বাংলাদেশের ৮টি বিভাগ ৬৪টি জেলাতে বিভক্ত। সর্বশেষ ময়মনসিংহ বিভাগ। জেলাগুলি আবার ৪৯৫টি উপজেলায় বিভক্ত।
বাংলাদেশের প্রথম জেলা চট্টগ্রাম জেলা ১৬৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রংপুর বাংলাদেশ দ্বিতীয় জেলা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৭৬৯ সালে। সর্বশেষ জেলা ফেনী জেলা ৭ নভেম্বর ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
আয়তন অনুযায়ী বাংলাদেশের বৃহত্তম জেলা হল রাঙ্গামাটি এবং বাংলাদেশের ক্ষুদ্রতম জেলা হল নারায়ণগঞ্জ।
বর্তমানে বাংলাদেশের ৮টি বিভাগের অন্তর্গত ৬৪টি জেলায় মোট ৪৯৫টি উপজেলা রয়েছে। সর্বশেষ গঠিত উপজেলাগুলি হল মাদারীপুরের ডাসার উপজেলা, কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলা ও সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলা।[১]বাংলাদেশের উপজেলাসমূহের তালিকা নিম্নরূপ:
উপজেলা হচ্ছে বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ একক। কয়েকটি গ্রাম বা ইউনিয়ন মিলে একটি উপজেলা গঠিত হয় এবং কয়েকটি উপজেলা নিয়ে একটি জেলা গঠিত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের ৮টি বিভাগের অন্তর্গত ৬৪টি জেলায় মোট ৪৯৫ টি উপজেলা রয়েছে।[১] সর্বশেষ গঠিত উপজেলাগুলি হল মাদারীপুরের ডাসার উপজেলা, কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলা ও সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলা।
উপজেলা শব্দটি সংস্কৃত ও আরবি ভাষার সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছে। উপ হলো সংস্কৃত উপসর্গ আর জেলা শব্দটি আরবি শব্দ “দিলা” থেকে উৎপন্ন।
গঠন ইতিহাস
১৯৮২ সালের ৭ই নভেম্বর স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা পুনর্গঠন) অধ্যাদেশ ১৯৮২ বলে প্রথমে উন্নীত থানা পরিষদ গঠন করা হয় এবং থানা পর্যায়ে বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। পরবর্তীকালে উন্নীত থানা পরিষদকে উপজেলা পরিষদে রূপান্তরিত করা হয়। এ সময়ে বাংলাদেশের প্রায় সমস্ত উপজেলাকে পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক কেন্দ্রে রূপ দেয়া হয়। এই অধ্যাদেশটি ১৯৯১ সালে বাতিল করা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৯৮ সালে জাতীয় সংসদে উপজেলা অধ্যাদেশ ১৯৯৮ পাস করে পুনরায় উপজেলা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়। কার্যালয় আদেশের মাধ্যমে ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ থেকে এই অধ্যাদেশ কার্যকরী হয়। সর্বশেষ ২০০৯ সালে উপজেলা পরিষদ আইন সংশোধন হয়। [২]
উপজেলার প্রধান
আইন বিভাগ
সংসদ সদস্যগণবাংলাদেশের উপজেলাতে আইন এবং নির্বাহী বিভাগের প্রধান। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ব্যবস্থা সংসদীয় পদ্ধতির। এই ব্যবস্থায় সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন প্রধানমন্ত্রী। বহুদলীয় গণতন্ত্র পদ্ধতিতে এখানে জনগণের সরাসরি ভোটে সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হন। নির্বাহী ক্ষমতা সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকে। সংসদ সদস্যগণ উপজেলাতে আইন বিভাগের প্রধান হিসেবে ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। যেহেতু এমপিরাই মন্ত্রীপরিষদের সদস্য সেহেতু তারাই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বা তার প্রতিনিধি হিসেবে উপজেলা পর্যায়ে নির্বাহী বিভাগ বা শাসন বিভাগ পরিচালনা করে। উল্লেখ্য, এক বা একাধিক উপজেলা নিয়ে একটি জাতীয় সংসদ আসন গঠিত হয়। বাংলাদেশের পদমর্যাদা ক্রম অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের পদক্রম ১২ নং ক্রমিকে অবস্থিত।
উপজেলা চেয়ারম্যান হলেন বাংলাদেশেরউপজেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী। সংশোধিত উপজেলা পরিষদ (কার্যক্রম বাস্তবায়ন) বিধিমালার ১৪(১) উপবিধি অনুযায়ী উপজেলার দপ্তরগুলোর কর্মকর্তা উপজেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরিত বিষয়ে সব কাগজপত্র ও নথি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে অনুমোদনের জন্য পেশ করবেন।
অফিসার ইন চার্জ (ওসি) পুলিশ থানার মুখ্য কর্মকর্তা। তিনি প্রথম শ্রেণীর নন-ক্যাডার অফিসার। পুলিশ ইন্সপেক্টর পদের কর্মকর্তারা অফিসার ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করেন।
একটি উপজেলার প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত স্থানীয় জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত পরিষদ উপজেলা পরিষদ নামে পরিচিত। উপজেলা পরিষদের মেয়াদকাল মিটিংয়ের দিন থেকে ৫ বছর। সরকার কর্তৃক মনোনীত একজন সরকারি কর্মকর্তা বা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এই পরিষদের সচিব হিসেবে সমস্ত নির্বাহী দায়িত্ব পালন করেন।[১০]
উপজেলা পর্যায়ের সমস্ত কার্যাবলীকে মূলত সংরক্ষিত ও হস্তান্তরিত এই দুইভাগে ভাগ করা হয়। সংরক্ষিত দায়িত্বের মধ্যে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, দেওয়ানী ও ফৌজদারী বিচার, রাজস্ব প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ, প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ, বৃহৎ শিল্প, খনন কার্য এবং খনিজ সম্পদের উন্নয়ন ইত্যাদি দায়িত্ব অন্যতম।
