দাহালা খাগড়াবাড়ী (#৫১) একটি ভারতীয় ছিটমহল ছিল যা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার জেলার অন্তর্গত ছিল। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের একটি অংশ ছিল। ১ আগস্ট ২০১৫ সালে বাংলাদেশকে দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এটি বাংলাদেশের একমাত্র তৃতীয়-ক্রমের ছিটমহল (বা কাউন্টার-কাউন্টার-ছিটমহল) ছিলো। এটি ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহলগুলির সর্বাপেক্ষা ছোটগুলির মধ্যে একটি- ৭,০০০ বর্গমিটার (১.৭ একর), যদিও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১০৬টি ও ভারতের অভ্যন্তরে ৯২টি বাংলাদেশী ছিটমহলের মধ্যে এটি সর্বাপেক্ষা ছোট নয়।
পরিদর্শন
দহলা খাগড়াবাড়ি (# ৫১) বাংলাদেশী গ্রাম উপনচৌকি ভজনি দ্বারা পুরোপুরি ঘেরা ছিলো এবং #১১০ নিজে ভারতীয় গ্রাম বালপাড়া খাগড়াবাড়ী এবং বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের দেবীগঞ্জের অন্তর্গত। এভাবে, দহলা খাগড়াবাড়ি একটি ছিল ছিটমহলের ছিটমহল। বাস্তবে, এই জমির অংশটুকু বসবাসের জন্য ব্যবহৃত না হয়ে কৃষিকাজের জন্য ব্যবহৃত হতো। এটি এর প্রথম ক্রমের ভারতীয় ছিটমহল থেকে কয়েক হাজার মিটার বাংলাদেশী জমি দ্বারা পৃথক ছিল।
এই ছিটমহলের মালিক একজন বাংলাদেশী কৃষক ছিলেন যিনি দহলা খাগড়াবাড়ির আশেপাশের ছিটমহলে বাস করেন (#৫১)
এর আকার ছোট হলেও, দহলা খাগড়াবাড়ি (# ৫১) ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে পাওয়া ছিটমহলগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা ছোট ছিল না, যেখানে সর্বাপেক্ষা ছোটটি হলো পানিসালা নং ৭৯, যা বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের অন্তর্গত ১,০৯০ বর্গমিটার (০.২৭ একর) বিশিষ্ট একটি ভারতীয় ছিটমহল। [১]
প্রশাসনের অভাব এবং ছিটমহলের বাসিন্দাদের অসুবিধাজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার কারণে, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত ও বাংলাদেশ সরকার ১৬২ টি ছিটমহল অদলবদলের অভিপ্রায় ঘোষণা করে, যাতে বাসিন্দাদের জাতীয়তার সুযোগ প্রদান করে সমস্যাটির সমাধান করা যায়।[২] ৬মে, ২০১৫-তে ভারত স্থলসীমান্ত চুক্তিটি অনুমোদন করে এবং ছিটমহলটিকে বাংলাদেশের কাছে তুলে দিতে সম্মত হয়।
পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু মূলত ক্রান্তীয় প্রকৃতির অর্থাৎ উষ্ণ ধরনের। এছাড়া এই রাজ্যের জলবায়ুর উপর মৌসুমী বায়ুর প্রভাব অত্যন্ত বেশি। এজন্য পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুকে ক্রান্তীয় মৌসুমী জলবায়ু বলা হয়ে থাকে। উত্তরের হিমালয় পর্বত থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তার এবং ভূমিরূপের নানা বৈচিত্র্য এই রাজ্যের বিভিন্ন অংশের বায়ুর উষ্ণতা, বায়ু প্রবাহ ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণের তারতম্য ঘটিয়েছে। জলবায়ুগতভাবে পশ্চিমবঙ্গ একটি বৈচিত্র্যময় রাজ্য।
জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য
ঋতু পরিবর্তন : পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুতে চারটি ঋতু চক্রাকারে আবর্তিত হয়। যথা: গ্রীষ্মকাল, বর্ষাকাল, শরৎকাল ও শীতকাল।
মৌসুমী বায়ুর প্রভাব : গ্রীষ্মকালে উষ্ণ-আর্দ্র দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু এবং শীতকালে শীতল ও শুষ্ক মৌসুমী বায়ু এই রাজ্যের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে বর্ষাকালে (গ্রীষ্মকালের শেষভাগ) প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটে এবং শীতকালে শুষ্ক ও শীতল জলবায়ু বিরাজ করে।
বিপরীতমুখী বায়ুপ্রবাহ : গ্রীষ্মকালে যে দিক থেকে বায়ু প্রবাহিত হয়, শীতকালে হয় ঠিক তার বিপরীত দিক থেকে।
উত্তরপ্রান্তে সর্বাধিক বৃষ্টিপাত : দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে এই রাজ্যের উত্তরপ্রান্তের পার্বত্য অঞ্চলে (দার্জিলিং হিমালয়ের পাদদেশে) প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়।
উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলের তুলনায় রাজ্যের বাকী এলাকার জলবায়ু সমভাবাপন্ন : দার্জিলিং হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল-এ ভূমির উচ্চতা বেশি বলে গ্রীষ্মকাল মনোরম, কিন্তু শীতকাল অত্যন্ত তীব্র
