Tag: মডেল জীব

  • মডেল জীব

    মডেল জীব

    মডেল বা প্রতিমান জীব (ইংরেজি: model organism) হল মানুষ নয় এমন কোনো প্রজাতি, যা নির্দিষ্ট জৈবিক ঘটনাকে বোঝার জন্য ব্যাপকভাবে অধ্যয়ণ করা হয় এই আশায় যে, মডেল জীব থেকে পাওয়া আবিষ্কারগুলো অন্যান্য জীবের কার্যক্রমের বিষয়েও আলোকপাত করবে।[১] বিবর্তনের ধারায় সকল জীবিত জীবের সাধারণ বংশধর এবং বিপাকীয় ও বিকাশমূলক পথ আর জিনগত উপাদানের সংরক্ষণের কারণে মডেল জীবের মাধ্যমে অন্যান্য জীব সম্পর্কেও জ্ঞান আহরণ সম্ভব হয়। [২] প্রতিমান জীব অধ্যয়ণ করার ফলে নানা ধরনের জ্ঞান আহরণ সম্ভব, কিন্তু অন্য জীবের ক্ষেত্রে এই জ্ঞান কাজে লাগানোর আগে সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরী।

    মডেল জীব

    মানুষের রোগ নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে, সরাসরি কোনো মানুষের ক্ষতি না করেই প্রতিমান জীবের মাধ্যমে রোগের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। যে জীবকে মডেল হিসেবে বেছে নেয়া হবে সেই জীবকে শ্রেণীবিন্যাসের দিক দিয়ে এমনভাবে মানুষের সমতুল্য হতে হবে যেন তা রোগ এবং তার প্রতিকারের ক্ষেত্রে সেইরুপ ক্রিয়া করবে যা মানুষের প্রয়োজনীয় শারীরবিদ্যার সমকক্ষ। যদিও মডেল জীবের জৈবিক ক্রিয়াকর্ম মানুষে প্রভাব ফেলার বিষয়টি নিশ্চিত করে না, তথাপি অনেক রোগের ঔষধ, চিকিৎসা ও নিরাময়ের জন্য প্রতিমান জীবের সাহায্য নেয়া হয়েছে।[৩][৪] মূলত, মানুষের রোগের ক্ষেত্রে তিন ধরনের জীবের মডেল ব্যবহৃত হয়ঃ সমসংস্থ বা হোমোলোগাস, সমরূপরৈখিক বা আইসোমরফিক, এবং পূর্বাভাসমূলক বা প্রেডিক্টিভ। সমসংস্থ প্রতিমান জীবে মানুষের রোগের মতোই একই কারণ, লক্ষণ এবং চিকিৎসা দেখা যায়। সমরূপরৈখিক জীবগুলোতে রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা মানুষের রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসার অনুরূপ। পূর্বাভাষমূলক জীব মানুষের নির্দিষ্ট রোগের মাত্র কয়েকটি দিক দিয়ে সমরূপ, তথাপি এরা অনেক রোগের বৈশিষ্ট্যের পদ্ধতি আলাদাকরণ ও পূর্বাভাষের ক্ষেত্রে বেশ উপযোগী।[৫]

    গুরুত্বপূর্ণ মডেল জীব

    জীবনের তিনটি অধিজগৎ বা ডোমেইনের প্রত্যেকটি থেকেই মডেল জীব নেয়া হয়েছে। ভাইরাসের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রাক-কেন্দ্রিক যে মডেল জীবটি বিগত ৬০ বছর ধরে ব্যাপকভাবে অধ্যয়ণ করা হয়েছে সেটি হল এশেরিকিয়া কোলাই (ই. কোলাই)। এটি মানুষের অন্ত্রের একটি সাধারণ গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া যাকে গবেষণাগারে অতি সহজে এবং কম খরচে জন্মানো ও লালন করা যায়। আণবিক জিনতত্ত্বে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত একটি মডেল জীব। এছাড়াও এটির বেশ গুরুত্ব দেখা যায় জৈবপ্রযুক্তিঅণুজীববিজ্ঞানে, যেখানে রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ’র অধিকাংশ কাজের ক্ষেত্রে একে পোষক জীবরূপে ব্যবহার করা হয়।[৬]

    সরল সুকেন্দ্রিক মডেল জীবের মধ্যে রয়েছে ক্ল্যামিডোমোনাস রেইনহার্ডটি নামের একটি এককোষী সবুজ শৈবাল যেটির জিনতত্ত্ব প্রচুর পরিমাণে অধিত। অন্য অনেক বিষয় ছাড়াও সালোকসংশ্লেষণ ও সক্রিয়তা বা মোটাইলিটির অধ্যয়ণে একে ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি, এই জীবের অনেকগুলো পরিচিত এবং নকশাকৃত মিউট্যান্ট ও প্রকাশিত বিন্যাস ট্যাগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, জিনগত রূপান্তর ও জিন নির্বাচনের জন্য বর্তমানে অনেক উন্নত পদ্ধতিও প্রচলিত রয়েছে।[৭]

    ডিক্টিওস্টেলিয়াম ডিসকয়ডিয়াম নামের অ্যামিবাকে জৈবানুবিজ্ঞান ও জিনতত্ত্বের গবেষণায় ব্যবহার করা হয়। এটি মূলত কোষ যোগাযোগ, ডিফারেন্সিয়েশন, ও প্রোগ্রামকৃত কোষ মৃত্যুর উদাহরণ হিসেবে অধিত হয়।