অন্যদিকে হস্তান্তরিত দায়িত্বের মধ্যে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, আন্তঃ উপজেলা সড়ক নির্মাণ ও সংরক্ষণ, কৃষি সম্প্রসারণ ও কৃষি উপকরণ সরবরাহ ও সেচ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণ ও পয়ঃ নিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রণয়ন ইত্যাদি কার্যক্রম অন্তর্ভূক্ত।
আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীন কওমি মাদ্রাসাসমূহের দাওরায়ে হাদিস (তাকমিল)-এর সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রি (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি)-এর সমমান প্রদান আইন, ২০১৮ হলো ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে পাস হওয়া একটি আইন। পাকিস্তান আমল থেকে কওমি মাদ্রাসার সরকারি স্বীকৃতির দাবি উঠতে থাকে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে এই দাবি আরও জোরালো হয়। ২০০৬ সালে আজিজুল হকের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে তৎকালীন বিএনপি সরকার সরকারি স্বীকৃতির ঘোষণা দিলেও পরবর্তীতে তা বাস্তবায়ন হয় নি। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্বীকৃতির উদ্যোগ নেয়। পরে শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে স্বীকৃতি গ্রহণে সবার মধ্যে ঐক্যমত্য হলে ২০১৭ সালে শেখ হাসিনা স্বীকৃতির ঘোষণা দেন।[১] যা ২০১৮ সালে এই আইনের মাধ্যমে আইনি বৈধতা পায়। সমালোচনা করা হয় যে, এই আইন পাসে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দিকে থেকে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পেয়েছে এবং হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মর্জিমাফিক আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।[২][৩]
ঔপনিবেশিক ভারতে ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দারুল উলুম দেওবন্দ।[৪] এই দারুল উলুম দেওবন্দকে কেন্দ্র করে সমগ্র বিশ্বে অসংখ্য কওমি মাদ্রাসা গড়ে উঠে।[৫]বঙ্গ অঞ্চলে এ ধারার প্রথম কওমি মাদ্রাসা দারুল উলুম হাটহাজারী।[৪] ১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক ভারত থেকে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান আমলে সর্বপ্রথম আতহার আলী, ছিদ্দিক আহমদ, শামসুল হক ফরিদপুরী এ মাদ্রাসাগুলোর সরকারি স্বীকৃতির দাবি উত্থাপন করেন।[৫] আতহার আলী স্বীকৃতির বিল আনার জন্য শফি উসমানিকে চিঠি লিখেন, যা এখনো সংরক্ষিত আছে।[৬]বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর সময়ে আশির দশকে প্রতিষ্ঠিত হয় বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ, যা সংক্ষেপে বেফাক নামে পরিচিত। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এটি স্বীকৃতির দাবি নিয়ে কাজ করতে থাকে। এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন হারুন ইসলামাবাদী, নূর উদ্দিন গহরপুরী, আবদুল জাব্বার জাহানাবাদী, আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া সহ বেফাকের প্রমুখ দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ।[৫][৬] বেফাকের প্রতিকূলতার কারণে আবদুল জাব্বার জাহানাবাদী তরুণদের মাধ্যমে স্বীকৃতির দাবি জোরালো করার চিন্তা করেন। ফলশ্রুতিতে নব্বইয়ের দশকে তার পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠে ‘বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা পরিষদ’ ও ‘কওমি মাদ্রাসা ছাত্র পরিষদ’। স্বীকৃতির দাবিতে জনমত তৈরির জন্য এই দুই সংগঠন ক্ষুদ্র পরিসরে প্রচার কাজ শুরু করে।[৫] ১৯৯২ সালের ২৯ মার্চ ঢাকা জেলা ক্রীড়া সমিতি মিলনায়তনে আয়োজিত ইসলামী ছাত্র মজলিসের কলেজ প্রতিনিধি সম্মেলনে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার সরকারি স্বীকৃতি সহ ১৩ দফা জাতীয় শিক্ষা দাবি উত্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে সেই দাবিতে এক লক্ষ স্বাক্ষর সংগ্রহ করে তৎকালীন বিএনপি সরকারের শিক্ষামন্ত্রী বরাবর জমা দেয়া হয়।[৭] ২০০৫ সালের ১৫ এপ্রিল আজিজুল হকপল্টন ময়দানে ‘কওমি মাদ্রাসা জাতীয় ছাত্র কনভেশন’ আয়োজন করে স্বীকৃতির দাবি তুলে ধরেন।
পরের বছর ২০০৬ সালের ১৬ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত তিনি ঢাকার মুক্তাঙ্গনে লাগাতার ৫ দিন অনশন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। ৫ম দিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তার কার্যালয়ে একটি ওলামা সম্মেলন ডেকে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্সের সমমান ঘোষণার আশ্বাস দিলে তিনি অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করেন।[৬] আজিজুল হকের এ কর্মসূচির ফলে স্বীকৃতির দাবি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক জনমত তৈরি হয়। তার সাথে উবায়দুল হক, মুহিউদ্দীন খান, ফজলুল হক আমিনী, সৈয়দ ফজলুল করিম প্রমুখ একাত্মতা ঘোষণা করেন।[৫] কওমি মাদ্রাসার স্বকীয়তা রক্ষার প্রশ্নে আপোষহীন অবস্থান নেন মুফতি আব্দুর রহমান।[৬] খালেদা জিয়া তার সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ব মূহুর্তে কওমি সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ঘোষণা দেন এবং ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয় এসংক্রান্ত গেজেটও প্রকাশ করে।[৭] তবে সেটি বাস্তবায়নের কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের সময় বা সুযোগ ঐ সরকার পায়নি৷ তখন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এ দাবির সাথে একমত ছিলেন না।[৩] ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ ও রুহুল আমিনের মাধ্যমে এই স্বীকৃতির দাবি আবার সামনে আসে।