Category: বাংলা ভাষা ও সাহিত্য

Bengali language and literature

  • আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি

    আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি হল একটি রবীন্দ্রসংগীত। গানটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতি-সংকলন গীতবিতান গ্রন্থের “স্বদেশ” পর্যায়ভুক্ত ২১ সংখ্যক গান। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময় গিরিডিতে থাকাকালীন (ভাদ্র-আশ্বিন ১৩১২) রবীন্দ্রনাথ যে ২০টি গান রচনা করেছিলেন এই গানটি তারই অন্যতম। গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ভাণ্ডার পত্রিকার ভাদ্র-আশ্বিন ১৩১২ সংখ্যায় (৬ আশ্বিন, ১৩১২/২২ অক্টোবর, ১৯০৫)। এরপর বাউল গীতিগ্রন্থে (আশ্বিন ১৩১২) এটি অন্তর্ভুক্ত হয় “মাতৃমূর্ত্তি” শিরোনামে। এছাড়াও গানটি পুনঃপ্রকাশিত হয় স্বদেশ (১৩১২), গান (“জাতীয়সঙ্গীত” পর্যায়, ১৩১৬), কাব্যগ্রন্থ (দশম খণ্ড, “জাতীয়সঙ্গীত” পর্যায়, ১৩২৩), গীতবিতান (প্রথম সংস্করণ) প্রথম খণ্ড (আশ্বিন ১৩৩৮) ও গীতবিতান (দ্বিতীয় সংস্করণ) প্রথম খণ্ড (ভাদ্র ১৩৪৫) সংকলনগুলিতেও। ১৩৩৮ সনের ২৮, ২৯ ও ৩১ ভাদ্র এবং ১ আশ্বিন তারিখে কলকাতায় বিশ্বভারতী দুর্গত সহায়ক সঙ্ঘ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে প্রকাশিত গীতোৎসব অনুষ্ঠানপত্রীতে মুদ্রিত ২১টি গানেরও অন্যতম ছিল এটি।[১]

    গানটির ছত্রসংখ্যা ২২ এবং কলিসংখ্যা ১/২/৩/৪।[২] গানটির সুর বাউলাঙ্গে মিশ্র বিভাস রাগে[২] ও একতালে নিবদ্ধ। স্বরবিতান গ্রন্থের ৪৬শ খণ্ডে গানটির ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী কৃত স্বরলিপিটি প্রকাশিত হয়েছে। ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী কৃত স্বরলিপিটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল সংগীত-প্রকাশিকা পত্রিকার বৈশাখ ১৩১৩ সংখ্যায়। অনাদিকুমার দস্তিদার কৃত অপর একটি স্বরলিপি প্রকাশিত হয় ১৩৫০ সনের গীতবিতান বার্ষিকী পত্রিকায়।[১]

    রবীন্দ্রনাথ স্বকণ্ঠে এইচ. বোস রেকর্ডস থেকে গানটি প্রথম রেকর্ড করেছিলেন (সিলিন্ডার রেকর্ড, লেবেল নং এইচ. বোস ৩৫৮)।[১] ১৯০৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি (৪ ফাল্গুন ১৩১২ শুক্রবার) তারিখে বেঙ্গলি পত্রিকায় প্রকাশিত “এইচ. বোসে’জ রেকর্ডস/সংস কমপোজড অ্যান্ড সাং বাই বাবু রবীন্দ্রনাথ টেগোর” শীর্ষক বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথের স্বকণ্ঠে রেকর্ডকৃত গানের তালিকায় এই গানটিরও উল্লেখ পাওয়া যায়।[২] কিন্তু পরবর্তীকালে চেষ্টা সত্ত্বেও এইচ. বোস রেকর্ডস থেকে রবীন্দ্রনাথের স্বকণ্ঠে রেকর্ড করা কোনও গানই উদ্ধার করা যায়নি।[৩]এরপর কলম্বিয়া রেকর্ড থেকে গানটি রেকর্ড করেন ধীরেন্দ্রনাথ দাস (রেকর্ড নং এন-১৭০২৯)।[৪] পরবর্তীকালে গানটি রেকর্ড করেন অনিতা মজুমদার ও সন্তোষ সেনগুপ্ত দ্বৈতকণ্ঠে (রেকর্ড নং এন-২৭৮০৪), হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (রেকর্ড নং জিই-৭৪৮৮, এসটিএইচভি ২৪২২) ও সাগর সেন[২]

  • অয়ি বিষাদিনী বীণা, আয় সখী, গা লো সেই-সব পুরানো গান

    অয়ি বিষাদিনী বীণা, আয় সখী, গা লো সেই-সব পুরানো গান— হল একটি রবীন্দ্রসংগীত। ১৪ ছত্রের এই গানটি[১] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতি-সংকলন গীতবিতান গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডের অন্তর্গত “জাতীয় সংগীত” অংশের ২ সংখ্যক গান। অনুমান করা হয় যে, এই গানটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত[২] সঞ্জীবন সভার (প্রতিষ্ঠাকাল ১২৮৩ বা ১২৮৪ বঙ্গাব্দ) অনুপ্রেরণায় রচিত এবং সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ স্বকণ্ঠে ১২৮৩ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে রাজা বদনচাঁদের টালার বাগানে হিন্দুমেলা প্রাঙ্গনে পরিবেশন করেছিলেন। সজনীকান্ত দাস অনুমান করেন, গানটির রচনাকাল ১৮৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮৭৮ সালের অগস্ট মাসের মধ্যবর্তী কোনও এক সময়।[১] কিরণশশী দে লিখেছেন, এই গানটি রবীন্দ্রনাথের বালক বয়সের রচনা – রচনাকালে তাঁর বয়স ছিল ১৩ কি ১৪ বছর মাত্র।[২] গীতবিতান সূচিপত্র গ্রন্থে এটির রাগ বাহার ও তাল কাওয়ালি বলে উল্লিখিত[৩] হলেও গানটির স্বরলিপি পাওয়া যায় না। দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত জাতীয় সঙ্গীত গ্রন্থের ২য় সংস্করণে (ভাদ্র ১২৮৫/অক্টোবর ১৮৭৮[৩]) গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, এই গ্রন্থের প্রথম সংস্করণে রবীন্দ্রনাথের কোনও গান অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এরপর নরেন্দ্রনাথ দত্ত (পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ নামে পরিচিত) ও বৈষ্ণবচরণ বসাক সম্পাদিত সঙ্গীতকল্পতরু গ্রন্থের (ভাদ্র ১২৯৪) “জাতীয়সঙ্গীত” বিভাগে গানটি সংকলিত হয়। দুর্গাদাস লাহিড়ী সম্পাদিত বাঙ্গালীর গান গ্রন্থেও (১৩১২) গানটি রবীন্দ্রনাথের নামেই রাগ ও তাল উল্লেখ সহ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।[১] রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর প্রকাশিত গীতবিতান গ্রন্থের ৩য় খণ্ডে (আশ্বিন ১৩৫৭) গানটি “জাতীয় সংগীত” অংশে সংকলিত হয়।[৪]

  • অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার

    অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার হল অনন্যা কর্তৃক পুরস্কার। বাংলা ১৪০১ সন (১৯৯৩ সাল) থেকে অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছে। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতিবছর একজন কৃতী নারী-সাহিত্যিক অথবা সাহিত্য-গবেষককে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়।

    পুরস্কারপ্রাপ্তগণ

  • অতুলপ্রসাদী

    অতুলপ্রসাদী হল সঙ্গীতজ্ঞ-কবি অতুলপ্রসাদ সেন কর্তৃক বাংলা ভাষায় রচিত ও সুরারোপিত গান। তিনি হলেন বাংলা সাহিত্যের পঞ্চকবির মধ্যে একজন। তাঁর গানগুলি মূলত স্বদেশি সঙ্গীত, ভক্তিগীতি ও প্রেমের গান; এই তিন ধারায় বিভক্ত। তবে তাঁর ব্যক্তি জীবনের বেদনা সকল ধরনের গানেই কম-বেশি প্রভাব ফেলেছে। এজন্য তাঁর অধিকাংশ গানই হয়ে উঠেছে করুণ-রস প্রধান।[১]

    উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত রবীন্দ্র প্রতিভার প্রভাববলয়ের মধ্যে বিচরণ করেও যাঁরা বাংলা কাব্যগীতি রচনায় নিজেদের বিশেষত্ব প্রকাশ করতে সক্ষম হন, অতুল প্রসাদ ছিলেন তাদের অন্যতম। সমকালীন গীতিকারদের তুলনায় তার সঙ্গীত সংখ্যা সীমিত হলেও অতুল প্রসাদের অনেক গানে সাঙ্গীতিক মৌলিকত্ব পরিলক্ষিত হয়; আর সে কারণেই তিনি বাংলা সঙ্গীত জগতে এক স্বতন্ত্র আসন লাভ করেছেন।[২]

    অতুলপ্রসাদ বাংলা গানে ঠুংরি ধারার প্রবর্তক। তিনিই প্রথম বাংলায় গজল রচনা করেন।[২] তাঁর রচিত বাংলা গজলের সংখ্যা ৬-৭টি।[৩] গীতিগুঞ্জ (১৯৩১) গ্রন্থে তার সমুদয় গান সংকলিত হয়।[৪] এই গ্রন্থের সর্বশেষ সংস্করণে (১৯৫৭) অনেকগুলি অপ্রকাশিত গান প্রকাশিত হয়।[১] অতুলপ্রসাদের গানের সংখ্যা ২০৮।[৫][২] অতুলপ্রসাদ সেনের কয়েকটি বিখ্যাত গান হল মিছে তুই ভাবিস মন, সবারে বাস রে ভালো,বঁধুয়া, নিঁদ নাহি আঁখিপাতে, একা মোর গানের তরী, কে আবার বাজায় বাঁশি, ক্রন্দসী পথচারিণী ইত্যাদি। তাঁর রচিত দেশাত্মবোধক গানগুলির মধ্যে প্রসিদ্ধ উঠ গো ভারত-লক্ষ্মী, বলো বলো বলো সবে, হও ধরমেতে ধীর।[৬][৪] তাঁর মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা! গানটি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অণুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। অতুলপ্রসাদের গানগুলি দেবতা, প্রকৃতি, স্বদেশ, মানব ও বিবিধ নামে পাঁচটি পর্যায়ে বিভক্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গানের বিশেষ গুণগ্রাহী ছিলেন। অতুলপ্রসাদী গান নামে পরিচিত এই ধারার একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী হলেন কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়।

    গানের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো গোছানো মানুষ ছিলেন না অতুলপ্রসাদ। তাই আসরে তাঁর গান গাওয়া হলে অনেকেই ভুল করে ভাবতেন রবীন্দ্রগান। লাজুক গীতিকবির জন্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে ১৯২৫ সালে প্রথম গ্রন্থিত হল তাঁর ‘কয়েকটি গান’।[২] তাঁর সর্বমোট গানের সংখ্যা মাত্র ২০৮টি এবং সে সবের মধ্যে মাত্র ৫০-৬০টি গান গীত হিসেবে প্রাধান্য পায়। অতুল প্রসাদের মামাতো বোন সাহানা দেবীর সম্পাদনায় ৭১টি গান স্বরলিপিসহ কাকলি (১৯৩০) নামে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়। তার অপর গানগুলিও গীতিপুঞ্জ এবং কয়েকটি গান নামে দুটি পৃথক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। ১৯২২-২৩ সালের দিকে কলকাতা থেকে প্রথম অতুল প্রসাদের গানের রেকর্ড বের হয় সাহানা দেবী ও হরেন চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে।

    অমল হোম তাঁকে বলেছেন “অক্লান্তকণ্ঠ”। দিলীপকুমার রায় বলেছেন, ‘‘আমাদের আগেকার যুগে ভক্তির গানে ফুলের মতন ফুটে উঠছিলেন চারজন কবি: দ্বিজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথ, রজনীকান্ত ও অতুলপ্রসাদ। এঁদের মধ্যে অতুলপ্রসাদ সর্বকনিষ্ঠ তথা অনলংকৃত কবি… তাঁর গান শুনতে শুনতে মনে হয়, দৈনন্দিন ঘরকন্নার মধ্য দিয়ে যেন একটি সরল উচ্ছ্বাসী কবি-হৃদয় নিজের মনের কথা বলে চলেছে তার আনন্দ বেদনা আশা-নিরাশার পসরা নিয়ে।’

  • বাংলাদেশের লোক সাহিত্য

    বাংলাদেশের লোক সাহিত্য বাংলা সাহিত্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। যদিও এর সৃষ্টি ঘটেছে গ্রমীণ জনগোষ্ঠির মাধ্যমে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রসার ঘটেছে মৌখিকভাবে, তথাপি বাংলা সাহিত্যকে এ লোক সাহিত্য ব্যাপ্তি প্রদান করেছে, করেছে সমৃদ্ধ। পৃথক পৃথক ব্যক্তি-বিশেষের সৃষ্টি পরিণত হয়েছে জনগোষ্ঠির ঐতিহ্যে যার মাধ্যমে প্রকাশ ঘটেছে ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি ও চিন্তা চেতনার।

    ইতিহাস

    ৩০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এই অঞ্চলে পর্যায়ক্রমে মৌর্য রাজবংশ, গুপ্ত রাজবংশ, পাল রাজবংশ, সেন রাজবংশ এবং মুসলিমদের আগমন ঘটেছে। এই অঞ্চলের মানুষ এদের জীবনযাত্রা এবং সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। এরপর পর্তুগাল, ফ্রান্স, এবং ব্রিটিশদের জাহাজ এদেশের বন্দরনোঙর ফেলেছে। এরা পণ্যের পাশাপাশি সংস্কৃতিও এদেশে রেখে গেছে। প্রতিটি জাতি শুধু শারীরিকভাবে নয়, সংস্কৃতিরও সহায়তায় এদেশে নিজেদের ছাপ রেখে গেছে এবং এভাবেই এদেশের সংস্কৃতির ভিত রচিত হয়েছে।

    বাংলা লোক সাহিত্যের সাধক

    পল্লীর জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ লোক সাহিত্যে অবদান রেখেছেন। এদের একটি বড় অংশ লোক-কবি যাদের সাধারণত বয়াতি বলা হয়ে থাকে। প্রাচীন রাশিয়ার BAYAT শব্দ থেকে বয়াতি শব্দের উৎপত্তি।বাংলার মাঝিরা নৌকায় পাল তুলে মনের সুখে ভাটিয়ালি গান গায়। দেশের উত্তরাঞ্চলের গাড়োয়ান বা গরুর গারির চালক গাড়ি চালাতে চালাতে ভাওয়াইয়া গানের সুর তুলে। বাউলেরা একতারা বাজিয়ে তাদের তত্ত্ব তুলে ধরেন।[১]
    তাদের কীর্তি আমাদের সামনে তুলে ধরতে কিছু মানুষ অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। নেত্রকোণা জেলার আইথর নামক স্থানের অধিবাসী চন্দ্রকুমার দে মৈমনসিংহ গীতিকা সংগ্রহ করেন। ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন এই গানগুলো সম্পাদনা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রকাশ করেন। পশ্চিমবঙ্গের আশুতোষ ভট্টাচার্য এবং বাংলাদেশের ড. মযহারুল ইসলাম সাম্প্রতিক সময়ে লোকসাহিত্য সম্পর্কে অনেক গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।