পশ্চিমবঙ্গের অবশিষ্ট সমভূমি অঞ্চলে গ্রীষ্মকাল ও শীতকালের মধ্যে উষ্ণতার পার্থক্য খুব বেশি হয় না। তবে পশ্চিমের পুরুলিয়া জেলায় শীত-গ্রীষ্মের তাপের পার্থক্য সমভূমি অঞ্চল থেকে বেশি।[১]
ঋতুচক্র
বছরের বিভিন্ন সময়ে উষ্ণতার তারতম্য, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, বায়ুপ্রবাহের বৈচিত্র্য প্রভৃতি লক্ষ্য করে আবহতত্ত্ববিদগণ পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুকে চারটি প্রধান ঋতুতে ভাগ করেছেন। যথা: গ্রীষ্মকাল, বর্ষাকাল, শরৎকাল ও শীতকাল। গ্রীষ্মকাল সম্পাদনা মার্চ মাসের শুরু থেকে মে মাস পর্যন্ত এর স্থায়ীত্ব।
উষ্ণতা
গ্রীষ্মকালে সমভূমি অঞ্চলে গড় উষ্ণতা থাকে ২৪ °সে (৭৫ °ফা) থেকে ৩২ °সে (৯০ °ফা)।[২] তবে, স্থানভেদে উষ্ণতার তারতম্য দেখা যায়। যেমন, এপ্রিল মে মাসে যখন শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, কোচবিহারে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উঠতে চায় না, তখন দক্ষিণবঙ্গ ও পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চলের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রিতে অবস্থান করে।[৩][৪][৫] গ্রীষ্মকালে বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়া, পশ্চিম বর্ধমান জেলায় তাপপ্রবাহ চলে ও উষ্ণতা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করে।[৬][৭][৮] তবে, দার্জিলিঙের পার্বত্য অঞ্চলে ভূমির উচ্চতা বেশি বলে গ্রীষ্মকাল মনোরম। দার্জিলিঙে গ্রীষ্মকালীন গড় উষ্ণতা ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বৃষ্টিপাত
মে মাসে মাঝে মাঝে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে কালবৈশাখী নামক ঘূর্ণিঝড়ের আবির্ভাবের ফলে ঝড়বৃষ্টি হয় এবং গরম অনেকটা কমে যায়।[৯]
বর্ষাকাল সম্পাদনা জুলাই মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাসের শেষভাগ পর্যন্ত বর্ষাকাল। বর্ষাকালে দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর থেকে আসা উষ্ণ-আর্দ্র দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে সারা রাজ্যে বৃষ্টিপাত হয়, কোথাও কম কোথাও বেশি। বার্ষিক ১৭৫ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাতের ১২৫ সেন্টিমিটার এই সময় বর্ষিত হয়। রাজ্যের উত্তরভাগে সর্বাধিক বৃষ্টিপাত হয় ২৫০ সেন্টিমিটার।
শরৎকাল সম্পাদনা অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যভাগ পর্যন্ত শরৎকালের স্থায়ীত্ব। এই সময় আকাশ মেঘমুক্ত হয় এবং অপেক্ষাকৃত মনোরম আবহাওয়া বিরাজ করে। তবে এসময় মাঝে মাঝে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে প্রবল ঝড়বৃষ্টি হয়, একে আশ্বিনের ঝড় বলা হয়। এই ঋতুর শেষে বাতাসে ক্রমশ হিমেল ভাব দেখা দেয়।
শীতকাল সম্পাদনা ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত শীতকাল স্থায়ী থাকে। জানুয়ারি শীতলতম মাস। তাপমাত্রা সর্বনিম্ন গড়ে ৯°-১৬° সেন্টিগ্রেড থাকলেও রাজ্যের উত্তরভাগে তাপমাত্রা আরও কমে যায়। কোন কোন সময় ঘূর্ণিঝড় পশ্চিমা ঝঞ্ঝার সামান্য বৃষ্টিপাত হয়।
জলবায়ুর নিয়ন্ত্রক
কর্কটক্রান্তি রেখা : পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে (পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বর্ধমান ও নদিয়া) পূর্ব-পশ্চিমে কর্কটক্রান্তি রেখা (২৩.৫° উত্তর) বিস্তৃত থাকায় এই রাজ্যের অধিকাংশ স্থান (দার্জিলিং হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল ছাড়া) উষ্ণভাবাপন্ন।
মৌসুমী বায়ু : বর্ষাকালে দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর থেকে আসা উষ্ণ-আর্দ্র দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে সারা রাজ্যে বৃষ্টিপাত হয়, কোথাও কম কোথাও বেশি। শীতকালে উত্তরভাগের ঠান্ডা স্থলভাগ থেকে আসা উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে ঠান্ডা পড়ে। এই বায়ুপ্রবাহ শুষ্ক থাকে বলে বৃষ্টিপাত বিশেষ হয় না।
ভূমির উচ্চতা : ভূমির উচ্চতা বাড়লে উষ্ণতা কমে।
পশ্চিমবঙ্গের সমভূমি অঞ্চলের তুলনায় দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলের উচ্চতা বেশি বলে উষ্ণতাও এই অঞ্চলে অনেক কম।
সামুদ্রিক প্রভাব : সমুদ্রের প্রভাবের জন্য এই রাজ্যের দক্ষিণ ভাগের জলবায়ু প্রায় সমভাবাপন্ন; শীত ও গ্রীষ্ম কোনটাই তীব্র নয়।