[৫][৮]শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে ২৫ সদস্য এবং পরে ৬২ সদস্যের আলেমদের প্রতিনিধিদল তার সাথে সাক্ষাৎ করে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা সনদের স্বীকৃতির দাবি জানায়। প্রতিনিধিদলে আজিজুল হক ও শাহ আহমদ শফীও ছিলেন।[৯] ২০০৯ সাল থেকেই প্রধানমন্ত্রী আলেমদের সঙ্গে যে আলোচনার সূত্রপাত করেন, সেটি ২০১০ সালে গ্রহণ করা শিক্ষানীতিতেও স্থান পায়। ২০১২ সালে কওমি সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়নে শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন গঠন করে সরকার।[১০] নানা প্রতিকূলতার কারণে কমিশনের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়।[৫] পরিশেষে ২০১৬ সালের ১০ ডিসেম্বর হাটহাজারী মাদ্রাসায় শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সে বৈঠকে কওমি মাদ্রাসার স্বকীয়তা পূর্ণমাত্রায় বজায় রেখে দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতির আলোকে কওমি সনদের স্বীকৃতি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত হয়।[৫]
আলেমদের ঐক্যমতের পর ২০১৭ সালে ১১ এপ্রিল শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে দেশের শীর্ষ আলেমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে কওমি সনদের স্বীকৃতির ঘোষণা প্রদান করেন।[৫] ১৩ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এসংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হয়।[১১] প্রজ্ঞাপন জারির পর আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীনে অভিন্ন প্রশ্নে ১৫ মে প্রথমবারের মতো সারা দেশে মোট ২১৮টি কেন্দ্রে দাওরায়ে হাদিস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।[৭] ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট এই আইনের খসড়ার অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। ১০ সেপ্টেম্বর প্রথমবার তা সংসদে তোলা হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর বিলের ওপর দেওয়া জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং সংশোধনী প্রস্তাবগুলোর নিষ্পত্তি শেষে কণ্ঠভোটে বিলটি পাস হয়।[২] ৮ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির সম্মতিলাভের পর এটি আইনে পরিণত হয়। আইনটি পাসের জন্য ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর শুকরানা মাহফিল আয়োজনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।[৮]
২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল শেখ হাসিনার ঘোষণার পর এটিকে হেফাজতে ইসলামের কাছে ‘নতি স্বীকার’ হিসেবে দেখিয়ে বিভিন্ন বাম সংগঠন এবং সুশীল সমাজের একটি অংশ এর সমালোচনা করে।[১২]বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি এটিকে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হিসেবে উল্লেখ করে।[১৩]আলিয়া মাদ্রাসার একটি অংশ এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জঙ্গিবাদ গেঁড়ে বসতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে এই সিদ্ধান্তকে অবিবেচনাপ্রসূত অ্যাখ্যা দিয়ে আদালতে যাওয়ার ঘোষণা দেন।[১৪][১৫]বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী বলেন, শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে পরাজিত করেছেন।[১৬] প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সভানেত্রী খালেদা জিয়া তার আমলে স্বীকৃতির বিষয়টি স্মরণ করে দিয়ে বলেন, শেখ হাসিনা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছে এবং এর মাধ্যমে আলেমদের ধোঁকা দিচ্ছে।[১৭]বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রীর ওই সিদ্ধান্তকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী এবং সংবিধানের মৌল চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক বলা হয়। সরকারের শরীক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল আপত্তি জানিয়ে বলে সামান্য ছাড় দেওয়া হলে তারা আবারও বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সংবিধানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। তবে এসব সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এটিকে বিদ্যমান বাস্তবতা হিসেবে বর্ণনা করে বলেন এতে ‘আপসের’ কোনো বিষয় নেই।[১৮]
বিলটি পাসের সময় জাতীয় পার্টির সাংসদ সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘মনে হচ্ছে এই আইনে সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মনে হচ্ছে চাপের মধ্যে বা যেমন খুশি তেমনভাবে এটি করা হয়েছে। এই বিলটি নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে।’ শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘আইনে সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। হয়তো এর কারণ দেওবন্দের কারিকুলাম অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে এটি করা হয়েছে।’ তবে তিনি এই আইন প্রণয়নের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান।[২] জাতীয় পার্টির আরেক সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, এটি একটি ঐতিহাসিক বিল। আমরা সম্পূর্ণভাবে একমত। আমি যাচাই বাছাইয়ের পক্ষে নই, আমি চাই বিলটি অবিলম্বে পাস করা হোক।’[১৯]
