Tag: বিসিএস পরীক্ষা মডেল টেস্ট

  • গ্রোভিও

    গ্রোভিও

    প্রাক-রোমান যুগে ইবেরীয় উপদ্বীপের ভাষিক মানচিত্র। এদের মধ্যে C – 2 চিহ্নিত অঞ্চলটিতে গ্রোভিওরা বাস করতো বলে মনে করা হয়।

    গ্রোভিও

    গ্রোভিওরা (লাতিনGrovii; স্পেনীয়grovios) ছিল প্রাক-রোমান যুগে ইবেরীয় উপদ্বীপের পশ্চিম অংশে বর্তমান পর্তুগালের উত্তরাংশ ও বর্তমান স্পেনের গালিথিয়া অঞ্চলের অংশবিশেষে বসবাস করা এক প্রাচীন উপজাতি। এর মূলত মিনিও নদীর উপত্যকা ও মোহনা, থিয়েস দ্বীপপুঞ্জ, বাইয়োনা অঞ্চল ও রিয়া দে বিগো সংলগ্ন এলাকায় বসবাস করতো। এদের বসবাসের সীমানা আ গ্রোভা উচ্চভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে মনে করা হয়। বর্তমান উত্তর পশ্চিম স্পেনের পন্তেবেদ্রা প্রদেশের তুই অঞ্চল ছিল তাদের অন্যতম মূল কেন্দ্র।[১] রোমানদের লেখাপত্রে কাস্তেলাম টাইডি নামে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্রোঞ্জ যুগ থেকেই এই অঞ্চলে মানুষের বসতি পরিলক্ষিত হয়।

    আলোইয়াআগিয়া পার্বত্য অঞ্চল, কাবেথা দে ফ্রাঙ্কোস ও তুই’এ এদের নির্মিত প্রাকারবেষ্টিত ধ্বংসাবশেষ বা কাস্ত্রো আবিষ্কৃত হয়েছে।

    প্রাচীন বিভিন্ন লেখাপত্রে, যেমন প্রখ্যাত রোমান ভৌগোলিক পম্পোনিয়াস মেলা, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী ও সৈনিক প্লিনি (বড়), রাজনীতিবিদ ও কবি সিলিকাস ইতালিকাস এবং টলেমির লেখাতেও এদের উল্লেখ পাওয়া যায়। পম্পোনিয়াস মেলা ও প্লিনির মতে এরা এদের আশেপাশে বসবাসকারী অন্যান্য উপজাতির ন্যায় কেল্টীয় ছিল না, বরং ছিল গ্রিক বংশোদ্ভূত।[১] ট্রয় যুদ্ধখ্যাত গ্রিক বীর ডিওমিডিসের বংশধর বলেও এরা উল্লিখিত হয়েছে। এদের মূল উপাস্য দেবতা ছিল সম্ভবত তুরিয়াকাস (আইরিশ দেবতা টোর-এর সঙ্গে যার সম্পর্কের ইঙ্গিত পাওয়া যায়)।

  • গৃহপালিত ভেড়ার ইতিহাস

    গৃহপালিত ভেড়ার ইতিহাস

    ভেড়া বা মেষ কে গৃহপালিত করার ইতিহাস ১১০০০ থেকে ৯০০০ খ্রিস্টপূর্ব আগের যখন থেকে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় বন্য মোফলন পোষ মানানো শুরু হয়।ভেড়া বা মেষ মানুষের দ্বারা প্রথম গৃহপালিত প্রাণী,যার প্রমাণ সে সময়ের ইরানি মূর্তি দেখে পাওয়া যায়।প্রথম দিকে ভেড়া মাংস, দুধ, এবং চামড়ার জন্য পালন করা হত।৬০০০ খ্রিস্টপূর্বের দিকে ইরানে পশমওয়ালা ভেড়া পালন শুরু হয় এবং পারস্য সংস্কৃতির লোকেরা ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য ভেড়ার পশমের উপর নির্ভরশীল হতে থাকেন। ঐ সময়ে তারা ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে আফ্রিকা এবং ইউরোপ থেকে ভেড়া আমদানি শুরু করেন।

    গৃহপালিত ভেড়ার ইতিহাস

    বন্য পূর্বপুরুষ

    মূল নিবন্ধ: Domestic sheep

    মোফলনদের মনে করা হয় গৃহপালিত ভেড়ার আদিম পূর্বপুরুষ

    গৃহপালিত ভেড়া এবং তাদের বন্য পূর্বপুরুষ মধ্যে বংশ পরম্পরার কোন সঠিক হদিস নেই।[১] তবে সবচেয়ে প্রচলিত অনুমান এই যে অভিস এরাইস মেষ এশিয়াটিক (O. orientalis) প্রজাতির মোফলন থেকে এসেছে।তবে এটা মনোনীত যে ইউরোপিয়ান মোফলন হচ্ছে গৃহপালিত ভেড়াদের মধ্যে প্রাচীনতম শাবক যা তাদের প্রাচীনতম প্রজাতি থেকে কম বন্য পরিবেশে বেড়ে উঠেছে,যা প্রাচীন সাহিত্যে ও ফুটে উঠেছে।[২]:৫স্কটল্যান্ড এর দুর্গদুগ্ধ মরিট এর মতো খুব কম প্রজাতি বন্য ইউরোপিয়ান মোফলনের সাথে সংকরায়নের মাধ্যমে প্রজনন করা হয়েছিল। [৩] একসময় মনে করা হত উরিয়াল(O. vignei) ইরানের আশপাশের মোফলনের সাথে সংরায়নের মাধ্যমে গৃহপালিত ভেড়ার একটি আদিম পূর্বপুরুষ। [৪]:৬ যাইহোক, উরিয়াল আরগালি ( O. ammon),এবং তুষার মেষ(O. nivicola) এর অন্যান্য অভিস প্রজাতির তুলনায় ক্রোমোজোমের সংখ্যা সতন্ত্র, যা তাদের অকল্পনীয় সম্পর্ক প্রদর্শন করে,এবং সনাক্তকারী গবেষণা প্রমাণ করে উরিয়াল প্রজাতির পূর্বপুরুষ এর কোনো অস্তিত্ব নেই।[১] অনেক গবেষণা ইউরোপীয় ও এশীয় প্রজাতির তুলনা আরও জোরদার করেছে এবং দুই প্রজাতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য জেনেটিক পার্থক্য প্রদর্শন করেছে।এসবের মধ্যে দুটি ব্যাখ্যা কে সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করা হয়েছে।প্রথম ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে একটি অজানা প্রজাতির বা উপপ্রজাতির বন্য ভেড়া থেকে গৃহপালিত ভেড়া উদ্ভূত হয়েছে। [৫] দ্বিতীয় ব্যাখ্যায় বলা হয় এই প্রজাতি বন্য মোফলনের বিভিন্ন প্রজাতির সংকর প্রকরণ যা অন্যান্য প্রাণীদের মতো পরিচিতি লাভ করে। [৬]

    প্রাচীন ভেড়া এবং আধুনিক প্রজাতির মধ্যে উল সংগ্রহ করার কৌশলকে প্রধান পার্থক্য হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। আদিম ভেড়াদের রোইং নামক প্রক্রিয়ায় হাত দ্বারা তাদের দেহ থেকে উল সংগ্রহ করা হত যার ফলে অনেক উল থেকে যেত। রোইং মোটা তন্তু পিছনে ফেলে রাখতে সাহায্য করে যাকে কেম্প ও বলা চলে এবং যা এখনও নরম মেষলোমের চেয়ে দীর্ঘতর।এছাড়াও মেষলোম মাঠ থেকে সংগ্রহ করা হতে পারে যা স্বাভাবিকভাবেই দেহ থেকে কষে পড়ে। রোইং এর এই বৈশিষ্ট্যের জন্য “সয়ায়” এবং অনেক “শিটল্যান্ড” প্রজাতি আজও টিকে আছে। প্রকৃতপক্ষে,সয়ায় প্রজাতির অন্যান্য উত্তর ইউরোপীয় প্রজাতির ভেড়াদের মতো ছোট লেজ, স্বাভাবিক রোইং মেষলোম, সঙ্কুচিত আকার, এবং উভয় লিঙ্গের ভেড়াদের শিং রয়েছে, যেগুলো নিবিড়ভাবে প্রাচীন ভেড়া এর সাথে সম্পর্কিত। মূলত, বয়ন এবং উল কাটন ইন্ডাস্ট্রিয়াল শিল্পের তুলনায় বরং একটি হস্তশিল্প যার একসময় বাড়ীতে,বাড়ীতে প্রচলন ছিল। বাবিলন, সুমেরীয়, এবং পারস্যরা সবাই ভেড়ার উপর নির্ভরশীল ছিল ; যদিও পোশাক শিল্পে লিলেন ছিল প্রথম বুনন কাপড়, যখন উল ছিল একটি উচ্চমূল্য পণ্য। মেষলোমের জন্য মেষপালের উন্নয়ন বৃদ্ধি ছিল আদিম শিল্পের প্রথম ধাপ,এবং ক্রমেই এটি পণ্যবিনিময় অর্থনীতির আদান-প্রদানের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়।অসংখ্য বাইবেলের পরিসংখ্যান পশুপাল রাখা সম্পর্কে বলে থাকে, এবং ইস্রায়েলের রাজারা তাদের প্রজাদের মালিকানাধীন ভেড়ার সংখ্যা অনুযায়ী কর নির্ধারণ করত। [৪]:৭

    এশিয়ায়

    পোষা পালন

    মেষ বা ভেড়া মানবজাতির দ্বারা প্রথম পোষ্য প্রাণী ( যদিও কুকুর পোষ মানানো হয় ২০,০০০ বছর আগে হতে।) ; পোষ পালনের সময় মেসোপটেমিয়ায় নয় থেকে এগারো হাজার বছর আগে বলে অনুমান করা হয়। [৪]:৪[৭]:১১–১৪[৮]:২[৯] তাদের বন্য আত্মীয়দের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল,যেমন-তুলনামূলক আগ্রাসনের অভাব, সামলানো আকার,তাড়াতাড়ি যৌন পরিপক্কতা, একটি সামাজিক প্রকৃতি, এবং উচ্চ প্রজনন হার,যা পোষ মানানোর জন্য তাদের বিশেষভাবে উপযুক্ত করে তুলেছিল। [১০]:৭৮–৮০অভিস অ্যারাইজ প্রজাতির মেষ আজ একটি সম্পূর্ণরূপে পোষা প্রাণী তে রূপান্তরিত যা তার স্বাস্থ্য এবং বেঁচে থাকার জন্য মানুষের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। বন্য ভেড়ার অস্তিত্ব আছে,(সাধারণত দ্বীপপুঞ্জ)যেখানে বড় শিকারী বর্জিত এলাকা আছে এবং যা বন্য ঘোড়া, ছাগল, শূকর, বা কুকুর এর আকারে নয়,যদিও বহু বন্য জনগোষ্ঠী দীর্ঘ সময় ধরে বিচ্ছিন্ন পরিবেশে স্বতন্ত্র প্রজাতির মতো বাস করছে। [১০]:৭৫[১১]

