হাবল মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্র বা মূল ইংরেজিতে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ (ইংরেজি: Hubble Space Telescope, সংক্ষেপে HST), মহাকাশেপৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের আয়ত্তাধীন ভাসমান পৃথিবীর প্রথম এবং একমাত্র (প্রেক্ষিত ২০১২) দূরবীক্ষণ যন্ত্র, যা এ পর্যন্ত (২০১২) সবচেয়ে দূরাবধি দেখার জন্য মানুষের তৈরি শ্রেষ্ঠ দূরবীক্ষণ যন্ত্র। এমনকি পরিষ্কার দৃশ্য দেখার ক্ষেত্রেও দূরবীক্ষণ যন্ত্রটি এগিয়ে আছে, এর উজ্জ্বল দৃশ্য দেখার ক্ষমতা হলো ০.০৫ আর্কসেকেন্ড।
হাবল মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্র একটি মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্র যা ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর কক্ষপথের মধ্যে চালু করা হয় এবং অপারেশন অবশেষ। যদিও প্রথম স্পেস দূরবীক্ষণ নয়, হাবলটি সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে বহুমুখী, এবং এটি একটি অত্যাবশ্যক গবেষণা সরঞ্জাম এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্য একটি জনসাধারণের স্বীকৃতি হিসাবে পরিচিত। এইচএসটি জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবলের নামে নামকরণ করা হয়, এবং এটি নাসা’র গ্রেট মানমন্দিরের এক, কম্পটন গামা রশ্মি মানমন্দির, চন্দ্র এক্স-রে মানমন্দির এবং স্পিৎজার স্পেস দূরবীক্ষণ সাথে।[৫]
একটি 2.4-মিটার (7.9 ফুট) আয়না সহ, হাবলের চারটি প্রধান যন্ত্র দৃশ্যমান এবং নিকটবর্তী অতিবেগুনী, পর্যবেক্ষণ এবং নিকটবর্তী অন্বেষণ বর্ণে পর্যবেক্ষণ করে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বিক্রির বাইরে হাবলের কক্ষপথটি অত্যন্ত উচ্চ-রেজোলিউশনের ছবি গ্রহণ করতে দেয়, যা স্থল-ভিত্তিক টেলিস্কোপের তুলনায় যথেষ্ট নিম্নতর পটভূমি লাইট। হাবল বেশিরভাগ বিস্তারিত দৃশ্যমান আলোর চিত্রই রেকর্ড করেছেন, যা স্থান ও সময়কে গভীর দৃষ্টিতে দেখতে দেয়। হাবলের অনেক পর্যবেক্ষণ জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিপ্লব সৃষ্টি করেছে, যেমন সঠিকভাবে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের হার নির্ণয় করা।
এইচএসটিটি ইউনাইটেড স্টেটস স্পেস এজেন্সি নাসা দ্বারা নির্মিত হয়েছিল, ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি থেকে অবদান। স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইনস্টিটিউট (STScI) হাবল এর লক্ষ্যগুলি নির্বাচন করে এবং ফলাফলগুলি তথ্যগুলি প্রক্রিয়া করে, যখন গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টার মহাকাশযানটি নিয়ন্ত্রণ করে।[৬]
স্পেস টেলিস্কোপগুলি 1923 সালের প্রথম দিকে প্রস্তাবিত হয়েছিল। 1983 সালে প্রস্তাবিত শুরু করা সাথে 1970-এর দশকে হাবলকে অর্থায়ন করা হয়েছিল, কিন্তু প্রকল্পটি প্রযুক্তিগত বিলম্ব, বাজেট সমস্যা, এবং চ্যালেঞ্জার দুর্যোগ (1986) দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। অবশেষে 1990 সালে চালু হয়, পাওয়া গেছে হাবল এর প্রধান আয়না ভুল মাটিতে ছিল, দূরবীন এর ক্ষমতা সমঝোতা। 1993 সালে একটি সার্ভিসিং মিশন দ্বারা আলোকবিদ্যা তাদের অভিপ্রায় মানের সংশোধন করা হয়েছিল
Hubble Space Telescope
হাবল একমাত্র টেলিস্কোপ মহাকাশে পরিসেবা করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে মহাকাশচারীগণ দ্বারা। 1990 সালে স্পেস শাটল ডিসকভারি চালু হওয়ার পর, পরবর্তী পাঁচটি স্পেস শাটল মিশন দূরবীক্ষণ যন্ত্রের মেরামত, আপগ্রেড এবং প্রতিস্থাপিত সিস্টেমগুলি, সমস্ত পাঁচটি প্রধান যন্ত্র সহ। কলম্বিয়া দুর্যোগের পর পঞ্চম মিশন নিরাপত্তার ভিত্তিতে বাতিল হয়ে যায় (2003)। তবে, আবেগপ্রবণ জনসাধারণের আলোচনার পর, নাসা প্রশাসক মাইক গ্রিফিন 2009 সালে সম্পন্ন পঞ্চম সার্ভিসিং মিশন অনুমোদন করে। টেলিস্কোপ 2018 হিসাবে কাজ করছে এবং 2030-2040 পর্যন্ত চলতে পারে। তার বৈজ্ঞানিক উত্তরাধিকারী, জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST), 2019 সালে চালু হওয়ার কথা রয়েছে।[৭]
ধারণা, নকশা এবং লক্ষ্য
প্রস্তাব এবং অগ্রদূত
মহাকাশচারী ওভেন গ্যারিওট স্কালেব এর মান্ড সৌর মহাকাশযান, 1973 এর পরে কাজ করে
১৯২৩ সালে, হেরমান অব্যর্থ (Hermann Oberth) – আধুনিক রকেটের পিতা হিসেবে বিবেচিত, রবার্ট এইচ (Robert H)। গডার্ড এবং কনস্ট্যান্টিন সিয়ালকোভস্কি (Konstantin Tsiolkovsky)-এর সাথে প্রকাশিত (মৃত) রাকটি জু ডেন প্ল্যানেটেনরুমেন (Rakete zu den Planetenräumen) (“দ্যা রকেট ইনটু প্লানেটারি স্পেস”), যা পৃথিবীর কক্ষপথে একটি দূরবীনকে কীভাবে চালিত করতে পারে? একটি রকেট দ্বারা।[৮]
হাবল স্পেস টেলিস্কোপের ইতিহাসটি ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানী লিমন স্পিৎসারের কাগজ “বহির্মুখী পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের জ্যোতির্বিদ্যা-সংক্রান্ত সুবিধার” খুঁজে পাওয়া যায়।[৯] এটিতে, তিনি দুটি প্রধান সুবিধার কথা আলোচনা করেছেন যে একটি স্থান-ভিত্তিক পর্যবেক্ষণকারী স্থল-ভিত্তিক টেলিস্কোপগুলির উপরে থাকবে। প্রথমত, কৌণিক সমাধানের (বস্তুগুলিকে স্পষ্টভাবে আলাদা করা যেতে পারে এমন ছোট ছোট বিভাজন) বায়ুমন্ডলে বিপর্যয়ের পরিবর্তে বিক্ষেপ দ্বারা সীমিত হবে, যার ফলে তারকাগুলিকে ঝলসানো হতে দেখা যায়, যা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে দৃশ্যমান। সেই সময় ভূগর্ভে অবস্থিত টেলিস্কোপগুলি ০.৫-১.০ টি আর্কসেকেন্ডের রেজুলেশনে সীমাবদ্ধ ছিল, ব্যাসের আয়তক্ষেত্র ২.৫ মিটার (8.2 ফুট) দিয়ে একটি টেলিস্কোপের জন্য একটি তাত্ত্বিক বিচ্ছুরণ-সীমিত সমাধানের 0.05 আর্কসেক্সের তুলনায় সীমিত ছিল। দ্বিতীয়ত, একটি স্পেস-ভিত্তিক টেলিস্কোপ অবলোহিত এবং অতিবেগুনী আলো দেখতে পারে, যা বায়ুমন্ডলে দৃঢ়ভাবে শোষিত হয়।
তহবিলের জন্য খোঁজা
নির্মাণ এবং প্রকৌশল
1972 সালের মার্চ মাসে পারকিন-এলমের হাবলের প্রাথমিক মিররকে পিষছিল
অপটিক্যাল দূরবীক্ষণ সমাবেশ (ওটিএ)
নামকরণ
বিজ্ঞানী এ্যাডউইন পি. হাব্লই (১৮৮৯-১৯৫৩) প্রথম, মহাজাগতিক বস্তুসমূহের ব্লু-শিফ্ট আর রেড-শিফ্ট দেখিয়ে প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, এই মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল; আর প্রতিটি বস্তু একটা আরেকটা থেকে ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছে; আর এই প্রমাণের উপর ভিত্তি করেই পরবর্তিতে মহাবিষ্ফোরণ তত্ত্বের প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।[১০] তাই এই বিজ্ঞানীকে সম্মান জানিয়ে হাবল টেলিস্কোপের নামকরণ করা হয়।[১১]
সংস্থাপন
বিশাল এই টেলিস্কোপটি নির্মাণ শেষ হলে ১৯৯০ সালের ২৪ এপ্রিল শাটল মিশন STS-31 দ্বারা স্পেস শাটল ডিসকভারি দিয়ে এটিকে পাঠানো হয় পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বাইরে, এর কক্ষপথে।[১২] পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ৫৯৬ কিলোমিটার উঁচুতে এর কক্ষপথে স্থান হয় টেলিস্কোপটির। তারপর সক্রীয় করা হয় একে।
বিবরণ
হাবল টেলিস্কোপ নিয়ন্ত্রণ করা হয় পৃথিবী থেকে। এটি একটি প্রতিফলন টেলিস্কোপ, আয়নার প্রতিফলনে সে দূরবর্তি বস্তুর তথ্য ধারণ করতে সক্ষম; সঠিক করে বললে হাবল মূলত ক্যাসেগ্রেইন রিফ্লেক্টর ঘরানার টেলিস্কোপ। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের জুলাইতে এতে জোড়া হয় চন্দ্র এক্স-রে টেলিস্কোপ। চন্দ্র’র ক্ষমতা এতটাই ব্যাপক যে, দেড় মাইল দূর থেকে ওটা দিয়ে দেড় ইঞ্চির কোনো লেখা অনায়াসে পড়া সম্ভব। প্রতি ৯৭ মিনিটে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ ঘণ্টায় ২৮,২০০ কিলোমিটার বেগে পৃথিবীকে একবার ঘুরে আসে। এর যাবতীয় শক্তি’র প্রয়োজন সে মেটায় সূর্যের আলো থেকে, এবং এজন্য এর রয়েছে ২৫ ফুট লম্বা দুটো সৌরপ্যানেল। আর শক্তি সঞ্চয়ের জন্য রয়েছে ৬টি নিকেল-হাইড্রোজেন ব্যাটারি, যেগুলো একত্রে ২০টা গাড়ির বিদ্যুৎ সংরক্ষণ করতে পারে।
হাবল টেলিস্কোপ অতিবেগুনী থেকে অবলোহিত পর্যন্ত (১১৫-২৫০০ ন্যানোমিটারে) আলোর সব তরঙ্গদৈর্ঘ্যে দেখতে সক্ষম। এই অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা নিয়ে হাবল যা পর্যবেক্ষণ করে তার প্রেক্ষিতে প্রতি সপ্তাহে ১২০ গিগাবাইট তথ্য পাঠায়। এতো এতো তথ্য সংরক্ষণে তাই ম্যাগনেটো-অপটিক্যাল ডিস্ক ব্যবহৃত হয়। হাবল, তার তোলা প্রথম ছবি পাঠায় ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের ২০ মে, সেটা ছিল স্টার ক্লাস্টার NGC 3532’র একটা দৃশ্য। সেই থেকে লক্ষাধিক ছবি পাঠিয়েছে পৃথিবীতে। আর সেসব ছবি বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে মহাবিশ্বের বয়স, জানা গেছে কোয়াযারদের সম্বন্ধে আর ডার্ক এনার্জি বা কৃষ্ণশক্তি সম্বন্ধে। হাবলের চোখ দিয়ে বিজ্ঞানীরা একেকটা গ্যালাক্সির বিভিন্ন অবস্থা সম্বন্ধে জেনেছেন। হাবল আবিষ্কার করে মহা শক্তিশালী গামা রে বার্স্ট বা গামারশ্মির বিষ্ফোরণ। হাবল, মহাকাশে গ্যাসের কিছু কুন্ডলি এমনভাবে আবিষ্কার করেছে, যেনবা তারা কিছু একটার ফাঁদে আটকা পড়েছে, যা ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে কাজ করে। হাবল, বৃহস্পতি’র উপগ্রহ ইউরোপার বাতাসে অক্সিজেনের উপস্থিতি সনাক্ত করেছে। এডউইন হাবল প্রমাণিত সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের মাত্রা আবিষ্কার করেছে হাবল টেলিস্কোপ। আর, হাবলের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে ৬,০০০-এরও বেশি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ।
Hubble Space Telescope
হাবলে ব্যবহৃত হয়েছে ওয়াইড ফিল্ড ক্যামেরা ৩ (WFC3), যা অতিবেগুনী রশ্মির কাছাকাছি রশ্মি, দৃশ্যমান আলোকরশ্মি, আর ইনফ্রারেডের কাছাকাছি রশ্মি দেখতে পারে। এর কস্মিক অরিজিন স্পেকট্রোস্কোপ (COS) অতিবেগুনীরশ্মিতে দেখতে পারে। এটা অনেকটা প্রিযমের মতো আলোকে ভাগ করে, ফলে এর দ্বারা দৃশ্যমান বস্তুর তাপমাত্রা, রাসায়নিক মিশ্রণ, ঘনত্ব, আর গতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এর অ্যাডভান্সড ক্যামেরা ফর সারফেস (ACS) দৃশ্যমান আলো দেখতে পারে, আর এটা ব্যবহৃত হয় মহাবিশ্বের প্রথম দিককার দৃশ্যগুলো ধারণ করতে। এছাড়া ডার্কম্যাটার, মহাবিশ্বের দূ-রবর্তি বস্তু, গ্যালাক্সির চাকতি ইত্যাদি গবেষণায়ও ব্যবহৃত হয়। এর স্পেস টেলিস্কোপ ইমেজিং স্পেকট্রোস্কোপ (STIS) অতিবেগুনী, দৃশ্যমান আলোকরশ্মি আর ইনফ্রারেডের কাছাকাছি আলো দেখতে সক্ষম, এবং এই যন্ত্রটি কৃষ্ণগহ্বর অনুসন্ধানে বেশ সক্ষম। এর নিয়ার ইনফ্রারেড ক্যামেরা অ্যান্ড মাল্টি-অবজেক্ট স্পেকট্রোমিটার (NICMOS) হলো হাবলের তাপ পরিমাপক যন্ত্র, এর দ্বারা লুক্কায়িত বস্তুর অনুসন্ধান করা হয়, আর দূরবর্তি আকাশে দৃষ্টি দেয়া হয়। আর এর ফাইন গাইড্যান্স সেন্সর (FGS) একে গাইড স্টার বা ধ্রুব তারা চিহ্নিত করে হাবলকে সেদিকে স্থির দৃষ্টিতে তাক করে থাকতে সহায়তা করে। এর সহায়তায় আরো যে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করা হয় তা হলো দুটো তারার মধ্যকার দূরত্ব আর তাদের আনুপাতিক গতি পরিমাপ।
এই টেলিস্কোপটি নাসা পাঠালেও পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকোনো বিজ্ঞানী হাবলকে ব্যবহারের অনুমতি চাইতে পারেন। অভিজ্ঞদের একটা প্যানেল তখন সেখান থেকে যোগ্যতমটি বাছাই করে সেদিকে হাবলকে ঘুরিয়ে সেখানকার ছবি তুলে পাঠান সেই বিজ্ঞানীকে বা সেই বিজ্ঞান মহলকে। প্রতিবছর এরকম বহু আবেদন জমা পড়ে, তবে সেখান থেকে বছরে প্রায় ১,০০০ আবেদন যাচাই করে প্রায় ২০০ আবেদন মঞ্জুর করা হয়, আর সেই আবেদন অনুযায়ী কাজ করতে হাবলকে মোটামুটি ২০,০০০ একক পর্যবেক্ষণ করতে হয়।
হাবলের দেখভাল আর ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে নাসা’র গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টার, আর স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইন্সটিটিউট (STScl)।
পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপ থলিEarth’s internal heat pockets পৃথিবীর তাপীয় ইতিহাসের মৌলিক অংশ। অনুমান করা হয় পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে পৃষ্ঠতলের তাপের প্রবাহ ৪৭±২ টেরাওয়াট।[১] এবং প্রায় সমান পরিমাণে দুটি প্রধান উৎস থেকে এই তাপ আসে। এর একটি হল ম্যান্টল এবং ভূপৃষ্ঠে অবস্থিত সমস্থানিকগুলির তেজস্ক্রিয় বিকিরণ দ্বারা উৎপাদিত তেজস্ক্রিয় উত্তাপ, এবং অপরটি পৃথিবীর গঠনের সময় উৎপন্ন আদ্য তাপ যার কিছু পরিমান এখনো থেকে গেছে।[২]
পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপ অধিকাংশ ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াগুলিকে শক্তি প্রদান করে[৩] এবং ভূত্বকীয় পাত গুলিকে চালনা করে।[২] এর ভূতাত্ত্বিক তাৎপর্য থাকা সত্ত্বেও, আসলে পৃথিবীর মোট তাপ থলির মাত্র ০.০৩% তাপশক্তি পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে ভূপৃষ্ঠে আসে, সেই জায়গায় সৌর বিকিরণ থেকে নির্গত হয় ১৭৩,০০০ টেরাওয়াট তাপশক্তি।[৪] এই সৌর বিকিরণ, প্রতফলনের পরে যা অবশেষে ভূপৃষ্ঠে এসে পৌঁছোয়, প্রতিদিনের চক্রে কেবল কিছু দশক সেন্টিমিটার এবং বার্ষিক চক্রের কিছু দশক মিটার পর্যন্ত পৃথিবী পৃষ্ঠে প্রবেশ করতে পারে। সুতরাং অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াগুলির জন্য সৌর বিকিরণের বিশেষ কোন তাৎপর্য নেই।[৫]
পৃথিবীর শীতলীভবনের হারের গণনার উপর ভিত্তি করে (পৃথিবীর অভ্যন্তরে ধ্রুবক পরিবাহিতা অনুমান করে নিয়ে), ১৮৬২ সালে উইলিয়াম থমসন, (পরে লর্ড কেলভিন) পৃথিবীর বয়স অনুমান করেছিলেন ৯৮ মিলিয়ন বছর,[৭] কিন্তু তেজষ্ক্রিয়তা সময় নির্ণয় করে পাওয়া গেছে পৃথিবীর বয়স ৪.৫ বিলিয়ন বছর। সুতরাং এই দুটি সময় একেবারেই মেলেনি।[৮] ১৮৯৫ সালে জন পেরি প্রস্তাব করে বলেছিলেন[৯] পৃথিবীর অভ্যন্তরে পরিবর্তনশীল পরিবাহিতা পৃথিবীর গণনা করা বয়সকে কোটি কোটি বছর বাড়িয়ে তুলতে পারে, তেজষ্ক্রিয়তা সময় নির্ণয় দিয়ে এটি পরে নিশ্চিত করা গিয়েছিল। থমসনের যুক্তির স্বাভাবিক উপস্থাপনার বিপরীতে, তাপের উৎস হিসাবে তেজস্ক্রিয়তাকে যোগ করে পর্যবেক্ষণ করে পাওয়া পৃথিবীর ভূত্বকের তাপীয় নতি ব্যাখ্যা করা যাবে না। আরও উল্লেখযোগ্যভাবে, পৃথিবীর মধ্যে যে তাপ পরিবাহিত হয় সেটি ম্যান্টল পরিচলন ক্রিয়া দ্বারা পরিবর্তিত হয়। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে থমসনের অনুমান,-শুধুমাত্র পরিবহনের মাধ্যমে শীতলতা- এই যুক্তি অসিদ্ধ হয়ে যায়।
বৈশ্বিক অভ্যন্তরীণ তাপ প্রবাহ
পৃথিবীর প্রস্থচ্ছেদে দেখা যাচ্ছে এর প্রধান বিভাগ এবং পৃথিবীর মোট অভ্যন্তরীণ তাপ প্রবাহে তাদের আনুমানিক অবদান, এবং পৃথিবীর মধ্যে প্রধান তাপ পরিবহন প্রক্রিয়া
পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে পৃথিবী পৃষ্ঠ পর্যন্ত মোট তাপ প্রবাহের আনুমানিক মাপ ৪৩ টেরাওয়াট থেকে ৪৯ টেরাওয়াটের (টেরাওয়াট হল ১০১২ওয়াট) মধ্যে থাকে।[১০] একটি সাম্প্রতিক অনুমান হল ৪৭ টেরাওয়াট,[১] যেটি গড় ৯১.৬ মিলিওয়াট/মি২ তাপ প্রবাহের সমতুল্য, এবং ৩৮,০০০ এর বেশি পরিমাপের উপর ভিত্তি করে এটই নির্দিষ্ট হয়েছে। মহাদেশীয় এবং মহাসাগরীয় ভূত্বকের তাপ প্রবাহ হল যথাক্রমে ৭০.৯ এবং ১০৫.৪ মিলিওয়াট/মি২।[১]