শিলিগুড়ি করিডোরভারতেরউত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির সঙ্গে দেশের অবশিষ্ট অংশের সংযোগরক্ষাকারী একটি সংকীর্ণ ভূখণ্ড। পশ্চিমবঙ্গেরউত্তরাঞ্চলে অবস্থিত এই ভূখণ্ডের আকৃতি মুরগির ঘাড়ের মতো বলে একে চিকেন’স নেক নামেও অভিহিত করা হয়। এই ভূখণ্ডের প্রস্থ ২১ থেকে ৪০ কিলোমিটার। এর দুপাশে নেপাল ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র। ভুটান করিডোরের উত্তর দিকে অবস্থিত।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় বৃহত্তর বাংলা প্রদেশ দ্বিখণ্ডিত হলে শিলিগুড়ি করিডোরের সৃষ্টি হয়। ১৯৭৫ সালে প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিত গণভোটের মাধ্যমে ভারতের সাথে মিলিত হওয়া অবধি রাজতন্ত্রী সিকিম করিডোরের উত্তর দিকে ছিল।[১][২] এটি শিলিগুড়ি করিডোরের উত্তরে ভারতকে একটি সুরক্ষা দিয়েছে এবং চীনা চুম্বি উপত্যকার পশ্চিম দিকের উপর ভারতের নিয়ন্ত্রণকে একীভূত করেছে।
২০০২ সালে ভারত, নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশ এই অঞ্চলে একটি মুক্ত বাণিজ্যাঞ্চল গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। এই প্রস্তাবে উক্ত অঞ্চলের মাধ্যমে অবাধে চার দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন চালানোর কথা বলা হয়।[৩] তবে অবৈধ ড্রাগ ও অস্ত্রচোরাচালান বর্তমানে এই অঞ্চলের প্রধান সমস্যা।[৪]
গুরুত্ব
যদিও শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের জন্য একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল অঞ্চল, এর অবস্থান একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করেছে যা বাংলাদেশের পক্ষেও গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে বৈরিতার ফলস্বরূপ ভারত বিভাগ হয়েছিল। প্রথম থেকেই এই দুটি নতুন রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক শত্রুতা ও সংঘাতের দ্বারা চিহ্নিত ছিল।
চীনের দখল করে নেয়ার সম্ভাবনা
এক প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘ভারত-ভুটান-চিনের সীমান্ত মিশেছে তিব্বতের চুম্বি উপত্যকার খুব কাছে। সিকিমের কুপুপের কাছে এখন যেখানে চিনা সেনার ঘাঁটি রয়েছে, সেখান থেকে শিলিগুড়ি করিডরের নাগরাকাটা আকাশপথে মোটামুটি ৪৫-৫০ কিলোমিটার। সেই দূরত্ব কমাতেই চিনা সেনা ডোকলাম কব্জা করতে চাইছে। কারণ, ডোকলাম থেকে নাগরাকাটার আকাশপথে দূরত্ব বড়জোর ২৫ কিলোমিটার।’’ ওই কর্তা জানাচ্ছেন, ডোকলামে স্থিতাবস্থা চলছে বলে এখন হা জেলার মধ্যেই অন্য রাস্তা খুঁজছে চিন।
যাতে ভুটানের মধ্যে দিয়ে শিলিগুড়ি করিডরের খুব কাছে ঘাঁটি গাড়া সম্ভব হয়। ডোকলামে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি কংক্রিট হেলিপ্যাড, কংক্রিটের ছাউনি, সুড়ঙ্গ, নজরদারি টাওয়ার তৈরি করেছে চিনা সেনা।
বেশ কিছু নতুন বাঙ্কারও বানিয়েছে। আর রাস্তা তো তৈরি করেইছে। তবে ডোকলামের সর্বোচ্চ অংশটিতে ভারতীয় সেনা মোতায়েন থাকায় নজরদারির দিক দিয়ে তারা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
ভারতীয় গোয়েন্দারা জেনেছেন, ভুটানের সঙ্গে সীমান্ত-বিবাদ নিয়ে চিনের আলোচনা চলছে ঠিকই। কিন্তু তার আগেই ভুটানের পশ্চিম দিকে ক্রমেই এগিয়ে আসছে চিন। টহলদারি চালাচ্ছে। এক গোয়েন্দা কর্তার কথায়, ‘‘ভুটানের মিডল সেক্টরের ৪৯৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা থিম্পুকে ছেড়ে দিতে চায় চিন। তার বদলে পশ্চিম ভুটানে ২৬৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিতে চায় তারা। এই অংশ সিকিম ও কালিম্পং লাগোয়া। গত ২৪-২৫ জুলাই চিনের উপ-বিদেশমন্ত্রী কং শুয়াংইউ থিম্পুতে গিয়ে ফের একই প্রস্তাব দিয়ে এসেছেন।’’ ওই গোয়েন্দা কর্তার বক্তব্য, আনুষ্ঠানিক ভাবে দু’দেশের যা কথাবার্তাই হোক না কেন, পশ্চিম ভুটানের ২৬৯ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ১৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় চিনা
সেনার অবাধ গতিবিধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগে মাসে এক বা দু’বার চিনের সেনা ‘লং রুট পেট্রলিং’-এ ভুটানের ভিতরে যেত। এখন প্রায়ই তাদের ওই এলাকায় দেখা যাচ্ছে। চিনের আম নাগরিকেরাও মাঝে-মধ্যে ভুটানি সেনার শিবিরে এসে কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন। এ সবে ভুটানের দিক থেকেও তেমন কোনও বাধা আসছে না।
এমন পরিস্থিতির কথা জানিয়ে প্রতিরক্ষা, বিদেশ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে সতর্ক করেছেন গোয়েন্দারা। যদিও গত ৭ মার্চ বিদেশ প্রতিমন্ত্রী ভি কে সিংহ লোকসভায় জানান, ২০১৭-এর ২৮ অগস্টের পরে ডোকলাম বা সংলগ্ন এলাকায় নতুন করে আর কিছু হয়নি। এক প্রতিরক্ষা বিশেষ়জ্ঞের কথায়, ‘‘ভুটানের পারোতে ভারতীয় সেনার উপস্থিতি রয়েছে। পারো থেকে হা জেলায় পৌঁছতে বেশি সময় লাগে না। ফলে এতটা উদ্বেগেরও কোনও কারণ নেই।’’ হাসিমারা ও পানাগড় বিমানঘাঁটি যে কোনও পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষমতা রাখে বলেও জানান তিনি।
তবু সরকার কোনও ঝুঁকি নিতে চাইছে না। কারণ ডোকলামে কিছু না-ঘটলেও ২০১৭-এর ২৮ ডিসেম্বর অরুণাচলের আপার সিয়াং জেলার শিয়ুং লা-তে সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে এসেছিল চিনা সেনা। ভারতের আপত্তি ও সীমান্ত বৈঠকের পরে তারা ফিরে যায়। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, ৫৭তম প্রতিষ্ঠা দিবসে ভারত-তিব্বত সীমান্ত পুলিশ (আইটিবিপি) জানিয়েছে, চিন সীমান্ত বরাবর নজরদারি ও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে গতি আনতে বেশ কিছু পদক্ষেপের একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করেছে তারা।