পর্বতের প্রভাব : পশ্চিমবঙ্গের উত্তর সীমান্তে হিমালয় পর্বতশ্রেণী পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত থাকায় একদিকে যেমন আর্দ্র দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু এতে বাধা পেয়ে এই রাজ্যে বৃষ্টিপাত ঘটায়, তেমনি উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ুও হিমালয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয় বলে পশ্চিমবঙ্গে শীত কম পড়ে।[২]
প্রভাব
বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভর করে পশ্চিমবঙ্গের সমভূমিতে বেশিরভাগ শস্য উৎপাদন হয়। উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু ধান ও পাট চাষের পক্ষে আদর্শ। এছাড়া ডাল ও তৈলবীজের ফলন ব্যাপকভাবে হয়। দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে অধিক বৃষ্টিপাতের ফলে চা-এর উৎপাদন উন্নতমানের এবং স্বাদে-গন্ধে জগৎ-বিখ্যাত।
তিনবিঘা করিডোর হল একটি স্বতন্ত্র ভূমি যা ভারতের মালিকানাধীন তিন বিঘা জায়গার মধ্যে অবস্থিত। এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ মহকুমা ও বাংলাদেশের লালমনিরহাটেরপাটগ্রাম উপজেলার সীমান্তে অবস্থিত। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের দহগ্রাম-আঙ্গরাপোতা ছিটমহলে যাতায়াতের সুবিধার্থে এটি বাংলাদেশকে ইজারার মাধ্যমে দেওয়া হয়।[১]
ইতিহাস
তিনবিঘা করিডোরের মাঝে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহলে যাতায়াতের রাস্তা।
তিনবিঘা করিডোরের চারপাশে কাটাঁতারের বেড়া।
১৯৭৪ এর ১৬ইমে এর ইন্দিরা গান্ধী-শেখ মুজিবুর রহমান চুক্তি অনুসারে ভারত ও বাংলাদেশ তিনবিঘা করিডোর (১৭৮ বাই ৮৫ মিটার (৫৮৪ ফু × ২৭৯ ফু)) ও দক্ষিণ বেরুবাড়ীর (৭.৩৯ বর্গকিলোমিটার (২.৮৫ বর্গমাইল)) সার্বভৌমত্ব পরস্পরের কাছে হস্তান্তর করে। এরফলে উভয়দেশেই তাদের ছিটমহলে যথাক্রমে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ও দক্ষিণ বেরুবাড়ীর যাতায়াত সুবিধা তৈরি হয়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ চুক্তি অনুসারে সাথে সাথেই দক্ষিণ বেরুবাড়ী ভারতের কাছে হস্তান্তর করে যদিও ভারত তিনবিঘা করিডোর বাংলাদেশের কাছে রাজনৈতিক কারণে হস্তান্তর করেনি। এটি হস্তান্তরে ভারতের সাংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন ছিল।[২][৩]
পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের অনেক বিরোধিতার পর ২০১১ সালে ভারত পূর্ণভাবে এটি বাংলাদেশকে দেওয়ার বদলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ইজারা হিসাবে দিয়েছিল এই শর্তে যে একই সময়ে দক্ষিণ বেরুবাড়ি ভারতের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে।[৪]
১২ নং দক্ষিণ বেরুবাড়ী ইউনিয়নের মোট আয়তন ২২.৫৮ বর্গকিলোমিটার (৮.৭২ বর্গমাইল), যার ১১.২৯ বর্গকিলোমিটার (৪.৩৬ বর্গমাইল) বাংলাদেশ পেয়েছিল। এছাড়াও পূর্বের ভাগ অনুসারে কোচ বিহারের চারটি ছিটমহল বাংলাদেশে পড়েছিল যার আয়তন ৬.৮৪ বর্গকিলোমিটার (২.৬৪ বর্গমাইল), এভাবে মোট আয়তন ১৮.১৩ বর্গকিলোমিটার (৭.০০ বর্গমাইল) যা বাংলাদেশে স্থানান্তর হওয়ার কথা ছিল। ১৯৬৭ সালের হিসেব অনুযায়ী এই ভূখন্ডগুলোর মোট জনসংখ্যার ৯০%ই ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের ছিটমহল দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ভারতে হস্তান্তরের কথা ছিল। যার মোট আয়তন ১৮.৬৮ বর্গকিলোমিটার (৭.২১ বর্গমাইল) ও ১৯৬৭ সালের হিসেব অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার ৮০% ছিল মুসলমান। যদি এই হস্তান্তর সফল হতো তাহলে এটি জাতিগত দাঙ্গা সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকত। ফলে তখন বেরুবাড়ীর জনগণ এই হস্তান্তরের বিরোধিতা করেছিল।