    মৌখিক সাহিত্য এবং এর প্রভাব

    লোক সাহিত্য মূলত মৌখিক সাহিত্য। ফলে এধরনের সাহিত্য স্মৃতিসহায়ক কৌশল, ভাষার গঠনকাঠামো এবং শৈলীর উপরও নির্ভর করে। এদেশের লোক সাহিত্য সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করছে। এগুলো হচ্ছে মহাকাব্য, কবিতানাটক, লোক গল্প, প্রবাদ বাক্য, গীতি কাব্য প্রভৃতি। লোক সাহিত্যের এই সম্পদগুলো সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে অথবা অন্য কোন উপায়ে এখনো এই অঞ্চলে টিকে রয়েছে। বহুবছর ধরে এদেশে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। বাংলাদেশের লোক সাহিত্য এই জাতিগোষ্ঠীগুলো দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। ফলশ্রুতিতে বর্তমান বাংলাদেশের বহুমুখী বৈচিত্র্যপূর্ণ বিশাল লোক সাহিত্যের একাংশের ব্যাখ্যায় ইতিহাসের প্রয়োজন পরে।

    বিস্তৃতি

    বাংলাদেশের লোক সাহিত্য লোক সাহিত্যের প্রচলিত সকল শাখায় নিজেকে বিস্তার করেছে। এগুলো হচ্ছে গল্প, সংগীত, ধাঁধা, প্রবাদ বাক্য, কুসংস্কার ও মিথ।

    লোকগীতি

    বাংলাদেশের সংগীত মূলত কাব্যধর্মী। এদেশীয় সংগীতে বাদ্যযন্ত্রের চেয়ে মৌখিক সুরের দক্ষতার উপর অধিক নির্ভরশীলতা লক্ষ করা যায়। লোকগীতিকে আমরা সাতটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করতে পারি। এগুলো হচ্ছেঃ প্রেম, ধর্মীয় বিষয়, দর্শন ও ভক্তি, কর্ম ও পরিশ্রম, পেশা ও জীবিকা, ব্যাঙ্গ ও কৌতুক এবং এসবের মিশ্রণ। অন্যদিকে এদেশীয় লোকসাহিত্যে আমরা গানের বিভিন্ন শাখা দেখতে পাই। এগুলো হচ্ছেঃ বাউল গান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, গম্ভীরা, কবিগান, জারিগান, সারিগান, ঘাটু গান,যাত্রা গান ,ঝুমুর গান, জাগের গান প্রভৃতি।

    বাউল গান

    লালনের জীবদ্দশায় আঁকা তাঁর একমাত্র ছবি। এঁকেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর

    মূল নিবন্ধঃ বাউল
    বাউল শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে মতান্তর রয়েছে।ইতিহাসবিদদের মতে, সতেরো শতকে বাংলাদেশে বাউল মতের উদ্ভব হয়। এ মতের প্রবর্তক হলেন আউল চাঁদ ও মাধববিবি। বীরভদ্র নামে এক বৈষ্ণব মহাজন সেই সময়ে একে জনপ্রিয় করে তোলেন। লালন সাঁইয়ের গানের মধ্য দিয়ে বাউল ব্যাপক পরিচতি লাভ করে। ২০০৫ সালে ইউনেস্কো বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মাঝে বাউল গানকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে।[২]

    সিলেটের মরমী সাহিত্য

    মূল নিবন্ধঃ সিলেটের মরমী সাহিত্য
    বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন লোকঐতিহ্যের অনবদ্য ফসল মরমী সঙ্গীত বা মরমীবাদের গান। প্রাচীন লোকসাহিত্য বা লোকঐতিহ্যের একাংশের রুপান্তর মরমী সাহিত্য। উল্লেখ্য যে, মরমী সঙ্গীত ও বাউল গানকে অধুনা যুগে যদিও এক করে ভাব হয়, কিন্তু এর ইতিহাস সন্ধানি সৈয়দ মোস্তফা কামাল ও অন্যান্যদের কাছে এর ভাবধারায় ভিন্নতা রয়েছে বলে অভিমত পাওয়া যায়।[৩][৪]

    ভাওয়াইয়া

    মূল নিবন্ধঃ ভাওয়াইয়া
    ভাওয়াইয়া গানের আকরভূমি রংপুর।[৫] বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের নদী-নালা কম থাকায় গরুর গাড়িতে চলাচলের প্রচলন ছিল। আর গরুর গাড়ির গাড়োয়ান রাত্রে গাড়ি চলাবস্থায় বিরহ ভাবাবেগে কাতর হয়ে আপন মনে গান ধরে। উঁচু-নিচু রাস্তায় গাড়ির চাকা পড়লে তার গানের সুরে আধো-ভাঙ্গা বা ভাঁজ পড়ে। এই রকম সুরে ভাঙ্গা বা ভাঁজ পড়া গীতরীতিই ‘ভাওয়াইয়া’ গানে লক্ষণীয়। এসকল গানে স্থানীয় সংস্কৃতি, জনপদের জীবনযাত্রা, তাদের কর্মক্ষেত্র, পারিবারিক ঘটনাবলী ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়।

    ভাটিয়ালি

    মূল নিবন্ধঃ ভাটিয়ালি
    ভাটিয়ালী বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের জনপ্রিয় লোকগীতি। বিশেষ করে নদ-নদী পূর্ণ ময়মনসিংহ অঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর-পূর্ব দিকের অঞ্চলগুলোতেই ভাটিয়ালী গানের মূল সৃষ্টি, চর্চাস্থল এবং সেখানে এ গানের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। বাউলদের মতে ভাটিয়ালী গান হলো তাদের প্রকৃতিতত্ত্ব ভাগের গান।[৬] ভাটিয়ালী গানের মূল বৈশিষ্টা হলো এ গানগুলো রচিত হয় মূলত মাঝি, নৌকা, দাড়, গুন ইত্যাদি বিষয়ে।

    গম্ভীরা

    মূল নিবন্ধঃ গম্ভীরা
    বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ও পশ্চিমবঙ্গের মালদহ অঞ্চলে গম্ভীরার প্রচলন রয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা অঞ্চলের গম্ভীরার মুখ্য চরিত্রে নানা-নাতি খুব জনপ্রিয়।সনাতন ধর্মালম্বীদের অন্যতম দেবতা শিব। শিবের অপর এক নাম‘গম্ভীর’। শিবের উৎসবে শিবের বন্দনা করে যে গান গাওয়া হত- সেই গানের নামই কালক্রমে হয়ে যায়‘গম্ভীরা’। শিব> গম্ভীর> গম্ভীরা। পালা-গম্ভীরায় অভিনয়ের মাধ্যমে এক একটা সমস্য তুলে ধরা হত। চৈত্র-সংক্রান্তিতে পালা-গম্ভীরা পরিবেশন করা হত। [৭]

    কবিগান

    মূল নিবন্ধঃ কবিগান
    কবিগান বাংলা লোকসংগীতের একটি বিশেষ ধারা। এই ধারায় লোককবিরা প্রতিযোগিতামূলক গানের আসরে অংশগ্রহণ করে থাকেন। কবিগান সাধারণত দুটি দলের দ্বারা গীত হয়। প্রত্যেকটি দলের নেতৃত্বে থাকেন একজন “কবিয়াল” বা “সরকার”। তার সহকারী গায়কদের বলা হয় “দোহার”। এঁরা সাধারণত নেতার কথাগুলিই পুণরাবৃত্তি করেন।[৮]

    জারিগান

    মূল নিবন্ধঃ জারিগান
    জারি শব্দটির অর্থ বিলাপ বা ক্রন্দন। এ শব্দটির উৎস-মূল ফার্সি ভাষা। তবে, বাংলায় এসে শব্দটি অর্থ ব্যাপকতা লাভ করেছে। বাংলাদেশে মহররমের বিশেষ দিনে কারবালার শোকাবহ ঘটনা অবলম্বনে নৃত্যগীত সহকারে যে কাহিনী পরিবেশিত হয় তা সাধারণভাবে জারিগান বলে পরিচিত। ১৭শ শতক থেকে বাংলায় এই গানের ধারা প্রচলিত।

    মৈমনসিংহ গীতিকা

    মূল নিবন্ধঃ মৈমনসিংহ গীতিকা
    ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রচলিত পালাগানগুলোকে একত্রে মৈমনসিংহ গীতিকা বলা হয়। এই গানগুলো প্রাচীন কাল থেকে মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে আসছে। তবে ১৯২৩-৩২ সালে ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন এই গানগুলো সম্পাদনা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রকাশ করেন। বর্তমান নেত্রকোণা জেলার আইথর নামক স্থানের আধিবাসী চন্দ্রকুমার দে এসব গাঁথা সংগ্রহ করছিলেন।

    পূর্ববঙ্গ-গীতিকা

    মূল নিবন্ধঃ পূর্ববঙ্গ-গীতিকা
    পূর্ববঙ্গ অঞ্চলের প্রচলিত লোকসাহিত্যকে একত্রে পূর্ববঙ্গ গীতিকা বলা হয়। প্রাচীন কাল থেকে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে আসা পালাগুলি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ১৯২৬ সালে ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ সাহায্যে পালাগুলো সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। পরে ১৯৭১-১৯৭৫ সালে ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক ও সাত খণ্ডে প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা প্রকাশ করেন।

    সিলেট গীতিকা

    মূল নিবন্ধঃ সিলেট গীতিকা
    সিলেটের লোকমানুষের রচিত মৌখিক কেচ্ছা, কাহিনী, যাত্রা-পালা ইত্যাদি লোকভাণ্ডারকে এক সাথে সিলেট গীতিকা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সিলেট অঞ্চলের প্রাচীন লোকমানুষের দৈনন্দিন জীবনধারা, আদিবাসী মানুষের জীবন-জীবিকা, সামন্ততান্ত্রিক শাসন প্রণালী, গ্রামীণ লোকচার, আবেগ অনুভূতি, প্রেম-বিরহ, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং মানবিকতা সম্মেলিত গাঁথাকেই সিলেট গীতিকার উৎস বলে ধরা হয়। অধ্যাপক আসদ্দর আলীর পদত্ত তালিকা অনুসারে ১২০টি লোকগাথাকে সিলেট গীতিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে [৯] এছাড়া চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্যভূষণ ১৯৬৮ সালে বাংলা একাডেমী থেকে ১০ টি গীতিকা নির্বাচন করে একত্রে সিলেট গীতিকা নাম দিয়ে প্রকাশ করেন।[১০]

    লোকগল্প

    লোকগল্প হচ্ছে সেসমস্ত গল্প মানুষের মুখে মুখে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পাড়ি দিচ্ছে। এগুলো গদ্য আকারে রচিত এবং সরল কিংবা জটিল হতে পারে। বিষয়, অর্থ এবং গঠনের উপর ভিত্তি করে লোকগল্প হতে পারে রূপকথা, মিথ, অ্যাডভেঞ্চার গল্প, বীরত্বের গল্প, ঐতিহাসিক গল্প, মনীষীদের গল্প। এদেশীয় গল্পের চরিত্রগুলো মূলত ভাগ্যনির্ভর এবং গল্পগুলোতে জ্ঞান, বুদ্ধির বদলে জাদুকরী শক্তির প্রাধান্য দেখা যায়।

  • বাংলা সাহিত্য

    রচিত সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্য নামে পরিচিত। আনুমানিক খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনার সূত্রপাত হয়। খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত বৌদ্ধ দোহা-সংকলন চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন। আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আরও তিনটি গ্রন্থের সঙ্গে চর্যাগানগুলো নিয়ে সম্পাদিত গ্রন্থের নাম দেন ” হাজার বছরের পুরনো বাঙ্গালা ভাষায় রচিত বৌদ্ধ গান ও দোহা “। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য ছিল কাব্যপ্রধান। ইসলাম ধর্ম, হিন্দু ধর্ম ও বাংলার লৌকিক ধর্মবিশ্বাসগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই সময়কার বাংলা সাহিত্য। ইসলামি ধর্মসাহিত্য,পীরসাহিত্য,বাউল পদাবলি,পবিত্র কুরআনের বঙ্গানুবাদ,মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলি, শাক্তপদাবলি, বৈষ্ণব সন্তজীবনী, রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতের বঙ্গানুবাদ, নাথসাহিত্য ইত্যাদি ছিল এই সাহিত্যের মূল বিষয়। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত হয় খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণের যুগে কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। এই সময় থেকে ধর্মীয় বিষয়বস্তুর বদলে মানুষ, মানবতাবাদ ও মানব-মনস্তত্ত্ব বাংলা সাহিত্যের প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর বাংলা সাহিত্যও দুটি ধারায় বিভক্ত হয়: ঢাকা-কেন্দ্রিক বাংলাদেশের সাহিত্যকলকাতা-কেন্দ্রিক পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য। বর্তমানে বাংলা সাহিত্য বিশ্বের একটি অন্যতম, সমৃদ্ধ সাহিত্যধারা হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে।

    যুগ বিভাজন

    মূল নিবন্ধ: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস

    বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাস প্রধানত তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত:[১][২]

    • আদিযুগ বা প্রাচীন যুগ (আনুমানিক ৬৫০ খ্রি. মতান্তরে ৯৫০ খ্রি.–১২০০ খ্রি.)
    • মধ্যযুগ (১২০১ খ্রি.–১৮০০ খ্রি.)
    • আধুনিক যুগ (১৮০১ খ্রি.–বর্তমান কাল)

    প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাজনৈতিক ইতিহাসের মতো নির্দিষ্ট সালতারিখ অনুযায়ী সাহিত্যের ইতিহাসের যুগ বিভাজন করা সম্ভব নয়। যদিও সাহিত্যের ইতিহাস সর্বত্র সালতারিখের হিসেব অগ্রাহ্য করে না। সাহিত্যকর্মের বৈচিত্র্যে ও বৈশিষ্ট্যে নির্দিষ্ট যুগের চিহ্ন ও সাহিত্যের বিবর্তনের ধারাটি বিশ্লেষণ করেই সাহিত্যের ইতিহাসে যুগবিভাগ করা হয়ে থাকে।

    আদিযুগ বা প্রাচীন যুগ

    বিষ্ণুর সম্মুখে প্রণত জয়দেব; বাংলার বৈষ্ণব সাহিত্যে তাঁর গীতগোবিন্দম্ কাব্যের প্রভাব অনস্বীকার্য। এমনকি রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনে রচিত কাব্যেও জয়দেবের প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর।

