদিগণকোঁচকা, কোঁকড়া, কোদলা ইত্যাদি।
  • ধাতু (বাংলা ব্যাকরণ)

    ব্যাকরণ শাস্ত্রে, ক্রিয়ামূল বলতে ক্রিয়াপদের অবিভাজ্য বা মূল অংশের অন্তর্নিহিত ভাবটির দ্যোতনা [টীকা ১] করে[১] অথবা বিশ্লেষণ করা যায় না এ রকম যে ক্ষুদ্রতম ধ্বনিসমষ্টি ক্রিয়ার বস্তু বা গুণ বা অবস্থানকে বুঝায়। ক্রিয়ামূলকে ধাতুও বলে। ক্রিয়ামূল বা ধাতু নির্দেশ করতে মূল শব্দের পূর্বে “√” করণী চিহ্ন ব্যবহার করা হয়।

    প্রকারভেদ

    ক্রিয়ামূল বা ধাতু প্রধানত তিন প্রকার।

    • মৌলিক ধাতু
      • বাংলা ধাতু
      • সংস্কৃত ধাতু
      • বিদেশি ধাতু
    • সাধিত ধাতু
      • নাম ধাতু
      • প্রযোজক ধাতু বা ণিজন্ত ধাতু
      • কর্মবাচ্যের ধাতু
    • যৌগিক বা সংযোগমূলক ধাতু
      • বিশেষ্যের সাথে যুক্ত হওয়া ধাতু
      • বিশেষণের সাথে যুক্ত হওয়া ধাতু
      • ধ্বন্যাত্মক অব্যয়ের সাথে যুক্ত হওয়া ধাতু

    মৌলিক বা সিদ্ধ ধাতু

    যেসকল ধাতুকে ভাঙা বা বিশ্লেষণ করা যায় না তাদের মৌলিক বা সিদ্ধ ধাতু বলে। উদাহরণ: √কর্‌, √চল, √দেখ্‌, √খেল,√পড়, √খা।

    উৎস বিবেচনায় মৌলিক ধাতুগুলোকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়: (ক) বাংলা ধাতু (খ) সংস্কৃত ধাতু এবং (গ) বিদেশি ধাতু

    সাধিত ধাতু

    কোনো মৌলিক ধাতু কিংবা নাম শব্দের সাথে আ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে যে ধাতু গঠিত হয় তাকে সাধিত ধাতু বলে। উদাহরণ: √কর + আ = √করা, √দেখ্‌ + আ = √দেখা, √পড়্+আ= √পড়া।

    সংযোগমূলক বা যৌগিক ধাতু

    বিশেষ্য , বিশেষণ ও ধ্বনাত্বক অব্যয়ের সাথে √কর্, √দে, √হ, √পা ইত্যাদি মৌলিক ধাতু যুক্ত হয়ে যে ধাতু গঠন করে তাকে সংযোগমূলক বা যৌগিক ধাতু বলে। উদাহরণ: পূজা কর্‌, রাজি হ, কষ্ট পা, শাস্তি দে।

    অন্যান্য ধাতুসমূহ

    নাম ধাতু

    নাম শব্দ অথ্যাৎ বিশেষ্য, বিশেষণ, অব্যয় প্রভৃতি শব্দ কখনও কখনও প্রত্যয়যোগে, কখনওবা প্রত্যয় যুক্ত না হয়ে ক্রিয়ারূপে ব্যবহৃত হয়, এ ধরনের ক্রিয়ার মূলকে নাম ধাতু বলে। উদাহরণ: জুতা > জুতানো, বেত > বেতানো, হাত > হাতানো, বাঁকা > বাঁকানো।

    ণিজন্ত বা প্রযোজক ধাতু

    মৌলিক ধাতুর সাথে ‘আ’ বা ‘ওয়া’ যুক্ত হয়ে ণিজন্ত বা প্রযোজক ধাতু গঠিত হয়। উদাহরণ: √কর + আ =করা। যা কিছু হারায় গিন্নী। বলেন, “কেষ্টা বেটাই চোর”, এখানে হারায় হলো প্রযোজক ধাতু। এটা এক ধরনের সাধিত ধাতু।

    ধ্বন্যাত্মক ধাতু

    ধাতুরূপে ব্যবহৃত অনুকার (অনুকার = সাদৃশ্যকরণ, অনুকরণ) ধ্বনিকে ধ্বন্যাত্মক ধাতু বলে। উদাহরণ: ফোঁসা, হাঁপা, মচ্‌মচা, টল্‌টলা।