    গৌণ পণ্য হিসেবে,এবং নতুন প্রজাতির উন্নয়নের লক্ষ্যে এশিয়ার দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে বা ইউরোপের পশ্চিমাঞ্চলে ভেড়া পালন শুরু হয়েছিল। [১২] প্রাথমিকভাবে, ভেড়া শুধুমাত্র মাংস, দুধ ও চামড়ার জন্য রাখা হত।ইরানে পাওয়া মূর্তিসংক্রান্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন বলে লোমশভেড়া নির্বাচন খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০০ অব্দে শুরু হতে পারে,[৪]:৫[৭]:১১ এবং প্রথম উলের বোনা জামাকাপড় দুই থেকে তিন হাজার বছর পরে প্রচলন হয়েছে। [১৩]:৮ এর আগে,ভেড়া মাংসের জন্য জবাই করা হত,তখনকার সময় চামড়া পাকিয়ে/কষিয়ে পরিধানের এক ধরনের নিমা তৈরি করা হত। গবেষকরা মনে করেন এধরনের পোশাকের উন্নয়ন উর্বর অঞ্চলের চেয়ে দূরবর্তী প্রচণ্ড শীতলঅঞ্চলে মানুষের বসবাসে উৎসাহিত করে যেখানে গড় তাপমাত্রা ৭০ ডিগ্রি ফারেনহাইট (২১°C)।[১৪] ক্যাটালহইউক(Çatalhöyük) এ প্রাপ্ত ভেড়ার কর্ষণদন্ত(molars) এবং হাড়গোড় এই ধারণা দেয় যে ঐসময়ে ভেড়া ঐসব এলাকায় গৃহপালিত হতে শুরু করে।[১৫] আধুনিক প্রজাতির সবপ্রধান বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে ব্রোঞ্জ যুগের ভেড়াদের সারা পশ্চিম এশিয়া জুড়ে ব্যাপক মিল ছিল। [৪]:৬

    খৃস্টপূর্ব ৬০০০ অব্দে, প্রাচীন শহর জেইতুন এর অধিবাসীরা ভেড়া ও ছাগল তাদের প্রাথমিক গৃহপালিত পশু হিসেবে পালন করত।[১৬] এছাড়াও বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চলে যাযাবর মেষপালকের চরিত্র/ধরন সংক্রান্ত অনেক নির্দশন শনাক্তকরা হয়েছে,যার মধ্যে- ভেড়া ও ছাগলের হাড়ের প্রাদুর্ভাব দ্বারা চিহ্নিত হয়েছে, শস্য বা শস্য-প্রক্রিয়াকরণ সরঞ্জামাদির অভাব, খুব সীমিত স্থাপত্য প্রদর্শনকারী চারিত্রিকবৈশিষ্ট্যের সমষ্টি, একটি কৃষি অঞ্চলের বাইরের এলাকা, এবং আধুনিক যাযাবর মেষপালকের জীবনসংক্রান্ত জনগণের সাথে মানবজাতিসমূহের বিজ্ঞানসন্মত বিবরণের সাদৃশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। [১৭]

    আধুনিক কালে

    একজন মেষরাখাল লেজওয়ালা-মোটা মেষ[১৮] এর সাথে আফগানিস্তান এর পর্বত পাদদেশে

    মধ্যপ্রাচ্যে

    ঐসব দেশে অনেক মেষ থাকলে ও ভবঘুরে এবং আধা-ভবঘুরে প্রজাতি একদম নগণ্য যেমন- সৌদি আরবে (সম্ভবত ৩%এর কম ), ইরান (৪%), এবং আফগানিস্তান (সর্বোচ্চ ১০%)। [১৯]

    ভারতে

    ভারতে মেরিনো এবং অন্যান্য উচ্চ মানের উল ভেড়ার সঙ্গে সংকরায়নের মাধ্যমে দেশী ভেড়ার শাবকের গুণমান উন্নত করার প্রচেষ্টায় চলছে। উন্নত মানের উল ও মাংস উৎপন্ন করার লক্ষ্যে দেশী ভেড়ার উত্পাদনে এই প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।

    চীনে

    চীনে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের ভেড়া-পালনের জন্য প্রয়োজনীয় বৃহৎ খোলা চারণভূমি না থাকায় ভেড়া চীনের কৃষি অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ নয়। চীনের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের মধ্যে ভেড়ার খামার বেশি দেখা যায় যেখানে খোলা চারণভূমি রয়েছে। ‘’’ঝান’’’ নামে চীনের একটি দেশি প্রজাতির ভেড়া আছে। সরকারের প্রচার সত্ত্বেও ১৯৮৫ সাল থেকে প্রজাতিটির বংশবৃদ্ধি কমে গেছে।

    জাপানে

    জাপানি সরকার ১৮০০ সালে সর্বত্র ভেড়া বাড়াতে কৃষকদের উৎসাহিত করে। মেষ প্রতিপালনের প্রকল্প হিসেবে ইয়র্কশায়ার,বার্কশায়ার, স্প্যানিশ মেরিনো, অসংখ্য চীনা এবং মঙ্গোলিয়ান প্রজাতির ভেড়া খামারে পালনের জন্য সরকার প্রচার করে উত্সাহ দান করে। কৃষকদের জ্ঞানের অভাব ছিল যে কিভাবে সফলভাবে ভেড়া রাখা যায় এবং আমদানি করা ভেড়া সম্পর্কে তথ্য প্রদানে সরকারের ব্যর্থতা, প্রকল্পটিকে ব্যর্থ করে দেয়,১৮৮৮ সালে এটি বন্ধ হয়ে যায়।

    মঙ্গোলিয়ায়

    ভেড়া পালন সহস্রাব্দ ধরে মঙ্গোলিয়ানদের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও জীবনধারায় রূপ নিয়েছে। মঙ্গোলিয়ান ভেড়া পালনের ঐতিহ্য ও আধুনিক বিজ্ঞান ভালোভাবে বিকশিত হয়েছে। মঙ্গোলিয়ান নির্বাচন এবং পশু বিজ্ঞান দেশের শ্রেণী বিভাগ করেছে- (১) উল ফাইবার এর দৈর্ঘ্য, সূক্ষ্মতা এবং স্নিগ্ধতা, (২)বিভিন্ন উচ্চতায় বাঁচার সামর্থ্য, (গ) প্রকৃত চেহারা, পুচ্ছ আকৃতি, আকার, এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য। সবচেয়ে সাধারণ প্রজাতির ভেড়াদের মধ্যে- মোঙ্গল কালহা, গভঃ-আলতাই, বাইদ্রাগ, বায়াদ, উঝেঞ্চিন, সাম্বার এবং অন্যান্য প্রজাতির সংখ্যা, মোটা-লেজ শাবক প্রজাতি।

    দেশের সমগ্র ভেড়া পালের দেশীয় প্রাণীর একটি আদমশুমারি প্রতি বছর প্রকাশ করা হয়। ২০১৪ সালের শেষের দিকের আদমশুমারি আনুযায়ী দেশে ভেড়ার সংখ্যা ২৩ মিলিয়নের অধিক যা সমগ্র দেশে মজুত প্রাণিদের ৪৪.৬ শতাংশ ।

    বার্ষিক চান্দ্র বছরের আগে মর্যাদাপূর্ণ সরকারি পুরস্কার “বেস্ট হারডার’’ (মঙ্গোলিয়ান “Улсын сайн малчин цол” ) মনোনয়ন ও নির্বাচন করা হয়।

    আফ্রিকায়

    ইউরোপে

    আমেরিকায়

    উত্তর আমেরিকায়

    দক্ষিণ আমেরিকায়

  • কিংবদন্তি

    কিংবদন্তি

    রে নাড ফক্স, ইতিহাসের কল্পিত কিংবদন্তি

    কিংবদন্তি

    কিংবদন্তি হলো ইতিহাস ও কল্পনা র সংমিশ্রনের লৌকিক কথা সাহিত্যের চরিত্র বিশিষ্ট লোককথা.. (ল্যাটিন, legenda, “things to be read”) মানুষের কাজের বয়ান যা বক্তা এবং স্রোতা ঊভয়ের দ্বারাই মানবেতিহাসে সংঘটিত বলে মনে করা হয় এবং তাকে কিছু সুনির্দিষ্ট যোগ্যতার অধিকারী হতে হয় যাতে গল্পটির verisimilitude থাকে। কিংবদন্তির সক্রিয় এবং নিষ্ক্রিয় অংশগ্রহণকারিদের কাছে এর এমন কোন অংশ নেই যা “বাস্তবতার” জগতের বাইরের, অত্যন্ত নমনীয় বা পরিবর্তনশীল কিছু ধ্রুবক দ্বারা সংজ্ঞায়িত, যার মাঝে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে অলৌকিক ঘটনা যা সত্যিই ঘটেছিল বলে বিশ্বাস করা হয়, প্রতিবোধনের নির্দিষ্ট ঐতিহ্যের মধ্যে যেখানে কিংবদন্তিটির উদ্ভব, এবং যার মধ্যে এটি সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে পারে, এটাকে তাজা ও জীবন্ত, এবং বাস্তবসম্মত রাখার জন্য। গ্রিম ভাইরা ঐতিহাসিক পটভূমিতে স্থাপিত লোককথাকে কিংবদন্তি বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন।

    এই নিবন্ধটি অসম্পূর্ণ। আপনি চাইলে এটিকে সম্প্রসারিত করে উইকিপিডিয়াকে সাহায্য করতে পারেন।
  • কালনিরূপণবিদ্যা

    কালনিরূপণবিদ্যা

    Joseph Scaliger-এর De emendatione temporum (১৫৮৩) এর মাধ্যমে আধুনিক কালনিরূপণবিদ্যার যাত্রা শুরু হয়েছে।[

    কালনিরূপণবিদ্যা (ইংরেজি ভাষায়: Chronology) বলতে সময়কে ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে বিভিন্ন ঘটনা যে সমায়ানুক্রমে ঘটেছে সেভাবে লিপিবদ্ধ করার পদ্ধতিকে বোঝায়। মানব সভ্যতার বিভিন্ন ঘটনার কালনিরূপণ করার প্রক্রিয়া বর্ষপঞ্জির সাথে নিবিঢ়ভাবে সম্পর্কিত।

    কালনিরূপণবিদ্যা
    (Agen) Portrait de Joseph Juste Scaliger – Musée du Louvre

    বৈজ্ঞানিক কালনিরূপণবিদ্যা মহাবিশ্বের বিভিন্ন ঘটনা যে ক্রমে এবং যে সময়ে ঘটেছে তা আবিষ্কার করে পুরো ইতিহাসকে একটিমাত্র সময়ের স্কেলে সাজানোর চেষ্টা করে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর ব্যবহার দেখা যায়। যেমন, জ্যোতির্বিজ্ঞানে মহাজাগতিক ঘটনাগুলোকে হাজার বা লক্ষ লক্ষ বছরের স্কেলে বিচার করা হয়, ভূতত্ত্ব এবং জীবাশ্মবিজ্ঞানে পৃথিবী এবং প্রাণের উদ্ভব ও বিবর্তনের ইতিহাস তুলে ধরার জন্য কয়েক শত বা কয়েক হাজার বছরের স্কেল ব্যবহার করা হয়। ভূ-কালনিরূপণবিদ্যা একেবারে প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে এমনকি সভ্যতার ইতিহাস পর্যন্ত নেমে আসে, এটিও কয়েক হাজার বছরের স্কেলে কাজ করতে পারে। সব ধরনের কালনিরূপণবিদ্যার মধ্যে সবচেয়ে ছোট স্কেল ব্যবহার করা হয় মানব সভ্যতার বিভিন্ন ঘটনা লিপিবদধ করতে।

    প্রাচীন কালের মানুষরা যে ধরনের ঐতিহাসিক কালনিরূপণবিদ্যায় অভ্যস্ত ছিল তা আধুনিক কালের নিখুঁত গবেষণায় অনেক সময়ই ভুল বিবেচিত হয়। কারণ তাদের প্রক্রিয়া সম্পর্কে অনেক সময় স্পষ্ট কিছু জানা যায় না এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের কালনিরূপণের পদ্ধতিটিই খুব ঘোলাটে। সেকালের সঠিক ইতিহাস তুলে আনতে তাই অনেক সময়ই জীবাশ্ম এবং প্রত্নতত্ত্ব ব্যবহার করা হয়।[২]