১৯৭১ এর পর ভারত বাংলাদেশকে প্রস্তাব দেয় বেরুবাড়ীর অর্ধাংশ ভারতের অধীন থাকবে এবং দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা বাংলাদেশেই থাকবে। এই চুক্তি অনুসারে ভারত দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাবাসীর বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য একটি তিনবিঘা আয়তনের জায়গা ইজারা হিসেবে দিয়েছিল। এটি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল এবং তিনবিঘার চারপাশে সতর্কতার সাথে বেষ্টনী দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৪ সালের ১৬ই মে ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত ১.১৪ ধারা অনুসারে বেরুবাড়ী বিরোধের অবসান ঘটে। চুক্তি অনুসারেঃ “ভারত দক্ষিণ বেরুবাড়ীর দক্ষিণাংশের অর্ধেক নিয়ন্ত্রণ করবে যার আনুমানিক আয়তন ৬.৮ বর্গকিলোমিটার (২.৬৪ বর্গমাইল) এবং বিনিময়ে বাংলাদেশ দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা নিয়ন্ত্রণ করবে। ভারত দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাবাসীদের বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ১৭৮ বাই ৮৫ মিটার (৫৮৪ ফু × ২৭৯ ফু) আয়তনের একটি ভূমি বাংলাদেশকে ইজারা হিসেবে দেবে।” [৫]
নামের উৎপত্তি
বাংলা আয়তন পরিমাপের একটি একক বিঘা থেকে তিনবিঘা নামের উৎপত্তি, ভূমিটির মোট আয়তন ১,৫০০ থেকে ৬,৭৭১ বর্গমিটার (১৬,১৫০ থেকে ৭২,৮৮০ বর্গফুট) যা তিন বিঘা পরিমাপের সমান।
করিডোরে প্রবেশ
তিনবিঘা করিডোরে ভারতীয় বিএসএফ এর ক্যাম্প।
পূর্বে করিডোরটি দিনের ১২ ঘণ্টা সময়ের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হত,[৬][৭] এতে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার অধিবাসীদের কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হত কারণ সে-সময় সেখানে কোন হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না।[৭]
২০১১ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার একটি চুক্তি অনুযায়ী বর্তমানে করিডোরটি ২৪ ঘণ্টাই উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।[৮][৯]
২০১১ সালের ১৯শে অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে করিডোরটি উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয়।[১০]
অবকাঠামো
২০১১ সালের পূর্বে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতাতে কোন হাসপাতাল[৭] বা কলেজ ছিল না। ২০১১ সালের ১৯শে অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দহগ্রামে একটি দশ শয্যার হাসপাতাল ও দহগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের উদ্বোধন করেন।[১০]
২০১১ সালে জনগণনার তথ্য অনুসারে কলকাতা মহানগর অঞ্চলের মোট জনসংখ্যা ১,৪১,১২,৫৩৬ জন অর্থাৎ ১ কোটি ৪০ লক্ষের কিছু বেশি।[৪] কেএমডিএ-এর রিপোর্ট অনুযায়ী অঞ্চলটির মোট আয়তন ১,৮৮৬.৬৭ বর্গকিলোমিটার (৭২৮.৪৫ মা২), সুতরাং এই অঞ্চলটির জনঘনত্ব ৭,৪৮০ প্রতি বর্গকিলোমিটার (১৯,৪০০ /বর্গমাইল)
জাট এলাকা হলো পাট চাষের একটি শব্দ যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ উত্তর-পূর্ব দিকের অংশকে নির্দেশ করে। এই ভৌগোলিক এলাকাটি বাংলাদেশের ঢাকা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল এবং কুমিল্লা জেলার অংশ নিয়ে গঠিত।[১] এলাকাটি প্রতি বছর বন্যার পানি দ্বারা বাহিত পলির তাজা জমা পায়। মাটির গঠন অম্লীয়, বেলে দোআঁশ থেকে কাদামাটি দোআঁশ পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়। বাণিজ্যিক গুণাগুণ অনুসারে, এই এলাকায় সবচেয়ে ভালো মানের পাট, জাট জাতীয় পাট জন্মে। বিশ্বে উন্নতমানের পাটের কারণে নারায়ণগঞ্জের এ অঞ্চলে আদমজী জুট মিল্স প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে মিলটি বিশ্বের বৃহত্তম পাটকলে পরিণত হয়। যদিও, মিলটি ২০০২ সালে বন্ধ হয়ে যায়।[২]
বাংলায় শহরটি চট্টগ্রাম নামে পরিচিত। নামটি চাটগাঁইয়া সংস্কৃতি, ভাষা এবং ইতিহাস থেকে এসেছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন ইতিহাস এবং চাটগাঁইয়া ভাষায় এটির বেশ কয়েকটি নাম আছে। চাটগাঁইয়া ভাষায় প্রায় ৫০% আরবি উৎসের শব্দভান্ডার রয়েছে।[১]
চাটগাঁইয়া নাম
চাটগাঁইয়া ভাষায় চট্টগ্রামের নাম চিটাঙ। অন্যান্য নামের মধ্যে রয়েছে চাটগা, চৈট্ট্যভূমি এবং চট্টলা।[২] চট্টগ্রামের চাটগাও নামটি এখনো হিন্দি, পাঞ্জাবি, এবং অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় ব্যবহার করা হয়। উর্দু এবং ফারসী ভাষায় চট্টগ্রামের নাম চাটগাম। এছাড়া চিটাগং নামটি চট্টগ্রামসহ সারা বাংলাদেশে এবং বাংলার পূর্ব উপভাষাও প্রচলিত, “গ্যাং” এর অর্থও গ্রাম। ইসলামাবাদ নামটি চট্টগ্রামের আরো একটি বহুল ব্যবহৃত নাম, যেটি মোঘল বিজয়ের পর দেয়া হয়। এবং এটি দ্বারা মূলত চট্টগ্রাম বিভাগীয় রাজধানী অর্থাৎ চট্টগ্রাম শহরকে বুঝানো হয়। এই নামেও চট্টগ্রাম সুপ্রসিদ্ধ। চাটগাঁইয়া ভাষাতেও চট্টগ্রাম শহর বুঝাতে এই নামের ব্যবহার আছে।