    নঞ্‌র্থক ধাতু

    “অস্তি” বাচক √হ ধাতুর পূর্বে নঞ্‌র্থক ‘ন’ শব্দের যোগে গঠিত √নহ্‌ ধাতুকে নঞ্‌র্থক ধাতু বলে। উদাহরণ: নহি, নই, নহ, নও, নহে, নয়।

    ধাতুর মূল

    শব্দ বা ধাতুর মূলকে প্রকৃতি বলে। সাধারণ অর্থে শব্দের মূল বলতে মৌলিক শব্দকে এবং ধাতুর মূল বলতে সিদ্ধ বা মৌলিক ধাতুকেই বুঝায়। উদাহরণ: “দোকান” শব্দের মূল “দোকান”, “ঢাকা” শব্দের মূল “ঢাকা” এবং √লিখ ধাতুর মূল “লিখ্‌”, √কর ধাতুর মূল “কর্”।

    প্রকৃতি দুই প্রকার। যথা-

    ২. ক্রিয়া-প্রকৃতি:

    ধাতু-প্রকৃতি বা ক্রিয়া-প্রকৃতি হলো ধাতুর মূল। ধাতু-প্রকৃতি বা ক্রিয়া-প্রকৃতি প্রত্যয় বা বিভক্তিযুক্ত না হয়ে শব্দরূপে ব্যবহৃত হয় না। যে সমস্ত ধাতু শব্দরূপে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়, সেগুলোতে একটি “শূন্য প্রত্যয় (০)” যুক্ত আছে বলে ধরে নেওয়া হয় । উদাহরণ: লিখ্‌, কর্‌ ।

    বিভিন্ন ধাতু

    মূল নিবন্ধ: ধাতুগণ

    বাংলা ভাষার সমস্ত ধাতুকে ২০টি গণে ভাগ করা হয়েছে। যথা:-

    ক্রমিক নংধাতুগণউদাহরণ
    হ-আদিগণহ (হওয়া), ল (লওয়া) ইত্যাদি।
    খা-আদিগণখা (খাওয়া), ধা (ধাওয়া), পা (পাওয়া), যা (যাওয়া) ইত্যাদি।
    দি-আদিগণদি (দেওয়া), নি (নেওয়া) ইত্যাদি।
    শু-আদিগণচু (চোঁয়ানো), নু (নোয়ানো), ছু (ছোঁয়া) ইত্যাদি।
    কর্-আদিগণকর্ ( করা), কম্ (কমা), গড় (গড়া), চল (চলা) ইত্যাদি।
    কহ্-আদিগণকহ্ (কহা), সহ্ (সহা), বহ্ (বহা) ইত্যাদি।
    কাট্-আদিগণগাঁথ্, চাল্, আক্, বাঁধ্, কাঁদ্ ইত্যাদি।
    গাহ্-আদিগণচাহ্, বাহ্, নাহ্ (নাহান>স্নান) ইত্যাদি।
    লিখ্-আদিগণকিন্, ঘির্, জিত্, ফির্, ভিড়্, চিন্ ইত্যাদি।
    ১০উঠ্-আদিগণউড়্, শুন্, ফুট্, খুঁজ্, খুল্, ডুব্, তুল্ ইত্যাদি।
    ১১লাফা-আদিগণকাটা, ডাকা, বাজা, আগা (অগ্রসর হওয়া) ইত্যাদি।
    ১২নাহা-আদিগণগাহা ইত্যাদি।
    ১৩ফিরা-আদিগণছিটা, শিখা, ঝিমা, চিরা ইত্যাদি।
    ১৪ঘুরা-আদিগণউঁচা, লুকা, কুড়া (কুড়াচ্ছে) ইত্যাদি।
    ১৫ধোয়া-আদিগণশোয়া, খোঁচা, খোয়া, গোছা, যোগা ইত্যাদি।
    ১৬দৌড়া-আদিগণপৌঁছা, দৌড়া ইত্যাদি।
    ১৭চটকা-আদিগণসমঝা, ধমকা, কচলা ইত্যাদি।
    ১৮বিগড়া-আদিগণহিচড়া, ছিটকা, সিটকা ইত্যাদি।
    ১৯উলটা-আদিগণদুমড়া, মুচড়া, উপচা ইত্যাদি।
    ২০ছোবলা-আদিগণকোঁচকা, কোঁকড়া, কোদলা ইত্যাদি।

    প্রাতিপাদিক

    প্রতিপাদিক হলো বিভক্তিহীন নাম-প্রকৃতি বা সাধিত শব্দ এবং বিভক্তিহীন তবে প্রত্যয়যুক্ত ক্রিয়ামূল বা ক্রিয়া-প্রকৃতি। প্রকৃতির সাথে প্রত্যয়ের যোগে যে শব্দ ও ক্রিয়ামূল গঠিত হয় তার নাম প্রাতিপাদিক। [২]