এর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধের মহড়াও। সীমান্তে হিমাঙ্কের নীচের তাপমাত্রায় আইটিবিপি-র কাজের সুবিধার জন্য শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আধুনিক ছাউনি তৈরির কথা জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ।
শিলিগুড়ি করিডোর, মানচিত্রে লাল রঙের বৃত্তের দ্বারা চিহ্নিত
ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে রাঢ় অঞ্চলটির ভিন্ন ভিন্ন নামে চিহ্নিত হয়েছে। আবার ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রাজ্য এখানে গড়ে উঠেছিল। প্রাচীন রাঢ় সভ্যতা ও গঙ্গারিডাই রাজ্য এখানেই অবস্থিত ছিল। তবে এর প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না।[২][৩][৪][৫]
নামকরণ ও ব্যুৎপত্তি
এই অঞ্চলের বিভিন্ন নামগুলি আসলে “রাঢ়” শব্দটির শব্দগত বিকৃতি। অনেক সময় “ঢ়” শব্দটি “ঢ” হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে রচিত জৈণ ধর্মগ্রন্থ আচারাঙ্গ সূত্র-এ “রাঢা”, “রাঢ”, “রাঢ়া”, “রাঢ়”, “লাঢা”, “লাঢ়” প্রভৃতি শব্দগুলি পাওয়া যায়। কোনো কোনো বইতে “লালা”, “রার” বা “লাড়” নামেও এই অঞ্চলের উল্লেখ আছে। ভাষাতাত্ত্বিক প্রভাত রঞ্জন সরকারের মতে, চীনারা রাঢ়কে “লাটি”, গ্রিকরা “গঙ্গারিডি” ও আর্যরা “রাট্টা” বলত। তবে অনেক গ্রিক, রোমান ও মিশরীয় বইতেই “গঙ্গারিডাই”, “গঙ্গারিডি”, “গঙ্গারিটাই” ও “গঙ্গারিডাম” সভ্যতা, রাজ্য বা জাতির উল্লেখ রাঢ়ের পাশাপাশি একইভাবে করা হয়েছে। মেগাস্থিনিস, টলেমি, স্ট্রাবো, প্লিনি দ্য এল্টার, অ্যারিয়ান, ডিওডোরাস সিকুলাস, কুইন্টাস কার্টিয়াস রিউফুস ও প্লুটার্কের রচনায় গঙ্গারিডাই রাজ্যের নাম পাওয়া যায়।[২][৩][৬][৭]
“রাঢ়” শব্দের ব্যুৎপত্তি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেকে বলেছেন, এটি অস্ট্রোএশিয়াটিক পরিবার-ভুক্ত কোনো এক স্থানীয় ভাষা থেকে এসেছে। সাঁওতালি ভাষায় প্রচলিত নিম্নোক্ত ভাষাগুলি থেকে এর উদ্ভব হওয়া সম্ভব: “লার” (সুতো), “রাড়” (সুর) ও “লাড়” (সাপ)। প্রভাতরঞ্জন সরকারের মতে, শব্দটির উৎস প্রোটো-অস্ট্রোএশিয়াটিক “রাঢ়া” বা “রাঢ়ো” শব্দদুটি, যার অর্থ “লালমাটির দেশ” বা “ল্যাটেরাইট মৃত্তিকার দেশ”।[২][৬]
“গঙ্গারিডাই” শব্দের উৎসটিও স্পষ্ট নয়। ঐতিহাসিক ড. অতুল সুর, প্লিনি ও টলেমির মতে এর অর্থ “গঙ্গার তীরবর্তী রাঢ় অঞ্চল”। যদিও অন্যান্য গবেষকদের মতে, এর অর্থ, “গঙ্গাহৃদি” (যে অঞ্চলের হৃদয়ে গঙ্গা প্রবাহিত), “গঙ্গারাষ্ট্র” বা “গোন্ডা-রিডাই” (গোন্ডা জাতির দেশ)। মেগাস্থিনিস এই অঞ্চলের অধিবাসীদের বলেছেন, “Gangarides’। ডিওডোরাস সিকুলাসের বর্ণনা অনুসারে, গঙ্গারিডাই “রাষ্ট্রে সবচেয়ে বড়ো আকারের ও সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় হাতি ছিল।”[৭]
ভূপ্রকৃতি ও মৃত্তিকা – পশ্চিমের মালভূমি থেকে কাঁকুড়ে পলিমাটি বয়ে এনে এই অঞ্চলের নদীগুলি এই সমভূমি সৃষ্টি করেছে। যদিও সঠিক অর্থে সমতলভূমি নয় রাঢ় অঞ্চল। স্থানে স্থানে ঢেউখেলানো অসমতম ভূমি ও টিলা এই অঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
পুরনো পলিমাটি দিয়ে গঠিত এই অঞ্চলে ল্যাটেরাইট লাল মাটির প্রাধান্যই বেশি। মাটির স্তর এখানে অগভীর। মাটির জলধারণ ক্ষমতা কম। নদী অববাহিকাগুলি বাদে অন্যত্র তাই মাটি খুব একটা উর্বর নয়।
নদনদী – রাঢ় অঞ্চলের প্রধান নদনদীগুলি হল ময়ূরাক্ষী, অজয়, দামোদর, দ্বারকেশ্বর, শিলাই ও কাঁসাই। এই নদীগুলির উৎপত্তিস্থল ছোটনাগপুর মালভূমি ও এগুলির প্রতিটিই ভাগীরথী-হুগলি বা তার কোনও উপনদীতে মিলিত হয়েছে। সুবর্ণরেখা নদীর অংশবিশেষও এই অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। বৃষ্টির জলে পুষ্ট হওয়ায় এগুলিতে সারা বছর জল থাকে না। তবে বর্ষাকালে প্রায়শই দুকুল ছাপিয়ে বন্যা দেখা দেয়।
জলবায়ু – সমুদ্র থেকে দূরে অবস্থিত হওয়ায় রাঢ় অঞ্চলের জলবায়ু চরমভাবাপন্ন। গ্রীষ্ম ও শীতকালের গড় তাপমাত্রা এখানে যথাক্রমে ৩৫º-৪০º ডিগ্রি সেলসিয়াস ও ১২º-১৪º ডিগ্রি সেলসিয়াস। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে রাঢ়ে বছরে গড়ে প্রায় ১৪০-১৬০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। তবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ উত্তর রাঢ়ের তুলনায় দক্ষিণ রাঢ়ে বেশি। এপ্রিল-মে মাস নাগাদ কালবৈশাখী ও অক্টোবরে আশ্বিনের ঝড়ও এই অঞ্চলের জলবায়ুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
প্রাকৃতিক উদ্ভিদ – এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক উদ্ভিদের মধ্যে শাল, মহুয়া, শিমূল, কুল, বাবলা, বাঁশ ও বিভিন্ন প্রজাতির ঘাস উল্লেখযোগ্য। এই অঞ্চল অরণ্যসংকূল। তবে বর্তমানে জনবসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে বহুলাংশে অরণ্যচ্ছেদন ও চাষাবাদ এই অঞ্চলের ভূমিক্ষয়ের অন্যতম কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। বর্তমানে ভূমিক্ষয় রোধের জন্য তাই কৃত্রিম উপায়ে বনায়ন শুরু হয়েছে।
অর্থনীতি
কৃষি – কৃষিতে এই অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী। সমতল ভূভাগ, উন্নত সেচব্যবস্থা ও অনুকূল অবস্থার জন্য রাঢ়ের নদী অববাহিকাগুলিতে ধান, গম, আখ, ডাল, তৈলবীজ, জোয়ার ও আলু প্রচুর পরিমাণে জন্মায়। এর মধ্যে ধানচাষ সর্বাধিক হয় বর্ধমান ও পশ্চিম মেদিনীপুরে। জোয়ার ও তৈলবীজ মেদিনীপুরে, গম বাঁকুড়ায়, বীরভূমে আখ প্রচুর উৎপন্ন হয়। হুগলি ও বর্ধমান জেলায় প্রচুর আলু এবং হুগলি ও মেদিনীপুরে পান ও বিভিন্ন প্রকার সবজি উৎপন্ন হয়।
