Joseph Scaliger-এর De emendatione temporum (১৫৮৩) এর মাধ্যমে আধুনিক কালনিরূপণবিদ্যার যাত্রা শুরু হয়েছে।[
কালনিরূপণবিদ্যা (ইংরেজি ভাষায়: Chronology) বলতে সময়কে ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে বিভিন্ন ঘটনা যে সমায়ানুক্রমে ঘটেছে সেভাবে লিপিবদ্ধ করার পদ্ধতিকে বোঝায়। মানব সভ্যতার বিভিন্ন ঘটনার কালনিরূপণ করার প্রক্রিয়া বর্ষপঞ্জির সাথে নিবিঢ়ভাবে সম্পর্কিত।
(Agen) Portrait de Joseph Juste Scaliger – Musée du Louvre
বৈজ্ঞানিক কালনিরূপণবিদ্যা মহাবিশ্বের বিভিন্ন ঘটনা যে ক্রমে এবং যে সময়ে ঘটেছে তা আবিষ্কার করে পুরো ইতিহাসকে একটিমাত্র সময়ের স্কেলে সাজানোর চেষ্টা করে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর ব্যবহার দেখা যায়। যেমন, জ্যোতির্বিজ্ঞানে মহাজাগতিক ঘটনাগুলোকে হাজার বা লক্ষ লক্ষ বছরের স্কেলে বিচার করা হয়, ভূতত্ত্ব এবং জীবাশ্মবিজ্ঞানে পৃথিবী এবং প্রাণের উদ্ভব ও বিবর্তনের ইতিহাস তুলে ধরার জন্য কয়েক শত বা কয়েক হাজার বছরের স্কেল ব্যবহার করা হয়। ভূ-কালনিরূপণবিদ্যা একেবারে প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে এমনকি সভ্যতার ইতিহাস পর্যন্ত নেমে আসে, এটিও কয়েক হাজার বছরের স্কেলে কাজ করতে পারে। সব ধরনের কালনিরূপণবিদ্যার মধ্যে সবচেয়ে ছোট স্কেল ব্যবহার করা হয় মানব সভ্যতার বিভিন্ন ঘটনা লিপিবদধ করতে।
প্রাচীন কালের মানুষরা যে ধরনের ঐতিহাসিক কালনিরূপণবিদ্যায় অভ্যস্ত ছিল তা আধুনিক কালের নিখুঁত গবেষণায় অনেক সময়ই ভুল বিবেচিত হয়। কারণ তাদের প্রক্রিয়া সম্পর্কে অনেক সময় স্পষ্ট কিছু জানা যায় না এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের কালনিরূপণের পদ্ধতিটিই খুব ঘোলাটে। সেকালের সঠিক ইতিহাস তুলে আনতে তাই অনেক সময়ই জীবাশ্ম এবং প্রত্নতত্ত্ব ব্যবহার করা হয়।[২]
কারাল সভ্যতা বা কারাল-সুপে সভ্যতা এখনও পর্যন্ত জানা সবচেয়ে প্রাচীন আন্দীয় সভ্যতা। দক্ষিণ আমেরিকার সুপ্রাচীন এই সভ্যতা বহু ক্ষেত্রে নর্তে চিকো সভ্যতা নামেও পরিচিত।[পা ১] প্রথম নামটি এসেছে পেরুর সুপে উপত্যকায় অবস্থিত কারাল অঞ্চলের নাম থেকে। এইস্থানেই এই সভ্যতার সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ স্তূপটি আবিস্কৃত হয়েছে। তাছাড়া এই অঞ্চলটি, যতদূর বোঝা গেছে, এই সভ্যতায় একটি অত্যন্ত পবিত্র স্থান বলেও বিবেচিত হত।[২] অন্যদিকে পেরুর এই অঞ্চলকে কথ্য ভাষায় বর্তমানে নর্তে চিকো (স্পেনীয়, অর্থ উত্তরের ছোট্ট স্থান) বলা হয়। তার থেকেই এই দ্বিতীয় নামটির সৃষ্টি। খ্রিস্টজন্মের ৯০০০ বছর আগেই এই সভ্যতার সূচনা হয়।[৩] তবে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ – ১৮০০ অব্দকে এই সভ্যতার সবচেয়ে বেশি বিকাশের সময় বলে মনে করা হয়।[৪] উত্তর-মধ্য পেরুর সমুদ্র উপকূলে এই সভ্যতার অন্তত ৩০টি কেন্দ্র খুঁজে পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে কারাল, আসপেরো, উয়ারিকাঙ্গা, কাবালেত, প্রভৃতি স্থলে খননকার্যের মাধ্যমে এই সভ্যতার প্রচূর নিদর্শন খুঁজে পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে রয়েছে পাথরে তৈরি সম্ভাব্য বড় বড় মন্দিরের উঁচু প্ল্যাটফর্ম, বসবাসের জন্য তৈরি বাড়ির ধ্বংসস্তূপ, বেশ কিছু ঢিবি, প্ল্যাটফর্মের উপর খাওয়াদাওয়ার চিহ্ন, হাড়ের তৈরি বেশ কিছু বাঁশি, প্রভৃতি। তবে নব্যপ্রস্তর যুগের এই সভ্যতায় ধাতুর ব্যবহার জানা ছিল না। এমনকী মৃৎপাত্র তৈরি বা ব্যবহারের কোনও নিদর্শনও এখানে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য থেকে এখানে যথেষ্ট জটিল একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপের অস্তিত্ব পরিষ্কার বোঝা যায়। কালের বিচারে এই সভ্যতার সর্বোত্তম বিকাশের সময়টি ছিল পুরনো পৃথিবীর সুমের সভ্যতার থেকে হাজার বছর পরে, কিন্তু মিশরে যে সময়ে পিরামিডগুলি নির্মাণ হয়, তার সমসাময়িক। পশ্চিম গোলার্ধের অপর প্রাচীন সভ্যতা কেন্দ্র মেসোআমেরিকার থেকে এই সভ্যতা অন্তত ২০০০ বছর প্রাচীন।[৫][৬]
OLYMPUS DIGITAL CAMERA
পৃথকভাবে সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল, পৃথিবীর এমন ছটি কেন্দ্রের অন্যতম ও আমেরিকা মহাদেশের সবচেয়ে পুরনো নগরসভ্যতা এই কারাল সভ্যতার কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। সাধারণভাবে অত্যন্ত শুষ্ক এই অঞ্চলের বুক দিয়ে বয়ে গেছে সুউচ্চ আন্দিজ পর্বতমালা থেকে নেমে আসা প্রায় ৫০টি ছোট ছোট নদী। এদের ধার বরাবর প্রতিষ্ঠিত এই সভ্যতার কেন্দ্রগুলিরও মূল ভিত্তি ছিল কৃষি। কিন্তু তারা চাষ করতো কোনও খাদ্যদ্রব্য নয়, মূলত তুলো। সেই তুলো দিয়ে মাছ ধরার জাল তৈরি করে সরবরাহ করা হত সমুদ্রতীরে অবস্থিত এই সভ্যতার কেন্দ্রগুলিতে। এই কেন্দ্রগুলিতে সংগৃহীত মাছ ও সামুদ্রিক নানা খাদ্যদ্রব্যই ছিল এই সভ্যতার মানুষের মূল খাদ্যদ্রব্য। জালের সাথে মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক খাদ্যদ্রব্যের বিনিময়ই ছিল সেই অর্থে এই সভ্যতার ভিত্তি। অবশ্য সঙ্কীর্ণ নদী উপত্যকাগুলিতে কিছু ফল ও সব্জিচাষের নিদর্শনও পাওয়া যায়। এই ধরনের সভ্যতার অন্য কোনও প্রাচীন নিদর্শনের কথা এখনও পর্যন্ত জানা নেই।[৫]
আজ থেকে প্রায় ৩৮০০ বছর আগে ভূমিকম্প বা এল নিনো জাতীয় কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এই সভ্যতার পতন ঘটে বলে মনে করা হয়। অবশ্য অতি সাম্প্রতিক গবেষণায় এ’জন্য কৃষিব্যবস্থার প্রচলন ও এই অঞ্চলের অনুর্বর জমি ও কৃষির প্রতিকূল আবহাওয়াকেও যথেষ্ট পরিমাণে দায়ী করা হয়।[৭]
আবিষ্কার
পেরুর মানচিত্রে কারাল সভ্যতার তিনটি বড় বড় কেন্দ্র আসপেরো, কারাল ও এল পারাইসো’র অবস্থান সূচীত হয়েছে।
১৯০৫ সালেই পেরুর সমুদ্রতীরে ও কিছুটা অভ্যন্তরে সুপে উপত্যকায় এই সভ্যতার কিছু নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। সেই হিসেবে সমুদ্রতীরে আসপেরো ও সমুদ্র থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরে কারালে প্রাচীন এই সভ্যতার নিদর্শনের কথা ১৯৪০’এর আগেই প্রত্নতাত্ত্বিক মহলে যথেষ্ট সুপরিচিতই ছিল। কিন্তু সেই সময় এই নিদর্শনগুলির উপর তেমন কিছু গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি।[৮] সে’ সময় বিশেষ করে আসপেরোতে প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদদের মনে হয়েছিল নব্যপ্রস্তরযুগের এই মানুষরা এমনকী কৃষিকাজও জানতো না। ১৯৭৩ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদ মাইকেল ই. মোজলি’র নেতৃত্বে আসপেরোতে যে খননকার্য চলে তাতেও মোটের উপর এই মতই সমর্থিত হয়। কিন্তু ১৯৯০’এর দশকে পেরুভীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ রুথ শেডি সলিস‘এর নেতৃত্বে সুপে উপত্যকায় কারাল ও অন্যান্য স্থানে যে ব্যাপক খননকার্য চালানো হয়, ২০০১ সালে তা প্রবন্ধাকারে প্রকাশিত হলে এই সভ্যতার প্রাচীনত্ব, উন্নতি ও ব্যাপকতা সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের ধারণা জন্মায়।[৯] ফলে আন্দীয় সভ্যতার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে পূর্বের ধারণা অনেকটাই বদলে যায়। বোঝা যায় এই অঞ্চলে মানবসভ্যতা আরও অনেকটাই বেশি প্রাচীন। পূর্ববর্তী ধারণা অনুযায়ী যে চাভিন সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে এতদিন এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতার মর্যাদা দেওয়া হত, কারাল সভ্যতার আবিষ্কার প্রমাণ করে এই অঞ্চলে মানব সভ্যতার বয়স তার থেকে হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। রেডিওকার্বন পরীক্ষাতেও কারাল সভ্যতার এই প্রাচীনত্বর প্রমাণ মেলে।[৩] তাছাড়া দেখা যায় এর উদ্ভব আন্দিজ পর্বতের কোনও উঁচু অঞ্চলে নয়, বরং সমুদ্র উপকূলের অপেক্ষাকৃত নিচু উপত্যকা অঞ্চলে। এছাড়া প্রায় ২০০ কিলোমিটার উত্তরে কাসমা উপত্যকার সেচিন’এ বার্লিনের ফ্রাইয়ে (মুক্ত) বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদরা ১৯৯২ সাল থেকে যে খননকার্য চালিয়ে যাচ্ছেন, সেখানেও এই সভ্যতার যোগসূত্র পাওয়া গেছে।[১০] এর থেকে কারাল সভ্যতার ব্যাপ্তি সম্বন্ধে ধারণাও আজ আরও স্পষ্ট হয়েছে। এই সবকিছু মিলিয়ে কারাল সভ্যতার গুরুত্ব আজ ঐতিহাসিকদের কাছে অনস্বীকার্য।
ভৌগোলিক অবস্থান
পেরুর প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলের উত্তর-মধ্য অঞ্চলে নর্তে চিকো অঞ্চলের অবস্থান, রাজধানী লিমা থেকে ১৫০ – ২০০ কিলোমিটার উত্তরে। এর দক্ষিণে লুরিন উপত্যকা ও উত্তরে কাসমা অঞ্চল। চারটি উপকূলীয় উপত্যকা উয়াউরা, সুপে, পাতিভিলচা ও ফোর্তালেজা নিয়ে এই অঞ্চলটি গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে শেষের তিনটি উপত্যকা সমুদ্র উপকূল দিয়ে পরস্পর যুক্ত। কিন্তু এদের মিলিত আয়তন মাত্র ১৮০০ বর্গকিলোমিটার । অথচ এই স্বল্প জায়গাতেই কারাল সভ্যতার অনেকগুলি কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এর থেকে বিশেষজ্ঞরা এই সভ্যতার যথেষ্ট ঘন জনবিন্যাসের কথা আন্দাজ করে থাকেন।[১১]
পেরুর এই উপকূলীয়় অঞ্চল প্রচণ্ড শুষ্ক একটি অঞ্চল। পূর্বে আন্দিজ পর্বতমালার অবস্থান ও পশ্চিমে সমুদ্র অভিমুখী প্রশান্ত মহাসাগরীয় বাণিজ্যবায়ু প্রবাহের ফলে এই অঞ্চলে একটি সঙ্কীর্ণ বৃষ্টিচ্ছায়া অঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তাই এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত যথেষ্ট কম। মাটিও অনুর্বর। তার উপর এই সঙ্কীর্ণ উপকূলীয় উপত্যকা অঞ্চলের মধ্য দিয়ে পূর্বের সুউচ্চ আন্দিজ পর্বতমালা থেকে নেমে আসা বরফ গলা জলে পুষ্ট অন্তত ৫০টি ছোট ছোট নদী বয়ে গেছে। ফলে উপত্যকাটি জায়গায় জায়গায় পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। এইসব দিক বিবেচনা করে দেখলে পৃথিবীর অন্যত্র যেসব অঞ্চলে এইরকম সুপ্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তাদের সাথে এই অঞ্চলের মিল যথেষ্ট অল্পই।[১২] তবু এই সব নদী থেকেই ছোট ছোট খাল কেটে এখানে সেচের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। এই অঞ্চলে মানুষের হাতে তৈরি যেসব স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষ এখনও দেখতে পাওয়া যায় ; দেখা যায় সেগুলিও বেশির ভাগই এইসব সেচখালের আশেপাশেই নির্মিত। এর থেকে বোঝা যায় এইসব ছোট ছোট নদী ও খালগুলি কারাল সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশের ক্ষেত্রে একরকম প্রাণভোমরার কাজ করেছিল।[১৩]
ঐতিহাসিক গুরুত্ব
কারালের একটি পিরামিড, কাছ থেকে
রেডিওকার্বন পরীক্ষার দ্বারা জানা গেছে, এই সভ্যতার বেশ কিছু নিদর্শনই (পরীক্ষার জন্য গৃহীত ৯৫টি নিদর্শনের মধ্যে অন্তত ১০টি) এমনকী ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের অর্থাৎ আজ থেকে ৫৫০০ বছরের চেয়েও প্রাচীন। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরনোটি ৯২৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। তবে তা থেকে শুধু নব্যপ্রস্তরযুগের মানুষের বসতির কিছু ইঙ্গিতের চেয়ে বেশি কিছু খুব বোঝা যায় না। কিন্তু যে দুটি ক্ষেত্রে নিদর্শনগুলির বয়স নির্ধারিত হয়েছে ৩৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, সেগুলি থেকে সামাজিক স্থাপত্যের কিছু ইঙ্গিত মেলে। তবে ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ সময় থেকে সামাজিকভাবে নির্মিত ও ব্যবহৃত মানুষের হাতে তৈরি স্থাপত্যর পরিমাণ যথেষ্ট পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায়। এর থেকে চার্লস মান প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদেরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে হয়তো ৩৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্বেই, না হলেও ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগেই নিশ্চিতভাবে এখানে সভ্যতার উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটেছিল।[১২] ফোর্তালেজা উপত্যকার উয়ারিকাঙ্গায় প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য বসতিটির বয়স জোনাথন হাস প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদরা ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নির্ধারণ করায় এখন সাধারণভাবে ওই সময়কেই কারাল সভ্যতার উন্মেষের নির্দিষ্ট সময় হিসেবে ধরা হয়।
উঁচু প্ল্যাটফর্ম বা বেদী, কারাল
রেডিওকার্বন পরীক্ষা থেকে আরও জানা গেছে, প্রথম দিকে এই সভ্যতার সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলগুলি ও দেশের অভ্যন্তরের অঞ্চলগুলি সমান্তরালেই বিকাশলাভ করছিল। কিন্তু ২৫০০ – ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ সময়কালে, এই সভ্যতার সবচেয়ে ব্যাপ্তির সময়ে, দেশের অভ্যন্তরের বিভিন্ন কেন্দ্রগুলিরই বেশি উন্নতি ঘটতে দেখা যায়। এই কেন্দ্রগুলির এই সময় জনসংখ্যা বৃদ্ধিরও যথেষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কারাল, প্রভৃতি দেশাভ্যন্তরের কেন্দ্রগুলির এইসময়েই উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। তবে উপকূলীয় অঞ্চলের উপর মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক খাদ্যের উপর এরা তখনও যথেষ্টই নির্ভরশীল ছিল।[৩] এর একটি সম্ভাব্য কারণ হয়তো এই অঞ্চলের উপকূল অংশে প্রায়শই এল নিনোজনিত সুদীর্ঘকালীন তীব্র খরার প্রাবল্য, আবার কখনও বা হঠাৎ হঠাৎ সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছাস; এর ফলেই হয়তো অধিবাসীরা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পরবর্তীকালে কিছুটা দেশের অভ্যন্তরে একটু উঁচু জায়গায় বসতিস্থাপন করে। কিন্তু খাদ্যের জন্য তাদের সমুদ্র নির্ভরতা থেকে যাওয়ায় সমুদ্র থেকে খুব দূরে তারা সরে যায়নি।
১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ এই সভ্যতার কেন্দ্রগুলি পরিত্যক্ত হয়। এর সঠিক কারণ এখনও জানা যায়নি। একদল মনে করেন, ভূমিকম্প, এল নিনো বা এই জাতীয় কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই এর কারণ। আবার অপর দলের মতে উপকূল অঞ্চল বরাবর উত্তরে ও দক্ষিণে ও পূর্বে আন্দিজ পর্বতের উচ্চভূমিতে এইসময় আরও কতগুলি শক্তিশালী কেন্দ্রের উত্থান লক্ষ্য করা যায়। এইসব অঞ্চলে, বিশেষ করে উত্তরে নানা খালের চিহ্ন দেখে বুঝতে পারা যায়, সেচনির্ভর কৃষিব্যবস্থা সেখানে গড়ে উঠেছিল। ফলে কারাল সভ্যতার মানুষ হয়তো বেশি খাদ্য নিরাপত্তাজনিত কারণেই এইসময় তাদের পুরনো অঞ্চল ছেড়ে আরও উর্বর অঞ্চলের দিকে সরে যায়, আর সঙ্গে নিয়ে যায় তাদের এতদিনের সঞ্চিত সেচনির্ভর কৃষিব্যবস্থার জ্ঞান।[৭]