    নাম-প্রাতিপাদিক

    বিভক্তহীন ও প্রত্যয়হীন কিংবা বিভক্তিহীন অথচ প্রত্যয়যুক্ত নাম-প্রকৃতিকে নাম প্রাতিপাদিক বলে। উদাহরণ: দোকান + দার = দোকানদার + কে = দোকানদারকে।

    ক্রিয়া-প্রাতিপাদিক

    বিভক্তহীন ও প্রত্যয়যুক্ত ধাতু-প্রকৃতিকে ক্রিয়া-প্রাতিপাদিক বলে। উদাহরণ: কর্‌ + অ = করা + কে = করাকে

    টীকা

  • ক্রিয়াপদ

    যে পদের দ্বারা কাজ করা বোঝায়, তাকে ক্রিয়া[টীকা ১] বলে। অথবা ধাতুর প্রয়োগগত রূপ হলো ক্রিয়া।ক্রিয়াপদের আরেকটি নাম হলো আখ্যাত বা আখ্যাতিক পদ।[১][২]

    ক্রিয়াপদের গঠন

    ক্রিয়ামূল তথা ধাতুর সঙ্গে পুরুষ অনুযায়ী কালসূচক ক্রিয়াবিভক্তি যোগ করে ক্রিয়াপদ গঠন করতে হয়। [৩]সংক্ষেপে ধাতু+বিভক্তি = ক্রিয়াপদ

    যেমন: √পড়্+এ=পড়ে

    অনুক্ত ক্রিয়াপদ

    যে বাক্যে ক্রিয়াপদ উহ্য থাকে তাকে অনুক্ত ক্রিয়া বলে।[৪]

    যেমন “ইনি আমার ভাই”(হন)

    “তোমার মা কেমন?”(আছেন)

    উদাহরণ দুটিতে যথাক্রমে ‘হন’ ও ‘আছেন’ উহ্য আছে।[৩]

    ক্রিয়াপদের প্রকারভেদ

    ভাব প্রকাশের দিক দিয়ে ক্রিয়াপদকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যথাঃ

    • সমাপিকা ক্রিয়া
    • অসমাপিকা ক্রিয়া
    • কর্মপদ গ্রহণের ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে ক্রিয়াপদ চার প্রকার।তথা:
      • অকর্মক ক্রিয়া
      • সকর্মক ক্রিয়া
      • দ্বিকর্মক ক্রিয়া
      • প্রযোজক ক্রিয়া
      • গঠন বৈশিষ্ট্য অনুসারে ক্রিয়াপদ চার প্রকার। যথা:

    সমাপিকা ক্রিয়া

    যে ক্রিয়াপদ বাক্যকে পরিপূর্ণ করে এবং বাক্যের অর্থকে সুস্পষ্ট করে তাকে সমাপিকা ক্রিয়া বলে। যেমন:

    ক্রিয়াপদের উদাহরণ

    • আমি বাড়ি যাব
    • আমরা সন্ধ্যায় পড়তে বসব

    অসমাপিকা ক্রিয়া

    যে ক্রিয়াপদ দ্বারা বাক্যের পরিসমাপ্তি ঘটে না, বক্তার কথা অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তাকে অসমাপিকা ক্রিয়া বলে।

    • আমরা হাত-মুখ ধুয়ে…
    • প্রভাতে সূর্য উঠলে…

    অসমাপিকা ক্রিয়া ৩ প্রকার ১.ভূত অসমাপিকা ক্রিয়া ২.ভাবী অসমাপিকা ক্রিয়া ৩.শর্ত অসমাপিকা ক্রিয়া

    অকর্মক

    যে বাক্যে একটিও কর্ম থাকে না তাকে অকর্মক বলে। যেমন:

    • সে হাসছে
    • রমা নাচছে

    এখানে ‘হাসছে’‘নাচছে’ ক্রিয়ার কর্ম নেই , আবার এদের ক্রিয়া ধারণের ক্ষমতাও নেই ,তাই এরা অকর্মক ক্রিয়া।

    সকর্মক

    যে বাক্যে একটি কর্ম থাকে তাকে সকর্মক বলে।যেমন:

    • আমি ভাত খাচ্ছি
    • সে বই পড়ছে

    এখানে কী খাচ্ছি আর কী পড়ছে’ তা বলা রয়েছে। কাজেই বাক্য দুটিতে খাচ্ছি এবং পড়ছে সকর্মক ক্রিয়া।