    বাংলা সাহিত্যের উন্মেষের পূর্বে বাংলায় সংস্কৃত, প্রাকৃতঅবহট্‌ঠ ভাষায় সাহিত্য রচনার রীতি প্রচলিত ছিল। এই সাহিত্যের মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যের আদি অধ্যায়ের সূচনা হয়।[৩] ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কি আক্রমণের বহু পূর্বেই বাঙালিরা একটি বিশেষ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। উন্মেষ ঘটে বাংলা ভাষারও। তবে প্রথম দিকে বাংলায় আর্য ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি ও অনার্য সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটেনি। সংস্কৃত ভাষায় লেখা অভিনন্দসন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত, শরণ, ধোয়ী, গোবর্ধন, উমাপতি ধরের কাব্যকবিতা, জয়দেবের গীতগোবিন্দম্, কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়সদুক্তিকর্ণামৃত নামক দুটি সংস্কৃত শ্লোকসংগ্রহ; এবং অবহট্‌ঠ ভাষায় রচিত কবিতা সংকলন প্রাকৃত-পৈঙ্গল বাঙালির সাহিত্য রচনার আদি নিদর্শন। এই সকল গ্রন্থ বাংলা ভাষায় রচিত না হলেও সমকালীন বাঙালি সমাজ ও মননের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়।[৪][৫] পরবর্তীকালের বাংলা বৈষ্ণব সাহিত্যে গীতগোবিন্দম্ কাব্যের প্রভাব অনস্বীকার্য।

    বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন হল চর্যাপদ। খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত চর্যা পদাবলি ছিল সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাধনসংগীত। আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিকগণ বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন যে চর্যার ভাষা প্রকৃতপক্ষে হাজার বছর আগের বাংলা ভাষা। সমকালীন বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্র এই পদগুলিতে প্রতিফলিত হয়েছে। সাহিত্যমূল্যের বিচারে কয়েকটি পদ কালজয়ী।

    মধ্যযুগ

    মধ্যযুগ ১২০০ থেকে ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সম্প্রসারিত। মধ্যযুগের প্রথম নিদর্শন বড়ু চণ্ডীদাসেরশ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। আনুমানিক চৌদ্দ শতকের শেষার্ধে বা পনেরো শতকের প্রথমার্ধে বড়ু চণ্ডীদাস রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনি অবলম্বনে এ কাব্য রচনা করেন। এ সময় মৈথিলি কবি বিদ্যাপতি ব্রজবুলি ভাষায় রাধাকৃষ্ণের প্রেমবিষয়ক পদ রচনা করেছিলেন। মধ্যযুগের প্রথম মুসলমান কবি শাহ মুহম্মদ সগীর পঞ্চদশ শতকে প্রণয়োপখ্যান জাতীয় কাব্য “ইউসুফ-জোলেখা” রচনা করেন। এর বাইরে অনুবাদসাহিত্য মধ্যযুগের অনেকখানি অংশজুড়ে আছে। এ ধারার সূত্রপাত হয় কবি কৃত্তিবাস কর্তৃক রামায়ণের বঙ্গানুবাদের মাধ্যমে। পরবর্তীতে বাংলায় আরও অনূদিত হয়েছে অসংখ্য গ্রন্থ। মধ্যযুগের বিশাল পরিসর জুড়ে ছিলো মঙ্গলকাব্য। দেবদেবীর মাহাত্ম্যসূচক এই কাব্যধারার সূত্রপাত হয় পনের শতকে। তবে ষোল শতকে এর সর্বাধিক প্রসার ঘটে। ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গল, শিবমঙ্গল বা শিবায়ন, চণ্ডীমঙ্গল ইত্যাদি এ পর্যায়েরই নানা শাখা। এই ধারার অন্যতম কবি মাণিক দত্ত, কানাহরি দত্ত, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপিলাই, কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর প্রমুখ। শ্রীচৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) আবির্ভাবের ফলে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ সমৃদ্ধির পথে অনেকখানি এগিয়ে যায়। মধ্যযুগেই আরাকানের রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের চর্চা আরম্ভ হয়। এছাড়া শাক্ত পদাবলী, নাথসাহিত্য, বাউল ও অপরাপর লোকসঙ্গীত, ময়মনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ-গীতিকা ইত্যাদি অমূল্য সাহিত্য মধ্যযুগেরই সৃষ্টি।

    ত্রয়োদশ শতাব্দী: বাংলা সাহিত্যের “অন্ধকার যুগ”

    বাংলা সাহিত্যের ১২০১১৩৫০ খ্রি. পর্যন্ত সময়কে “অন্ধকার যুগ” বা “বন্ধ্যা যুগ” বলে কেউ কেউ মনে করেন। হুমায়ুন আজাদ তার “লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী” গ্রন্থে (পৃ. ১৭) লিখেছেন- “১২০১ থেকে ১৩৫০ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে রচিত কোন সাহিত্য কর্মের পরিচয় পাওয়া যায়না বলে এ-সময়টাকে বলা হয় ‘অন্ধকার যুগ’। পণ্ডিতেরা এ-সময়টাকে নিয়ে অনেক ভেবেছেন, অনেক আলোচনা করেছেন, কিন্তু কেউ অন্ধকার সরিয়ে ফেলতে পারেন নি।এ- সময়টির দিকে তাকালে তাই চোখে কোন আলো আসেনা, কেবল আঁধার ঢাকা চারদিক।” কিন্তু, ওয়াকিল আহমদ তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের পুরাবৃত্ত’ (পৃ. ১০৫)-এ লিখেছেন- “বাংলা সাতিহ্যের কথিত ‘অন্ধকার যুগ’ মোটেই সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বের যুগ ছিল না। ধর্ম -শিক্ষা শিল্প চর্চার দায়িত্ব যাদের উপর ন্যস্ত ছিল, তারা সীমিত আকারে হলেও শিক্ষা সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। তবে, কি হিন্দু কি মুসলমান কেউ লোকভাষা বাংলাকে গ্রহণ করেননি। বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন না থাকার এটাই মুখ্য কারণ।”

    এসময়ের সাহিত্য নিদর্শন: ১. প্রাকৃত ভাষার গীতি কবিতার সংকলিত গ্রন্থ ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’ ২. রামাই পণ্ডিত রচিত ‘শূন্যপুরাণ’ (গদ্যপদ্য মিশ্রিত) ৩. হলায়ুধ মিশ্র রচিত ‘সেক শুভোদয়া’ (গদ্যপদ্য মিশ্রিত) ৪. ডাক ও খনার বচন

    • ‘নিরঞ্জনের উষ্মা’ শূন্যপুরাণ এর অন্তর্গত একটি কবিতা।[৬]

    আধুনিক যুগ

    মূলত বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগ নিয়ে মত পার্থক্য থাকলেও,মোটামুটি ভাবে ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দে ভারত চন্দ্রের মৃত্যুর পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূত্রপাত বলে নানা সমালোচক মতপ্রকাশ করেছেন। কালের দিক থেকে আধুনিক যুগকে কয়েকটি ধাপে ভাগ করা যায়- ১৭৬০-১৭৯৯খ্রিঃ(আধুনিক যুগের প্রথম পর্ব) ১৮০০-১৮৫৮খ্রিঃ(আধুনিক যুগের দ্বিতীয় পর্ব) ১৮৫৯-১৯০০খ্রিঃ(আধুনিক যুগের তৃতীয় পর্ব) ১৯০১-১৯৪৭খ্রিঃ(আধুনিক যুগের চতুর্থ পর্ব) ১৯৪৮-২০০০খ্রিঃ(আধুনিক যুগের পঞ্চম পর্ব) ২০০১খ্রিঃ- বর্তমানকাল(আধুনিক যুগের ষষ্ঠ পর্ব)

    বিভিন্ন সময়ের বিশেষায়িত সাহিত্যধারা-সমূহ

    চর্যাপদ

    মূল নিবন্ধ: চর্যাপদ

    চর্যাপদ পুঁথির একটি পৃষ্ঠা

    চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীনতম কাব্য তথা সাহিত্য নিদর্শন। নব্য ভারতীয় আর্যভাষারও প্রাচীনতম রচনা এটি।[৭] খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত এই গীতিপদাবলির রচয়িতারা ছিলেন সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ। বৌদ্ধ ধর্মের গূঢ়ার্থ সাংকেতিক রূপবন্ধে ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যেই তারা পদগুলি রচনা করেছিলেন। বাংলা সাধন সংগীতের শাখাটির সূত্রপাতও এই চর্যাপদ থেকেই। এই বিবেচনায় এটি ধর্মগ্রন্থ স্থানীয় রচনা। একই সঙ্গে সমকালীন বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্রাবলি এই পদগুলিতে উজ্জ্বল। এর সাহিত্যগুণ আজও চিত্তাকর্ষক। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থশালা থেকে চর্যার একটি খণ্ডিত পুঁথি উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে চর্যাপদের সঙ্গে বাংলা ভাষার অনস্বীকার্য যোগসূত্র বৈজ্ঞানিক যুক্তিসহ প্রতিষ্ঠিত করেন। চর্যার প্রধান কবিগণ হলেন লুইপাদ, কাহ্নপাদ, ভুসুকুপাদ, শবরপাদ প্রমুখ।

    শ্রীকৃষ্ণকীর্তন

    মূল নিবন্ধ: শ্রীকৃষ্ণকীর্তন

    শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ুচণ্ডীদাস নামক জনৈক মধ্যযুগীয় কবি রচিত রাধাকৃষ্ণের প্রণয়কথা বিষয়ক একটি আখ্যানকাব্য। [৮] ১৯০৯ সালে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রাম থেকে এই কাব্যের একটি পুথি আবিষ্কার করেন। ১৯১৬ সালে তারই সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামে পুথিটি প্রকাশিত হয়।[৯] যদিও কারও কারও মতে মূল গ্রন্থটির নাম ছিল শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভকৃষ্ণের জন্ম, বৃন্দাবনে রাধার সঙ্গে তার প্রণয় এবং অন্তে বৃন্দাবন ও রাধা উভয়কে ত্যাগ করে কৃষ্ণের চিরতরে মথুরায় অভিপ্রয়াণ – এই হল শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মূল উপজীব্য। আখ্যানভাগ মোট ১৩ টি খণ্ডে বিভক্ত। পুথিটি খণ্ডিত বলে কাব্যরচনার তারিখ জানা যায় না। তবে কাব্যটি আখ্যানধর্মী ও সংলাপের আকারে রচিত বলে প্রাচীন বাংলা নাটকের একটি আভাস মেলে এই কাব্যে। গ্রন্থটি স্থানে স্থানে আদিরসে জারিত ও গ্রাম্য অশ্লীলতাদোষে দুষ্ট হলেও আখ্যানভাগের বর্ণনানৈপূণ্য ও চরিত্রচিত্রণে মুন্সিয়ানা আধুনিক পাঠকেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। চর্যাপদের পর ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ বাংলা ভাষার দ্বিতীয় প্রাচীনতম আবিষ্কৃত নিদর্শন। বাংলা ভাষাতত্ত্বের ইতিহাসে এর গুরুত্ব তাই অপরিসীম। অপরদিকে এটিই প্রথম বাংলায় রচিত কৃষ্ণকথা বিষয়ক কাব্য। মনে করা হয়, এই গ্রন্থের পথ ধরেই বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলির পথ সুগম হয়।

    মধ্যযুগীয় বাংলা অনুবাদ সাহিত্য

    মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বিস্তৃত অঙ্গন জুড়ে অনুবাদ সাহিত্যের চর্চা হয়েছিল এবং পরিণামে এ সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধিসাধনে অনুবাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অপরিসীম।সকল সাহিত্যের পরিপুষ্টিসাধনে অনুবাদমূলক সাহিত্যকর্মের বিশিষ্ট ভূমিকা আছে।বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এর ব্যতীক্রম পরিলক্ষিত হয় না।”সমৃদ্ধতর নানা ভাষা থেকে বিচিত্র নতুন ভাব ও তথ্য সঞ্চয় করে নিজ নিজ ভাষার বহন ও সহন ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলাই অনুবাদ সাহিত্যের প্রাথমিক প্রবণতা।”ভাষার মান বাড়ানোর জন্য ভাষার ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হয়,আর তাতে সহায়তা করে অনুবাদকর্ম।উন্নত সাহিত্য থেকে ঋণ গ্রহণ করা কখনো অযৌক্তিক বিবেচিত হয়নি।উন্নত ও সমৃদ্ধ ভাষা-সাহিত্যের সান্নিধ্যে এলে বিভিন্ন বিষয়ের প্রতিশব্দ তৈরি করা সম্ভব হয়,অন্য ভাষা থেকে প্রয়োজনীয় শব্দও গ্রহণ করা যায়।অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ বক্তব্য আয়ত্তে আসে।ভাষা ও সাহিত্যের যথার্থ সমৃদ্ধির লক্ষ্যে শ্রেষ্ঠ ও সম্পদশালী ভাষায় উৎকর্ষপূর্ণ সাহিত্যসৃষ্টির অনুবাদ একটি আবশ্যিক উপাদান।

    জ্ঞানবিজ্ঞানের বিষয়ের বেলায় শুদ্ধ অনুবাদ অভিপ্রেত।কিন্তু সাহিত্যের অনুবাদ শিল্পসম্মত হওয়া আবশ্যিক বলেই তা আক্ষরিক হলে চলে না।ভিন্ন ভাষার শব্দ সম্পদের পরিমাণ, প্রকাশক্ষমতা ও বাগভঙ্গি অনুযায়ী ভিন্ন ভাষায় ব্যক্ত কথায় সংকোচন, প্রসারণ, বর্জন ও সংযোজন আবশ্যিক হয়।মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে যে অনুবাদের ধারাটি সমৃদ্ধি লাভ করে তাতে সৃজনশীল লেখকের প্রতিভা কাজ করেছিল।সে কারণে মধ্যযুগের এই অনুবাদকর্ম সাহিত্য হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে।

    বুলিকে লেখ্য ভাষার তথা সাহিত্যের ভাষায় উন্নীত করার সহজ উপায় হচ্ছে অনুবাদ।অন্যভাষা থেকে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি জ্ঞান-মননের বিভিন্ন বিসয় অনুবাদ করতে হলে সে বিষয়ক ভাব-চিন্তা-বস্তুর প্রতিশব্দ তৈরী করা অনেক সময় সহজ হয়,তৈরী সম্ভব না হলে মূল ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করতে হয়।এভাবেই সভ্য জাতির ভাষা-সাহিত্য মাত্রই গ্রহণে-সৃজনে ঋদ্ধ হয়েছে।এ ঋণে লজ্জা নেই।যে জ্ঞান বা অনুভব আমাদের দেশে পাঁচশ বছরেও লভ্য হত না,তা আমরা অনুবাদের মাধ্যমে এখনই পেতে পারি।যেমনঃ বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থগুলো,শ্রেষ্ঠ দার্শনিক চিন্তাগুলো,বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলো,সমাজতত্ত্বগুলো-মানবচিন্তার শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলো এভাবে আয়ত্তে আসে।