    ১]

  • কারাল সভ্যতা

    কারাল সভ্যতা

    কারাল সভ্যতা বা কারাল-সুপে সভ্যতা এখনও পর্যন্ত জানা সবচেয়ে প্রাচীন আন্দীয় সভ্যতাদক্ষিণ আমেরিকার সুপ্রাচীন এই সভ্যতা বহু ক্ষেত্রে নর্তে চিকো সভ্যতা নামেও পরিচিত।[পা ১] প্রথম নামটি এসেছে পেরুর সুপে উপত্যকায় অবস্থিত কারাল অঞ্চলের নাম থেকে। এইস্থানেই এই সভ্যতার সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ স্তূপটি আবিস্কৃত হয়েছে। তাছাড়া এই অঞ্চলটি, যতদূর বোঝা গেছে, এই সভ্যতায় একটি অত্যন্ত পবিত্র স্থান বলেও বিবেচিত হত।[২] অন্যদিকে পেরুর এই অঞ্চলকে কথ্য ভাষায় বর্তমানে নর্তে চিকো (স্পেনীয়, অর্থ উত্তরের ছোট্ট স্থান) বলা হয়। তার থেকেই এই দ্বিতীয় নামটির সৃষ্টি। খ্রিস্টজন্মের ৯০০০ বছর আগেই এই সভ্যতার সূচনা হয়।[৩] তবে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ – ১৮০০ অব্দকে এই সভ্যতার সবচেয়ে বেশি বিকাশের সময় বলে মনে করা হয়।[৪] উত্তর-মধ্য পেরুর সমুদ্র উপকূলে এই সভ্যতার অন্তত ৩০টি কেন্দ্র খুঁজে পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে কারাল, আসপেরো, উয়ারিকাঙ্গা, কাবালেত, প্রভৃতি স্থলে খননকার্যের মাধ্যমে এই সভ্যতার প্রচূর নিদর্শন খুঁজে পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে রয়েছে পাথরে তৈরি সম্ভাব্য বড় বড় মন্দিরের উঁচু প্ল্যাটফর্ম, বসবাসের জন্য তৈরি বাড়ির ধ্বংসস্তূপ, বেশ কিছু ঢিবি, প্ল্যাটফর্মের উপর খাওয়াদাওয়ার চিহ্ন, হাড়ের তৈরি বেশ কিছু বাঁশি, প্রভৃতি। তবে নব্যপ্রস্তর যুগের এই সভ্যতায় ধাতুর ব্যবহার জানা ছিল না। এমনকী মৃৎপাত্র তৈরি বা ব্যবহারের কোনও নিদর্শনও এখানে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য থেকে এখানে যথেষ্ট জটিল একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপের অস্তিত্ব পরিষ্কার বোঝা যায়। কালের বিচারে এই সভ্যতার সর্বোত্তম বিকাশের সময়টি ছিল পুরনো পৃথিবীর সুমের সভ্যতার থেকে হাজার বছর পরে, কিন্তু মিশরে যে সময়ে পিরামিডগুলি নির্মাণ হয়, তার সমসাময়িক। পশ্চিম গোলার্ধের অপর প্রাচীন সভ্যতা কেন্দ্র মেসোআমেরিকার থেকে এই সভ্যতা অন্তত ২০০০ বছর প্রাচীন।[৫][৬]

    কারাল সভ্যতা
    OLYMPUS DIGITAL CAMERA

    পৃথকভাবে সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল, পৃথিবীর এমন ছটি কেন্দ্রের অন্যতম ও আমেরিকা মহাদেশের সবচেয়ে পুরনো নগরসভ্যতা এই কারাল সভ্যতার কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। সাধারণভাবে অত্যন্ত শুষ্ক এই অঞ্চলের বুক দিয়ে বয়ে গেছে সুউচ্চ আন্দিজ পর্বতমালা থেকে নেমে আসা প্রায় ৫০টি ছোট ছোট নদী। এদের ধার বরাবর প্রতিষ্ঠিত এই সভ্যতার কেন্দ্রগুলিরও মূল ভিত্তি ছিল কৃষি। কিন্তু তারা চাষ করতো কোনও খাদ্যদ্রব্য নয়, মূলত তুলো। সেই তুলো দিয়ে মাছ ধরার জাল তৈরি করে সরবরাহ করা হত সমুদ্রতীরে অবস্থিত এই সভ্যতার কেন্দ্রগুলিতে। এই কেন্দ্রগুলিতে সংগৃহীত মাছ ও সামুদ্রিক নানা খাদ্যদ্রব্যই ছিল এই সভ্যতার মানুষের মূল খাদ্যদ্রব্য। জালের সাথে মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক খাদ্যদ্রব্যের বিনিময়ই ছিল সেই অর্থে এই সভ্যতার ভিত্তি। অবশ্য সঙ্কীর্ণ নদী উপত্যকাগুলিতে কিছু ফল ও সব্জিচাষের নিদর্শনও পাওয়া যায়। এই ধরনের সভ্যতার অন্য কোনও প্রাচীন নিদর্শনের কথা এখনও পর্যন্ত জানা নেই।[৫]

    আজ থেকে প্রায় ৩৮০০ বছর আগে ভূমিকম্প বা এল নিনো জাতীয় কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এই সভ্যতার পতন ঘটে বলে মনে করা হয়। অবশ্য অতি সাম্প্রতিক গবেষণায় এ’জন্য কৃষিব্যবস্থার প্রচলন ও এই অঞ্চলের অনুর্বর জমি ও কৃষির প্রতিকূল আবহাওয়াকেও যথেষ্ট পরিমাণে দায়ী করা হয়।[৭]

    আবিষ্কার

    পেরুর মানচিত্রে কারাল সভ্যতার তিনটি বড় বড় কেন্দ্র আসপেরো, কারাল ও এল পারাইসো’র অবস্থান সূচীত হয়েছে।

    ১৯০৫ সালেই পেরুর সমুদ্রতীরে ও কিছুটা অভ্যন্তরে সুপে উপত্যকায় এই সভ্যতার কিছু নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। সেই হিসেবে সমুদ্রতীরে আসপেরো ও সমুদ্র থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরে কারালে প্রাচীন এই সভ্যতার নিদর্শনের কথা ১৯৪০’এর আগেই প্রত্নতাত্ত্বিক মহলে যথেষ্ট সুপরিচিতই ছিল। কিন্তু সেই সময় এই নিদর্শনগুলির উপর তেমন কিছু গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি।[৮] সে’ সময় বিশেষ করে আসপেরোতে প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদদের মনে হয়েছিল নব্যপ্রস্তরযুগের এই মানুষরা এমনকী কৃষিকাজও জানতো না। ১৯৭৩ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদ মাইকেল ই. মোজলি’র নেতৃত্বে আসপেরোতে যে খননকার্য চলে তাতেও মোটের উপর এই মতই সমর্থিত হয়। কিন্তু ১৯৯০’এর দশকে পেরুভীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ রুথ শেডি সলিস‘এর নেতৃত্বে সুপে উপত্যকায় কারাল ও অন্যান্য স্থানে যে ব্যাপক খননকার্য চালানো হয়, ২০০১ সালে তা প্রবন্ধাকারে প্রকাশিত হলে এই সভ্যতার প্রাচীনত্ব, উন্নতি ও ব্যাপকতা সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের ধারণা জন্মায়।[৯] ফলে আন্দীয় সভ্যতার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে পূর্বের ধারণা অনেকটাই বদলে যায়। বোঝা যায় এই অঞ্চলে মানবসভ্যতা আরও অনেকটাই বেশি প্রাচীন। পূর্ববর্তী ধারণা অনুযায়ী যে চাভিন সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে এতদিন এই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতার মর্যাদা দেওয়া হত, কারাল সভ্যতার আবিষ্কার প্রমাণ করে এই অঞ্চলে মানব সভ্যতার বয়স তার থেকে হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। রেডিওকার্বন পরীক্ষাতেও কারাল সভ্যতার এই প্রাচীনত্বর প্রমাণ মেলে।[৩] তাছাড়া দেখা যায় এর উদ্ভব আন্দিজ পর্বতের কোনও উঁচু অঞ্চলে নয়, বরং সমুদ্র উপকূলের অপেক্ষাকৃত নিচু উপত্যকা অঞ্চলে। এছাড়া প্রায় ২০০ কিলোমিটার উত্তরে কাসমা উপত্যকার সেচিন’এ বার্লিনের ফ্রাইয়ে (মুক্ত) বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদরা ১৯৯২ সাল থেকে যে খননকার্য চালিয়ে যাচ্ছেন, সেখানেও এই সভ্যতার যোগসূত্র পাওয়া গেছে।[১০] এর থেকে কারাল সভ্যতার ব্যাপ্তি সম্বন্ধে ধারণাও আজ আরও স্পষ্ট হয়েছে। এই সবকিছু মিলিয়ে কারাল সভ্যতার গুরুত্ব আজ ঐতিহাসিকদের কাছে অনস্বীকার্য।

    ভৌগোলিক অবস্থান

    পেরুর প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলের উত্তর-মধ্য অঞ্চলে নর্তে চিকো অঞ্চলের অবস্থান, রাজধানী লিমা থেকে ১৫০ – ২০০ কিলোমিটার উত্তরে। এর দক্ষিণে লুরিন উপত্যকা ও উত্তরে কাসমা অঞ্চল। চারটি উপকূলীয় উপত্যকা উয়াউরা, সুপে, পাতিভিলচা ও ফোর্তালেজা নিয়ে এই অঞ্চলটি গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে শেষের তিনটি উপত্যকা সমুদ্র উপকূল দিয়ে পরস্পর যুক্ত। কিন্তু এদের মিলিত আয়তন মাত্র ১৮০০ বর্গকিলোমিটার । অথচ এই স্বল্প জায়গাতেই কারাল সভ্যতার অনেকগুলি কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এর থেকে বিশেষজ্ঞরা এই সভ্যতার যথেষ্ট ঘন জনবিন্যাসের কথা আন্দাজ করে থাকেন।[১১]

    পেরুর এই উপকূলীয়় অঞ্চল প্রচণ্ড শুষ্ক একটি অঞ্চল। পূর্বে আন্দিজ পর্বতমালার অবস্থান ও পশ্চিমে সমুদ্র অভিমুখী প্রশান্ত মহাসাগরীয় বাণিজ্যবায়ু প্রবাহের ফলে এই অঞ্চলে একটি সঙ্কীর্ণ বৃষ্টিচ্ছায়া অঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তাই এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত যথেষ্ট কম। মাটিও অনুর্বর। তার উপর এই সঙ্কীর্ণ উপকূলীয় উপত্যকা অঞ্চলের মধ্য দিয়ে পূর্বের সুউচ্চ আন্দিজ পর্বতমালা থেকে নেমে আসা বরফ গলা জলে পুষ্ট অন্তত ৫০টি ছোট ছোট নদী বয়ে গেছে। ফলে উপত্যকাটি জায়গায় জায়গায় পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। এইসব দিক বিবেচনা করে দেখলে পৃথিবীর অন্যত্র যেসব অঞ্চলে এইরকম সুপ্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তাদের সাথে এই অঞ্চলের মিল যথেষ্ট অল্পই।[১২] তবু এই সব নদী থেকেই ছোট ছোট খাল কেটে এখানে সেচের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। এই অঞ্চলে মানুষের হাতে তৈরি যেসব স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষ এখনও দেখতে পাওয়া যায় ; দেখা যায় সেগুলিও বেশির ভাগই এইসব সেচখালের আশেপাশেই নির্মিত। এর থেকে বোঝা যায় এইসব ছোট ছোট নদী ও খালগুলি কারাল সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশের ক্ষেত্রে একরকম প্রাণভোমরার কাজ করেছিল।[১৩]