    দ্বিকর্মক

    যে বাক্যে দুটি কর্ম থাকে তাকে দ্বিকর্মক বলা হয়।

    এক্ষেত্রে, ববস্তুবাচক কর্মপদটি মুখ্যকর্ম, আর ব্যক্তিবাচক কর্মপদটি গৌণ কর্ম।

    • শিক্ষক ছাত্রদের(গৌণ কর্ম) বাংলা(মুখ্যকর্ম) পড়াচ্ছেন।
    • বাবা আমাকে(গৌণ কর্ম) একটি কলম(মুখ্যকর্ম) কিনে দিয়েছেন

    প্রযোজক ক্রিয়া

    যে ক্রিয়া অন্যের দ্বারা চালিত হয় তাকে প্রযোজক ক্রিয়া বলে।[৬] যেমন

    • মা শিশুকে চাঁদ দেখাচ্ছেন।
    • সাপুড়ে সাপ খেলাচ্ছে।

    এখানে “মা” এবং “সাপুড়ে” প্রযোজক কর্তা, “শিশু” ও “সাপ” প্রযোজ্য কর্তা। “চাঁদ দেখাচ্ছেন” ও “খেলাচ্ছে” প্রযোজক ক্রিয়া।

  • কি ও কী

    কিকী বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত শব্দদ্বয়, যেখানে কি ক্রিয়াবিশেষণ (অব্যয়) এবং কী সর্বনাম পদ হিসেবে কাজ করে।[১] উভয়ই প্রশ্নবোধক বা বিস্ময়সূচক বাক্যে ব্যবহৃত হয়। সমোচ্চারিত শব্দ হওয়ায় প্রায়শই লেখা ও পড়ার সময় শব্দদ্বয়ের বানান ও অর্থ নিয়ে ব্যবহারকারীদের অসুবিধা সৃষ্টি হয়। অনেকে ভিন্ন অর্থ প্রকাশের জন্য কেবল একটি শব্দই ব্যবহার করেন।

    পার্থক্য ও ব্যবহার

    ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ দিয়ে যেসকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়, সেসকল ক্ষেত্রে কি ব্যবহৃত হয় এবং ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ দিয়ে যেসকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় না, বিশদ বিবরণ দিতে হয়, সেসকল ক্ষেত্রে কী ব্যবহৃত হয়।[২][৩] কি-এর উত্তরে ক্রিয়াবিশেষণ এবং কী-এর উত্তরে বিশেষ্য বা সর্বনাম পদ পাওয়া যায়। তুমি কি খাবে? তুমি কী খাবে?

    প্রথম প্রশ্নে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে সে খাবে কি-না, যার উত্তর হতে পারে “হ্যাঁ, খাবো” অথবা “না, খাবো না”, যেখানে দ্বিতীয় প্রশ্নে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে সে কোন খাবারটি খাবে, যার উত্তর কোনো খাদ্যপণ্যের নাম হতে পারে।

    বিস্ময়সূচক বাক্যে কিংবা হর্ষ বিষাদ বুঝাতে হলে কী ব্যবহার হবে।[৩] কী সুন্দর কথা বলেছে! কী মধুর

  • কারক

    কারক শব্দটির ব্যাকরণগত অর্থ হলো- যা ক্রিয়া সম্পাদন করে। বাংলা ব্যাকরণ শাস্ত্রে, কারক বলতে মূলত ক্রিয়ার সঙ্গে বাক্যের বিশেষ্যসর্বনাম পদের সম্পর্ককে নির্দেশ করে। কারকের সম্পর্ক বোঝাতে বিশেষ্য ও সর্বনাম পদের সঙ্গে সাধারণত বিভক্তিঅনুসর্গ যুক্ত হয়।[১] বাক্যস্থ কোনো পদের সঙ্গে ক্রিয়াপদের সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলে শুধুমাত্র তখনই কারক হবে।

    প্রকারভেদ

    আধুনিক বাংলা ব্যাকরণে কারক ছয় প্রকার:

    পূর্বে সম্প্রদান কারককে কারকের একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসাবে ধরা হলেও বর্তমানে তা কর্ম কারকের অংশ হিসাবে বিবেচিত।

    ছয়টি কারকের উদাহরণ

    নিম্নোক্ত বাক্যসমূহে ছয়টি কারক উপস্থাপন করা হলো: বেগম সাহেবা প্রতিদিন ভাঁড়ার থেকে নিজ হাতে গরিবদের চাল দিতেন। এখানে–