যখন পৃথিবীর মোট অভ্যন্তরীণ তাপের প্রবাহ ভূত্বকে সেভাবে পৌঁছোয় না, পৃথিবীর তাপের দুটি মূল উৎস,- তেজষ্ক্রিয় এবং আদ্য তাপ-এদের আপেক্ষিক অবদান অত্যন্ত অনিশ্চিত। কারণ এগুলি সরাসরি পরিমাপ করা কঠিন। রাসায়নিক এবং ভৌত পরীক্ষা অনুযায়ী এই তাপ অবদানের আনুমানিক পরিসর তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ জনিত উত্তাপ থেকে ১৫–৪১ টেরাওয়াট এবং আদ্য তাপ থেকে ১২–৩০ টেরাওয়াট।[১০]
পৃথিবীর কাঠামো হ’ল বাইরে একটি শক্ত ভূত্বক, যার মধ্যে মহাদেশীয় ভূত্বক হল তুলনামূলকভাবে পুরু এবং মহাসাগরীয় ভূত্বক হল পাতলা, তবে দুটিই কঠিন। এর নিচে আছে কঠিন কিন্তু বহতা ম্যান্টল, তার নিচে তরল বহির্মজ্জা, এবং শেষে একটি কঠিন অন্তর্মজ্জা। কোনও উপাদানের বহমানতা তার তাপমাত্রার সমানুপাতিক; তাই, পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপ প্রবাহের অভিব্যক্তি হিসাবে শক্ত ম্যান্টল এখনও তাপমাত্রার ক্রিয়াকলাপে দীর্ঘ সময়ের হিসেবে প্রবাহিত হতে পারে।[২] পৃথিবীর অন্তস্থল থেকে কিভাবে তাপমুক্ত হচ্ছে তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে ম্যান্টল পরিচলন ঘটে। অধিক উত্তপ্ত ভাসমান ম্যান্টল ওপর দিকে ওঠে এবং তুলনামূলক ভাবে কম উত্তপ্ত ঘনতর ম্যান্টল নিচের দিকে চলে যায়। ম্যান্টলের এই পরিচলন প্রবাহ পৃথিবীর অশ্মমণ্ডল পাতের চলাচলকে নিয়ন্ত্রিত করে। এইভাবে, ভূত্বকীয় পাতের ক্রিয়াকলাপের জন্য নিম্ন ম্যান্টলে তাপের অতিরিক্ত ভাণ্ডারটি গুরুত্বপূর্ণ এবং নিম্ন ম্যান্টলে যে তেজস্ক্রিয় উপাদানগুলি জমা আছে তাদের সমৃদ্ধকরণের সম্ভাব্য উৎস।[১১]
Earth’s internal heat pockets
পৃথিবীর তাপ পরিবহন ঘটে পরিবহন, ম্যান্টল পরিচলন, জলবাহী সংবহন, এবং আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণের মাধ্যমে।[১২] পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপ প্রবাহের যতটা ভূ-পৃষ্ঠে আসে তার ৮০% ম্যান্টল পরিচলনের মাধ্যমে হয়। বাকি তাপের বেশিরভাগই পৃথিবীর ভূত্বকে উদ্ভূত হয়।[১৩] আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুপাত, ভূমিকম্প এবং পর্বতমালা সৃষ্টির কারণে প্রায় ১% এর মত তাপ আসে।[২] সুতরাং, পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপের প্রায় ৯৯% ভূত্বকে পরিবহনের মাধ্যমে ক্ষয় হয়, এবং ম্যান্টল পরিচলন এই তাপ পরিবহনে প্রধান ভূমিকা নেয়। পুরু মহাদেশীয় ভূত্বক থেকে বেশিরভাগ তাপ প্রবাহ অভ্যন্তরীণ তেজস্ক্রিয় বিকিরণের জন্য হয়; বিপরীতে পাতলা মহাসাগরীয় ভূত্বকে অভ্যন্তরীণ তেজস্ক্রিয় বিকিরণের তাপ মাত্র ২%।[২] উপরিভাগে অবশিষ্ট তাপ প্রবাহ ম্যান্টল পরিচলনের থেকে ভূত্বকের তলদেশীয় উত্তাপের কারণে হয়। তাপের প্রবাহ শিলার বয়সের সাথে ব্যাস্তানুপাতিকভাবে সম্পর্কিত,[১]মধ্য-মহাসাগর শৈলশিরার নবীনতম শৈল থেকে সর্বোচ্চ তাপ প্রবাহ হয়, এটি দেখা গেছে পৃথিবীর তাপ প্রবাহের বৈশ্বিক মানচিত্র থেকে।[১]
পৃথিবীর ম্যান্টল এবং ভূত্বকে তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের ফলে পরবর্তী সমস্থানিকের জন্ম হয় এবং জিওনিউট্রিনো ও তাপশক্তি বা তেজস্ক্রিয় তাপ নিসৃত হয়। অন্যান্য তেজস্ক্রিয় সমস্থানিকের তুলনায় চারটি প্রধান তেজস্ক্রিয় সমস্থানিক তেজস্ক্রিয় তাপের সিংহভাগের জন্য দায়ী। সেগুলি হল: ইউরেনিয়াম-২৩৮ (২৩৮ইউ), ইউরেনিয়াম-২৩৫ (২৩৫ইউ), থোরিয়াম-২৩২ (২৩২থো), এবং পটাসিয়াম-৪০ (৪০কে)।[১৪] ২০০ কিলোমিটার গভীরতা থেকে শিলা নমুনাপ্রাপ্তির অসম্ভাব্যতার কারণে, পুরো ম্যান্টলে জুড়ে নির্দিষ্টভাবে তেজস্ক্রিয় তাপ নির্ধারণ করা শক্ত,[১৪] যদিও কিছু অনুমান পাওয়া যায়।[১৫] পৃথিবীর মজ্জাংশে, ভূ-রসায়ন অধ্যয়ন ইঙ্গিত দেয় যে ওই অঞ্চলে তেজস্ক্রিয় উপাদানগুলির কম ঘনত্বের কারণে তাদের তেজস্ক্রিয় তাপের উল্লেখযোগ্য উৎস হওয়ার সম্ভাবনা নেই।[১৬] ম্যান্টলে তেজস্ক্রিয় তাপ উৎপাদন বিষয়টি ম্যান্টল পরিচলনের কাঠামোর সাথে যুক্ত। ধারণা করা হয় যে নিম্ন ম্যান্টলের কাঠামোতে উচ্চ ঘনত্বের স্তরযুক্ত তেজস্ক্রিয় তাপ উৎপাদনকারী উপাদান থাকতে পারে, অথবা সমস্ত ম্যান্টল জুড়ে ছোট ছোট তেজস্ক্রিয় পদার্থের ভাণ্ডার থাকতে পারে।[১৭]
Earth’s internal heat pockets
সমস্থানিক
তাপমুক্তি ওয়াট/কিগ্রা সমস্থানিক
অর্দ্ধায়ু বছর
ম্যান্টলের গড় ঘনত্ব কিগ্রা সমস্থানিক/কিগ্রা ম্যান্টল
তাপমুক্তি ওয়াট/কিগ্রা ম্যান্টল
২৩২থো
২৬.৪×১০−৬
১৪.০×১০৯
১২৪×১০−৯
৩.২৭×১০−১২
২৩৮ইউ
৯৪.৬×১০−৬
৪.৪৭×১০৯
৩০.৮×১০−৯
২.৯১×১০−১২
৪০কে
২৯.২×১০−৬
১.২৫×১০৯
৩৬.৯×১০−৯
১.০৮×১০−১২
২৩৫ইউ
৫৬৯×১০−৬
০.৭০৪×১০৯
০.২২×১০−৯
০.১২৫×১০−১২
জিওনিউট্রিনো শনাক্তকারী ২৩৮ইউ এবং ২৩১থো এর ক্ষয় শনাক্ত করতে পারে এবং এইভাবে বর্তমান তেজস্ক্রিয় তাপ থলিতে তাদের অবদান অনুমানের করা যায়, কিন্তু ২৩৫ইউ এবং ৪০কে – এদের শনাক্ত করা যায় না। তবুও, মনে করা হয় ৪০কে এর অবদান ৪ টেরাওয়াট তাপশক্তি।[১৮] তবে সংক্ষিপ্ত অর্ধায়ুর কারণে ২৩৫ইউ এবং ৪০কে এর ক্ষয় প্রথম অবস্থার পৃথিবীতে তেজস্ক্রিয় তাপ প্রবাহে বড় অবদান রেখেছিল। বর্তমানের চেয়ে সেই সময় পৃথিবী অনেক বেশি উত্তপ্ত ছিল।[১১] পৃথিবীর মধ্য থেকে তেজস্ক্রিয় ক্ষয়ের মাধ্যমে মুক্ত জিওনিউট্রিনোর পরিমাপের প্রাথমিক ফলাফল, তেজস্ক্রিয় তাপের একটি প্রতিনিধিত্বকারী সংখ্যা, অনুমান দিয়েছিল যে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ মোট তাপ উৎসের অর্ধেক হল তেজস্ক্রিয় তাপ[১৮] এবং এটি পূর্ববর্তী অনুমানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।[১৭]
আদ্য তাপ হল পৃথিবী তার আসল গঠন থেকে ক্রমশ শীতল হতে থাকায় যে তাপ হারিয়েছে, এবং এটি এখনও সক্রিয়ভাবে উৎপাদিত তেজস্ক্রিয় উত্তাপের বিপরীতে। পৃথিবীর মজ্জার তাপ প্রবাহ—মজ্জা ত্যাগ করে তা ওপরে অবস্থিত ম্যান্টলের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে—এটি আদ্য তাপের কারণে বলেই মনে করা হয়, এবং অনুমান করা হয় এর পরিমান ৫–১৫ টেরাওয়াট।[১৯] ম্যান্টলের আদ্য তাপ হ্রাসের পরিমানের অনুমান ৭ থেকে ১৫ টেরাওয়াটের মধ্যে। এটি গণনা করা হয় মূল তাপ প্রবাহ এবং পৃষ্ঠের তাপ প্রবাহ থেকে পাওয়া মোট তেজস্ক্রিয় উত্তাপের ব্যবকলন করে।[১০]
দলিত বৌদ্ধ আন্দোলন বা নববৌদ্ধ আন্দোলন (পালি : নবযান)[১] হল বিংশ শতাব্দীতে সিংহলিবৌদ্ধ ভিক্ষুগণের সহায়তায় ভারতের দলিতগণকে নিয়ে গড়ে ওঠা একটি বৌদ্ধ নবজাগরণ। ভারতের দলিত আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ভীমরাও আম্বেডকর বর্ণাশ্রম ভিত্তিক ব্রাহ্মণ্য হিন্দুসমাজের নিন্দাপূর্বক সমস্ত দলিত অর্থাৎ শূদ্রাদি নিম্নবর্ণীয় ব্যক্তিগণকে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হতে আহ্বান করেন এবং এর ফলে এই আন্দোলন বিশেষ তাৎপর্য লাভ করে।
১৮৯৮ সালে, পন্ডিত ইয়োথি থাস তামিলনাড়ুতে শাক্য বৌদ্ধ সমাজ – ভারতীয় বৌদ্ধ সমিতি নামেও পরিচিত – প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি দলিতদের জন্য হিন্দু ধর্মের ধর্মীয় বিকল্প হিসেবে বৌদ্ধ ধর্মকে উপস্থাপন করেন। থাসের প্রচেষ্টার ফলে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতে তামিল দলিতদের মধ্যে একটি বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে ওঠে। ভারতীয় বৌদ্ধ সমিতির প্রথম সভাপতি ছিলেন পল ক্যারাস। আম্বেদকরবাদী আন্দোলনের বিপরীতে, ভারতীয় বৌদ্ধ সমিতি শ্রীলঙ্কায় প্রতিষ্ঠিত থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের ঐতিহ্যকে গ্রহণ করে (যেখানে থাস তার প্রশিক্ষণ এবং বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন)।[২]
দুটি আদি ধর্ম আন্দোলন – যেগুলি বৌদ্ধ ধর্মের পক্ষে হিন্দু ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করেছিল – উত্তরপ্রদেশে স্বামী অচ্যুতানন্দ হরিহর এবং পাঞ্জাবে বাবু মঙ্গু রাম চালু করেছিলেন। একটি অস্পৃশ্য পরিবারে জন্মগ্রহণকারী, অচ্যুতানন্দ আর্য সমাজ শুদ্ধি সংস্কার আন্দোলনে যোগদান করেন এবং সেখানে প্রায় আট বছর (১৯০৫-১৯১২) কাজ করেন।[৩] তিনি অনুভব করেছিলেন যে আর্য সমাজ সূক্ষ্ম উপায়ে অস্পৃশ্যতা অনুশীলন করে এবং পরবর্তীকালে সামাজিক-রাজনৈতিক ভারতীয় অছুত মহাসভা আন্দোলন শুরু করার জন্য এটি ছেড়ে দেয়। অচ্যুতানন্দ আদি-হিন্দু পত্রিকা প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি দলিতদেরকে “ভারতীয়দের আদি ধর্ম” হিসেবে আদি-ধর্মে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান।[৪] অচ্যুতানন্দ একটি যৌথ সাংস্কৃতিক ও জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে তার দর্শন প্রণয়ন করেছিলেন। তিনি এটি উপজাতি সমাজ সহ দলিতদের বাইরেও দর্শকদের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন এবং উপবাসের পাশাপাশি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিরোধিতা করেছিলেন, এই বলে যে ব্রাহ্মণরা “ব্রিটিশদের মতই ভারতে বিদেশী” ছিল, আনন্দ তেলতুম্বদে অনুসারে। বাবু মঙ্গু রামও পাঞ্জাবের একটি অস্পৃশ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যার একটি সমৃদ্ধ চামড়া ব্যবসা ছিল।
মঙ্গু রাম ১৯০৯ সালে ২৩ বছর বয়সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসেন এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় কাজ করেন।[৪] সেখানে, তিনি গদর পার্টিতে যোগ দেন এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করার জন্য ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ভারতে অস্ত্র পাচার করেন। ১৯২৫ সালে, তিনি দলিত স্বাধীনতার দিকে মনোনিবেশ করেন, “অ্যাড ধর্ম” আন্দোলনের পাশাপাশি তার ধারণাগুলি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আদি-ডাঙ্কা নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা চালু করেন। তেলতুম্বডের মতে, মান্ডু রামের ধর্মীয় আন্দোলন বাস্তবায়িত হতে ব্যর্থ হয় এবং মঙ্গু রাম পরে আম্বেদকরবাদী আন্দোলনে যোগ দেন।[৫] ১৯১৪ সালে, প্রকাশকে কলকাতায় বোধনন্দ মহাস্তবীর হিসেবে নিযুক্ত করা হয় এবং লখনউতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার শুরু করেন। তিনি ১৯১৬ সালে ভারতীয় বুদ্ধ সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯২৮ সালে একটি বিহার স্থাপন করেন।[৬]
১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দেয়েবলা সম্মেলনে বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেডকর ঘোষণা করেন যে তিনি কিছুতেই একজন হিন্দুধর্মাবলম্বী হিসেবে মৃত্যুবরণ করবেন না কারণ হিন্দুধর্ম বর্ণভিত্তিক সমাজব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে বিভেদ এবং বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। এর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ আম্বেডকরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং প্রত্যেকেই তাকে স্ব স্ব ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার আহ্বান জানান। এরপর বিভিন্ন বৈঠকে দলিতদের ধর্মান্তরিত হওয়ার ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিকগুলি আলোচিত হয়। ১৯৩৬ সালের ২২ মে লখনউতে একটি ” সর্বধর্ম সম্মেলন ” অনুষ্ঠিত হয়। জগজীবন রাম সহ বহু বিশিষ্ট দলিত নেতৃবর্গ উক্ত সম্মেলনে যোগদান করেন, যদিও বাবাসাহেব আম্বেডকর এই সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে পারেননি। এই সম্মেলনে ইসলাম, খ্রিস্ট ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্ম সহ বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিগণ তাদের ধর্মের গুণাবলি দলিত নেতাদের সামনে ব্যাখ্যা করেন।
১০ জুন, ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ভিক্ষু লোকনাথবাবাসাহেব আম্বেডকরেরদাদরের বাসভবনে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার জন্য তাকে অনুরোধ করেন। পরে গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লোকনাথ জানান যে আম্বেডকরবৌদ্ধ ধর্মের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং সমগ্র দলিত সম্প্রদায়কে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত করার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছেন। ১৯৩৭ সালে লোকনাথ তার সিংহলে অবস্থিত ছাপাখানা থেকে ভারতের নিপীড়িত এবং দলিত সম্প্রদায়ের উদ্দেশে একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেন যাতে লিখিত হয়, বৌদ্ধ ধর্ম আপনাদের মুক্তি এনে দেবে।
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের প্রথমার্ধে আম্বেডকর একবার কানপুরে অবস্থিত আচার্য ঈশ্বরদত্ত মেধার্থীর বুদ্ধিপুরী বিদ্যালয়ে ভ্রমণ করেন। ইতঃপূর্বেই মেধার্থী ভিক্ষু লোকনাথ কর্তৃক বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন এবং ১৯৪০ সালের মধ্যভাগে তার আম্বেডকরের সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। দিল্লিতে কিছুদিনের জন্য আম্বেডকর আচার্য মেধার্থীর নিকটে পালি ভাষাও শিক্ষা করেন।
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দেকোল্হাপুরের মহারাজ চতুর্থ সাহু কর্তৃক আয়োজিত ” অব্রাহ্মণ সম্মেলন “-এ আম্বেডকর প্রথমবার বোধানন্দ মহাস্থবিরের সাক্ষাৎপ্রাপ্ত হন। ১৯৪০ সালে পর পর দু’টি অনুষ্ঠানে তারা পুনরায় সাক্ষাৎ করেন এবং ধর্ম বিষয়ে আলোচনা করেন। মহাস্থবির আম্বেডকরের দ্বিতীয় বিবাহে আপত্তি প্রকাশ করেন কারণ তার দ্বিতীয়া স্ত্রী ছিলেন ব্রাহ্মণ কুলজাতা। পরবর্তীকালে মহাস্থবিরের অনুগামীগণ আম্বেডকরের ” রিপাবলিকান পার্টি ” (Republican Party)-তে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
দলিতদের জন্য একমাত্র বৌদ্ধ ধর্মই মঙ্গলপ্রদ, এই তত্ত্বের উপর বহু গ্রন্থ প্রকাশের পর আম্বেডকর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ অক্টোবর নাগপুরেরদীক্ষাভূমিতে আনুষ্ঠানিকভাবে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন। তিনি একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাছ থেকে ত্রিরত্ন এবং পঞ্চশীল গ্রহণ করেন। এরপর সেখানে উপস্থিত তার ৩৮০০০০ অনুগামীও বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। সেই দীক্ষানুষ্ঠানে আচার্য ঈশ্বরদত্ত মেধার্থী এবং তার শিষ্য ভোজদেব মুদিত-ও উপস্থিত ছিলেন।
এর পরবর্তীকালে বহু ধর্মান্তরিত দলিত নিজেদের ” আম্বেডকর বৌদ্ধ ” বলে অভিহিত করেছেন কারণ আম্বেডকরের দীক্ষাগ্রহণের মাধ্যমেই এই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। আবার কেউ কেউ এই আন্দোলনকে নববৌদ্ধ আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন কারণ এর ফলে ভারতে অবলুপ্তপ্রায় বৌদ্ধ ধর্মের পুনর্জাগরণ সম্ভব হয়েছিল।
আম্বেডকর কর্তৃক গৃহীত ২২টি শপথ
Dalit Buddhist movement
স্বয়ং দীক্ষাগ্রহণের পর আম্বেডকর তার অনুগামীগণকে দীক্ষাপ্রদান করেন। ত্রিরত্ন এবং পঞ্চশীল গ্রহণের পর তারা সম্মিলিতভাবে ২২টি শপথ গ্রহণ করেন। এরপর ১৬ অক্টোবর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দেআম্বেডকর অপর একটি গণদীক্ষার আয়োজন করেন এবং সেখানেও নবদীক্ষিত বৌদ্ধগণকে নিম্নোল্লিখিত ২২টি শপথ প্রদান করেন।