বাংলা নাম
বাংলা নাম চট্টগ্রাম-এর প্রত্যয় রয়েছে “-গ্রাম” যা প্রমিত বাংলা গ্রাম থেকে এসেছে, এবং “চট্ট” শব্দটি “চাটি” অর্থাৎ বাতি থেকে উৎপন্ন। একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী নামটি ইসলামের প্রসারের সময়ে, যখন একজন মুসলমান শহরের একটি পাহাড়ের চূড়ায় একটি চাটি (বাতি) জ্বালিয়েছিলেন এবং নামাজ আদায় করার জন্য (আজান) আহ্বান করেছিলেন।[৩] এইভাবে, অনেকে শহরকে বলতে থাকেন, চাটিগ্রাম বা চাটিগাঁও, যেখানে গাঁও অর্থ গ্রাম।
আরবি নাম
আরব ব্যবসায়ীরা নবম শতাব্দীতে চট্টগ্রামে উন্নত মুদ্রা, ব্যাংকিং এবং শিপিং দেখেছিল। শুরুর দিকের বিশ্বজনীন মুসলমানরা সমুদ্র বাণিজ্যের একটি প্রবেশপথ হিসেবে বন্দরের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।[৪] ভৌগোলিকভাবে, গঙ্গা বদ্বীপবাংলায় অবস্থিত। আরবি শব্দ শাত (شط) যার অর্থ বদ্বীপ, এটি চট্টগ্রাম, গঙ্গা বদ্বীপ, শাত আল-গঞ্জ (شط الغانج) এর ব্যুৎপত্তিও হতে পারে। [৫][৬][৭] মরক্কোর ভ্রমণকারী ইবনে বতুতাচট্টগ্রাম বন্দরকেসাদকাওয়ান (سدكاوان) বলে উল্লেখ করেছেন। [৮][৯] বর্তমানে চট্টগ্রামের আরবি নাম হল শীতাগুং (شيتاغونغ), যা চট্টগ্রামের ইংরেজি নাম থেকে উৎপন্ন।
আরাকানি নাম
বাংলা সালতানাত থেকে আরাকানের স্বাধীনতার পর ম্রাক ইউ রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর শহর ছিল চট্টগ্রাম। শহরের ব্যুৎপত্তির বার্মিজ ঐতিহ্য হল, ৯ম শতাব্দীতে আক্রমণকারী একজন আরাকানিজ রাজা শহরটিকে সিট-টা-গুং নাম দিয়েছিলেন (যার অর্থ যইুদ্ধ করা অনুচিত)। [৫]
পর্তুগিজ এবং ডাচ নাম
আদি ডাচ বাংলার মানচিত্র
পর্তুগিজরা বন্দর শহরটিকে পোর্টো গ্র্যান্ডে ডি বেঙ্গালা বলে উল্লেখ করেছিল, যার অর্থ “বাংলার গ্র্যান্ড হারবার”। শব্দটি প্রায়শই পোর্টো গ্র্যান্ডে হিসাবে সরলীকৃত ছিল। [১০] অন্যান্য নামের মধ্যে রয়েছে ডাচ থেকে Xatigan[১১], Xetigam, এবং Chatigão একটি আদি বাংলা নাম থেকে এসেছে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
ঐতিহাসিক নাম এবং ডাকনাম
ওলন্দাজ জাহাজ ১৭০২ সালে মুঘল আমলে চট্টগ্রাম পরিদর্শন করে
চট্টগ্রামের মুঘল বিজয় বাঙালি নিয়ন্ত্রণ পুনরায় প্রতিষ্ঠা করে এবং স্থিতিশীলতা ও বাণিজ্যের যুগের সূচনা করে। শহরটির নামকরণ করা হয় ইসলামাবাদ (ইসলামের শহর) এবং পুরনো শহরে এখনও ব্যবহার করা হচ্ছে।[১২][১৩]
রোমান ঐতিহাসিক প্লিনি দ্য এল্ডারের মতে, চট্টগ্রাম বন্দরকে এরিথ্রীয় সাগরের পেরিপ্লাসে গঙ্গাবাজার (Gongabazaar) অর্থ “গঙ্গার বাজার” হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্ণিত স্থানটি সম্ভবত সীতাকুণ্ড, সীতাকুণ্ড উপজেলায় অবস্থিত। [১৪]
প্রাচীন তিব্বতীয় গ্রন্থে শহরটি জ্বালানধারা (Jaalondhaara) নামে পরিচিত ছিল এবং আরব ভৌগোলিক গ্রন্থে সামান্দর (Samandar) নামে পরিচিত ছিল। [১৪]
শহরটি বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার (বাংলাদেশের প্রবেশপথ) এবং সেইসাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী নামে পরিচিত। [১৫]
গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ (বঙ্গীয় ব-দ্বীপ[১] বা সুন্দরবন ব-দ্বীপ, ইংরেজি: Ganges Delta বা, Bengal Delta) দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত একটি ব-দ্বীপ যা বাংলাদেশ এবং ভারতেরপশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ নিয়ে গঠিত। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম নদী ভিত্তিক ব-দ্বীপ।[২][৩] এটি গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র সহ বেশ কয়েকটি নদীর মিলিত জলরাশি হিসেবে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। এ কারণে একে অনেক সময় গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র ব-দ্বীপ নামেও অভিহিত করা হয়। এটি বিশ্বের উর্বরতম অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি। তাই, অনেকে একে গ্রিন ডেল্টা বা সবুজ ব-দ্বীপ বলে থাকেন। বদ্বীপটি হুগলী নদী থেকে পূর্ব দিকে মেঘনা নদী পর্যন্ত প্রসারিত।
ভূগোল
ব-দ্বীপের একটি সাধারণ দৃশ্য, যেখানে খেজুর গাছ, ধান খেত, সবুজ সমতল ভূমি এবং পুকুর দেখা যাচ্ছে।
গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ দেখতে অনেকটা ত্রিভুজ আকৃতির এবং এটি একটি “আর্কুয়েট” (তোরণ-আকৃতির) বদ্বীপ হিসাবে বিবেচিত হয়। বদ্বীপটি ১,০৫,০০০ কিমি২ (৪১,০০০ মা২)-এরও বেশি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। বদ্বীপটি বাংলাদেশ এবং ভারতে বিস্তৃত থাকলেও উত্তরের ভুটান, তিব্বত, ভারত ও নেপাল থেকে সৃষ্ট নদীগুলো এই বদ্বীপের মধ্য দিয়ে নিষ্কাশিত হয়। ব-দ্বীপটির প্রায় ৬০% হয় বাংলাদেশে এবং ৪০% ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত। বদ্বীপটির বেশিরভাগ অঞ্চল নদী বাহিত ছোট ছোট পলি কণা দ্বারা গঠিত। এমনকি নদীগুলো তাদের উৎস হিমবাহগুলো থেকে ফ্লুভিও-হিমবাহ হিসাবে এই সূক্ষ্ম কণাগুলো বহন করে নিয়ে আসে। লাল এবং লাল-হলুদ ল্যাটারাইট মাটি আরো পূর্ব দিকের প্রান্তে পাওয়া যায়। এই মাটিতে প্রচুর পরিমাণে খনিজ লবণ ও পুষ্টি উপাদান রয়েছে, যা কৃষির জন্য অত্যন্ত উপযোগী।
এটি অসংখ্য চ্যানেল, জলাশয়, হ্রদ এবং পলি মাটির প্লাবন সমভূমি (চর)-এর সমন্বয়ে গঠিত। গঙ্গার শাখানদী- গড়াই-মধুমতি নদী গাঙ্গেয় ব-দ্বীপকে দুটি অংশে বিভক্ত করেছে: একটি হল ভূতাত্ত্বিকভাবে তরুণ ও সক্রিয় পূর্বাঞ্চলীয় বদ্বীপ এবং অপরটি হল পুরাতন ও কম সক্রিয় পশ্চিমাঞ্চলীয় বদ্বীপ।[১]
জনসংখ্যা
মৌসুমী বায়ু জনিত বন্যা, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে বেশি পানি প্রবাহ জনিত বন্যা এবং উত্তর ভারত মহাসাগরেরঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ১২৫ থেকে ১৪৩ মিলিয়ন মানুষ এই ব-দ্বীপে বাস করে। বাংলাদেশীদের একটি বড় অংশ গাঙ্গেয় বদ্বীপে বসবাস করে এবং দেশের অনেক মানুষ বেঁচে থাকার জন্য এই বদ্বীপের উপর নির্ভরশীল।[৪]
মনে করা হয়, ৩০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের উপর নির্ভরশীল এবং প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মানুষ গঙ্গা অববাহিকায় বাস করে। অর্থাৎ, এটিই বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল নদী অববাহিকা। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের অধিকাংশ অঞ্চলের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি কিলোমিটারে ২০০ জন (অর্থাৎ, বর্গমাইল প্রতি ৫২০ জন) এবং এটি বিশ্বের সর্বাধিক ঘনবসতিযুক্ত অঞ্চলগুলোর একটি।
গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ জুড়ে রয়েছে তিনটি বাস্তুসংস্থান অঞ্চল। নিম্নতর গাঙ্গেয় সমভূমির আর্দ্র পর্ণমোচী অরণ্য অঞ্চল এ অঞ্চলের সর্বাধিক অংশ জুড়ে বিদ্যমান। অবশ্য, বনের বেশিরভাগ অংশই কৃষিকাজের জন্য ফাঁকা করা হয়েছে এবং শুধুমাত্র ছোট ছোট কিছু বনাঞ্চল রয়েছে। ক্যানব্রেক নামে পরিচিত লম্বা ঘাসের ঘন স্ট্যান্ডগুলো আর্দ্র অঞ্চলে বৃদ্ধি পায়। সুন্দরবনের স্বাদুপানির জলাভূমির বনাঞ্চল বঙ্গোপসাগরে কাছাকাছি অবস্থিত। এই বন শুষ্ক মৌসুমে নোনাপানিতে প্লাবিত হয় আবার বর্ষা মৌসুমে মিঠাপানিতে প্লাবিত হয়। এই বনও ধীরে ধীরে কৃষি জমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। বাস্তু-অঞ্চলের ১৪,৬০০ বর্গকিলোমিটার (৫,৬০০ মা২)-এর মধ্যে মাত্র ১৩০ বর্গকিলোমিটার (৫০ মা২) অঞ্চল সুরক্ষিত। বদ্বীপটির বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ হল বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভবাস্তুসংস্থান অঞ্চল, যা ৫৪ টি দ্বীপ সহ মোট ২০,৪০০ বর্গকিলোমিটার (৭,৯০০ মা২) জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। সুন্দরবনের নামকরণও করা হয়েছে সুন্দরী নামে পরিচিত একটি ম্যানগ্রোভ প্রজাতির উদ্ভিদের নামানুসারে, যার বৈজ্ঞানিক নাম Heritiera fomes।
ব-দ্বীপের প্রাণীগুলির মধ্যে রয়েছে দেশি অজগর (Python molurus), মেঘলা চিতা (Neofelis nebulosa), ভারতীয় হাতি (Elephas maximus indicus), কুমির ইত্যাদি। প্রায় ১,০২০টি বিপন্নপ্রায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার (Panthera tigris tigris) সুন্দরবনে বাস করে বলে মনে করা হয়। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় গ্রীষ্মমন্ডলীয় পাতলা বন রয়েছে যা থেকে মূল্যবান কাঠ পাওয়া যায়। এই অঞ্চলে শাল, সেগুন এবং অশ্বত্থ গাছ পাওয়া যায়। এছাড়া, বদ্বীপ অঞ্চলে গরান গাছও রয়েছে।