    • বেগম সাহেবা – ক্রিয়ার সাথে কর্তৃসম্বন্ধ
    • চাল – ক্রিয়ার সাথে কর্ম সম্বন্ধ
    • হাতে – ক্রিয়ার সাথে করণ সম্বন্ধ
    • গরিবদের – ক্রিয়ার সাথে সম্প্রদান (কর্ম) সম্পর্ক
    • ভাঁড়ার থেকে – ক্রিয়ার সাথে অপাদান সম্পর্ক
    • প্রতিদিন – ক্রিয়ার সাথে অধিকরণ সম্পর্ক

    দানবীর রাজা হর্ষবর্ধন প্রয়াগের মেলায় রাজভাণ্ডার থেকে স্বহস্তে দরিদ্র প্রজাদের অর্থসম্পদ বিতরণ করতেন। এখানে–

    • দানবীর রাজা হর্ষবর্ধন – ক্রিয়ার সাথে কর্তৃসম্বন্ধ
    • অর্থসম্পদ – ক্রিয়ার সাথে কর্ম সম্বন্ধ
    • স্বহস্তে – ক্রিয়ার সাথে করণ সম্বন্ধ
    • দরিদ্র প্রজাদের – ক্রিয়ার সাথে সম্প্রদান (কর্ম) সম্পর্ক
    • রাজভাণ্ডার থেকে – ক্রিয়ার সাথে অপাদান সম্পর্ক
    • প্রয়াগের মেলায় – ক্রিয়ার সাথে অধিকরণ সম্পর্ক

    ইতিহাস

    অধিকাংশ ভাষাতত্ত্ববিদ এটি মেনে নিয়েছেন, যে প্রাচীন গ্রিকদের তাদের নিজেদের ভাষার বিভিন্ন ক্রিয়াপদের সঙ্গে নামপদের সম্পর্ক ও বাক্যে এদের ব্যবহার সম্মন্ধে বিস্তৃত ধারণা ছিল। গ্রিক কবি আনাক্রিয়ন এর একটি পুস্তিকা থেকে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে। তবুও এই বিষয়টি সম্পূর্ণ নিশ্চিত নয়, যে আধুনিক ব্যাকরণে “কারক” বলতে যে বিষয়টিকে বোঝানো হয়, তা সম্পর্কে প্রাচীন গ্রিকরা পুরাপুরি অবগত। “ব্যাকরণের কারক”কে সর্বপ্রথম ব্যাকরণের একটি স্বতন্ত্র অংশ হিসাবে বৈরাগ্যবাদীরা স্বীকৃতি দিয়েছিল, যা তারা জানতে পেরেছিল প্রাচীন গ্রিসের পেরিপেটীয় ঘরানার কিছু দার্শনিকদের কাছ থেকে।[২][৩]

    নামের ব্যুৎপত্তি ও সংজ্ঞা

    কারক শব্দটি প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার *কাড ধাতু থেকে এসেছে[৪], যার অর্থ হলো- “যা কাজ সম্পাদন করে”।

    বাক্যস্থিত ক্রিয়াপদের সঙ্গে নামপদের যে সম্পর্ক, তাকে কারক বলে।[১]

    ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহে কারক

    মোটামুটি সকল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহর ব্যাকরণেই কারক বিদ্যমান। তবে ইউরোপমধ্য এশিয়ার ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলোর থেকে ভারত উপমহাদেশের ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহতে কারকের বৈশিষ্ট্য বেশি ফুটে ওঠে। এর কারণ অত্যাধিক হারে বিভক্তি ও অনুসর্গের ব্যবহার। বাংলা ভাষাতেও এর ব্যাতিক্রম নয়। ইন্দো-আর্য ভাষাসমূহের অধিকাংশ কারক সংস্কৃত হতে আগত।

    বিভক্তি

    মূল নিবন্ধ: বিভক্তি

    বাংলা কারক সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমে বিভক্তি সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। কারণ কারকের সম্পর্ক বোঝাতে নামপদের সঙ্গে বিভক্তি যুক্ত হয়। বিভক্তিগুলো ক্রিয়াপদের সাথেও নামপদের সম্পর্ক স্থাপন করে।[১]

    ০ (শূন্য) বিভক্তি (অথবা অ-বিভক্তি), এ (য়), তে (এ), কে, রে, র (এরা) – এ কয়টি খাঁটি বাংলার শব্দ বিভক্তি। এছাড়া বিভক্তি স্থানীয় কয়েকটি অব্যয় শব্দও কারক-সম্বন্ধ নির্ণয়ের জন্য বাংলায় প্রচলিত রয়েছে। যেমন – দ্বারা, দিয়ে, হতে, থেকে ইত্যাদি।

    নিচের ছকের বিভক্তিগুলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে নামপদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকে।