    ঐতিহাসিক গুরুত্ব

    কারালের একটি পিরামিড, কাছ থেকে

    রেডিওকার্বন পরীক্ষার দ্বারা জানা গেছে, এই সভ্যতার বেশ কিছু নিদর্শনই (পরীক্ষার জন্য গৃহীত ৯৫টি নিদর্শনের মধ্যে অন্তত ১০টি) এমনকী ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের অর্থাৎ আজ থেকে ৫৫০০ বছরের চেয়েও প্রাচীন। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরনোটি ৯২৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। তবে তা থেকে শুধু নব্যপ্রস্তরযুগের মানুষের বসতির কিছু ইঙ্গিতের চেয়ে বেশি কিছু খুব বোঝা যায় না। কিন্তু যে দুটি ক্ষেত্রে নিদর্শনগুলির বয়স নির্ধারিত হয়েছে ৩৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, সেগুলি থেকে সামাজিক স্থাপত্যের কিছু ইঙ্গিত মেলে। তবে ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ সময় থেকে সামাজিকভাবে নির্মিত ও ব্যবহৃত মানুষের হাতে তৈরি স্থাপত্যর পরিমাণ যথেষ্ট পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায়। এর থেকে চার্লস মান প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদেরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে হয়তো ৩৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্বেই, না হলেও ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগেই নিশ্চিতভাবে এখানে সভ্যতার উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটেছিল।[১২] ফোর্তালেজা উপত্যকার উয়ারিকাঙ্গায় প্রাপ্ত উল্লেখযোগ্য বসতিটির বয়স জোনাথন হাস প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদরা ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নির্ধারণ করায় এখন সাধারণভাবে ওই সময়কেই কারাল সভ্যতার উন্মেষের নির্দিষ্ট সময় হিসেবে ধরা হয়।

    উঁচু প্ল্যাটফর্ম বা বেদী, কারাল

    রেডিওকার্বন পরীক্ষা থেকে আরও জানা গেছে, প্রথম দিকে এই সভ্যতার সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলগুলি ও দেশের অভ্যন্তরের অঞ্চলগুলি সমান্তরালেই বিকাশলাভ করছিল। কিন্তু ২৫০০ – ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ সময়কালে, এই সভ্যতার সবচেয়ে ব্যাপ্তির সময়ে, দেশের অভ্যন্তরের বিভিন্ন কেন্দ্রগুলিরই বেশি উন্নতি ঘটতে দেখা যায়। এই কেন্দ্রগুলির এই সময় জনসংখ্যা বৃদ্ধিরও যথেষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কারাল, প্রভৃতি দেশাভ্যন্তরের কেন্দ্রগুলির এইসময়েই উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। তবে উপকূলীয় অঞ্চলের উপর মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক খাদ্যের উপর এরা তখনও যথেষ্টই নির্ভরশীল ছিল।[৩] এর একটি সম্ভাব্য কারণ হয়তো এই অঞ্চলের উপকূল অংশে প্রায়শই এল নিনোজনিত সুদীর্ঘকালীন তীব্র খরার প্রাবল্য, আবার কখনও বা হঠাৎ হঠাৎ সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছাস; এর ফলেই হয়তো অধিবাসীরা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পরবর্তীকালে কিছুটা দেশের অভ্যন্তরে একটু উঁচু জায়গায় বসতিস্থাপন করে। কিন্তু খাদ্যের জন্য তাদের সমুদ্র নির্ভরতা থেকে যাওয়ায় সমুদ্র থেকে খুব দূরে তারা সরে যায়নি।

    ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ এই সভ্যতার কেন্দ্রগুলি পরিত্যক্ত হয়। এর সঠিক কারণ এখনও জানা যায়নি। একদল মনে করেন, ভূমিকম্প, এল নিনো বা এই জাতীয় কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই এর কারণ। আবার অপর দলের মতে উপকূল অঞ্চল বরাবর উত্তরে ও দক্ষিণে ও পূর্বে আন্দিজ পর্বতের উচ্চভূমিতে এইসময় আরও কতগুলি শক্তিশালী কেন্দ্রের উত্থান লক্ষ্য করা যায়। এইসব অঞ্চলে, বিশেষ করে উত্তরে নানা খালের চিহ্ন দেখে বুঝতে পারা যায়, সেচনির্ভর কৃষিব্যবস্থা সেখানে গড়ে উঠেছিল। ফলে কারাল সভ্যতার মানুষ হয়তো বেশি খাদ্য নিরাপত্তাজনিত কারণেই এইসময় তাদের পুরনো অঞ্চল ছেড়ে আরও উর্বর অঞ্চলের দিকে সরে যায়, আর সঙ্গে নিয়ে যায় তাদের এতদিনের সঞ্চিত সেচনির্ভর কৃষিব্যবস্থার জ্ঞান।[৭]

    খাদ্যাভ্যাস

    কারাল সভ্যতার মানুষের খাদ্যাভ্যাস সম্বন্ধে যা সুনির্দিষ্টরূপে জানতে পারা গেছে, তা নিম্নরূপ –

    1. রুথ শেডি সলিস কারালে খননকার্য পরিচালনার সময় খননস্থল থেকে সেইসময়ে ব্যবহৃত কিছু কিছু শস্যফল উৎপাদনকারী ও কন্দজাতীয় উদ্ভিদের অস্তিত্বর প্রমাণ পান। এগুলি হল স্কোয়াশ, কয়েকরকমের বিনস, পেয়ারা, লুকুমা, মিষ্টি আলু, প্রভৃতি।[১৪] পরবর্তীকালে জোনাথন হাস প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদরা আরও উত্তরে কিছু খননস্থলেও এই উদ্ভিদগুলির খোঁজ পান। তার সঙ্গে তারা আভোকাডো, আচিরা, প্রভৃতি আরও কিছু উদ্ভিদের ব্যবহারেরও প্রমাণ পান। বর্তমানে এই সভ্যতার বিভিন্ন খননস্থলগুলি থেকে সে’ সময় মেইজেরও যে প্রচলন ছিল, তা নিশ্চিতভাবেই জানতে পারা গেছে।[১৫]
    2. কিন্তু সামুদ্রিক বা সমুদ্রজাত খাদ্যের আধিক্য এই সভ্যতার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। সমুদ্রোপকূল ও দেশাভ্যন্তর – সর্বত্রই এই ধরনের খাদ্য ব্যবহারের যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। কারালে খননকার্য চলাকালীন রুথ শেডি সলিস লক্ষ্য করেন “অসংখ্য প্রাণীজ ভুক্তাবশেষ, যার প্রায় পুরোটাই সামুদ্রিক”। এর মধ্যে শামুক বা ঝিনুকের খোল থেকে শুরু করে অ্যাঙ্কোভি, সার্ডিন, প্রভৃতি মাছের কাঁটা ও হাড়, প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।[১৪] বিশেষ করে অ্যাঙ্কোভি মাছের অবশেষ থেকে পরিষ্কার যে এই মাছ দেশাভ্যন্তরেও খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হত।[১২] এর থেকে সাধারণভাবে মনে করা হয়, এই সভ্যতার মানুষ খাদ্যের জন্য মূলত সমুদ্রজাত বিভিন্ন খাদ্যের উপরই নির্ভর করতো। অবশ্য জোনাথন হাস প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদ সমুদ্রজাত খাদ্যনির্ভরতার এই তত্ত্বের সাথে সাহমত্য প্রকাশ করেননি।[১১]
    3. ১৯৯০’এর দশকের অনুসন্ধানের ফলে কারাল সভ্যতার ব্যাপ্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগেই আসপেরো, প্রভৃতি সমুদ্রোপকূলের প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চলগুলিতে অনুসন্ধানের ফলে মাইকেল এডওয়ার্ড মোজলি প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এই সভ্যতার মূল ভিত্তি ছিল সমুদ্রজাত খাদ্য। শস্যজাতীয় খাদ্য সিদ্ধ করার উপযোগী কোনওরকম মৃৎপাত্রের অনুপস্থিতি তাদের এই সিদ্ধান্তকেই আরও জোরদার করে। খনন অঞ্চলে উঁচু প্ল্যাটফর্মের উপর পাওয়া ছোট ছোট ঢিবি বা স্তূপ থেকে তারা আন্দাজ করেন এগুলি আসলে প্রাণীজ খাদ্য প্রক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত উনুনজাতীয় বস্তুরই অবশেষ মাত্র।[৮]

    দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থলে উল্লিখিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রত্নতত্ত্ববিদদের মধ্যে ‘আন্দীয় সভ্যতার সমুদ্রনির্ভরতা‘র তত্ত্ব[১৬][১৭] বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আবার তা তাদের মধ্যে তীব্র বিতর্কেরও জন্ম দেয়। কারণ সাধারণভাবে দেখা গেছে, কোনও জায়গায় সভ্যতার উত্থানের পিছনে সেখানকার মানুষের কৃষিনির্ভরতা, বিশেষ করে অন্তত একটি শস্যের ব্যাপক চাষের ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। কারণ উদ্বৃত্ত খাদ্য ব্যতীত জনঘনত্ব বৃদ্ধি ও কিছু সংখ্যক মানুষের সরাসরি খাদ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়ার বাইরে থাকার সুযোগ তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। ফলে অপেক্ষাকৃত জটিল সমাজব্যবস্থার উদ্ভবের জন্য অন্তত একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত কৃষির উন্নতি খুবই প্রয়োজন। এই কারণেই ‘আন্দীয় সভ্যতার সমুদ্রনির্ভরতা’র তত্ত্ব ঐতিহাসিকদের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদের জন্ম দেয়। তবে চার্লস মান প্রমুখ বিশেষজ্ঞ এই তত্ত্বর সত্যতার সম্ভাবনার পক্ষেই মতপ্রকাশ করেছেন।[১২]

    উপকূল ও দেশাভ্যন্তর

    এই সভ্যতার খাদ্যাভ্যাস সংক্রান্ত বিতর্কের সাথে সাথেই প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে আরেকটি বিতর্কও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে – উপকূল না দেশাভ্যন্তর, এই সভ্যতার মূল কেন্দ্র ছিল কোথায়? মোজলি প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদদের প্রস্তাবিত আন্দীয় সভ্যতার সমুদ্রনির্ভরতার তত্ত্ব অনুসারে এই সভ্যতার মূল কেন্দ্র হওয়া উচিত ছিল সবসময়েই সমুদ্রোপকূলবর্তী অঞ্চল। কিন্তু বিশেষ করে ৯০’এর দশকে কারাল অঞ্চলে ব্যাপক খননকার্য ও বিরাট একটি শহরের আবিষ্কার এই তত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয়। সমুদ্র থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরের এই শহরটি শুধুমাত্র পেরুর নয়, সমগ্র আমেরিকা মহাদেশের মধ্যেই প্রাচীনতম।[৯] এর উপর ভিত্তি করেই ঐতিহাসিকরা এই অঞ্চলের সম্ভাব্য কৃষিজ উৎপাদনের উপর জোর আরোপ করা শুরু করেন ও তার সাক্ষপ্রমাণ খুঁজে বের করার তাগিদও তাদের মধ্যে জোরদার হয়ে ওঠে। তবে রেডিওকার্বন পরীক্ষায় দেখা যায় আসপেরো প্রভৃতি সমুদ্রোপকূলবর্তী কিছু কিছু অঞ্চল তুলনায় প্রাচীনতর।[১২] এর থেকে অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদই মতপ্রকাশ করেন যে এই সভ্যতার সূচনা প্রথমে সমুদ্রোপকূলবর্তী অঞ্চলে হয়ে থাকলেও পরে তা ধীরে ধীরে দেশাভ্যন্তরে সরে আসে। অর্থাৎ, পরের দিকে কৃষিব্যবস্থার কিছু প্রসার ঘটলেও অন্তত এই সভ্যতা গড়ে ওঠার সময়ে সমুদ্রজাত খাদ্যনির্ভরতাই ছিল প্রধান।[১৮] ফলে নতুন করে বিতর্ক চাগিয়ে ওঠে, ভিতরের বড় বড় কেন্দ্রগুলি উপকূলের কেন্দ্রগুলির উপর নির্ভরশীল ছিল, না উপকূলীয় ছোট ছোট গ্রামগুলিই আসলে ছিল অভ্যন্তরের বড় বড় কেন্দ্রগুলির নিছক বাইরের দিকের উপগ্রহমাত্র।[১৩]