আমি জগতের সকল জীবের প্রতি দয়া এবং করুণা প্রদর্শন করব এবং তাদের রক্ষা করব।
আমি চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করব না।
আমি মিথ্যা বাক্য উচ্চারণ করব না এবং কখনও মিথ্যাচার করব না।
আমি ইন্দ্রিয়কাম চরিতার্থ করার জন্য কোন অসাধু কার্যে লিপ্ত হব না।
আমি মদ্যাদি মাদকদ্রব্য সেবন করব না।
আমি জীবনে প্রতিনিয়ত অষ্টাঙ্গ মার্গ অনুশীলনের প্রয়াস করব এবং সকলের প্রতি করুণা অভ্যাস করব।
আমি হিন্দুধর্ম ত্যাগ করছি কারণ হিন্দুধর্ম মনুষ্যত্বের পক্ষে ক্ষতিকর। হিন্দুধর্ম বর্ণাশ্রমভিত্তিক সমাজব্যবস্থার মাধ্যমে মানবসমাজে বিভেদের প্রাচীর সৃষ্টি করেছে এবং সাম্য প্রতিষ্ঠাকে প্রতিহত করেছে। তাই আমি বৌদ্ধ ধর্মকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমার ধর্ম হিসেবে অবলম্বন করলাম।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক প্রচারিত ধর্মই একমাত্র সত্য ধর্ম।
আমি বিশ্বাস করি যে আমি জন্মান্তরিত হয়েছি।
আমি এতদ্বারা ঘোষণা করছি যে আমি ভবিষ্যতে ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক প্রচারিত ধর্ম দর্শন এবং শিক্ষানুসারে জীবনযাপন করব।
বৌদ্ধ আন্দোলন কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল আম্বেদকরের ধর্মান্তরের পরেই তার মৃত্যুর কারণে। এটি অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে তাৎক্ষণিক জনসমর্থন পায়নি যা আম্বেদকর আশা করেছিলেন। আম্বেদকরবাদী আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে বিভাজন এবং দিকনির্দেশনার অভাব একটি অতিরিক্ত বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন মানুষের দ্বারা তা আবারও প্রসারিত হয়। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, বর্তমানে ভারতে ৮.৪৪ মিলিয়ন বৌদ্ধ রয়েছে, যাদের মধ্যে অন্তত 6.5 মিলিয়ন মহারাষ্ট্রে মারাঠি বৌদ্ধ। এটি বৌদ্ধধর্মকে ভারতের পঞ্চম বৃহত্তম ধর্ম এবং মহারাষ্ট্রের জনসংখ্যার ৬%, কিন্তু ভারতের সামগ্রিক জনসংখ্যার ৩%-এরও কম।[৭]
বৌদ্ধ পুনরুজ্জীবন দুটি রাজ্যে কেন্দ্রীভূত রয়েছে: আম্বেদকরের জন্মস্থান মহারাষ্ট্র এবং উত্তর প্রদেশ – বোধনন্দ মহাস্তবীর, আচার্য মেধারথি এবং তাদের সহযোগীদের দেশ।
হিব্রু বাইবেল (Hebrew Bible) বলতে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ধর্মীয় পুস্তকাবলীর সাধারণ অংশকে বোঝায়। পণ্ডিতেরা খ্রিস্টানদের পুরাতন বাইবেল (Old Testament) বা ইহুদিদের তানাখ (Tanakh) (যে গ্রন্থগুলো প্রকৃতপক্ষে একই) বোঝাতে গিয়ে এই পরিভাষাকেই নিরপেক্ষ মনে করে ব্যবহার করেন। হিব্রু বাইবেলকে ইহুদিরাতানাখ বলে থাকে। গ্রন্থটির তিনটি অংশের আদ্যক্ষরের সমন্বয়ে তানাখ শব্দটি গঠিত। ইসলাম ধর্মবিশ্বাসীগণ বিশ্বাস করেন মুসার উপর তাওরাত কিতাব নাজিল হয়। কিন্তু তারা তানাখকে তাওরাত কিতাব বলে স্বীকৃতি দেয় না।
ভগবদ্গীতা (সংস্কৃত: भगवद्गीता, ˈbʱəɡəʋəd̪ ɡiːˈt̪aː (সাহায্য·তথ্য), ভগবানের গান) বা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা বা গীতা একটি ৭০০-শ্লোকের হিন্দু ধর্মগ্রন্থ। এটি প্রাচীন সংস্কৃতমহাকাব্যমহাভারত-এর একটি অংশ। যদিও গীতা একটি স্বতন্ত্র ধর্মগ্রন্থ তথা একটি পৃথক উপনিষদের মর্যাদা পেয়ে থাকে। হিন্দুরা গীতা-কে ভগবানের মুখনিঃসৃত বাণী মনে করেন। হিন্দুধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যের ইতিহাসে গীতা এক বিশেষ স্থানের অধিকারী।[১৭]গীতা-র কথক কৃষ্ণ হিন্দুদের দৃষ্টিতে ঈশ্বরের অবতার পরমাত্মা স্বয়ং।[১৭] তাই গীতা-য় তাকে বলা হয়েছে “শ্রীভগবান”।[১৮]
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের রথচালকের ভূমিকায় কৃষ্ণ
গীতা-র বিষয়বস্তু কৃষ্ণ ও পাণ্ডব রাজকুমার অর্জুনের কথোপকথন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু ঠিক আগে শত্রুপক্ষে আত্মীয়, বন্ধু ও গুরুকে দেখে অর্জুন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। এই সময় কৃষ্ণ তাকে ক্ষত্রিয় যোদ্ধার ধর্ম স্মরণ করিয়ে দিয়ে এবং বিভিন্ন প্রকার যোগশাস্ত্র[১৯] ও বৈদান্তিক দর্শন ব্যাখ্যা করে তাকে যুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করেন। তাই গীতা-কে বলা হয় হিন্দু ধর্মতত্ত্বের একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ এবং হিন্দুদের জীবনচর্যার একটি ব্যবহারিক পথনির্দেশিকা। যোগশাস্ত্র ব্যাখ্যার সময় কৃষ্ণ নিজের “স্বয়ং ভগবান” রূপটি উন্মোচিত করেন এবং বিশ্বরূপে অর্জুনকে দর্শন দিয়ে আশীর্বাদ করেন। অর্জুন ছাড়া প্রত্যক্ষভাবে কৃষ্ণের মুখ থেকে গীতা শুনেছিলেন সঞ্জয় (তিনি যুদ্ধের ঘটনা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বর্ণনা করার জন্য বেদব্যাসের কাছ থেকে দিব্য দৃষ্টি লাভ করেছিলেন), হনুমান (তিনি অর্জুনের রথের চূড়ায় বসে ছিলেন) ও ঘটোৎকচের পুত্র বর্বরিক যিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সব ঘটনা দেখেছিলেন)।
গীতা-কে গীতোপনিষদ বলা হয়। অর্থাৎ, গীতাউপনিষদ বা বৈদান্তিক সাহিত্যের অন্তর্গত।[২০] “উপনিষদ্” নামধারী ধর্মগ্রন্থগুলি শ্রুতিশাস্ত্রের অন্তর্গত হলেও, মহাভারত-এর অংশ বলে গীতা স্মৃতিশাস্ত্রের অন্তর্গত।[২১][২২] আবার উপনিষদের শিক্ষার সারবস্তু গীতা-য় সংকলিত হয়েছে বলে একে বলা হয় “উপনিষদসমূহের উপনিষদ”।[২৩]গীতা-কে মোক্ষশাস্ত্র নামেও অভিহিত করা হয়।[২৪]
পুরাণ (সংস্কৃত: पुराण purāṇa, “প্রাচীনযুগীয়”) হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের গুরুত্বপূর্ণ আখ্যানমূলক ধর্মগ্রন্থ-সমুচ্চয়। পুরাণে সৃষ্টি থেকে প্রলয় পর্যন্ত ব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাস, রাজন্যবর্গ, যোদ্ধৃবর্গ, ঋষি ও উপদেবতাগণের বংশবৃত্তান্ত এবং হিন্দু সৃষ্টিতত্ত্ব, দর্শন ও ভূগোলতত্ত্ব আলোচিত হয়েছে।[২৭] পুরাণে সাধারণত নির্দিষ্ট কোনো দেবতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং তাতে ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তার প্রাবল্যও লক্ষিত হয়। এই গ্রন্থগুলি প্রধানত আখ্যায়িকার আকারে রচিত, যা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।
লোকমতে, মহাভারত-রচয়িতা বেদব্যাস পুরাণসমূহের সংকলক।[২৮] যদিও পুরাণের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন পাঠগুলি গুপ্ত সাম্রাজ্যের (খ্রিস্টীয় তৃতীয়-পঞ্চম শতাব্দী) সমসাময়িক। এর অধিকাংশ উপাদানই ঐতিহাসিক বা অন্যান্য সূত্রাণুযায়ী এই সময়কাল ও তার পরবর্তী শতাব্দীগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত। পুরাণগ্রন্থগুলি ভারতের নানা স্থানে রচিত হয়েছিল। পুরাণের সামগ্রিক পাঠে কিছু সাধারণ ধারণা লক্ষিত হয়; কিন্তু একটি পুরাণের উপর অপর আরেকটি পুরাণের প্রভাব অন্বেষণ দুঃসাধ্য। তাই সাধারণভাবে এগুলিকে সমসাময়িক বলেই ধরে নেওয়া হয়।.[২৯]
লিখিত পাঠ্যগুলির রচনাতারিখ পুরাণের প্রকৃত রচনাতারিখ নয়। কারণ একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে পূর্ববর্তী এক সহস্রাব্দ কাল ধরে এই কাহিনিগুলি মৌখিকভাবে প্রচারিত হয়ে আসে। এবং পরবর্তীকালে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত এগুলির আকার ও রূপ পরিবর্তিত হতে দেখা যায়।[৩০]
কাশীর মহারাজা ডক্টর বিভূতি নারায়ণ সিংহের পৃষ্ঠপোষকতা ও তত্ত্বাবধানে অল ইন্ডিয়া কাশীরাজ ট্রাস্ট গঠিত হলে পুরাণ নিয়ে সুসংহত গবেষণার কাজ শুরু হয়। এই সংস্থা থেকে পুরাণের সমালোচনামূলক সংস্করণ এবং পুরাণম্ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে।[৩১]
উপনিষদ
উনিশ শতকের প্রথমভাগে লেখা ঋগ্বেদ পুথি
উপনিষদ্ (সংস্কৃত: उपनिषद्) হিন্দুধর্মের এক বিশেষ ধরনের ধর্মগ্রন্থের সমষ্টি। এই বইগুলিতে হিন্দুধর্মের তাত্ত্বিক ভিত্তিটি আলোচিত হয়েছে। উপনিষদের অপর নাম বেদান্ত। ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, উপনিষদ্গুলিতে সর্বোচ্চ সত্য ব্রহ্মের প্রকৃতি এবং মানুষের মোক্ষ বা আধ্যাত্মিক মুক্তি লাভের উপায় বর্ণিত হয়েছে। উপনিষদ্গুলি মূলত বেদ-এর ব্রাহ্মণ ও আরণ্যক[৩২] অংশের শেষ অংশে পাওয়া যায়। এগুলি প্রাচীনকালে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় মুখে মুখে প্রচলিত ছিল।
দুশোরও বেশি উপনিষদের কথা জানা যায়। এগুলির মধ্যে প্রথম বারোটিই প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলিকে “মুখ্য উপনিষদ” বলে। ভগবদ্গীতা, ব্রহ্মসূত্র এবং মুখ্য উপনিষদ্গুলি[৩৩] (এগুলিকে একসঙ্গে প্রস্থানত্রয়ী বলা হয়) পরবর্তীকালে হিন্দু বেদান্ত দর্শনের বিভিন্ন শাখার জন্ম দিয়েছিল। এগুলির মধ্যে দুটি একেশ্বরবাদী শাখা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[note ১][note ২][note ৩]
ঐতিহাসিকদের মতে, মুখ্য উপনিষদ্গুলি প্রাক্-বৌদ্ধ যুগ থেকে[৩৭][৩৮] শুরু করে খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দের প্রথমার্ধ্ব পর্যন্ত[৩৮] সুদীর্ঘ সময়কালের বিভিন্ন পর্বে রচিত হয়। অপর দিকে অপ্রধান উপনিষদগুলি মধ্যযুগ ও প্রাক্-আধুনিক যুগের রচনা।[৩৯] অবশ্য প্রতিটি উপনিষদের সঠিক রচনাকাল নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। ব্রিটিশ কবি মার্টিন সেমোর-স্মিথ উপনিষদ্গুলিকে “সর্বকালের ১০০টি সবচেয়ে প্রভাবশালী বই”-এর তালিকাভুক্ত করেছেন।[৪০] আর্থার শোপেনহাওয়ার, রালফ ওয়াল্ডো এমারসন ও হেনরি ডেভিড থোরো সহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি উপনিষদ্গুলির গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। গবেষকেরা উপনিষদের দর্শনের সঙ্গে প্লেটো ও কান্টের দর্শনের মিল খুঁজে পান।[৪১][৪২]
ত্রিপিটকবৌদ্ধ ধর্মীয় পালি গ্রন্থের নাম। বুদ্ধের দর্শন এবং উপদেশের সংকলন। পালি তি-পিটক হতে বাংলায় ত্রিপিটক শব্দের প্রচলন। তিন পিটকের সমন্বিত সমাহারকে ত্রিপিটক বোঝানো হচ্ছে। এই তিনটি পিটক হলো বিনয় পিটক, সূত্র পিটক ও অভিধর্ম পিটক।
পিটক শব্দটি পালি এর অর্থ – ঝুড়ি, পাত্র, বাক্স ইত্যাদি, অর্থ যেখানে কোনো কিছু সংরক্ষন করা হয়।[৪৩] বৌদ্ধদের মূল ধর্মীয় গ্রন্থ। খ্রীষ্ট পূর্ব ৩য় শতকে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে ত্রিপিটক পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃত হয়। এই গ্রন্থের গ্রন্থনের কাজ শুরু হয়েছিল গৌতম বুদ্ধ এর পরিনির্বানের তিন মাস পর অর্থাৎ খ্রিষ্ট পূর্ব ৫৪৩ অব্দে এবং সমাপ্তি ঘটে খ্রিষ্ট পূর্ব প্রায় ২৩৬ অব্দে। প্রায় তিনশ বছরে তিনটি সঙ্ঘায়নের মধ্যে এর গ্রন্থায়নের কাজ শেষ হয়।[৪৪]
বিনয় পিটক
বিনয় ত্রিপিটকের সর্বাগ্রে গ্রথিত বিষয়, বিনয় বুদ্ধশাসনের আয়ু স্বরুপ, বিনয়ের স্থিতিতেই বুদ্ধ শাসনের স্থিতি নির্ভরশীল। গৌতম বুদ্ধের পরিনির্বাণের অব্যবহতি পরে এ বিষয় অনুধাবন করে বুদ্ধশিষ্যদের অগ্রজ সারির প্রাজ্ঞ- অভিজ্ঞ ধর্মধর, বিনয়ধর ও মাতিকাধর ভিক্ষুদের নিয়ে প্রথম সংগীতির মাধ্যমে বিনয় ও ধর্ম সংরক্ষ্ণণের ব্যবস্থা করা হয়। [৪৫]
সূত্র পিটক
সূত্র শব্দের অর্থ সত্যের প্রকাশ । সেই সত্য হলো তথাগত গৌতম বুদ্ধ সম্বোধির প্রভাবে জ্ঞাত সত্যের প্রকাশ। অন্যভাবে বলা যায় চতুরার্য সত্যের সূচনা করে বলেই সূত্র। [৪৬] যে কথা স্বয়ং বুদ্ধ বলেছেন ” চারি আর্য্য সত্য বর্জিত কোন ধর্ম নেই।” সুতরাং – দুঃখ , দুঃখের কারণ (সমুদয়) , দুঃখ নিরোধ ও দুঃখ নিরোধের উপায় – এই চারি সত্যের ব্যখামুলক প্রকাশ বুদ্ধ বচনের যেই অংশে নিহিত তাই সূত্র। সূত্র জাতীয় বুদ্ধ বচন সমুহ ত্রিপিটকের যে বিভাগে একত্রীকরণ করা হয়েছে তাকে সুত্ত পিটক বলে।Prof. Winternitz লিখেছেন ” the suttapitak is our mose reliable source for the Dhamma , the religion of Buddha and his earliest disciples” [৪৭]
ত্রিপিটকের তিন মূল ধারার অন্যতম একটি হলো অভিধর্ম পিটক। এটিকে বৌদ্ধ দর্শনের সংহত সংস্করণ বলা হয়। এখানে বৌদ্ধ দর্শনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ রয়েছে। তথাগত বুদ্ধ নানা উপদেশের মাধ্যমে যে তত্ত্বসমূহ উপস্থাপন করেছেন, যে নৈতিক আদর্শিক বিষয়সমুহ তিনি অনুসরণ, অনুকরণ ও অনুধাবন করতে উপদেশ দিয়েছেন সে তত্ত্বসমুহের বিন্যস্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে বিনয় পিটকে।[৪৮] বাঙ্গালী অভিধর্ম গবেষকদের মধ্যে অন্যতম বীরেন্দ্র লাল মুৎসদ্দি অভিধর্ম পিটক সম্বন্ধে বলেছেন:
“
সূত্রের ভাষা আছে, উচ্ছ্বাস আছে, উদান আছে, গাথা আছে, উদ্দীপনা আছে, অপায় আছে, অপায় ভয় আছে, দেব-ব্রহ্মা আছে, দেব-ব্রহ্মলোকের আকর্ষণ আছে, নির্বাণের সুসমাচার আছে।[৪৯]
বাইবেল হল খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। বাইবেল (বিবলজ) শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে বা ‘পাওযা’ গ্রীক বিবলিয়া শব্দ থেকে, যার অর্থ ‘একটি পুস্তক’। এটি প্যাপিরাস গাছের ছাল। বাইবেল হচ্ছে শাস্ত্রলিপি বা পুস্তক, ঈশ্বরের বাক্য। বাইবেল হলো ৬৬টি পুস্তকের একটি সংকলন, যা দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত— ৩৯টি পুস্তক সংবলিত পুরাতন নিয়ম বা ওল্ড টেস্টামেন্ট, এবং ২৭টি পুস্তক সংবলিত নতুন নিয়ম বা নিউ টেস্টামেন্ট। খ্রিস্টধর্মমতে, ১৬০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ৪০জন লেখক বাইবেল রচনা করেছিলেন। এরা ছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন লোক। বাইবেলের মুখ্য বিষয়বস্তু বা কেন্দ্রমণি হলেন যীশু। পুরাতন নিয়ম মূলত হিব্রু ভাষায় লিখিত, তবে দানিয়েল ও ইষ্রা পুস্তক দুটির কিছু অংশ অরামীয় ভাষায় লিখিত। নুতন নিয়ম গ্রীক ভাষায় রচিত। বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ এই বাইবেল লিখেছেন। খ্রিস্টানগণ বিশ্বাস করেন, এই বাইবেল রচনা হয়েছিল খ্রিস্টীয় ত্রিত্ববাদের অন্যতম পবিত্র আত্মার সহায়তায়। পৃথিবীর অনেক ভাষায় বাইবেল অনুবাদ হয়েছে। বাইবেলে বলা হয়েছে যে মানুষের গুনাহ্ থেকে নাজাত করার জন্য ঈশ্বর তার মনোনিত ব্যক্তি যীশুকে দুনিয়াতে প্রেরণ করেন। যে কেউ যীশুর প্রতি বিশ্বাস করে এবং পাপ মাফ পাবার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে ঈশ্বরের দিকে ফেরে সেই মুক্তি পায়। বাইবেলের ইউহোন্না খন্ডের ১৪ রুকু ৬ আয়াতে বলা হয়েছে, “আমিই (যীশুই) পথ, সত্য আর জীবন। আমার মধ্য দিয়ে না গেলে কেউই পিতার কাছে (অর্থাৎ ঈশ্বরের কাছে) যেতে পারে না।” ইসলাম ধর্মে “বাইবেল” বলে কোনো ধর্মগ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায় না। উল্লেখ পাওয়া যায়, ঈশ্বরের বাণীবাহক ঈসার [আ.] প্রতি অবতীর্ণ ইঞ্জিল নামক ধর্মগ্রন্থের। কুরআনে বর্ণিত ঈসাকেই বাইবেলে যীশু বলা হয়। তবে মুসলিমরা বিশ্বাস করে বাইবেল আল্লাহর গ্রন্থ ইনযিলের পরিবর্তিত গ্রন্থ। কারণ মুসলিম ধারণা মতে, খ্রিস্টান পন্ডিতরা ইনযিলে পরিবর্তন সাধন করেছে[৫০]।