    বিভক্তি
    (সংস্কৃত)
    একবচনবহুবচন
    প্রথমা০, অ, এ (য়), তে, এতে।রা, এরা, গুলি (গুলো), গণ।
    দ্বিতীয়া০, অ, কে, রে (এরে), এ, য়, তে।দিগে, দিগকে, দিগেরে, *দের।
    তৃতীয়া০, অ, এ, তে, দ্বারা, দিয়া (দিয়ে), কর্তৃক।দিগের দিয়া, দের দিয়া, দিগকে দ্বারা, দিগ কর্তৃক, গুলির দ্বারা, গুলিকে দিয়ে, *গুলো দিয়ে, গুলি কর্তৃক, *দের দিয়ে।
    চতুর্থীদ্বিতীয়ার মতোদ্বিতীয়ার মতো
    পঞ্চমীএ (য়ে, য়), হইতে, *থেকে, *চেয়ে, *হতে।দিগ হইতে, দের হইতে, দিগের চেয়ে, গুলি হইতে, গুলির চেয়ে, *দের হতে, *দের থেকে, *দের চেয়ে।
    ষষ্ঠীর, এর।*দিগের, দের, গুলির, গণের, গুলোর
    সপ্তমীএ (য়), তে, এতে।দিগে, দিগেতে, গুলিতে, গণে, গুলির মধ্যে, গুলোতে, গুলোর মধ্যে।

    তারকা চিহ্নিত (*) বিভক্তিগুলো এবং বন্ধনীতে লিখিত শব্দ চলিত ভাষায় ব্যবহৃত হয়।

    দ্রষ্টব্য: বিভক্তি চিহ্ন স্পষ্ট না হলে সেখানে শূন্য বিভক্তি আছে মনে করা হয়।

    কর্তৃকারক

    মূল নিবন্ধ: কর্তৃকারক

    প্রশ্ন কাঠামো: কে, কারা + ক্রিয়া +?

    বাক্যস্থিত যে বিশেষ্য বা সর্বনাম পদ কাজ সম্পন্ন করে তাকে ক্রিয়ার কর্তা বা কর্তৃকারক বা কর্তা কারক বলে। ক্রিয়ার সঙ্গে কে বা কারা যোগ করে প্রশ্ন করলে উত্তরে কর্তৃকারক পাওয়া যায়।

    উদাহরণ:

    • খোকা বই পড়ে। [কে বই পড়ে?]
    • মেয়েরা ফুল তোলে। [কারা ফুল তোলে?]
    • আমরা নদীর ঘাট থেকে রিকশা নিয়েছিলাম। [কারা নদীর ঘাট থেকে রিকশা নিয়েছিলাম/নিয়েছিল?]

    কর্ম কারক

    মূল নিবন্ধ: কর্ম কারক

    প্রশ্ন কাঠামো: কি, কাকে + ক্রিয়া +?

    যাকে আশ্রয় করে কর্তা কাজ সম্পন্ন করে, তাকে কর্ম কারক বলে। ক্রিয়ার সঙ্গে কি বা কাকে দ্বারা প্রশ্ন করলে উত্তরে কর্ম কারক পাওয়া যায়।

    উদাহরণ:

    • ডাক্তার ডাকো। [কাকে ডাকো?]
    • তাকে বলো। [কাকে বলো?]
    • শিক্ষককে জানাও। [কাকে জানাও?]

    সম্প্রদান কারক

    মূল নিবন্ধ: সম্প্রদান কারক

    প্রশ্ন কাঠামো: কি বা কাকে + ক্রিয়া +?

    যাকে স্বত্ব ত্যাগ করে দান, অর্চনা, সাহায্য ইত্যাদি করা হয়, তাকে সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুযায়ী সম্প্রদান কারক বলে। একে নিমিত্ত কারক-ও বলা হয়। এখানে লক্ষণীয় যে, বস্তু নয় ব্যক্তিই সম্প্রদান কারক। ক্রিয়াকে কাকে দিয়ে প্রশ্ন করলে যে উত্তর পাওয়া যায় তা সম্প্রদান কারক। স্বত্বত্যাগ না করে কোনো জিনিস কাউকে উদ্দেশ্য করে দিলে সেটি কর্মকারক হিসাবে বিবেচিত হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হয় না। এই বিভ্রান্তি এড়াতে বর্তমানে সম্প্রদান কারককে কর্ম কারকের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

    উদাহরণ:

    • ভিখারিকে ভিক্ষা দাও। (স্বত্বত্যাগ করে)
    • বেলা যে পড়ে এল, জলকে চলো।

    করণ কারক

    মূল নিবন্ধ: করণ কারক

    প্রশ্ন কাঠামো: কিসের দ্বারা, কি দ্বারা, কি দিয়ে + ক্রিয়া +?