খাদ্যাভ্যাস
কারাল সভ্যতার মানুষের খাদ্যাভ্যাস সম্বন্ধে যা সুনির্দিষ্টরূপে জানতে পারা গেছে, তা নিম্নরূপ –
রুথ শেডি সলিস কারালে খননকার্য পরিচালনার সময় খননস্থল থেকে সেইসময়ে ব্যবহৃত কিছু কিছু শস্য ও ফল উৎপাদনকারী ও কন্দজাতীয় উদ্ভিদের অস্তিত্বর প্রমাণ পান। এগুলি হল স্কোয়াশ, কয়েকরকমের বিনস, পেয়ারা, লুকুমা, মিষ্টি আলু, প্রভৃতি।[১৪] পরবর্তীকালে জোনাথন হাস প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদরা আরও উত্তরে কিছু খননস্থলেও এই উদ্ভিদগুলির খোঁজ পান। তার সঙ্গে তারা আভোকাডো, আচিরা, প্রভৃতি আরও কিছু উদ্ভিদের ব্যবহারেরও প্রমাণ পান। বর্তমানে এই সভ্যতার বিভিন্ন খননস্থলগুলি থেকে সে’ সময় মেইজেরও যে প্রচলন ছিল, তা নিশ্চিতভাবেই জানতে পারা গেছে।[১৫]
কিন্তু সামুদ্রিক বা সমুদ্রজাত খাদ্যের আধিক্য এই সভ্যতার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। সমুদ্রোপকূল ও দেশাভ্যন্তর – সর্বত্রই এই ধরনের খাদ্য ব্যবহারের যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। কারালে খননকার্য চলাকালীন রুথ শেডি সলিস লক্ষ্য করেন “অসংখ্য প্রাণীজ ভুক্তাবশেষ, যার প্রায় পুরোটাই সামুদ্রিক”। এর মধ্যে শামুক বা ঝিনুকের খোল থেকে শুরু করে অ্যাঙ্কোভি, সার্ডিন, প্রভৃতি মাছের কাঁটা ও হাড়, প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।[১৪] বিশেষ করে অ্যাঙ্কোভি মাছের অবশেষ থেকে পরিষ্কার যে এই মাছ দেশাভ্যন্তরেও খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হত।[১২] এর থেকে সাধারণভাবে মনে করা হয়, এই সভ্যতার মানুষ খাদ্যের জন্য মূলত সমুদ্রজাত বিভিন্ন খাদ্যের উপরই নির্ভর করতো। অবশ্য জোনাথন হাস প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদ সমুদ্রজাত খাদ্যনির্ভরতার এই তত্ত্বের সাথে সাহমত্য প্রকাশ করেননি।[১১]
১৯৯০’এর দশকের অনুসন্ধানের ফলে কারাল সভ্যতার ব্যাপ্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগেই আসপেরো, প্রভৃতি সমুদ্রোপকূলের প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চলগুলিতে অনুসন্ধানের ফলে মাইকেল এডওয়ার্ড মোজলি প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এই সভ্যতার মূল ভিত্তি ছিল সমুদ্রজাত খাদ্য। শস্যজাতীয় খাদ্য সিদ্ধ করার উপযোগী কোনওরকম মৃৎপাত্রের অনুপস্থিতি তাদের এই সিদ্ধান্তকেই আরও জোরদার করে। খনন অঞ্চলে উঁচু প্ল্যাটফর্মের উপর পাওয়া ছোট ছোট ঢিবি বা স্তূপ থেকে তারা আন্দাজ করেন এগুলি আসলে প্রাণীজ খাদ্য প্রক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত উনুনজাতীয় বস্তুরই অবশেষ মাত্র।[৮]
দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থলে উল্লিখিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রত্নতত্ত্ববিদদের মধ্যে ‘আন্দীয় সভ্যতার সমুদ্রনির্ভরতা‘র তত্ত্ব[১৬][১৭] বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আবার তা তাদের মধ্যে তীব্র বিতর্কেরও জন্ম দেয়। কারণ সাধারণভাবে দেখা গেছে, কোনও জায়গায় সভ্যতার উত্থানের পিছনে সেখানকার মানুষের কৃষিনির্ভরতা, বিশেষ করে অন্তত একটি শস্যের ব্যাপক চাষের ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। কারণ উদ্বৃত্ত খাদ্য ব্যতীত জনঘনত্ব বৃদ্ধি ও কিছু সংখ্যক মানুষের সরাসরি খাদ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়ার বাইরে থাকার সুযোগ তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। ফলে অপেক্ষাকৃত জটিল সমাজব্যবস্থার উদ্ভবের জন্য অন্তত একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত কৃষির উন্নতি খুবই প্রয়োজন। এই কারণেই ‘আন্দীয় সভ্যতার সমুদ্রনির্ভরতা’র তত্ত্ব ঐতিহাসিকদের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদের জন্ম দেয়। তবে চার্লস মান প্রমুখ বিশেষজ্ঞ এই তত্ত্বর সত্যতার সম্ভাবনার পক্ষেই মতপ্রকাশ করেছেন।[১২]
উপকূল ও দেশাভ্যন্তর
এই সভ্যতার খাদ্যাভ্যাস সংক্রান্ত বিতর্কের সাথে সাথেই প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে আরেকটি বিতর্কও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে – উপকূল না দেশাভ্যন্তর, এই সভ্যতার মূল কেন্দ্র ছিল কোথায়? মোজলি প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদদের প্রস্তাবিত আন্দীয় সভ্যতার সমুদ্রনির্ভরতার তত্ত্ব অনুসারে এই সভ্যতার মূল কেন্দ্র হওয়া উচিত ছিল সবসময়েই সমুদ্রোপকূলবর্তী অঞ্চল। কিন্তু বিশেষ করে ৯০’এর দশকে কারাল অঞ্চলে ব্যাপক খননকার্য ও বিরাট একটি শহরের আবিষ্কার এই তত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয়। সমুদ্র থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরের এই শহরটি শুধুমাত্র পেরুর নয়, সমগ্র আমেরিকা মহাদেশের মধ্যেই প্রাচীনতম।[৯] এর উপর ভিত্তি করেই ঐতিহাসিকরা এই অঞ্চলের সম্ভাব্য কৃষিজ উৎপাদনের উপর জোর আরোপ করা শুরু করেন ও তার সাক্ষপ্রমাণ খুঁজে বের করার তাগিদও তাদের মধ্যে জোরদার হয়ে ওঠে। তবে রেডিওকার্বন পরীক্ষায় দেখা যায় আসপেরো প্রভৃতি সমুদ্রোপকূলবর্তী কিছু কিছু অঞ্চল তুলনায় প্রাচীনতর।[১২] এর থেকে অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদই মতপ্রকাশ করেন যে এই সভ্যতার সূচনা প্রথমে সমুদ্রোপকূলবর্তী অঞ্চলে হয়ে থাকলেও পরে তা ধীরে ধীরে দেশাভ্যন্তরে সরে আসে। অর্থাৎ, পরের দিকে কৃষিব্যবস্থার কিছু প্রসার ঘটলেও অন্তত এই সভ্যতা গড়ে ওঠার সময়ে সমুদ্রজাত খাদ্যনির্ভরতাই ছিল প্রধান।[১৮] ফলে নতুন করে বিতর্ক চাগিয়ে ওঠে, ভিতরের বড় বড় কেন্দ্রগুলি উপকূলের কেন্দ্রগুলির উপর নির্ভরশীল ছিল, না উপকূলীয় ছোট ছোট গ্রামগুলিই আসলে ছিল অভ্যন্তরের বড় বড় কেন্দ্রগুলির নিছক বাইরের দিকের উপগ্রহমাত্র।[১৩]
তুলো
তবে একটা বিষয় সম্বন্ধে আজ ঐতিহাসিকরা অনেকটাই নিশ্চিত। শুরুতে যদি নাও হয়, পরে অন্তত উপকূলীয় অঞ্চলগুলির চেয়ে এই সভ্যতার ভরকেন্দ্র স্থলভাগের অভ্যন্তরের কেন্দ্রগুলিতেই স্থানান্তরিত হয়। এর এক প্রধান কারণ ছিল তুলো (Gossypium barbadense; গসিপিয়াম বারবাডেন্স প্রজাতির)।[১১][১২] তুলো যদিও খাওয়া যায় না, কিন্তু এর থেকে তৈরি সুতো দিয়ে প্রস্তুত জাল ছাড়া সমুদ্রজাত খাদ্য সংগ্রহ ও মাছ ধরা অসম্ভব। তারউপর নানা ধরনের কাপড়, পোশাক ও থলি তৈরিতেও তুলো অপরিহার্য। এছাড়া একধরনের লম্বা ঘাস দিয়েও শক্ত থলি তৈরি হত, বিভিন্ন নির্মাণের ক্ষেত্রে পাথর বওয়ার কাজে যা ব্যবহৃত হত। কারাল অঞ্চলের খননকার্যে এইধরনের তৃণনির্মিত থলির নিদর্শন পাওয়া গেছে।[১৯] অর্থাৎ, দেশাভ্যন্তরের বিভিন্ন কেন্দ্রগুলির মূল ভিত্তি ছিল এই তুলো ও ঘাসের চাষ ও তার থেকে নানাধরনের প্রয়োজনীয় জাল, কাপড়, থলি, প্রভৃতির উৎপাদন বজায় রাখা। অন্যদিকে উপকূলীয় কেন্দ্রগুলির মূল উৎপাদন ছিল মাছ ও সমুদ্রজাত খাদ্য, যার উপর স্থলাভ্যন্তরের কেন্দ্রগুলিও নির্ভরশীল ছিল। বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণের উপর নির্ভর করেই বর্তমানে উপকূল ও দেশাভ্যন্তরের কেন্দ্রগুলির এই পারস্পরিক নির্ভরতার তত্ত্বই জোরদার হয়ে উঠেছে।
সমাজ ও রাজনীতি
যেহেতু এই সুপ্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কিত প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ ব্যতীত আর কোনও ঐতিহাসিক উপাদানই আমাদের হাতে এসে পৌঁছয়নি, তাই কারাল সভ্যতার মানুষের সমাজ, সামাজিক সংগঠন, রাজনীতি, প্রশাসন, ধর্মাচরণ, অর্থনীতি, প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমাদের জ্ঞান স্বভাবতই সীমিত। প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলিকে যথাসম্ভব বিশ্লেষণ করে এইসব ক্ষেত্রে প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকরা যতটুকু তথ্য আহরণ করতে এখনও পর্যন্ত সক্ষম হয়েছে তা নিয়ে নিচে আলোচনা করা হল।
এখন প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে মূলত তিন ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে পরোক্ষে মানব পরিচালিত প্রশাসনের উদ্ভবের আন্দাজ করা হয়ে থাকে। এগুলি হল –
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রমাণ
ধর্মীয় আচার ও রীতিনীতি পালনের প্রমাণ
প্রশাসনিক বাহুবলের প্রত্যক্ষ উপস্থিতির প্রমাণ
জোনাথন হাস প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদ কারাল সভ্যতায় এগুলির অন্তত দুটির যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করেন। সেইদিক দিয়ে এই সভ্যতাকে প্রাচীন পৃথিবীর সুপ্রাচীন দুই সভ্যতা (অন্যটি হল সুমের), যেখানে সম্পূর্ণ নিজস্ব ঘরানায় স্বতন্ত্রভাবে প্রশাসনের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে, তাদের অন্যতম বলে মেনে নিতে হয়। অবশ্য সমস্ত প্রত্নতত্ত্ববিদদের পক্ষে এই বিষয়ে এখনও ঐকমত্য্য গড়ে ওঠেনি।[১২]
প্রশাসন
চার্লস মান প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদ মতপ্রকাশ করেছেন যে কারাল সভ্যতার প্রশাসন ছিল মূলত ধর্মভিত্তিক। সেখানে বিভিন্ন নির্মাণস্থল ও প্ল্যাটফর্মগুলিতে নিয়মিত ভোজসভার ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া গেছে, যেখানে গানবাজনা ও সম্ভবত সুরার প্রচলনও ছিল[পা ২]; এর থেকে আন্দাজ করা যায় সমাজে ইতোমধ্যেই এমনধরনের একটি অভিজাত নাগরিক সমাজ গড়ে উঠেছিল, যারা নিত্যপ্রয়োজনীয় দৈনন্দিকতার বাইরে গিয়েও কোনও উৎসব উপলক্ষে কোথাও জড়ো হতে পারত এবং সেই উৎসবে কিছুটা প্রাচূর্যর চর্চাও দেখা যেত। অর্থাৎ সমাজে উৎপাদনশীলতা ইতোমধ্যেই সেই প্রাচূর্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল।[১২] স্বভাবতই আন্দাজ করা যায়, এই প্রাচূর্যটুকু মূলত সমাজের সুবিধেভোগী ও ক্ষমতাবান অংশই ভোগ করতে সক্ষম ছিল। এর থেকে সমাজে একধরনের কর্তৃত্বর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। এই কর্তৃত্বর আরও ইঙ্গিত পাওয়া যায়, বিভিন্ন বড় বড় নির্মাণগুলিকে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করলে। এগুলির মধ্যে কতগুলি হল বিরাট, তৈরি হয়েছিল ধীরে ধীরে, দীর্ঘদিন ধরে; আবার কতগুলি, যেমন কারালে পাওয়া বিশাল প্ল্যাটফর্মগুলি, তৈরি হয়েছিল এক কি দুই দফায়।[১৪] কিন্তু এই উভয় ক্ষেত্রেই এই ধরনের নির্দিষ্ট ও বিপুল কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য দরকার প্রচূর শ্রমিকের এবং নির্দিষ্ট পরিকল্পনাভিত্তিক সংগঠনের। তাছাড়া অল্পসময়ের মধ্যে কোনও নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে নির্দিষ্টরূপের বিপুল নির্মাণকার্য কখনওই সম্ভব নয়, আবার দীর্ঘকাল ধরে একটি নির্দিষ্ট নির্মাণকার্য পরিচালনাও একরকম অসম্ভব। অর্থাৎ এই সব বৃহৎ পিরামিড, সৌধের ভগ্নাবশেষ, স্তূপ ও প্ল্যাটফর্মগুলির অস্তিত্বই জানান দেয় কারাল সভ্যতায় একধরনের শক্তিশালী কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের বিকাশ ঘটেছিল, যদিও সেখানে প্রশাসনিক কেন্দ্রিকতার কতটা বিকাশ ঘটেছিল তা বলা সম্ভব নয়। এছাড়াও উপাকা ও পাতিভিলচা খননস্থলদুটিতে কিছু গুদামজাতীয় নির্মাণের নিদর্শন খুঁজে পাওয়া গেছে, যেগুলিতে সম্ভবত তুলো বা এইধরনের সে’সময়ের মূল্যবান সামগ্রী সঞ্চিত করে রাখা হত। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে এও কারাল-সুপে সমাজে শক্তিশালী কর্তৃপক্ষের উপস্থিতির এক অকাট্য প্রমাণ।[১২]
অর্থনীতি
হাস, ক্রিমার, প্রমুখ বিশেষজ্ঞের মতে কারাল সভ্যতার অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল তুলো ও অন্যান্য খাদ্য উৎপাদনকারী উদ্ভিদের চাষ ও তা থেকে উৎপন্ন ফসলের উপর নিয়ন্ত্রণ এবং এগুলি নিয়ে বাণিজ্যের ক্রমবিস্তার। স্বভাবতই এইভাবে বিকশিত ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল এই সভ্যতার দেশাভ্যন্তরের বিভিন্ন কেন্দ্রগুলি। হাস বলেছেন, কারাল-সুপে সভ্যতার সমুদ্রতীরবর্তী বড় কেন্দ্র হিসেবে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে মাত্র দুটি প্রত্নস্থলকে – আসপেরো ও বান্দুরিয়া। এছাড়া আরও দুটি কেন্দ্রকেও হয়তো একই মর্যাদা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু তুলো থেকে তৈরি মাছ ধরার জাল ও খাদ্য উৎপাদনকারী উদ্ভিদের চিহ্ন পেরুভীয় উপকূল রেখা ধরে উত্তরে ও দক্ষিণে বিস্তৃত এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া গেছে। এর থেকে বোঝাই যায় এগুলিকে ভিত্তি করে একটি বড় ধরনের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড চলত। হয়তো বা দেশাভ্যন্তরের বড় বড় কেন্দ্রগুলিই এই বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্র ছিল।[১১]
অন্যদিকে রুথ শেডি সলিসের লাগাতার গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে কারালকে কেন্দ্র করে কারাল ও আসপেরোতে উৎপাদিত বস্তু পণ্য হিসেবে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রফতানি করা হত ও বিনিময়ে বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী আমদানিও করা হত। এগুলির মধ্যে আমাজন অঞ্চল থেকে আনা ধোঁয়াহীন ঝিমুনি তামাক, ইকুয়েডরের সমুদ্রোপকূল থেকে আনা স্পন্ডাইলাস জাতীয় ঝিনুকের খোল, আন্দিজের উচ্চভূমি থেকে আনা উন্নত ধরনের রঙ, প্রভৃতি ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[২০] শেডির কাজ থেকে আরও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, মহাদেশের আরও অভ্যন্তরে জঙ্গল এলাকার অধিবাসী, এমনকী উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের সাথেও কারালের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল।[২১] অবশ্য এই বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলার মতো প্রমাণ এখনও হাতে আসেনি।
ধর্ম ও নেতৃত্ব
প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে যেটুকু আন্দাজ করা যায়, তা হল কারাল সভ্যতায় ধর্মর স্থান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসনিক ব্যবস্থার ভিত্তিও ছিল অনেকাংশেই ধর্মই। এই সভ্যতার নেতৃত্ব ছিল সম্ভবত পুরোহিতদের হাতেই। দেবতা ও অতিপ্রাকৃত শক্তির সাথে তাদের যোগাযোগের আপাত ক্ষমতাই ছিল তাদের প্রতিপত্তির মূল।[১১] তবে স্বভাবতই কারাল সভ্যতায় প্রচলিত ধর্ম সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এখনও পর্যন্ত খুবই সীমিত। খ্রিস্টপূর্ব ২২৫০ – ২৫০০ অব্দ নাগাদ সময়ের একটি প্রাচীন লাউ’এর খোল শুধু পাওয়া গেছে[২২], যাতে দুই হাতে দণ্ডধারী এক মূর্তি অঙ্কিত আছে; এই ধরনের দণ্ডধারী দেবমূর্তি কাছাকাছি অঞ্চলের পরবর্তী বিভিন্ন আন্দীয় সভ্যতাতেও দেখতে পাওয়া যায়; তার থেকেই প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, কারাল সভ্যতাতেও এই দেবতা পূজিত হত। উইনিফ্রেড ক্রিমার দাবি করেন, এই মূর্তি যে সত্যিই ঐ সভ্যতায় পূজিত দেবমূর্তি, তার নানা লক্ষণ পরিস্ফূট।