    তুলো

    তবে একটা বিষয় সম্বন্ধে আজ ঐতিহাসিকরা অনেকটাই নিশ্চিত। শুরুতে যদি নাও হয়, পরে অন্তত উপকূলীয় অঞ্চলগুলির চেয়ে এই সভ্যতার ভরকেন্দ্র স্থলভাগের অভ্যন্তরের কেন্দ্রগুলিতেই স্থানান্তরিত হয়। এর এক প্রধান কারণ ছিল তুলো (Gossypium barbadense; গসিপিয়াম বারবাডেন্স প্রজাতির)।[১১][১২] তুলো যদিও খাওয়া যায় না, কিন্তু এর থেকে তৈরি সুতো দিয়ে প্রস্তুত জাল ছাড়া সমুদ্রজাত খাদ্য সংগ্রহ ও মাছ ধরা অসম্ভব। তারউপর নানা ধরনের কাপড়, পোশাক ও থলি তৈরিতেও তুলো অপরিহার্য। এছাড়া একধরনের লম্বা ঘাস দিয়েও শক্ত থলি তৈরি হত, বিভিন্ন নির্মাণের ক্ষেত্রে পাথর বওয়ার কাজে যা ব্যবহৃত হত। কারাল অঞ্চলের খননকার্যে এইধরনের তৃণনির্মিত থলির নিদর্শন পাওয়া গেছে।[১৯] অর্থাৎ, দেশাভ্যন্তরের বিভিন্ন কেন্দ্রগুলির মূল ভিত্তি ছিল এই তুলো ও ঘাসের চাষ ও তার থেকে নানাধরনের প্রয়োজনীয় জাল, কাপড়, থলি, প্রভৃতির উৎপাদন বজায় রাখা। অন্যদিকে উপকূলীয় কেন্দ্রগুলির মূল উৎপাদন ছিল মাছ ও সমুদ্রজাত খাদ্য, যার উপর স্থলাভ্যন্তরের কেন্দ্রগুলিও নির্ভরশীল ছিল। বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণের উপর নির্ভর করেই বর্তমানে উপকূল ও দেশাভ্যন্তরের কেন্দ্রগুলির এই পারস্পরিক নির্ভরতার তত্ত্বই জোরদার হয়ে উঠেছে।

    সমাজ ও রাজনীতি

    যেহেতু এই সুপ্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কিত প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ ব্যতীত আর কোনও ঐতিহাসিক উপাদানই আমাদের হাতে এসে পৌঁছয়নি, তাই কারাল সভ্যতার মানুষের সমাজ, সামাজিক সংগঠন, রাজনীতি, প্রশাসন, ধর্মাচরণ, অর্থনীতি, প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমাদের জ্ঞান স্বভাবতই সীমিত। প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলিকে যথাসম্ভব বিশ্লেষণ করে এইসব ক্ষেত্রে প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকরা যতটুকু তথ্য আহরণ করতে এখনও পর্যন্ত সক্ষম হয়েছে তা নিয়ে নিচে আলোচনা করা হল।

    এখন প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে মূলত তিন ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে পরোক্ষে মানব পরিচালিত প্রশাসনের উদ্ভবের আন্দাজ করা হয়ে থাকে। এগুলি হল –

    1. অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রমাণ
    2. ধর্মীয় আচার ও রীতিনীতি পালনের প্রমাণ
    3. প্রশাসনিক বাহুবলের প্রত্যক্ষ উপস্থিতির প্রমাণ

    জোনাথন হাস প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদ কারাল সভ্যতায় এগুলির অন্তত দুটির যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করেন। সেইদিক দিয়ে এই সভ্যতাকে প্রাচীন পৃথিবীর সুপ্রাচীন দুই সভ্যতা (অন্যটি হল সুমের), যেখানে সম্পূর্ণ নিজস্ব ঘরানায় স্বতন্ত্রভাবে প্রশাসনের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে, তাদের অন্যতম বলে মেনে নিতে হয়। অবশ্য সমস্ত প্রত্নতত্ত্ববিদদের পক্ষে এই বিষয়ে এখনও ঐকমত্য্য গড়ে ওঠেনি।[১২]

    প্রশাসন

    চার্লস মান প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদ মতপ্রকাশ করেছেন যে কারাল সভ্যতার প্রশাসন ছিল মূলত ধর্মভিত্তিক। সেখানে বিভিন্ন নির্মাণস্থল ও প্ল্যাটফর্মগুলিতে নিয়মিত ভোজসভার ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া গেছে, যেখানে গানবাজনা ও সম্ভবত সুরার প্রচলনও ছিল[পা ২]; এর থেকে আন্দাজ করা যায় সমাজে ইতোমধ্যেই এমনধরনের একটি অভিজাত নাগরিক সমাজ গড়ে উঠেছিল, যারা নিত্যপ্রয়োজনীয় দৈনন্দিকতার বাইরে গিয়েও কোনও উৎসব উপলক্ষে কোথাও জড়ো হতে পারত এবং সেই উৎসবে কিছুটা প্রাচূর্যর চর্চাও দেখা যেত। অর্থাৎ সমাজে উৎপাদনশীলতা ইতোমধ্যেই সেই প্রাচূর্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল।[১২] স্বভাবতই আন্দাজ করা যায়, এই প্রাচূর্যটুকু মূলত সমাজের সুবিধেভোগী ও ক্ষমতাবান অংশই ভোগ করতে সক্ষম ছিল। এর থেকে সমাজে একধরনের কর্তৃত্বর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। এই কর্তৃত্বর আরও ইঙ্গিত পাওয়া যায়, বিভিন্ন বড় বড় নির্মাণগুলিকে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করলে। এগুলির মধ্যে কতগুলি হল বিরাট, তৈরি হয়েছিল ধীরে ধীরে, দীর্ঘদিন ধরে; আবার কতগুলি, যেমন কারালে পাওয়া বিশাল প্ল্যাটফর্মগুলি, তৈরি হয়েছিল এক কি দুই দফায়।[১৪] কিন্তু এই উভয় ক্ষেত্রেই এই ধরনের নির্দিষ্ট ও বিপুল কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য দরকার প্রচূর শ্রমিকের এবং নির্দিষ্ট পরিকল্পনাভিত্তিক সংগঠনের। তাছাড়া অল্পসময়ের মধ্যে কোনও নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে নির্দিষ্টরূপের বিপুল নির্মাণকার্য কখনওই সম্ভব নয়, আবার দীর্ঘকাল ধরে একটি নির্দিষ্ট নির্মাণকার্য পরিচালনাও একরকম অসম্ভব। অর্থাৎ এই সব বৃহৎ পিরামিড, সৌধের ভগ্নাবশেষ, স্তূপ ও প্ল্যাটফর্মগুলির অস্তিত্বই জানান দেয় কারাল সভ্যতায় একধরনের শক্তিশালী কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের বিকাশ ঘটেছিল, যদিও সেখানে প্রশাসনিক কেন্দ্রিকতার কতটা বিকাশ ঘটেছিল তা বলা সম্ভব নয়। এছাড়াও উপাকাপাতিভিলচা খননস্থলদুটিতে কিছু গুদামজাতীয় নির্মাণের নিদর্শন খুঁজে পাওয়া গেছে, যেগুলিতে সম্ভবত তুলো বা এইধরনের সে’সময়ের মূল্যবান সামগ্রী সঞ্চিত করে রাখা হত। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে এও কারাল-সুপে সমাজে শক্তিশালী কর্তৃপক্ষের উপস্থিতির এক অকাট্য প্রমাণ।[১২]

    অর্থনীতি

    হাস, ক্রিমার, প্রমুখ বিশেষজ্ঞের মতে কারাল সভ্যতার অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল তুলো ও অন্যান্য খাদ্য উৎপাদনকারী উদ্ভিদের চাষ ও তা থেকে উৎপন্ন ফসলের উপর নিয়ন্ত্রণ এবং এগুলি নিয়ে বাণিজ্যের ক্রমবিস্তার। স্বভাবতই এইভাবে বিকশিত ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল এই সভ্যতার দেশাভ্যন্তরের বিভিন্ন কেন্দ্রগুলি। হাস বলেছেন, কারাল-সুপে সভ্যতার সমুদ্রতীরবর্তী বড় কেন্দ্র হিসেবে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে মাত্র দুটি প্রত্নস্থলকে – আসপেরোবান্দুরিয়া। এছাড়া আরও দুটি কেন্দ্রকেও হয়তো একই মর্যাদা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু তুলো থেকে তৈরি মাছ ধরার জাল ও খাদ্য উৎপাদনকারী উদ্ভিদের চিহ্ন পেরুভীয় উপকূল রেখা ধরে উত্তরে ও দক্ষিণে বিস্তৃত এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে খুঁজে পাওয়া গেছে। এর থেকে বোঝাই যায় এগুলিকে ভিত্তি করে একটি বড় ধরনের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড চলত। হয়তো বা দেশাভ্যন্তরের বড় বড় কেন্দ্রগুলিই এই বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্র ছিল।[১১]

    অন্যদিকে রুথ শেডি সলিসের লাগাতার গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে কারালকে কেন্দ্র করে কারাল ও আসপেরোতে উৎপাদিত বস্তু পণ্য হিসেবে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রফতানি করা হত ও বিনিময়ে বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী আমদানিও করা হত। এগুলির মধ্যে আমাজন অঞ্চল থেকে আনা ধোঁয়াহীন ঝিমুনি তামাক, ইকুয়েডরের সমুদ্রোপকূল থেকে আনা স্পন্ডাইলাস জাতীয় ঝিনুকের খোল, আন্দিজের উচ্চভূমি থেকে আনা উন্নত ধরনের রঙ, প্রভৃতি ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[২০] শেডির কাজ থেকে আরও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, মহাদেশের আরও অভ্যন্তরে জঙ্গল এলাকার অধিবাসী, এমনকী উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের সাথেও কারালের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল।[২১] অবশ্য এই বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলার মতো প্রমাণ এখনও হাতে আসেনি।

    ধর্ম ও নেতৃত্ব

    প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ থেকে যেটুকু আন্দাজ করা যায়, তা হল কারাল সভ্যতায় ধর্মর স্থান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসনিক ব্যবস্থার ভিত্তিও ছিল অনেকাংশেই ধর্মই। এই সভ্যতার নেতৃত্ব ছিল সম্ভবত পুরোহিতদের হাতেই। দেবতা ও অতিপ্রাকৃত শক্তির সাথে তাদের যোগাযোগের আপাত ক্ষমতাই ছিল তাদের প্রতিপত্তির মূল।[১১] তবে স্বভাবতই কারাল সভ্যতায় প্রচলিত ধর্ম সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এখনও পর্যন্ত খুবই সীমিত। খ্রিস্টপূর্ব ২২৫০ – ২৫০০ অব্দ নাগাদ সময়ের একটি প্রাচীন লাউ’এর খোল শুধু পাওয়া গেছে[২২], যাতে দুই হাতে দণ্ডধারী এক মূর্তি অঙ্কিত আছে; এই ধরনের দণ্ডধারী দেবমূর্তি কাছাকাছি অঞ্চলের পরবর্তী বিভিন্ন আন্দীয় সভ্যতাতেও দেখতে পাওয়া যায়; তার থেকেই প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, কারাল সভ্যতাতেও এই দেবতা পূজিত হত। উইনিফ্রেড ক্রিমার দাবি করেন, এই মূর্তি যে সত্যিই ঐ সভ্যতায় পূজিত দেবমূর্তি, তার নানা লক্ষণ পরিস্ফূট।