অনুমান করা হয় যে প্রায় ৩০,০০০ চিত্রা হরিণ (Axis axis) বদ্বীপটির সুন্দরবন অংশে রয়েছে। এছাড়াও সেখানে মাছরাঙা, ঈগল, কাঠঠোকরা, শালিক (Acridotheres tristis), জলার তিতির (Francolinus gularis) এবং দোয়েল (Copsychus saularis) পাখি দেখা যায়। বদ্বীপটিতে দুটি প্রজাতির ডলফিনের সন্ধান পাওয়া যায়: ইরাবতী ডলফিন (Orcaella brevirostris) এবং গঙ্গা নদীর ডলফিন (Platanista gangetica gangetica)। ইরাবতী ডলফিন একটি মহাসাগরীয় ডলফিন, যা বঙ্গোপসাগর থেকে বদ্বীপে প্রবেশ করে। তবে গঙ্গা নদীর ডলফিন সত্তিকারার্থেই একটি নদীতে বসবাসকারী ডলফিন। তবে এটি অত্যন্ত বিরল এবং বিপন্নপ্রায় প্রাণী হিসাবে বিবেচিত।
এছাড়া, অঞ্চলটিতে যেসব উদ্ভিদ পাওয়া যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: সুন্দরী, গর্জন, বাঁশ, গোলপাতা (Nypa fruticans) এবং ম্যানগ্রোভ খেজুর (Phoenix paludosa)। উদ্ভিদের অনেক বিপন্ন প্রজাতিও এখানে পাওয়া যায়।
ভূ-তত্ত্ব
গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত: ভারতীয় পাত, ইউরেশীয় পাত এবং বার্মা পাত।[৫]ইওসিন প্যালিওসেল্ফের প্রান্তটি কলকাতা থেকে শিলং মালভূমির প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। প্যালিওসেল্ফের প্রান্তটি উত্তর-পশ্চিমে পুরু মহাদেশীয় ভূত্বক থেকে দক্ষিণ-পূর্বের পাতলা মহাদেশীয় বা মহাসাগরীয় ভূত্বকে রূপান্তর চিহ্নিত করে। হিমালয়ের প্রবাহ থেকে আগত বিপুল পরিমাণে পলি ইওসিনের পর থেকে বদ্বীপটির সমুদ্রসৈকতকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার (২৫০ মা) প্রসারিত করেছে। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের নিচে পেলোশেল্ফের প্রান্তের দক্ষিণ-পূর্বে পলির ঘনত্ব ১৬ কিলোমিটার (১০ মাইল) অতিক্রম করতে পারে।[৬]
অর্থনীতি
ধান, গবাদি পশু এবং নদী ও পুকুরের মাছ এ অঞ্চলের মানুষের খাদ্যের প্রধান উৎস।
বাংলাদেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লোক কৃষি ক্ষেত্রে কর্মরত। তারা বদ্বীপের উর্বর প্লাবনভূমিতে ফসল ফলান। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে যেসব ফসল উৎপন্ন হয় সেগুলোর মধ্যে প্রধান হল পাট, চা এবং ধান।[৪] মাছ ধরাও এ অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশা। কারণ এ অঞ্চলের অনেকের কাছেই মাছ একটি প্রধান খাদ্য।[৭]
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিজ্ঞানীরা মাছ চাষে উন্নত পদ্ধতি প্রয়োগ করতে বদ্বীপের দরিদ্র মানুষদেরকে সহায়তা দিয়ে আসছেন। অব্যবহৃত পুকুরগুলোকে কার্যকর মাছের খামারে পরিণত করে এবং বিদ্যমান পুকুরগুলোতে মাছ চাষে উন্নত পদ্ধতি ব্যবহার করে অনেকেই এখন মাছ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করে পুকুরে মাছের উৎপাদন ৮০০% বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে।[৮]চিংড়ি সাধারণত খোলা পানিতে নিমজ্জিত কন্টেইনার বা খাঁচায় চাষ করা হয়। এগুলোর বেশিরভাগই রফতানি করা হয়।[৭]
অসংখ্য নদী-নালা বেষ্টিত থাকায় অঞ্চলটিতে যাতায়াত করা বেশ কষ্টসাধ্য। বেশিরভাগ দ্বীপপুঞ্জ থেকে মূল ভূখণ্ডে যাতায়াতের একমাত্র উপায় হল কাঠের ফেরি নৌকা। সেতুর সংখ্যা খুবই কম। কিছু দ্বীপ এখনও বৈদ্যুতিক গ্রিডের সাথে সংযুক্ত নেই। সেসব দ্বীপের বাসিন্দাদের মাঝে সৌর কোষ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রবণতা দেখা যায়।
আর্সেনিক দূষণ
আর্সেনিক একটি প্রাকৃতিক মৌল যা স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলে এর প্রকোপ বেশি। এটি ধান এবং অন্যান্য প্রধান ফসলের মাধ্যমে খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করতে পারে।
জলবায়ু
গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের বেশিরভাগ এলাকা গ্রীষ্মমন্ডলীয় আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চলে অবস্থিত। এর পশ্চিমাঞ্চলে প্রতি বছর ১,৫০০ থেকে ২,০০০ মিমি (৫৯ থেকে ৭৯ ইঞ্চি) এবং পূর্বাঞ্চলে প্রতি বছর ২,০০০ থেকে ৩,০০০ মিমি (৭৯ থেকে ১১৮ ইঞ্চি) বৃষ্টিপাত হয়। গরম ও শুষ্ক গ্রীষ্মকাল এবং শীতল ও শুষ্ক শীতকাল জলবায়ুকে কৃষির জন্য উপযুক্ত করে তোলে।
বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়