পাদটীকা
এই দুই নাম নিয়ে বিতর্ক আছে। ৯০’এর দশকে যাঁর নেতৃত্বে এই সভ্যতার উপর সবচেয়ে বেশি কাজ হয় সেই পেরুভীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ ডঃ রুথ শেডি সলিস এই সভ্যতাকে কারাল সভ্যতা বলে অভিহিত করেন। অন্যদিকে এই কাজে তাঁর সহযোগী মার্কিন প্রত্নতত্ত্ববিদ জোনাথন হাস ও উইনিফ্রেড ক্রিমার এই সভ্যতাকে নর্তে চিকো সভ্যতা বলে অভিহিত করেন। যেহেতু দ্বিতীয়দলের মতামত নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে,[১] এখানে সাধারণভাবে এই সভ্যতাকে কারাল সভ্যতা বলেই উল্লেখ করা হচ্ছে।
কারালে খননকার্য চালাতে গিয়ে ঐ প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন অঞ্চল থেকে রুথ শেডি সলিসের দল হাড়নির্মিত ৩২টি বাঁশির একটি সম্পূর্ণ সেট উদ্ধার করে। এর থেকে বোঝা যায় সমাজে গানবাজনার যথেষ্ট চলই ছিল এবং এই প্ল্যাটফর্মগুলি কিছুটা উৎসবস্থল হিসেবেও ব্যবহৃত হত। এছাড়া ওই একই অঞ্চলে ৩৭টি শিঙা জাতীয় বস্তুও খুঁজে পাওয়া গেছে। এর থেকে সুরাপানের বিষয়টিরও কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়।[২০][২১]
উত্তর হিসপানিয়া বা নিকট হিসপানিয়া (লাতিন ভাষা – Hispania Citerior; স্পেনীয় ভাষা – Hispania Cercana, উচ্চারণ – ইসপানিয়া থেরকানা) বর্তমান স্পেনের উত্তরপূর্ব অঞ্চলে ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী একটি রোমান প্রদেশ। দ্বিতীয় পুনিক যুদ্ধেকার্থেজীয়দের কাছ থেকে ইবেরীয় উপদ্বীপের কর্তৃত্ব রোমান প্রজাতন্ত্রের হাতে আসার পর খ্রিস্টপূর্ব ১৯৭ অব্দে রোমানরা পিরেনিজ পর্বতের দক্ষিণে উপদ্বীপের তাদের নিজেদের কর্তৃত্বাধীন অঞ্চলকে প্রশাসনিকভাবে দু’টি প্রদেশে ভাগ করে। এর মধ্যে উত্তরের, অর্থাৎ রোম থেকে অপেক্ষাকৃত নিকট প্রদেশটির নাম দেওয়া হয় “নিকট হিসপানিয়া” বা “উত্তর হিসপানিয়া”। এই প্রদেশটি উত্তরে পিরেনিজ থেকে উপদ্বীপের পূর্ব উপকূল ধরে বর্তমান স্পেনের উপকূলীয় শহর কার্তাখেনা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।[১][২]
এই প্রদেশের প্রশাসনিক কেন্দ্র নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কিছু বিতর্ক আছে। আগে মনে করা হত এই প্রদেশের প্রধানদপ্তর প্রথমে কার্তাখেনা নোভা (বর্তমান কার্তাখেনা) থেকে পরিচালিত হলেও পরে সিজার অগাস্টাসের সময়ে তা তারাকো শহরে (বর্তমান তারাগোনা) স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু এখন মনে করা হয়, প্রথম থেকেই প্রশাসনিক দপ্তর হিসেবে কার্তাখেনার পাশাপাশি তারাকোকেও ব্যবহার করা হত।[৩] রোমান ভৌগোলিক স্ট্রাবোর লেখাও এর সাক্ষ্য বহন করে। [৪] পরবর্তীকালে প্রজাতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটলে সিজার অগাস্টাসের সময় উত্তর হিসপানিয়াও একটি রাজতান্ত্রিক প্রদেশে রূপান্তরিত হয়। এইসময় তারাকো থেকেই এর প্রশাসন পরিচালিত হওয়ায় একে হিসপানিয়া তারাকোনেনসিস নামেও অভিহিত করা হতে থাকে। তবে সরকারিভাবে তখনও পর্যন্ত হিসপানিয়া থিতেরিওর বা নিকট হিসপানিয়া নামটিই বজায় ছিল।[৫] এই প্রদেশের অন্যান্য শহরের মধ্যে সাগুন্তুম (বর্তমান নাম সাগুন্তো, ভ্যালেন্সিয়া শহরের উত্তরে অবস্থিত) ও ইয়েরদা (বর্তমান ইয়েইদা) উল্লেখযোগ্য।
হিসপানিয়া থিতেরিওরের রোমান প্রশাসন এই প্রদেশের পশ্চিমে বসবাসকারী থেলতিবেরীয়দের সাথে বারেবারে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এর ফলে পশ্চিমের বিভিন্ন অঞ্চলেও রোমের কর্তৃত্ব ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে। সম্রাট অগাস্টাস খ্রিস্টপূর্ব ২৭ অব্দে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হলে রোমের অধীন বিভিন্ন প্রদেশগুলিকে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়। এইসময়ে হিসপানিয়া থিতেরিওরের সাথে আরও বেশ কিছু অঞ্চল যুক্ত করা হয় এবং সেই বৃহত্তর প্রদেশটিকে সাধারণভাবে হিসপানিয়া তারাকোনেনসিস নামে অভিহিত করা শুরু হয়। খ্রিস্টপূর্ব ২৯ – ১৯ অব্দে কান্তাব্রীয় যুদ্ধে[৬] রোমানদের জয়ের ফলে প্রায় সমগ্র ইবেরীয় উপদ্বীপ রোমানদের অধীন হয়ে পড়লে হিসপানিয়া তারাকোনেনসিসের আয়তন প্রভুত পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। হিসপানিয়া থিতেরিওর নামটি এইসময় থেকেই অপ্রচলিত হয়ে পড়ে।
আবিস্কারের যুগ, বা অনুসন্ধানের যুগ (আনুমানিক ১৫শ শতাব্দীর শুরু থেকে সপ্তাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি), বলতে সেই সময়কে বুঝায় যার মাধ্যমে ইউরোপীয় সংস্কৃতি ব্যাপক সমুদ্র অভিযানের মাধ্যমে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে যায় এবং বিশ্বায়নের সূচনা করে। এটি সেই সময়কেও নির্দেশ করে যখন ইউরোপে উপনিবেশবাদ এবং বাণিজ্যবাদের ব্যাপক উত্থান ঘটে এবং বিভিন্ন দেশের জাতীয় নীতি হিসবে গৃহীত হয়। এসময় ইউরোপীয়দের কাছে অজানা অনেক নতুন নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কার হয় যেখানে আগে থেকেই জনবসতির অস্তিত্ব ছিল। আর অইউরোপীয়দের কাছে এটা ছিল অজানা কোনো মহাদেশ থেকে আক্রমণকারীদের আগমনের শামিল।
অনুসন্ধানের ধারা শুরু হয় পর্তুগিজদের ১৪১৯ এবং ১৪২৭ সালে আটলান্টিক মহাসাগরের ম্যাদিরা ও আজোরো দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কার, ১৪৩৪ সালে আফ্রিকার উপকূল, ১৪৯৮ সালে ভারত আগমনের সমুদ্রপথ আবিষ্কার, স্পেনের রাজার সহয়তায় ১৪৯২ সাল থেকে ১৫০২ সাল পর্যন্ত ক্রিস্টফার কলম্বাসের আমেরিকা অভিযানের এবং মেগানলেসের ১৫১৯-১৫২২ সালের মধ্যে প্রথম পুরো পৃথিবী পরিভ্রমণের মাধ্যমে। এই সব আবিষ্কারগুলো আটলান্টিক,ভারত,প্রশান্ত মহাসাগরগুলোতে সমুদ্র অভিযান এবং আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা ও অস্টেলিয়াতে স্থল অভিযানের দিকে ধাবিত করে, যা ১৯শ শতাব্দী পর্যন্ত বজায় ছিল এবং শেষ হয় বিংশ শতাব্দীর মেরু অঞ্চল অনুসন্ধানের মাধ্যমে।
ইউরোপিয়ানদের এরকম অভিযানের মাধ্যমে বিশ্ব বাণিজ্যের এবং প্রাচীন বিশ্ব (ইউরোপ,এশিয়া,আফ্রিকা) ও নতুন বিশ্ব (আমেরিকা ও অস্টেলিয়া) এর সংযোগের মাধ্যমে উপনিবেশ সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে। পাশাপাশি কলম্বিয়ান বিনিময়ের মাধ্যমে বৃক্ষ, পশু, খাদ্য, মানব জনসংখ্যা ( দাসসহ),সংক্রামক রোগ জীবাণু এবং সংস্কৃতি পূর্ব গোলার্ধ এবং পশ্চিম গোলার্ধের মাঝে বিনিময় ঘটে।
বৈশ্বিক বাস্তুসংস্থান, কৃষি ও সংস্কৃতিতে বিশ্বায়নের এই ঘটনা সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ। কারণ আবিষ্কারের যুগ এবং ইউরোপিয়ানদের অভিযানের পরেই পৃথিবীর বৈশ্বিক মানচিত্র তৈরি, নতুন বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি এবং দূরবর্তী সভ্যতার কাছে আসার সুযোগ হয়। কিন্তু পাশাপাশি ইউরোশিয়া ও আফ্রিকায় নতুন রোগের আগমন ঘটে যা আগে ছিল না, এর সাথে ইউরোপ কর্তৃক স্থানীয়দের দাস বানানো, শোষণ করা, তাদের উপর আধিপাত্য বিস্তার করা হয় এবং উপনিবেশ স্থাপন করে। আর এর মাধ্যমে খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা খ্রিস্ট ধর্ম পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পরে।[১][২]
পর্যালোচনা
প্রধান যাত্রাসমূহের মানচিত্র। নিচে বিস্তারিত দেখুন
যুবরাজ হেনরির সহায়তায় পর্তুগিজরা প্রথম ১৪১৮ সাল থেকে আফ্রিকার আটলান্টিক উপকূলীয় এলাকা অনুসন্ধান শুরু করে। তারা কারভাল নামে নতুন হালকা জাহাজ তৈরি করে যা আরো বেশি পাল্লার এবং দ্রুত,[৩] পাশাপাশি এটা ছিলো খুব অল্প ও খুব বেশি বাতাসেও চলার উপযোগী ছিলো। ১৪৮৮ সালে বার্টোমুলো দিয়াজ এই পথে ভারত মহাসাগরে পৌঁছে
আন্দীয় সভ্যতার সমুদ্রনির্ভরতা বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা একটি বিতর্কিত তত্ত্ব। এই তত্ত্বর মূল উপজীব্য বিষয় হল, দক্ষিণ আমেরিকারপেরুতে সুউচ্চ আন্দিজ পর্বতমালার পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল বরাবর যে সুপ্রাচীন সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে, সেই সভ্যতার ভিত্তি পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে গড়ে ওঠা সেই সময়ের অন্যান্য সুপ্রাচীন সভ্যতার মতো কৃষি ছিল না; বরং খাদ্যের জন্য এই সুপ্রাচীন সভ্যতার মানুষ মূলত সমুদ্রজাত নানা খাদ্যর উপর নির্ভর করতো।
মধ্য পেরুর সমুদ্রোপকূলবর্তী বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক খননস্থলে বিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন সময়ে ব্যাপক খননকার্য চালানো হয়। এর মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিল ১৯৭০’এর দশকে আসপেরো নামক স্থানে চালানো খননকার্য। এই খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত তথ্যের উপর নির্ভর করে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে মাইকেল এডওয়ার্ড মোজলি প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে,এই সভ্যতার মূল ভিত্তি ছিল সমুদ্রজাত খাদ্য। শস্যজাতীয় খাদ্য সিদ্ধ করার উপযোগী কোনওরকম মৃৎপাত্রের অণুপস্থিতি তাদের এই সিদ্ধান্তকেই আরও জোরদার করে। খনন অঞ্চলে উঁচু প্ল্যাটফর্মের উপর পাওয়া ছোট ছোট ঢিবি বা স্তূপ থেকে তারা আন্দাজ করেন এগুলি আসলে প্রাণীজ খাদ্য প্রক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত উনুনজাতীয় বস্তুরই অবশেষ মাত্র।[১] এর উপর ভিত্তি করেই এরপর থেকে আন্দীয় সভ্যতার সমুদ্রনির্ভরতার তত্ত্ব ঐতিহাসিক মহলে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।[২]
তবে এই তত্ত্ব তাদের মধ্যে যথেষ্ট বিতর্কেরও জন্ম দেয়। কারণ সাধারণভাবে স্বীকৃত তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনও জায়গায় সভ্যতার উত্থানের পিছনে সেখানকার মানুষের কৃষিনির্ভরতা, বিশেষ করে অন্তত একটি শস্যের ব্যাপক চাষের ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। কারণ উদ্বৃত্ত খাদ্য ব্যতীত জনঘনত্ব বৃদ্ধি ও কিছু সংখ্যক মানুষের সরাসরি খাদ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়ার বাইরে থাকার সুযোগ তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। ফলে অপেক্ষাকৃত জটিল সমাজব্যবস্থার উদ্ভবের জন্য অন্তত একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত কৃষির উন্নতি খুবই প্রয়োজন। পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে যেখানেই স্বতন্ত্রভাবে সুপ্রাচীন সভ্যতাগুলির বিকাশ ঘটেছে, সেখানেই এই বিষয়টির সত্যতা লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু আন্দীয় সভ্যতার সমুদ্রনির্ভরতার তত্ত্ব এই স্বীকৃত তত্ত্বটিকেই একরকম চ্যালেঞ্জ করে বসে। ফলে তা ঐতিহাসিক মহলে তুমুল বিতর্কের জন্ম দেয়।
পরবর্তীকালে ঐ অঞ্চলের কাছাঁকাছি আরও বিভিন্ন স্থলে আরও অনেকগুলি খননস্থলে ঐ একই সময়ের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। এর মধ্যে বিখ্যাত পেরুভীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ রুথ শেডি সলিসের নেতৃত্বে সমুদ্রোপকূল থেকে ২৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরে কারাল নামক স্থানে যে খননকার্য চলে, তার ফলে ঐ অঞ্চলে খ্রিস্টপূর্ব ৯০০০[৩] অব্দ থেকে শুরু করে যে পরস্পর সংযুক্ত এক বিস্তীর্ণ সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল, তা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে ওঠে। কারাল’এ এই সভ্যতার সবচেয়ে বড় কেন্দ্রটি আবিষ্কৃত হয়েছিল বলে ঐ স্থলের নামানুসারে এই সভ্যতাকে সাধারণত কারাল সভ্যতা বলে অভিহিত করা হয়। এই সভ্যতার বিকাশের সর্বোত্তম সময়কাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ – ১৮০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়কাল।[৪] এইসব স্থলে খননকার্যে একদিকে যেমন সমুদ্রজাত খাদ্যের নানা নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে, অন্যদিকে কৃষিরও বেশ কিছু চিহ্ন আবিষ্কৃত হয়েছে। এই তথ্যের উপর নির্ভর করে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে জোনাথন হাস, উইনিফ্রেড ক্রিমার, প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদ এই তত্ত্বর তীব্র বিরোধিতা করেন।[৫] তবে চার্লস মান প্রমুখ বিশেষজ্ঞ আবার এই তত্ত্বর সত্যতার সম্ভাবনার পক্ষেই মতপ্রকাশ করেছেন।[৬]
বিতর্ক
কারালে প্রাপ্ত চুল্লীর ধ্বংসাবশেষ
১৯৭০’এর দশকে যখন প্রথম এই তত্ত্বটির উদ্ভব ঘটে, তখন থেকেই তাকে ঘিরে তীব্র বিতর্কেরও জন্ম হয়। বহু প্রত্নতত্ত্ববিদই প্রশ্ন তোলেন, সামুদ্রিক ও সমুদ্রজাত খাদ্যর যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষের উপর ভিত্তি করে এই তত্ত্বকে সামনে আনা হয়েছে, সেইসব খাদ্য মানুষকে কত ক্যালোরি শক্তি জোগাতে সক্ষম? সেই সব খাদ্যজাত পুষ্টির উপর নির্ভর করে একটি সভ্যতা গড়ে ওঠাই বা কতটা সম্ভব?[৭] অবশ্য তখনও পর্যন্ত এই সভ্যতার মূলত বিভিন্ন সমুদ্রোপকূলবর্তী খননস্থলগুলিতেই অণুসন্ধান চালানো হয়েছিলো এবং সেখানে প্রাপ্ত তথ্যর উপর ভিত্তি করেই এই তত্ত্ব গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ৯০’এর দশকে সমুদ্র থেকে বেশ খানিকটা ভিতরে বিভিন্ন স্থলে এবং বিশেষ করে কারালে এই সভ্যতার এক বিশাল কেন্দ্র আবিষ্কৃত হওয়ায় এই তত্ত্ব আরও প্রশ্নের মুখে পড়ে। কারণ –
এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত এই সভ্যতার সর্ববৃহৎ এই কেন্দ্রটি সমুদ্র থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরে অবস্থিত। অর্থাৎ এতদিন ধরে যে ধারণা ছিল যে এই সভ্যতা ছিল মূলত সমুদ্রোপকূলবর্তী কিছু ছোট ছোট গ্রামেই সীমাবদ্ধ, তা ঠিক নয়।
কারালে খননকার্যে সেইসময়ে ব্যবহৃত কিছু কিছু শস্য ও ফল উৎপাদনকারী ও কন্দজাতীয় উদ্ভিদের অস্তিত্বর প্রমাণ পাওয়া যায়। এগুলি হল স্কোয়াশ, কয়েকরকমের বিনস, পেয়ারা, লুকুমা, মিষ্টি আলু, প্রভৃতি।[৮] পরবর্তীকালে জোনাথন হাস প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদরা আরও উত্তরে কিছু খননস্থলেও এই উদ্ভিদগুলির খোঁজ পান। তার সঙ্গে তারা আভোকাডো, আচিরা, প্রভৃতি আরও কিছু উদ্ভিদের ব্যবহারেরও প্রমাণ পান। বর্তমানে এই সভ্যতার বিভিন্ন খননস্থলগুলি থেকে সে’ সময় মেইজেরও যে প্রচলন ছিল, তা নিশ্চিতভাবেই জানতে পারা গেছে।[৯]