    পাদটীকা

    এই দুই নাম নিয়ে বিতর্ক আছে। ৯০’এর দশকে যাঁর নেতৃত্বে এই সভ্যতার উপর সবচেয়ে বেশি কাজ হয় সেই পেরুভীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ ডঃ রুথ শেডি সলিস এই সভ্যতাকে কারাল সভ্যতা বলে অভিহিত করেন। অন্যদিকে এই কাজে তাঁর সহযোগী মার্কিন প্রত্নতত্ত্ববিদ জোনাথন হাস ও উইনিফ্রেড ক্রিমার এই সভ্যতাকে নর্তে চিকো সভ্যতা বলে অভিহিত করেন। যেহেতু দ্বিতীয়দলের মতামত নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে,[১] এখানে সাধারণভাবে এই সভ্যতাকে কারাল সভ্যতা বলেই উল্লেখ করা হচ্ছে।

    1. কারালে খননকার্য চালাতে গিয়ে ঐ প্ল্যাটফর্ম সংলগ্ন অঞ্চল থেকে রুথ শেডি সলিসের দল হাড়নির্মিত ৩২টি বাঁশির একটি সম্পূর্ণ সেট উদ্ধার করে। এর থেকে বোঝা যায় সমাজে গানবাজনার যথেষ্ট চলই ছিল এবং এই প্ল্যাটফর্মগুলি কিছুটা উৎসবস্থল হিসেবেও ব্যবহৃত হত। এছাড়া ওই একই অঞ্চলে ৩৭টি শিঙা জাতীয় বস্তুও খুঁজে পাওয়া গেছে। এর থেকে সুরাপানের বিষয়টিরও কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়।[২০][২১]

    তথ্যসূত্র

  • একেসো

    একেসো

    একেসো উপজাতির একটি নিদর্শন

    একেসো
  • উত্তর হিসপানিয়া

    উত্তর হিসপানিয়া

    উত্তর হিসপানিয়া বা নিকট হিসপানিয়া (লাতিন ভাষাHispania Citerior; স্পেনীয় ভাষাHispania Cercana, উচ্চারণ – ইসপানিয়া থেরকানা) বর্তমান স্পেনের উত্তরপূর্ব অঞ্চলে ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী একটি রোমান প্রদেশ। দ্বিতীয় পুনিক যুদ্ধে কার্থেজীয়দের কাছ থেকে ইবেরীয় উপদ্বীপের কর্তৃত্ব রোমান প্রজাতন্ত্রের হাতে আসার পর খ্রিস্টপূর্ব ১৯৭ অব্দে রোমানরা পিরেনিজ পর্বতের দক্ষিণে উপদ্বীপের তাদের নিজেদের কর্তৃত্বাধীন অঞ্চলকে প্রশাসনিকভাবে দু’টি প্রদেশে ভাগ করে। এর মধ্যে উত্তরের, অর্থাৎ রোম থেকে অপেক্ষাকৃত নিকট প্রদেশটির নাম দেওয়া হয় “নিকট হিসপানিয়া” বা “উত্তর হিসপানিয়া”। এই প্রদেশটি উত্তরে পিরেনিজ থেকে উপদ্বীপের পূর্ব উপকূল ধরে বর্তমান স্পেনের উপকূলীয় শহর কার্তাখেনা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।[১][২]

    উত্তর হিসপানিয়া

    এই প্রদেশের প্রশাসনিক কেন্দ্র নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কিছু বিতর্ক আছে। আগে মনে করা হত এই প্রদেশের প্রধানদপ্তর প্রথমে কার্তাখেনা নোভা (বর্তমান কার্তাখেনা) থেকে পরিচালিত হলেও পরে সিজার অগাস্টাসের সময়ে তা তারাকো শহরে (বর্তমান তারাগোনা) স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু এখন মনে করা হয়, প্রথম থেকেই প্রশাসনিক দপ্তর হিসেবে কার্তাখেনার পাশাপাশি তারাকোকেও ব্যবহার করা হত।[৩] রোমান ভৌগোলিক স্ট্রাবোর লেখাও এর সাক্ষ্য বহন করে। [৪] পরবর্তীকালে প্রজাতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটলে সিজার অগাস্টাসের সময় উত্তর হিসপানিয়াও একটি রাজতান্ত্রিক প্রদেশে রূপান্তরিত হয়। এইসময় তারাকো থেকেই এর প্রশাসন পরিচালিত হওয়ায় একে হিসপানিয়া তারাকোনেনসিস নামেও অভিহিত করা হতে থাকে। তবে সরকারিভাবে তখনও পর্যন্ত হিসপানিয়া থিতেরিওর বা নিকট হিসপানিয়া নামটিই বজায় ছিল।[৫] এই প্রদেশের অন্যান্য শহরের মধ্যে সাগুন্তুম (বর্তমান নাম সাগুন্তো, ভ্যালেন্সিয়া শহরের উত্তরে অবস্থিত) ও ইয়েরদা (বর্তমান ইয়েইদা) উল্লেখযোগ্য।

    হিসপানিয়া থিতেরিওরের রোমান প্রশাসন এই প্রদেশের পশ্চিমে বসবাসকারী থেলতিবেরীয়দের সাথে বারেবারে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এর ফলে পশ্চিমের বিভিন্ন অঞ্চলেও রোমের কর্তৃত্ব ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে। সম্রাট অগাস্টাস খ্রিস্টপূর্ব ২৭ অব্দে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হলে রোমের অধীন বিভিন্ন প্রদেশগুলিকে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়। এইসময়ে হিসপানিয়া থিতেরিওরের সাথে আরও বেশ কিছু অঞ্চল যুক্ত করা হয় এবং সেই বৃহত্তর প্রদেশটিকে সাধারণভাবে হিসপানিয়া তারাকোনেনসিস নামে অভিহিত করা শুরু হয়। খ্রিস্টপূর্ব ২৯ – ১৯ অব্দে কান্তাব্রীয় যুদ্ধে[৬] রোমানদের জয়ের ফলে প্রায় সমগ্র ইবেরীয় উপদ্বীপ রোমানদের অধীন হয়ে পড়লে হিসপানিয়া তারাকোনেনসিসের আয়তন প্রভুত পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। হিসপানিয়া থিতেরিওর নামটি এইসময় থেকেই অপ্রচলিত হয়ে পড়ে।

  • আবিষ্কারের যুগ

    আবিষ্কারের যুগ

    আবিস্কারের যুগ, বা অনুসন্ধানের যুগ (আনুমানিক ১৫শ শতাব্দীর শুরু থেকে সপ্তাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি), বলতে সেই সময়কে বুঝায় যার মাধ্যমে ইউরোপীয় সংস্কৃতি ব্যাপক সমুদ্র অভিযানের মাধ্যমে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে যায় এবং বিশ্বায়নের সূচনা করে। এটি সেই সময়কেও নির্দেশ করে যখন ইউরোপে উপনিবেশবাদ এবং বাণিজ্যবাদের ব্যাপক উত্থান ঘটে এবং বিভিন্ন দেশের জাতীয় নীতি হিসবে গৃহীত হয়। এসময় ইউরোপীয়দের কাছে অজানা অনেক নতুন নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কার হয় যেখানে আগে থেকেই জনবসতির অস্তিত্ব ছিল। আর অইউরোপীয়দের কাছে এটা ছিল অজানা কোনো মহাদেশ থেকে আক্রমণকারীদের আগমনের শামিল।

    আবিষ্কারের যুগ

    অনুসন্ধানের ধারা শুরু হয় পর্তুগিজদের ১৪১৯ এবং ১৪২৭ সালে আটলান্টিক মহাসাগরের ম্যাদিরা ও আজোরো দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কার, ১৪৩৪ সালে আফ্রিকার উপকূল, ১৪৯৮ সালে ভারত আগমনের সমুদ্রপথ আবিষ্কার, স্পেনের রাজার সহয়তায় ১৪৯২ সাল থেকে ১৫০২ সাল পর্যন্ত ক্রিস্টফার কলম্বাসের আমেরিকা অভিযানের এবং মেগানলেসের ১৫১৯-১৫২২ সালের মধ্যে প্রথম পুরো পৃথিবী পরিভ্রমণের মাধ্যমে। এই সব আবিষ্কারগুলো আটলান্টিক,ভারত,প্রশান্ত মহাসাগরগুলোতে সমুদ্র অভিযান এবং আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা ও অস্টেলিয়াতে স্থল অভিযানের দিকে ধাবিত করে, যা ১৯শ শতাব্দী পর্যন্ত বজায় ছিল এবং শেষ হয় বিংশ শতাব্দীর মেরু অঞ্চল অনুসন্ধানের মাধ্যমে।

    ইউরোপিয়ানদের এরকম অভিযানের মাধ্যমে বিশ্ব বাণিজ্যের এবং প্রাচীন বিশ্ব (ইউরোপ,এশিয়া,আফ্রিকা) ও নতুন বিশ্ব (আমেরিকা ও অস্টেলিয়া) এর সংযোগের মাধ্যমে উপনিবেশ সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে। পাশাপাশি কলম্বিয়ান বিনিময়ের মাধ্যমে বৃক্ষ, পশু, খাদ্য, মানব জনসংখ্যা ( দাসসহ),সংক্রামক রোগ জীবাণু এবং সংস্কৃতি পূর্ব গোলার্ধ এবং পশ্চিম গোলার্ধের মাঝে বিনিময় ঘটে।

    বৈশ্বিক বাস্তুসংস্থান, কৃষি ও সংস্কৃতিতে বিশ্বায়নের এই ঘটনা সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ। কারণ আবিষ্কারের যুগ এবং ইউরোপিয়ানদের অভিযানের পরেই পৃথিবীর বৈশ্বিক মানচিত্র তৈরি, নতুন বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি এবং দূরবর্তী সভ্যতার কাছে আসার সুযোগ হয়। কিন্তু পাশাপাশি ইউরোশিয়া ও আফ্রিকায় নতুন রোগের আগমন ঘটে যা আগে ছিল না, এর সাথে ইউরোপ কর্তৃক স্থানীয়দের দাস বানানো, শোষণ করা, তাদের উপর আধিপাত্য বিস্তার করা হয় এবং উপনিবেশ স্থাপন করে। আর এর মাধ্যমে খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা খ্রিস্ট ধর্ম পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পরে।[১][২]

    পর্যালোচনা

    প্রধান যাত্রাসমূহের মানচিত্র। নিচে বিস্তারিত দেখুন

    যুবরাজ হেনরির সহায়তায় পর্তুগিজরা প্রথম ১৪১৮ সাল থেকে আফ্রিকার আটলান্টিক উপকূলীয় এলাকা অনুসন্ধান শুরু করে। তারা কারভাল নামে নতুন হালকা জাহাজ তৈরি করে যা আরো বেশি পাল্লার এবং দ্রুত,[৩] পাশাপাশি এটা ছিলো খুব অল্প ও খুব বেশি বাতাসেও চলার উপযোগী ছিলো। ১৪৮৮ সালে বার্টোমুলো দিয়াজ এই পথে ভারত মহাসাগরে পৌঁছে