১৯৭০ সালের নভেম্বরে, বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে মারাত্মক ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়টি গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলে আঘাত হানে ১৯৭০ ভোলা ঘূর্ণিঝড়ে ৫,০০,০০০ মানুষ নিহত হয় (সরকারিভাবে হিসেবে) এবং আরও ১০,০০০ জন নিখোঁজ হয়। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুমান করেছিল যে, ভোলা ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০,০০,০০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।[৯]
১৯৯১ সালে বদ্বীপটিতে আরেকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এতে প্রায় ১,৩৯,০০০ মানুষ মারা যায়।[১০]
এ অঞ্চলে প্রায়ই তীব্র বন্যা দেখা দিয়ে থাকে। ১৯৯৯ সালে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে বন্যার ফলে প্রায় এক হাজার মানুষ নিহত এবং ৩০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছিল। পুরো ধানের ফসল নষ্ট হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার এই অঞ্চলের মানুষকে খাদ্য সরবরাহ করার জন্য ৯০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা চেয়েছিল।[১১]
বঙ্গীয় ব-দ্বীপের ইতিহাস
বিনিতা দামোদরন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসন কর্তৃক দুর্ভিক্ষ ব্যবস্থাপনার রীতিটির ব্যাপক সমালোচনা করেছেন এবং বন ও জমি পরিচালনার ফলে যে বড় ধরনের পরিবেশগত পরিবর্তন হয়েছে তার সাথে এই পদ্ধতিগুলোর সম্পর্ক চিহ্নিত করেছেন।[১২][১৩][১৪] দেবযানী ভট্টাচার্য্য দেখিয়েছেন যে পরিবেশগত পরিবর্তন মোকাবিলা করে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে বিংশ শতাব্দীতে সূচনা পর্যন্ত ঔপনিবেশিক শক্তি কীভাবে কলকাতাকে নগর কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলেছিল।[১৫][১৬]
বঙ্গীয় বা গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের পূর্ব অংশকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে ইফতেখার ইকবাল কৃষ্ণবিত্ত সমৃদ্ধি বা হ্রাস, সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব, দারিদ্র্য এবং দুর্ভিক্ষ অধ্যয়ন করার জন্য বঙ্গীয় ব-দ্বীপকে (বিশেষত, ঔপনিবেশিক সময়কালকে) একটি পরিবেশগত কাঠামো হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন।[১৭] ইকবাল দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে ঔপনিবেশিক শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে ফরায়েজি আন্দোলনের মতো প্রতিরোধ আন্দোলন কীভাবে অধ্যয়ন করা যেতে পারে।[১৮]
বঙ্গীয় বা গাঙ্গেয় বদ্বীপের পরিবেশ ইতিহাসের গবেষণার ক্ষেত্রে একটি দুর্বল দিক হল বেশিরভাগ গবেষণা অষ্টাদশ থেকে একবিংশ শতাব্দীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই অষ্টাদশ শতকের পূর্বে এই অঞ্চলের পরিবেশগত ইতিহাস সম্পর্কে তথ্যের অভাব রয়েছে।
বদ্বীপের ভবিষ্যত
আসন্ন বছরগুলোতে গাঙ্গেয় বদ্বীপে বসবাসকারী লোকদের সবচেয়ে বড় যে হুমকির সম্মুখীন হতে হবে তা হল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আর মাত্র ০.৫ মিটার (১ ফু ৮ ইঞ্চি) বাড়লেই বাংলাদেশে প্রায় ছয় মিলিয়ন লোক ঘরছাড়া হতে পারে।[১৯]
বদ্বীপটিতে তিতাস এবং বখরাবাদ গ্যাস ক্ষেত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। ফলে, এখন বেশ কয়েকটি বড় বড় তেল সংস্থা গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে অনুসন্ধান চালানোর কাজে বিনিয়োগ করেছে।[২০][২১]
উত্তরবঙ্গ হল বাংলাদেশের উত্তর দিকে অবস্থিত একটি ভৌগোলিক অঞ্চল। উত্তরাঞ্চলের দুই বিভাগ রাজশাহী বিভাগ ও রংপুর বিভাগকে একত্রে বলা হয় উত্তরবঙ্গ। প্রাচীন বঙ্গ রাজ্যের ভৌগোলিক নাম উত্তরবঙ্গ থেকেই এই নামের ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে এই অংশটি সমগ্র বাংলাদেশের উত্তরে বলেই, উত্তরবঙ্গ বলা হয়ে থাকে। রংপুর বিভাগ গঠন করার পূর্বে, পুরো উত্তরবঙ্গই রাজশাহী বিভাগের মধ্যে ছিল। মোট ১৬ টি জেলা নিয়ে উত্তরবঙ্গ গঠিত হয়েছে। নাটোরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় প্রশাসনিক বাসভবন অবস্থিত। পাকিস্তান আমলে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান বাংলাদেশের দ্বিতীয় সদরদপ্তর ছিল এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে নাটোরকে দেশের দ্বিতীয় প্রশাসনিক রাজধানী ও দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী তথা উত্তরা গর্ভামেন্ট হাউজকে উত্তরা গণভবন হিসেবে ঘোষণা করেন।