পেরুর এই উপকূলীয়় অঞ্চল যদিও প্রচণ্ড শুষ্ক একটি অঞ্চল, কিন্তু এই সঙ্কীর্ণ উপকূলীয় উপত্যকা অঞ্চলের মধ্য দিয়ে পূর্বের সুউচ্চ আন্দিজ পর্বতমালা থেকে নেমে আসা বরফ গলা জলে পুষ্ট অন্তত ৫০টি ছোট ছোট নদী বয়ে গেছে। এই সভ্যতার যেসব কেন্দ্রগুলির ধ্বংসাবশেষ সমুদ্র থেকে দূরে দেশাভ্যন্তরে খুঁজে পাওয়া গেছে, সেগুলি বেশিরভাগই এই সব নদীগুলি বা তার থেকে কাটা কিছু খালের পাশে অবস্থিত। এইসব খালের অস্তিত্ব স্বভাবতই একধরনের সেচব্যবস্থা ও কৃষির ইঙ্গিতবাহী; আর এই খালগুলির পাশে সভ্যতার কেন্দ্রগুলি গড়ে ওঠাই কৃষির উপর তাদের একধরনের নির্ভরতার প্রতি নির্দেশ করে।
তৃণনির্মিত থলি – কারাল
এতৎসত্ত্বেও আন্দীয় সভ্যতার সমুদ্রনির্ভরতার তত্ত্বটিকে বাতিল পরিগণিত করা যায় না। কারণ –
সামুদ্রিক বা সমুদ্রজাত খাদ্যের আধিক্য এই সভ্যতার এক অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। সমুদ্রোপকূল ও দেশাভ্যন্তর – সর্বত্রই এই ধরনের খাদ্য ব্যবহারের যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। এমনকী কারালেও খননকার্য চলাকালীন রুথ শেডি সলিস লক্ষ্য করেন “অসংখ্য প্রাণীজ ভুক্তাবশেষ, যার প্রায় পুরোটাই সামুদ্রিক”। এর মধ্যে শামুক বা ঝিনুকের খোল থেকে শুরু করে অ্যাঙ্কোভি, সার্ডিন, প্রভৃতি মাছের কাঁটা ও হাড়, প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।[৮] বিশেষ করে অ্যাঙ্কোভি মাছের অবশেষ থেকে পরিষ্কার যে এই মাছ দেশাভ্যন্তরেও খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হত।[৬] অর্থাৎ সাধারণভাবে এটা বলা যেতেই পারে যে, এই সভ্যতার মানুষ খাদ্যের জন্য মূলত সমুদ্রজাত বিভিন্ন খাদ্যের উপরই নির্ভর করতো।
আরও একটি বিষয় সম্বন্ধে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে আজ ঐতিহাসিকরা অনেকটাই নিশ্চিত। তা হল এই সভ্যতা্র অন্যতম কৃষিজ উৎপাদন ছিল একধরনের তুলো (Gossypium barbadense; গসিপিয়াম বারবাডেন্স প্রজাতির)। এই তুলো থেকে তৈরি সুতো দিয়েই মাছ ধরার জাল তৈরি হত। এছাড়া একধরনের লম্বা ঘাসও এখানে উৎপন্ন হত, যার থেকে শক্ত থলি তৈরি করা হত। কারাল অঞ্চলের খননকার্যে এইধরনের তৃণনির্মিত থলির নিদর্শন পাওয়া গেছে।[১০] অর্থাৎ, কৃষিজ উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও খাদ্যের জন্য এই সভ্যতার মানুষ মূলত সামুদ্রিক খাদ্যের উপরই নির্ভরশীল ছিল, যদিও সেই খাদ্য সংগ্রহের জন্য তাদের কৃষিজ ফসলের উপরই নির্ভর করতে হত।
পারস্পরিক নির্ভরতার তত্ত্ব
এই কারণেই এই অঞ্চলে সুপ্রাচীন সভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রে বর্তমানে একধরনের পারস্পরিক নির্ভরতার তত্ত্ব জোরদার হয়ে উঠেছে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, দেশাভ্যন্তরের বিভিন্ন কেন্দ্রগুলির মূল ভিত্তি ছিল এই তুলো ও ঘাসের চাষ ও তার থেকে নানাধরনের প্রয়োজনীয় জাল, কাপড়, থলি, প্রভৃতির উৎপাদন বজায় রাখা। অন্যদিকে উপকূলীয় কেন্দ্রগুলির মূল উৎপাদন ছিল মাছ ও সমুদ্রজাত খাদ্য, যার উপর স্থলাভ্যন্তরের কেন্দ্রগুলিও নির্ভরশীল ছিল। বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণের উপর নির্ভর করেই বর্তমানে উপকূল ও দেশাভ্যন্তরের কেন্দ্রগুলির এই পারস্পরিক নির্ভরতার তত্ত্বই জোরদার হয়ে উঠেছে।
দীর্ঘতম পর্বতমালা হলো দক্ষিণ আমেরিকারআন্দিজ পর্বতমালা। এই পার্বত্য ভূভাগে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত কয়েকটি প্রাচীন সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছিল, যাদের মধ্যে কতগুলি হল অতি প্রাচীন। সম্মিলিতভাবে এসব সভ্যতাকেই মূলত আন্দীয় সভ্যতা বলা হয়ে থাকে। উত্তরে আজকের কলম্বিয়া থেকে দক্ষিণে আতাকামা মরুভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত এক বিশাল ভূভাগে এই সভ্যতাগুলির বিকাশ ও বিস্তৃতির সাক্ষ্য পাওয়া যায়। বিশেষ করে আজকের পেরু ছিল এইসব প্রাচীন সভ্যতার বিকাশের কেন্দ্রভূমি।[১][২] অবশ্য তার বাইরেও তিওয়ানাকু, প্রভৃতি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতার অস্তিত্বর কথাও আমরা জানতে পারি।
OLYMPUS DIGITAL CAMERA
ইনকা সাম্রাজ্য ছিল পেরুর স্পেনীয় বিজয়ের পূর্বে এই অঞ্চলের প্রাচীন আমেরিন্ডিয়ান অধিবাসীদের শেষ স্বাধীন রাজনৈতিক অস্তিত্ব। এমনকী তাদের সাম্রাজ্যেও কিন্তু আমরা দেখতে পাই বহু জাতি, ভাষা ও সভ্যতার আলাদা আলাদা অস্তিত্ব বজায় ছিল। এরা যদিও সবাই ইনকাদের শাসনের অধীনেই ছিল, সকলের তাদের প্রতি সমান আনুগত্য ছিল না, সকলের সংস্কৃতিও একইরকম ছিল না। যেমন চিমুরা মুদ্রার ব্যবহার করতো, কিন্তু ইনকা সাম্রাজ্যে তার ব্যবহার ছিল না। সেখানে বিনিময় প্রথার মাধ্যমেই বাণিজ্য চলতো। আবার চাচাপোয়ারা ইনকাদের অধীনতা মানতে বাধ্য হলেও বাস্তবে তাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্নই রয়ে গিয়েছিল। এই কারণেই স্পেনীয়দের সাথে তাদের লড়াই শুরু হলে চাচাপোয়া অভিজাতদের এক বড় অংশ ইনকাদের পরিবর্তে স্পেনীয়দেরই সাহায্য করে।[৩]
১৫২০‘র দশকের শেষের দিকে এই অঞ্চলে স্পেনীয়দের আবির্ভাব[৪][৫] ও তারপর থেকে তাদের উপনিবেশের ক্রমাগত বিস্তারের ফলে এই অঞ্চলে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক যে বিরাট পরিবর্তনের সূচনা ঘটে, তার ফলেই এই অঞ্চলের প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন ঘটে ও ইউরোপীয় ধারার সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে শুরু করে।[৪]
প্রাক-কলম্বীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সভ্যতা
কলম্বাসেরআমেরিকা আবিষ্কার সমগ্র আমেরিকার ইতিহাসেই ধারাবাহিকতার মাঝে এক ছেদ’এর কাজ করেছিল। দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ অঞ্চলও তার ব্যতিক্রম নয়। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমভাগে এই অঞ্চলে স্পেনীয়দের পদার্পণ এতটাই প্রভাববিস্তার করে যে তার আগে পর্যন্ত এই অঞ্চলের মানুষের সভ্যতার সুদীর্ঘ ধারা এর ফলে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। বহুক্ষেত্রে ভাষা সংস্কৃতি থেকে পুরো জাতি পর্যন্ত এর ধাক্কায় বিলুপ্ত হয়, বা তাদের আগেকার সভ্যতা সংস্কৃতির সাথে সমস্ত সম্পর্ক হারিয়ে ফেলে। ফলে আজ যখন ঐতিহাসিকরা আবার ঐ অঞ্চলের ইতিহাস পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছেন, দেখা গেছে স্পেনীয়দের আগমণের সময়ে মূলত স্পেনীয়দেরই লেখা কিছু বিবরণ ও স্পেনীয় ভাষা শিখে সেই ভাষাতেই লেখা আমেরিন্ডীয়দের অতি সামান্য কিছু বিবরণ ছাড়া তাদের হাতে আর বিশেষ কিছুই এসে পৌঁছয়নি। ফলে কলম্বাসের অভিযানের পূর্বের ইতিহাস উদ্ধারের ক্ষেত্রে মূলত প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের উপর নির্ভর করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। সেই কারণেই আন্দীয় অঞ্চলের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গেলেও কলম্বাস-পূর্ব প্রত্নতাত্ত্বিক সভ্যতা ও স্পেনীয়দের আগমণের সমকালীন সভ্যতা এই দুইভাগে ভাগ করে আলোচনা করাই শ্রেয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রের ইতিহাসের উপকরণ তুলনামূলকভাবে বেশি, তাই তার বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনাও তুলনায় অনেক বেশি বিস্তারিত।
প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল থেকে ২৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরে শুষ্ক সুপে উপত্যকায় ৫০০০ বছরের পুরনো দুটি কারাল পিরামিড।
কারাল সভ্যতা বা কারাল-সুপে সভ্যতা এখনও পর্যন্ত জানা সবচেয়ে প্রাচীন আন্দীয় সভ্যতা। এই সভ্যতা বহু ক্ষেত্রে নর্তে চিকো সভ্যতা নামেও পরিচিত।[৬] প্রথম নামটি এসেছে পেরুর সুপে উপত্যকায় অবস্থিত কারাল অঞ্চলের নাম থেকে। এইস্থানেই এই সভ্যতার সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ স্তূপটি আবিস্কৃত হয়েছে। তাছাড়া এই অঞ্চলটি, যতদূর বোঝা গেছে, এই সভ্যতায় একটি অত্যন্ত পবিত্র স্থান বলেও বিবেচিত হত।[৭] অন্যদিকে পেরুর এই অঞ্চলকে কথ্য ভাষায় বর্তমানে নর্তে চিকো (স্পেনীয়, অর্থ উত্তরের ছোট্ট স্থান) বলা হয়। তার থেকেই এই দ্বিতীয় নামটির সৃষ্টি। খ্রিস্টজন্মের ৯০০০ বছর আগেই এই সভ্যতার সূচনা হয়।[৮] তবে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ – ১৮০০ অব্দকে এই সভ্যতার সবচেয়ে বেশি বিকাশের সময় বলে মনে করা হয়।[৯] উত্তর-মধ্য পেরুর সমুদ্র উপকূলে এই সভ্যতার অন্তত ৩০টি কেন্দ্র খুঁজে পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে কারাল, আসপেরো, উয়ারিকাঙ্গা, কাবালেত, প্রভৃতি স্থলে খননকার্যের মাধ্যমে এই সভ্যতার প্রচূর নিদর্শন খুঁজে পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে রয়েছে পাথরে তৈরি সম্ভাব্য বড় বড় মন্দিরের উঁচু প্ল্যাটফর্ম, বসবাসের জন্য তৈরি বাড়ির ধ্বংসস্তূপ, বেশ কিছু ঢিবি, প্ল্যাটফর্মের উপর খাওয়াদাওয়ার চিহ্ন, হাড়ের তৈরি বেশ কিছু বাঁশি, প্রভৃতি। তবে নব্যপ্রস্তর যুগের এই সভ্যতায় ধাতুর ব্যবহার জানা ছিল না। এমনকী মৃৎপাত্র তৈরি বা ব্যবহারের কোনও নিদর্শনও এখানে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য থেকে এখানে যথেষ্ট জটিল একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপের অস্তিত্ব পরিষ্কার বোঝা যায়। কালের বিচারে এই সভ্যতার সর্বোত্তম বিকাশের সময়টি ছিল পুরনো পৃথিবীর সুমের সভ্যতার থেকে হাজার বছর পরে, কিন্তু মিশরে যে সময়ে পিরামিডগুলি নির্মাণ হয়, তার সমসাময়িক। পশ্চিম গোলার্ধের অপর প্রাচীন সভ্যতা কেন্দ্র মেসোআমেরিকার থেকে এই সভ্যতা অন্তত ২০০০ বছর প্রাচীন।[১০]
পৃথকভাবে সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল, পৃথিবীর এমন ছটি কেন্দ্রের অন্যতম ও আমেরিকা মহাদেশের সবচেয়ে পুরনো নগরসভ্যতা এই কারাল সভ্যতার কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। সাধারণভাবে অত্যন্ত শুষ্ক এই অঞ্চলের বুক দিয়ে বয়ে গেছে সুউচ্চ আন্দিজ পর্বতমালা থেকে নেমে আসা প্রায় ৫০টি ছোট ছোট নদী। এদের ধার বরাবর প্রতিষ্ঠিত এই সভ্যতার কেন্দ্রগুলিরও মূল ভিত্তি ছিল কৃষি। কিন্তু তারা চাষ করতো কোনও খাদ্যদ্রব্য নয়, মূলত তুলো। সেই তুলো দিয়ে মাছ ধরার জাল তৈরি করে সরবরাহ করা হত সমুদ্রতীরে অবস্থিত এই সভ্যতার কেন্দ্রগুলিতে। এই কেন্দ্রগুলিতে সংগৃহীত মাছ ও সামুদ্রিক নানা খাদ্যদ্রব্যই ছিল এই সভ্যতার মানুষের মূল খাদ্যদ্রব্য। জালের সাথে মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক খাদ্যদ্রব্যের বিনিময়ই ছিল সেই অর্থে এই সভ্যতার ভিত্তি। অবশ্য সঙ্কীর্ণ নদী উপত্যকাগুলিতে কিছু ফল ও সব্জিচাষের নিদর্শনও পাওয়া যায়। এই ধরনের সভ্যতার অন্য কোনও প্রাচীন নিদর্শনের কথা এখনও পর্যন্ত জানা নেই।[১০]
আজ থেকে প্রায় ৩৮০০ বছর আগে ভূমিকম্প বা এল নিনো জাতীয় কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এই সভ্যতার পতন ঘটে বলে মনে করা হয়।
দক্ষিণ আমেরিকার অন্য এক সুপ্রাচীন সংস্কৃতি হল লাস ভেগাস সংস্কৃতি। প্রাচীন এই সংস্কৃতির বিকাশকাল মোটামুটি ৮০০০ – ৪৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।[১১] তবে অত্যন্ত ছোট ছোট মূলত পরিবারকেন্দ্রিক উৎপাদনভিত্তিক এই সংস্কৃতি তখনও তেমন কোনও কেন্দ্রীয় প্রশাসন যতদূর সম্ভব গড়ে তুলতে পারেনি। এই কারণে সভ্যতা শব্দটির তুলনায় সংস্কৃতি শব্দটি এদের বর্ণনায় বেশি উপযুক্ত। নৃতত্ত্ববিদ কারেন ই স্টোটার্ট’এর মতে ইকুয়েডরের প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূল অঞ্চলের জটিল জীববৈচিত্রের সাথে সাথে সুন্দরভাবে খাপ খাইয়ে এরা এদের বসতিগুলি গড়ে তুলেছিল।[১১] এই অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া প্রায় ৩১টি সুপ্রাচীন বসতির অবশেষ থেকে পাওয়া জিনিসপত্রের রেডিওকার্বন পরীক্ষায় এদের বয়সের প্রাচীনত্ব সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত হয়েছে।[১২]
এখানকার মানুষ ছিল মূলত শিকারী ও সংগ্রাহক; তবে এরা মাছ ধরতে জানতো। পরবর্তীকালে আদিম পদ্ধতিতে চাষও শুরু করে এরা। কাঠ, বাঁশ, লম্বা ঘাস ও গাছের ছাল এরা নানা কাজে ব্যবহার করতো।[১৩] তবে মৃৎপাত্র তৈরির পদ্ধতি এদেরও জানা ছিল না।
এরা ছোট ছোট দলে বাস করতো। তবে আশেপাশের নানা অঞ্চলের মানুষের সাথে এদের যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রায় ৩০০০ বছরের মধ্যে এদের জীবনযাপন পদ্ধতিতে খুব সামান্যই পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল।[১১] বর্তমান ইকুয়েডরের সান্তা এলেনা অঞ্চলের সুম্পাতে এদের সবচেয়ে বড় বসতিটি আবিস্কৃত হয়েছে।
এই সভ্যতার সর্বোত্তম বিকাশের সময়কাল মোটামুটি খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দ থেকে ২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় হাজার বছর ব্যাপী সময়কাল। এদের ভাষা আমাদের জানা নেই এবং যতদূর সম্ভব সেই ভাষা আজ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। তাই এরা নিজেরা নিজেদের কী বলতো সে সম্পর্কে কিছুই জানতে পারা যায় না।[১৪] আন্দিজ পর্বতের উপর প্রায় ১০০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত পেরুর চাভিন দে উয়ান্তার’এ এই সভ্যতার সব থেকে বড় কেন্দ্রটি আবিস্কৃত হয়েছে বলে, সেই জায়গার নাম অনুসারে তাদের চাভিন সংস্কৃতি বলে উল্লেখ করা হয়। কারাল-সুপে সভ্যতার আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত এই সভ্যতাকেই দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা বলে মনে করা হত। আন্দিজ পর্বতের উচ্চভূমিতে এদের মূল কেন্দ্রগুলি অবস্থিত হলেও উপকূলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এদের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল।[১৫]
সোনার নেকলেস, চাভিন সংস্কৃতি