  • আফ্রিকার ইতিহাস

    আফ্রিকার ইতিহাস

    আফ্রিকার ইতিহাস হলো পূর্ব আফ্রিকায় হোমিনিড নামক প্রাচীন মানব এবং প্রায় ৩০০০-২৫০,০০ বছর আগে শারীরবৃত্তীয়ভাবে আধুনিক মানুষ (হোমো সেপিয়েন্স)-এর উত্থানের সময় থেকে বৈচিত্র্যময় এবং রাজনৈতিক উন্নয়নশীল জাতি রাষ্ট্রগুলির সৃষ্টির পর থেকে আফ্রিকার বর্তমান অবস্থা। প্রাচীন মিশরে এবং পরবর্তীতে নুবিয়া,সাহিল,মাগরেব এবং আফ্রিকার শৃঙ্গে প্রথম নথিভুক্ত ইতিহাসের উদ্ভব ঘটে।

    আফ্রিকার ইতিহাস

    উপনিবেশ কালের পূর্বের আফ্রিকা

    একজন রাজকীয় অশ্বারোহী যোদ্ধা

    হোমিনিড এবং হোমো স্যাপিয়েন্স এর বিবর্তন

    প্রস্তর যুগের সময়কালীন আফ্রিকান দ্বিখণ্ডিত শিল্পকলা (বর্শার তীক্ষ্ণ অংশ)

    হোমিনিন উপ-পরিবার এবং হোমো গণ এই উভয়টির জন্মস্থান হল আফ্রিকা। এদের অন্তর্ভুক্ত ৮টি প্রজাতিরই প্রথম জন্ম হয়েছে আফ্রিকায় যার মধ্যে কেবল হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতিটিই বর্তমানে অস্তিত্বশীল রয়েছে।

    জীবাশ্মবিদ্যা এবং প্রত্নতত্ত্বের সর্বাধুনিক ব্যাখ্যা অনুসারে আজ থেকে প্রায় ৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে হোমিনিডদের অস্তিত্বশীলতার সর্বশেষ প্রমাণ পাওয়া যায়। এই প্রাণীগুলো ছিল অনেকটাই তাদের নিকটতম প্রতিবেশী বৃহৎ আফ্রিকান উল্লুকের মত। কিন্তু হোমিনিডদের দ্বিপদী চলন প্রক্রিয়া ছিল যা তাদেরকে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছিল বিপুলভাবে। কারণ দ্বিপদী চলনের কারণেই তারা বনাঞ্চল এবং পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকার উষ্ণমন্ডলীয় বৃক্ষহীন সমতলভূমি এই উভয় স্থানেই বসবাসে পারঙ্গম ছিল। তারা এমন একটি সময় এই সুবিধা ভোগ করছিল যখন আফ্রিকা ধীরে ধীরে শুষ্ক হয়ে উঠছিল এবং বনাঞ্চল হ্রাস পেয়ে উষ্ণ মন্ডলীয় অঞ্চলের আধিপত্য বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। এভাবেই প্রায় ৩ মিলিয়ন বছর পূর্বে বেশ কিছু অস্ট্রালোপিথেকাইন হোমিনিড প্রজাতি আফ্রিকার দক্ষিণ, পূর্ব এবং কেন্দ্রীয় অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃতি লাভ করে।

    এরপর বিবর্তনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ধাপ ছিল হোমো হ্যাবিলিস এর বিবর্তন যা আজ থেকে প্রায় ২ মিলিয়ন বছর পূর্বে সংঘটিত হয়। এরাই প্রথম প্রজাতি যারা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি প্রস্তুতে সক্ষম ছিল। এই সক্ষমতার কারণে হোমো হ্যাবিলিসরা প্রথম মাংস ভক্ষণ শুরু করে। তারা নিজেদের প্রস্তুতকৃত হাতিয়ার ব্যবহার করে অন্য জন্তুদের শিকারকৃত প্রাণী বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাবার হিসেবে গ্রহণ শুরু করে। এছাড়াও এসময় থেকেই প্রথম তারা মৃত প্রাণীদের শবদেহ সংরক্ষণ শুরু করে যা থেকে তারা অস্থি ও মজ্জা সংগ্রহ করে। তবে হোমো হ্যাবিলিসরা বড় শিকারী প্রাণীদের সাথে শিকারে পেরে উঠতোনা এবং অধিকাংশ সময়ই শিকার করার পরিবর্তে শিকারে পরিণত হতো। শিকারের পাশাপাশি তারা পাখির বাসা থেকে ডিম চুরি, ছোটোখাটোো প্রাণী এবং দূর্বল কিন্তু বড় প্রাণী শিকার করতো।

    প্রায় এক মিলিয়ন বছরের পূর্বে বিবর্তিত হয় হোমো ইরেক্টাস। এদের মস্তিষ্কের আকৃতি অপেক্ষাকৃত বৃহৎ (১,০০০ সিসি) ছিল যার সাহায্যে এরা আরো কার্যকর পাথরের অস্ত্র বানাতে সক্ষম হয় এবং এর ফলশ্রুতিতে আফ্রিকান সমতলভূমির সবচেয়ে দূর্ধর্ষ শিকারীতে পরিণত হয়। হোমো ইরেক্টাসরাই প্রথম আগুনের ব্যবহার করতে শিখে এবং এদের মধ্যে অনেকেই আফ্রিকা ত্যাগ করে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। এরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে উপনিবেশ স্থাপন করে এবং বিবর্তিত হয়ে হোমো ফ্লোরেসিয়েন্সিসে পরিণত হয়।

    জীবাশ্মের নমুনা এটিই নির্দেশ করে যে ১০০,০০০ – ১৫০,০০০ বছর পূর্বে দক্ষিণ এবং পূর্ব আফ্রিকায় হোমো স্যাপিয়েন্সদের বসতি ছিল। ভাষাতাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক প্রমাণাদি থেকে পরবর্তিতে আফ্রিকা থেকে অনেক মানুষের বহির্গমনের নিদর্শন পাওয়া যায়। এছাড়া আফ্রিকাতেও অনেক মানুষ আসে আর এসবের বিস্তারি বিবরণ উদ্ধার করা হয়েছে কম্পিউটারের সাহায্যে জীনগত গবেষণার মাধ্যমে।

    প্রাগৈতিহাসিক নিওলিথিক সংস্কৃতি

    উত্তর আফ্রিকা

    বর্তমানে প্রাপ্ত নিওলিথিক যুগের কিছু খেদাইকৃত শিলিলিপি এবং সাহারা মরুভূমিতে প্রাপ্ত প্রাগৈতিহাসিক যুগের স্মৃতিস্তম্ভের বৃহৎ আকারের বেশ কিছু প্রস্তরখন্ড হতে যা জানা গেছে সে অনুসারে তুষার যুগে উত্তর আফ্রিকার শুষ্ক ঘাসাচ্ছাদিত সমতলভূমিতে শিকারী এবং পশু ও ফসল সংগ্রহকারী সংস্কৃতি বিদ্যমান ছিল। বর্তমানে যেখানে সাহারা মরুভূমি অবস্থিত সেখানে প্রাচীনকালের এক সময় ভালোরকমের কৃষিকাজ হত বলেও জানা গেছে। কিন্তু যখন সাহারার মরুকরণ শুরু হয় তখন এখানকার কৃষিজীবী জনগণ নীল নদের উপত্যকায় বসবাসের মাধ্যমে সেখানে কেন্দ্রীভূত হতে শুরু করে। সেখানেই প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভিত্তিভূমি স্থাপিত হয়। তবে এই স্থাপনকালে মিশরে শিক্ষা-দীক্ষার প্রচলন হয়নি। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় এটিই প্রতীয়মান হয় যে নীল নদের উপত্যকা জুড়ে মানব বসতির ইতিহাস ফারাও রাজাদের সাম্রাজ্য স্থাপনের ইতিহাসের চেয়েও অনেক পুরনো। এই অঞ্চলে প্রায় ৬০০০ খৃস্টপূর্বাব্দে সুসংঘটিত কৃষিকাজের সূচনা ঘটে।

    সাব-সাহারান আফ্রিকা

    আরও দেখুন

    দেআফ্রিকার ইতিহাস
    সার্বভৌম রাষ্ট্রআলজেরিয়া • ইথিওপিয়া • ইরিত্রিয়া • উগান্ডা • অ্যাঙ্গোলা • কঙ্গো • গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো • ক্যামেরুন • কেনিয়া • কেপ ভের্দি • কোত দিভোয়ার • কোমোরোস • গাবন • গাম্বিয়া • গিনি • গিনি-বিসাউ • ঘানা • চাদ • জাম্বিয়া • জিবুতি • জিম্বাবুয়ে • টোগো • তানজানিয়া • তিউনিসিয়া • দক্ষিণ আফ্রিকা • নাইজেরিয়া • নামিবিয়া • বিষুবীয় গিনি • বুর্কিনা ফাসো • বুরুন্ডি • বেনিন • বতসোয়ানা • মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র • মরক্কো • মরিশাস • মাদাগাস্কার • মালাউই • মালি • মিশর • মোজাম্বিক • মৌরিতানিয়া • রুয়ান্ডা • লাইবেরিয়া • লিবিয়া • লেসোথো • সুদান • সাঁউ তুমি ও প্রিঁসিপি • সিয়েরা লিওন • সেনেগাল • সোমালিয়া • সোয়াজিল্যান্ড
    অধীনস্থ,
    স্বায়ত্তশাসিত এবং
    অন্যান্য প্রশাসনিক অঞ্চল
    ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ / সেউতা / মেলিয়া (স্পেন)  • মাদেইরা (পর্তুগাল)  • মায়োত / রেউনিওঁ (ফ্রান্স)  • পান্টল্যান্ড  • সেন্ট হেলিনা (যুক্তরাজ্য)  • সোকোত্রা (ইয়েমেন)  • সোমালিল্যান্ড  • দক্ষিণ সুদান  • পশ্চিম সাহারা  • জাঞ্জিবার (তানজানিয়া)


    আফ্রিকা বিষয়ক এই নিবন্ধটি অসম্পুর্ণ, আপনি চাইলে এটিকে সমৃদ্ধ করতে পারেন।

    বিষয়শ্রেণীসমূহ:

  • আন্দীয় সভ্যতার সমুদ্রনির্ভরতা

    আন্দীয় সভ্যতার সমুদ্রনির্ভরতা

    আন্দীয় সভ্যতার সমুদ্রনির্ভরতা বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা একটি বিতর্কিত তত্ত্ব। এই তত্ত্বর মূল উপজীব্য বিষয় হল, দক্ষিণ আমেরিকার পেরুতে সুউচ্চ আন্দিজ পর্বতমালার পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল বরাবর যে সুপ্রাচীন সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে, সেই সভ্যতার ভিত্তি পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে গড়ে ওঠা সেই সময়ের অন্যান্য সুপ্রাচীন সভ্যতার মতো কৃষি ছিল না; বরং খাদ্যের জন্য এই সুপ্রাচীন সভ্যতার মানুষ মূলত সমুদ্রজাত নানা খাদ্যর উপর নির্ভর করতো।