এছাড়া পণ্য ফসলের মধ্যে বাঁকুড়া জেলায় পলাশ ও কুল গাছে লাক্ষাকীট এবং বাঁকুড়া, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ জেলায় রেশমকীটের খাদ্য তুঁতগাছের চাষ হয়।
খনিজ – এই অঞ্চলে অল্প পরিমাণে হলেও কিছু উৎকৃষ্ট খনিজ পাওয়া যায়। বর্ধমানের রাণীগঞ্জ অঞ্চলে প্রচুর উৎকৃষ্ট কয়লা মজুত আছে। বীরভূমের মহম্মদবাজার, খড়িয়া, কামারপুকুর ও বাঁকুড়ার মেজিয়ায় অল্প পরিমাণে অভ্র, ফায়ার ক্লে ও চিনামাটি পাওয়া যায়। পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি, লাবণি ও সরিষা থানায় অল্প ম্যাঙ্গানিজ পাওয়া যায়। এছাড়া হুগলি ও বর্ধমান জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে বালির খাদ আছে।
শিল্প – রাঢ় অঞ্চলে বৃহৎ শিল্প খুব একটা গড়ে ওঠেনি। তবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জন্য এই অঞ্চল জগদ্বিখ্যাত। এই অঞ্চলের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী কুটিরশিল্প হল – বাঁকুড়া ও বীরভূম জেলার পোড়ামাটি ও টেরাকোটার কাজ ও পুতুল শিল্প, বিষ্ণুপুরের রেশম, তসর, শাঁখা ও কাঁসা-পিতলের শিল্প, মুর্শিদাবাদের হাতির দাঁতের শিল্প ও রেশম শিল্প, পশ্চিম মেদিনীপুরের মাদুর ও বেতশিল্প এবং হুগলির তাঁতশিল্প।
এছাড়া বীরভূমের আহম্মদপুরের চিনি কল ও রাঢ়ের বিভিন্ন অঞ্চলের চালকল, তেলকল ও কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরির কারখানা এই অঞ্চলের মাঝারি শিল্পের কয়েকটি নিদর্শন। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বর্ধমান, বাঁকুড়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরে কিছু বৃহৎ শিল্পস্থাপনে উদ্যোগী হয়েছেন। এর মধ্যে বর্ধমানের অন্ডালে একটি বিমাননগরী বা এয়াট্রোপোলিশ স্থাপনের পরিকল্পনা অন্যতম।
বিহারীনাথপশ্চিমবঙ্গেরবাঁকুড়া জেলার উচ্চতম পাহাড়। এই অঞ্চলটি জেলার অন্যতম গভীর বনাঞ্চলও বটে। এই পাহাড়ের উচ্চতা ৪৫১ মিটার (১,৪৮০ ফুট)।[১] বিহারীনাথ বাঁকুড়া শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার (৩৭ মাইল) এবং শালতোড়া শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার (৯ মাইল) দূরে অবস্থিত। বিহারীনাথ এলাকায় কিছু প্যালিওলিথিক প্রত্নসামগ্রী উদ্ধার হয়। এর পর থেকেই এই পাহাড় ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলি পুরাতাত্ত্বিক মহলে বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি করেছে।[২] বিহারীনাথ পাহাড়ের পাদদেশ অংশটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। ০.৫০ হেক্টর আয়তনের একটি ছোটো জলাধারকে কেন্দ্র করে এই পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। বিহারীনাথের নিকটে একটি প্রাচীন জৈন মন্দিরও আছে।[৩] এই অঞ্চলে ভূগর্ভে কয়লা সঞ্চিত রয়েছে। বিহারীনাথ ব্লক দামোদরোত্তর অঞ্চলের রানিগঞ্জ কয়লাক্ষেত্রের দক্ষিণ মধ্য অংশে অবস্থিত। পুরো অঞ্চলটিই পলিমাটিতে ঢাকা।[৪]
বাংলাদেশ এবং ভারত একটা ৪,১৫৬ কিমি (২,৫৮২ মাইল) লম্বা আন্তর্জাতিক সীমানা অংশ ভাগ করে, এটা বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘতম ভূমি সীমানা, যার মধ্যে আছে অসম ২৬২ কিমি (১৬৩ মাইল), ত্রিপুরা ৮৫৬ কিমি (২৭৫ মাইল), মিজোরাম ১৮০ কিমি (১১০ মাইল), মেঘালয়া ৪৪৩ কিমি (২৭৫ মাইল) এবং পশ্চিমবঙ্গ ২,২১৭ কিমি (১,৩৭৮ মাইল)।[১] সীমানার পাশাপাশি বাংলাদেশের বিভাগগুলোর মধ্যে আছে ময়মনসিংহ, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট এবং চট্টগ্রাম। দুটো রাষ্ট্রের মধ্যে কতগুলো থাম দিয়ে মার্কা করা আছে। সামান্য সীমা নির্ধারণ করা জায়গায় দু-দিক থেকে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া আছে। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে ভারত এবং বাংলাদেশ দু-দেশের অনুমোদন সাপেক্ষে ভূমি পরিসীমা চুক্তি করে সীমানার সরলীকরণ করা হয়েছে।[২]
গোসম্পদ, খাবার জিনিস, ওষুধ এবং মাদকদ্রব্য ভারত থেকে বাংলাদেশে চোরা কারবারের গুপ্তপথ হিসেবে সীমানাকে ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও, বেআইনি অনুপ্রবেশকারীরা বাংলাদেশ থেকে ভারতে সীমানা অতিক্রম করে। কারণ একটা বিরাট সংখ্যক বেআইনি অনুপ্রবেশকারী সীমানা অতিক্রম করে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ঢোকে, ভারতীয় সীমা প্রহরা চৌকিগুলো একটা বিতর্কিত দেখামাত্র-গুলিচালনা নীতি কার্যকর করেছে।[৪][৫][৬] ভারতীয় সেনা এবং বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে হিংসার খবরের জন্যে এই নীতি নেওয়া হয়েছে।[৭] ২০০১ খ্রিস্টাব্দে খুব লক্ষণীয়ভাবে ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ছোটো লড়াইয়ে সামিল হয়ছিল, এই সীমানা যার সাক্ষ্য বহন করে।