পেরুর বর্তমান রাজধানী লিমার কাছে অবস্থিত এই চাভিন দে উয়ান্তার শহরটি খ্রিস্টপূর্ব ৯০০ অব্দ নাগাদ নির্মিত হয়। তবে তার আগেও এখানে বসবাসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই কেন্দ্রের মন্দিরটিকে চাভিন স্থাপত্যের একটি প্রধান নিদর্শন বলে মনে করা হয়। এটি দীর্ঘদিন ধরে ধাপে ধাপে তৈরি করা হয়েছে। এই অঞ্চলে প্রচূর বৃষ্টিপাত হয়। তাই বৃষ্টির জলের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য মন্দিরটিকে ঘিরে অত্যন্ত সুন্দর নিকাশী ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছিল। তাছাড়া মন্দির তৈরি করতে যে সাদা ও কালো পাথরের ব্যবহার করা হয়েছিল, তা বয়ে আনা হয়েছিল দূর থেকে। এর থেকে এক ধরনের সাংগঠনিক ক্ষমতার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়, যার থেকে বোঝা যায় চাভিনদের কেন্দ্রীয় শাসক গোষ্ঠী ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী।[১৫] তবে তাদের প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে তেমন কিছুই আবিস্কৃত হয়নি। চাভিন দে উয়ান্তার ছিল মূলত একটি ধর্মীয় কেন্দ্র। তবে এর অবস্থান ছিল পার্বত্য ও উপকূলীয় অঞ্চলের যোগাযোগের রাস্তা ও উত্তর দক্ষিণে যোগাযোগের রাস্তার একরকম সংযোগস্থলে। সেই কারণে আন্দাজ করা হয়, রাজনৈতিক দিক থেকেও এর যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল।[১৬]
চাভিন সভ্যতা ছিল মূলত কৃষিভিত্তিক। এরা ভুট্টা, কিনোয়া, আলু, প্রভৃতি ফসলের চাষ করতো। চাষের জন্য জল সেচের বন্দোবস্তও ছিল। স্থানীয় পশু ইয়ামাকে তারা পোষ মানিয়েছিল। তাদের মাংস খাওয়া হত, পোশাক তৈরির জন্য তাদের লোম ব্যবহৃত হত, আবার মালবহনের কাজেও তাদের ব্যবহার করা হত।[১৫][১৭] পূর্ববর্তী কারাল সভ্যতার সাথে তাদের এক উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হল, মৃৎপাত্রের ব্যবহার তারা জানতো। উপকূলীয় অঞ্চলে তাদের ব্যবহৃত সুন্দর সুন্দর মৃৎপাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, যার থেকে তাদের শিল্পবোধের পরিচয় মেলে। এছাড়া মন্দিরগাত্রে ও দেওয়ালেও তারা খোদাই করে অনেক শিল্পকর্ম রচনা করেছিল। এগুলির সাথে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের যোগ ছিল বলে মনে করা হয়।[১৭] ধাতুবিদ্যাতেও তাদের যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় মেলে। ধাতু গলিয়ে তারা কাজ করতে জানতো। সোনার কাজেও তাদের দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়।[১৫]
ভালদিভিয়া সংস্কৃতি
বর্তমান ইকুয়েডরের মানচিত্রে ভালদিভিয়া-সংস্কৃতির কেন্দ্রগুলির অবস্থান
চাভিন সংস্কৃতি যদি এক অর্থে কারাল-সুপে সভ্যতার উত্তরাধিকার বহন করে থাকে, লাস ভেগাস সংস্কৃতির সরাসরি উত্তরাধিকার বর্তায় ভালদিভিয়া সংস্কৃতির উপর। তবে এই দুই প্রাচীন সংস্কৃতি সময়ের হিসেবে পরস্পর সরাসরি যুক্ত ছিল না, বরং একের বিলোপ ও অপরের উদ্ভবের মধ্যে প্রায় ৬০০ বছরের ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান ইকুয়েডরের গুয়াইয়াস প্রদেশের সান্তা এলেনা উপদ্বীপের ভালদিভিয়া শহরের কাছে নব্যপ্রস্তরযুগীয় এই সংস্কৃতির কেন্দ্রগুলি প্রথম আবিস্কৃত হয়েছিল বলে তার এই নাম। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ – ১৮০০ অব্দের মধ্যে ইকুয়েডরের পশ্চিম উপকূল বরাবর এই সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। সেই হিসেবে এই সংস্কৃতি ছিল দক্ষিণে বিকশিত ও উন্নত কারাল সভ্যতারই সমসাময়িক। তবে কারাল সভ্যতার মতো এখানে কোনও বৃহৎ শহর গড়ে ওঠা বা জটিল প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের তেমন নিদর্শন পাওয়া যায় না। গুয়াইয়াস, লস রিওস, মানাবি এবং এল ওরো প্রভৃতি প্রদেশে লা সেন্তিনেলা, লা লোরা, পুয়েব্লো নুয়েভো, সান ইসিদ্রো, সান পাবলো, প্রভৃতি স্থানে এই সভ্যতার প্রায় ১৫০টি কেন্দ্র খুঁজে পাওয়া গেছে।[১৮]
ইকুয়েডরীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ এমিলিও এস্ত্রাদা ১৯৫৬ সালে প্রথম এই সংস্কৃতির নিদর্শন আবিষ্কার করেন। এরা মৃৎপাত্র তৈরি করতে জানতো; এদের তৈরি মৃৎপাত্রগুলিতে প্রথমদিকে সুক্ষতার যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হলেও ক্রমে ক্রমে এরা এতে খুবই দক্ষ হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে তৈরি এদের রঙীন, পালিশযুক্ত ও সুক্ষ কারুকার্যতে পরিপূর্ণ পাত্রগুলি তার সাক্ষ বহন করে। এদের জীবনযাত্রার মূল ভিত্তি ছিল কৃষি ও মৎসশিকার। ভুট্টা, কাসাভা, বিনস, স্কোয়াশ, তুলো, প্রভৃতি ছিল তাদের প্রধান ফসল। সমুদ্র উপকূল, খাঁড়ি ও নদী থেকে তারা মাছও ধরতো। তুলো থেকে তারা কাপড় তৈরি করতো।
ভালদিভিয়ার মানুষের থাকার জায়গারও একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আছে। কোনও একটি জায়গাকে কেন্দ্র করে সাধারণত বৃত্তাকারে বা উপবৃত্তাকারে বাড়িগুলিকে সাজিয়ে তাদের বসতিগুলি গড়ে উঠেছিল। এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় ভালদিভীয় বসতিটি প্রায় ১০ হেক্টর জমির উপর গড়ে উঠেছিল। সেখানে যতদূর সম্ভব প্রায় ৩০০ মানুষ বসবাস করতো। তাদের বাড়িগুলিও ছিল বৃত্তাকার, উপবৃত্তাকার বা কিছুটা U-আকৃতির। এদের তৈরি ভেনাস মূর্তিগুলিও বিশেষভাবে বিখ্যাত। আরও উল্লেখ্য, এই মূর্তিগুলি প্রতিটিই আলাদা আলাদা ব্যক্তির – কোনও দেবীমূর্তি নয়। মূর্তিগুলি সাধারণত মাটি দিয়েই তৈরি হত।
বর্তমান পেরুর পশ্চিমে দীর্ঘ প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলের দক্ষিণ অংশে পারাকাস উপদ্বীপ সংলগ্ন ইকা অঞ্চলে মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ৯০০ থেকে ১০০ অব্দের মধ্যে বিকশিত যে সংস্কৃতির নজির পাওয়া যায়, তা পারাকাস সংস্কৃতি নামে পরিচিত। পারাকাস উপদ্বীপে প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষগুলো থেকেই এই সংস্কৃতির মানুষের সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানতে পারা গেছে। ১৯২০’র দশকে বিখ্যাত পেরুভীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ হুলিও তেলিও প্রথম এই সংস্কৃতির বিষয়ে অনুসন্ধান চালান।[১৯] বড় বড় কবরস্থানে একসাথে অনেক মৃতদেহর সৎকার করা, মৃতদেহকে মমি করে রাখা, জলসেচের জন্য কাটা খালের বিন্যাস, সোনা পিটিয়ে তৈরি অলঙ্কার ও মুখোশ, অবসিডিয়ান ছুরি, মৃৎপাত্র এবং উন্নত রঙীন ও জটিল বয়নশিল্প এই সংস্কৃতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য।[২০]
ইকা উপত্যকা অঞ্চলে পারাকাস সংস্কৃতির মানুষদের বসবাস কালেই যতদূর সম্ভব উত্তর থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০ অব্দ নাগাদ এক নতুন সংস্কৃতির মানুষদের ঐ উপত্যকায় আগমণ ঘটে। এরপর অন্তত এক প্রজন্ম বা তার কিছু বেশি সময়কাল পারাকাস উপদ্বীপ ও ইকা উপত্যকা, দুই অঞ্চলেই এই দুই সংস্কৃতির মানুষই পাশাপাশি বসবাস করতে থাকে। এই নতুন সংস্কৃতির মানুষদের টোপারা বলে অভিহিত করা হয়। পারাকাস ও টোপারা সংস্কৃতির মধ্যে মিশ্রণের ফলেই পরবর্তী নাজকা সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে। পারাকাসদের সুক্ষ বয়নশিল্প ও মৃৎশিল্পের দক্ষতা এই নতুন সংস্কৃতিতেও গৃহীত হয়। যদিও পারাকাসদের বয়নশিল্পের যা কিছু নিদর্শন শুষ্ক উপকূল অঞ্চল থেকেই বেশি পাওয়া গেছে, সাম্প্রতিক গবেষণায় যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে যে এই সংস্কৃতির মানুষদের আন্দিজ পর্বতের উচ্চভূমিতেও যাতায়াত ছিল। সেখানেও তারা বসতি স্থাপনও করেছিল।
নাজকা সংস্কৃতি হল আন্দীয় অঞ্চলের আরেক সুপ্রাচীন সংস্কৃতি। মোটামুটি ১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল এই সংস্কৃতির বিকাশের সময়। দক্ষিণ পেরুর শুষ্ক উপকূলে নাজকা শহরের কাছে রিও গ্রন্দে নদীর উপত্যকায় এই সভ্যতা বিস্তার লাভ করেছিল বলে ঐ শহরের নামানুসারে একে নাজকা সংস্কৃতি বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই সভ্যতায় আমরা সহজেই পূর্বসুরী পারাকাস সংস্কৃতিরই ধারাবাহিকতা লক্ষ করে থাকি। কিছু কিছু পরিবর্তন সূচিত হলেও, এদের বয়নশিল্প, সূচিকর্ম বা মৃৎপাত্র অনেকটা একই প্রকার। এদের আরও দুটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি হল পুকুইয়ো ও নাজকা রেখা। এর মধ্যে প্রথমটি হল মাটির নীচ দিয়ে জলসংবহনের এক বিশেষ পদ্ধতি, নাজকারা যার উদ্ভব ঘটিয়েছিল। এখনও পর্যন্ত ৩২টি পুকুইয়ো পাওয়া গেছে। আর দ্বিতীয়টির কারণে নাজকারা আজ পৃথিবী বিখ্যাত। এগুলি হল মাটির উপর টানা বিশাল বিশাল সরলরেখা এবং তার সমন্বয়ে অঙ্কিত জ্যামিতিক চিত্র ও নানা পশুপাখির ছবি। এগুলির বিশালত্ব সত্যিই ধারণা করা কঠিন। প্রায়শই রেখাগুলি মাইলের পর মাইল জুড়ে বিস্তৃত এবং এতটাই বড় যে আধুনিক যুগে হেলিকপ্টার বা বিমানের সাহায্যেই একমাত্র তার পূর্ণাঙ্গ ছবি তোলা সম্ভব হওয়ার পর তাদের প্রকৃত চেহারা সম্পর্কে সঠিক ধারণা তৈরি করা গেছে।[২১] ড্রেসডেনের জার্মান গবেষিকা মারিয়া রাইখা এরকম ৫০টি চিত্র ও ১০০০টিরও বেশি রেখা আবিষ্কার করেছেন, যাদের কোনও কোনওটি এমনকী ২০ কিলোমিটার লম্বা।[২২][২৩][২৪]
নাজকাদের কোনও কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তাদের বসতিগুলি ছিল ছোট, কোনও শহরের চিহ্ন সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে নাজকা উপত্যকার নিম্নাংশে কাউয়াচি নামক স্থানে একটি মাটির ঢিবি ও পিরামিড পাওয়া গেছে, যতদূর সম্ভব যা ধর্মীয় কারণেই ব্যবহৃত হত। এখানে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যে নানা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও ভোজসভার চিহ্ন পাওয়া গেছে।
তাদের কৃষি ব্যবস্থা ছিল বেশ উন্নত। মিষ্টি আলু, স্কোয়াশ, ভুটা, ম্যানিওক, প্রভৃতি ফসল তারা উৎপাদন করতো। চাষের জন্য সেচের ব্যবস্থা ছিল। এছাড়া তারা সমুদ্রে জালের সাহায্যে মাছও ধরতো। সিল মাছ শিকারেও তারা ছিল দক্ষ। ৫০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ তাদের পতন শুরু হয়। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই পতন মোটামুটি সম্পূর্ণ হয়। বিশেষজ্ঞরা এর কারণ হিসেবে সমুদ্র উপকূল অঞ্চলে বারে বারে আছড়ে পড়া সামুদ্রিক ঝড় তথা এল নিনো জনিত বন্যাকে অনেক সময়ই দায়ী করে থাকেন।[২৫]
মোচে সংস্কৃতি মোচিকা সংস্কৃতি, প্রাক-চিমু সংস্কৃতি, প্রভৃতি নামেও পরিচিত। পেরুর উত্তরাংশে সমুদ্রোপকূলে আজকের মোচে ও ত্রুহিলিও শহরের কাছাকাছি অঞ্চলে মোটামুটি ১০০ – ৮০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। বিশেষজ্ঞদের মতে এরাও রাজনৈতিকভাবে কোনও একটি রাষ্ট্র গঠন করে উঠতে পারেনি। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে পরস্পর বিচ্ছিন্ন থাকলেও তারা একটি সাধারণ সংস্কৃতির জন্ম দিতে সক্ষম হয়। এদের তৈরি অসংখ্য দেবদেবীর মূর্তি ও বিশাল বিশাল স্থাপত্যর নিদর্শন আজ পর্যন্ত বিদ্যমান। বিশেষ করে সুন্দর সুন্দর মৃৎপাত্র, সোনার কাজ, মূলত ইঁটের তৈরি বিশাল বিশাল স্থাপত্য বা উয়াকা এবং জটিল ও বিস্তৃত সেচব্যবস্থা মোচে সংস্কৃতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য।[২৬] এদের সংস্কৃতি বিকাশের সমগ্র যুগটিকে আধুনিক ঐতিহাসিকরা মোটামুটি তিনটি পৃথক উপযুগে ভাগ করে থাকেন – প্রাচীন মোচে সংস্কৃতি (১০০ – ৩০০ খ্রিষ্টাব্দ), মধ্য মোচে সংস্কৃতি (৩০০ – ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ) ও অন্তিম মোচে সংস্কৃতি (৫০০ – ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ)।[২৭]
এরা ছিল মূলত একটি কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতি। কৃষির প্রয়োজনেই এরা বিস্তীর্ণ একটি অঞ্চল জুড়ে জটিল সেচব্যবস্থার বিকাশ ঘটায়। তার জন্য এরা প্রয়োজনে নদীস্রোতকে ঘুরিয়ে দিয়ে হলেও ফসলের মাঠে জলের জোগান নিশ্চিত করে।[২৭][২৮] তবে এদের হস্তশিল্প সবচেয়ে বিখ্যাত। এদের তৈরি বিভিন্ন শিল্পদ্রব্য থেকে এদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারা যায়। শিকার, মাছ ধরা থেকে শুরু করে মারপিট, এমনকী যৌনাচার পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ের অত্যন্ত বাস্তবানুগ চিত্র সেখানে পাওয়া যায়। এদের তৈরি মূর্তিগুলির আরেকটি বিশেষত্ব হল সেগুলি বেশিরভাগই মনে হয় ব্যক্তিবিশেষের, কোনও দেবদেবীর নয়।[২৮]
মোচেদের তৈরি আরও দুটি জিনিস বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। তাদের ইঁট নির্মিত বিশাল বিশাল উয়াকাগুলির রঙের ঔজ্জ্বল্য, কারুকার্য ও বিশালত্ব সত্যিই বিস্ময়ের উদ্রেক করে। কিন্তু কিছুটা প্রাকৃতিক কারণে, কিছুটা স্পেনীয় বিজয়ের সময়ে লুঠপাটের কারণে সেগুলি আজ অনেকটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত। অন্যদিকে তাদের তৈরি সোনা ও অন্য ধাতুর তৈরি শিল্পকর্মগুলি তাদের সুক্ষ্মতার জন্যই বিস্ময়উদ্রেককারী।[২৮] এরা দক্ষিণে ইকা উপত্যকার নাজকা সংস্কৃতির সমসাময়িক। এদের উদ্ভবের সাথে পূর্ববর্তী চাভিন সংস্কৃতির যোগাযোগ আছে বলে মনে করা হয়। ওয়ারি ও চিমুদের এদের উত্তরসূরী বলে সাধারণভাবে ঐতিহাসিকরা মতপ্রকাশ করে থাকেন।
তিওয়ানাকু সভ্যতা (স্পেনীয় – Tiahuanaco বা Tiahuanacu) হল প্রাক্-কলম্বীয় আমেরিকার এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতা। দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়ার পশ্চিমাংশে এর বিকাশ ঘটেছিল। ঐতিহাসিকদের মতে এরা ছিল ইনকাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পূর্বসূরী। তিতিকাকা হ্রদ তীরবর্তী এই সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে বলিভিয়ার রাজধানী লা পাজ থেকে পশ্চিমে দেসাখুয়াদেহো যাওয়ার রাস্তায় লা পাজ থেকে ৭২ কিলোমিটার দূরে তিওয়ানাকু নামক স্থানে। আন্দিজ পর্বতের সুউচ্চ আলতিপ্লানো উচ্চভূমিতে অবস্থিত এই অঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১২৬০০ ফুট বা ৪০০০ মিটার উঁচু। ১৫৪৯ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনীয় বিজেতা (কনকিস্তাদোর) পেদ্রো সিয়েজা দে লেওন ইনকাদের শক্তিকেন্দ্র কুলিয়াসুয়ু খুঁজে বের করতে গিয়ে ঘটনাচক্রে তিওয়ানাকুতে এই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করে ফেলেন।[২৯] মনে করা হয় এই শহরই ছিল এই সভ্যতার প্রশাসনিক প্রধান শহর। অন্তত পাঁচশো বছর এই শহরকে কেন্দ্র করে এই সভ্যতার শাসনব্যবস্থা বজায় ছিল বলে মনে করা হয়। ২০০০ সাল থেকে এই শহর ইউনেস্কো দ্বারা বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।[৩০]
প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিওয়ানাকু শহর সংলগ্ন অঞ্চলে সুপ্রাচীন সময় থেকেই মানুষের বসতি স্থাপিত হয়েছিল। প্রথম দিকে এটি ছিল একটি ছোট্ট কৃষিভিত্তিক গ্রাম।[৩১] কিন্তু ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৩০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই অঞ্চল একটি উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় কেন্দ্রে পরিণত হয়। এরপর তাকে কেন্দ্র করেই একটি শক্তিশালী রাজ্যের বিস্তার ঘটে, তিওয়ানাকু যার প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। ৬০০ – ৯০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই সভ্যতা তার বিকাশের চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছয় বলে মনে করা হয়।[২৯] এইসময় বর্তমান বলিভিয়ার পশ্চিম অংশ থেকে এই সভ্যতা পশ্চিমে দক্ষিণ পেরু, উত্তর চিলি, ও উত্তর-পশ্চিম আর্জেন্তিনাতেও ছড়িয়ে পড়ে।