    চৌদ্দ পনেরো শতকে আমাদের লেখ্য সাহিত্যও তেমনি সংস্কৃত-অবহটঠ থেকে ভাব-ভাষা-ছন্দ গ্রহণ করেছে,পুরাণাদি থেকে নিয়েছে বর্ণিত বিষয় ও বর্ণনাভঙ্গি এবং রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত-প্রণয়োপাখ্যান-ধর্মশাস্ত্র প্রভৃতি সংস্কৃত-ফারসী-আরবী-হিন্দি থেকে অনূদিত হয়েছে আমাদের ভাষায়।এভাবেই আমাদের লিখিত বা শিষ্ট বাংলা ভাষাসাহিত্যের বুনিয়াদ নির্মিত হয়েছিল।

    আদর্শ অনুবাদকের একটা বিশেষ যোগ্যতা অপরিহার্য। ভাষান্তর করতে হলে উভয় ভাষার গতিপ্রকৃতি, বাকভঙ্গি ও বাকবিধির বিষয়ে অনুবাদকের বিশেষ ব্যুৎপত্তির দরকার।তাহলেই ভাষান্তর নিখুঁত ও শিল্পগুণান্বিত হয়।তাই ভাষাবিদ কবি ছাড়া অন্য কেউ কাব্যের সুষ্ঠু অনুবাদে সমর্থ হয় না।মধ্যযুগে অ-কবিও অনুবাদ কর্মে উৎসাহী ছিলেন।তাই অনুবাদে নানা ত্রুটি দেখা যায়।এছাড়া এঁরা নিজেদের সামর্থ্য রুচিবুদ্ধি ও প্রয়োজন অনুসারে মূল পাঠের গ্রহণ-বর্জন ও সংক্ষেপ করেছেন।এজন্য মধ্যযুগের বাংলা ভাষায় কোন তথাকথিত অনুবাদই নির্ভরযোগ্য নয়।সবগুলোই কিছু কায়িক,কিছু ছায়িক,কিছু ভাবিক অনুবাদ এবং কিছু স্বাধীন রচনা।কাব্য সাহিত্যের অনুবাদ আক্ষরিক হতেই পারে না।

    বৈষ্ণব পদাবলি

    বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্য একটি বিস্তৃত কালপর্ব জুড়ে বিন্যস্ত। প্রাকচৈতন্যযুগে বিদ্যাপতি,চণ্ডীদাস এবং চৈতন্য ও চৈতন্য পরবর্তী যুগে গোবিন্দদাস,জ্ঞানদাস বিশেষভাবে খ্যাতিমান হলেও আরও বহু কবি বৈষ্ণব ধর্মাশ্রিত পদ লিখেছেন। তবে ধর্মবর্ণনির্বিশেষে পদাবলি চর্চার এই ইতিহাস চৈতন্যের ধর্মান্দোলনের পরই ছড়িয়েছিল। বৈষ্ণব পদাবলির মূল বিষয়বস্তু হল কৃষ্ণের লীলা এবং মূলত মাধুর্যলীলা। অবশ্য এমন নয় যে কৃষ্ণের ঐতিহ্যলীলার চিত্রণ হয়নি। তবে সংখ্যাধিক্যের হিসেবে কম। আসলে বৈষ্ণব পদাবলির মধ্যে রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা স্তরে স্তরে এমন গভীর ও বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হয়েছে যে অনেকের ধারণা বাংলা সাহিত্যে এ আসলে একটি রোমান্টিক প্রণয়কাব্যের নমুনা। বস্তুত পৃথিবীর অন্যান্য মধ্যযুগীয় সাহিত্যের মতনই এও বিশেষভাবে ধর্মাশ্রিত ও বৈষ্ণব ধর্মের তত্ত্ববিশ্বের উপরে প্রতিষ্ঠিত। তবে যে কোন ধর্মের মতনই বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বেরও আনেকগুলি ঘরানা ছিল। এর মধ্যে তাত্ত্বিকভাবে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল বৃন্দাবনের বৈষ্ণবগোষ্ঠী। এদের ধর্মীয় দর্শনের প্রভাব পড়েছে চৈতন্যপরবর্তী পদকর্তাদের রচনায়। প্রাকচেতন্যযুগের পদাবলিকারদের রচনায় তন্ত্র বা নানা সহজিয়া সাধনপন্থার প্রভাব রয়েছে। ভারতীয় সাধনপন্থা মূলত দ্বিপথগামী- স্মার্ত ও তান্ত্রিকী। শশীভূষণ দাশগুপ্ত এই দুই পথকেই বলেছেন “উল্টাসাধন”[১০] তন্ত্রও হল এই উল্টাসাধনই। দেহভান্ডই হল ব্রহ্মান্ড এই বিশ্বাস সহজিয়া ও তান্ত্রিক পন্থীদের। সেই কারণে চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতির সঙ্গে জ্ঞানদাস বা গোবিন্দদাসদের মূলগত প্রভেদ রয়েছে। বৃন্দাবনের বৈষ্ণবগোষ্ঠী যে তত্ত্ববিশ্ব নির্মাণ করলেন তাতে কৃষ্ণলীলার মূল উৎস ভাগবত ও আন্যান্য পুরাণ হলেও,আসলে কৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা, সর্বোপরি রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা প্রাধান্য পেল। কেননা এঁদের মতে কৃষ্ণের দুই রূপ। প্রথমটি ঐশ্বর্যস্বরূপ ঈশ্বর, যিনি সর্বশক্তিমান। কৃষ্ণের ঘনিষ্ঠ প্রতিটি লোক সে তার মাতাপিতা বা, স্ত্রী বা সখা যেই হোক না কেন- কৃষ্ণকে তারা ভগবান বলে জানেন, সেভাবেই তাকে দেখেন। দ্বিতীয়টি হল মাধুর্যস্বরূপ কৃষ্ণ। এইরূপে কৃষ্ণের লীলার যে বিচিত্র প্রকাশ অর্থাৎ প্রভুরূপে,পুত্ররূপে,সখারূপে, প্রেমিকরূপে সর্বোপরি রাধামাধবরূপে তাতে কোথাও কৃষ্ণের মনে বা কৃষ্ণলীলাসহকারদের মনে কৃষ্ণের ঐশ্বর্যমূর্তির জাগরণ ঘটেনা। ঐশ্বর্যমূর্তি নেই বলে কৃষ্ণভক্তি এখানে শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতর হয়ে শুদ্ধতম হয়েছে। তাই এই মতাবলম্বী বৈষ্ণব কবিসাধকরা কেউ প্রভু, কেউ পুত্র, কেউ সখা, আর কেউবা প্রেমিকরূপে কৃষ্ণকে প্রার্থনা করেছেন। শেষোক্ত কবিসাধকের সংখ্যাই বেশি।

    বৃন্দাবনের ষড়গোস্বামীর অন্যতম রূপ গোস্বামী উজ্জ্বলনীলমণি-তে কৃষ্ণভক্তিকেই একমাত্র রসপরিনতি বলা হয়েছে। এর স্হায়ীভাব হল দুপ্রকারের-

    1. বিপ্রলম্ভ শৃঙ্গার
    2. সম্ভোগ শৃঙ্গার

    আবার এই দুটি প্রকারও আবার চারটি করে উপবিভাগে বিন্যস্ত।

    বিপ্রলম্ভ

    1. পূর্বরাগ
    2. মান (এরও দুটি ভাগ- সহেতু আর নির্হেতু)
    3. প্রেমবৈচিত্ত
    4. প্রবাস (এরও দুটি ভাগ- সুদূর আর অদূর)

    সম্ভোগ

    1. সংক্ষিপ্ত
    2. সংকীর্ণ
    3. সম্পূর্ণ
    4. সমৃদ্ধিমান

    বৈষ্ণব পদাবলিতে কৃষ্ণের লীলাবিলাস এই বিষয়পর্যায়ে বিন্যস্ত। অবশ্য,উপর্যুক্ত চারটি ছাড়াও বিপ্রলম্ভকে আরও সূক্ষাতিসূক্ষভাগে ভাগ করা হয়েছে নানাসময়। যেমন- অনুরাগ, আক্ষেপানুরাগ কিংবা, বিপ্রলব্ধা, খন্ডিতা বা, বাসরসজ্জিতা অথবা অভিসার। পুরাণ ছাড়া সাহিত্যে বা কাব্যে বাংলা বৈষ্ণব পদাবলির উৎস হল- সংস্কৃত পদসংকলন গ্রন্থগুলি। যথা, গাথা সপ্তশতী,……. তাছাড়া জয়দেবের গীতগোবিন্দের কথা তো এ প্রসঙ্গে বলতেই হয়। বিদ্যাপতি মূলত মৈথিলি ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলি রচনা করেছেন। তবে অনেকে এই পদাবলিগুলির ভাষার বিশেষ মাধুর্যের জন্য একে ব্রজবুলি ভাষা বলে কল্পনা করতে চেয়েছেন। প্রাচীন এই মতটিকে পরবর্তীকালের আধুনিক সমালোচক শংকরীপ্রসাদ বসু স্বীকার করে নিয়েছেন এবং বিদ্যাপতিকে একটি সাহিত্যিক ভাষার মহান সর্জক বলে মনে করেছেন।[১১] সে যাই হোক ভাষাগত এই প্রভাব যে পরবর্তীকালের কবিদেরও বিরাট প্রভাবিত করেছিল তার প্রমাণ গোবিন্দদাস। জ্ঞানদাসের কিছু কিছু পদও এই তথাকথিত ব্রজবুলি ভাষাতেই রচিত। মধ্যযুগের বহু কবি এই ভাষাতেই পদরচনা করেছেন। এমনকি আধুনিক কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও যখন ‘ ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী ‘ লেখেন তখন তিনি লেখেন ব্রজবুলি ভাষাতেইবৈষ্ণব পদাবালি সাহিত্যে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দ দাস ছাড়াও যশোরাজ খান, চাঁদকাজী, রামচন্দ বসু, বলরাম দাস, নরহরি দাস, বৃন্দাবন দাস, বংশীবদন, বাসুদেব, অনন্ত দাস, লোচন দাস, শেখ কবির, সৈয়দ সুলতান, হরহরি সরকার, ফতেহ পরমানন্দ, ঘনশ্যাম দাশ, গয়াস খান, আলাওল, দীন চণ্ডীদাস, চন্দ্রশেখর, হরিদাস, শিবরাম, করম আলী, পীর মুহম্মদ, হীরামনি, ভবানন্দ প্রমুখ উল্লেখ্যযোগ্য কবি। বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যিক গুণে আসামান্য। বিভিন্ন কবির লেখা কিছু পদ এখানে উল্লেখ করা হল- ১.সই কেমনে ধরিব হিয়া।/আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়/ আমার আঙিনা দিয়া।।/সে বধুঁ কালিয়া না চাহে ফিরিয়া/ এমতি করিল কে।/আমার অন্তর যেমন করিছে/তেমনি করুক সে।।/যাহার লাগিয়া সব তেয়াগিনু/ লোকে অপযশ কয়।/সেই গুণনিধি ছাড়িয়া পিরীতি/আর যেন কার হয়।।/যুবতী হইয়া শ্যাম ভাঙাইয়া/এমত করিল কে।/আমার পরাণ যেমতি করিছে/তেমতি হউক সে।। (চণ্ডীদাস) ২.চলে নীল সাড়ি নিঙারি নিঙারি/পরান সহিতে মোর।/সেই হৈতে মোর হিয়া নহে থির/মন্মথ জ্বরে ভোর । (চণ্ডীদাস) ৩.এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর/এ ভরা বাদর মাহ ভাদর/শূন্য মন্দির মোর।।/ঝম্পি ঘণ গন — জন্তি সন্ততি/ভুবন ভরি বরি খন্তিয়া।/কান্ত পাহুন কাম দারুন/সঘনে খন শর হন্তিয়া।।/কুলিশ শত শত পাত-মোদিত/ময়ূর নাচত মাতিয়া।/মও দাদুরী ডাকে ডাহুকী/ফাটি যাওত ছাতিয়া।।/তিমির দিক ভরি ঘোর যামিনী/অথির বিজুরিক পাঁতিয়া।/বিদ্যাপতি কহ কৈছে গোঙায়াবি/হরি বিনে দিন রাতিয়া।। (বিদ্যাপতি)

    মঙ্গলকাব্য

    মধ্যযুগের বাংলা কাব্যধারার একবিশিষ্ট শাখা হল মঙ্গলকাব্য। মঙ্গল শব্দের আভিধানিক অর্থ হল কল্যাণ। মধ্যযুগে বিভিন্ন দেব-দেবীর মহিমা ও মাহাত্ম্যকীর্তন এবং পৃথিবীতে তাদের পূজা প্রতিষ্ঠার কাহিনী নিয়ে যেসব কাব্য রচিত হয়েছে সেগুলোই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মঙ্গল কাব্য নামে পরিচিত।মঙ্গলকাব্যের তিনটি প্রধান ঐতিহ্যের মধ্যে মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গলধর্মমঙ্গল ছিল অন্যতম । এই কাব্য তিনটির প্রধান চরিত্র হল যথাক্রমে মনসা, চণ্ডীধর্মঠাকুর যারা বাংলার সকল স্থানীয় দেবতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়। এছাড়াও কিছু ছোট মঙ্গলকাব্য রয়েছে, যেমন- শিবমঙ্গল, কালিকা মঙ্গল, রায় মঙ্গল, শশী মঙ্গল, শীতলা মঙ্গল ও কমলা মঙ্গল প্রভৃতি নামে পরিচিত। মঙ্গলকাব্যের প্রচলিত প্রধান কবিরা হলেন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, বিজয়গুপ্ত, রূপরাম চক্রবর্তী প্রমুখ।

    রাজসভার সাহিত্য

    রাজসভার সাহিত্য হল রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত সাহিত্য। মধ্যযুগের প্রধান রাজসভার কবি ছিলেন আলাওল (১৫৯৭-১৬৭৩) এবং ভারত চন্দ্র প্রমুখ। মহাকবি আলাওল ছিলেন আরাকান রাজসভার প্রধান কবি। তিনি আরবি ও ফার্সি ভাষায় কাব্য রচনা করেছিলেন। ব্রজবুলি ও মঘী ভাষাও তার আয়ত্তে ছিল। প্রাকৃতপৈঙ্গল, যোগশাস্ত্র, কামশাস্ত্র, অধ্যাত্মবিদ্যা, ইসলাম ও হিন্দু ধর্মশাস্ত্র-ক্রিয়াপদ্ধতি, যুদ্ধবিদ্যা, নৌকা ও অশ্ব চালনা প্রভৃতিতে বিশেষ পারদর্শী হয়ে আলাওল মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। আলাওলের পদ্মাবতী (১৬৪৮ খৃ:) ছিল সবচেয়ে বিখ্যাত মহাকাব্য। তাছাড়া :