    “করণ” শব্দটির অর্থ – যন্ত্র, সহায়ক বা উপায়। ক্রিয়া সম্পাদনের যন্ত্র, উপকরণ বা উপায়কেই করণ কারক বলে। বাক্যস্থিত ক্রিয়াপদের সঙ্গে কিসের দ্বারা বা কি দ্বারা (কি দিয়ে) প্রশ্ন করলে উত্তরে করণ কারক পাওয়া যায়।

    উদাহরণ:

    • নীরা কলম দিয়ে লেখে। [নীরা কি দিয়ে লেখে?]
    • “জগতে কীর্তিমান হয় সাধনায়।” [কি দিয়ে/কি দ্বারা জগতে কীর্তিমান হয়?]
    • চাষিরা ধারালো কাস্তে দ্বারা ধান কাটছে। [চাষিরা কি দ্বারা ধান কাটছে?]

    অপাদান কারক

    মূল নিবন্ধ: অপাদান কারক

    প্রশ্ন কাঠামো: কি হতে, কি থেকে, কোথা হতে, কোথা থেকে + ক্রিয়া +?

    যা থেকে কিছু বিচ্যুত, গৃহীত, জাত, বিরত, আরম্ভ, দূরীভূত ও রক্ষিত হয় এবং যা দেখে কেউ ভীত হয়, তাকে অপাদান কারক বলে।

    উদাহরণ:

    • জমি থেকে ফসল পাই। [কোথা থেকে ফসল পাই?]
    • গাছ থেকে পাতা পড়ে। [কোথা থেকে পাতা পড়ে?]
    • সুক্তি থেকে মুক্তো মেলে। [কি থেকে মুক্তো মেলে?]
    • ঢাকা থেকে কলকাতা অনেক দূর। [কোথা থেকে কলকাতা অনেক দূর?]
    • পরাজয়ে ডরে না বীর। [ভয় বুঝাতে অপাদান কারক]
    • সোমবার পরীক্ষা শুরু হবে। [আরম্ভ বুঝাতে অপাদান কারক]

    অধিকরণ কারক

    মূল নিবন্ধ: অধিকরণ কারক

    প্রশ্ন কাঠামো: কোথায়, কখন, কিসে + ক্রিয়া +?

    ক্রিয়া সম্পাদনের সময়, স্থান এবং আধারকে অধিকরণ কারক বলে।

    উদাহরণ:

    • বাড়িতে কেউ নেই। [কোথায় কেউ নেই?]
    • বসন্তে কোকিল ডাকে। [কখন কোকিল ডাকে?]
    • সূর্যোদয়ে অন্ধকার দূরীভূত হয়। [কিসে অন্ধকার দূরীভূত হয়?]
    • বাবা বাড়ি আছেন। [বাবা কোথায় আছেন?]
    • বিকাল পাঁচটায় অফিস ছুটি হবে। [কখন অফিস ছুটি হবে?]

    সম্বন্ধ পদ

    যে পদ বিশেষ্য ও সর্বনাম পদের সঙ্গে বিশেষ্য ও সর্বনাম পদের সম্পর্ক নির্দেশ করে, তাকে সম্বন্ধ পদ বা সম্বন্ধ কারক বলে। ক্রিয়াপদের সঙ্গে এদের সম্পর্ক পরোক্ষ হয়। পূর্বে কারকে শ্রেণিভুক্ত না করা হলেও বর্তমানে একটি কারক হিসাবে বিবেচিত হয়, কারণ ক্রিয়ার সঙ্গে এদের সম্পর্ক বিদ্যমান।

    বিভক্তি

    • সম্বন্ধ পদে -র বা -এর বিভক্তি (ষষ্ঠী বিভক্তি) যুক্ত হয়ে থাকে। যেমন- আমি + -র = আমার, খালিদ + -এর = খালিদের।
    • সময়বাচক অর্থে সম্বন্ধ পদে -কার > -কের বিভক্তি যুক্ত হয়। যেমন- আজি + -কার = আজিকার > আজকের, পূর্বে + -কার = পূর্বেকার, কালি + -কার = কালিকার > কালকার > কালকের।
      তবে “কাল” শব্দটির উত্তরে শুধু -এর বিভক্তিই যুক্ত হয়। যেমন- কাল + -এর = কালের। উদাহরণ– সে কত কালের কথা। [সে কবেকার কথা?]