মূলত কৃষিকে ভিত্তি করেই এই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। চাষের জন্য এরা তিতিকাকা হ্রদ সংলগ্ন নিচু জমির মধ্যে কিছু অংশ উঁচু করে কৃষিজমি তৈরি করে। এই উঁচু জমিগুলোর মাঝখানে কিছুটা জল বাঁধাই থেকে যায়। তার ফলে জমি যে জল পায়, তাতে দেখা গেছে এই ধরনের জমি অতি উচ্চ ফলনশীলে পরিণত হয়। আবার এই জলে একই সাথে মাছও চাষ করা যায়। আবার চারদিকের নিচু থেকে যাওয়া ডোবা জমি যাতায়াতের জন্য জলপথ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।[৩২] এই সভ্যতার স্থাপত্য শিল্পও সত্যিই চোখে পড়ারই মতো। তিওয়ানাকু শহরে নানা পর্যায়ে অসংখ্য নির্মাণকার্য চলেছিল। এদের মধ্যে বেশ কটির ধ্বংসস্তূপ আমাদের সময় পর্যন্ত টিকে রয়েছে। এদের মধ্যে প্রধান হল একটি পিরামিড – আকাপানা, বারো ফুট উঁচু একটি সূর্যতোরণ, একটি তিনশো ফুট লম্বা বড় বড় দরজাসহ পাথরের পাঁচিল ঘেরা উঠোন – কালাসাসায়া, প্রভৃতি।[৩২]
একাদশ শতাব্দী নাগাদ এই সভ্যতার পতনের সূচনা ঘটে। দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধেই তাদের শাসন ভেঙে পড়ে। তবে ধর্মীয় ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে তাদের শহরগুলির ধ্বংসাবশেষ আজও ইনকা-পূর্ব আন্দীয় সভ্যতাগুলির উৎকর্ষের জাজ্জ্বল্যমান নিদর্শন হিসেবেই দাঁড়িয়ে রয়েছে।[৩০]
চাচাপোয়ারা হল আন্দিজ পার্বত্যাঞ্চলের আরেক প্রাচীন জাতি। আন্দিজ পর্বতের পূর্ব ঢালে, অর্থাৎ প্রশান্ত মহাসাগরের বিপরীত দিকে, বর্তমান পেরুর আমাজন নদী সংলগ্ন আমাজোনাস অঞ্চলে তাদের সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। ইনকাদের সাথে তাদের দীর্ঘদিন ধরে শত্রুতার সম্পর্ক ছিল। বহু চেষ্টার পর অবশেষে স্পেনীয় আক্রমণের মাত্র বছর ষাটেক আগে ১৪৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ইনকারা তাদের নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করতে সক্ষম হয়। চাচাপোয়া নামটিও তাদেরই দেওয়া, কেচুয়া ভাষায় যার মানে ‘মেঘ-যোদ্ধা’। এই অঞ্চলে অতিবৃষ্টি অরণ্য (রেন ফরেস্ট) ও সবসময় আর্দ্র পরিবেশের জন্যই বোধহয় ইনকারা তাদের এমন নামে ডাকত।
তবে চাচাপোয়াদের সম্বন্ধে খুব বেশি তথ্য হাতে পাওয়া যায় না। কারণ তাদের সম্বন্ধে স্পেনীয় ও ইনকাদের রেখে যাওয়া প্রত্যক্ষ বিবরণ নিতান্তই স্বল্প। এইকারণেই তাদের উপর তথ্যর প্রয়োজনে আমাদের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির উপরই বেশি নির্ভর করতে হয়। যাইহোক, তাদের সম্বন্ধে যেটুকু বিবরণ পাওয়া যায়, তার অন্যতম হল স্পেনীয় বিজেতা ও ঐতিহাসিক পেদ্রো সিয়েজা দে লেওনের লেখা বর্ণনা। তিনি চাচাপোয়াদের সমগ্র আমেরিন্ডীয়দের মধ্যে সবচেয়ে ফরসা ও সুন্দর বলে উল্লেখ করেছেন।[৩৩] এর থেকে বোঝা যায় অন্য আন্দীয় জাতিগুলির থেকে এরা ছিল কিছুটা আলাদা। তবে পেরুর ইনস্তিতুতো দে আরকেওলখিয়া আমাজোনিকার প্রত্নতাত্ত্বিকরা চাচাপোয়াদের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী পরীক্ষা করে অভিমত প্রকাশ করেন যে তারা সংস্কৃতিগত দিক থেকে আমাজনীয় জাতিগুলির থেকে আন্দীয় জাতিগুলিরই বেশি কাছাকাছি ছিল।
যদিও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণাদি থেকে বুঝতে পারা যায়, ২০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ সময় থেকেই আন্দিজ পর্বতের পূর্বঢালের এই আমাজন অরণ্যাঞ্চলে মানুষের বসতি ছিল, চাচাপোয়াদের সংস্কৃতির বিকাশের সূচনাসময় হিসেবে সাধারণত ৭৫০ – ৮০০ খ্রিষ্টাব্দকেই ধরা হয়। এদের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল একটি বিশাল দুর্গ – কুয়েলাপ ও গ্রান পাহাতেন, পাহাড়ের চূড়ার উপর তৈরি আরেকটি দেওয়াল ঘেরা প্রাচীন বসতির ধ্বংসস্তূপ। দুটি জায়গাতেই সামরিক প্রয়োজনে নির্মাণের দিকটি পরিষ্কার ফুটে ওঠে।[৩৪] মনে হয় উয়ারিদের (চাচাপোয়াদের সমসাময়িক এই সংস্কৃতি আন্দিজের ঠিক উলটো ঢালে এইসময় বিকাশ লাভ করেছিল ও পর্বতের উচ্চভূমি থেকে একেবারে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল।) হাত থেকে প্রতিরক্ষার খাতিরেই তারা এগুলি, গড়ে তুলেছিল। এর থেকে তাদের ‘যোদ্ধা’ পরিচয়টিরও ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এছাড়াও কুয়েলাপ’এর অদূরেই তাদের একটি কবরস্থান কারাহিয়াও আবিষ্কৃত হয়েছে।[৩৫] তবে পঞ্চদশ শতকে ইনকারা আন্দিজ পর্বত পেরিয়ে তার পূর্বঢালের দিকে অগ্রসর হলে, চাচাপোয়াদের সাথে তাদের সংঘর্ষ বাধে। প্রবল প্রতিরোধ সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত ১৪৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তারা ইনকাদের হাতে পরাজিত হয়। তাদের একরকম জোর করেই দলে দলে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়। তাদের পরপর বিভিন্ন বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করা হয়। এই কারণেই হয়তো স্পেনীয়রা যখন এই অঞ্চলে প্রবেশ করে, ইনকাদের বিরুদ্ধে বহুক্ষেত্রে চাচাপোয়ারা স্পেনীয়দেরই পক্ষাবলম্বন করে। যাইহোক, ১৫৪৭’এর পর চাচাপোয়াদের স্বাধীন অস্তিত্ব স্পেনীয় ঔপনিবেশিক সৈন্যদের হাতেই খর্বিত হয় ও পরবর্তী সময়ে প্রবল অত্যাচার, দারিদ্র ও মহামারীতে তাদের জনসংখ্যা প্রবলভাবে হ্রাস পায়।[৩৬]
উয়ারি বা ওয়ারিরা (স্পেনীয় – Huari, উচ্চারণ – উয়ারি) ৫০০ – ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ সময়কালে[৩৭] তাদের সভ্যতা তথা সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। সময়ের বিচারে এরা ছিল তিওয়ানাকুদের সমসাময়িক। এদের মূল কেন্দ্রটি ছিল দক্ষিণ পেরুতে বর্তমান আয়াকুচো শহরের ১১ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত উয়ারিতে। প্রাচীন এই শহরকে কেন্দ্র করে উপকূলের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে শুরু করে আন্দিজ পর্বতের উচ্চস্থল পর্যন্ত তারা তাদের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। সংস্কৃতিগত দিক থেকে এরা ছিল কারাল সভ্যতার উত্তরাধিকারী ও পরবর্তীকালের ইনকাদের পূর্বসূরী। জলের প্রয়োজন মেটাতে ও সেচের প্রয়োজনে এরা বড় বড় খাল কাটে ও পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে কৃষিভিত্তিক সভ্যতা গড়ে তোলে। এদের প্রধান ফসল ছিল আলু ও ভুট্টা। এদের শহরগুলো ছিল প্রাচীর ঘেরা। তারমধ্যে বাড়িগুলো ছিল পরপর সাজানো। মাঝে সরু রাস্তা। তবে বড় বড় প্রাসাদ, চক, চোখ ধাঁধানো মন্দির বা পিরামিডের কোনও নিদর্শন তেমন পাওয়া যায়নি। এদের বিষয়ে আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এই যে শহরগুলোর জোরদার সুরক্ষা ব্যবস্থা বলে তেমন কিছু চোখে পড়ে না। অর্থাৎ, যুদ্ধবিগ্রহের তেমন প্রকোপ তাদের সহ্য করতে হয়নি।[৩৮]
প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে ঐতিহাসিকরা উপকূলীয় পেরুর ও মধ্য-কেন্দ্রীয় আন্দিজের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এদের সভ্যতা ও সাম্রাজ্যের বিভিন্ন ভগ্নাবশেষ খুঁজে পেয়েছেন। এদের মধ্যে ‘উয়ারি’ থেকে অনেকখানি উত্তরে চিকলায়োতে যে প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষটি মাত্র ২০০৮ সালে খুঁজে পাওয়া গেছে, তা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।[৩৯] এছাড়াও দক্ষিণ পেরুতে মোকাহুয়া অঞ্চলের পার্বত্য উচ্চভূমিতেও তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর চেরো বাউল আবিষ্কৃত হয়েছে। তাদের এই শহরটি আরও গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে এখানেই তারা তিওয়ানাকুদের সাথে সরাসরি সংস্পর্শে এসেছিল ও দুই সভ্যতার মানুষ পাশাপাশি প্রায় কয়েকশো বছর বসবাসও করে। কিন্তু তাদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহের তেমন কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যায় না।[৪০] আবার দক্ষিণ-পূর্বে কুজকো থেকে তিতিকাকা হ্রদ যাওয়ার পথে আন্দিজ পর্বতের উপরে তাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র পিকিলিয়াক্তা খুঁজে পাওয়া গেছে। এত দূরে দূরে ছড়িয়ে থাকা তাদের বিভিন্ন কেন্দ্রগুলির অবস্থান থেকেই বোঝা যায়, তাদের সাম্রাজ্য কতটা বিস্তৃতি লাভ করেছিল।
৮০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ সময় থেকে উয়ারিদের পতনের আভাস পাওয়া যেতে শুরু করে। আর ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ তাদের শহরগুলি হঠাৎই পরিত্যক্ত হয়। এর প্রকৃত কারণ সম্বন্ধে প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকরা এখনও পর্যন্ত একমত হতে পারেননি।
চিমু সভ্যতা
১১০০ থেকে ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তৈরি[৪১] চিমু মৃৎপাত্র
উত্তর পেরুর প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে চিমোর অঞ্চলে বর্তমান ত্রুহিলিও শহরের কাছাকাছি এলাকায় চিমু সভ্যতার বিকাশ ঘটে। এর ঐতিহাসিক সময়কাল ছিল মোটামুটি ১২৫০ থেকে ১৪৭০ খ্রিষ্টাব্দ। এরা মূলত ছিল উত্তর পেরুর উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দা। আন্দিজ পর্বত ও প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলের মধ্যবর্তী সঙ্কীর্ণ, মাত্র ২০ থেকে ১০০ মাইল চওড়া, কিন্ত যথেষ্ট লম্বা এক ভূভাগকে তাদের সভ্যতার বিকাশস্থল বলে চিহ্নিত করা হয়। তবে পরবর্তীকালে এদের প্রভাব যথেষ্ট বিস্তার লাভ করে। দক্ষিণে পেরুর বর্তমান রাজধানী লিমার কাছকাছি অঞ্চল থেকে শুরু করে উত্তরে আজকের ইকুয়েডরের সীমানা পর্যন্ত অঞ্চলে এদের প্রভাবাধীন ছিল বলে জানতে পারা গেছে।[৪২] এদের মূল শহর ও প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল চান চান। চিমু সভ্যতার সর্বোচ্চ বিকাশের সময় এই শহরে এক লক্ষাধিক মানুষ বাস করত বলে মনে করা হয়। সেই হিসেবে সমকালীন দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম শহর ছিল এই চান চান।[৪৩] শহরটিতে ইঁটের তৈরি বিশাল বিশাল প্রাসাদ দেখতে পাওয়া যায়। ১৪৭০ সালে তাদের শেষ রাজা মিনচামাঙ্কামানের পতন ঘটে ও ইনকা সম্রাট তুপাক ইনকা ইউপানাকির বাহিনী চিমুদের এলাকা দখল করে তাকে ইনকা সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে। এই অঞ্চলে স্পেনীয়দের আগমণের মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে ঘটা এই যুদ্ধেই স্বাধীন রাজ্য হিসেবে চিমুদের অস্তিত্বের বিলোপ ঘটে। সেই কারণেই স্পেনীয়রা যখন এখানে এসে পৌঁছয়, তখনও ইনকাদের হাতে চিমুদের পতনের আগের সময়ের সাক্ষী কিছু মানুষ অন্তত বেঁচেছিলেন। স্পেনীয় ঐতিহাসিকরা তাদের কাছ থেকে চিমুদের সম্বন্ধে কিছু তথ্য সংগ্রহ করে লিখে গেছেন বলে, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ ব্যতীতও তাদের সম্বন্ধে আরও কিছু তথ্য অন্তত আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে।
পাশাপাশি প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে আমরা জানতে পারি, মোচেদের উত্তরাধিকারী হিসেবেই তাদের সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল। চিমুদের তৈরি মৃৎপাত্রগুলি, অন্তত তাদের প্রথম যুগে, দেখা যায় মোচেদের তৈরি মৃৎপাত্রগুলির সাথে বৈশিষ্ট্যগতভাবে অনেকটাই একইরকম। প্রায়শই এগুলি দেখতে হত কোনও না কোনও জীবজন্তুর মতো। এছাড়া ছয়তলযুক্ত কোনও বোতল বা পাত্রের উপরে কোনও দাঁড়িয়ে বা বসে থাকা ব্যক্তি মানুষের মূর্তিও অনেকসময়ই দেখতে পাওয়া যায়। চিমু মৃৎপাত্রগুলির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল, এতে কালো রঙের ব্যবহার বিশেষ করে চোখে পড়ে। বিভিন্ন মূল্যবান ধাতু ব্যবহার করে প্রস্তুত তাদের ধাতুশিল্পেও সুক্ষ্মতা ও দক্ষতার যথেষ্ট পরিচয় মেলে। মূলত সোনা, রূপা ও তামার মিশ্রিত একধরনের সংকর ধাতুর ব্যাপক ব্যবহার ছিল চিমুদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।[৪৪] কৃষি ও মাছ ধরা ছিল তাদের সভ্যতার দুই মূল ভিত্তি। কৃষির জন্য তারা জলসেচের এক বিরাট ও জটিল ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। মোচে নদী থেকে জলসেচের মাধ্যমে তারা প্রায় ৫০ হাজার একর জমিতে চাষের ব্যবস্থা করেছিল। তাদের মূল ফসল ছিল ভুট্টা ও তুলো।[৪৪] তাদের ধর্মের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে তারা ছিল চন্দ্র উপাসক। সূর্য উপাসক ইনকাদের সাথে তাদের ধর্মাচরণের মূল পার্থক্য ছিল এইখানেই। দেবতার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী উৎসর্গ করা ছিল তাদের ধর্মাচরণের আরেক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।[৪৫]
বর্তমান পেরুরকোস্কো এলাকায় সুপ্রাচীন ইনকা সভ্যতার সূচনা হয়েছিল একটি উপজাতি হিসাবে। দ্বাদশ শতাব্দিতে মধ্য আমেরিকা থেকে আগত একদল ভাগ্যান্বেষি পেরুর কুজকো (Cuzko) উপত্যকায় এসে বসবাস শুরু করে। আগত এই জনগোষ্ঠির মধ্যে ছিল কৃষক, কারিগর, কামার ইত্যাদি। স্থানীয় লোকেদের পরাভূত করে হাতুন তামাক নামক এক সাহসী যোদ্ধা ১৩৯০ সালের দিকে কুজকো উপত্যকায় একটি রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে। রাজত্বের নাম হয় ইনকা এবং রাজা তাপাক নিজেকে ভিরাকোচা ইনকা (জনগণের ঈশ্বর) নামে ভূষিত করেন। বলা যেতে পারে ইনকা সভ্যতার সূচনা কিছুটা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে হয়েছিল।
ইনকা সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর একটি দৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ছিল। এই আন্দীয় সভ্যতায় টাকার প্রচলন ছিল এবং ভোগ্যপণ্য ও বিলাসপণ্যের ব্যবসা বাণিজ্য বিস্তৃতি লাভ করেছিল। এই সভ্যতায় কর ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। বলা হয়ে থাকে যে কর উত্তোলকরা বিভিন্ন পশু, বৃদ্ধ বা দাসের বলি উৎসর্গ হিসেবে গ্রহণ করত।