    বিকাশমূলক জীববিজ্ঞান অধ্যয়ণের জন্য সেনোরাবডিটিস এলেগ্যান্স একটি মডেল জীব

    চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণায় ল্যাবরেটরী মাইস সুপরিচিত

    অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে ড্রসোফিলা মেলানোগ্যাস্টার নামক ফলের মাছি, থমাস হান্ট মর্গান ও অন্যান্য গবেষকদের জিনতত্ত্বের গবেষণার কারণে, অত্যন্ত জনপ্রিয়। এদেরকে অতি সহজে গবেষণাগারে পুনরূৎপাদন করা যায় এবং এদের দ্রুত প্রজন্ম, উচ্চমাত্রার উর্বরতা, গুটিকয়েক ক্রোমোজোম, ও সহজে ঘটানো পর্যবেক্ষণযোগ্য পরিব্যক্তি রয়েছে।[৮] সেনোরাবডিটিস এলেগ্যান্স নামের নেমাটোডকে বিকাশ ও শারীরবিদ্যার জিনগত নিয়ন্ত্রণের রহস্যগুলো উন্মোচনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সর্বপ্রথম ১৯৬৩ সালে সিডনি ব্রেনার এই জীবটিকে নিউরনের বিকাশের মডেলরূপে প্রতিষ্ঠা করেন, এবং তারপর থেকে এটি নানান ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।[৯][১০] বহুকোষী প্রাণীদের মধ্যে সর্বপ্রথম এই জীবটিরই জিনোম বিন্যাস সম্পন্ন হয় এবং সর্বশেষ তথ্যমতে এর কানেকটোম সম্পন্ন হয়েছে।[১১][১২]

    আরাবিডোপসিস থ্যালিয়ানা হল একালের সবচাইতে জনপ্রিয় প্রতিমান উদ্ভিদ। এর ছোট গঠন এবং ক্ষুদ্র জীবনচক্র, দ্রুত জিনগত অধ্যয়ণে সহায়তা করে।[১৩] এর অনেক ফেনোটাইপগত ও জৈবরাসায়নিক মিউট্যান্ট ইতোমধ্যে নকশা করা হয়ে গেছে।[১৩] উদ্ভিদের মধ্যে সর্বপ্রথম আরাবিডপসিসের জিনোম বিন্যাস সম্পন্ন হয়েছে।[১৩]

    মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে গিনিপিগ একটি পুরাতন মডেল যেটি রবার্ট কক ও অন্যান্য ব্যাক্টেরিয়া বিশেষজ্ঞগন ব্যাক্টেরিয়ার দ্বারা সংক্রমণের পোষক হিসেবে ব্যবহার করতেন। একসময় “গবেষণাগারের প্রাণী” হিসেবে জনশ্রুতি থাকলেও বর্তমানে এর ব্যবহার কমে এসেছে। বর্তমানে প্রথম শ্রেণীর একটি মেরুদণ্ডী মডেল জীব হল ইঁদুর (Mus musculus)। এর অনেক অন্তর্জাত বংশ বিদ্যমান রয়েছে। এছাড়াও, নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের জন্য এই জীবের নির্দিষ্ট প্রকরণ রয়েছে যাদেরকে প্রায়ই দেহের আকার, মুটিয়ে যাওয়া, পেশিবহুলতা, ও স্বতঃপ্রবৃত্ত চাকতি দৌড়ের আচরণের মত চিকিৎসাবিজ্ঞানের নানান গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।[১৪]

    ধেড়ে ইঁদুর (Rattus norvegicus), বিষবিদ্যা ছাড়াও স্নায়ুতাত্ত্বিক গবেষণায় মডেল জীবরুপে ব্যবহৃত হয়। পশ্চিমা নখওয়ালা ব্যাঙ (Xenopus tropicalis) ও আফ্রিকার নখওয়ালা ব্যাঙের (Xenopus laevis) ডিমভ্রুণকে বিকাশমূলক জীববিজ্ঞান, কোষ জীববিজ্ঞান, বিষবিদ্যা, ও স্নায়ুবিজ্ঞানের অধ্যয়ণে ব্যবহার করা হয়।[১৫][১৬] প্রায় স্বচ্ছ দেহ সমৃদ্ধ জেব্রাফিশকে বিকাশ, বিষবিদ্যা ও টক্সিকোপ্যাথলোজি,[১৭] নির্দিষ্ট জিনের কাজ এবং সিগনালিং পথের গবেষণায় ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।

    অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মডেল জীব ও এদের প্রধান কাজ হলঃ টি৪ ফাজ (ভাইরাস সংক্রমণ), টেট্রাহাইমেনা থার্মোফিলিয়া (অন্তঃকোষীয় প্রক্রিয়া), স্যাকারোমাইসিস সেরেভিসিয়া, স্কিৎজোস্যাকারোমাইসিস পম্বে (কোষ চক্র, কোষ পোলারিটি, আরএনএআই, সেন্ট্রোমেয়ার, ট্রান্সক্রিপশন), ভুট্টা (ট্রান্সপোজোন্স), হাইড্রা (পুনরুৎপাদন ও মরফোজেনেসিস),[১৮] বিড়াল (নিউরোফিজিওলজি), মুরগি (বিকাশ), কুকুর (শ্বসনতন্ত্র ও কার্ডিওভাস্কুলার তন্ত্র), নথোব্রাঙ্কিয়ুস ফুরজেরি (বার্ধক্য),[১৯] মানুষ নয় এমন প্রাইমেট, যেমন, রেসাস মাকাক এবং শিম্পাঞ্জি (হেপাটাইটিস, এইচআইভি, পারকিনসন্স রোগ, কগনিশন, ও টিকা)