    আন্দীয় সভ্যতার সমুদ্রনির্ভরতা

    মধ্য পেরুর সমুদ্রোপকূলবর্তী বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক খননস্থলে বিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন সময়ে ব্যাপক খননকার্য চালানো হয়। এর মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিল ১৯৭০’এর দশকে আসপেরো নামক স্থানে চালানো খননকার্য। এই খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত তথ্যের উপর নির্ভর করে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে মাইকেল এডওয়ার্ড মোজলি প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে,এই সভ্যতার মূল ভিত্তি ছিল সমুদ্রজাত খাদ্য। শস্যজাতীয় খাদ্য সিদ্ধ করার উপযোগী কোনওরকম মৃৎপাত্রের অণুপস্থিতি তাদের এই সিদ্ধান্তকেই আরও জোরদার করে। খনন অঞ্চলে উঁচু প্ল্যাটফর্মের উপর পাওয়া ছোট ছোট ঢিবি বা স্তূপ থেকে তারা আন্দাজ করেন এগুলি আসলে প্রাণীজ খাদ্য প্রক্রিয়ার জন্য প্রস্তুত উনুনজাতীয় বস্তুরই অবশেষ মাত্র।[১] এর উপর ভিত্তি করেই এরপর থেকে আন্দীয় সভ্যতার সমুদ্রনির্ভরতার তত্ত্ব ঐতিহাসিক মহলে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।[২]

    তবে এই তত্ত্ব তাদের মধ্যে যথেষ্ট বিতর্কেরও জন্ম দেয়। কারণ সাধারণভাবে স্বীকৃত তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনও জায়গায় সভ্যতার উত্থানের পিছনে সেখানকার মানুষের কৃষিনির্ভরতা, বিশেষ করে অন্তত একটি শস্যের ব্যাপক চাষের ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। কারণ উদ্বৃত্ত খাদ্য ব্যতীত জনঘনত্ব বৃদ্ধি ও কিছু সংখ্যক মানুষের সরাসরি খাদ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়ার বাইরে থাকার সুযোগ তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। ফলে অপেক্ষাকৃত জটিল সমাজব্যবস্থার উদ্ভবের জন্য অন্তত একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত কৃষির উন্নতি খুবই প্রয়োজন। পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে যেখানেই স্বতন্ত্রভাবে সুপ্রাচীন সভ্যতাগুলির বিকাশ ঘটেছে, সেখানেই এই বিষয়টির সত্যতা লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু আন্দীয় সভ্যতার সমুদ্রনির্ভরতার তত্ত্ব এই স্বীকৃত তত্ত্বটিকেই একরকম চ্যালেঞ্জ করে বসে। ফলে তা ঐতিহাসিক মহলে তুমুল বিতর্কের জন্ম দেয়।

    পরবর্তীকালে ঐ অঞ্চলের কাছাঁকাছি আরও বিভিন্ন স্থলে আরও অনেকগুলি খননস্থলে ঐ একই সময়ের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। এর মধ্যে বিখ্যাত পেরুভীয় প্রত্নতত্ত্ববিদ রুথ শেডি সলিসের নেতৃত্বে সমুদ্রোপকূল থেকে ২৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরে কারাল নামক স্থানে যে খননকার্য চলে, তার ফলে ঐ অঞ্চলে খ্রিস্টপূর্ব ৯০০০[৩] অব্দ থেকে শুরু করে যে পরস্পর সংযুক্ত এক বিস্তীর্ণ সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল, তা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে ওঠে। কারাল’এ এই সভ্যতার সবচেয়ে বড় কেন্দ্রটি আবিষ্কৃত হয়েছিল বলে ঐ স্থলের নামানুসারে এই সভ্যতাকে সাধারণত কারাল সভ্যতা বলে অভিহিত করা হয়। এই সভ্যতার বিকাশের সর্বোত্তম সময়কাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ – ১৮০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়কাল।[৪] এইসব স্থলে খননকার্যে একদিকে যেমন সমুদ্রজাত খাদ্যের নানা নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে, অন্যদিকে কৃষিরও বেশ কিছু চিহ্ন আবিষ্কৃত হয়েছে। এই তথ্যের উপর নির্ভর করে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে জোনাথন হাস, উইনিফ্রেড ক্রিমার, প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদ এই তত্ত্বর তীব্র বিরোধিতা করেন।[৫] তবে চার্লস মান প্রমুখ বিশেষজ্ঞ আবার এই তত্ত্বর সত্যতার সম্ভাবনার পক্ষেই মতপ্রকাশ করেছেন।[৬]

    বিতর্ক

    কারালে প্রাপ্ত চুল্লীর ধ্বংসাবশেষ

    ১৯৭০’এর দশকে যখন প্রথম এই তত্ত্বটির উদ্ভব ঘটে, তখন থেকেই তাকে ঘিরে তীব্র বিতর্কেরও জন্ম হয়। বহু প্রত্নতত্ত্ববিদই প্রশ্ন তোলেন, সামুদ্রিক ও সমুদ্রজাত খাদ্যর যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষের উপর ভিত্তি করে এই তত্ত্বকে সামনে আনা হয়েছে, সেইসব খাদ্য মানুষকে কত ক্যালোরি শক্তি জোগাতে সক্ষম? সেই সব খাদ্যজাত পুষ্টির উপর নির্ভর করে একটি সভ্যতা গড়ে ওঠাই বা কতটা সম্ভব?[৭] অবশ্য তখনও পর্যন্ত এই সভ্যতার মূলত বিভিন্ন সমুদ্রোপকূলবর্তী খননস্থলগুলিতেই অণুসন্ধান চালানো হয়েছিলো এবং সেখানে প্রাপ্ত তথ্যর উপর ভিত্তি করেই এই তত্ত্ব গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ৯০’এর দশকে সমুদ্র থেকে বেশ খানিকটা ভিতরে বিভিন্ন স্থলে এবং বিশেষ করে কারালে এই সভ্যতার এক বিশাল কেন্দ্র আবিষ্কৃত হওয়ায় এই তত্ত্ব আরও প্রশ্নের মুখে পড়ে। কারণ –

    1. এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত এই সভ্যতার সর্ববৃহৎ এই কেন্দ্রটি সমুদ্র থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরে অবস্থিত। অর্থাৎ এতদিন ধরে যে ধারণা ছিল যে এই সভ্যতা ছিল মূলত সমুদ্রোপকূলবর্তী কিছু ছোট ছোট গ্রামেই সীমাবদ্ধ, তা ঠিক নয়।
    2. কারালে খননকার্যে সেইসময়ে ব্যবহৃত কিছু কিছু শস্যফল উৎপাদনকারী ও কন্দজাতীয় উদ্ভিদের অস্তিত্বর প্রমাণ পাওয়া যায়। এগুলি হল স্কোয়াশ, কয়েকরকমের বিনস, পেয়ারা, লুকুমা, মিষ্টি আলু, প্রভৃতি।[৮] পরবর্তীকালে জোনাথন হাস প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদরা আরও উত্তরে কিছু খননস্থলেও এই উদ্ভিদগুলির খোঁজ পান। তার সঙ্গে তারা আভোকাডো, আচিরা, প্রভৃতি আরও কিছু উদ্ভিদের ব্যবহারেরও প্রমাণ পান। বর্তমানে এই সভ্যতার বিভিন্ন খননস্থলগুলি থেকে সে’ সময় মেইজেরও যে প্রচলন ছিল, তা নিশ্চিতভাবেই জানতে পারা গেছে।[৯]
    3. পেরুর এই উপকূলীয়় অঞ্চল যদিও প্রচণ্ড শুষ্ক একটি অঞ্চল, কিন্তু এই সঙ্কীর্ণ উপকূলীয় উপত্যকা অঞ্চলের মধ্য দিয়ে পূর্বের সুউচ্চ আন্দিজ পর্বতমালা থেকে নেমে আসা বরফ গলা জলে পুষ্ট অন্তত ৫০টি ছোট ছোট নদী বয়ে গেছে। এই সভ্যতার যেসব কেন্দ্রগুলির ধ্বংসাবশেষ সমুদ্র থেকে দূরে দেশাভ্যন্তরে খুঁজে পাওয়া গেছে, সেগুলি বেশিরভাগই এই সব নদীগুলি বা তার থেকে কাটা কিছু খালের পাশে অবস্থিত। এইসব খালের অস্তিত্ব স্বভাবতই একধরনের সেচব্যবস্থা ও কৃষির ইঙ্গিতবাহী; আর এই খালগুলির পাশে সভ্যতার কেন্দ্রগুলি গড়ে ওঠাই কৃষির উপর তাদের একধরনের নির্ভরতার প্রতি নির্দেশ করে।

    তৃণনির্মিত থলি – কারাল

    এতৎসত্ত্বেও আন্দীয় সভ্যতার সমুদ্রনির্ভরতার তত্ত্বটিকে বাতিল পরিগণিত করা যায় না। কারণ –

    1. সামুদ্রিক বা সমুদ্রজাত খাদ্যের আধিক্য এই সভ্যতার এক অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। সমুদ্রোপকূল ও দেশাভ্যন্তর – সর্বত্রই এই ধরনের খাদ্য ব্যবহারের যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। এমনকী কারালেও খননকার্য চলাকালীন রুথ শেডি সলিস লক্ষ্য করেন “অসংখ্য প্রাণীজ ভুক্তাবশেষ, যার প্রায় পুরোটাই সামুদ্রিক”। এর মধ্যে শামুক বা ঝিনুকের খোল থেকে শুরু করে অ্যাঙ্কোভি, সার্ডিন, প্রভৃতি মাছের কাঁটা ও হাড়, প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।[৮] বিশেষ করে অ্যাঙ্কোভি মাছের অবশেষ থেকে পরিষ্কার যে এই মাছ দেশাভ্যন্তরেও খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হত।[৬] অর্থাৎ সাধারণভাবে এটা বলা যেতেই পারে যে, এই সভ্যতার মানুষ খাদ্যের জন্য মূলত সমুদ্রজাত বিভিন্ন খাদ্যের উপরই নির্ভর করতো।
    2. আরও একটি বিষয় সম্বন্ধে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে আজ ঐতিহাসিকরা অনেকটাই নিশ্চিত। তা হল এই সভ্যতা্র অন্যতম কৃষিজ উৎপাদন ছিল একধরনের তুলো (Gossypium barbadense; গসিপিয়াম বারবাডেন্স প্রজাতির)। এই তুলো থেকে তৈরি সুতো দিয়েই মাছ ধরার জাল তৈরি হত। এছাড়া একধরনের লম্বা ঘাসও এখানে উৎপন্ন হত, যার থেকে শক্ত থলি তৈরি করা হত। কারাল অঞ্চলের খননকার্যে এইধরনের তৃণনির্মিত থলির নিদর্শন পাওয়া গেছে।[১০] অর্থাৎ, কৃষিজ উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও খাদ্যের জন্য এই সভ্যতার মানুষ মূলত সামুদ্রিক খাদ্যের উপরই নির্ভরশীল ছিল, যদিও সেই খাদ্য সংগ্রহের জন্য তাদের কৃষিজ ফসলের উপরই নির্ভর করতে হত।

    পারস্পরিক নির্ভরতার তত্ত্ব

    এই কারণেই এই অঞ্চলে সুপ্রাচীন সভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রে বর্তমানে একধরনের পারস্পরিক নির্ভরতার তত্ত্ব জোরদার হয়ে উঠেছে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, দেশাভ্যন্তরের বিভিন্ন কেন্দ্রগুলির মূল ভিত্তি ছিল এই তুলো ও ঘাসের চাষ ও তার থেকে নানাধরনের প্রয়োজনীয় জাল, কাপড়, থলি, প্রভৃতির উৎপাদন বজায় রাখা। অন্যদিকে উপকূলীয় কেন্দ্রগুলির মূল উৎপাদন ছিল মাছ ও সমুদ্রজাত খাদ্য, যার উপর স্থলাভ্যন্তরের কেন্দ্রগুলিও নির্ভরশীল ছিল। বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণের উপর নির্ভর করেই বর্তমানে উপকূল ও দেশাভ্যন্তরের কেন্দ্রগুলির এই পারস্পরিক নির্ভরতার তত্ত্বই জোরদার হয়ে উঠেছে।