    প্রকারভেদ

    সম্বন্ধ পদ বহু প্রকারের হতে পারে।

    • অধিকরণ সম্বন্ধ: রাজার রাজ্য, প্রজার জমি।
    • জন্ম-জনক সম্বন্ধ: গাছের ফল, পুকুরের মাছ।
    • কার্যকারণ সম্বন্ধ: অগ্নির উত্তাপ, রোগের কষ্ট।
    • উপাদান সম্পর্ক: রূপার থালা, সোনার বাটি।
    • গুণ সম্বন্ধ: মধুর মিষ্টতা, নিমের তিক্ততা।
    • হেতু সম্বন্ধ: ধনের অহঙ্কার, রূপের দেমাক।
    • ব্যাপ্তি সম্বন্ধ: রোজার ছুটি, শরতের আকাশ।
    • ক্রম সম্বন্ধ: পাঁচের পৃষ্ঠা, সাতের ঘর।
    • অংশ সম্বন্ধ: হাঁতির দাঁত, মাথার চুল।
    • ব্যবসায় সম্বন্ধ: পাটের গুদাম, আদার ব্যাপারী।
    • ভগ্নাংশ সম্বন্ধ: একের তিন, সাতের পাঁচ।
    • কৃতি সম্বন্ধ: নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’, মাইকেলের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’।
    • আধার-আধেয় সম্বন্ধ: বাটির দুধ, শিশির ওষুধ।
    • অভেদ সম্বন্ধ: জ্ঞানের আলো, দুঃখের দহন।
    • উপমান-উপমেয় সম্বন্ধ: ননীর পুতুল, লোহার শরীর।
    • বিশেষণ সম্বন্ধ: সুখের দিন, যৌবনের চাঞ্চল্য।
    • নির্ধারণ সম্বন্ধ: সবার সেরা, সবার ছোট।
    • কারক সম্বন্ধ:
      • কর্তৃ সম্বন্ধ – রাজার হুকুম।
      • কর্ম সম্বন্ধ: প্রভুর সেবা, সাধুর দর্শন।
      • করণ সম্বন্ধ: চোখের দেখা, হাতের লাঠি।
      • অপাদান সম্বন্ধ: বাঘের ভয়, বৃষ্টির পানি।
      • অধিকরণ সম্বন্ধ: ক্ষেতের ধান, দেশের লোক।

    সম্বোধন পদ

    “সম্বোধন” শব্দটির অর্থ আহ্বান। যাকে সম্বোধন বা আহ্বান করে কিছু বলা হয়, তাকে সম্বোধন পদ বলে। সম্বোধন পদ বাক্যের অংশ। কিন্তু বাক্যস্থিত ক্রিয়াপদের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ থাকে না বলে, সম্বোধন পদ কারক নয়।

    নিয়মাবলি

    • অনেক সময় সম্বোধন পদের পূর্বে ওগো, ওরে, হে, অয়ি প্রভৃতি অব্যয়বাচক শব্দ বসে সম্বোধনের সূচনা করে। যেমন- “ওগো, তোরা জয়ধ্বনি কর”, “ওরে, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে”, “অয়ি নির্মল ঊষা, কে তোমাকে নিরমিল?”
    • অনেক সময় সম্বন্ধসূচক অব্যয়টি কেবল সম্বোধন পদের কাজ করে থাকে।
    • সম্বোধন পদের পরে অনেক সময় বিস্ময়সূচক চিহ্ন (!) দেওয়া হয়। এই ধরনের বিস্ময়সূচক চিহ্নকে “সম্বোধন চিহ্ন” বলা হয়ে থাকে। কিন্তু আধুনিক বাংলা ব্যাকরণে সম্বোধন চিহ্ন স্থানে কমা (,) চিহ্নের প্রয়োগই বেশি হয়। যেমন- ওরে খোকা, যাবার সময় একটা কথা শুনে যাস্।

    ব্যতিক্রম

    বাংলায় এমন অনেক বাক্য রয়েছে যেখানে ক্রিয়াপদ নেই। উদাহরণস্বরূপ, “মাঠে মাঠে অজস্র ফসল”, “ছোট ছোট ডিঙি নৌকাগুলো নদীতে ভাসমান।”
    এ জাতীয় ক্রিয়াহীন অনেক বাক্য বাংলায় রয়েছে। ক্রিয়াপদ নেই বলে এই বাক্যগুলোর অন্তর্গত নাম শব্দগুলোর কারকও নেই। সেজন্য বলা হয়[কে?], “বাংলা বাক্য কারক-প্রধান নয়।”[৫] তবে বিভক্তি ছাড়া বাংলা বাক্য গঠিত হতে পারে না বলে বাংলা বাক্য বিভক্তিপ্রধান।

    আরো দেখুন