২০০৯ খ্রিস্টাব্দের জুলাইতে চ্যানেল ৪ নিউজ সংবাদ দেয় যে, বিএসএফ ভারত-বাংলাদেশি বেড়া চৌকির পাশাপাশি কয়েকশো বাংলাদেশি মানুষকে হত্যা করে। বিএসএফ দাবি করে যে, বেড়া চৌকির মূল উদ্দেশ হল বেআইনি অনুপ্রবেশ ঠেকানো এবং সীমা-পার সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ।[৮] ২০১০ খ্রিস্টাব্দে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লু) ৮১ পাতার প্রতিবেদন দাখিল করে যাতে বলা হয়েছে, বিএসএফের অসংখ্য অপব্যবহার সামনে এসেছে। প্রতিবেদনটা নেওয়া হয়েছে বিএসএফের পীড়নের শিকার, সাক্ষী, বিএসএফ সদস্য এবং তার বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ থেকে। প্রতিবেদন বলছে যে, একুশ শতকের প্রথম দশকের মধ্যে ১০০০ বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছে। এইচআরডব্লু বলছে বিএসএফ শুধু বেআইনি অনুপ্রবেশকারী অথবা চোরাকারবারীদেরই হত্যা করেনি, এমনকি নিরীহ ব্যক্তি যাদের কাছাকাছি দেখা গিয়েছে, কখনোবা এমনকি যারা সীমানার কাছে জমিতে কাজ করছে (কৃষিজমি) তাদেরও।[৯]
বাংলাদেশ সরকার বিএসএফের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যে, তারা জোর করে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ঢুকে ভারত-বাংলাদেশ সীমানার পাশাপাশি এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। এটা বাংলাদেশ থেকে ব্যাপকভাবে বেআইনি অনুপ্রবেশের প্রতিশোধ এবং যার ফলে ভারত-বাংলাদেশের মাঝে কাঁটাতারের বেড়ার সূত্রপাত।[১০] ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের আগস্টে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিএসএফ কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে যে, তারা ৫৯ জন বেআইনি ব্যক্তিকে হত্যা করেছে (৩৪ বাংলাদেশি, ২১ ভারতীয় এবং বাকিরা অজ্ঞাত) যারা আগের ছ-মাসের মধ্যে সীমানা পার করার চেষ্টা করেছিল।[১১] বাংলাদেশি সংবাদ মাধ্যম অভিযোগ করেছে যে বিএসএফ বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও জেলারহরিপুর উপজেলা থেকে ২০১০ খ্রিস্টাব্দে ৮ এবং ১৫ বছর বয়সী ৫ জন বাংলাদেশি শিশুকে অপহরণ করেছে। শিশুরা সীমানার কাছে মাছ ধরতে এসেছিল।[১২] ২০১০-এ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অভিযোগ করেছে যে সীমান্ত প্রতিরক্ষা বাহিনী এলোপাথাড়ি হত্যা করেছে। ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি বিএসএফ বাহিনী হত্যা করে লাশটা বেড়ার ওপর ঝুলিয়ে রেখেছিল – যেটা ছিল ফেলানি (১৫ বছর বয়সী এক বাংলাদেশি বালিকা)।[১৩]
ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে চোরাচালান এবং অবৈধ অনুপ্রবেশ, গরু পাচার, মাদক এবং বেআইনি অস্ত্র চালান ইত্যাদি নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক সম্মেলন সংঘটিত হয়েছে, বিজিবি থেকে কর্নেল মুহম্মদ শাহিদ সারওয়ার সীমান্ত প্রতিরক্ষা বাহিনীকে দুর্বৃত্তদের এক তালিকা দিয়েছেন, যা ভারতে জায়গা নিয়েছে, এবং বিএসএফ-ও একই ধরনের তালিকা বিজিবিকে হস্তান্তর করেছে।
পরিবেষ্টিত অঞ্চল, বিপরীত অধিকৃত এবং অনির্দেশিত সীমানাগুলো
ভারত—বাংলাদেশ সীমানা
পরিবেষ্টিত অঞ্চল অথবা ছিটমহলসমূহ হল ভারত ও বাংলাদেশের মাঝে ভারত অন্তর্ভুক্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সীমানায় অবস্থিত দু-দেশের মধ্যে একটা দীর্ঘ বিচার্য বিষয়।
সীমানাটা তৈরি হয়েছে একটা সরু দাগ দিয়ে যাকে ‘চিকেন্স নেক‘ বা ‘পাখির ঘাড়’ বলা হয় এবং যা ভারতের মূল ভূভাগ ও উত্তর-পূর্ব ভারতকে অসুবিধেজনক অবস্থায় যোগ করেছে
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত মেদিনীপুর বিভাগভুক্ত একটি জেলা। বাঁকুড়া জেলার ভূগোল মধ্য রাঢ়ের এক বৃহদায়তন অঞ্চলের ভৌগোলিক বিস্তৃতির পরিচায়ক। পশ্চিমের উচ্চভূমি, ছোট ছোট টিলা, কাঁকুড়ে লাল মাটি, খরস্রোতা নদীনালা ও চরমভাবাপন্ন জলবায়ু বাঁকুড়া জেলার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য।
অবস্থান ও বিস্তৃতি
বাঁকুড়া জেলা পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যভাগে ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল থেকে মধ্য গাঙ্গেয় নিম্নভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত। এই জেলা দক্ষিণে ২২º৩৮´ উত্তর অক্ষাংশ থেকে উত্তরে ২৩º৩৮´ উত্তর অক্ষাংশ এবং পশ্চিমে ৮৬º৩৬´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ থেকে পূর্বে ৮৭º৪৬´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। জেলার মোট ভৌগোলিক আয়তন ৬৮৮২ বর্গ কিলোমিটার। জেলার উত্তরে পশ্চিম বর্ধমান জেলা, দক্ষিণে ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা, দক্ষিণ-পূর্ব হুগলি জেলা এবং পশ্চিমে পুরুলিয়া জেলা। দামোদর নদ বাঁকুড়া ও দুই বর্ধমান জেলাদুটিকে পৃথক করেছে।
বাঁকুড়া জেলার বিস্তৃতি ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে নিম্ন গাঙ্গেয় সমভূমির মধ্যভাগ পর্যন্ত। এই অঞ্চলের মধ্যে ভূপ্রাকৃতিক তারতম্য অনুযায়ী বাঁকুড়া জেলাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় – পশ্চিমের উচ্চভূমি ও পাহাড়ি অঞ্চল, মধ্যভাগের অসমতল ভূমিভাগ ও পূর্বের পলিগঠিত সমভূমি।
পশ্চিমের উচ্চভূমি ও পাহাড়ি অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য হল বন্ধুর ভূমিভাগ, ঘন অরণ্য, স্থানে স্থানে বিচ্ছিন্ন ল্যাটেরাইট পাহাড়, টিলা, শিলাস্তুপ ও উপত্যকা। এই অঞ্চলের উত্তরভাগ শুশুনিয়া উচ্চভূমি নামে পরিচিত। শুশুনিয়া ও বিহারীনাথ এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য পাহাড়। মধ্যভাগের অসমতল ভূমিভাগও শিলাস্তুপ, নিম্নশৈলশিরা ও উপত্যকাযুক্ত। অন্যদিকে সমগ্র বিষ্ণুপুর মহকুমা ও সদর মহকুমার অধিকাংশ থানা নিয়ে গঠিত পূর্বের সমভূমি অঞ্চল দামোদর ও দ্বারকেশ্বর নদের সঞ্চিত পলিদ্বারা গঠিত। এখান থেকেই পশ্চিমে ভূমিভাগ ক্রমশ উঁচু হয়েছে।
ভূতত্ত্ব