কুরআন (القرآن) মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ।[৫১] “কুরান” বা “কুরআন” শব্দটি আরবী শব্দ, এই শব্দের উতপত্তি ও অর্থ নিয়ে বিশেষজ্ঞ আলেমদের মাঝে মতপার্থক্য আছে। কারো কারো মতে কুরান শব্দটি নবী মুহাম্মদের প্রতি অবতীর্ণ কিতাবের “আলাম” বা নির্ধারিত নাম, যেমন তাওরাত, ইঞ্জিল, যাবুর দ্বারা নির্ধারিত তিনটি পৃথক পৃথক কিতাব বুঝানো হয়ে থাকে, কুরান দ্বারাও ঠিক তেমনি একটি নির্ধারিত কিতাব বুঝানো হয়ে থাকে। এই হিসাবে শব্দটি –আরবী ব্যকরন রীতি অনুযায়ী- অন্য কোন উতস-শব্দ থেকে “মুশতাক” বা উদ্ভূত শব্দ নয়। ইমাম শাফী র. এর মত এটা। আবার অন্য আলেমের মত এই যে, কুরান শব্দটি তার উতস-শব্দ থেকে “মুশতাক” বা উদ্ভূত একটি শব্দ। যারা এই মত প্রকাশ করেন তারা আবার কুরানের উতস-মুল বা মুল শব্দ নির্ধারনে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রদান করেছেনঃ কারো মতে কুরান শব্দটি আরবী “কারান” থেকে উদ্ভূত যার অর্থ যুক্ত করা, যেহেতু কুরানে বিভিন্ন আয়াত, সুরা একে অপরের সাথে যুক্ত তাই একে “কুরান” বলা হয়ে থাকে। আবার কারো মতে মুল শব্দ “কারান” নয়, বরং মুল শব্দ হচ্ছে “করায়া” যার অর্থ পড়া, এখানে আরবী ভাষার রীতি অনুযায়ী পড়া দ্বারা পঠিত গ্রন্থ বা কিতাবকে বুঝানো হয়েছে । কুরানের এই শেষোক্ত অর্থই বেশি পরিচিত -অর্থাৎ কুরানের শাব্দিক অর্থ “পঠিত কিতাব”। [৫২] “কুরান আল্লাহর বাণী, যা তার রাসুলের উপর অবতীর্ণ হয়েছে, যার অনুরুপ কুরান পেশ করতে সবাই অক্ষম, যার তেলাওয়াত ইবাতাদ, যা “মুতাওয়াতির” বা অকাট্যভাবে বর্নিত, যা মুসহাফে লিখিত, যার শুরু হয়েছে সুরা ফাতিহা দিয়ে আর শেষ হয়েছে সুরা নাসের মাধ্যমে”। ইসলামী ইতিহাস অনুসারে দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে খণ্ড খণ্ড অংশে এটি ইসলামের নবী মুহাম্মাদের নিকট অবতীর্ণ হয়। কুরআনে সর্বমোট ১১৪টি সূরা আছে। আয়াত বা পঙ্ক্তি সংখ্যা ৬,২৩৬ টি বা ৬,৬৬৬ টি। এটি মূল আরবি ভাষায় অবর্তীর্ণ হয়।[৫৩][৫৪][৫৫][৫৬] মুসলিম চিন্তাধারা অনুসারে কুরআন ধারাবাহিকভাবে অবর্তীর্ণ ধর্মীয় গ্রন্থগুলোর মধ্যে সর্বশেষ এবং গ্রন্থ অবতরণের এই ধারা ইসলামের প্রথম বাণীবাহক আদম থেকে শুরু হয়। কুরআনে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ রয়েছে যার সাথে বাইবেলসহ অন্যান্য ধর্মীয়গ্রন্থের বেশ মিল রয়েছে, অবশ্য অমিলও কম নয়। তবে কুরআনে কোনও ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা নেই। ইসলামী ভাষ্যমতে কুরআন অপরিবর্তনীয় এবং এ সম্পর্কে মুসলিমরা কুরয়ানের যে আয়াতের কথা উল্লেখ করে থাকে তা হল:
“
আমি স্বয়ং এ উপদেশগ্রন্থ অবতরণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।[৫৭]
”
আরবি ব্যাকরণেকুরআন শব্দটি মাসদার তথা ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি قرأ ক্বরা’আক্রিয়া পদ থেকে এসেছে যার অর্থ পাঠ করা বা আবৃত্তি করা। এই ক্রিয়াপদটিকেই কুরআন নামের মূল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।[৫৮] এই শব্দটির মিটার বা “মাসদার” (الوزن) হচ্ছে غفران তথা “গুফরান”। এর অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত ভাব, অধ্যবসায় বা কর্ম সম্পাদনার মধ্যে একাগ্রতা। উদাহরণস্বরুপ, غفر নামক ক্রিয়ার অর্থ হচ্ছে “ক্ষমা করা”; কিন্তু এর আরেকটি মাসদার রয়েছে যার যা হলো غفران, এই মাসদারটি মূল অর্থের সাথে একত্রিত করলে দাঁড়ায় ক্ষমা করার কর্মে বিশেষ একাগ্রতা বা অতি তৎপর বা অতিরিক্ত ভাব। সেদিক থেকে কুরআন অর্থ কেবল পাঠ করা বা আবৃত্তি করা নয় বরং আরেকটি অর্থ হচ্ছে একাগ্র ভঙ্গীতে পাঠ বা আবৃত্তি করা। কুরআনের মধ্যেও এই অর্থেই কুরআন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআনের সূরা আল-কিয়ামাহ্ (৭৫ নং সূরা) ১৮ নং আয়াতে এই শব্দটি উল্লেখিত আছে:
“
অতঃপর, আমি যখন তা পাঠ করি (ক্বুরা’নাহু), তখন আপনি সেই পাঠের (কুরআ’নাহ্) অনুসরণ করুন।[৫৯]
হাদিস (আরবিতে الحديث) হলো মূলত ইসলাম ধর্মের শেষ বাণীবাহক মুহাম্মাদের বাণী ও জীবনাচরণ। হাদিসের উপদেশ মুসলমানদের জীবনাচরণ ও ব্যবহারবিধির অন্যতম পথনির্দেশ। কুরআন ইসলামের মৌলিক গ্রন্থ এবং হাদিসকে অনেক সময় তার ব্যাখ্যা হিসেবেও অভিহিত করা হয়। আল্লামা হাফেজ সাখাবী (রহ.) বলেন- والحديث لغة ضد القد يم واصطلا حامااضيف الى النبى ﷺ قولا له اوفعلا له اوتقرير اوصفة حتى الحركات والسكنات فى اليقظة والمنام – অর্থ: আভিধানিক অর্থে হাদীস শব্দটি কাদীম তথা অবিনশ্বরের বিপরীত আর পরিভাষায় বলা হয় রাসূলুাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দিকে সম্বন্ধযুক্ত। চাই তার বক্তব্য হোক বা কর্ম বা অনুমোদন অথবা গুণ এমন কি ঘুমন্ত অবস্থায় বা জাগ্রত অবস্থায় তার গতি ও স্থির সবই হাদীস।
বুখারী শরীফের বিশিষ্ট ব্যাখ্যাগ্রন্থ عمدة القارى এর মধ্যে হাদীস সম্বন্ধে রয়েছে: علم الحديث هو علم يعرف به اقوال النبى ﷺ وافعاله واخواله – অর্থ: ইলমে হাদীস এমন বিশেষ জ্ঞান যার সাহায্যে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা, কাজ ও অবস্থা জানতে পারা যায়। আর ফিক্হবিদদের নিকট হাদীস হল: اقوال رسول الله ﷺ وافعاله – অর্থ: হাদীস হলো আল্লাহর রাসূলের কথা ও কাজসমূহ। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও আলিয়া মাদ্রাসার সাবেক হেড মাওলানা মুফতী সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান বারকাতী (রহ.) এর মতে, হাদীস (حديث) এমন একটি বিষয় যা রাসূলুাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী, কর্ম ও নীরবতা এবং সাহাবায়ে কেরাম, তাবিঈনদের কথা, কর্ম ও মৌন সম্মতিকে বুঝায়।[৬০]
দেশ হল একটি ভৌগোলিক অঞ্চল। এই দেশ শব্দটি প্রায়সই রাজনৈতিক বিভাগ বা সার্বভৌমিক রাষ্ট্র অঞ্চল বা সাবেক রাজনৈতিক বিভাগের ভৌগোলিক অঞ্চলকে সূচিত করে। সাধারণ ভাবে দেশ বলতে সার্বভৌমিক রাষ্ট্র-এর ধারণার সাথে মিলে যায় এবং যা রাষ্ট্র ,জাতি বা সরকারের সঙ্গে সংযুক্ত।
দেশের তালিকা
বাংলা, ইংরেজি, সরকারী, জাতীয় ও রাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূ্র্ণ ভাষায় দেশের নাম [Note ১]
আলজেরিয়া – Algeria গণতান্ত্রিক গণপ্রজাতন্ত্রী আলজেরিয়া (People’s Democratic Republic of Algeria) আরবি ভাষা: الجمهورية الجزائرية الديمقراطية الشعبية – الجزائر → Al-Jazāir – Al Jumhūriyat al-Jazāiriyat ad-Dīmuqrāţiyat ash-Sha‘bīyah
আর্মেনিয়া – Armenia আর্মেনিয়া প্রজাতন্ত্র (Republic of Armenia) আর্মেনীয় ভাষা: Հայաստան – Հայաստանի Հանրապետություն → Hayastan – Hayastani Hanrapetut’yun
বেলারুশ – Belarus বেলারুশ প্রজাতন্ত্র (Republic of Belarus) বেলারুশীয় ভাষা: Белару́сь – Рэспубліка Белару́сь→ Bielaruś – Respublika Bielaruśরুশ ভাষা: Беларусь – Республика Беларусь→ Belarus’ – Respublika Belarus’
বলিভিয়া – Bolivia বলিভিয়া বহুজাতিক রাষ্ট্র (Plurinational State of Bolivia) স্পেনীয় ভাষা: Bolivia – Estado Plurinacional de Bolivia কেচুয়া ভাষা: Bulivya – Bulivya Mamallaqta আইমারা ভাষা: Wuliwya – Wuliwya Suyu
বার্মা – Burma রিপাবলিক অব দ্য ইউনিয়ন অব মায়ানমার (Republic of the Union of Myanmar) [Note ১৩][৯]বর্মী ভাষা: မြန်မာပြည် – ပြည်ထောင်စု သမ္မတ မြန်မာနိုင်ငံတော်→ আ-ধ্ব-ব: Myamà (ম্যামা) – Pyìdàùngzu’ Thàmmada’ Myamà Nàyngngàɴdɔ̀ (প্যীদাঊংযু’ থাম্মদা’ ম্যামা নায়েঙ্ঙাংদ)
জাতিসংঘের সদস্য দেশ
নেই
বুরুন্ডি – Burundi বুরুন্ডি প্রজাতন্ত্র (Republic of Burundi) রুন্ডি ভাষা: Burundi – Republika y’Uburundi ফরাসি ভাষা: Burundi – République du Burundi
জাতিসংঘের সদস্য দেশ
নেই
কম্বোডিয়া – Cambodia কম্বোডিয়া রাজ্য (Kingdom of Cambodia) খমের ভাষা: កម្ពុជា – ព្រះរាជាណាចក្រកម្ពុជា→ Kâmpŭchéa – Preăh Réachéanachâk Kâmpŭchéaফরাসি ভাষা: Cambodge – Royaume du Cambodge
জাতিসংঘের সদস্য দেশ
নেই
ক্যামেরুন – Cameroon ক্যামেরুন প্রজাতন্ত্র (Republic of Cameroon) ফরাসি ভাষা: Cameroun – République du Cameroun
চীন – China গণচীন/গণপ্রজাতন্ত্রী চীন (People’s Republic of China)The People’s Republic of China (PRC) is commonly referred to as “China”, while the Republic of China (ROC) is commonly referred to as “Taiwan”. The ROC is also occasionally known diplomatically as Chinese Taipei, along with other names.</ref> চৈনিক ভাষা: 中国 – 中华人民共和国→ মান্দারিন: “Zhōngguó” – Zhōnghuá Rénmín Gònghéguó তিব্বতী ভাষা: ཀྲུང་ཧྭ་ – ཀྲུང་ཧྭ་མི་དམངས་སྤྱི མཐུན་རྒྱལ་ཁབ → ওয়ালী: “Krung Hwa” – “Krung Hwa Mi Dmangs Spyi Mthun Rgyal Khab” উইগুর ভাষা: جۇڭخۇا خەلق جۇمھۇرىيىتى – جۇڭخۇا→ Jungkhua – Jungkhua Khelq Jumhuriyitiচুয়াং ভাষা: Cunghvaz – Cunghvaz Yinzminz Gunghozgoz
কোমোরোস – Comoros কোমোরোস দ্বীপপুঞ্জ (Union of the Comoros) কমোরীয় ভাষা: Komoriya – Udzima wa Komori আরবি ভাষা: الاتحاد القمري – جزر القمر→ Ǧuzur al-Qumur/al-Qamar – Al-Ittiḥād al-Qumurī/al-Qamarīফরাসি ভাষা: Comores – Union des Comores
জাতিসংঘের সদস্য দেশ
নেই
কমোরোস ৩টি দ্বীপের একটি সংঘ যা ফ্রান্সের অংশ মায়োতকে এর চতুর্থ দ্বীপ হিসেবে নিজস্ব বলে দাবি করে|[Note ১৮][১০]বাংক দ্যু গেইসেরের ওপর ফরাসি সার্বভৌমত্বের সঙ্গে কমোরোসের দ্বন্দ্ব আছে|[৪]
কিউবা – Cuba কিউবা প্রজাতন্ত্র (Republic of Cuba) স্পেনীয় ভাষা: Cuba – República de Cuba
জাতিসংঘের সদস্য দেশ
নেই
সাইপ্রাস – Cyprus সাইপ্রাস প্রজাতন্ত্র (Republic of Cyprus) গ্রিক ভাষা: Κύπρος – Κυπριακή Δημοκρατία→ Kýpros; – Kypriakī́ Dīmokratíaতুর্কি ভাষা: Kıbrıs – Kıbrıs Cumhuriyeti
বিশেষজ্ঞ মতামত (Expart Opinion) ভারতীয় সাক্ষ্য আইনে (The Indian Evidence Act – 1872) ৪৫ নং ধারায়, তৃতীয় ব্যক্তির মতামত হিসেবে প্রাসঙ্গিক। যখন আদালতে, বিদেশী আইন, বিজ্ঞান, কলা (Art)র কোনো বিষয়ের ওপর অথবা হাতের লেখা, আঙুলের ছাপের একক অনন্য পরিচিতি সম্পর্কে অভিমত গঠন করার দরকার পড়ে তখন সেই বিষয় অর্থাৎ উক্ত বিদেশী আইন, বিজ্ঞান, কলা, হাতের লেখা, আঙুলের ছাপ সংক্রান্ত প্রশ্নে বিশেষ ভাবে দক্ষ ব্যক্তিদের মতামত প্রাসঙ্গিক হিসেবে বিবেচিত হবে।[১][২]
শর্ত
বিশেষজ্ঞ (Expart) একজন সাক্ষী (Witness) হিসেবে আদালতে তার মতামত দেন। তিনি শুধুমাত্র সেই বিষয়েই আদালতকে অবহিত করবেন যা তার পর্যবেক্ষণ ও বিশেষ দক্ষতা কাজে লাগিয়ে জেনেছেন। সিদ্ধান্ত বা অভিমত নয়। সিদ্ধান্তে আসার দায়িত্ব আদালতের। অর্থাৎ বিশেষজ্ঞ মতামত আদালতগ্রাহ্য হওয়ার জন্যে ১) বিষয়টি এমনি হতে হবে যেখানে বিশেষজ্ঞর সাক্ষ্য বা মতামত অবশ্য প্রয়োজন ২) আলোচ্য সাক্ষী প্রকৃতপক্ষে একজন বিশেষজ্ঞ।[১]
বাংলা প্রত্নতত্ত্ব শব্দটি ‘প্র+ত্ন= প্রত্ন’ অর্থ- পুরাতন ও ‘তৎ+ত্ব= তত্ত্ব’অর্থ-বিজ্ঞান। সমষ্টিগত অর্থ হল, পুরাতন বিষয়ক জ্ঞান। প্রচলিত ধারণায়, বস্তুগত নিদর্শনের ভিত্তিতে অতীত পুনঃনির্মাণ করার বিজ্ঞানকেই প্রত্নতত্ত্ব বলে চিহ্নিত করা হয়। অতীতের সংস্কৃতি ও পরিবেশগত নিয়ে চর্চা করে এমন অন্যান্য বিজ্ঞান বা বিষয়গুলোর (যেমন- ভূতত্ত্ব, পরিবেশ বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস, মনোবিজ্ঞান, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি) মধ্যে প্রত্নতত্ত্বের বিশেষত্ব হলো- এটি কেবল বস্তুগত নিদর্শন অর্থাৎ প্রামাণ্য তথ্য নিয়ে কাজ করে এবং তার সাথে মানুষের জীবনধারার সম্পর্ক নির্ণয় করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- ভূতাত্ত্বিক ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা প্রাচীন ভূমিরূপ ও অন্যান্য পরিবেশগত তথ্য বিশ্লেষণ করে ইনামগাঁওয়ের কয়েকহাজার বছরের বৃষ্টিপাতের ধরনের একটি উপাত্ত হাজির করেছেন। প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রাচীন ভূমিরূপ ও অন্যান্য পরিবেশগত তথ্য উদ্ধারের এই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকলেও ওই বিশেষ বৃষ্টিপাতের পরিস্থিতিতে মানুষ কিভাবে বসবাস ও জীবনযাপন, এই বিশেষ বিশ্লেষণটি প্রত্নতাত্ত্বিকরা করে থাকেন। ইনামগাওয়ের পরিবৈশিক তথ্য ও গর্তবসতিগুলো এই দুই প্রাচীন উপাদান মিলিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা সেই সময়ের মানুষের জীবনপ্রণালি বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করেন। তাই প্রত্নতত্ত্বের অধ্যয়নের মূল বিষয়গুলো হলো- ভৌত ধ্বংসাবশেষ, পরিবেশগত তথ্য, জৈব অবশেষ বা জীবাশ্ম, প্রাকৃতিক-সাংস্কৃতিক ভূদৃশ্যাবলী ইত্যাদি। আর প্রত্নতত্ত্বের কাজ হলো- এইসব বিষয়কে বিশ্লেষণ করে প্রাচীনকালের মানুষ এবং পরিবেশ ও প্রকৃতির তৎকালীন চিত্র বোঝা এবং তার মাধ্যমে মানুষ এবং পরিবেশ ও প্রকৃতির পরিবর্তনের ধারা ব্যাখ্যার মাধ্যমে ভবিষ্যতের মানুষ এবং পরিবেশের রূপরেখা নির্মাণ করা। এর ফলে প্রত্নতত্ত্ব প্রধানত ইতিহাস ও পরিবেশ বিজ্ঞানের এক সহযোগী। তবে পরিবৈশিক প্রেক্ষিতের চেয়ে মানুষের সংস্কৃতির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত এমন বিষয়েই দীর্ঘকাল ধরে প্রত্নতাত্ত্বিক কর্মকাণ্ড সীমিত ছিল। কাজেই সাধারণত প্রত্নস্থান ও পুরাতন জিনিসপত্র আবিষ্কার, স্থান ও বস্তু চিহ্নিতকরণ ও নথিভুক্তকরণ এবং বস্তু ও কাঠামোর বিজ্ঞানসম্মত সংরক্ষণ ও তা জনসমক্ষে উপস্থাপন এর মধ্যেই প্রত্নতাত্ত্বিক চর্চা সীমাবদ্ধ ছিল। প্রাকৃতিক ও পরিবৈশিক প্রেক্ষিত এবং অবস্তুগত ভাবগত নিদর্শন যেমন সামাজিক সম্পর্ক ও মনোস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বর্তমানে প্রত্নতত্ত্বে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর ফলে প্রত্নতত্ত্ব বর্তমানে মানুষের অতীত ইতিহাসের গৃহবন্দী চর্চার বদলে পরিবেশ, ভূপ্রকৃতি এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের অন্যান্য বিষয়ের অতীত অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যত নির্মাণের বিজ্ঞান হিসেবে চর্চিত হচ্ছে।
উদ্ভব ও বিকাশ
খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫৬–খ্রিষ্টপূর্ব ৫৩৯ অব্দে বেবিলনের সিপপুরে সামাথ নামক একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের নির্মাতার নাম জানার উদ্দেশ্যে সম্রাট নবনিডাস (Nabonidus) ধ্বংসস্তুপের মধ্যে খননকাজ পরিচালনা করেন। তার এই কীর্তির জন্য তাকে পৃথিবীর প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক বলে অভিহিত করা হয়। সম্রাটের কন্যা এন্নিগালডি নান্না (Ennigaldi Nanna) খননে প্রাপ্ত এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে সংগৃহীত নিদর্শনাদি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন।
গ্রিক ঐতিহাসিক থুকিডাইডেস (Thucydides)-এর বর্ণনা থেকে জানা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬০– খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৬ অব্দে এথেন্সের প্রত্নতাত্ত্বিকরা দেলস (Delos)-এর ঈজিয়ান দ্বীপের (Aegean Islands) প্রাচীন সমাধিগুলোতে খনন পরিচালনা করে খননে প্রাপ্ত নিদর্শনাদি সম্পর্কে সেই সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। অন্য দিকে, প্রাচীন চীনে পূর্ব-প্রজন্মের নিদর্শনাদি সংরক্ষণের মাধ্যমে পারিবারিক ও মৌখিকভাবে হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস সংরক্ষণের প্রচলন ছিল। রোমান দার্শনিক লুকরেটিয়াস (Lucretius) খ্রিষ্টপূর্ব ৯৯–খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫ অব্দে এবং চীনা দার্শনিক ইউয়ান কং (Yuan K’ang) খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে চীনাদের প্রত্ননিদর্শন সংরক্ষণের এই চর্চা এবং এই নিদর্শনগুলোর বিশ্লষেণ করে প্রাচীন চীনা সংস্কৃতির রূপরেখা উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন।