স্পেনীয় বিজেতাদের হাতে ১৫৭২ খ্রিষ্টাব্দে ইনকাদের শেষ শক্ত ঘাঁটির পতন ঘটে। কিন্তু এর আগে ১৪৩৮ – ১৫৩৩ সালের মধ্যে এদের সভ্যতা ও সাম্রাজ্য তার বিকাশের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছয়। নিজেদের সাম্রাজ্য ও প্রভাবাধীন এলাকা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে এরা সরাসরি যুদ্ধের পাশাপাশি নানাধরনের আপাত শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিও ব্যবহার করে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম অংশের এক বিশাল ভূখণ্ডকে নিজেদের শাসনাধীনে আনতে সক্ষম হয়। বর্তমান পেরুর আন্দিজ পর্বতমালাকে কেন্দ্র করে এদের শাসনাধীন ও প্রভাবাধীন এলাকা ছড়িয়ে পড়ে বর্তমান ইকুয়েডর, পশ্চিম ও দক্ষিণমধ্য বলিভিয়া, উত্তরপশ্চিম আর্জেন্তিনা, উত্তর ও উত্তরমধ্য চিলি ও দক্ষিণ কলম্বিয়ায়। তাদের এই সাম্রাজ্য ছিল এতটাই বিশাল যে ১৫৩০ সাল নাগাদ তার আয়তন ছিল প্রায় ৯ লক্ষ ৫০ হাজার বর্গ কিলোমিটার; এই বিশাল ভূখণ্ডের বাসিন্দা ছিল ২০০টিরও বেশি আলাদা আলাদা জাতি, যারা সকলেই ছিল ইনকাদের শাসনাধীন।[৪৬]
মুইজকা
স্বর্ণনির্মিত মুইজকা ভেলা – এল ডোরাডো উপকথার জন্মের পিছনে এই ধরনের স্বর্ণ্নির্মিত শিল্পের ভূমিকা কম ছিল না।
বর্তমান কলম্বিয়ার প্রায় মাঝামাঝি অঞ্চলে, আন্দিজ পর্বতমালার পূর্ব রেঞ্জের (কর্ডিলিয়েরা ওরিয়েন্টাল) উচ্চভূমিতে মুইজকা উপজাতির মানুষ ইনকাদের ও অন্যান্য আন্দীয় সভ্যতার আওতার বাইরে থেকেই একধরনের পৃথক সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। প্রায় ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে তারা বসবাস করতো। তারা ছিল চিবচা ভাষী মানুষ। ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তারা প্রথম স্পেনীয়দের সংস্পর্শে আসে। এদের অবশ্য কোনও ঐক্যবদ্ধ রাজ্য গড়ে ওঠেনি। তারা ছোট ছোট অঞ্চলকে ভিত্তি করেই তাদের পৃথক পৃথক গোষ্ঠীশাসন গড়ে তুলেছিল। এইসব গোষ্ঠীর প্রধান বা নেতাদের বলা হত কাথিকে; কিন্তু এইসব কাথিকেদের নেতৃত্বে তারা তাদের ছোট ছোট রাজ্যগুলিকে একসাথে করে কতগুলি রাজ্যজোট গড়ে তোলে। এই রাজ্যজোটগুলিতে থাকা প্রতিটি পৃথক রাজ্যই ছিল স্বাধীন, কিন্তু তারা তাদের কিছু সাধারণ স্বার্থে এই ধরনের অপেক্ষাকৃত বড় জোট গড়ে তোলে। এরকম তিনটি জোটের কথা জানতে পারা যায়, যাদের নেতা ছিল তিনজন – থাকে, থিপা ও ইরাকা। এদের মধ্যে যেমন রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল, তেমনি বৈরিতাও কম ছিল না।[৪৭]
তবে এরা ছিল যথেষ্ট উন্নত। অন্তত ইউরোপীয়দের আগমণের কালে বা তার অব্যবহিত পূর্বে দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম শক্তিশালী সমাজ ও অর্থনীতি ছিল এরা। বিশেষ করে খনিশিল্পে তাদের যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় মেলে। তারা পান্না, তামা, কয়লা, সোনা, প্রভৃতি খনিজ সম্পদে ছিল বেশ ধনী। তাদের অর্থনীতিও ছিল যথেষ্ট মজবুত। বিশেষত সোনার সুক্ষ্ম অলঙ্করণের কাজে এদের দক্ষতা ছিল তুলনাহীন। হারিয়ে যাওয়া স্বর্ণশহর এল ডোরাডোর উপকথার জন্মের পিছনে এদের স্বর্ণপ্রাচূর্যের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল বলেই মনে করা হয়। মূলত বিনিময় প্রথায় তারা বাণিজ্য করতো। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে শুরু করে নানাপ্রকার বিলাসসামগ্রী – সবই তারা এইভাবেই বিনিময় করতো। তাদের সমাজ মূলত ছিল কৃষিভিত্তিক। কৃষির প্রয়োজনে তারা আন্দিজের উচ্চভূমিতেও সেচব্যবস্থা ও ধাপ কেটে চাষের জমি গড়ে তুলেছিল। বুনন ছিল তাদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র। এদের বোনা নানাধরনের অত্যন্ত জটিল বুননের সুক্ষ্ম কাপড়ের নিদর্শন পাওয়া গেছে।[৪৮]
এদের সমাজে খেলাধূলার বিশেষ গুরুত্ব ছিল। ক্রীড়া ছিল বহুক্ষেত্রেই তাদের ধর্মীয় আচারের একটি অঙ্গ। এইসব খেলার মধ্যে তেহো নামক ধাতব চাকতি নির্ভর একটি খেলা কলম্বিয়ায় আজও জনপ্রিয়। এছাড়া কুস্তিও ছিল আরেকটি জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ খেলা। এই খেলায় বিজয়ীকে গোষ্ঠীপ্রধানের তরফ থেকে সুক্ষ্ম একটি শাল উপহার দেওয়া হত এবং তাকে গুয়েচে বা যোদ্ধা বলে গণ্য করা হত।
এরা ছিল মূলত সূর্যের উপাসক। সোগামোসো বা সূর্যদেবের পবিত্র শহরে তাদের প্রধান মন্দিরটি অবস্থিত ছিল। পুরোহিতদের এদের সমাজে যথেষ্ট প্রভাব ছিল। ছোট থেকেই তাদের আলাদা ধরনের শিক্ষা দেওয়া হত। চাষবাস থেকে যুদ্ধ পর্যন্ত সবকিছুতেই তাদের পরামর্শের খুবই গুরুত্ব ছিল। প্রচলিত গল্পের পরম্পরা থেকে মনে করা হয়, শুরুতে তাদের ধর্মে নরবলিরও প্রচলন ছিল। কিন্তু স্পেনীয়দের সংস্পর্শে আসার আগেই এই প্রথা অবলুপ্ত হয়েছিল। কারণ স্পেনীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে এরকম কোনও নরবলির কথা শুনতে পাওয়া যায় না। ১৫৪২ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনীয়দের হাতে এদের পতন ঘটে।[৪৭]
মিশরের আদি রাজত্ব (ইংরেজি – Early Dynastic Period ; জার্মান – Frühdynastische Periode ; ৩১০০ – ২৬৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বলতে মিশরের ইতিহাসের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক সময়কে সাধারণভাবে বোঝানো হয়ে থাকে। উত্তর ও দক্ষিণ মিশরের ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি একক রাজ্য গড়ে ওঠার সময়কালকে (৩১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এর সূচনাপর্ব ধরা হয়ে থাকে ও তৃতীয় রাজবংশের তথা পুরাতন রাজত্বের সূচনা পর্যন্ত সাধারণভাবে এর ব্যাপ্তি ছিল বলে ধারণা করা হয়।[১] মিশরের প্রথম ও দ্বিতীয় রাজবংশের রাজত্বকালকে এই যুগের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে গণ্য করা হয়।[২] এই সময়ের প্রথমদিকে মিশরের রাজধানী ছিল তিথনিস। পরবর্তীকালে প্রথম রাজবংশের আমলে তা মেমফিসে সরিয়ে আনা হয়।
সূচনা
মিশরের ফারাওদের ঐতিহাসিক দ্বিমুকুট; এর একটি উচ্চ মিশরের ও অন্যটি নিম্ন মিশরের প্রতীক।
উচ্চ ও নিম্ন মিশর তথা দক্ষিণ ও উত্তর মিশরের একত্রীকরণের মাধ্যমে এই ঐতিহাসিক সময়পর্বের সূচনা। ফারাও মেনেসের রাজত্বকালেই এই ঐক্য সাধিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের মিশরীয় সন্ন্যাসী মানেথো‘র এগিপটিয়াকা (“মিশরের ইতিহাস”) থেকেও এই তথ্যই সমর্থিত হয়। তবে আধুনিক ঐতিহাসিকরা তার সঠিক পরিচয় নিয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি। অনেকে তাকে তৃতীয় নাকাদা সংস্কৃতিকালীন নৃপতি নারমের বলে মনে করে থাকেন।[৩][৪][৫] আবার কারুর মতে প্রথম রাজবংশের ফারাও হোর-আহা ও মেনেস একই মানুষ।[৬] সেই হিসেবে অনেকেই তাকেই প্রথম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেও মনে করে থাকেন।[৭] যাই হোক না কেন, মিশরীয় ঐতিহ্য অনুসারে তাকে পরবর্তী ৩০০০ বছর স্থায়ী ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে মিশর শাসন করা ফারাওদের প্রথমজন বলে গণ্য করা হয়।
রেডিওকার্বন পদ্ধতিতে প্রাপ্ত তথ্য থেকে গবেষকরা আজ অনেকটাই নিশ্চিত যে মিশরের আদি রাজত্বকালীন প্রথম রাজবংশভুক্ত বা তার আগের রাজবংশপূর্ব যে বিভিন্ন ফারাওয়ের সম্পর্কে আমরা জানতে পারি, তাদের নির্দিষ্ট সময়কাল ও ক্রমপর্যায় সম্পর্কে আমাদের ধারণার বেশ কিছু সংশোধনের প্রয়োজন আছে।[৮]
প্রথম রাজবংশ
মূল নিবন্ধ – প্রথম রাজবংশ প্রথম রাজবংশের ফারাওদের ক্রমতালিকা সম্বন্ধে আজ ঐতিহাসিকরা অনেকটাই নিশ্চিত। এই রাজবংশের প্রথম ফারাও ছিলেন মেনেস অথবা নারমের, শেষ শাসক ছিলেন কা। এই বংশের আটজন নৃপতির কথা জানতে পারা যায়। এঁদের সকলেই আবিডোসে সমাধিস্থ হন। এই রাজবংশের প্রায় শেষ পর্যন্ত ঐতিহ্যানুসারে রাজার মৃত্যুর পর তার নিকটাত্মীয় ও বিশ্বস্ত কর্মচারীদেরও রাজার সাথে পাঠানো হত। রাজার কবরের পাশেই ছোট ছোট বর্গাকার কবরে রাজার সমাধিস্থলেই তাদেরও স্থান হত।
এই রাজবংশের আমলে মেয়েদেরও যে যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল, তার প্রমাণ রাণী মেরিৎনেইত; ফারাও ডেনের আমলে তার যে কতটা গুরুত্ব ছিল তা আন্দাজ করা যায় তার সমাধি থেকে। সমাধিটি যথেষ্ট বড়; তার উপর তার নিজস্ব ব্যক্তিগত চিহ্ন (পিনতাদেরা) এবং ধর্মীয় আচার ও রীতি পালনের জন্য নিজস্ব জায়গা; সমাধিস্থলটিও যথেষ্ট বড়, পৃথক ও রাজকীয়[৯] – এ’সব কিছুই তার পৃথক রাজকীয় মর্যাদারই ইঙ্গিতবাহী।[১০] এর থেকে ঐতিহাসিকরা আন্দাজ করেন যে ফারাও ডেন’এর অল্পবয়সে একটা উল্লেখযোগ্য সময় ফারাও’এর হয়ে তিনিই হয়তো রাজকীয় কাজকর্ম দেখাশুনো করতেন।[১০] সেই কারণেই হয়তো ফারাও ডেন তার মাকে সিংহাসনের যুগ্ম অধিকারীর সম্মান প্রদান করেছিলেন। অবশ্য মিশরের ইতিহাসে এ’রকম ঘটনার উদাহরণ আমরা পরেও দেখতে পাই, যেমন দ্বাদশ রাজবংশের রাণী নোফ্রুসোবেক বা অষ্টাদশ রাজবংশের রাণী হাতশেপসুত।[১১]
মিশরের প্রথম রাজবংশের শাসনকাল নানা কারণে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এইসময় প্রশাসনিক বহু রীতির প্রথম প্রচলন ঘটে; নতুন নতুন প্রশাসনিক পদ্ধতির প্রয়োগও দেখতে পাওয়া যায়। যেমন, এইসময় থেকেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অধিকর্তা ও রাজকীয় পরিবারের সদস্যদের জন্য হা-তিয়া (প্রাদেশিক গভর্নর), ইরি-পাৎ, আজ-মের, প্রভৃতি সম্মানসূচক পদবী ও পদ প্রচলিত হয়। ফারাও হোর-ডেন রাজকীয় উপাধির প্রচলন করে নিসুত-বিতি উপাধি গ্রহণ করেন; তার উত্তরাধিকারী ফারাও আনেজিব এই উপাধিকেই কিছুটা পরিবর্তন করে নেবুই হিসেবে পরিচিত হন। প্রথম রাজবংশের প্রত্যেক শাসকই নিজেদের জন্য আলাদা আলাদা রাজকীয় প্রাসাদ নির্মাণ করান। সুনির্দিষ্ট বৈদেশিক নীতির রূপায়নের নজিরও আমরা এই আমলে লক্ষ করি। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন সাম্রাজ্য, যেমন সিরিয়া, নুবিয়া বা লেভান্তের সঙ্গে সম্পর্কের নিরিখে এই সম্পর্ক নির্ধারিত হত। পশ্চিম দিকের প্রতিবেশী লিবীয়দের সাথে এইসময় মিশরের যুদ্ধবিগ্রহ ছিল একপ্রকার নৈমিত্তিক ঘটনা।
মিশরবিদরা অনেকেই সন্দেহ করেন, প্রথম রাজবংশের শেষের দিকে সিংহাসন নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়; এর পরিণামেই আবিডোসের রাজকীয় সমাধিক্ষেত্র এইসময় লুটের শিকার হয়।[১২] এইসময় সিংহাসনে বসেন কিছু অখ্যাতনামা ফারাও, যেমন স্নেফেরকা, সেখেৎ বা হোরাস-বা; এঁদের সম্বন্ধে আমরা খুব একটা কিছু জানি না।
দ্বিতীয় রাজবংশ
দ্বিতীয় রাজবংশের সূচনাকালে পরপর তিনজন ফারাও সম্পর্কে মিশরবিদরা অনেকটাই নিশ্চিত; এঁদের মধ্যে প্রথমজন ছিলেন হোতেপসেখেমুই; তারপরে সিংহাসনে বসেন ফারাও নেবরে ও শেষে ক্ষমতায় আসেন নিনেতিয়ের; তৃতীয়জনের মৃত্যুর পর সিংহাসন নিয়ে দ্বন্দ্ব পুনরায় মাথা চাড়া দেয় বলে ঐতিহাসিকরা অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন।[১২][১৩]
ভোলফগাং হেলক, ওয়াল্টার ব্রায়ান এমেরি, হেরমান এ. শ্ল্যোগল, ইউর্গেন ফন বেকেরট, প্রমুখ মিশরবিদদের মতে দ্বিতীয় রাজবংশের আমলে মিশর দু’টি পৃথক সাম্রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে; উচ্চ ও নিম্নমিশর প্রশাসনিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। সেনেড, সেথ-পেরিবসেন এবং সেখেমিব-পেরেনমাৎ‘এর মতো ফারাওরা শুধুমাত্র উচ্চমিশরে রাজত্ব করেন; তাদের ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল আবিডোস; অন্যদিকে একইসময়ে সেনেফেরকা, নেফেরকারে/ আকা, হুদিয়েফা বা নেফেরকাসোকার, প্রমুখ ফারাওরা নিম্নমিশরে রাজত্ব করেন ও মেমফিসকে তাদের শাসনকেন্দ্র হিসেবে বেছে নেন। এই অনুমানের অন্যতম ভিত্তি হল ফারাও সেখেমিব ও পেরিবসেন’এর নামাঙ্কিত কিছু কাদামাটি নির্মিত শীলমোহর; উচ্চ ও নিম্ন মিশরের মধ্যে প্রশাসনিক বিভাজন এখানে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লিখিত। যেমন উপরিউক্ত শীলগুলিতে রাজকীয় শীলমোহর ব্যবহারের অধিকারীদের সুস্পষ্টভাবে “উচ্চমিশরের
আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীন কওমি মাদ্রাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিস (তাকমিল)-এর সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি)-এর সমমান প্রদান আইন, ২০১৮ হলো ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে পাস হওয়া একটি আইন। পাকিস্তান আমল থেকে কওমি মাদ্রাসার সরকারি স্বীকৃতির দাবি উঠতে থাকে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে এই দাবি আরও জোরালো হয়। ২০০৬ সালে আজিজুল হকের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তৎকালীন বিএনপি সরকার সরকারি স্বীকৃতির ঘোষণা দিলেও পরবর্তীতে তা বাস্তবায়ন হয় নি। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্বীকৃতির উদ্যোগ নেয়। পরে শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে স্বীকৃতি গ্রহণে সবার মধ্যে ঐক্যমত্য হলে ২০১৭ সালে শেখ হাসিনা স্বীকৃতির ঘোষণা দেন।[১] যা ২০১৮ সালে এই আইনের মাধ্যমে আইনি বৈধতা পায়। সমালোচনা করা হয় যে, এই আইন পাসে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দিকে থেকে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পেয়েছে এবং হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মর্জিমাফিক আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।[২][৩]
ঔপনিবেশিক ভারতে ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দারুল উলুম দেওবন্দ।[৪] এই দারুল উলুম দেওবন্দকে কেন্দ্র করে সমগ্র বিশ্বে অসংখ্য কওমি মাদ্রাসা গড়ে উঠে।[৫]বঙ্গ অঞ্চলে এ ধারার প্রথম কওমি মাদ্রাসা দারুল উলুম হাটহাজারী।[৪] ১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক ভারত থেকে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান আমলে সর্বপ্রথম আতহার আলী, ছিদ্দিক আহমদ, শামসুল হক ফরিদপুরী এ মাদ্রাসাগুলোর সরকারি স্বীকৃতির দাবি উত্থাপন করেন।[৫] আতহার আলী স্বীকৃতির বিল আনার জন্য শফি উসমানিকে চিঠি লিখেন, যা এখনো সংরক্ষিত আছে।[৬]বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর সময়ে আশির দশকে প্রতিষ্ঠিত হয় বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ, যা সংক্ষেপে বেফাক নামে পরিচিত। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এটি স্বীকৃতির দাবি নিয়ে কাজ করতে থাকে। এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন হারুন ইসলামাবাদী, নূর উদ্দিন গহরপুরী, আবদুল জাব্বার জাহানাবাদী, আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া সহ বেফাকের প্রমুখ দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ।[৫][৬] বেফাকের প্রতিকূলতার কারণে আবদুল জাব্বার জাহানাবাদী তরুণদের মাধ্যমে স্বীকৃতির দাবি জোরালো করার চিন্তা করেন। ফলশ্রুতিতে নব্বইয়ের দশকে তার পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠে ‘বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা পরিষদ’ ও ‘কওমি মাদ্রাসা ছাত্র পরিষদ’। স্বীকৃতির দাবিতে জনমত তৈরির জন্য এই দুই সংগঠন ক্ষুদ্র পরিসরে প্রচার কাজ শুরু করে।[৫] ১৯৯২ সালের ২৯ মার্চ ঢাকা জেলা ক্রীড়া সমিতি মিলনায়তনে আয়োজিত ইসলামী ছাত্র মজলিসের কলেজ প্রতিনিধি সম্মেলনে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার সরকারি স্বীকৃতি সহ ১৩ দফা জাতীয় শিক্ষা দাবি উত্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে সেই দাবিতে এক লক্ষ স্বাক্ষর সংগ্রহ করে তৎকালীন বিএনপি সরকারের শিক্ষামন্ত্রী বরাবর জমা দেয়া হয়।[৭] ২০০৫ সালের ১৫ এপ্রিল আজিজুল হকপল্টন ময়দানে ‘কওমি মাদ্রাসা জাতীয় ছাত্র কনভেশন’ আয়োজন করে স্বীকৃতির দাবি তুলে ধরেন।