বাঁকুড়া জেলার অধিকাংশ অঞ্চল ল্যাটেরাইট ও পলিমৃত্তিকা দ্বারা গঠিত। যদিও জেলার পশ্চিমাংশ গঠিত হয়েছে আর্কিয়ান যুগের সিস্টোস ও নিসোস শিলার দ্বারা ও দক্ষিণাংশ গণ্ডোয়ানা সিস্টেমের পাললিক শিলা দ্বারা গঠিত। জেলার উত্তর-পশ্চিমাংশে কিছু মেসোজোয়িক যুগের ডলোরাইট গঠিত ডাহক লক্ষিত হয়। অন্যদিকে বিষ্ণুপুর মহকুমার বিস্তীর্ণ অঞ্চল গঠিত হয়েছে সাম্প্রতিক পলি দ্বারা।
নদনদী
বাঁকুড়া জেলার প্রধান নদনদীগুলি হল দামোদর, দ্বারকেশ্বর, শিলাই ও কংসাবতী। নদীগুলি পরস্পরের সঙ্গে প্রায় সমান্তরালে ভূমির ঢাল অনুসারে উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্বে প্রবাহিত হয়েছে। এগুলির উৎপত্তি ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল ও মৌসুমি বৃষ্টির জলে পুষ্ট হওয়ায় বর্ষাকাল ছাড়া বছরের অন্য সময়ে এই সকল নদীতে জল অত্যন্ত কম থাকে। যদিও বর্ষায় প্রায়ই এই জেলায় দুকুল ছাপিয়ে বন্যা দেখা দেয় কিন্তু শীতকাল আসার সঙ্গে সঙ্গেই আবার জলতলের উচ্চতা নেমে যায়। দামোদর এই জেলার প্রধান নদ ও এই নদ বাঁকুড়াকে বর্ধমান থেকে পৃথক করেছে। ভয়াল বন্যা এই নদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সেই কারণে দামোদর ‘বাংলার দুঃখ’ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। তবে বর্তমানে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন এই নদে বাঁধ দিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। সালি ও বোদাই বাঁকুড়ায় দামোদরের প্রধান উপনদী। দ্বারকেশ্বর নদ জেলার মধ্যভাগ দিয়ে উত্তর-পশ্চিম থেকে পূর্বে প্রবাহিত। এর প্রধান উপনদী হল আরকুসা, গন্ধেশ্বরী, শিলাই, বরাহ ইত্যাদি। এছাড়া জয়নাগু, কুমারী, কানা দামোদর, ভৈরববাঁকি, তারাফেনী জেলার উল্লেখযোগ্য নদনদী। দামোদরের জলোচ্ছ্বাসে মেজিয়া ব্লকে একটি বিল তৈরি হয়েছে। এটি মেজিয়া বিল নামে পরিচিত।
পাহাড়-পর্বত
বিহারীনাথ বাঁকুড়া জেলার সর্বোচ্চ পাহাড়। জেলার উত্তরভাগে শালতোড়া ব্লকে অবস্থিত এই পাহাড়ের উচ্চতা ১৪৬৯ ফুট। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাহাড় ছাতনা ব্লকে অবস্থিত শুশুনিয়া। উচ্চতা ১৪৪২ ফুট। তৃতীয় সর্বোচ্চ পাহাড় রানিবাঁধ ব্লকের বামনীসিনি। এর উচ্চতা ৮০০ ফুট। অন্যান্য পাহাড়ের মধ্যে খাতড়া ব্লকের মশক ও লেভি পাহাড়, গঙ্গাজলঘাটি ব্লকের কাড়ো পাহাড়, রানিবাঁধ ব্লকের ছেঁদাপাহাড়, মেজিয়া ব্লকের মেজিয়া পাহাড় ও খাতড়া ব্লকের মুকুটমণিপুর পাহাড় উল্লেখযোগ্য।[১]
জলবায়ু
বাঁকুড়া জেলার জলবায়ু উষ্ণ ও শুষ্ক। সমুদ্র থেকে দূরে অবস্থিত হওয়ায় এই অঞ্চলের জলবায়ু চরমভাবাপন্ন, যদিও স্বাস্থ্যকর। উষ্ণ গ্রীষ্ম, উচ্চ আর্দ্রতা ও সুষম বৃষ্টিপাত এই অঞ্চলের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য। শীতকাল (নভেম্বরের মধ্যভাগ থেকে-ফেব্রুয়ারির শেষভাগ), গ্রীষ্মকাল (মার্চ-মে), বর্ষাকাল (জুন-সেপ্টেম্বর) ও শরৎকাল (অক্টোবর-নভেম্বরের প্রথম ভাগ) – এই চারটি ঋতু এই জেলায় বিশেষভাবে লক্ষিত হয়। গ্রীষ্মকালীন সর্বাধিক তাপমাত্রা ৪৪º-৪৫º সেন্টিগ্রেড ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৫º সেন্টিগ্রেড এবং শীতকালীন সর্বাধিক ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা যথাক্রমে ৩৩º সেন্টিগ্রেড ও ৬º সেন্টিগ্রেড। মার্চ মাস থেকে উষ্ণতা বৃদ্ধি পেতে থাকে ও মে মাসে তাপমাত্রা সর্বাধিক হয়। অপরদিকে শরৎকালে উষ্ণতা হ্রাস পেতে শুরু করে ও ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে এই জেলা সর্বাধিক শীতল থাকে। গ্রীষ্মে মাঝে মাঝে লু ও শীতে শৈত্যপ্রবাহও বইতে দেখা যায়। জেলার গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৪০০ মিলিমিটার, যার অধিকাংশই বর্ষাকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ঘটে। উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্বে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস পায়। গ্রীষ্মে কালবৈশাখী ঝড় দেখা যায়।
মৃত্তিকা
বাঁকুড়া জেলার অধিকাংশ স্থানই কাঁকুড়ে ল্যাটেরাইট বা বেলে-দোঁয়াশ মাটিতে গঠিত। কিন্তু দামোদর অববাহিকার ইন্দাস, কোতুলপুর ও সোনামুখী ব্লক এলাকার উত্তরভাগ সাম্প্রতিক পলি দ্বারা গঠিত। উচ্চভূমির মাটি অনুর্বর হলেও ধান, ভূট্টা ও গম চাষের উপযুক্ত। নিম্নভূমির মাটি উর্বর। এই মাটি সালি ও সুমা – এই দুই ধরনের। সালি মাটিতে ধান ও সুমা মাটিতে নানাপ্রকার ফসলের চাষ ভাল হয়।
স্বাভাবিক উদ্ভিদ
বাঁকুড়া জেলার মোট বনভূমির আয়তন ২৪৭.৭০ হাজার হেক্টর, যা জেলার মোট ভৌগোলিক আয়তনের ২১.৪৭%। জাতীয় অরণ্য নীতি কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে এটি সামান্য কম। মূলত শুষ্ক ক্রান্তীয় পর্ণমোচী অরণ্য বা শালবন এখানে বেশি দেখা যায়। এছাড়া পিয়াশাল, সেগুন, বহেড়া, পলাশ, কুসুম, মহুয়া, পিপুল, বাবলা, আম, কাঁঠাল, পারাষি এবং আগাছার মধ্যে ধুতুরা, নিশিন্দা, আশশেওড়া ইত্যাদি দেখা যায়। জেলার সোনামুখী, জয়পুর, বিষ্ণুপুর, রানিবাঁধ এলাকায় অরণ্যাঞ্চল নিবিড়। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ছাড়া জেলার সর্বত্রই অরণ্য অসমান বিস্তৃত। তবে ভূমিরূপের বিচ্ছিন্নতার উপর অরণ্যের বিস্তার নির্ভরশীল। উচ্চভূমি, পাহাড়ের ঢাল, শৈলশিরাগুলিতে অরণ্যের ঘনত্ব বেশি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বৃক্ষচ্ছেদন করে চাষাবাদ ও বসতিস্থাপনের ফলে অরণ্যপ্রকৃতি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে তাই কৃত্রিম উপায়ে বনায়ন ঘটিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা চলছে।