ভারতে সুলতানী শাসনামলে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ ও এর ভিত্তিতে ইতিহাস চর্চার সূচনা হয়। মুহম্মদ বিন তুঘলক (১৩২৪–১৩৫১) ব্যাপক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুশীলন করেন। তিনি সারা ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য প্রাচীন নিদর্শন সংগ্রহ করেন এবং এগুলোর আলোকে ইতিহাস রচনার জন্য পেশাদার প্রত্নতাত্ত্বিক নিয়োগ করেন। অশোকস্তম্ভসমূহের শিলালিপির পাঠোদ্ধারের জন্য তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা পৃথিবীর প্রথম পেশাদারী প্রত্নতাত্ত্বিক চর্চার গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ।
চতুদর্শ শতক থেকে ইউরোপের রেনেসাঁ পর্বে অভিজাতদের মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়; ফলে প্রত্নতাত্ত্বিক ও প্রত্ন-লুটেরা উভয় সম্প্রদায় মূলত যেকোনো উপায়ে প্রত্ন নিদর্শন সংগ্রহ করার জন্য উৎসাহী হয়ে ওঠেন। মিশরের পিরামিড ও ইউরোপের প্রাচীন সমাধিগুলোতে প্রত্নতত্ত্ব চর্চার নামে এক ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করা হয়। ইতালিতে (রোম) যাচ্ছেতাই খনন এবং নিদর্শন বাণিজ্য এতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, সেখানে বেশকিছু প্রত্ননিদর্শন বিক্রির বাজার ও বার্ষিক প্রত্ননিদর্শন বিক্রয় মেলা আয়োজন করা হতো।
এই প্রথায় প্রথম বিপরীতমুখী প্রয়াস চালান ইংরেজ গবেষক জন লিল্যান্ড (John Leland)। ১৫৩৩ থেকে ১৫৪৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি প্রাচীন নথিপত্র সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও গবেষণায় নিয়োজিত থাকেন। অপর ইংরেজ গবেষক উইলিয়াম কার্ডেন (William Carden) ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ইংল্যান্ডের প্রাচীন নিদর্শনসমূহের এক বিস্তারিত তালিকা প্রণয়ন করেন যা “ব্রিটানিয়া” নামে প্রকাশিত হয়। তার গবেষণাকর্মটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা, তিনি স্থানিক প্রেক্ষিতের সাথে সঙ্গতি রেখে প্রাচীন নিদর্শনগুলোর ব্যাখ্যা করেন এবং উদ্ভিদের দেহবৃদ্ধির ধরনের পার্থক্যের ভিত্তিতে মাটির নিচে চাপা পড়া প্রত্নস্থান শনাক্তকরণের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। প্রত্নস্থান চিহ্নিতকরণ ও বিশ্লেষণের এই এরিয়াল পদ্ধতি (প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের কারণে বিবর্তিত হলেও) আজো অত্যন্ত জনপ্রিয়। অপর ইংরেজ প্রত্নতাত্ত্বিক জন অব্রে (John Aubrey) Stonehenge ও Abebury নামে দুটি প্রত্নস্থানের বিশদ বিবরণ ও বিশ্লেষণ করেন। তার বিবরণের ওপর নির্ভর করে ১৭০৯ খ্রিষ্টাব্দে হারকুল্যুনেউম ও পম্পেই অঞ্চলে সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালিত হয়। ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এখানে একটানা খনন পরিচালিত হয়, এবং প্রাপ্ত নিদর্শনসমূহের অদ্ভুত ধাঁধায় খনন পরিত্যাক্ত হয় এবং তা থেকে কোনো ইতিহাস ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে খনন আবার শুরু হয়, এখনো সেখানে খনন চলছে।
১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে ডেনিশ প্রত্নতাত্ত্বিক ও কিউরেটর সি জে থমসন “থ্রি এজ সিস্টেম”আবিষ্কার করলে ইতিহাসের অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ হয়ে ওঠে। ফলে প্রত্নতত্ত্ব চর্চা এক নতুন গতি পায়। তিনি পৃথিবীর ইতিহাসকে পাথর যুগ, ব্রোঞ্জের যুগ ও লোহার যুগ – এই তিনটি ভাগে ভাগ করলে, পাথরের হাতিয়ার ও ব্রোঞ্জের হাতিয়ারগুলো আসলে কী তা বোঝা সম্ভব হয়, এবং ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী ব্যাখ্যা প্রদানের হাত থেকে প্রত্নতত্ত্ব রক্ষা পায়। অপর ডেনিশ প্রত্নতাত্ত্বিক জে জে ওয়ারসাই ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দে এই গবেষণাকে একটি একক প্রত্নস্থানের স্তরবিন্যাসের মাধ্যমে প্রমাণ করতে সক্ষম হন। একটি প্রত্নস্থানের বিভিন্ন গভীরতায় বিভিন্ন ধরনের প্রত্নসামগ্রী যে একই সময়ের ব্যক্তিরা ব্যবহার করেনি, তা যে মানুষের ইতিহাসের বিকাশের ও পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা এই তথ্য প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় এক অভাবনীয় গতি দেয়।
১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে পম্পেই ও হারকুল্যুনেউম-এ প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু হয় এবং এইবার প্রত্নতাত্ত্বিকরা উক্ত প্রত্নস্থলের মানুষের জীবনপ্রণালি ব্যাখ্যায় অগ্রগতি লাভ করেন। এই সাফল্য দেশ-বিদেশের প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের এক উৎসবের সূচনা করে। কার্টিয়াস গ্রিসের অলিম্পিয়ায়, কোল্ডওয়ে এবং ওয়াল্টার মেসোপটেমিয়ায়, হার্বাট কনসট্যান্টিন্যাপল ও তুরস্কের বিভিন্ন জায়গায়, পিট রিভার্স ইংল্যান্ডে এবং হুইলার ভারতে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন সূচনা করেন। এই প্রত্যেকটি খনন পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন অধ্যায় যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
আধুনিক প্রত্নতত্ত্ব
আধুনিক প্রত্নতত্ত্ব চর্চা শুরু হয় জার্মানদের হাতে। জার্মান মানবতাবাদী ও প্রাক-ইতিহাসবেত্তা (প্রিহিস্টোরিয়ান) গুস্তাফ কোসিনা ১৮৯৫ হতে ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মৃত্যুর আগ পর্যন্ত “বসতি প্রত্নতত্ত্ব” (সেটেলমেন্ট প্রত্নতত্ত্ব) নামে প্রত্নতত্ত্বের এক আধুনিক মতবাদের বিকাশ ঘটান। এর মূল ভিত্তি ছিল, বস্তুনিদর্শনের (আর্টিফ্যাক্ট) ধরনের মাধ্যমে মানব সংস্কৃতি নির্ণয় এবং স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক অঞ্চলকে প্রাচীন ট্রাইব বা এথনিক গ্রুপের বসতি এলাকা বলে চিহ্নিত করা। তার পদ্ধতির সবচে সমস্যাযুক্ত বিষয় হলো বর্তমান মানুষের সংস্কৃতির সঙ্গে অতীত সংস্কৃতির ধারাবাহিকতাকে সরাসরি বর্ণনা করা। এর মাধ্যমে তিনি বর্তমান জার্মানদেরকেই নর্ডিক, আর্য বা ইন্দো-ইউরোপীয় (ইন্দো-জার্মান)-দের উত্তরাধিকার ঘোষণা করেন। তিনি অন্য সংস্কৃতি ও মানুষদের ওপরে জার্মানদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের পরাজয়ের পর তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে যুক্তি করতে থাকেন, লৌহ যুগে পোল্যান্ড জার্মানদের বসতির একটি অংশ ছিল। কোসিনার মৃত্যুর পর জাতীয় সমাজতান্ত্রিকদের উদ্ভব হলে তারাও তার এই ডগমা গ্রহণ করে। থার্ড রাইখের সময় (হিটলারের নাজী শাসনামলকে থার্ড রাইখ বলা হয়) এই মতবাদ পৃষ্ঠপোষকতা পায়। নাজী শাসনে এটি প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা পায়। আলফ্রেড রোজেনবার্গ এবং হাইনরিখ হিমলার এই মতবাদ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণের চেষ্টা করেন। এডলফ হিটলার এদের উভয়কে সরাসরি সাহায্য করেন। হিমলার গড়ে তোলেন Deutsches Ahnenerbe (জার্মান বংশগতির উত্তরাধিকার) নামক একটি সংস্থা। এরা কোসিনার বসতি প্রত্নতত্ত্বের বাধ্যতামূলক ব্যবহার করে (Jones ১৯৯৮:৩)। তারা জার্মানীর পূর্বদিকে বিস্তার আবিষ্কার করে। এই বিস্তার ছিল পোল্যান্ড, দক্ষিণ রাশিয়া এবং ককেশাস অঞ্চলে। প্রত্নতত্ত্বের এই ধারার সঙ্গে আরও যারা এই দলে যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে হ্যান্স রাইনার্থ ও হারমান উইর্থের নাম উল্লেখযোগ্য। ইউরোপ বা বৈশ্বিকভাবে ব্যাপারটি যেমন-ই হোক না কেন, এই গবেষণা জার্মানদের জাতীয় চেতনা ও অহমবোধ বিকাশে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
অন্যদিকে, পোলিশ প্রত্নতাত্ত্বিক Konrad Jazdewski ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে ইউরোপের প্রত্নতাত্ত্বিক অ্যাটলাস প্রকাশ করেন, তাতে তিনি ব্রোঞ্জ যুগে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে স্লোবানিক জাতির সম্প্রসারনকে চিত্রিত করেন (Kristiansen ১৯৯২:১৮), অর্থাৎ এক অর্থে তিনি পোলিশ (স্লোবানিক)-দেরকেই ইউরোপের প্রকৃত মালিক হিসেবে উপস্থাপন করেন; এটি পোলিশদের আত্মশ্লাঘার একটি হাতিয়ার হিসেবে আজো ক্রিয়াশীল।
একই ভাবে ফ্রান্সে রোমান সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ প্রতিহতকরণে গলদের প্রতিরোধের প্রত্নতাত্ত্বিক নথিগুলো ফরাসি জাতীয় চেতনা বিকাশে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। আয়ারল্যান্ডের জাতীয় চেতনার বিকাশ ঘটেছে লা টেনে-র ওপরে প্রত্নতত্ত্বের গবেষণালব্ধ তথ্যগুলো প্রকাশিত হওয়ার পর। যদিও জার্মানদের মতো এখানেও তা একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কারণ ঘটায়, কিন্তু আইরিশ জাতীয় প্রেরণার এক উৎস হিসেবেই থেকে যায়। একই ভাবে ইসরাইলের মাসাদা অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের পর দেখা যায়- সেখানে রোমান সাম্রাজ্যের বিরোধিতাকারী একদল ইহুদি গণ-আত্মহত্যা করেছিল; এই ঘটনা এবং স্থানটি ইসরাইল রাষ্ট্রটির জাতীয় চেতনার প্রতীক হিসেবে তৈরি হয়েছে, স্থানটি সামরিক অনুষ্ঠানাদির কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে উঠেছে (Zarubavel ১৯৯৪)।
প্রত্নতত্ত্বের এই ধারার বিকাশ উত্তর আফ্রিকা এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম গড়ে তুলতে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে (Mattingly ১৯৯৬:৫৬-৯ এবং Paddayya ১৯৯৫:১৪১)। সাম্প্রতিক সময়ে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ-রামমন্দির বিতর্কেও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রূপে ব্যবহৃত হয়েছে (Rao ১৯৯৪, Pollock ১৯৯৬)।
বসতি প্রত্নতত্ত্বের পর প্রত্নতত্ত্বের যে মতবাদটি সবচেয়ে বেশি প্রভাব-বিস্তারী ছিল তা হলো সংস্কৃতি-ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত্ব। গর্ডন চাইল্ড এই মতবাদের প্রধান উদ্যোক্তা। প্রত্নতত্ত্ব চর্চায় তার ব্যাপক অবদানের জন্য অনেকে তাকে প্রত্নতত্ত্বের জনক-ও বলে থাকেন। যেসব বিষয় সাধারণভাবে সংস্কৃতির অংশ বলে গণ্য হয় এবং প্রায়ই যা প্রাচীন সামাজিক সত্তার বিভিন্ন খণ্ডাংশের ফল হিসেবে গণ্য হয় তার এককের স্থানিক ও সময়গত কাঠামোর মধ্যে তৈরি বস্তুগত নিদর্শনের অভিজ্ঞতাবাদী সারসংক্ষেপ, বর্ণনা এবং শ্রেণীকরণের (ক্লাসিফিকেশন) বৈশিষ্ট্যকেই সংস্কৃতি-ইতিহাস বলা যেতে পারে। সংস্কৃতি-ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত্বের বিভিন্ন আঞ্চলিক ও জাতীয় ঐতিহ্যের ভিন্নতা (বা বৈচিত্র্য) সত্ত্বেও এটাই ছিল বিশ শতকের ইউরোপ ও পৃথিবীর অন্যত্র প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক মতবাদ। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে অতীত জনগণ বা জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইতিহাস তৈরি করা হয়, যা আসলে নাজি জার্মানীর প্রত্নতাত্ত্বিক কাঠামোর মূলনীতির সঙ্গে একই।
জাপানের ঐতিহ্যবাহী কৃষি ও কৃষিনির্ভর সংস্কৃতির প্রতি জাতীয় গুরুত্ব আরোপ এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদেরভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রত্নতত্ত্বের এই ঘরানার গবেষণাগুলো অত্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে।
১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় তাসকান শহরে ড. উইলিয়াম রাথজে পরিচালিত ফেলনাময়লা প্রকল্প (The Garbage Project) আধুনিক প্রত্নতত্ত্বের এক মাইলস্টোন। শহরের অধিবাসীদের ফেলে দেওয়া ময়লা-আবর্জনা থেকে শহরের মানুষের স্বভাব-চরিত্র-সংস্কৃতি বিশ্লেষণ করে তিনি প্রাচীন নিদর্শন থেকেও যে প্রাচীন মানুষের সংস্কৃতি ব্যাখ্যা করা সম্ভব তা প্রমাণ করেন। এর ফলে প্রত্নতত্ত্ব শুধু বিজ্ঞানকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, তা-ই নয়, বরং পদ্ধতি হিসেবেও প্রত্নতত্ত্ব যে বৈজ্ঞানিক তা প্রমাণিত হয়। এই গবেষণা প্রকাশিত হওয়ার পর বিভিন্ন দেশে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে প্রত্নতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে তথ্য আহরণ করা শুরু হয় এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব জনপ্রিয় বিষয় হিসেবে চালু করা হয়। এর ফলে আশির দশক থেকে বিশ্বব্যাপী প্রত্নতত্ত্ব চর্চা ব্যাপক বৃদ্ধি পেলে এর মতাদর্শিক ঘরানারও ব্যাপক বিস্তার ঘটে। কাঠামোবাদী, প্রক্রিয়াবাদী, উত্তর-প্রক্রিয়াবাদী, নির্মাণবাদী ইত্যাদি নানা ঘরানা দ্রুত প্রকাশিত হয়। আপাত অর্থে বিভিন্ন ছোট ছোট ইস্যুতে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে আলাদা আলাদা গ্রুপ সৃষ্টি হয়, পিটার আকো একে বলছেন “ঘেটো”। এই সময় প্রথমবারের মতো মানুষের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াকে পরিস্থিতি (সিচুয়েশন) এবং প্রেক্ষিত (কনটেক্সট) এর নিরিখে গবেষণা করার প্রচেষ্টা শুরু হয়। আরও পরিষ্কার করে বললে, প্রত্নতত্ত্বের রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়; অতীত মানুষের বিভিন্ন গোষ্ঠী, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক-সূত্র ও সম্পর্কের সামর্থ্য, রাজনৈতিক সংগঠন ও সামাজিক স্তরায়নকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঊনিশশো আশির দশকের বিশ্ব পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করার ও সমাধানের পথনির্দেশের জন্য প্রত্নতাত্ত্বিকরা তাদের অবস্থান থেকে অবদান রাখার চেষ্টা করেন। গোষ্ঠী, শ্রেণী, সীমানা, আদিবাসী, জাতিত্ব ইত্যাদি প্রকরণগুলো প্রত্নতত্ত্বে আলোচিত হতে থাকে। এই সময় আকো, জোনস ও আরও কিছু লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক প্রত্নতাত্ত্বিকের উদ্যোগে কাজের তত্ত্ব বলে এক তত্ত্বহীন ঘেটো-র উদ্ভব ঘটে, এদের মূল বক্তব্য হলো- কাজ করতে করতেই একজন গবেষক তার তত্ত্ব খুঁজে পাবেন, যার সাথে পৃথিবীতে প্রচলিত অন্য তত্ত্বসমূহের কোনো মিল না-ও থাকতে পারে। কিন্তু অন্য তত্ত্বের প্রতি পূর্ব-ধারণার (প্রি-কনসেপ্ট) ফলে তিনি যদি ভ্রান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হন, সেটি সত্যিই বিপজ্জনক।
প্রত্নতত্ত্বের কাজের পদ্ধতি
জরিপ
উৎখননের সম্ভাব্যতা বা বাস্তবতা যাচাই করার জন্যই জরিপ করা হয়।পদ্ধতিগতভাবে,প্রত্নস্থান বা প্রত্ননির্দশন শনাক্ত করা, খুঁজে বের করা,তা ভূ-পৃষ্ঠে চিহ্নত করা, মানচিত্রে শনাক্ত করা,এবং গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করাকে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বলে। জরিপ গবেষণা ২ ধরনের হয়ে থাকে।যথাঃ ১.জরিপ-পূর্ব গবেষণা. ২.মাঠ জরিপ গবেষণা.