পরের বছর ২০০৬ সালের ১৬ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত তিনি ঢাকার মুক্তাঙ্গনে লাগাতার ৫ দিন অনশন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। ৫ম দিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তার কার্যালয়ে একটি ওলামা সম্মেলন ডেকে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্সের সমমান ঘোষণার আশ্বাস দিলে তিনি অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করেন।[৬] আজিজুল হকের এ কর্মসূচির ফলে স্বীকৃতির দাবি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক জনমত তৈরি হয়। তার সাথে উবায়দুল হক, মুহিউদ্দীন খান, ফজলুল হক আমিনী, সৈয়দ ফজলুল করিম প্রমুখ একাত্মতা ঘোষণা করেন।[৫] কওমি মাদ্রাসার স্বকীয়তা রক্ষার প্রশ্নে আপোষহীন অবস্থান নেন মুফতি আব্দুর রহমান।[৬] খালেদা জিয়া তার সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ব মূহুর্তে কওমি সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ঘোষণা দেন এবং ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয় এসংক্রান্ত গেজেটও প্রকাশ করে।[৭] তবে সেটি বাস্তবায়নের কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের সময় বা সুযোগ ঐ সরকার পায়নি৷ তখন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এ দাবির সাথে একমত ছিলেন না।[৩] ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ ও রুহুল আমিনের মাধ্যমে এই স্বীকৃতির দাবি আবার সামনে আসে।[৫][৮]শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে ২৫ সদস্য এবং পরে ৬২ সদস্যের আলেমদের প্রতিনিধিদল তার সাথে সাক্ষাৎ করে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা সনদের স্বীকৃতির দাবি জানায়। প্রতিনিধিদলে আজিজুল হক ও শাহ আহমদ শফীও ছিলেন।[৯] ২০০৯ সাল থেকেই প্রধানমন্ত্রী আলেমদের সঙ্গে যে আলোচনার সূত্রপাত করেন, সেটি ২০১০ সালে গ্রহণ করা শিক্ষানীতিতেও স্থান পায়। ২০১২ সালে কওমি সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়নে শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন গঠন করে সরকার।[১০] নানা প্রতিকূলতার কারণে কমিশনের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়।[৫] পরিশেষে ২০১৬ সালের ১০ ডিসেম্বর হাটহাজারী মাদ্রাসায় শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সে বৈঠকে কওমি মাদ্রাসার স্বকীয়তা পূর্ণমাত্রায় বজায় রেখে দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতির আলোকে কওমি সনদের স্বীকৃতি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত হয়।[৫]
আলেমদের ঐক্যমতের পর ২০১৭ সালে ১১ এপ্রিল শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে দেশের শীর্ষ আলেমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে কওমি সনদের স্বীকৃতির ঘোষণা প্রদান করেন।[৫] ১৩ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এসংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হয়।[১১] প্রজ্ঞাপন জারির পর আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীনে অভিন্ন প্রশ্নে ১৫ মে প্রথমবারের মতো সারা দেশে মোট ২১৮টি কেন্দ্রে দাওরায়ে হাদিস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।[৭] ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট এই আইনের খসড়ার অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। ১০ সেপ্টেম্বর প্রথমবার তা সংসদে তোলা হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর বিলের ওপর দেওয়া জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং সংশোধনী প্রস্তাবগুলোর নিষ্পত্তি শেষে কণ্ঠভোটে বিলটি পাস হয়।[২] ৮ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির সম্মতিলাভের পর এটি আইনে পরিণত হয়। আইনটি পাসের জন্য ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর শুকরানা মাহফিল আয়োজনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।[৮]
২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল শেখ হাসিনার ঘোষণার পর এটিকে হেফাজতে ইসলামের কাছে ‘নতি স্বীকার’ হিসেবে দেখিয়ে বিভিন্ন বাম সংগঠন এবং সুশীল সমাজের একটি অংশ এর সমালোচনা করে।[১২]বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি এটিকে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হিসেবে উল্লেখ করে।[১৩]আলিয়া মাদ্রাসার একটি অংশ এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জঙ্গিবাদ গেঁড়ে বসতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে এই সিদ্ধান্তকে অবিবেচনাপ্রসূত অ্যাখ্যা দিয়ে আদালতে যাওয়ার ঘোষণা দেন।[১৪][১৫]বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী বলেন, শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে পরাজিত করেছেন।[১৬] প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সভানেত্রী খালেদা জিয়া তার আমলে স্বীকৃতির বিষয়টি স্মরণ করে দিয়ে বলেন, শেখ হাসিনা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছে এবং এর মাধ্যমে আলেমদের ধোঁকা দিচ্ছে।[১৭]বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রীর ওই সিদ্ধান্তকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী এবং সংবিধানের মৌল চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক বলা হয়। সরকারের শরীক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল আপত্তি জানিয়ে বলে সামান্য ছাড় দেওয়া হলে তারা আবারও বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সংবিধানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। তবে এসব সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এটিকে বিদ্যমান বাস্তবতা হিসেবে বর্ণনা করে বলেন এতে ‘আপসের’ কোনো বিষয় নেই।[১৮]
বিলটি পাসের সময় জাতীয় পার্টির সাংসদ সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘মনে হচ্ছে এই আইনে সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মনে হচ্ছে চাপের মধ্যে বা যেমন খুশি তেমনভাবে এটি করা হয়েছে। এই বিলটি নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে।’ শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘আইনে সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। হয়তো এর কারণ দেওবন্দের কারিকুলাম অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে এটি করা হয়েছে।’ তবে তিনি এই আইন প্রণয়নের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান।[২] জাতীয় পার্টির আরেক সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, এটি একটি ঐতিহাসিক বিল। আমরা সম্পূর্ণভাবে একমত। আমি যাচাই বাছাইয়ের পক্ষে নই, আমি চাই বিলটি অবিলম্বে পাস করা হোক।’[১৯]
ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে রাঢ় অঞ্চলটির ভিন্ন ভিন্ন নামে চিহ্নিত হয়েছে। আবার ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রাজ্য এখানে গড়ে উঠেছিল। প্রাচীন রাঢ় সভ্যতা ও গঙ্গারিডাই রাজ্য এখানেই অবস্থিত ছিল। তবে এর প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না।[২][৩][৪][৫]
নামকরণ ও ব্যুৎপত্তি
এই অঞ্চলের বিভিন্ন নামগুলি আসলে “রাঢ়” শব্দটির শব্দগত বিকৃতি। অনেক সময় “ঢ়” শব্দটি “ঢ” হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে রচিত জৈণ ধর্মগ্রন্থ আচারাঙ্গ সূত্র-এ “রাঢা”, “রাঢ”, “রাঢ়া”, “রাঢ়”, “লাঢা”, “লাঢ়” প্রভৃতি শব্দগুলি পাওয়া যায়। কোনো কোনো বইতে “লালা”, “রার” বা “লাড়” নামেও এই অঞ্চলের উল্লেখ আছে। ভাষাতাত্ত্বিক প্রভাত রঞ্জন সরকারের মতে, চীনারা রাঢ়কে “লাটি”, গ্রিকরা “গঙ্গারিডি” ও আর্যরা “রাট্টা” বলত। তবে অনেক গ্রিক, রোমান ও মিশরীয় বইতেই “গঙ্গারিডাই”, “গঙ্গারিডি”, “গঙ্গারিটাই” ও “গঙ্গারিডাম” সভ্যতা, রাজ্য বা জাতির উল্লেখ রাঢ়ের পাশাপাশি একইভাবে করা হয়েছে। মেগাস্থিনিস, টলেমি, স্ট্রাবো, প্লিনি দ্য এল্টার, অ্যারিয়ান, ডিওডোরাস সিকুলাস, কুইন্টাস কার্টিয়াস রিউফুস ও প্লুটার্কের রচনায় গঙ্গারিডাই রাজ্যের নাম পাওয়া যায়।[২][৩][৬][৭]
“রাঢ়” শব্দের ব্যুৎপত্তি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেকে বলেছেন, এটি অস্ট্রোএশিয়াটিক পরিবার-ভুক্ত কোনো এক স্থানীয় ভাষা থেকে এসেছে। সাঁওতালি ভাষায় প্রচলিত নিম্নোক্ত ভাষাগুলি থেকে এর উদ্ভব হওয়া সম্ভব: “লার” (সুতো), “রাড়” (সুর) ও “লাড়” (সাপ)। প্রভাতরঞ্জন সরকারের মতে, শব্দটির উৎস প্রোটো-অস্ট্রোএশিয়াটিক “রাঢ়া” বা “রাঢ়ো” শব্দদুটি, যার অর্থ “লালমাটির দেশ” বা “ল্যাটেরাইট মৃত্তিকার দেশ”।[২][৬]
“গঙ্গারিডাই” শব্দের উৎসটিও স্পষ্ট নয়। ঐতিহাসিক ড. অতুল সুর, প্লিনি ও টলেমির মতে এর অর্থ “গঙ্গার তীরবর্তী রাঢ় অঞ্চল”। যদিও অন্যান্য গবেষকদের মতে, এর অর্থ, “গঙ্গাহৃদি” (যে অঞ্চলের হৃদয়ে গঙ্গা প্রবাহিত), “গঙ্গারাষ্ট্র” বা “গোন্ডা-রিডাই” (গোন্ডা জাতির দেশ)। মেগাস্থিনিস এই অঞ্চলের অধিবাসীদের বলেছেন, “Gangarides’। ডিওডোরাস সিকুলাসের বর্ণনা অনুসারে, গঙ্গারিডাই “রাষ্ট্রে সবচেয়ে বড়ো আকারের ও সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় হাতি ছিল।”[৭]
ভূপ্রকৃতি ও মৃত্তিকা – পশ্চিমের মালভূমি থেকে কাঁকুড়ে পলিমাটি বয়ে এনে এই অঞ্চলের নদীগুলি এই সমভূমি সৃষ্টি করেছে। যদিও সঠিক অর্থে সমতলভূমি নয় রাঢ় অঞ্চল। স্থানে স্থানে ঢেউখেলানো অসমতম ভূমি ও টিলা এই অঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
পুরনো পলিমাটি দিয়ে গঠিত এই অঞ্চলে ল্যাটেরাইট লাল মাটির প্রাধান্যই বেশি। মাটির স্তর এখানে অগভীর। মাটির জলধারণ ক্ষমতা কম। নদী অববাহিকাগুলি বাদে অন্যত্র তাই মাটি খুব একটা উর্বর নয়।
নদনদী – রাঢ় অঞ্চলের প্রধান নদনদীগুলি হল ময়ূরাক্ষী, অজয়, দামোদর, দ্বারকেশ্বর, শিলাই ও কাঁসাই। এই নদীগুলির উৎপত্তিস্থল ছোটনাগপুর মালভূমি ও এগুলির প্রতিটিই ভাগীরথী-হুগলি বা তার কোনও উপনদীতে মিলিত হয়েছে। সুবর্ণরেখা নদীর অংশবিশেষও এই অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। বৃষ্টির জলে পুষ্ট হওয়ায় এগুলিতে সারা বছর জল থাকে না। তবে বর্ষাকালে প্রায়শই দুকুল ছাপিয়ে বন্যা দেখা দেয়।
জলবায়ু – সমুদ্র থেকে দূরে অবস্থিত হওয়ায় রাঢ় অঞ্চলের জলবায়ু চরমভাবাপন্ন। গ্রীষ্ম ও শীতকালের গড় তাপমাত্রা এখানে যথাক্রমে ৩৫º-৪০º ডিগ্রি সেলসিয়াস ও ১২º-১৪º ডিগ্রি সেলসিয়াস। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে রাঢ়ে বছরে গড়ে প্রায় ১৪০-১৬০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। তবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ উত্তর রাঢ়ের তুলনায় দক্ষিণ রাঢ়ে বেশি। এপ্রিল-মে মাস নাগাদ কালবৈশাখী ও অক্টোবরে আশ্বিনের ঝড়ও এই অঞ্চলের জলবায়ুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
প্রাকৃতিক উদ্ভিদ – এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক উদ্ভিদের মধ্যে শাল, মহুয়া, শিমূল, কুল, বাবলা, বাঁশ ও বিভিন্ন প্রজাতির ঘাস উল্লেখযোগ্য। এই অঞ্চল অরণ্যসংকূল। তবে বর্তমানে জনবসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে বহুলাংশে অরণ্যচ্ছেদন ও চাষাবাদ এই অঞ্চলের ভূমিক্ষয়ের অন্যতম কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। বর্তমানে ভূমিক্ষয় রোধের জন্য তাই কৃত্রিম উপায়ে বনায়ন শুরু হয়েছে।
অর্থনীতি
কৃষি – কৃষিতে এই অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী। সমতল ভূভাগ, উন্নত সেচব্যবস্থা ও অনুকূল অবস্থার জন্য রাঢ়ের নদী অববাহিকাগুলিতে ধান, গম, আখ, ডাল, তৈলবীজ, জোয়ার ও আলু প্রচুর পরিমাণে জন্মায়। এর মধ্যে ধানচাষ সর্বাধিক হয় বর্ধমান ও পশ্চিম মেদিনীপুরে। জোয়ার ও তৈলবীজ মেদিনীপুরে, গম বাঁকুড়ায়, বীরভূমে আখ প্রচুর উৎপন্ন হয়। হুগলি ও বর্ধমান জেলায় প্রচুর আলু এবং হুগলি ও মেদিনীপুরে পান ও বিভিন্ন প্রকার সবজি উৎপন্ন হয়।
এছাড়া পণ্য ফসলের মধ্যে বাঁকুড়া জেলায় পলাশ ও কুল গাছে লাক্ষাকীট এবং বাঁকুড়া, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ জেলায় রেশমকীটের খাদ্য তুঁতগাছের চাষ হয়।
খনিজ – এই অঞ্চলে অল্প পরিমাণে হলেও কিছু উৎকৃষ্ট খনিজ পাওয়া যায়। বর্ধমানের রাণীগঞ্জ অঞ্চলে প্রচুর উৎকৃষ্ট কয়লা মজুত আছে। বীরভূমের মহম্মদবাজার, খড়িয়া, কামারপুকুর ও বাঁকুড়ার মেজিয়ায় অল্প পরিমাণে অভ্র, ফায়ার ক্লে ও চিনামাটি পাওয়া যায়। পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি, লাবণি ও সরিষা থানায় অল্প ম্যাঙ্গানিজ পাওয়া যায়। এছাড়া হুগলি ও বর্ধমান জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে বালির খাদ আছে।
শিল্প – রাঢ় অঞ্চলে বৃহৎ শিল্প খুব একটা গড়ে ওঠেনি। তবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জন্য এই অঞ্চল জগদ্বিখ্যাত। এই অঞ্চলের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী কুটিরশিল্প হল – বাঁকুড়া ও বীরভূম জেলার পোড়ামাটি ও টেরাকোটার কাজ ও পুতুল শিল্প, বিষ্ণুপুরের রেশম, তসর, শাঁখা ও কাঁসা-পিতলের শিল্প, মুর্শিদাবাদের হাতির দাঁতের শিল্প ও রেশম শিল্প, পশ্চিম মেদিনীপুরের মাদুর ও বেতশিল্প এবং হুগলির তাঁতশিল্প।
এছাড়া বীরভূমের আহম্মদপুরের চিনি কল ও রাঢ়ের বিভিন্ন অঞ্চলের চালকল, তেলকল ও কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরির কারখানা এই অঞ্চলের মাঝারি শিল্পের কয়েকটি নিদর্শন। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বর্ধমান, বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরে কিছু বৃহৎ শিল্পস্থাপনে উদ্যোগী হয়েছেন। এর মধ্যে বর্ধমানের অন্ডালে একটি বিমাননগরী বা এয়াট্রোপোলিশ স্থাপনের পরিকল্পনা অন্যতম।