    • সতীময়না লোরচন্দ্রানী (১৬৫৯খৃঃ)
    • সপ্ত পয়কর (১৬৬৫ খৃঃ)
    • সয়ফুলমুলুক-বদিউজ্জামাল (১৬৬৯খৃঃ)
    • সিকান্দরনামা (১৬৭৩খৃঃ)
    • তোহফা (১৬৬৪ খৃঃ)
    • রাগতালনামা

    মধ্যযুগের শেষ এবং আধুনিক যুগের প্রধান কবি ছিল ভারত চন্দ্র। তিনি তার অন্নদামঙ্গল কাব্যের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। এই কাব্যের বিখ্যাত উক্তি হল, “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”।

    শিবায়ন কাব্য

    শিবায়ন কাব্য মধ্যযুগীয় বাংলা আখ্যানকাব্যের একটি ধারা। শিব ও দুর্গার দরিদ্র সংসার জীবন কল্পনা করে মঙ্গলকাব্যের আদলে এই কাব্যধারার উদ্ভব। শিবায়ন কাব্যে দুটি অংশ দেখা যায় – পৌরাণিক ও লৌকিক। মঙ্গলকাব্যের আদলে রচিত হলেও শিবায়ন মঙ্গলকাব্য নয়, মঙ্গলকাব্যের সঙ্গে এক কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এই কাব্যের দুটি ধারা দেখা যায়। প্রথমটি মৃগলুব্ধ-মূলক উপাখ্যান ও দ্বিতীয়টি শিবপুরাণ-নির্ভর শিবায়ন কাব্য। শিবায়নের প্রধান কবিরা হলেন রতিদেব, রামরাজা, রামেশ্বর ভট্টাচার্য, রামচন্দ্র কবিচন্দ্র ও শঙ্কর কবিচন্দ্র।

    শাক্তপদাবলি

    শাক্তপদাবলী হল কালী-বিষয়ক বাংলা ভক্তিগীতির একটি জনপ্রিয় ধারা। এই শ্রেণীর সঙ্গীত শাক্তপদাবলীর একটি বিশিষ্ট পর্যায়। শাক্তকবিরা প্রধানত তন্ত্রাশ্রয়ী দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন বলে শাক্তপদাবলীতে তন্ত্রদর্শন নানাভাবে দ্যোতিত। শাক্তপদাবলীর পদগুলিতে কালী বা শ্যামা মাতৃরূপে ও ভক্ত সাধক সন্তানরূপে কল্পিত। ভক্তের প্রাণের আবেগ, আকুতি, আবদার, অনুযোগ, অভিযোগ, দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার নিবেদন ছন্দোবদ্ধ হয়ে গীতধারায় প্রকাশিত হয়েছে এই পর্যায়ে। এই কারণে সাধনতত্ত্বের পাশাপাশি আত্মনিবেদনের ঘনিষ্ঠ আকুতি শাক্তপদাবলীর পদগুলিতে অপূর্ব কাব্যময় হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, সমাজজীবন ও লৌকিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ এই পদাবলির অধ্যাত্মতত্ত্ব শেষাবধি পর্যবসিত হয়েছে এক জীবনমুখী কাব্যে।

    শাক্তপদাবলী ধারাটি বিকাশলাভ করে খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। এই সময় বঙ্গদেশে বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে এক রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটকালে বৈষ্ণব ধর্মানুশীলনের পরিবর্তে শাক্তদর্শন ও শক্তিপূজা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। তার কারণ দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়ার সতীরুপের শক্তিপীঠগুলির অনেকগুলিই বঙ্গদেশে। সেই শক্তিপীঠগুলিকে কেন্দ্র করে প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে এসেছে শক্তিসাধনা। তারই ফলশ্রুতিতে উদ্ভূত হয় শাক্তসাহিত্য। শাক্তপদাবলীর শ্রেষ্ঠ কবি রামপ্রসাদ সেন এবং তার পরেই স্থান কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের। এই দুই দিকপাল শাক্তপদকর্তা ছাড়াও অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট পদকর্তা এই ধারায় সংগীতরচনা করে শাক্তসাহিত্য ও সর্বোপরি শাক্তসাধনাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য – কৃষ্ণচন্দ্র রায়, শম্ভুচন্দ্র রায়, নরচন্দ্র রায়, হরুঠাকুর অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, রামনিধি গুপ্ত (নিধুবাবু), কালী মির্জা, দাশরথি রায় (দাশুরায়) প্রমুখ। অনেক মুসলমান কবিও শাক্তপদাবলী ধারায় নিজ নিজ কৃতিত্ব স্থাপন করে গেছেন। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ শ্যামাসঙ্গীত রচয়িতা হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। অন্যদিকে এই শতাব্দীর জনপ্রিয় শ্যামাসঙ্গীত গায়কদের অন্যতম হলেন পান্নালাল ভট্টাচার্য, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, রামকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।

    নাথসাহিত্য

    বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগে নাথধর্মের কাহিনি অবলম্বনে রচিত আখ্যায়িকা কাব্য।প্রাচীনকালে শিব উপাসক এক সম্প্রাদয় ছিল,তাদের ধর্ম ছিল নাথধর্ম।হাজার বছর আগে ভারতে এই সম্প্রাদয় খ্যাতি লাভ করেছিল। তাদের গতিবিধির ব্যাপকতার জন্য সারা ভারতবর্ষে তাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। নাথ অর্থ প্রভু,দীক্ষালাভের পর নামের সাথে তারা নাথ শব্দটি যোগ করত। তারা বিশেষ ক্ষমতার অধিকারি ছিল। বৌদ্ধ ও শৈব ধর্মের সমন্বয়ে এ ধর্ম গরে ওঠে। এই নাথ পন্থা বৌদ্ধ মহাযান আর শূন্যবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। অবিদ্যা ও অজ্ঞান থেকে মুক্তির জন্য এবং মহাজ্ঞান লাভ করাই নাথগনের লক্ষ্য ছিল।সাধনার মাধ্যমে দেহ পরিশুদ্ধ করে মহাজ্ঞান লাভের যোগ্য করলে তাকে পক্ক দেহ বলা হত। এই মতের প্রতিষ্ঠাতা মীননাথ। আর শিব হল আদি নাথ। সব নাথ তার অনুসারী। দশম-একাদশ শতকে নাথধর্মের প্রভাব বিস্তার লাভ করে। অই সময়ে নাথ সাহিত্য বিস্তার লাভ করে। প্রধান প্রধান নাথগন হলেন- মীননাথ,গোরখনাথ,প্রমুখ।

    বাউল সাহিত্য

    বাউল মতবাদের উপর ভিত্তি করে রচিত সাহিত্যই হল বাউল সাহিত্য। বাউল সাধকদের সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছেন জগন্মোহন গোসাঁই ও লালন সাঁই। লালন তার বিপুল সংখ্যক গানের

    মাধ্যমে বাউল মতের দর্শন এবং অসাম্প্রদায়িকতার প্রচার করেছিলেন। এছাড়াও বাউল কবিদের মধ্যে জালাল খাঁ, রশিদ উদ্দিন, হাছন রাজা, রাধারমণ, সিরাজ সাঁই, পাঞ্জু সাঁই, পাগলা কানাই, শীতলং সাঁই, দ্বিজদাস, হরিচরণ আচার্য, মনোমোহন দত্ত, লাল মাসুদ, সুলা গাইন, বিজয় নারায়ণ আচার্য, দীন শরৎ (শরৎচন্দ্র নাথ), রামু মালি, রামগতি শীল, মুকুন্দ দাস, আরকুন শাহ্‌, সিতালং ফকির, সৈয়দ শাহ্‌ নূর, শাহ আব্দুল করিম, উকিল মুন্সি, চান খাঁ পাঠান, তৈয়ব আলী, মিরাজ আলী, দুলু খাঁ, আবেদ আলী, উমেদ আলী, আবদুল মজিদ তালুকদার, আবদুস সাত্তার, খেলু মিয়া, ইদ্রিস মিয়া, আলী হোসেন সরকার, চান মিয়া, জামসেদ উদ্দিন, গুল মাহমুদ, প্রভাত সূত্রধর, আবদুল হেকিম সরকার, ক্বারী আমীর উদ্দিন আহমেদ, ফকির দুর্বিন শাহ, শেখ মদন, দুদ্দু সাঁই,কবি জয়দেব, কবিয়াল বিজয়সরকার, ভবা পাগলা, নীলকণ্ঠ, দ্বিজ মহিন, পূর্ণদাস বাউল, খোরশেদ মিয়া, মিরাজ উদ্দিন পাঠান, আব্দুল হাকিম, মহিলা কবি আনোয়ারা বেগম ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। তাদের মাধ্যমেই বাউল মতবাদ বা বাউল সাহিত্য বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

    বাংলা লোক সাহিত্য

    বাংলাদেশের লোক সাহিত্য বাংলা সাহিত্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। যদিও এর সৃষ্টি ঘটেছে অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রসার ঘটেছে মৌখিকভাবে, তথাপি বাংলা সাহিত্যকে এ লোক সাহিত্য ব্যাপ্তি প্রদান করেছে, করেছে সমৃদ্ধ। পৃথক পৃথক ব্যক্তি-বিশেষের সৃষ্টি পরিণত হয়েছে জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যে যার মাধ্যমে প্রকাশ ঘটেছে ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি ও চিন্তা চেতনার। লোক সাহিত্য মূলত মৌখিক সাহিত্য। ফলে এধরনের সাহিত্য স্মৃতিসহায়ক কৌশল, ভাষার গঠনকাঠামো এবং শৈলীর উপরও নির্ভর করে। এদেশের লোক সাহিত্য সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করছে। এগুলো হচ্ছে মহাকাব্য, কবিতা ও নাটক, লোক গল্প, প্রবাদ বাক্য, গীতি কাব্য প্রভৃতি। লোক সাহিত্যের এই সম্পদগুলো সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে অথবা অন্য কোন উপায়ে এখনো এই অঞ্চলে টিকে রয়েছে। বহুবছর ধরে এদেশে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। বাংলাদেশের লোক সাহিত্য এই জাতিগোষ্ঠীগুলো দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। ফলশ্রুতিতে বর্তমান বাংলাদেশের বহুমুখী বৈচিত্র্যপূর্ণ বিশাল লোক সাহিত্যের একাংশের ব্যাখ্যায় ইতিহাসের প্রয়োজন পরে।

    বাংলাদেশের লোক সাহিত্য লোক সাহিত্যের প্রচলিত সকল শাখায় নিজেকে বিস্তার করেছে। এগুলো হচ্ছে গল্প, ছড়া, ডাক ও খনার বচন, সংগীত, ধাঁধা, প্রবাদ বাক্য, কুসংস্কার ও মিথ। লোকগীতি বাংলা লোক সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশের সংগীত মূলত কাব্যধর্মী। এদেশীয় সংগীতে বাদ্যযন্ত্রের চেয়ে মৌখিক সুরের দক্ষতার উপর অধিক নির্ভরশীলতা লক্ষ করা যায়। লোকগীতিকে আমরা সাতটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করতে পারি। এগুলো হচ্ছেঃ প্রেম, ধর্মীয় বিষয়, দর্শন ও ভক্তি, কর্ম ও পরিশ্রম, পেশা ও জীবিকা, ব্যাঙ্গ ও কৌতুক এবং এসবের মিশ্রণ। অন্যদিকে এদেশীয় লোকসাহিত্যে আমরা গানের বিভিন্ন শাখা দেখতে পাই। এগুলো হচ্ছেঃ বাউল গান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, গম্ভীরা, কবিগান, জারিগান, সারিগান, ঘাটু গান,যাত্রা গান ,ঝুমুর গান, জাগের গান প্রভৃতি।

    বাংলা লোক সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হল:

    • মৈমনসিংহ গীতিকা (ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রচলিত পালাগানগুলোকে একত্রে মৈমনসিংহ গীতিকা বলা হয়। এই গানগুলো প্রাচীন কাল থেকে মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে আসছে। তবে ১৯২৩-৩২ সালে ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন এই গানগুলো সম্পাদনা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রকাশ করেন। বর্তমান নেত্রকোণা জেলার আইথর নামক স্থানের আধিবাসী চন্দ্রকুমার দে এসব গাঁথা সংগ্রহ করছিলেন।)
    • পূর্ববঙ্গ-গীতিকা (পূর্ববঙ্গ অঞ্চলের প্রচলিত লোকসাহিত্যকে একত্রে পূর্ববঙ্গ গীতিকা বলা হয়। প্রাচীন কাল থেকে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে আসা পালাগুলি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ১৯২৬ সালে ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ সাহায্যে পালাগুলো সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। পরে ১৯৭১-১৯৭৫ সালে ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক ও সাত খণ্ডে প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা প্রকাশ করেন।)
    • ঠাকুরমার ঝুলি
    • ঠাকুরদাদার ঝুলি

    বাংলা গদ্যের উন্মেষপর্ব

    চিঠিপত্র লেখা এবং দলিল-দস্তাবেজ লেখার প্রয়োজনে বাংলা গদ্যের সূত্রপাত। দলিল-দস্তাবেজ ইত্যাদি সংস্কৃত ও পার্সি – এই দুই ভাষার প্রভাবে পরিকীর্ণ। আদি সাহিত্যিক গদ্যে কথ্যভাষার প্রতিফলন সুস্পষ্ট। পর্তুগীজ ধর্মপ্রচারক মানোএল দা আস্‌সুম্পসাঁউ-এর রচনা রীতি বাংলা গদ্যের অন্যতম আদি নিদর্শন। ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত কৃপার শাস্ত্রের অর্থ ভেদ গ্রন্থ থেকে নিম্নরূপ উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। লক্ষ্যণীয় এই অংশে বৃহত্তর ঢাকা এলাকার কথ্য ভাষা প্রতিফলিতঃ–

    “ফ্লান্দিয়া দেশে এক সিপাই বড় তেজোবন্ত আছিল। লড়াই করিতে করিতে বড় নাম তাহার হইল, এবং রাজায় তাহারে অনেক ধন দিলেন। ধন পাইয়া তাহার পিতামাতার ঘরে গেল। তাহার দেশে রাত্রে পৌঁছিল। তাহার এক বইন আছিল ; তাহার পন্থে লাগাল পাইল ; ভাইয়ে বইনরে চিনিল, তাহারে বইনে না চিনিল। তখন সে বইনেরে কহিল, “তুমি কী আমারে চিন?” “না, ঠাকুর” বইনে কহিল। সে কহিল,”আমি তোমার ভাই।” ভাইয়ের নাম শুনিয়া উনি বড় প্রীত হইল। ভাইয়ে ঘরের খবর লইল, জিজ্ঞাস করিল, “আমারদিগের পিতামাতা কেমন আছেন?” বইনে কহিল, “কুশল।” দুইজনে কথাবার্তা কহিল।”

    প্যারীচাঁদ মিত্র রচিত আলালের ঘরে দুলাল বাংলা ভাষায় রচিত আদি গদ্যসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এটি ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত এই গ্রন্থের ভাষা ‘আলাল ভাষা’ নামে পরিচিত। এই গ্রন্থে কথ্যরূপী গদ্য একটি পৃথক লেখ্য রূপে উন্নীত হয়।

    “বেণীবাবু কহিলেন- অদ্য রাত্রে এখানে থাকো কল্য প্রাতে তোমাকে কলিকাতায় লইয়া স্কুলে ভর্তি করিয়া দিব। ক্ষণেক কাল পরে মতিলাল জলযোগ করিয়া দেখিল অনেক বেলা আছে। চঞ্চল স্বভাব- এক স্থানে কিছু কাল বসিতে দারুণ ক্লেশ বোধ হয়- এজন্য আস্তে আস্তে উঠিয়া বাটীর চতুর্দিকে দাঁদুড়ে বেড়াইতে লাগিল- কখন ঢেঁস্কেলের ঢেঁকিতে পা দিতেছে- কখন বা ছাতের উপর গিয়া দুপদুপ করিতেছে-কখন বা পথিকদিগকে ইঁট-পাটকেল মারিয়া পিট্টান দিতেছে ; এইরূপে দুপ-দাপ করিয়া বালী প্রদক্ষিণ করিতে লাগিল-কাহারো বাগানে ফুল ছেঁড়ে-কাহারো গাছের ফল পাড়ে-কাহারো মট্কার উপর উঠিয়া লাফায়- কাহারো জলের কলসি ভাঙিয়া দেয়।”

    বাংলা গদ্য শুরুতে ছিল সংস্কৃতি গদ্যের চালে রচিত যার প্রমাণ বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজ। বলা যায়, বিশিষ্ট গদ্যকার প্রমথ চৌধুরী বাংলা গদ্যকে একটি দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছেন। লেখার ভাষাকে জনবান্ধব ও সহজবোধ করে তোলা অর্থাৎ সাহিত্যে চলিত ভাষা প্রচলনের কৃতিত্ব অনেকাংশেই তার।

    বঙ্কিমসাহিত্য

    ১৯৬৯ সালের একটি ভারতীয় ডাকটিকিটে বঙ্কিমের ছবি (বঙ্কিমের প্রতি সম্মানপ্রদর্শনপূর্বক এই ডাকটিকিট তৈরি করা হয়)

    বাংলা সাহিত্যের মূল ধারা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরেই হয়েছিলো; ১৮৩৮ সালে জন্মগ্রহণকারী বঙ্কিম মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে ১৮৬২ সালে একটি উপন্যাস লেখার কাজ শুরু করেছিলেন, ঐ বছরই এক ইংরেজ নারী হানা ক্যাথেরিন মুলেন্স ফুলমণি ও করুণার বিবরণ (এটাকে ধরা হয় প্রথম বাংলা ভাষার উপন্যাস) নামের একটি উপন্যাস প্রকাশ করেছিলেন তা দেখেই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বঙ্কিম এবং ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত হয় প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাস যেটা ছিলো একজন বাঙালি রচিত প্রথম বাংলা ভাষার উপন্যাস। বঙ্কিমের প্রথম উপন্যাসের খসড়া শেষ হতে হতে তিন বছর লেগে যায় এবং তিনি ১৮৬৫ সালে দুর্গেশনন্দিনী নামের একটি উপন্যাস প্রকাশ করতে সক্ষম হন, তারপর তিনি পান ‘বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক’-এর মর্যাদা কারণ দুর্গেশনন্দিনী ছিলো বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম যৌগিকতাময়, পরিস্রুতময়, সূচিতাযুক্ত বাংলা ভাষার শক্তির সীমামুক্ত উপন্যাস; উপন্যাসটিকে বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক উপন্যাস ধরা হচ্ছে সেই উনবিংশ শতক থেকে এখন পর্যন্ত।[১২]

    বঙ্কিম একজন সফল প্রেমমূলক উপন্যাসের রচয়িতা ছিলেন; তার উপন্যাস ভারতীয় বাঙালি তরুণ-তরুণীর মাঝে প্রেমবোধ জাগ্রত করতো সেই উনবিংশ শতাব্দীতেই।[১৩]

    বঙ্কিমের প্রেমমূলক উপন্যাসউপন্যাস প্রকাশের বছর
    দুর্গেশনন্দিনী১৮৬৫
    কপালকুণ্ডলা১৮৬৬
    মৃণালিনী১৮৬৯
    যুগলাঙ্গুরীয়১৮৭৪
    চন্দ্রশেখর১৮৭৫
    রাজসিংহ১৮৮১
    আনন্দমঠ১৮৮২
    দেবী চৌধুরানী১৮৮৪
    রাধারাণী১৮৮৬
    সীতারাম১৮৮৭

    রবীন্দ্রসাহিত্য

    বাংলা সাহিত্যের আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (৭ই মে, ১৮৬১ – ৭ই আগস্ট, ১৯৪১) (২৫ বৈশাখ, ১২৬৮ – ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) কথা অবধারিতভাবেই স্বতন্ত্র। তার জীবন ও সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যে একটি সম্পূর্ণ নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। তিনি ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। তাকে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরুবিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়। তার প্রকাশিত মৌলিক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৫২। তবে বাঙালি সমাজে তার জনপ্রিয়তা প্রধানত সংগীতস্রষ্টা হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ প্রায় দুই হাজার গান লিখেছিলেন। কবিতা ও গান ছাড়াও তিনি ১৩টি উপন্যাস, ৯৫টি ছোটগল্প, ৩৬টি প্রবন্ধের বই এবং ৩৮টি নাটক রচনা করেছিলেন।

    আধুনিক বাংলা কবিতা

    ১৮০০- বর্তমান, চলমান। মধ্য ও আধুনিক যুগের মধ্যে যিনি সেতুবন্ধন তৈরি করেন তিনি হলেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে, মধ্যযুগের তিরোভাব এবং আধুনিক যুগের আবির্ভাবের সীমারেখার সময়ে কাব্যচর্চাকারীই হচ্ছেন যুগসন্ধিক্ষণের কবি। অর্থাৎ লেখায় মধ্যযুগের ক্ষয়িষ্ণু প্রভাব এবং আধুনিককালের ঈষৎ আভাস, দু’য়েরই উপস্থিতি লক্ষণীয়। উল্লেখযোগ্য যুগসন্ধিক্ষণের কবি হচ্ছেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯)। মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) মধ্যযুগীয় পয়ারমাত্রার ভেঙে কবি প্রবেশ করেন মুক্ত ছন্দে।রচনা করেন সনেট। লাভ করেন, আধুনিক কবিতার জনকের খ্যাতি। ইউরোপীয় ভাবধারার রোমান্টিক ও গীতি কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪) ভোরের পাখি নামে পরিচিত ছিলেন। মহিরুহ বৃক্ষের ন্যায় বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। মহাকাব্য ব্যতীত সাহিক্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে তিনি খ্যাতির স্তম্বটি প্রতিষ্ঠা করেননি। রবীন্দ্রানুসারী ভাবধারার অন্যান্য কবিরা হলেন: সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রমোহন বাগচী বিশ শতকের শুরুতে কবিতায় পঞ্চপুরুষ রবীন্দ্রবিরোধিতার করেন, তারা হলেন: মোহিতলাল মজুমদার, কাজী নজরুল ইসলামযতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। আধুনিক কবিতার স্বর্ণযুগ: রবীন্দ্র ভাব ধারার বাইরে এসে দশক প্রথার চলু করেন তিরিশের পঞ্চপান্ডব কবি: অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-৮৭), জীবননান্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪), বিষ্ণু দে (১৯০৯-৮২), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-৬০)।

    বাংলা কথাসাহিত্য

    বাংলা উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের নতুনতম অঙ্গ। এর সূত্রপাত ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। প্যারিচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরে দুলাল প্রকাশিত হয় ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে। এর আখ্যানভাগে এবং রচনাশৈলীতে উপন্যাসের মেজাজ পরিলক্ষিত হয়। বাংলা উপন্যাসের একটি দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে দীর্ঘ কাল বাংলা উপন্যাসে ইউরোপীয় উপন্যাসের ধাঁচ ছায়া ফেলেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি বাংলা সাহিত্যের সকল শাখাকে ঋদ্ধ করেছেন তার হাতেও উপন্যাস নতুন মাত্রা লাভ করেছে যদিও সমালোচকরা রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসকে রসোত্তীর্ণ মনে করেন না। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর আরেকজন প্রভাবশালী ঔপন্যাসিক। তবে এরা সবাই মানুষের ওপর তলের ওপর দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রেখেছেন।

    বিংশ শতকের প্রথমভাগে বুদ্ধদেব বসু, অচ্যিন্তকুমার সেন প্রমুখের হাতে বাংলা কথাসাহিত্য একটি দৃঢ় ভিত্তি লাভ করে। তবে বাংলা উপন্যাস নতুন মাত্রা লাভ করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জগদীশ গুপ্তকমলকুমার মজুমদারের হাতে। এদের হাতে উপন্যাস বড় মাপের পরিবর্তে মানবিক অস্তিত্বের নানা দিকের ওপর আলোকপাত করে বিকশিত হয়। বস্তুত: রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে মানিক বন্দ্যেপাধ্যায় সম্ভবত সবচেয়ে কুশলী উপন্যাস শিল্পী। তারই পদরেখায় আমরা দেখতে পাই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কে। এরা উপন্যাসকে মানবিক অস্তিতের মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক জটিলতার ওপর নিবিড় আলোকপাত করেছেন, লেখনীশৈলীর জোরে উপন্যাসকে সাধারণ পাঠকের কাছকাছি নিয়ে গেছেন এবং একই সঙ্গে উপন্যাসের শিল্পশৈলীতে এনছেন দৃঢ় গদ্যের সক্ষমতা।

    সুমথনাথ ঘোষগজেন্দ্রকুমার মিত্রের বাংলা কথাসাহিত্য নতুন মাত্রা লাভ করে ৷ সুমথনাথ ঘোষ শুধু সাহিত্যস্রষ্টাই ছিলেন না , প্রকাশক হিসাবেও ছিলেন স্বনামধন্য ৷ একশোরও বেশি বই লিখেছেন সুমথনাথ৷ প্রথম উপন্যাস , ‘বাঁকা স্রোত ’৷ তিনিই অভিন্নহূদয় বন্ধু ও সুসাহিত্যিক গজেন্দ্রকুমার মিত্রের সঙ্গে যৌথভাবে শুরু করলেন ‘মিত্র ও ঘোষ ’ প্রকাশনা ৷ শিশু -কিশোরদের জন্য লিখেছেন ‘মোহন সিং -এর বাঁশি ’, ‘ছোটদের বিশ্বসাহিত্য ’র মতো বই৷ অনুবাদ করেছেন আলেকসান্দার দুমার ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’, ওয়াল্টার স্কটের ‘আইভ্যান হো ’ বা চার্লস ডিকেন্সের ‘ডেভিড কপারফিল্ড ’।[১৪]

    বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলা উপন্যাসে সম্পূর্ণ নতুন করণকৌশল নিয়ে আবির্ভূত হলেন বাংলাদেশের হুমায়ূন আহমেদ। তিনি বাংলা উপন্যাসকে নতুন খাতে প্রবাহিত করলেন। বাংলা উপন্যাস দীর্ঘকাল পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্যিকদের হাতে পরিপুষ্ট হয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদ একাই শত বর্ষের খামতি পূরণ করে দিলেন। তার উপন্যাসের অবয়ব হলো সবজান্তা লেখকের বর্ণনার পরিবর্তে পাত্র-পাত্রীদের মিথস্ক্রিয়া অর্থাৎ সংলাপকে প্রাধান্য দিয়ে ছোট এবং স্বল্প পরিসরে অনেক কথা বলার পদ্ধতি প্রবর্তন করলেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদ দেখালেন যে ইয়োরোপীয় আদলের বাইরেও সফল, রসময় এবং শিল্পোত্তীর্ণ উপন্যাস লেখা সম্ভব।

    ১৯৮০’র দশকে হুমায়ূন আহমেদের সবল উপস্থিতি অনুভব করার আগে বাংলা উপন্যাস মূলত পশ্চিমবঙ্গের ঔপন্যাসিকদের হাতে গড়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের অবদান ছিল তুলনামূলক ভাবে কম, গুণগত মানও প্রশ্নাতীত ছিল না। এ সময়কার কয়েকজন প্রধান লেখক হলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, বাণী রায়, হর্ষ দত্ত প্রমুখ।

    একবিংশ শতাব্দী শুরু হয়েছে বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগের উত্তরাধিকার বহন করে। এ সময় কিছু কিছু নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাসের স্বাক্ষর রেখেছেনি কতিপয় লেখক। উত্তরআধুনিক ধ্যানধারণা অবলম্বন করেও লিখেছেন কেউ কেউ। তবে নতুন কোন ধারা প্রবল বেগে ধাবিত করার মতো নতুন কারো আবির্ভাব এখনো হয় নি। তবে বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, নাসরীন জাহান, ইমদাদুল হক মিলন, আবুল বাশার,শহিদুল জহির, আবদুল মান্নান সৈয়দ সহ প্রমুখ শক্তিশালী ঔপন্যাসিকের সবল উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছে। পশ্চিমবঙ্গেও অনেক নতুন নতুন ঔপন্যাসিকের আবির্ভাব লক্ষ্য করা গেছে যদিও প্রচলিত রীতির বাইরে যাওয়ার শক্তিশালী হাতের দেখা পাওয়া যায়নি। এই একই সময়ে কবি জীবনানন্দ দাশের লেখা ১৪টি উপন্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলি ১৯৩০-১৯৫০ কালপরিসরে লিখিত। জীবনানন্দ দাশের উপন্যাস সম্পূর্ণ নতুর ধাঁচের, চিন্তা-মননে এবং শৈলীতে।

    বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য

    সাহিত্যে বর্ণনামূলক গদ্যকে প্রবন্ধ বলা হয়। প্রবন্ধ সাহিত্যের অন্যতম একটি শাখা। এর সমার্থক শব্দগুলো হল – সংগ্রহ, রচনা, সন্দর্ভ। প্রবন্ধের বিষয়বস্তু শৈল্পিক, কাল্পনিক, জীবনমুখী, ঐতিহাসিক কিম্বা আত্মজীবনীমূলক হয়ে থাকে। যিনি প্রবন্ধ রচনা করেন তাকে প্রবন্ধকার বলা হয়। প্রবন্ধে মূলত কোনো বিষয়কে তুলে ধরে তার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়। বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য খুবি সমৃদ্ধ। যুগে যুগে অনেক প্রাবন্ধিক তাদের প্রবন্ধের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হল বজ্ঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিবিধ প্রবন্ধ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিচিত্র প্রবন্ধ এবং প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধ সংগ্রহ । তাছাড়া আরও অনেক প্রাবন্ধিক আছেন, যেমন- কাজী আবদুল ওদুদ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, আবদুল হক প্রমুখ।

    বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি-সাহিত্যিক

    মধ্যযুগ (১২০০ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ)

    মধ্যযুগের সমগ্র পরিসর জুড়েই কাব্যের একচ্ছত্র আধিপত্য লক্ষণীয়। বিবিধ শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত ছিলো এই সাহিত্যচর্চা। এখানে এ সময়ের বিভিন্ন শাখার উল্লেখযোগ্য কবির একটি সম্মিলিত তালিকা দেয়া হলো। তালিকা প্রস্তুতে কোনো ধরনের ক্রম অনুসরণ করা হয়নি।

    আধুনিক যুগের প্রথম ভাগের সাহিত্যিক (১৮০০ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ)

    এখানে সেসব কবি ও লেখকদের নাম দেয়া হয়েছে, যাঁরা লেখালেখির মাধ্যমে পরিচিত হয়েছেন দেশভাগের আগেই; যদিও এঁদের অনেকেই দেশবিভাগের পরও সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। কিন্তু এরপরও এঁদেরকে আধুনিক যুগের শুরুর দিককার সাহিত্যিক হিসেবেই ধরা যেতে পারে। তালিকাটি করা হয়েছে সাহিত্যিকদের জন্মসালের ক্রম অনুযায়ী।

    সমসাময়িক সাহিত্যিক (১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান)

    দেশবিভাগের পর দুই বাংলাতেই সাহিত্যচর্চার স্বতন্ত্র বল

    য় তৈরি হয়। তবে সাহিত্যের জগৎ সবসময়ই বৈশ্বিক, বিশেষতঃ ভাষার মিলের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি প্রকট। দেশভাগের পর থেকে শুরু করে অদ্যাবধি দুই বাংলার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিকদের সম্মিলিত নামের তালিকা এটি। প্রসঙ্গতঃ এই তালিকাটি করা হয়েছে বর্ণানুসারে, এবং এতে বিভিন্ন নাম প্রতিনিয়তই সংযুক্ত হচ্ছে এবং হবে।

    পুরস্কার ও সম্মাননা

    নোবেল পুরস্কার

    আরও তথ্যের জন্য দেখুন: সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার

    বাংলাদেশের সাহিত্য পুরস্কার

    পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য পুরস্কার

  • সুগন্ধী পখিলা

    সুগন্ধি পখিলা অসমর প্রসিদ্ধ কবি হীরেন ভট্টাচার্যর স্ব-নির্বাচিত একগুচ্ছ কবিতার সংকলন। বনলতা প্রকাশনের ব্যানারে কবিতা বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮১ সালের ২০ মার্চে। ২০০৭ সালের বইটির ত্রয়োদশ প্রকাশ পর্যন্ত কবি ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে লেখা মোট ১৩৮ টা কবিতা এতে সন্নিবিষ্ট হয়েছে। ‘রৌদ্রকামনা’, ‘মোর দেশ’, ‘আহিনর লেণ্ডস্কেপ’, ‘কতনা ব’হাগ’, ‘ভোগালি’ ইত্যাদি কবিতা সংকলনটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রচ্ছদসজ্জা শিল্পী ননী বরপূজারীর[১]

    পুরস্কার

    সুগন্ধি পখিলার মাধ্যমে ভট্টাচার্য ১৯৮৫ সালে অসম সাহিত্য সভারবিষ্ণু রাভা পুরস্কার‘ এবং ভারতীয় বিদ্যা ভবনের ‘রাজাজী সাহিত্য পুরস্কার‘ লাভ করেন। ১৯৮৭ সালে ‘সোভিয়েট দেশ নেহরু পুরস্কার‘-এ সম্মানিত হয়েছিল।

  • লা দিভিনা কোম্মেদিয়া

    দিভিনা কোম্মেদিয়া (ইতালীয়: Divina Commedia দান্তে কর্তৃক রচিত একটি সুদীর্ঘ মহাকাব্য। বিশ্ব সাহিত্যের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ কাজগুলোর অন্যতম এই মহাকাব্যটি এর ইংরেজি অনুবাদ ডিভাইন কমেডি (ইংরেজি: The Divine Comedy) নামেই বিশ্বে সুপরিচিত। বাংলা ভাষা সহ পৃথিবীর অসংখ্য ভাষায় এ মহাকাব্য অনূদিত হয়েছে। এটি অদ্যাবধি ইতালিয় সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে পরিগণিত।[১][২]

    দান্তের জন্ম ১২৬৫’র ১৪ মে থেকে ১৩ জুনের মধ্যে; তার অকস্মাৎ প্রয়াণ ১৩২১ খ্রিষ্টাব্দে। ১৩০৮ থেকে শুরু করে, তার মৃত্যুর (১৩২১) এক বছর আগে ১৩২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ মহাকাব্য লেখা হয়। এ কাব্যে পরকাল তথা মৃত্যুপরবর্তী জীবনের কাল্পনিক উপস্থাপন মধ্যযুগের মনস্তত্ত্বের প্রতীক। মধ্যযুগে পাশ্চাত্য গির্জাগুলো কীভাবে জীবনযাত্রা বিকশিত হয়েছিল তা দান্তের কবিতার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কবিতাটি ইতালির পশ্চিমের তুস্কান অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা হয়েছে। তুস্কান ভাষাকে প্রমিত ইতালীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার পেছনেও এর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে।[৩]

    কাঠামো

    লা দিভিনা কোম্মেদিয়া মহাকাব্যটি তিন পর্বে বিভক্ত যথা:— ইনফেরনো, পুরগাতোরিও এবং পারাদিসো। প্রতিটি পর্বে রয়েছে ৩৩টি সর্গ বা কান্তি (ইতালিয় ভাষায় কান্তির একক কান্তো)। তবে ইনফারনো পর্বে আছে ৩৪টি সর্গ। অবশ্য এটি মুখবন্ধ স্বরূপ। অর্থাৎ সব মিলিয়ে সর্বমোট ১০০টি কান্তি রয়েছে এ মহাকাব্যে।[৪] মহাকাব্যে পংক্তির সংখ্যা ১৪,২৩৩।

    এ সাহিত্যকর্মে “তিন”—এর ব্যবহার অভিক্ষিপ্ত। সাথে সাথে, ছন্দ হিসেবেও তেরজা রিমা ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে প্রতিটি লাইনেই রয়েছে ১১টি মাত্রা।

    কাহিনী ও বিষয়বস্তু

    খ্রিস্টান ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে দান্তের নরক ভ্রমণ ও স্বর্গ গমনের কাহিনী এ মহাকাব্যের মূল উপজীব্য।[৫] প্রকৃতপক্ষে এ কবিতায় স্রষ্টার দিকে আত্মার ভ্রমণের কথাই বলা হয়েছে।[৬] দান্তে মধ্যযুগের খ্রিস্টান ধর্মচিন্তা ও দর্শন ফুটিয়ে তুলেছেন, বিশেষত থামিস্টিক দর্শন ও থমাস একিনাসের সুম্মা থিওলোজিকা।[৭] যার কারণে, “দিভিনা কোম্মেদিয়া”-কে “ছন্দে ছন্দে সুম্মা”(The Summa in verse)ডাকা হয়। [৮] দান্তের এ সাহিত্যকর্মে ভের্গিলকে মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, কারণ বিয়েত্রিচকে দেখানো হয়েছে ঐশ্বরিক জ্ঞান হিসেবে।[৯]

    উত্তমপুরুষে লেখা এ কাব্যে দেখা যায় তিনটি ভিন্ন জগতে দান্তের ভ্রমণ। রোমান কবি ভের্গিলকে দেখা যায় তার নরক ও পুরিগাতোরিও ভ্রমণে নির্দেশক হিসেবে থাকতে; বিয়েত্রিচ, দান্তের প্রেমিকা, তাকে স্বর্গে নিয়ে যায়। বিয়েত্রিচ ছিলো ফ্লোরেন্স শহরের এক রমণী, যার সাথে দান্তোর শৈশবে দেখা হয়। সারাজীবনই দান্তে তার প্রেমে মগ্ন ছিলেন, যার কথা আসে তার লা ভিতা নুওভাতে আসে। [১০]

    But already my desire and my will
    were being turned like a wheel, all at one speed,
    by the Love which moves the sun and the other stars.[১১]

  • যেতে নাহি দিব

    “যেতে নাহি দিব” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত একটি কবিতা। এই কবিতাটি সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। মূল বাংলা কবিতাটিতে ১৭৬টি পঙ্‌ক্তি রয়েছে। এর ইংরেজি অনুবাদটি সংক্ষিপ্ত, এবং তাতে ১৬টি পঙ্‌ক্তি রয়েছে।[১][২]

    সারসংক্ষেপ

    পূজার ছুটির পরে কবি (বা কথক) তার কর্মস্থলে ফিরে যেতে প্রস্তুত। তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য দুয়ারে গাড়ি প্রস্তুত। ভৃত্যগণ ব্যস্ত হয়ে জিনিসপত্র গোছাচ্ছে। গৃহিণীর চোখ অশ্রুসজল। কবি তার গৃহিণীকে বললেন “তবে আসি”, গৃহিণী কিছু না বলে মাথা নত করে চোখের জল গোপন করলেন। কবি তার চার বছরের কন্যার কাছে গিয়ে বিদায় জানালেন, কিন্তু এই শিশু তাকে চমকে দিয়ে বললো “যেতে আমি দিব না তোমায়”। কবি বুঝতে পারলেন না এত ছোট মেয়ে এই ভাবে কথা বলার শক্তি কোথায় পেল।

  • ভূমেন্দ্র গুহ

    ভূমেন্দ্র গুহ একজন বাঙালি কবি যিনি কবি জীবনানন্দ দাশের পাণ্ডুলিপি পাঠোদ্ধার ও প্রকাশের জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন ভারতের একজন নামকরা শৈল্যচিকিৎসাবিদ। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের হৃদশল্য চিকিৎসা বিভাগের এককালের প্রধান কবি ভূমেন্দ্র গুহ পরিচিত ছিলেন অধ্যাপক ড. বি.এন. গুহরায় নামে। তাঁর পিতৃপ্রদত্ত পূর্ণনাম ভূমেন্দ্রনাথ গুহরায়। তবে পশ্চিমপূর্ব বাংলার সাহিত্যের জগতে তিনি কবি ভূমেন্দ্র গুহ নামে পরিচিত হয়েছিলেন। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা এগারো । কিন্তু কালক্রমে তাঁর কবি-পরিচয় ছাপিয়ে ‘জীবনানন্দ গবেষক’ এই পরিচয়টিই ক্রমান্বয়ে বড় হয়ে গিয়েছিল।[১]

    জন্ম শিক্ষা ও জীবন

    ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে আগস্ট মাসের ২ তারিখ ভারতের মধ্য প্রদেশে বিলাসপুর-এ তাঁর জন্ম হয়েছিল। জীবনানন্দেরই মতো পৈত্রিক সূত্রে তিনি বরিশালেরই মানুষ। পিতামহ সতীশচন্দ্র গুহরায়ের আদিনিবাস ছিল অবিভক্ত ভারতের বরিশাল জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার মৈষাণী গ্রামে। তিনি ছিলেন মুনিনাগ গ্রামের জমিদারপুত্র, কিন্তু ভাগ্যের ফেরে স্বপরিবারচ্যুত হয়ে জেলেসমাজের একজন হয়ে গিয়েছিলেন।

    ভূমেন্দ্র গুহ’র বাবা নগেন্দ্রনাথ গুহরায় রেল কোম্পানিতে চাকুরি করতেন। বদলির চাকুরি, ফলে নানা স্কুলে পড়তে হয়েছে ভূমেন্দ্র গুহকে, তবে ম্যাট্রিক পাশ করেছেন কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনের ছাত্র হিসেবে। বঙ্গবাসী কলেজ থেকে আইএসসি করার পর ডাক্তারি পড়েছিলেন ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজে। ১৯৫৭’য় ডাক্তারি পাশের পর তিনি শল্যচিকিৎসায় মাস্টার্স করেছেন; পরে বিশেষভাবে বক্ষদেশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, হৃৎপিণ্ড ও ভাসকুলার সার্জারিতে এম.সি-এইচ।

    শৈল্যচিকিৎসা বিদ্যায় অবদান

    ষাটের দশকে ভারতের প্রথম ওপেনহার্ট সার্জারি হয়েছিল ১৯৬২ তে; সেদিন অপারেশন থিয়েটারে শিক্ষক প্রফেসর ডা. অজিত কুমার বসুর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন তরুণ শল্যবিদ বি. এন. গুহরায়।[২] এরপর এ বিষয়ে তিনি অনেক গবেষণা করেছেন; তাঁর দেড়শরও বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক জার্নালে। যুক্তভাবে একটি ডাক্তারির বই-ও প্রকাশ করেছিলেন, বেশ কিছু বহুলেখক গ্রন্থের জন্য লিখেছেন। শেষ জীবনে কলকাতা মেডিকেল কলেজ-এর থোরাসিক সার্জারি বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন চৌদ্দ বছর। লিভার সিরোসিস রোগটি অপরেশন ক’রে সারানোর পদ্ধতিটিও তাঁরই আবিষ্কার: এটি বিশ্বব্যাপী চিকিৎসাশাস্ত্রে গুহরায়-বাসু শান্ট অপারেশন নামে খ্যাত। চাকরিজীবনে যথেষ্ট ব্যস্ত ছিলেন ড. বি. এন. গুহরায়।

    জীবনানন্দ দাশের পাণ্ডুলিপি সংশ্রব

    ১৯৫৪য়, অক্টোবরের এক শীতার্ত মধ্যরাত-উত্তীর্ণ সময়ে ট্রামের ধাক্কায় মারাত্মকভাবে আহত জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু হয়েছিল। মৃত্যুকালে তাঁর প্রকাশনা বলতে ৫টি কাব্যগ্রন্থ এবং শ্রেষ্ঠ কবিতায় অন্তর্ভুক্ত ১৬২টি কবিতা এবং বিভিন্ন সাময়িক পত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরো শত খানেক কবিতাও কয়েকটি প্রবন্ধ-নিবন্ধ। জীবদ্দশায় কোন প্রবন্ধ গ্রন্থ প্রকাশ করে যান নি জীবনানন্দ দাশ। ২১টি উপন্যাস একং শতাধিক ছোট গল্প রচনা করলেও একটিও ছাপতে দেননি কোথাও। ট্রাংকে তালা-চাবি এঁটে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলেন হাজার হাজার কবিতা, গল্প-উপন্যাসের খাতা ও ডায়েরি। প্রায় তিরিশ হাজার পাতার অপ্রকাশিত লেখা রেখে গিয়েছিলেন জীবনানন্দ শত-শত রুলটানা এক্সারসাইজ খাতায় । এই সব শত-শত রুলটানা এক্সারসাইজ খাতা খুঁজে খুঁজে পড়ে পড়ে, ভারি পাওয়ারের চশমায় না কুলোলে আতশি কাচের সাহায্য নিয়ে, জীবনানন্দের জড়ানো অনতিস্পষ্ট হস্তাক্ষরের প্রতিরোধ উপেক্ষা ক’রে অগণিত অপ্রকাশিত কবিতা, গল্প, উপন্যাস পাঠোদ্ধার ক’রে যিনি প্রকাশ করবার ব্যবস্থা করে যাচ্ছিলেন কবি ভূমেন্দ্র গুহ । [৩]

    পঞ্চাশের দশকের শুরুতে নিজেদের সাহিত্যের ছোটকাগজ “ময়ূখ”-এর জন্য কবিতা সংগ্রহ করতে গিয়ে জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে যে পরিচয় হয়েছিল, তারই সূত্র ধ’রে কবির মৃত্যু পরবর্তী সময়ে তাঁর পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ভূমেন্দ্রর । কার্যত জীবনানন্দের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত রচনা সংবলিত ট্রাংকভর্তি অসংখ্য লেখার খাতা তাঁরই অধিকারে সংরক্ষিত ছিল দীর্ঘ কাল। সেগুলোর অধিকাংশ পাঠোদ্ধার করে তিনি প্রকাশযোগ্য পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন। বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় কাব্য রূপসী বাংলা এবং জীবনানন্দের সপ্তম কাব্য সংকলন বেলা অবেলা কালবেলা, তাঁর প্রথম প্রবন্ধসংকলন কবিতার কথা এবং সর্বপ্রথম প্রকাশিত উপন্যাস মাল্যবান-এর মুদ্রণযোগ্য পাণ্ডুলিপি- সবই ভূমেন্দ্র গুহ’র হাতে তৈরী। কলকাতার প্রতিক্ষণ পাবলিকেশনস ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ১২ খণ্ডের জীবনানান্দ সমগ্র প্রকাশ শুরু করেছিল ভূমেন্দ্র গুহেরই কপি করা বিবিধ পাণ্ডুলিপির ভিত্তিতে। অপ্রকাশিত কবিতার সংকলন হে প্রেম তোমাকে ভেবে ভেবে, ছায়া-আবছায়া, উপন্যাস সফলতা-নিষ্ফলতা এবং ২০১২ তে প্রকাশিত অপ্রকাশিত শেষ ১৪টি গল্প ও ২টি উপন্যাস এবং ১৪ খণ্ডে প্রকাশিত পাণ্ডুলিপির কবিতা (সহায়তা করেছিলেন বর্তমানের বিশেষ জীবনানন্দ গবেষক গৌতম মিত্র) ইত্যাদিরও পশ্চাৎ কারিগর তিনি।

    ভূমেন্দ্র গুহ কেবল লেখার খাতা থেকে মুদ্রণযোগ্য পাণ্ডুলিপিই প্রস্তুত করেন নি, তিনি জীবনানন্দের অনেক লেখার খাতাকে চির অবলুপ্তির হাত থেকে বাঁচিয়েছেন; ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত লেখার খাতাগুলো সযত্নে আগলে রেখেছিলেন নিজের টানে, যত দিন না চাকরিসূত্রে কলকাতার বাইরে চলে যাওয়ার ডাক এসেছিল।[১]

    কাব্যকৃতি

    তাঁর পদ্য লেখার শুরু উত্তর কৈশোরে যদিও সঞ্জয় ভট্টাচার্যের “পূর্বাশা” পত্রিকায় ১৯৫২’র মাঝামাঝি একটি কবিতা মুদ্রণের মধ্য দিয়ে তাঁর কবিজীবনের অভিষেক হয়েছিল মনে করতেন কবি ভূমেন্দ্র গুহ। পঞ্চাশ দশকের শুরুতে তাঁর কবিতা লেখার গোড়াপত্তন হলেও প্রথম কবিতা সংকলন “যম” প্রকাশিত হয়েছিল অনেক পরে, ১৯৯৪-এ। এবংবিধ দীর্ঘ ব্যবধান যে কারো পক্ষে কৌতূহলোদ্দীপক। শ্রেষ্ঠ কবিতা’র কবিতাগুলোর রচনাকাল উল্লেখ করা হয়েছে এই ভাবে: ১৯৫৫-৫৮ খ্রিস্টাব্দ এবং ১৯৯০-২০০৪ খ্রিস্টাব্দ। ২০০৫ পর্যন্ত এই কালপরিধিতেই তিনি কবিতা লেখায় সক্রিয় থেকেছেন এরকম অনুমান করা চলে। অর্থাৎ ১৯৫৯ থেকে ১৯৮৯ এই টানা তিরিশ বছর হয়তো ব্যতিক্রম কিছু ছিল, কেননা দেখা যাচ্ছে শ্রেষ্ঠ কবিতা’য় ষাট দশকের কবিতাও একআধটি আছে। ভূমেন্দ্র গুহ কবিতার টেবিল থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিলেন। তাঁর জীবিকাজীবনের সঙ্গে এ সময়টি মিলিয়ে নেয়া যায়। এই দীর্ঘবিরতি তাঁর আদি কবিসত্তাকে অক্ষুণ্ন রেখেছিল কতটুকু সে প্রশ্ন অসঙ্গত হবে না। তবে ইত্যবসরে তিনি একটি কাব্যভাষা খুঁজে পেয়েছিলেন যাকে উত্তর-জীবনানন্দীয় কাব্যভাষা বলে চিহ্নিত করা যায়। অন্যদিকে বিষয়বস্তুর নির্বাচনে তিনি উত্তর-জীবনানন্দীয় কবিদের মতই নিবিড় আত্মজৈবনিকতার মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন স্বস্তিময় আরাধনা: “ভেবে দেখেছি কী হতে চেয়েছিলুম, কী হতে পারতুম, কী হতে পারতুম না, অর্থাৎ আকাঙ্ক্ষা, আকাঙ্ক্ষাতেই বানিয়ে নিচ্ছিলুম নিজেকে, নৌকার দাঁড়ে অভিভাবিকা ছিল–তার শীতল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নামে-নামে যে-সব ডাকনাম– পুড়ে-যাওয়া মরুভূমিটি বুদ্বুদে-বুদ্বুদে ষোলো-আনা গর্ভবতী হবে; তখনও সে থাকবে সেখানে সেই জলের মতন যে অপরাধী পাপী কিন্তু অচ্ছোদ।” যারা জীবনান্দের খোঁজখবর রাখেন তাঁরা জানেন, ’৯০এর দশক থেকে শুরু ক’রে জীবনানন্দ আর ভূমেন্দ্র গুহ নাম দুটি অবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। অনতিতরুণ ভূমেন্দ্র গুহ সেই পঞ্চাশের শুরুতেই জীবনানন্দকে খুব বড় কবি বলে মান্য করেছিলেন। হয়তো জীবনানন্দের কাব্যভাষা তাঁকে কিছুটা আকর্ষণও করে থাকবে। তাঁর নিজের কোন কোন কবিতায় সে প্রমাণ তো আছে; কোনটির কাঠামোতে প্রত্যক্ষ ছিল জীবনানন্দ’র প্রগাঢ় ছায়াপাত:

    চোখে যে গড়াবে জল, সে-রকম সাহসিক নই, সেই চোখ যা এখন বিস্তীর্ণ আকাশ খুঁজে দেখে: নক্ষত্রেরা আছে কি না মৃতপ্রায় দিকের সন্ধানে; আরেকটু হেঁটে গেলে ভোর হবে, প্রথম প্রত্যুষা; জনৈক মৃতের ছবি দেয়ালে আয়নায় রাখা হবে। মধ্য রাত পার হলে দুইটি বছর, মানে কাল দুই দিকে চ’লে যাচ্ছে, যাচ্ছে আমাদের প্রেম যেন; পিঁপড়ের মতন পায়ে দুঃখ বাসা বাঁধছে হৃদয়ে। হেঁটে যাচ্ছি অন্ধকার, অন্ধকার পথের দু’পাশে যে সব শ্মশান আছে শুভ্রতায় ভুলে যাচ্ছি তা-ও; এখন বিকেল, আর সামান্য প্রভেদ মেনে নিলে অন্ধকার মাঝামাঝি দীর্ঘশ্বাসটুকু: যা গিয়েছে তার থেকে রাত্রিটিকে খুলে নিয়ে এসে দেখেছি যে, এই মাত্র কব্জির নিকটে রক্ত নাচে; অবশেষে এইটুকু বিশ্বাস জমাই ইহকালে;

    সে-সময় জানো তুমি যদি না অসত্য ব’লে থাকো।

    পরিণত বয়সে কেমন কবিতা লিখতেন ভূমেন্ত্র গুহ, তা নিচের উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যাবে:

    “তুমি আমাকে প্রেমের কথা বলবে, আমি কামনা করতে থাকি, এবং গোপন অপরাধে নিঃশেষিত হয়ে যাই। পরিবর্তে তোমার দেবীর মতো দু’টি হাত আমার উদ্বুদ্ধ শরীরটিকে খুঁজে নেয়, আমি দেখি। তুমি তোমার অনাগত একমাত্র সন্তানটির কথা গভীর উদ্বেগের ভিতর উচ্চারণ করো। তার জন্য পূজাবেদিটির সর্বাঙ্গে ধান রাখো, ফুল রাখো, বিল্বপত্র রাখো, কদলীখ- রাখো, ততোধিক রাখো প্রচুর নবীন দূর্বাঘাসের আচ্ছাদন, যাতে তোমার তৃণাস্তীর্ণ মৌল বেদিটিকে পদ্মপাতার ভঙ্গিমায় ঠিক চিনে নিতে পারি। তুমি আমার জন্য সমুদ্রমন্থনের আনুষঙ্গিক বিষপানের স্মৃতি পুনর্জীবিত করে তোলে।”

    [১]

    প্রকাশনা

    কাব্য

    ভূমেন্দ্র গুহ’র তাঁর কবিতাগ্রন্থগুলোর নাম এরকম রেখেছিলেন: “যম”, “ঋতুচক্র”, “পিতামহ”, “উত্তরপুরুষ”, “এই সব দিনাতিপাত”, “এই মাত্র”, “ভালো থাকুন”,“ঢের দিন বেঁচে থাকা হল”, “এককালের বসতবাড়িটি”, “বেলা-শেষের অতি-কথন”, ও “অন্ত-কবিতা”।

    এছাড়া তিনি ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করে গেছেন “শ্রেষ্ঠ কবিতা”। ২০১৫’য় তাঁর প্রয়াণের কিছু আগে রাহুল পুরকায়স্থের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতাসমগ্র যার প্ররচ্ছদনাম ভূমেন্দ্র গুহ’র কবিতা”। “শ্রেষ্ঠ কবিতা” তাঁকে এনে দিয়েছিল রবীন্দ্র পুরস্কার, ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে ।

    গদ্য

    যৌবনে, ১৯৫৮য়, তিনি স্যাফোর কাব্য অনুবাদ করেছিলেন। বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম স্যাফোর কবিতা অনুবাদ করেছেন। হেনরী মিলারের “ঘাতকদের সময়” অনুবাদ করেছেন (তবে বলে রাখা দরকার অনুবাদের জন্য লেগেছে ১৩৮ পাতা, আর ভূমিকা-টীকার জন্য বাকী ২৭৪ পৃষ্ঠা)। ২০০৮এ প্রকাশ করেছেন জীবনানন্দের অপ্রাকশিত উপন্যাস “সফলতা-নিষ্ফলতা”। এখানেও বলে রাখা দরকার যে ১১৭ পাতার এ উপন্যাসের শুরুতে আছে ১৬ পৃষ্ঠার একটি ভূমিকা আর শেষে আছে ১২৫ পৃষ্ঠাব্যাপী টীকা-টিপ্পনীর বিশাল বহর। ২০১২ তে প্রকাশ করেছেন জীবনানন্দ’র “সমরেশ ও অন্যান্য গল্প” এবং “অপ্রকাশিত শেষ ১৮টি গল্প ও ২টি উপন্যাস”। কেবল জীবনানন্দ নিয়ে তাঁর বই একটিই; আর সেটি হলো “আলেখ্য : জীবনাননদ দাশ”। তাঁর জীবনানন্দ চর্চার অনুপুঙ্খ দলিল ২০০৮-এ প্রকাশিত “জীবনানন্দ ও সঞ্চয় ভট্টাচার্য”। উপন্তু জীবনানন্দের লিটের‌্যারি নোটস “দিনলিপি” শিরোনামে প্রকাশ করেছিলেন ৪টি প্রশস্ত খণ্ডে। দিনলিপি লেখার খাতার ফ্যাকসিমিলি প্রকাশ করেছেন “শেষ ছ’বছর” শিরোনোমে। বাংলাদেশের কালি ও কলম পত্রিকার-এর সম্পাদক আবুল হাসানাতের উদ্যোগে ভূমেন্দ্র গুহ জীবনানন্দ দাশের কবিতার মূলানুগ পাঠের একটি সংকলনগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি করতে সম্মত হয়েছিলেন ২০০৯-এ। কাজ চলছিল সেই ২০১১ থেকে। তাতে “শ্রেষ্ঠ কবিতা” সহ জীবনানন্দের সাতটি কাব্যগ্রন্থ থেকে বাছাই করা কবিতা, জীবনানন্দের মৃত্যুকালে অপ্রকাশিত ৭৯টি কবিতা এবং সরাসরি ৩২টি লেখার খাতা থেকে ১৪৩২টি কবিতা (পূর্বোল্লিখিতগুলোবাদ দিয়ে) পত্রস্থ করা হয়েছে। কবিতা-সংবলিত ৬৮৭ পৃষ্ঠার প্রথম খণ্ডের পর ৪৯৬ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় খণ্ডে ভূমেন্দ্র গুহের লেখা ভূমিকা ও টীকা-টিপ্পনী।[৪][৫]

    মৃত্যু

    ক্যান্সারে ভুগছিলেন ভূমেন্দ্র গুহ, কিন্তু কাউকে বলেন নি। নিঃশব্দে মৃত্যুবরণ করলেন ২০ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে, ঘুমের ভেতর। [৬