অনুসন্ধান
কোন প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের পূর্বে প্রাকখনন গবেষণা সম্পাদন করতে হয়। এর জন্য প্রথম Archaeo- book study বা library work কার্য সম্পর্কে ধারণা অর্জন এর পর কোন জায়গায় প্রত্ননিদর্শন আছে কিনা বা ঐ স্থানটি প্রত্নস্থান কিনা তা পায়ে হেটে জরিপ/খুজে বের করার মাধ্যমকে অনুসন্ধান বলে।
উৎখনন
কোনো গবেষণার ক্ষেত্রে অনুসন্ধানের ঠিক পরের স্থানটি দখল করে আছে উৎখনন। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যা কোনো পুস্তকে লিপিবদ্ধ নয়। উৎখনন হলো এমন একটি বিষয় যা কোনো প্রত্নতত্ত্ববিদও পুনঃপুন খনন কার্য সম্পাদনের মাধ্যমেও কোনো প্রত্নস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়ার বিশেষ প্রক্রিয়া। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া যেমন; grid পদ্ধতি, এরিয়াল ইমেজ, স্যাটেলাইট ইমেজ ইত্যাদি পদ্ধতি অবলম্বন করে উৎখনন কার্য সম্পন্ন করা যায়।
সংরক্ষণ
আমরা যখন কোনো প্রত্নস্থান থেকে কোন প্রকার প্রত্নবস্তুু পাই সেটাকে নানা প্রকার পদার্থ দ্বারা এটিকে তার সাথে মানানসই করে এটিকে কোন একটি জাদুঘর বা প্রত্নতাত্ত্বিক দর্শনীয় জায়গায় রাখি এটাই সংরক্ষন।আবার যাতে কোনো প্রকার বিলুপ্তির আশংক্ষা না থাকে সে পর্যায়ে রাখাকে সংরক্ষন বলে।
নথিভুক্তকরণ
আমরা যখন কোনো প্রত্নবস্তু পাই সেটি কিভাবে পেলাম,সেটি কোন সময়ের,তার ওজন কত,তার উচ্চতা,তার রং,তার নাম,কতটুকু মাটির নিচে পেলাম,কোন অঞ্চলের,এভাবে খুঁটিনাটি সব লিখাকেই বলে নথিভুক্তকরন।
প্রত্নতত্ত্বের উপাদান
প্রত্নতত্ত্বের উপাদান হিসেবে সাধারণভাবে ভৌত ধ্বংসাবশেষ, পরিবেশগত তথ্য, জৈব অবশেষ বা জীবাশ্ম, প্রাকৃতিক-সাংস্কৃতিক ভূদৃশ্যাবলী ইত্যাদিকে বিবেচনা করা হয়। তবে ভাবগত নিদর্শন যার আপাত অর্থে কোনো বহনযোগ্য, বাণিজ্যযোগ্য বা দৃশ্যমান অস্তিত্ব নাই এমন কোন বিষয়ও হতে পারে প্রত্নতাত্ত্বিকের প্রধান সূত্র।ক
মৃতপূর্বপুরুষদের উপাসনা বা শ্রদ্ধা হলো, মৃত ব্যক্তির প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধার উপর ভিত্তি করে উপাসনা। কিছু সংস্কৃতিতে, এটি বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত যে মৃতদের অবিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব রয়েছে এবং জীবিতদের ভাগ্যকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা থাকতে পারে। কিছু গোষ্ঠী তাদের প্রত্যক্ষ, পারিবারিক পূর্বপুরুষদের পূজা করে। কিছু কিছু সম্প্রদায় ও ধর্ম, বিশেষ করে পূর্বদেশীয় সনাতনপন্থী মণ্ডলী এবং রোমান ক্যাথলিক মণ্ডলীসাধুদেরকে ঈশ্বরের কাছে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে পূজা করে; পরেরটিও পুর্গেটরিতে বিদেহী আত্মার জন্য প্রার্থনায় বিশ্বাস করে। তবে অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠী মৃতদের প্রতি পূজা করাকে মূর্তিপূজা ও পাপ বলে জ্ঞান করে।
ইউরোপীয়, এশীয়, ওশেনিয়ান, আফ্রিকান ও আফ্রো-ডায়াস্পোরিক সংস্কৃতিতে, পূর্বপুরুষ পূজার লক্ষ্য হল জীবিতদের প্রতি পূর্বপুরুষদের অব্যাহত মঙ্গল এবং ইতিবাচক মনোভাব নিশ্চিত করা এবং কখনও কখনও বিশেষ অনুগ্রহ বা সহায়তার জন্য অনুরোধ করা। পূর্বপুরুষের শ্রদ্ধার সামাজিক বা অ-ধর্মীয় কাজ হল আত্মীয়তার মূল্যবোধ গড়ে তোলা, যেমন ফিলিয়াল ধার্মিকতা, পারিবারিক আনুগত্য ও পারিবারিক বংশের ধারাবাহিকতা। পূর্বপুরুষের পূজা সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত জটিলতার প্রতিটি স্তরের সমাজে ঘটে এবং এটি আধুনিক সময়ে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুশীলনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে আজও রয়ে গেছে।
সাধারণভাবে
পূর্বপুরুষের উপাসনা দেবতারউপাসনার মতো নয়। কিছু আফ্রো-ডায়াস্পোরিক সংস্কৃতিতে, পূর্বপুরুষকে জীবিতদের পক্ষে মধ্যস্থতা করতে সক্ষম হিসাবে দেখা হয়, প্রায়শই মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যে বার্তাবাহক হিসাবে। আত্মা হিসেবে যারা একসময় নিজেরাই মানুষ ছিল, তারা ঐশ্বরিক সত্তার চেয়ে মানুষের চাহিদা বুঝতে সক্ষম হিসাবে দেখা হয়। অন্যান্য সংস্কৃতিতে, পূর্বপুরুষের উপাসনার উদ্দেশ্য অনুগ্রহ চাওয়া নয় বরং দায়িত্ব পালন করা। কিছু সংস্কৃতি বিশ্বাস করে যে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রকৃতপক্ষে তাদের বংশধরদের দ্বারা সরবরাহ করা প্রয়োজন, এবং তাদের অনুশীলনের মধ্যে খাদ্য এবং অন্যান্য বিধান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অন্যরা বিশ্বাস করে না যে পূর্বপুরুষরা এমনকি তাদের বংশধরেরা তাদের জন্য কী করে সে সম্পর্কেও সচেতন, কিন্তু যেটি হল ধার্মিকতার প্রকাশটি গুরুত্বপূর্ণ।
অধিকাংশ সংস্কৃতি যারা পূর্বপুরুষ উপাসনা করে তারা একে “পূর্বপুরুষ উপাসনা” বলে না। ইংরেজিতে, উপাসনা শব্দটি সাধারণত দেবতা বা ঈশ্বরকে প্রদত্ত শ্রদ্ধেয় প্রেম ও ভক্তি বোঝায় না।[১][২][৩] যাইহোক, অন্যান্য সংস্কৃতিতে, এই উপাসনা কোন বিশ্বাস দেয় না যে বিদেহী পূর্বপুরুষরা কোন ধরনের দেবতা হয়ে উঠেছে। বরং, এই রীতিটি হল পূর্ণাঙ্গ কর্তব্য, ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করার এবং তাদের পরবর্তী জীবনে পূর্বপুরুষদের দেখাশোনা করার পাশাপাশি তাদের জীবিত বংশধরদের জন্য তাদের নির্দেশনা খোঁজার উপায়। এই বিষয়ে, অনেক সংস্কৃতি ও ধর্মের অনুরূপ অনুশীলন রয়েছে। কেউ কেউ তাদের পিতামাতা বা অন্যান্য পূর্বপুরুষদের সমাধি পরিদর্শন করতে পারে, ফুল ছেড়ে তাদের সম্মান ও স্মরণ করার জন্য তাদের কাছে প্রার্থনা করতে পারে, পাশাপাশি তাদের পূর্বপুরুষদের তাদের দেখাশোনা চালিয়ে যেতে বলে। যাইহোক, এটি তাদের উপাসনা হিসাবে বিবেচিত হবে না কারণ উপাসনা শব্দটি সর্বদা নির্দিষ্ট পশ্চিমা ইউরোপীয় খ্রিস্টান ঐতিহ্যের একচেটিয়া ও সংকীর্ণ প্রসঙ্গে এমন অর্থ প্রকাশ করতে পারে না।
সেই অর্থে পূর্বপুরুষ উপাসনা শব্দগুচ্ছ কিছু পশ্চিম ইউরোপীয় খ্রিস্টান ঐতিহ্যের সীমিত দৃষ্টিকোণ থেকে, চিনা ও অন্যান্য বৌদ্ধ-প্রভাবিত এবং কনফুসিয়ান-প্রভাবিত সমাজের পাশাপাশি আফ্রিকান ও ইউরোপীয় সংস্কৃতি নিজেদেরকে করতে দেখে। এটি ইংরেজিতে veneration শব্দের অর্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা ব্যক্তির মর্যাদা, জ্ঞান বা উৎসর্গের কারণে সৃষ্ট মহান সম্মান বা শ্রদ্ধা বুঝায়।[৪][৫][৬]
যদিও পূর্বপুরুষের উপাসনার উৎপত্তি সম্বন্ধে কোনো সাধারণভাবে গৃহীত তত্ত্ব নেই, এই সামাজিক ঘটনাটি এখন পর্যন্ত নথিভুক্ত সমস্ত মানব সংস্কৃতিতে কোনো না কোনো আকারে দেখা যায়। ডেভিড-ব্যারেট এবং কার্নি দাবি করেন যে মানব বিবর্তনের সময় পূর্বপুরুষ উপাসনা গোষ্ঠী সমন্বয় ভূমিকা পালন করতে পারে,[৭] এবং এটি এমন প্রক্রিয়া যা ধর্মীয় প্রতিনিধিত্বকে গোষ্ঠী সংহতি বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করে।[৮][৯]
পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার সংস্কৃতি
পূর্বপুরুষের উপাসনা আফ্রিকাজুড়ে প্রচলিত এবং অনেক ধর্মের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এটি প্রায়শই সর্বোত্তম সত্ত্বাতে বিশ্বাসের দ্বারা বৃদ্ধি পায়, তবে প্রার্থনা এবং/অথবা বলিদান সাধারণত পূর্বপুরুষদের জন্য দেওয়া হয় যারা নিজেরাই এক ধরনের গৌণ দেবতা হয়ে উঠতে পারেন। পূর্বপুরুষের উপাসনা অনেক আফ্রিকানদের মধ্যে রয়ে গেছে, কখনও কখনও খ্রিস্টধর্মের পরবর্তী গৃহীত ধর্মগুলির পাশাপাশি অনুশীলন করা হয় (যেমন নাইজেরিয়াতে ইগবো লোকদের মধ্যে), এবং ইসলামে (বিভিন্ন মান্ডে মানুষ এবং বামুম এবং বাকোসি জনগণের মধ্যে) এশিয়া-আফ্রিকা মহাদেশের বেশিরভাগ অংশে[১০][১১] এবং গোঁড়া সেরাধর্মে, প্যাঙ্গুল সেরার জনগণের দ্বারা পূজা করা হয়।
এশিয়ান সংস্কৃতি
কম্বোডিয়া
পছুম বেন এবং কম্বোডিয়ান নববর্ষের সময় লোকেরা তাদের পূর্বপুরুষদের কাছে উপহার দেয়। পছুম বেন এমন সময় যখন অনেক কম্বোডিয়ান সাত প্রজন্ম পর্যন্ত মৃত আত্মীয়দের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।[১২] সন্ন্যাসীরা পালি ভাষায় রচিত শ্লোকগুলি রাতে উচ্চারণ করেন (নিরন্তর, না ঘুমিয়ে) নরকের দরজা খোলার পূর্বসূচীতে, এমন ঘটনা যা বছরে একবার ঘটে বলে ধারণা করা হয় এবং এটি পালি ত্রিপিটকে উদ্ভূত রাজা যমের সৃষ্টিতত্ত্বের সাথে যুক্ত। এই সময়ের মধ্যে, নরকের দরজা খোলা হয় এবং মৃতদের ভূত (প্রেত) বিশেষভাবে সক্রিয় বলে অনুমান করা হয়। এটি মোকাবেলা করার জন্য, তাদের উপকার করার জন্য খাদ্য-অর্ঘ করা হয়। এই ভূতগুলির মধ্যে কিছু তাদের শুদ্ধকরণের সময় শেষ করার সুযোগ পায়, যেখানে অন্যদের অস্থায়ীভাবে নরক ছেড়ে যাওয়ার জন্য কল্পনা করা হয়, তারপরে আরও কষ্ট সহ্য করার জন্য; অনেক ব্যাখ্যা ছাড়া, আত্মীয় যারা নরকে নেই (যারা স্বর্গে আছে বা অন্যথায় পুনর্জন্ম হয়েছে) তাদেরও সাধারণত অনুষ্ঠান থেকে উপকৃত হওয়ার কল্পনা করা হয়।
মেংজিয়া লংশান মন্দিরে পূজার সময় ধূপ জ্বালানো, যা গুয়ান ইউ, মাজু এবং অন্যান্যদের জন্য উৎসর্গ করা হয়
চীনে, পূর্বপুরুষের উপাসনা (敬祖, পিনয়িন: jìngzǔ) এবং পূর্বপুরুষের উপাসনা (拜祖, পিনয়িন: bàizǔ) মৃত ব্যক্তির কর্মকে সম্মান ও স্মরণ করার চেষ্টা করে; তারা মৃতদের চূড়ান্ত শ্রদ্ধার প্রতিনিধিত্ব করে। পিতামাতাকে (এবং প্রবীণদের) সম্মান করার গুরুত্ব এই সত্যের সাথে নিহিত যে একজনের সত্তার সমস্ত শারীরিক দিকগুলি পিতামাতার দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল, যারা দৃঢ় পদে না থাকা পর্যন্ত মঙ্গল বজায় রাখতে থাকে। পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা ও শ্রদ্ধা হল জীবনে এবং পরবর্তীতে তাদের এই করুণাময় কাজটি ফিরিয়ে দেওয়া। শি (尸; “মৃতদেহ, ব্যক্তিত্ব”) ছিলেন চৌ রাজবংশ (১০৪৫-২৫৬ খৃষ্টপূর্বাব্দ) মৃত আত্মীয়ের বলিদানকারী প্রতিনিধি। শি অনুষ্ঠানের সময়, পূর্বপুরুষের আত্মা অনুমিতভাবে ব্যক্তিত্বের মধ্যে প্রবেশ করবে, যিনি বলিদানের নৈবেদ্য খাবেন ও পান করবেন এবং আধ্যাত্মিক বার্তা প্রকাশ করবেন।
পূর্বপুরুষরা ভারত ও চীনে ব্যাপকভাবে শ্রদ্ধেয়, সম্মানিত এবং পূজনীয়। মৃত ব্যক্তির আত্মাকে পিতৃ বলা হয়, যাকে পূজা করা হয়। যখন একজন ব্যক্তি মারা যায়, তখন পরিবার তেরো দিনের শোক পালন করে, যাকে সাধারণত শ্রাদ্ধ বলা হয়। এক বছর থেকে, তারা তর্পণের আচার পালন করে, যেখানে পরিবার মৃতকে নৈবেদ্য দেয়। এই আচার-অনুষ্ঠানের সময়, পরিবার মৃত ব্যক্তির পছন্দের খাবার তৈরি করে এবং মৃতকে খাবার দেয়। তারা কাকদের এই খাবারটি নির্দিষ্ট দিনে অফার করে কারণ এটি বিশ্বাস করা হয় যে আত্মা এটির স্বাদ নিতে পাখির আকারে আসে। তারা যোগ্য ব্রাহ্মণদের শ্রাদ্ধ, নির্দিষ্ট প্রস্তুতির একটি ছোট উৎসব দিতেও বাধ্য। এই আচারের পরেই পরিবারের সদস্যদের খেতে দেওয়া হয়। এটা বিশ্বাস করা হয় যে এটি পূর্বপুরুষের আত্মাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে তারা ভুলে যায় না এবং তাদের ভালবাসা হয়, তাই এটি তাদের শান্তি নিয়ে আসে। শ্রাধের দিন, লোকেরা প্রার্থনা করে যে পূর্বপুরুষদের আত্মা শান্তি পায়, কোনও শত্রুতা ভুলে যায় এবং শান্তি পায়। প্রতি বছর, নির্দিষ্ট তারিখে (হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে) যখন ব্যক্তি মারা গিয়েছিল, পরিবারের সদস্যরা এই আচারের পুনরাবৃত্তি করে।
সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং মহাদেশের অন্য কোথাও বৃহৎ ভারতীয় ও চীনা জনসংখ্যার ফলস্বরূপ পূর্বপুরুষ-উপাসনার ভারতীয় ও চীনা রীতি এশিয়া জুড়ে প্রচলিত। অধিকন্তু, ফিজি ও গায়ানার মত জায়গায় বৃহৎ ভারতীয় জনসংখ্যার ফলে এই অনুশীলনগুলি তাদের এশিয়ান মাতৃভূমির বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে।
ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়ায় পূর্বপুরুষদের উপাসনা কিছু আদিবাসীদের ঐতিহ্য। টোবা বাতাকের পোডম, মিনাহাসানদের ওয়ারুগা এবং করো জনগণের (ইন্দোনেশিয়া) কফিন হল পূজার রূপের কয়েকটি উদাহরণ।
জাপান
জাপানেবৌদ্ধধর্মের প্রবর্তনের আগে, পূর্বপুরুষদের উপাসনা এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সাধারণ ছিল না, বিশেষ করে অ-অভিজাতদের জন্য।[১৩] হেইয়ান যুগে, পরিত্যাগ মৃতদের নিষ্পত্তির সাধারণ পদ্ধতি ছিল।[১৪] বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাবের পর, কবরস্থানে দাফন বা দাহ করার পরে কখনও কখনও আচার অনুষ্ঠান করা হত।[১৫]
কোরিয়া
পূর্বপুরুষদের জন্য কোরিয়ান জেসা বেদি
কোরিয়াতে, পূর্বপুরুষের উপাসনাকে জেনেরিক শব্দ জেরি (হাঙ্গুল: 제례; হাঞ্জা: 祭禮) বা জেসা (হাঙ্গুল: 제사; হাঞ্জা: 祭祀) দ্বারা উল্লেখ করা হয়। জেরির উল্লেখযোগ্য উদাহরণের মধ্যে রয়েছে মুনমিও জেরিয়ে এবং জংমিও জেরি, যা প্রতি বছর যথাক্রমে শ্রদ্ধেয় কনফুসীয় পণ্ডিত এবং প্রাচীন যুগের রাজাদের জন্য পর্যায়ক্রমে সম্পাদিত হয়। পরিবারের কোনো সদস্যের মৃত্যুবার্ষিকীতে আয়োজিত অনুষ্ঠানকে বলা হয় চ্যারি (차례)। এটা আজও চর্চা করা হয়।[১৬]
বেশিরভাগ ক্যাথলিক, বৌদ্ধ এবং অবিশ্বাসীরা পৈতৃক আচার পালন করে, যদিও প্রোটেস্ট্যান্টরা তা করে না।[১৭] পৈতৃক আচারের উপর ক্যাথলিক নিষেধাজ্ঞা ১৯৩৯ সালে প্রত্যাহার করা হয়, যখন ক্যাথলিক চার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্বপুরুষের আচারকে নাগরিক অনুশীলন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।[১৭]
সিজে (시제, 時祭; 사시제 বা 四時祭 বলাও হয়) – পাঁচ বা ততোধিক প্রজন্ম অপসারিত পূর্বপুরুষদের জন্য অনুষ্ঠিত মৌসুমী অনুষ্ঠান (সাধারণত বার্ষিক দশম চান্দ্র মাসে সঞ্চালিত হয়)
মায়ানমার
আধুনিক মায়ানমারে পূর্বপুরুষের উপাসনা মূলত কিছু জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, কিন্তু এর মূলধারার অবশিষ্টাংশ এখনও বিদ্যমান, যেমন “বো বো গি” (আক্ষরিক অর্থে “মহান পিতামহ”) এর উপাসনার পাশাপাশি অন্যান্য অভিভাবক আত্মা যেমন “নাত”, যার সবগুলোই হয়তো ঐতিহাসিক নিদর্শনপূর্ব পুরুষের উপাসনা।[১৯]
প্রাক-ঔপনিবেশিক বার্মায় রাজদরবারে পূর্বপুরুষের উপাসনা ছিল। কোনবং রাজবংশের সময়, মৃত রাজা ও তাদের স্ত্রীদের কঠিন সোনার ছবিগুলিকে রাজপরিবার দ্বারা বছরে তিনবার পূজা করা হত, বার্মিজ নববর্ষের সময় (থিংয়ান), ভাসার শুরুতে ও শেষে।[২০] ছবিগুলি কোষাগারে সংরক্ষিত ছিল এবং জেটাউনজাউং (ဇေတဝန်ဆောင်, “হল অফ অ্যানসেস্টরস”) এ উপাসনা করা হয়েছিল, বইয়ের সাথে।[২০]
কিছু পণ্ডিত পূর্বপুরুষ উপাসনার অদৃশ্য হওয়ার কারণ হিসেবে বৌদ্ধ মতবাদের অ্যানিকা ও অনত্তা, অস্থিরতা ও ‘স্ব’কে প্রত্যাখ্যান করার জন্য দায়ী করেন।[২১]
বিভিন্ন ইগোরোট বুলুল অ্যানিতো বা পূর্বপুরুষ আত্মাকে চিত্রিত করে (১৯০০ খৃষ্টাব্দ)
প্রাক-ঔপনিবেশিক ফিলিপাইনের অ্যানিমিস্টিক আদিবাসী ধর্মগুলিতে, পূর্বপুরুষ আত্মারা ছিল দুটি প্রধান ধরনের আত্মার মধ্যে একটি (অ্যানিতো) যাদের সাথে শামানরা যোগাযোগ করে। পূর্বপুরুষের আত্মাগুলিকে উমলাগাদ (আদি “অভিভাবক” বা “তত্ত্বাবধায়ক”) নামে পরিচিত ছিল। তারা প্রকৃত পূর্বপুরুষদের আত্মা বা পরিবারের সাধারণ অভিভাবক আত্মা হতে পারে। প্রাচীন ফিলিপিনোরা বিশ্বাস করত যে মৃত্যুর পর, ব্যক্তির আত্মা (সাধারণত নৌকায়) আত্মিক জগতে ভ্রমণ করে।[২২][২৩][২৪] আত্মা জগতে একাধিক অবস্থান হতে পারে, বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীতে পরিবর্তিত। আত্মারা কোন জায়গায় শেষ হয় তা নির্ভর করে তারা কিভাবে মারা গেছে, মৃত্যুর সময় কত বয়সে বা জীবিত থাকাকালীন ব্যক্তির আচরণ। আত্মারা পাতালে মৃত আত্মীয়দের সাথে পুনরায় মিলিত হয় এবং পাতাল জগতে স্বাভাবিক জীবনযাপন করে যেমন তারা বস্তুজগতে করেছিল। কিছু ক্ষেত্রে, মন্দ লোকদের আত্মা নির্দিষ্ট আত্মিক রাজ্যে প্রবেশ করার আগে তপস্যা ও শুদ্ধির মধ্য দিয়ে যায়। আত্মারা শেষ পর্যন্ত আত্মা জগতে কিছু সময়ের পর পুনর্জন্ম লাভ করবে।[২২][২৩][২৫][২৬]
আত্মা জগতের আত্মা বস্তুগত জগতে এখনও কিছুটা প্রভাব বজায় রাখে এবং এর বিপরীতে। প্যাগানিতো আচারগুলি সুরক্ষা, মধ্যস্থতা বা পরামর্শের জন্য ভাল পূর্বপুরুষ আত্মাদের আহ্বান করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। মৃতদের প্রতিহিংসাপরায়ণ আত্মা আবির্ভাব বা ভূত (ম্যান্টিউ) হিসাবে প্রকাশ করতে পারে এবং জীবিত মানুষের ক্ষতি করতে পারে। প্যাগানিতো তাদের সন্তুষ্ট বা নির্বাসিত করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।[২২][২৫][২৭] পূর্বপুরুষ আত্মাগুলি অসুস্থতা বা মৃত্যুর সময়ও বিশিষ্টভাবে চিত্রিত হয়, কারণ তারা আত্মাকে পাতালের দিকে ডাকে, আত্মাকে (সাইকোপম্প), বা আগমনের পর আত্মার সাথে দেখা করে বলে বিশ্বাস করা হয়।[২২]
পূর্বপুরুষ আত্মাগুলি কর্ডিলারানদের মধ্যে কালাডিং নামেও পরিচিত;[২৮] মাগুইন্দানাও এবং মারানাও-এর মধ্যে টোনং;[২৯] সামা-বাজাউ-এর মধ্যে উম্বো;[৩০] তাগালগদের মধ্যে নিনুনো; এবং বিচলানদের মধ্যে নোনো।[৩১] পূর্বপুরুষের আত্মা সাধারণত খোদাই করা মূর্তি দ্বারা উপস্থাপিত হয় যাকে তাওটাও বলা হয়।এগুলি ব্যক্তির মৃত্যুর পরে সম্প্রদায় দ্বারা খোদাই করা হয়েছিল। প্রতিটি পরিবারের একটি তাওতাও ঘরের কোণে একটি শেলফে সংরক্ষিত ছিল।[২২]
প্রধানত রোমান ক্যাথলিক ফিলিপিনো লোকেরা ১৫২১ সালে স্প্যানিশ মিশনারিদের সংস্পর্শে আসার পর থেকে খ্রিস্টান হওয়া সত্ত্বেও – যদিও তাদের প্রতিবেশীদের কাছে সাধারণ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই পূর্বপুরুষদেরকে এখনও বিশেষভাবে সম্মান করে। বর্তমান দিনে, বাড়ির বেদিতে মৃতদের ছবি তোলার মাধ্যমে পূর্বপুরুষের শ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়, এটি অনেক ফিলিপিনো খ্রিস্টান বাড়িতে সাধারণ জিনিস। ফটোগ্রাফের আগে মোমবাতিগুলি প্রায়শই জ্বালিয়ে রাখা হয়, যা কখনও কখনও তাজা সাম্পাগুইটা জাতীয় ফুলের মালা দিয়ে সজ্জিত করা হয়।পূর্বপুরুষ, বিশেষ করে মৃত পিতা-মাতাকে এখনও সাইকোপম্প হিসাবে গণ্য করা হয়, কারণ একজন মৃত ব্যক্তিকে মৃত আত্মীয়দের আত্মার দ্বারা পরকালে (তাগালগ: সুন্দো, “আনয়ন”) নিয়ে আসা হয়। বলা হয়ে থাকে যে, মৃত ব্যক্তিরা যখন মৃত প্রিয়জনদের নাম ডাকে, তখন তারা দেখতে পায় সেই বিশেষ ব্যক্তিদের আত্মারা মৃত্যুশয্যার পাদদেশে অপেক্ষা করছে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
ফিলিপিনো ক্যাথলিক ও আগ্লিপায়ান মৃতদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখায় ফিলিপাইনে এর সর্বশ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি হল ৩১ অক্টোবর ও ২ নভেম্বরের মধ্যে হ্যালোমাস ঋতু, যাকে বিভিন্নভাবে উন্ডাস ([দ্য] ফার্স্ট, স্প্যানিশ আন্দাস বা সম্ভবত হনরা শব্দের উপর ভিত্তি করে বলা হয়), টদস লস শান্তস (আক্ষরিক অর্থে সমস্তসেন্টস), এবং কখনও কখনও আরাওং মগা পাতায় (“ডে অফ দ্য ডেড”), যা অল সোলস ডে-এর নিম্নলিখিত গৌরবকে বোঝায়। ফিলিপিনোরা ঐতিহ্যগতভাবে এই দিনটিকে মৃত পরিবার পরিদর্শন করে, তাদের সমাধি পরিষ্কার ও মেরামত করে পালন করে। সাধারণ নৈবেদ্য হল প্রার্থনা, ফুল, মোমবাতি এবং এমনকি খাবার, যখন অনেকে দিনের অবশিষ্ট সময় কাটায় এবং পরবর্তী রাত্রি কবরস্থানে পুনর্মিলন, খেলা ও গান বা গান বাজায়।[৩২]
চীনা ফিলিপিনোদের মধ্যে, পূর্বপুরুষ উপাসনার সাথে সম্পর্কিত সবচেয়ে স্পষ্ট ও স্বতন্ত্র রীতিনীতি রয়েছে, যা ঐতিহ্যবাহী চীনা ধর্ম থেকে চলে আসে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের বর্তমান ক্যাথলিক বিশ্বাসের সাথে মিশে যায়। অনেকে এখনও পারিবারিক সমাধিতে ও বাড়িতে ছবি তোলার আগে ধূপ জ্বালায় এবং কিম জ্বালায়, যখন তারা অল সোলস ডে পিরিয়ডের সময় আয়োজিত গণসমাবেশে চীনা অনুশীলনগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
শ্রীলংকা
শ্রীলঙ্কায়, প্রথাগত শ্রীলঙ্কার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অংশ হিসেবে মৃত্যুর পর ষষ্ঠ দিনে পূর্বপুরুষকে অর্ঘ প্রদান করা হয়।[৩৩]
থাইল্যান্ড
গ্রামীণ উত্তর থাইল্যান্ডে, ফাউন ফি (থাই: ฟ้อนผี, “স্পিরিট নৃত্য” বা “ভূতের নৃত্য”) নামে পরিচিত পূর্বপুরুষদের আত্মাদের সম্মানে ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়। এতে পূর্বপুরুষদের জন্য স্পিরিট মিডিয়াম সোর্ড ফাইটিং, স্পিরিট-পসেসড ড্যান্সিং এবং এবং আধ্যাত্মিক মোরগ লড়াইয়ে স্পিরিট মিডিয়াম মোরগ লড়াই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।[৩৪]
ভিয়েতনাম
পূর্বপুরুষদের জন্য ভিয়েতনামী বেদী। লক্ষ্য করুন ছোট বৌদ্ধ বেদি উপরের কোণে উঁচু
নববর্ষের নৈবেদ্য উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী পোশাকে একজন বৃদ্ধ
পূর্বপুরুষের উপাসনা হল ভিয়েতনামী সংস্কৃতির অন্যতম একীভূত দিক, কারণ কার্যত সমস্ত ভিয়েতনামী, ধর্মীয় অনুষঙ্গ নির্বিশেষে (বৌদ্ধ, ক্যাথলিক বা অ্যানিমিস্ট) তাদের বাড়িতে বা ব্যবসায় পূর্বপুরুষের বেদী রয়েছে।
ভিয়েতনামে, ঐতিহ্যগতভাবে লোকেরা জন্মদিন উদযাপন করত না (পশ্চিমা প্রভাবের আগে), কিন্তু প্রিয়জনের মৃত্যুবার্ষিকী সবসময় গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ ছিল। মৃত ব্যক্তির স্মরণে ভোজসভার জন্য পরিবারের সদস্যদের অপরিহার্য জমায়েত ছাড়াও, নরকের টাকার সাথে ধূপকাঠি পোড়ানো হয় এবং পূর্বপুরুষের বেদীতে নৈবেদ্য হিসাবে খাবারের বড় থালা তৈরি করা হয়, যেখানে সাধারণত তাদের নামের ছবি বা ফলক থাকে মৃত নিখোঁজ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে, তাদের পরিবার মৃত বলে বিশ্বাস করে, বায়ু সমাধি তৈরি করা হয়।
গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী বা ধর্মীয় উদযাপনের সময়, নতুন ব্যবসা শুরু করার সময়, বা এমনকি যখন কোনও পরিবারের সদস্যদের নির্দেশনা বা পরামর্শের প্রয়োজন হয় এবং এটি ভিয়েতনামী সংস্কৃতির সন্তানোচিত কর্তব্যের উপর জোর দেওয়ার বৈশিষ্ট্য।
ভিয়েতনামী পূর্বপুরুষদের উপাসনার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল যে নারীদের ঐতিহ্যগতভাবে পৈতৃক আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও সহ-কর্মকর্তার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, চীনা কনফুসিয়ান মতবাদের বিপরীতে, যা শুধুমাত্র পুরুষ বংশধরদের এই ধরনের আচার সম্পাদন করতে দেয়।[৩৫]
ইউরোপীয় সংস্কৃতি
গ্রামীণ স্পেনের মনোরম কবরস্থান
ইউরোপের ক্যাথলিক দেশগুলিতে (পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের অ্যাংলিকান চার্চের সাথে চলতে থাকে), ১ নভেম্বর (অল সেন্টস ডে) পরিচিত হয়ে ওঠে এবং এখনও বিশেষভাবে যারা মারা গেছে তাদের শ্রদ্ধা করার দিন হিসাবে পরিচিত, এবং যারা চার্চ দ্বারা সরকারী সাধু বলে বিবেচিত হয়েছে। নভেম্বর ২, (অল সোলস ডে), বা “মৃত দিবস”, হল সেই দিন যখন সমস্ত বিশ্বস্ত মৃতদের স্মরণ করা হয়। সেই দিন, পরিবারগুলি তাদের মৃত আত্মীয়দের জন্য মোমবাতি জ্বালাতে, তাদের ফুল রেখে এবং প্রায়শই পিকনিক করতে কবরস্থানে যায়। অল সেন্টস’-“অল হ্যালোস ইভ” বা “হ্যালোয়েন”-এর আগের সন্ধ্যা হল বেসরকারীভাবে নরকের বাস্তবতা মনে রাখার, মন্দের কাছে হেরে যাওয়া আত্মাদের শোক করার এবং নরক এড়ানোর উপায়গুলি মনে রাখার জন্য অনানুষ্ঠানিকভাবে ক্যাথলিক দিন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] এটি সাধারণত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কিছু অংশে পালিত হয় হালকা-হৃদয় ভীতি ও ভয়ের চেতনায়, যা ভূতের গল্প, বনফায়ার, পোশাক পরা, জ্যাক-ও-লন্ঠন খোদাই করা এবং ” ট্রিক-অর-ট্রিটিং” (দ্বারে দ্বারে গিয়ে মিছরির জন্য ভিক্ষা করা)।
উত্তর আমেরিকা
অফরেন্ডা টেকুইস্কিয়াপান, মেক্সিকোতে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়, ফুল, পুষ্পস্তবক, কবরের সজ্জা এবং কখনও কখনও মোমবাতি, খাবার, ছোট নুড়ি বা মৃতদের জীবনের মূল্যবান জিনিসগুলি মৃতদের সম্মান করার উপায় হিসাবে সারা বছর কবরে রাখা হয়। উভয় দেশের বর্তমান জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক পটভূমিতে এই ঐতিহ্যের উৎপত্তি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, মেমোরিয়াল ডে-তে অনেক লোক মৃত প্রিয়জনদের সম্মান জানায় যারা সামরিক বাহিনীতে ছিলেন। ইস্টার, ক্রিসমাস, ক্যান্ডেলমাস এবং অল সোলস ডে, ডে অফ দ্য ডেড বা সামহেন-এর মতো ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য সহ দিনগুলিও এমন সময় যখন মৃত ব্যক্তির আত্মীয় ও বন্ধুরা তাদের প্রিয়জনের কবরে জড়ো হতে পারে। ক্যাথলিক চার্চে, একজনের স্থানীয় প্যারিশ চার্চ প্রায়ই মৃতদের জন্য তাদের মৃত্যুবার্ষিকী বা অল সোলস ডেতে প্রার্থনা করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, মেমোরিয়াল ডে হল ফেডারেল ছুটির দিন যা দেশের সেনাবাহিনীতে কাজ করা মৃত পুরুষ ও মহিলাদের স্মরণ করার জন্য, বিশেষ করে যারা যুদ্ধে বা সক্রিয় চাকরির সময় মারা গিয়েছিল। আরলিংটন ও গেটিসবার্গের মতো ১৪৭টি জাতীয় কবরস্থানে, স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য প্রতিটি কবরে ছোট আমেরিকান পতাকা রাখা সাধারণ। মে মাসের শেষ সোমবার মেমোরিয়াল ডে ঐতিহ্যগতভাবে পালন করা হয়, ৩-দিনের সাপ্তাহিক ছুটির জন্য বরাদ্দ করা হয় যেখানে অনেক স্মারক পরিষেবা ও প্যারেড শুধুমাত্র সারা দেশেই নয়, বিদেশের মাটিতে ২৬টি আমেরিকান কবরস্থানে (ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইউনাইটেড) কিংডম, ফিলিপাইন, পানামা, ইতালি,লুক্সেমবার্গ, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ডস ও তিউনিসিয়া)। এটি প্রবীণদের মধ্যে তাদের মৃত্যুর তারিখে পতিত পরিষেবা সদস্যদের স্মরণ করা সাধারণ অভ্যাস। বিশ্বযুদ্ধে তাদের শহর মুক্ত করার যুদ্ধে মারা যাওয়া আমেরিকানদের স্মরণ করার সময় অন্যান্য দেশেও এই অভ্যাসটি সাধারণ। এর উদাহরণ হল ১৬ আগস্ট (১৯৪৪) কর্নেল গ্রিফিথ, লেভেসে শত্রুদের ক্রিয়াকলাপে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মারা যান, একই দিনে তিনি চার্টেস ক্যাথেড্রালকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর কৃতিত্ব পান।
ইহুদি ধর্মে, যখন কবর স্থান পরিদর্শন করা হয়, তখন শিরস্তরের উপর একটি ছোট নুড়ি স্থাপন করা হয়। যদিও এর কোন সুস্পষ্ট উত্তর নেই কেন, নুড়ি ফেলে রাখার এই রীতিটি বাইবেলের সেই দিনগুলিতে হতে পারে যখন মানুষ পাথরের স্তূপের নীচে চাপা পড়েছিল। আজ, তারা টোকেন হিসাবে বামে আছে যে মানুষ সেখানে পরিদর্শন এবং মনে রাখা হয়েছে।[৩৬]
বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির আমেরিকানরা তাদের বাড়িতে তাদের পূর্বপুরুষদের ছবি, ফুল এবং স্মৃতিচিহ্ন সহ মৃত প্রিয়জনদের জন্য উৎসর্গীকৃত মন্দির তৈরি করতে পারে। ক্রমবর্ধমানভাবে, রাস্তার ধারে অনেক মন্দির দেখা যেতে পারে মৃত আত্মীয়দের জন্য যারা গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল বা সেই স্থানেই মারা গিয়েছিল, কখনও কখনও রাজ্য বা প্রদেশ দ্বারা অর্থায়ন করা হয় কারণ এই মার্কারগুলি বিপজ্জনক এলাকায় সাবধানে গাড়ি চালানোর জন্য শক্তিশালী অনুস্মারক হিসাবে কাজ করে। ওয়াশিংটন, ডি সি-তে ভিয়েতনাম ভেটেরান্স মেমোরিয়াল, বিশেষ করে মৃত ব্যক্তিদের অর্ঘ্য দেবার জন্য পরিচিত; অবশিষ্ট আইটেম জাতীয় উদ্যান পরিষেবা দ্বারা সংগ্রহ করা হয় এবং আর্কাইভ করা হয়।
চার্চ অফ জেসাস ক্রাইস্ট অফ ল্যাটার-ডে সেন্টস-এর সদস্যরা অন্যান্য পরিবারের সাথে তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের জন্য মরণোত্তর বাপ্তিস্ম এবং অন্যান্য আচার অনুষ্ঠান করে।
নেটিভ আমেরিকানরা মৃতদের পূজার ব্যাপারে খুব বেশি উদ্বিগ্ন ছিল না, যদিও তারা মৃতদেরকে কাপড় ও সরঞ্জাম দিয়ে কবর দেওয়ার পাশাপাশি মাঝে মাঝে কবরস্থানে খাবার ও পানীয় রেখে দিতে পরিচিত ছিল; পুয়েব্লো ভারতীয়রা মৃতদের ধর্মকে সমর্থন করত যারা আচারিক নৃত্যের মাধ্যমে মৃতদের পূজা করত বা আবেদন করত।[৩৭]
ইসলাম
ইসলাম কবর মাজার ও পূর্বপুরুষ উপাসনা সম্পর্কে জটিল ও মিশ্র দৃষ্টিভঙ্গি আছে। অনেক প্রারম্ভিক ইসলামিক ব্যক্তিত্বের কবর হল মুসলমানদের জন্য পবিত্র স্থান, যার মধ্যে আলিও রয়েছে এবং অনেক সাহাবী ও প্রাথমিক খলিফা সহ কবরস্থান। অন্যান্য অনেক সমাধি হল প্রধান স্থাপত্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্থান, যার মধ্যে রয়েছে পাকিস্তানের জাতীয় সমাধি এবং ভারতের তাজমহল। যাইহোক, ওয়াহাবি ধর্মীয় আন্দোলন সাধু পূজার ধারণাকে বিতর্কিত করে।[৩৮] এই আন্দোলনের অনুসারীরা সৌদি আরব এবং ইসলামিক রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল সহ অনেক কবরস্থান ধ্বংস করেছে।
ইমান আহমাদ, আল-হাকিম এবং অন্যরা মারওয়ান ইবন আল-হাকাম-একজন অন্যায় শাসক-এর সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন যে তিনি একবার নবীর কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং একজন লোককে নবীর কবরে গাল দিয়ে দেখেছেন। মারওয়ান ইবনুল হাকাম জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি জানেন আপনি কি করছেন? কবরের কাছে, মারওয়ান ইবনে আল-হাকাম বুঝতে পারলেন যে এটি আবু আইয়ুব আল-আনসারি, নবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহাবী। আবু আইয়ুব আল-আনসারী উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, আমি জানি আমি কি করছি। আমি এখানে আল্লাহর রাসূলের জন্য এসেছি – পাথরের জন্য নয়।” এর দ্বারা তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে তিনি নবীর সান্নিধ্যে দোয়া চাচ্ছেন, তাঁর কবর ঢেকে রাখা পাথরের জন্য নয়। আবু আইয়ুব আল আনসারী তার প্রতিক্রিয়া অব্যাহত রেখেছিলেন যা তিনি আল্লাহর রসূলকে বলতে শুনেছেন: “শাসকরা সঠিকভাবে শাসন করলে ইসলামের ধর্ম নিয়ে কাঁদবেন না। বরং এই ধর্মের জন্য কান্নাকাটি কর যদি শাসকরা ভুল শাসন করে থাকে।” তার প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে, আবু আইয়ুব মারওয়ান ইবনে আল-হাকামকে বলছিলেন: “আপনি সেই শাসকদের মধ্যে একজন নন যারা সঠিকভাবে ইসলামের নিয়ম অনুসারে শাসন করছেন।
ইসলামের কিছু অনুসারী সাধু পূজার ধারণার সাথে বিরোধিতা করে, কিন্তু এই প্রথাটি তুরস্কে, বিশেষ করে আলেভি মুসলমানদের মাধ্যমে বজায় রাখা হয়েছে।[৩৮]
প্রাচীন সংস্কৃতি
পূর্বপুরুষের উপাসনা অনেক ঐতিহাসিক সমাজের বিশিষ্ট বৈশিষ্ট্য ছিল।
প্রাচীন মিশর
যদিও কিছু ইতিহাসবিদ দাবি করেন যে প্রাচীন মিশরীয় সমাজ তার বিস্তৃত সমাধি ও মমিকরণের আচারের কারণে “মৃত্যু সম্প্রদায়” ছিল, এটি ছিল বিপরীত। দর্শন যে “এই পৃথিবী শুধু অশ্রুর উপত্যকা” এবং মৃত্যু ও ঈশ্বরের সাথে থাকা পার্থিব অস্তিত্বের চেয়ে ভাল অস্তিত্ব প্রাচীন মিশরীয়দের মধ্যে তুলনামূলকভাবে অজানা ছিল। এর অর্থ এই নয় যে তারা জীবনের কঠোরতার সাথে অপরিচিত ছিল; বরং, তাদের নীতির মধ্যে এই জীবন ও পরবর্তী জীবনের মধ্যে ধারাবাহিকতার অনুভূতি অন্তর্ভুক্ত ছিল। মিশরীয় জনগণ তাদের দৈনন্দিন জীবনের সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও ধর্মকে এতটাই ভালবাসত যে তারা পরবর্তীতে সেগুলি চালিয়ে যেতে চেয়েছিল-যদিও কেউ কেউ সুন্দর পশ্চিমে (মিশরীয় পরবর্তী জীবন) আরও ভাল স্টেশনের আশা করতে পারে।
সমাধিগুলি পরকালে বাসস্থান ছিল এবং তাই সেগুলি যত্ন সহকারে নির্মিত ও সজ্জিত করা হয়েছিল, ঠিক যেমন জীবিতদের জন্য ঘর ছিল। মমিকরণ মৃতদেহ সংরক্ষণের একটি উপায় ছিল যাতে মৃত ব্যক্তির কা (আত্মা) জীবিত থাকাকালীন উপভোগ করা জিনিসগুলির অফার পেতে ফিরে আসতে পারে। যদি মমিকরণ সাশ্রয়ী না হয়, তবে মৃত ব্যক্তির অনুরূপ “কা-মূর্তি” এই উদ্দেশ্যে খোদাই করা হয়েছিল। ধন্য মৃতদের সম্মিলিতভাবে আখু বা “চকচকেরা” (একবচন: আখ) বলা হত। তাদের বর্ণনা করা হয়েছিল “বাদামের পেটে সোনার মতো জ্বলজ্বল” (ড. নুইত) এবং প্রকৃতপক্ষে অনেক সমাধি ও মন্দিরের ছাদে সোনার তারা হিসাবে চিত্রিত হয়েছিল।
যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কা আখ হয়ে ওঠে তা মৃত্যুর পরে স্বয়ংক্রিয় ছিল না; এটি ডুয়াট বা আদারওয়ার্ল্ডের মাধ্যমে ৭০-দিনের যাত্রা জড়িত, যা মৃতদের লর্ড ওয়েসির (ড. ওসিরিস) এর সামনে বিচারের দিকে পরিচালিত করেছিল যেখানে কা-এর হৃদয়কে মাআতের পালক (সত্যের প্রতিনিধিত্ব করে) এর বিপরীতে ওজন করা হবে ) যাইহোক, যদি কা সঠিকভাবে প্রস্তুত না করা হয়, তাহলে এই যাত্রা বিপজ্জনক বিপদ এবং অদ্ভুত দানব দ্বারা পরিপূর্ণ হতে পারে; তাই আবিষ্কৃত প্রাচীনতম ধর্মীয় গ্রন্থগুলির মধ্যে কিছু, যেমন আনি এর প্যাপিরাস (সাধারণত দ্য বুক অফ দ্য ডেড নামে পরিচিত) এবং পিরামিড লিপিগুলি আসলে গাইড হিসাবে লেখা হয়েছিলমৃত ব্যক্তিকে সফলভাবে দুআত নেভিগেট করতে সাহায্য করুন।
যদি হৃদয় মা’আতের পালকের সাথে ভারসাম্য বজায় রাখে, তাহলে কা বিচার রায় দিয়েছিল এবং আখ হিসেবে সুন্দর পশ্চিমে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছিল যিনি ছিলেন মা হেরু (“স্বরের সত্য”) দেবতা এবং অন্যান্য আখুদের মধ্যে বসবাস করার জন্য। এই মুহুর্তে শুধুমাত্র কা-কে আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জীবিতদের দ্বারা পূজা করার যোগ্য বলে মনে করা হয়েছিল। যারা দুআতে হারিয়ে গেছে বা ইচ্ছাকৃতভাবে বিচার এড়াতে চেষ্টা করেছে তারা হতভাগ্য (এবং কখনও কখনও বিপজ্জনক) মুতু, অস্থির মৃত। যাদের সত্যিকারের দুষ্ট হৃদয় পালককে ছাড়িয়ে গেছে তাদের জন্য, দেবী অ্যামিট তাদের গ্রাস করার জন্য ওয়েসিরের বিচারের আসনের পিছনে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছিলেন। তিনি যৌগিক প্রাণী ছিলেন যা মিশরের তিনটি মারাত্মক প্রাণীর মতো: কুমির, জলহস্তী ও সিংহ। আম্মিটকে খাওয়ানোর জন্য এটিকে ইটারনাল ভ্যায়েডে পাঠানো হয়েছিল, কা হিসেবে “অনির্মিত” হতে হবে।
আম্মিত খাওয়ার পাশাপাশি, শারীরিক মৃত্যুর পর একজন কাকে সবচেয়ে খারাপ পরিণতি ভুলে যেতে হবে। এই কারণে, প্রাচীন মিশরে পূর্বপুরুষের পূজা ছিল স্মরণের গুরুত্বপূর্ণ আচার যাতে এই জীবনে এবং পরবর্তী জীবনে কাকে “জীবিত” রাখা যায়। রাজকীয়, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা ও ধনীরা তাদের স্থানীয় যাজকদের সাথে তাদের সমাধিতে প্রার্থনা এবং নৈবেদ্য দেওয়ার জন্য চুক্তি করেছিলেন। বিনিময়ে, যাজকদের প্রদত্ত পরিষেবার জন্য অর্থ প্রদান হিসাবে নৈবেদ্যগুলির অংশ রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিছু কবরের শিলালিপি এমনকি পথচারীদেরকে মৃত ব্যক্তির নাম উচ্চস্বরে বলার জন্য আমন্ত্রণ জানায় (যা তাদের স্মৃতিকে চিরস্থায়ী করতেও সাহায্য করেছিল) এবং তারা চাইলে জল, প্রার্থনা বা অন্যান্য জিনিস দেওয়ার জন্য। স্বল্প ধনী ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত বাড়িতে, পারিবারিক আখু এর আবাসন ছবি এবং পূজার বেদি হিসেবে পরিবেশনের উদ্দেশ্যে দেয়ালে কুলুঙ্গি খোদাই করা হয়।
কেমেটিক অর্থোডক্সির ধর্মে এই একই ধর্মীয় বিশ্বাস এবং পূর্বপুরুষদের পূজার অনুশীলনের অনেকগুলি আজও চালু রয়েছে।
দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথম দিকের রোমান সারকোফ্যাগাস থেকে বিশদ বিবরণ যা মেলেগারের মৃত্যুকে চিত্রিত করে।
রোমানরা, অনেক ভূমধ্যসাগরীয় সমাজের মতো, মৃতদের মৃতদেহকে দূষিত বলে মনে করত।[৩৯] রোমের ধ্রুপদী যুগে, মৃতদেহকে প্রায়শই দাহ করা হতো এবং ছাই শহরের দেয়ালের বাইরে একটি সমাধিতে রাখা হতো। ফেব্রুয়ারী মাসের বেশির ভাগ সময়ই ছিল মৃতদের শুদ্ধিকরণ, প্রায়শ্চিত্ত ও শ্রদ্ধার জন্য, বিশেষ করে প্যারেন্টালিয়ার নয় দিনের উৎসবে, যে সময়ে পরিবার তার পূর্বপুরুষদের সম্মান করেছিল। পরিবার কবরস্থান পরিদর্শন করে এবং কেক ও ওয়াইন ভাগ করে, মৃতদের জন্য অর্ঘ্য হিসাবে এবং নিজেদের মধ্যে খাবার হিসাবে উভয়ই। প্যারেন্টালিয়া ২১শে ফেব্রুয়ারী আরও নোংরা ফেরালিয়ার সাথে সমাপ্তি ঘটায়, মানেসকে বলিদান ও নৈবেদ্য প্রদানের সর্বজনীন উৎসব, মৃতদের সম্ভাব্য দূষিত আত্মা যাদের প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন ছিল।[৪০] ল্যাটিন এপিটাফের সবচেয়ে সাধারণ শিলালিপি শব্দগুলির মধ্যে একটি হল ডিস ম্যানিবুস, সংক্ষেপে ডিএম, “মানেস দেবতাদের জন্য”, যা কিছু খ্রিস্টান সমাধির পাথরেও দেখা যায়। ২২ ফেব্রুয়ারী ক্যারিস্টিয়া ছিল পারিবারিক লাইনের উদযাপন কারণ এটি বর্তমান পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।[৪১]
সম্ভ্রান্ত রোমান পরিবার তাদের বাড়ির ট্যাবলিনিয়ামে (ডোমাস) পূর্বপুরুষের ছবি (কল্পনা) প্রদর্শন করেছিল। কিছু উৎস ইঙ্গিত করে যে এই প্রতিকৃতিগুলি আবক্ষ্য ছিল, আবার অন্যরা বলে যে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মুখোশও প্রদর্শিত হয়েছিল। মুখোশগুলি, সম্ভবত মৃত ব্যক্তির মুখ থেকে মোমের আদলে তৈরি, অভিজাত রোমান মারা যাওয়ার সময় শেষকৃত্যের মিছিলের অংশ ছিল। পেশাগত শোকার্তরা মৃত ব্যক্তির পূর্বপুরুষদের মুখোশ এবং রেগালিয়া পরতেন কারণ মৃতদেহ বাড়ি থেকে, রাস্তা দিয়ে এবং শেষ বিশ্রামস্থলে নিয়ে যাওয়া হত।[৪২]
বিশ্বকাপ (ইংরেজি: World cup) এক ধরনের বৈশ্বিকক্রীড়াপ্রতিযোগিতাবিশেষ। এতে সচরাচর বিভিন্ন দেশের জাতীয় দল বা ব্যক্তিগতভাবে কোন খেলোয়াড় সংশ্লিষ্ট দেশের প্রতিনিধিত্ব করে ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে শিরোপাজয় করে নিজ দেশের পরিচিতি বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে তুলে ধরে। বিশ্বকাপকে সচরাচর নির্দিষ্ট ক্রীড়া বা খেলার প্রধান প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিজয়ী দল বা ব্যক্তি ঐ খেলায় সর্বোচ্চ সম্মাননা ও ক্রীড়ায় সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত হন। তবে অলিম্পিকের ন্যায় কিছু কিছু খেলায় শিরোপালাভ করাও বিশ্বকাপের সমতুল্য।
বেশকিছু খেলা বিশ্ববাসীর কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। কিন্তু ফিফা বিশ্বকাপকেই সাধারণতঃ বিশ্বকাপ নামে ডাকা হয়।[১] ১৯৩০ সালে প্রথমবারের মতো এসোসিয়েশন ফুটবল প্রতিযোগিতার বৈশ্বিক অসম্ভব জনপ্রিয়তাই এর মূল কারণ।
বৈশিষ্ট্যাবলী
কিছু ক্রীড়া পরিচালনাকারী সংস্থা বিশ্বকাপের পরিবর্তে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপ বা এর সম্পর্কযুক্ত অন্যকোন ক্রীড়া পরিভাষা ব্যবহার করে। সংস্থাগুলো অনেক সময় বিশ্বকাপ এবং বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপ – উভয় ধরনের প্রতিযোগিতাই ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম-কানুন প্রয়োগপূর্বক আয়োজন করে থাকে। সংক্ষিপ্ত কিংবা দীর্ঘমেয়াদী সময়কালের উপযোগী করে বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে বয়সসীমা, উন্মুক্ত, লিঙ্গভেদ ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারে আয়োজন করা হয়। দলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত করা হয়। প্রায়শঃই নক-আউট প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বকাপের সমাপণ ঘটানো হয়। এক্ষেত্রে দলের সংখ্যা যখন দুইটি হয়, তখন পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচী অনুযায়ী বিশ্বকাপের চূড়ান্ত খেলা অনুষ্ঠিত হয়। খেলার বিজয়ীকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব হিসেবে সোনা কিংবা রূপায় মোড়ানো এবং তুলনামূলকভাবে বড় সুন্দর একটি ট্রফি প্রদান করা হয়। পাশাপাশি অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দেরকেও পদক প্রদান করা হয়। খুব কমক্ষেত্রেই উভয় দলকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়। বিজয়ী দল এ খেতাব পরবর্তী চার, দুই কিংবা এক বছরের জন্য প্রাপ্য হন। দলগত ক্রীড়ায় এর বহুল প্রয়োগ ঘটে। বিশ্বকাপ ফুটবলের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল বা আইসিসি’র নিয়ন্ত্রণাধীন বিশ্বকাপ ক্রিকেটের জনপ্রিয়তাও বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত।