স্ট্যানফোর্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফিলোসফি অনুসারে, ধর্মদর্শন হচ্ছে, “ধর্মীয় ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কিত ধারণা এবং কেন্দ্রীয় বিষয় নিয়ে দার্শনিক অনুসন্ধান”।[১] এটি একটি প্রাচীন পাঠ্য বিষয়, যা অনেক প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে দার্শনিক আলোচনায় পাওয়া যায়, এবং এটি দর্শনের অন্যান্য শাখা যেমন অধিবিদ্যা, জ্ঞানতত্ত্ব ও নীতিশাস্ত্রের সাথে সম্পর্কিত।[২]
ধর্মদর্শন(Religion) ধর্মীয় দর্শন থেকে আলাদা কারণ ধর্মদর্শন ধর্মীয় দর্শনের মত কোন নির্দিষ্ট ধর্মব্যবস্থার সমস্যাগুলোর পরীক্ষা নীরিক্ষা করে না, বরং ধর্মদর্শন ধর্মের সামগ্রিক প্রকৃতি নিয়েই বিভিন্ন আলোচনা করে। ধর্মদর্শনের পাঠ এমনভাবে গড়ে উঠেছে যাতে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী উভয়েই নিরাবেগভাবে এই বিষয়ে পাঠ করতে পারে।[৩]
দার্শনিক উইলিয়াম এল. রো ধর্মের দর্শনের সংজ্ঞা দেন এভাবেঃ “মৌলিক ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধারণার সমালোচনামূলক পরীক্ষণ”।[৪] ধর্মের দর্শনের আওতায় যেসব বিষয়াদি পরেঃ ঈশ্বরের ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের বিশ্বাস, বিভিন্নরকমের ধর্মীয় অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যকার সম্পর্ক, ভালো ও খারাপ – এর প্রকৃতি ও পরিসর এবং জন্ম, ইতিহাস ও মৃত্যুর ধর্মীয় ব্যাখ্যা।[৫] ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার নৈতিক অর্থ, বিশ্বাসের এর সাথে যুক্তি, অভিজ্ঞতা আর ঐতিহ্যের সম্পর্ক; অলৌকিকতা, পবিত্র বাণী, বৈরাগ্যবাদ, ক্ষমতা আর পরিত্রাণ – এসব জিনিসও ধর্মের দর্শনের আওতায় পড়ে।[৬]
উনিশ শতক এর আগ পর্যন্ত ‘ধর্মের দর্শন’ শব্দটি পশ্চিমে ব্যবহার হয় নি।[৭] বেশিরভাগ পূর্বাধুনিক ও প্রথমদিককার আধুনিক দার্শনিক কাজসমূহ ধর্মীয় সারমর্ম ও ‘অ-ধর্মীয়’ দার্শনিক প্রশ্নসমূহের এক সংমিশ্রণ ছিল। উদাহরণস্বরূপ, এশিয়ায় হিন্দু উপনিষদ, দাওবাদ, কনফুসিয়াসবাদ আর বৌদ্ধধর্ম সংক্রান্ত কিতাবাদি ছিল।[৮] গ্রীক দর্শন, যেমন পিথাগোরাসবাদ, বৈরাগ্যদর্শন এর মধ্যে দেবতা সংক্রান্ত বিভিন্ন ধারণা ছিল, আর মধ্যযুগীয় দর্শন শক্তভাবে তিনটি ইব্রাহিমিএক ঈশ্বরবাদী ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত। পশ্চিম বিশ্বে প্রথম দিককার আধুনিক দার্শনিকগণ যথা থমাস হোব্স, জন লক আর জর্জ বার্কিলি নানধরনের ইহজাগতিক বিষয়ের পাশাপাশি ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়েও আলোচনা করেন।[৯]
Religion
ধর্মের দর্শন, ধর্মতত্ত্ব হতে এ দিক থেকে আলাদা যে, ধর্মতত্ত্বে “সমালোচনামূলক চিন্তাধারা ধর্মীয় বিশ্বাস এর উপর ভিত্তিকৃত”।[১০] আবার, “ধর্মতত্ত্ব কোন কর্তৃত্বশালীর উপর নির্ভর করে যে চিন্তাভাবনা, ভাবপ্রকাশ ও সাক্ষী হওয়ার ব্যাপার সমূহ নিয়ন্ত্রণ করে … [যখন] দর্শন তার যুক্তিসমূহ ভিত্তি করে সময়হীন প্রমাণের উপর”।[১১]
প্রাচীন সেরামানের দার্শনিকগণ দ্বারা ধর্মের দর্শনের কিছু অংশকে অধিবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। অ্যারিস্টটলেরঅধিবিদ্যায় অন্তহীন গতির জন্য মূল কারণ ছিল একটি অচালিত চালক, যে, প্রবৃত্তি বা চিন্তার ব্যবহার করে গতিকে গতিময় করে নিজে গতিশীল হওয়া ছাড়া।[১২] এই অচালিত চালক, অ্যারিস্টটল এর মতে, হলেন ঈশ্বর, যা ধর্মতত্ত্বের পড়ালেখার বিষয়বস্তু। যদিও দার্শনিকগণ একে ধর্মের দর্শনের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন আর স্বাভাবিকভাবে একে পড়ালেখার আলাদা এক বিষয় হিসেবে দেখা হয়, তবু কিছু মানুষ, বিশেষ করে ক্যাথলিক দার্শনিকগণ দ্বারা এখনও একে অধিবিদ্যার অংশ হিসেবে দেখা হয়।
অধিবিদ্যার অংশ হিসেবে
এরিস্টোটল
ধর্মদর্শনের কিছু বিষয় প্রাচীন দর্শনের সময় থেকেই অধিবিদ্যার অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এরিস্টোটলের মেটাফিজিক্স-এ শাশ্বত গতির পূর্বজ কারণ হিসেবে |”নিশ্চল চালক”-কে (unmoved mover) দায়ী করেছেন, যিনি আকাঙ্খার বা চিন্তার বস্তুর মত, নিজে না চালিত হয়ে অন্য বস্তুকে চালিত করে।[১২] এরিস্টোটলের মতে, ঈশ্বর ধর্মতত্ত্বে আলোচনার বিষয়। যাইহোক, আজ দার্শনিকগণ এই ঈশ্বর নিয়ে আলোচনার জন্য “ধর্মদর্শন” শব্দটি ব্যবহার করেন, এবং একে আলোচনার ভিন্ন ক্ষেত্র হিসেবে দেখা হয়। যদিও একে অনেকে, বিশেষ করে ক্যাথলিক দার্শনিকগণ অধিবিদ্যার মধ্যে ফেলেন।
“ref2” নামসহ <ref> ট্যাগ পূর্ববর্তী লেখায় ব্যবহৃত হয়নি।
দার্শনিক উইলিয়াম এল. রো ধর্মের দর্শনের সংজ্ঞা দেন এভাবেঃ “মৌলিক ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধারণার সমালোচনামূলক পরীক্ষণ”।[৪] ধর্মের দর্শনের আওতায় যেসব বিষয়াদি পরেঃ ঈশ্বরের ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের বিশ্বাস, বিভিন্নরকমের ধর্মীয় অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যকার সম্পর্ক, ভালো ও খারাপ – এর প্রকৃতি ও পরিসর এবং জন্ম, ইতিহাস ও মৃত্যুর ধর্মীয় ব্যাখ্যা।[৫] ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার নৈতিক অর্থ, বিশ্বাসের এর সাথে যুক্তি, অভিজ্ঞতা আর ঐতিহ্যের সম্পর্ক; অলৌকিকতা, পবিত্র বাণী, বৈরাগ্যবাদ, ক্ষমতা আর পরিত্রাণ – এসব জিনিসও ধর্মের দর্শনের আওতায় পড়ে।[৬]
Religion
উনিশ শতক এর আগ পর্যন্ত ‘ধর্মের দর্শন’ শব্দটি পশ্চিমে ব্যবহার হয় নি।[৭] বেশিরভাগ পূর্বাধুনিক ও প্রথমদিককার আধুনিক দার্শনিক কাজসমূহ ধর্মীয় সারমর্ম ও ‘অ-ধর্মীয়’ দার্শনিক প্রশ্নসমূহের এক সংমিশ্রণ ছিল। উদাহরণস্বরূপ, এশিয়ায় হিন্দু উপনিষদ, দাওবাদ, কনফুসিয়াসবাদ আর বৌদ্ধধর্ম সংক্রান্ত কিতাবাদি ছিল।[৮] গ্রীক দর্শন, যেমন পিথাগোরাসবাদ, বৈরাগ্যদর্শন এর মধ্যে দেবতা সংক্রান্ত বিভিন্ন ধারণা ছিল, আর মধ্যযুগীয় দর্শন শক্তভাবে তিনটি ইব্রাহিমিএক ঈশ্বরবাদী ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত। পশ্চিম বিশ্বে প্রথম দিককার আধুনিক দার্শনিকগণ যথা থমাস হোব্স, জন লক আর জর্জ বার্কিলি নানধরনের ইহজাগতিক বিষয়ের পাশাপাশি ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়েও আলোচনা করেন।[
হিব্রু বাইবেল (Hebrew Bible) বলতে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ধর্মীয় পুস্তকাবলীর সাধারণ অংশকে বোঝায়। পণ্ডিতেরা খ্রিস্টানদের পুরাতন বাইবেল (Old Testament) বা ইহুদিদের তানাখ (Tanakh) (যে গ্রন্থগুলো প্রকৃতপক্ষে একই) বোঝাতে গিয়ে এই পরিভাষাকেই নিরপেক্ষ মনে করে ব্যবহার করেন। হিব্রু বাইবেলকে ইহুদিরাতানাখ বলে থাকে। গ্রন্থটির তিনটি অংশের আদ্যক্ষরের সমন্বয়ে তানাখ শব্দটি গঠিত। ইসলাম ধর্মবিশ্বাসীগণ বিশ্বাস করেন মুসার উপর তাওরাত কিতাব নাজিল হয়। কিন্তু তারা তানাখকে তাওরাত কিতাব বলে স্বীকৃতি দেয় না।
ভগবদ্গীতা (সংস্কৃত: भगवद्गीता, ˈbʱəɡəʋəd̪ ɡiːˈt̪aː (সাহায্য·তথ্য), ভগবানের গান) বা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা বা গীতা একটি ৭০০-শ্লোকের হিন্দু ধর্মগ্রন্থ। এটি প্রাচীন সংস্কৃতমহাকাব্যমহাভারত-এর একটি অংশ। যদিও গীতা একটি স্বতন্ত্র ধর্মগ্রন্থ তথা একটি পৃথক উপনিষদের মর্যাদা পেয়ে থাকে। হিন্দুরা গীতা-কে ভগবানের মুখনিঃসৃত বাণী মনে করেন। হিন্দুধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যের ইতিহাসে গীতা এক বিশেষ স্থানের অধিকারী।[১৭]গীতা-র কথক কৃষ্ণ হিন্দুদের দৃষ্টিতে ঈশ্বরের অবতার পরমাত্মা স্বয়ং।[১৭] তাই গীতা-য় তাকে বলা হয়েছে “শ্রীভগবান”।[১৮]
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের রথচালকের ভূমিকায় কৃষ্ণ
গীতা-র বিষয়বস্তু কৃষ্ণ ও পাণ্ডব রাজকুমার অর্জুনের কথোপকথন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু ঠিক আগে শত্রুপক্ষে আত্মীয়, বন্ধু ও গুরুকে দেখে অর্জুন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। এই সময় কৃষ্ণ তাকে ক্ষত্রিয় যোদ্ধার ধর্ম স্মরণ করিয়ে দিয়ে এবং বিভিন্ন প্রকার যোগশাস্ত্র[১৯] ও বৈদান্তিক দর্শন ব্যাখ্যা করে তাকে যুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করেন। তাই গীতা-কে বলা হয় হিন্দু ধর্মতত্ত্বের একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ এবং হিন্দুদের জীবনচর্যার একটি ব্যবহারিক পথনির্দেশিকা। যোগশাস্ত্র ব্যাখ্যার সময় কৃষ্ণ নিজের “স্বয়ং ভগবান” রূপটি উন্মোচিত করেন এবং বিশ্বরূপে অর্জুনকে দর্শন দিয়ে আশীর্বাদ করেন। অর্জুন ছাড়া প্রত্যক্ষভাবে কৃষ্ণের মুখ থেকে গীতা শুনেছিলেন সঞ্জয় (তিনি যুদ্ধের ঘটনা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বর্ণনা করার জন্য বেদব্যাসের কাছ থেকে দিব্য দৃষ্টি লাভ করেছিলেন), হনুমান (তিনি অর্জুনের রথের চূড়ায় বসে ছিলেন) ও ঘটোৎকচের পুত্র বর্বরিক যিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সব ঘটনা দেখেছিলেন)।
গীতা-কে গীতোপনিষদ বলা হয়। অর্থাৎ, গীতাউপনিষদ বা বৈদান্তিক সাহিত্যের অন্তর্গত।[২০] “উপনিষদ্” নামধারী ধর্মগ্রন্থগুলি শ্রুতিশাস্ত্রের অন্তর্গত হলেও, মহাভারত-এর অংশ বলে গীতা স্মৃতিশাস্ত্রের অন্তর্গত।[২১][২২] আবার উপনিষদের শিক্ষার সারবস্তু গীতা-য় সংকলিত হয়েছে বলে একে বলা হয় “উপনিষদসমূহের উপনিষদ”।[২৩]গীতা-কে মোক্ষশাস্ত্র নামেও অভিহিত করা হয়।[২৪]
পুরাণ (সংস্কৃত: पुराण purāṇa, “প্রাচীনযুগীয়”) হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের গুরুত্বপূর্ণ আখ্যানমূলক ধর্মগ্রন্থ-সমুচ্চয়। পুরাণে সৃষ্টি থেকে প্রলয় পর্যন্ত ব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাস, রাজন্যবর্গ, যোদ্ধৃবর্গ, ঋষি ও উপদেবতাগণের বংশবৃত্তান্ত এবং হিন্দু সৃষ্টিতত্ত্ব, দর্শন ও ভূগোলতত্ত্ব আলোচিত হয়েছে।[২৭] পুরাণে সাধারণত নির্দিষ্ট কোনো দেবতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় এবং তাতে ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তার প্রাবল্যও লক্ষিত হয়। এই গ্রন্থগুলি প্রধানত আখ্যায়িকার আকারে রচিত, যা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।
লোকমতে, মহাভারত-রচয়িতা বেদব্যাস পুরাণসমূহের সংকলক।[২৮] যদিও পুরাণের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন পাঠগুলি গুপ্ত সাম্রাজ্যের (খ্রিস্টীয় তৃতীয়-পঞ্চম শতাব্দী) সমসাময়িক। এর অধিকাংশ উপাদানই ঐতিহাসিক বা অন্যান্য সূত্রাণুযায়ী এই সময়কাল ও তার পরবর্তী শতাব্দীগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত। পুরাণগ্রন্থগুলি ভারতের নানা স্থানে রচিত হয়েছিল। পুরাণের সামগ্রিক পাঠে কিছু সাধারণ ধারণা লক্ষিত হয়; কিন্তু একটি পুরাণের উপর অপর আরেকটি পুরাণের প্রভাব অন্বেষণ দুঃসাধ্য। তাই সাধারণভাবে এগুলিকে সমসাময়িক বলেই ধরে নেওয়া হয়।.[২৯]
লিখিত পাঠ্যগুলির রচনাতারিখ পুরাণের প্রকৃত রচনাতারিখ নয়। কারণ একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে পূর্ববর্তী এক সহস্রাব্দ কাল ধরে এই কাহিনিগুলি মৌখিকভাবে প্রচারিত হয়ে আসে। এবং পরবর্তীকালে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত এগুলির আকার ও রূপ পরিবর্তিত হতে দেখা যায়।[৩০]
কাশীর মহারাজা ডক্টর বিভূতি নারায়ণ সিংহের পৃষ্ঠপোষকতা ও তত্ত্বাবধানে অল ইন্ডিয়া কাশীরাজ ট্রাস্ট গঠিত হলে পুরাণ নিয়ে সুসংহত গবেষণার কাজ শুরু হয়। এই সংস্থা থেকে পুরাণের সমালোচনামূলক সংস্করণ এবং পুরাণম্ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে।[৩১]
উপনিষদ
উনিশ শতকের প্রথমভাগে লেখা ঋগ্বেদ পুথি
উপনিষদ্ (সংস্কৃত: उपनिषद्) হিন্দুধর্মের এক বিশেষ ধরনের ধর্মগ্রন্থের সমষ্টি। এই বইগুলিতে হিন্দুধর্মের তাত্ত্বিক ভিত্তিটি আলোচিত হয়েছে। উপনিষদের অপর নাম বেদান্ত। ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, উপনিষদ্গুলিতে সর্বোচ্চ সত্য ব্রহ্মের প্রকৃতি এবং মানুষের মোক্ষ বা আধ্যাত্মিক মুক্তি লাভের উপায় বর্ণিত হয়েছে। উপনিষদ্গুলি মূলত বেদ-এর ব্রাহ্মণ ও আরণ্যক[৩২] অংশের শেষ অংশে পাওয়া যায়। এগুলি প্রাচীনকালে গুরু-শিষ্য পরম্পরায় মুখে মুখে প্রচলিত ছিল।
দুশোরও বেশি উপনিষদের কথা জানা যায়। এগুলির মধ্যে প্রথম বারোটিই প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলিকে “মুখ্য উপনিষদ” বলে। ভগবদ্গীতা, ব্রহ্মসূত্র এবং মুখ্য উপনিষদ্গুলি[৩৩] (এগুলিকে একসঙ্গে প্রস্থানত্রয়ী বলা হয়) পরবর্তীকালে হিন্দু বেদান্ত দর্শনের বিভিন্ন শাখার জন্ম দিয়েছিল। এগুলির মধ্যে দুটি একেশ্বরবাদী শাখা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[note ১][note ২][note ৩]
ঐতিহাসিকদের মতে, মুখ্য উপনিষদ্গুলি প্রাক্-বৌদ্ধ যুগ থেকে[৩৭][৩৮] শুরু করে খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দের প্রথমার্ধ্ব পর্যন্ত[৩৮] সুদীর্ঘ সময়কালের বিভিন্ন পর্বে রচিত হয়। অপর দিকে অপ্রধান উপনিষদগুলি মধ্যযুগ ও প্রাক্-আধুনিক যুগের রচনা।[৩৯] অবশ্য প্রতিটি উপনিষদের সঠিক রচনাকাল নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। ব্রিটিশ কবি মার্টিন সেমোর-স্মিথ উপনিষদ্গুলিকে “সর্বকালের ১০০টি সবচেয়ে প্রভাবশালী বই”-এর তালিকাভুক্ত করেছেন।[৪০] আর্থার শোপেনহাওয়ার, রালফ ওয়াল্ডো এমারসন ও হেনরি ডেভিড থোরো সহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি উপনিষদ্গুলির গুরুত্ব স্বীকার করেছেন। গবেষকেরা উপনিষদের দর্শনের সঙ্গে প্লেটো ও কান্টের দর্শনের মিল খুঁজে পান।[৪১][৪২]
ত্রিপিটকবৌদ্ধ ধর্মীয় পালি গ্রন্থের নাম। বুদ্ধের দর্শন এবং উপদেশের সংকলন। পালি তি-পিটক হতে বাংলায় ত্রিপিটক শব্দের প্রচলন। তিন পিটকের সমন্বিত সমাহারকে ত্রিপিটক বোঝানো হচ্ছে। এই তিনটি পিটক হলো বিনয় পিটক, সূত্র পিটক ও অভিধর্ম পিটক।
পিটক শব্দটি পালি এর অর্থ – ঝুড়ি, পাত্র, বাক্স ইত্যাদি, অর্থ যেখানে কোনো কিছু সংরক্ষন করা হয়।[৪৩] বৌদ্ধদের মূল ধর্মীয় গ্রন্থ। খ্রীষ্ট পূর্ব ৩য় শতকে সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে ত্রিপিটক পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃত হয়। এই গ্রন্থের গ্রন্থনের কাজ শুরু হয়েছিল গৌতম বুদ্ধ এর পরিনির্বানের তিন মাস পর অর্থাৎ খ্রিষ্ট পূর্ব ৫৪৩ অব্দে এবং সমাপ্তি ঘটে খ্রিষ্ট পূর্ব প্রায় ২৩৬ অব্দে। প্রায় তিনশ বছরে তিনটি সঙ্ঘায়নের মধ্যে এর গ্রন্থায়নের কাজ শেষ হয়।[৪৪]
বিনয় পিটক
বিনয় ত্রিপিটকের সর্বাগ্রে গ্রথিত বিষয়, বিনয় বুদ্ধশাসনের আয়ু স্বরুপ, বিনয়ের স্থিতিতেই বুদ্ধ শাসনের স্থিতি নির্ভরশীল। গৌতম বুদ্ধের পরিনির্বাণের অব্যবহতি পরে এ বিষয় অনুধাবন করে বুদ্ধশিষ্যদের অগ্রজ সারির প্রাজ্ঞ- অভিজ্ঞ ধর্মধর, বিনয়ধর ও মাতিকাধর ভিক্ষুদের নিয়ে প্রথম সংগীতির মাধ্যমে বিনয় ও ধর্ম সংরক্ষ্ণণের ব্যবস্থা করা হয়। [৪৫]
সূত্র পিটক
সূত্র শব্দের অর্থ সত্যের প্রকাশ । সেই সত্য হলো তথাগত গৌতম বুদ্ধ সম্বোধির প্রভাবে জ্ঞাত সত্যের প্রকাশ। অন্যভাবে বলা যায় চতুরার্য সত্যের সূচনা করে বলেই সূত্র। [৪৬] যে কথা স্বয়ং বুদ্ধ বলেছেন ” চারি আর্য্য সত্য বর্জিত কোন ধর্ম নেই।” সুতরাং – দুঃখ , দুঃখের কারণ (সমুদয়) , দুঃখ নিরোধ ও দুঃখ নিরোধের উপায় – এই চারি সত্যের ব্যখামুলক প্রকাশ বুদ্ধ বচনের যেই অংশে নিহিত তাই সূত্র। সূত্র জাতীয় বুদ্ধ বচন সমুহ ত্রিপিটকের যে বিভাগে একত্রীকরণ করা হয়েছে তাকে সুত্ত পিটক বলে।Prof. Winternitz লিখেছেন ” the suttapitak is our mose reliable source for the Dhamma , the religion of Buddha and his earliest disciples” [৪৭]
ত্রিপিটকের তিন মূল ধারার অন্যতম একটি হলো অভিধর্ম পিটক। এটিকে বৌদ্ধ দর্শনের সংহত সংস্করণ বলা হয়। এখানে বৌদ্ধ দর্শনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ রয়েছে। তথাগত বুদ্ধ নানা উপদেশের মাধ্যমে যে তত্ত্বসমূহ উপস্থাপন করেছেন, যে নৈতিক আদর্শিক বিষয়সমুহ তিনি অনুসরণ, অনুকরণ ও অনুধাবন করতে উপদেশ দিয়েছেন সে তত্ত্বসমুহের বিন্যস্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে বিনয় পিটকে।[৪৮] বাঙ্গালী অভিধর্ম গবেষকদের মধ্যে অন্যতম বীরেন্দ্র লাল মুৎসদ্দি অভিধর্ম পিটক সম্বন্ধে বলেছেন:
“
সূত্রের ভাষা আছে, উচ্ছ্বাস আছে, উদান আছে, গাথা আছে, উদ্দীপনা আছে, অপায় আছে, অপায় ভয় আছে, দেব-ব্রহ্মা আছে, দেব-ব্রহ্মলোকের আকর্ষণ আছে, নির্বাণের সুসমাচার আছে।[৪৯]
বাইবেল হল খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। বাইবেল (বিবলজ) শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে বা ‘পাওযা’ গ্রীক বিবলিয়া শব্দ থেকে, যার অর্থ ‘একটি পুস্তক’। এটি প্যাপিরাস গাছের ছাল। বাইবেল হচ্ছে শাস্ত্রলিপি বা পুস্তক, ঈশ্বরের বাক্য। বাইবেল হলো ৬৬টি পুস্তকের একটি সংকলন, যা দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত— ৩৯টি পুস্তক সংবলিত পুরাতন নিয়ম বা ওল্ড টেস্টামেন্ট, এবং ২৭টি পুস্তক সংবলিত নতুন নিয়ম বা নিউ টেস্টামেন্ট। খ্রিস্টধর্মমতে, ১৬০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ৪০জন লেখক বাইবেল রচনা করেছিলেন। এরা ছিলেন পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন লোক। বাইবেলের মুখ্য বিষয়বস্তু বা কেন্দ্রমণি হলেন যীশু। পুরাতন নিয়ম মূলত হিব্রু ভাষায় লিখিত, তবে দানিয়েল ও ইষ্রা পুস্তক দুটির কিছু অংশ অরামীয় ভাষায় লিখিত। নুতন নিয়ম গ্রীক ভাষায় রচিত। বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ এই বাইবেল লিখেছেন। খ্রিস্টানগণ বিশ্বাস করেন, এই বাইবেল রচনা হয়েছিল খ্রিস্টীয় ত্রিত্ববাদের অন্যতম পবিত্র আত্মার সহায়তায়। পৃথিবীর অনেক ভাষায় বাইবেল অনুবাদ হয়েছে। বাইবেলে বলা হয়েছে যে মানুষের গুনাহ্ থেকে নাজাত করার জন্য ঈশ্বর তার মনোনিত ব্যক্তি যীশুকে দুনিয়াতে প্রেরণ করেন। যে কেউ যীশুর প্রতি বিশ্বাস করে এবং পাপ মাফ পাবার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে ঈশ্বরের দিকে ফেরে সেই মুক্তি পায়। বাইবেলের ইউহোন্না খন্ডের ১৪ রুকু ৬ আয়াতে বলা হয়েছে, “আমিই (যীশুই) পথ, সত্য আর জীবন। আমার মধ্য দিয়ে না গেলে কেউই পিতার কাছে (অর্থাৎ ঈশ্বরের কাছে) যেতে পারে না।” ইসলাম ধর্মে “বাইবেল” বলে কোনো ধর্মগ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায় না। উল্লেখ পাওয়া যায়, ঈশ্বরের বাণীবাহক ঈসার [আ.] প্রতি অবতীর্ণ ইঞ্জিল নামক ধর্মগ্রন্থের। কুরআনে বর্ণিত ঈসাকেই বাইবেলে যীশু বলা হয়। তবে মুসলিমরা বিশ্বাস করে বাইবেল আল্লাহর গ্রন্থ ইনযিলের পরিবর্তিত গ্রন্থ। কারণ মুসলিম ধারণা মতে, খ্রিস্টান পন্ডিতরা ইনযিলে পরিবর্তন সাধন করেছে[৫০]।
কুরআন (القرآن) মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ।[৫১] “কুরান” বা “কুরআন” শব্দটি আরবী শব্দ, এই শব্দের উতপত্তি ও অর্থ নিয়ে বিশেষজ্ঞ আলেমদের মাঝে মতপার্থক্য আছে। কারো কারো মতে কুরান শব্দটি নবী মুহাম্মদের প্রতি অবতীর্ণ কিতাবের “আলাম” বা নির্ধারিত নাম, যেমন তাওরাত, ইঞ্জিল, যাবুর দ্বারা নির্ধারিত তিনটি পৃথক পৃথক কিতাব বুঝানো হয়ে থাকে, কুরান দ্বারাও ঠিক তেমনি একটি নির্ধারিত কিতাব বুঝানো হয়ে থাকে। এই হিসাবে শব্দটি –আরবী ব্যকরন রীতি অনুযায়ী- অন্য কোন উতস-শব্দ থেকে “মুশতাক” বা উদ্ভূত শব্দ নয়। ইমাম শাফী র. এর মত এটা। আবার অন্য আলেমের মত এই যে, কুরান শব্দটি তার উতস-শব্দ থেকে “মুশতাক” বা উদ্ভূত একটি শব্দ। যারা এই মত প্রকাশ করেন তারা আবার কুরানের উতস-মুল বা মুল শব্দ নির্ধারনে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রদান করেছেনঃ কারো মতে কুরান শব্দটি আরবী “কারান” থেকে উদ্ভূত যার অর্থ যুক্ত করা, যেহেতু কুরানে বিভিন্ন আয়াত, সুরা একে অপরের সাথে যুক্ত তাই একে “কুরান” বলা হয়ে থাকে। আবার কারো মতে মুল শব্দ “কারান” নয়, বরং মুল শব্দ হচ্ছে “করায়া” যার অর্থ পড়া, এখানে আরবী ভাষার রীতি অনুযায়ী পড়া দ্বারা পঠিত গ্রন্থ বা কিতাবকে বুঝানো হয়েছে । কুরানের এই শেষোক্ত অর্থই বেশি পরিচিত -অর্থাৎ কুরানের শাব্দিক অর্থ “পঠিত কিতাব”। [৫২] “কুরান আল্লাহর বাণী, যা তার রাসুলের উপর অবতীর্ণ হয়েছে, যার অনুরুপ কুরান পেশ করতে সবাই অক্ষম, যার তেলাওয়াত ইবাতাদ, যা “মুতাওয়াতির” বা অকাট্যভাবে বর্নিত, যা মুসহাফে লিখিত, যার শুরু হয়েছে সুরা ফাতিহা দিয়ে আর শেষ হয়েছে সুরা নাসের মাধ্যমে”। ইসলামী ইতিহাস অনুসারে দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে খণ্ড খণ্ড অংশে এটি ইসলামের নবী মুহাম্মাদের নিকট অবতীর্ণ হয়। কুরআনে সর্বমোট ১১৪টি সূরা আছে। আয়াত বা পঙ্ক্তি সংখ্যা ৬,২৩৬ টি বা ৬,৬৬৬ টি। এটি মূল আরবি ভাষায় অবর্তীর্ণ হয়।[৫৩][৫৪][৫৫][৫৬] মুসলিম চিন্তাধারা অনুসারে কুরআন ধারাবাহিকভাবে অবর্তীর্ণ ধর্মীয় গ্রন্থগুলোর মধ্যে সর্বশেষ এবং গ্রন্থ অবতরণের এই ধারা ইসলামের প্রথম বাণীবাহক আদম থেকে শুরু হয়। কুরআনে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ রয়েছে যার সাথে বাইবেলসহ অন্যান্য ধর্মীয়গ্রন্থের বেশ মিল রয়েছে, অবশ্য অমিলও কম নয়। তবে কুরআনে কোনও ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা নেই। ইসলামী ভাষ্যমতে কুরআন অপরিবর্তনীয় এবং এ সম্পর্কে মুসলিমরা কুরয়ানের যে আয়াতের কথা উল্লেখ করে থাকে তা হল:
“
আমি স্বয়ং এ উপদেশগ্রন্থ অবতরণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।[৫৭]
”
আরবি ব্যাকরণেকুরআন শব্দটি মাসদার তথা ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি قرأ ক্বরা’আক্রিয়া পদ থেকে এসেছে যার অর্থ পাঠ করা বা আবৃত্তি করা। এই ক্রিয়াপদটিকেই কুরআন নামের মূল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।[৫৮] এই শব্দটির মিটার বা “মাসদার” (الوزن) হচ্ছে غفران তথা “গুফরান”। এর অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত ভাব, অধ্যবসায় বা কর্ম সম্পাদনার মধ্যে একাগ্রতা। উদাহরণস্বরুপ, غفر নামক ক্রিয়ার অর্থ হচ্ছে “ক্ষমা করা”; কিন্তু এর আরেকটি মাসদার রয়েছে যার যা হলো غفران, এই মাসদারটি মূল অর্থের সাথে একত্রিত করলে দাঁড়ায় ক্ষমা করার কর্মে বিশেষ একাগ্রতা বা অতি তৎপর বা অতিরিক্ত ভাব। সেদিক থেকে কুরআন অর্থ কেবল পাঠ করা বা আবৃত্তি করা নয় বরং আরেকটি অর্থ হচ্ছে একাগ্র ভঙ্গীতে পাঠ বা আবৃত্তি করা। কুরআনের মধ্যেও এই অর্থেই কুরআন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআনের সূরা আল-কিয়ামাহ্ (৭৫ নং সূরা) ১৮ নং আয়াতে এই শব্দটি উল্লেখিত আছে:
“
অতঃপর, আমি যখন তা পাঠ করি (ক্বুরা’নাহু), তখন আপনি সেই পাঠের (কুরআ’নাহ্) অনুসরণ করুন।[৫৯]
হাদিস (আরবিতে الحديث) হলো মূলত ইসলাম ধর্মের শেষ বাণীবাহক মুহাম্মাদের বাণী ও জীবনাচরণ। হাদিসের উপদেশ মুসলমানদের জীবনাচরণ ও ব্যবহারবিধির অন্যতম পথনির্দেশ। কুরআন ইসলামের মৌলিক গ্রন্থ এবং হাদিসকে অনেক সময় তার ব্যাখ্যা হিসেবেও অভিহিত করা হয়। আল্লামা হাফেজ সাখাবী (রহ.) বলেন- والحديث لغة ضد القد يم واصطلا حامااضيف الى النبى ﷺ قولا له اوفعلا له اوتقرير اوصفة حتى الحركات والسكنات فى اليقظة والمنام – অর্থ: আভিধানিক অর্থে হাদীস শব্দটি কাদীম তথা অবিনশ্বরের বিপরীত আর পরিভাষায় বলা হয় রাসূলুাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দিকে সম্বন্ধযুক্ত। চাই তার বক্তব্য হোক বা কর্ম বা অনুমোদন অথবা গুণ এমন কি ঘুমন্ত অবস্থায় বা জাগ্রত অবস্থায় তার গতি ও স্থির সবই হাদীস।
বুখারী শরীফের বিশিষ্ট ব্যাখ্যাগ্রন্থ عمدة القارى এর মধ্যে হাদীস সম্বন্ধে রয়েছে: علم الحديث هو علم يعرف به اقوال النبى ﷺ وافعاله واخواله – অর্থ: ইলমে হাদীস এমন বিশেষ জ্ঞান যার সাহায্যে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা, কাজ ও অবস্থা জানতে পারা যায়। আর ফিক্হবিদদের নিকট হাদীস হল: اقوال رسول الله ﷺ وافعاله – অর্থ: হাদীস হলো আল্লাহর রাসূলের কথা ও কাজসমূহ। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও আলিয়া মাদ্রাসার সাবেক হেড মাওলানা মুফতী সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান বারকাতী (রহ.) এর মতে, হাদীস (حديث) এমন একটি বিষয় যা রাসূলুাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী, কর্ম ও নীরবতা এবং সাহাবায়ে কেরাম, তাবিঈনদের কথা, কর্ম ও মৌন সম্মতিকে বুঝায়।[৬০]
ধর্ম ও যৌনতা বা যৌনতা সম্পর্কিত ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি (Religion and sexuality)আদিকাল থেকে মানুষের যৌনাদর্শ তথা যৌন নৈতিকতা গঠন এবং যৌনাচার নিরূপণে প্রধান ভূমিকা রেখে এসেছে।
প্রতিটি প্রধান ধর্ম যৌনতা, নৈতিকতা ও নীতিশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে নৈতিক সূত্রাবলী তৈরি করেছে। এই নৈতিক সূত্রাবলী এমন পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় যেগুলি যৌন আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে এবং জনগণের যৌন ক্রিয়াকলাপ এবং অভ্যাসগুলি প্রভাবিত করতে পারে।
সময়ের সাথে এবং সংস্কৃতির মধ্যে যৌন নৈতিকতা ব্যাপকভাবে পার্থক্য রয়েছে। একটি সমাজের যৌন মান- যৌন আচরণের মান-ধর্মীয় বিশ্বাস, বা সামাজিক ও পরিবেশগত অবস্থার সাথে যুক্ত হতে পারে, বা এই সমস্তগুলি। যৌনতা এবং প্রজনন বিশ্বব্যাপী মানুষের মিথস্ক্রিয়া এবং সমাজের মৌলিক উপাদান। উপরন্তু, “যৌন সীমাবদ্ধতা” সমস্ত মানব সমাজের জন্য অদ্ভুত সংস্কৃতির সর্বজনীন এক।[১][২] তদনুসারে, বেশিরভাগ ধর্ম মানুষের আচার-আচরণে যৌনতার জন্য একটি “যথাযথ” ভূমিকার প্রশ্নটি সমাধান করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে যৌন নিরপেক্ষতার বিভিন্ন কোড রয়েছে, যা যৌন কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে বা নির্দিষ্ট যৌন সংক্রামিত কর্ম বা চিন্তাধারার জন্য আদর্শ মান নির্ধারণ করে।
ধর্ম এবং ধর্মবিশ্বাসীদের দৃষ্টিভঙ্গি বিস্তৃতভাবে লিঙ্গ ও যৌনতা থেকে একটি বিশ্বাসী বিশ্বাসের জন্য নেতিবাচক ধারণা প্রদান করে, যা ঐশ্বরিকের সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি। কিছু ধর্ম জৈবিক প্রজনন (কখনও কখনও শুধুমাত্র যখন আনুষ্ঠানিক বৈবাহিক অবস্থা এবং একটি নির্দিষ্ট বয়সে) অনুমোদিত, এবং যৌন পরিতোষ জন্য চর্চা অন্যান্য কার্যকলাপ হিসাবে অভ্যাস হিসাবে অভ্যাসের জন্য অনুশীলন করা হয় যৌন কার্যকলাপ মধ্যে পার্থক্য।
সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি প্রবল আকর্ষণ দেখা যায় যেটা আজও বিদ্যমান। প্রত্যেকেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। ইসলাম ধর্মে তা নিষেধ করা হয়নি। তবে এখানে বেশ কিছু নীতিমালা প্রদান করা হয়েছে। পশুদের মত যৌনকামনা পূরণ করার অধিকার দেওয়া হয়নি। এখানে বিবাহের ব্যবস্থা রয়েছে। বিবাহের মাধ্যমে একজন পুরুষ কোনো মহিলাকে অধিকার করতে পারবে। তবে এর জন্য উপহার স্বরূপ পুরুষের পক্ষ থেকে মহিলাকে মহর প্রদান করতে হবে। এর সর্বোচ্চ কোনো ধরা বাধা পরিমাণ নেই তবে সর্বনিন্ম দশ দিরহাম হতে হবে।
সূরা নিসার তিন নং আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা আমাদের জানান:
তোমরা দুই দুই বা তিন তিন বা চার চারটি বিয়ে করো। যদি মনে করো সমতা রক্ষা করতে পারবে না তাহলে একটি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকো
এখন আমরা বলতে পারি যে, একজন মহিলা একসময়ে একজন স্বামী গ্রহণ করতে পারবে। কিন্তু পুরুষ একসাথে চারটি বিয়ে করতে পারবে। তবে পুরুষ যদি দুই, তিন অথবা চারটি বিয়ে করে, তবে তার সকল স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে হবে এবং সমান অধিকার দিতে হবে ।
অন্যায়ভাবে যৌনক্রিয়া করাকে যিনা বলে। ইসলামে এটাকে কঠোরভাবে নিষেধের সাথে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
ব্যভিচারের দায়ে অভিযুক্ত পুরুষ ও নারী যারা, তাদের প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত প্রদান কর, তাদের বিষয়ে করুণা যেন তোমাদেরকে দুর্বল না করে— —সূরা আন-নুর, আয়াত ২
রাসুল (স.) হাদীসে বলেন,
একজন অবিবাহিত পুরুষ একজন অবিবাহিত নারীর সাথে ব্যভিচার করে, তাদেরকে একশত বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য নির্বাসন পেতে হবে। আর বিবাহিত পুরুষের সাথে বিবাহিত নারীর ব্যভিচারের ক্ষেত্রে, তাদেরকে একশত বেত্রাঘাত এবং পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে হবে।— — সহীহ মুসলিম, ১৭:৪১৯১ (ইংরেজি)
Religion and sexuality
এই অবৈধ যৌনাচারের ধারা বর্ণনা করতে গিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেনঃ
আদম সন্তানের উপর যিনার যে অংশ লিপিবদ্ধ আছে তা অবশ্যই সে প্রাপ্ত হবে। দু-চোখের যিনা হল (নিষিদ্ধ যৌনতার প্রতি) দৃষ্টিপাত করা, দু’কানের যিনা হল শ্রবণ করা, রসনার যিনা হল কথোপকথন করা, হাতের যিনা হল স্পর্শ করা, পায়ের যিনা হল হেঁটে যাওযা, অন্তরের যিনা হচ্ছে আকাঙ্ক্ষা ও কামনা করা। আর যৌনাঙ্গ অবশেষে তা বাস্তবায়িত করে অথবা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে।— — সহীহ বুখারী, ৮:৭৭:৬০৯ (ইংরেজি),সহীহ মুসলিম, ৩৩:৬৪২১ (ইংরেজি)
সুতরাং, আমরা বলতে পারি ইসলামে অবৈধ যৌনাচারের কোনো সুযোগ নেই। বরং এর জন্য রয়েছে মহা শাস্তি।
প্রতিটি প্রধান ধর্ম যৌনতা, নৈতিকতা ও নীতিশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে নৈতিক সূত্রাবলী তৈরি করেছে। এই নৈতিক সূত্রাবলী এমন পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় যেগুলি যৌন আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে এবং জনগণের যৌন ক্রিয়াকলাপ এবং অভ্যাসগুলি প্রভাবিত করতে পারে।
ধর্ম (বাংলা উচ্চারণ: [dʱɔɾmo]ধর্মো) হলো নির্দিষ্ট আচরণ ও অনুশীলন, নৈতিকতা, বিশ্বাস, বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি, গ্রন্থ, পবিত্র স্থান, ভবিষ্যদ্বাণী, ধর্মে নীতিশাস্ত্র বা সংস্থার একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা, যা মানবতাকে অতিপ্রাকৃত, অতীন্দ্রিয় এবং আধ্যাত্মিকতা উপাদানগুলোর সাথে সম্পর্কিত করে;[১] কিন্তু, কোনো অবিকল একটি ধর্ম গঠন করে তা নিয়ে কোনো পণ্ডিতের ঐকমত্য নেই।[২][৩]
বিভিন্ন ধর্মে ঐশ্বরিক,[৪]পবিত্র জিনিস,[৫]বিশ্বাস,[৬] একটি অতিপ্রাকৃত সত্ত্বা বা অতিপ্রাকৃত প্রাণী “এক ধরণের উল্লসিত তাড়না এবং অতিক্রম যা বাকি জীবনের জন্য নিয়ম ও ক্ষমতা সরবরাহ করে” থেকে শুরু করে বিভিন্ন উপাদান থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে।[৭] ধর্মীয় রীতিনীতির মধ্যে আচার, উপদেশ, স্মরণসভা বা সঙ্গীত (দেবতা ও/অথবা সাধুদের), উৎসর্গ (উপাসনা), উৎসব, ভোজ, বিবাহপরিষেবা, ধ্যান, প্রার্থনা, সঙ্গীত, শিল্প, নৃত্য, জনসেবা বা মানব সংস্কৃতির অন্যান্য দিক অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। ধর্মগুলির পবিত্র ইতিহাস এবং আখ্যান রয়েছে, যা পবিত্র শাস্ত্র এবং প্রতীক এবং পবিত্র স্থানগুলিতে সংরক্ষিত থাকতে পারে, যার লক্ষ্য বেশিরভাগই জীবনকে অর্থ প্রদান করা। ধর্মগুলিতে সাংকেতিক গল্প থাকতে পারে, যা কখনও কখনও অনুসারীরা সত্য বলে মনে হয়, যা জীবন, মহাবিশ্ব এবং অন্যান্য ঘটনার উৎপত্তি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতে পারে। ঐতিহ্যগতভাবে, আধ্যাত্মিক বিশ্বাস, যুক্তি ছাড়াও, ধর্মীয় বিশ্বাসের উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়েছে।[৮]
বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ১০,০০০ স্বতন্ত্র ধর্ম রয়েছে। বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৮৪℅ খ্রীষ্টধর্ম, ইসলাম, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম বা লোকধর্মের, কোনো না কোনো ধরনের সাথে যুক্ত।[৯] ধর্মীয়ভাবে অসম্পৃক্ত জনসংখ্যার মধ্যে রয়েছে যারা কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম, নাস্তিক এবং অজ্ঞেয়বাদীদের সাথে সনাক্ত করে না। যদিও ধর্মীয়ভাবে অসম্পৃক্তরা বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু ধর্মীয়ভাবে অসম্পৃক্তদের অনেকেরই এখনও বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস রয়েছে।[১০]
ধর্মীয় অধ্যয়নধর্মতত্ত্ব, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব এবং সামাজিক বৈজ্ঞানিক অধ্যয়নসহ বিভিন্ন গ্রন্থগত শাখা নিয়ে গঠিত। ধর্মের তত্ত্বগুলো ধর্মের উৎপত্তি এবং কাজের জন্য বিভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করে, যার মধ্যে ধর্মীয় সত্ত্বা এবং বিশ্বাসের তত্ত্ববিদ্যার ভিত্তিও রয়েছে।[১১]
ধর্ম শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত √ধৃ হতে (অর্থ ‘ধারণ’)। ‘একজন ব্যক্তি তার জীবনে তার যত প্রকার বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে সব মিলিয়ে হয় তার ধর্ম।’ তার বিশ্বাস, তার পরম্পরাগত শিক্ষা, তারা আচার ব্যবহার ইত্যাদি এই সবই তার ধর্ম। যেভাবে আগুনের ধর্ম দহন করা, জলের ধর্ম শীতলতা, পশুর ধর্ম পশুত্ব, তেমনি মানুষের ধর্ম হয় মনুষত্ব। কিন্তু শাস্ত্র বলে মানুষ উচ্চমার্গীয় একটি জীব এবং এই উচ্চমার্গীয় জীবকে নির্ণয়ের জন্য মনুস্মৃতি বা (মনুষ্যের বিধি বিধান সম্বলিত গ্রন্থ)লেখা হয়েছে। এই গ্রন্থ অনুসারে মনুষ্য ধর্ম বিবেচিত হবে দশটি গুণ এর মাধ্যমে, যে দশটি গুণের উপস্থিতি তাদেরকে মনুষ্য প্রমাণ করবে। যথা-
ইংরেজি Religion (উচ্চারণ: রিলিজিয়ন, অর্থ: উপসনা ধর্ম) শব্দটির উৎপত্তি ফরাসিreligion থেকে, যেমন, “religious community” (উচ্চারণ: রিলিজিয়াস কমিউনিটি, অর্থ: ধর্মীয় সম্প্রদায়)। আবার এটি এসেছে লাতিনreligionem থেকে (nom. religio) যার অর্থ “পবিত্র বিষয়ের প্রতি শ্রদ্ধা, ঈশ্বরদের প্রতি নিষ্ঠা” (“respect for what is sacred, reverence for the gods”),[১২] এবং “বাধ্যতা, যা মানুষ ও ঈশ্বরদের মধ্যে সেতুবন্ধনস্বরূপ” (“obligation, the bond between man and the gods”),[১৩] যেটি আবার লাতিন religiō থেকে পাওয়া।
religion
প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় পৃথিবীতে, আধুনিক ‘religion’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত লাতিন শব্দমূল religio -কে বোঝা হতো ব্যক্তিবিশেষের উপাসনা করার গুণ হিসেবে; কখনই মতবাদ, চর্চা কিংবা জ্ঞানের উৎসকে নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হতো না।[১৪] ধর্মের আধুনিক ধারণা এমন এক বিমূর্ততা, যা ধর্মকে কতকগুলো স্বতন্ত্র বিশ্বাস বা মতবাদের সমষ্টি হিসেবে উপস্থাপন করে। ধর্মের অর্থ হিসেবে এটি অতি সাম্প্রতিক একটি উদ্ভাবন, ইংরেজি ভাষা যার ব্যাপক ব্যবহার সপ্তাদশ শতাব্দী থেকে লক্ষণীয়। এসময় ‘ধর্ম’ বলতে বোঝানো হতে থাকে ‘উপাসনা ধর্মকে’। ইতিহাসবেত্তারা এর কারণ হিসেবে প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারের সময়ে খ্রিষ্ট ধর্মের বিভাজন ও ভ্রমণের যুগে বৈশ্বায়নকে দায়ী করে থাকেন।[১৪] এ যুগে, ইউরোপীয়দের সাথে অসংখ্য ভিন্ন সংস্কৃতির ও ভাষার দেশী-বিদেশী জনপদের যোগাযোগ স্থাপন আরও সাধারণ একটি ব্যাপারে পরিণত হয়। আবার এসব জনগোষ্ঠীর মধ্যে অনেকেরই নিজ ভাষায় ধর্মীয় ভাব প্রকাশের জন্য ‘religion’ -এর সমতূল্য ধারণা বা সমার্থক শব্দ ছিল না।[১৪] সপ্তাদশ শতকই সেই সময়, যখন ধর্মের ধারণা আধুনিক আকার পেতে শুরু করে। যদিও বাইবেল, কুরআন এবং অন্যান্য প্রাচীন পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহের মূল ভাষায় লিখিত সংস্করণে ধর্মের ধারণার কোন সুস্পষ্ট উল্লেখ ছিল না।
religion
এমনকি যে সংস্কৃতিতে এই ধর্মগ্রন্হসমূহ লেখা হয় কিংবা যারা এই গ্রন্হগুলো অনুসরণ করতেন তাদেরও ধর্মের কোন সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না।[১৫] উদাহরণস্বরূপ, গ্রিক শব্দ threskeia (উচ্চারণ: থ্রেসকিয়া বা থ্রিসকিয়া) -এর কথা বলা যায়, যেটি হিরোডোটাস ও জোসিফাসের মত প্রখ্যাত গ্রিক লেখকেরা ‘উপাসনা’ অর্থে ব্যবহার করতেন। অথচ আজকের দিনে নিউ টেস্টামেন্টে এর অনুবাদ করা হয়েছে ‘ধর্ম’ হিসেবে। মধ্যযুগেও উক্ত শব্দটি ‘উপাসনা’ কিংবা এর সমার্থক ভাব প্রকাশে ব্যবহৃত হতো।[১৫] আবার কুরঅানের ক্ষেত্রে, অধিকাংশ সময়ই আরবী শব্দ دين (উচ্চারণ: দ্বীন) -এর আধুনিক ইংরেজি অনুবাদ করা হয় ‘religion’ বা ধর্ম হিসেবে, কিন্তু সপ্তাদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত অনুবাদকেরা এই শব্দটি ব্যবহার করতেন ‘আইন’ বোঝাতে।[১৫] এমনকি খ্রিষ্টপূর্ব ১ম শতকেও গ্রিক দার্শনিক জোসিফাস গ্রিক শব্দ ioudaismos (উচ্চারণ: ইউদাইসমোস) -কে ‘সম্প্রদায়’ অর্থে ব্যবহার করতেন, যার সাথে আধুনিককালের এক সেট বিমূর্ত ধারণা ও বিশ্বাসের সমাহার হিসেবে ধর্মের যে সংজ্ঞা প্রণীত হয়েছে তার কোন সম্পর্ক নেই। যদিও বর্তমানকালে অনেকেই ioudaismos -কে ‘ইহুদি ধর্ম’ (Judaism) হিসেবে অনুবাদ করেন।[১৫] উনবিংশ শতকেই প্রথম চলিত ভাষায় ‘বৌদ্ধ ধর্ম’ (Buddhism), ‘হিন্দু ধর্ম’ (Hinduism), ‘তাওবাদ’ (Taoism), ‘কনফুসিয়ানিজম’ (Confucianism) প্রভৃতি শব্দের উন্মেষ ঘটে।[১৪][১৬]জাপানের সুদীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, জাপানে কখনই কোথাও ‘ধর্মের’ কোন ধারণা ছিল না। যেহেতু জাপানী ভাষায় ‘ধর্ম’ বোঝাতে কোন শব্দ ছিল না, এমনকি এর কাছাকাছি ভাব প্রকাশ করে এমন কোন শব্দও না থাকায়, যখন ১৮৫৩ সালে মার্কিন রণতরীগুলো জাপানের উপকূলে এর জলসীমায় অবস্থান নেয় এবং তৎকালীর জাপান সরকারকে অন্যান্য অনেক বিষয়ের সাথে ধর্মের স্বাধীনতাকেও রাষ্ট্রনীতি হিসেবে স্বীকার করে সন্ধিপত্রে স্বাক্ষরের জন্য চাপ দিতে থাকে, তখন জাপান সরকার বাধ্য হয় এই পশ্চিমা ধারণা গ্রহণ করতে।[১৬]
religion
উনিশ শতকের প্রখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদম্যাক্স মুলারের মতে, ইংরেজি ভাষায় ব্যবহৃত ‘religion’ শব্দটির শব্দমূল, লাতিন religio (উচ্চারণ: রিলিজিও) শব্দটি মূলত ব্যবহৃত হতো “ঈশ্বর কিংবা ঈশ্বরবর্গের প্রতি নিষ্ঠা, পবিত্র বিষয়সমূহ সম্পর্কে সাবধানী চিন্তা ও ভক্তি (যেটিকে পরবর্তীতে সিসারো ‘অধ্যবসায়’ হিসেবে ব্যাক্ত করেন)” অর্থে।[১৭][১৮] ম্যাক্স মুলার পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বহু সংস্কৃতিকে ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে অনুরূপ ক্ষমতা-কাঠামোর অধিকারী হিসেবে চিন্হিত করেন, যেগুলোর মধ্যে মিশরীয়, পারস্যীয় ও ভারতীয় সংস্কৃতিও অন্তর্ভুক্ত। তার মতে আজ যেগুলোকে আদিম ধর্মমত বলা হয়, তৎকালীন মানুষের কাছে সেগুলো ছিল কেবলই ‘আইন’ মাত্র।[১৯]
অনেক ভাষাতেই এমন শব্দাবলি রয়েছে যেগুলোকে ‘ধর্ম’ হিসেবে অনুবাদ করা যেতে পারে, কিন্তু ভাষাভাষিরা হয়তো ভিন্নভাবে সেগুলো ব্যবহার করতে পারেন। আবার কিছু ভাষায় ধর্ম বলতে কোন শব্দই নেই। উদাহরণস্বরূপ, সংস্কৃত धर्म (উচ্চারণ: ধার্মা বা dharma) শব্দটিকে কখনও কখনও ‘উপাসনা ধর্ম’ হিসেবে ভাষান্তর করা হলেও এর আরেকটি অর্থ ‘আইন’। চিরায়ত যুগে দক্ষিণ এশিয়ায় ভক্তির মাধ্যমে প্রায়শ্চিত্ত (penance through piety) এবং ধর্মানুষ্ঠানিক ও ব্যবহারিক প্রথাগুলোও আইন শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রথমদিককার মধ্যযুগীয় জাপানে ‘সাম্রাজ্যবাদী আইন’ এবং সর্বজনীন বা ‘বুদ্ধের আইনের’ মধ্যে এক ধরনের মেলবন্ধন ছিল, যেগুলো পরবর্তীকালে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষমতার স্বাধীন উৎসে পরিণত হয়।[২০][২১]
religion
হিব্রু ভাষায় ‘ধর্মের’ কোন অবিকল সমার্থক শব্দ নেই, এবং ইহুদি ধর্ম স্পষ্টরূপে ধর্মীয়, জাতীয়তাবাদী, বর্ণীয় কিংবা সাম্প্রদায়িক পরিচয়সমূহের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখায় না।[২২] এই ধর্মের কেন্দ্রীয় ধারণাসমূহের মধ্যে ‘halakha’ (উচ্চারণ: হালাকা বা হালাখা) অন্যতম, যার অর্থ, ‘পথ’ বা ‘পথে চলা’, যা আবার অনেকসময় ‘আইন’ হিসেবেও অনুবাদ করা হয়। এই আইন দ্বারা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, বিশ্বাস ও দৈনন্দিন জীবনে এর প্রয়োগ নির্দেশিত হয়।[২৩]
সংজ্ঞা
religion
পণ্ডিতগণ ধর্মের সংজ্ঞা নিয়ে একমত হতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে, দুটি সাধারণ সংজ্ঞা ব্যবস্থা রয়েছে: সমাজতাত্ত্বিক/কার্যকরী এবং ঘটনাগত/দার্শনিক।[২৪][২৫][২৬][২৭][২৮]
আধুনিক পাশ্চাত্য মতবাদ
ধর্মের ধারণার উৎপত্তি আধুনিক যুগে পাশ্চাত্য সভ্যতায়।[২৯]
ধর্মের বৈশিষ্ট্য
প্রাণী সুলভ ধর্ম অথবা বৈশিষ্ট্য – পৃথিবীর অন্য সকল প্রাণীর মতই মানুষেরও কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন – খাওয়া, ঘুম, ভয়, মৈথুন, মলত্যাগ, বিবাদ, আত্মরক্ষা, পরিবেশে টিকে থাকার আয়োজন।
religion
মনুষ্য সুলভ ধর্ম অথবা বৈশিষ্ট্য – যে কারণে তারা মানুষ অর্থাৎ তাদের অর্জিত জ্ঞান, যা কেবল অনুভবই করা যায়, দেখা যায়না। এ বৈশিষ্ট্যের দ্বারাই মানুষ তার প্রাণী সুলভ ধর্ম অথবা বৈশিষ্ট্যকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কেবলমাত্র সমাজে বেড়ে ওঠা মানুষ্যের (হোমো স্যাপিয়েন্স-এর) মাঝেই এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, যেমন – পরিচিতি, ভাবের আদান-প্রদানের জন্য ভাষা জ্ঞান, সামাজিকতা, পঞ্চ ইন্দ্রিয় কে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি, চিন্তা করে আবিষ্কারের ক্ষমতা, বিশ্লেষণাত্মক মন, স্ব প্রতিফলনের ক্ষমতা, চেতনা ও বোধশক্তি, ইচ্ছাশক্তি, আবেগ ও অনুভূতি, ধৈর্য, বিবেক, ক্ষমা। এই মনুষ্য সুলভ ধর্ম অথবা বৈশিষ্ট্যের জন্য কালে কালে বিভিন্ন দর্শন, নিয়মকানুন এবং পথনির্দেশনা এসেছে।
ধর্মের ইতিহাস বিভিন্ন ধর্মমতে ভিন্ন ভিন্ন, তবে বর্তমান পৃথিবীর প্রধান তিনটি ধর্ম অর্থ্যাৎ ইসলাম, খ্রিস্টান ও ইহুদি ধর্মমতে পৃথিবীর সকল মানুষ একজন পিতা ও একজন মাতা থেকে জন্ম গ্রহণ করেছে। এই দুইজন আদি পিতা আদম (Adam) ও মাতা হাওয়া (Eve) এর মাধ্যমে পৃথিবীর সকল মানুষের জন্ম। এই তিন ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ যথাক্রমে কুরআন মাজিদ, বাইবেল (নিউ টেস্টামেন্ট) ও তাওরাহ (ওল্ড টেস্টামেন্ট) থেকে এই ঘটনার সুত্র পাওয়া যায়। মানব্জাতির সৃষ্টির পর থেকেই মুলত মানুষের ধর্মের সুত্রপাত। ইসলাম ধর্মমতে আদম (আলাইহিস সালাম) পৃথিবীতে আগমনের পর তার প্রাথমিক কাজ ছিল কিভাবে পৃথিবীতে জীবন ধারণ করতে হবে তা প্রতিপালন করা এবং এক্ষেত্রে ফেরেশতা জিবরাইল (আলাইহিস সালাম) (Gabrial) আদম (আলাইহিস সালাম) কে সহযোগিতা করেছেন। কিভাবে ঘর নির্মাণ করতে হবে, খাবার তৈরী করতে হবে, শিকার করতে হবে এসকল জিনিস ছিল তার প্রাথমিক ধর্ম। পরবর্তিতে আদম (আলাইহিস সালাম) ও হাওয়া (আলাইহিস সালাম) এর সন্তানসন্ততি জন্মগ্রহণ করলে তখনো তাদের জীবনধারণ করাটাই ছিল তাদের ধর্মের মূল বিধিবিধান।
religion
ধর্মীয় ধারনাগুলোর প্রাচীনতম প্রমাণ পাওয়া যায় কয়েক হাজার বছর আগে মধ্য ও নিম্ন প্যালিলিথিক যুগে। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ প্রায় ৩০০,০০০ বছর আগে ধর্মীয় ধারনার প্রমাণ হিসাবে হোমো স্যাপিয়েনদের কবরস্থানের কথা উল্লেখ করেছেন। ধর্মীয় ধারনার অন্যান্য প্রমাণ আফ্রিকায় পাওয়া যায়, যার মধ্যে মধ্য পাথর যুগে হস্তনির্মিত বিভিন্ন প্রতীকী অন্তর্ভুক্ত। যাইহোক, প্রাথমিক প্যালিলিথিক যুগের হস্তনির্মিত বিভিন্ন প্রতীকীর ব্যাখ্যা, যা কিভাবে ধর্মীয় ধারণা সম্পর্কিত, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ কিছুটা কম বিতর্কিত। বিজ্ঞানীরা সাধারণত ধর্মীয় ধারনার প্রতিনিধিত্বকারী হিসাবে উর্ধ-প্যালোলিথিক (৫০,০০০-১৩,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) যুগ থেকে পাওয়া বেশ কয়েকটি প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয় ব্যাখ্যা করে থাকেন। সেই যুগের ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোর সাথে সম্পর্কিত উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে সিংহের মত দেখতে মানুষ, শুক্রের মূর্তি, চাউট গুহার সমাধি, গুহা চিত্র ইত্যাদি।
উনিশ শতকের গবেষকগণ ধর্মের উৎস সম্পর্কিত বিভিন্ন তত্ত্ব প্রস্তাব করেছিলেন, যেটি খ্রিস্টান মতবাদকে বিতর্কিত করেছিলো। উদারতার আগে দাবিগুলো চ্যালেঞ্জ করেছিল। প্রারম্ভিক তত্ত্ববিদ এডওয়ার্ড বার্নেট টাইলর (১৮৩২-১৯১৭) এবং হার্বার্ট স্পেন্সার (১৮২০-১৯০৩) অ্যানিমিজমের ধারণা প্রস্তাব করেছিলেন। আর প্রত্নতত্ত্ববিদ জন লুবক (১৮৩৪-১৯১৩) শব্দটিকে “প্রতিমাবাদ” বলেন। এদিকে ধর্মীয় পণ্ডিত ম্যাক মুলার (১৮২৩-১৯০০) বলেন ধর্ম শুরু হয় হেডোনিজম থেকে। ফোকলোরিস্ট উইলহেলম মানহার্ড (১৯৩১-১৮৮০) বলেছিলেন, ধর্ম “প্রাকৃতিকতা” থেকে শুরু হয়েছিল, যার দ্বারা তিনি প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর পৌরাণিক ব্যাখ্যা বোঝাতে চেয়েছিলেন।[৩০] এই সব তত্ত্বগুলো ব্যাপকভাবে সমালোচনা করা হয়েছে। ধর্মের উৎপত্তি সংক্রান্ত কোন বিস্তৃত ঐক্যমত্য নেই।
religion
প্রাক-মৃৎপাত্র নিওলিথিক এ (পিপিএনএ) গোবেকলি তেপে, যা এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রাচীনতম ধর্মীয় স্থান।[৩১] এর মধ্যে রয়েছে বিশাল টি-আকৃতির প্রস্তর স্তম্ভ, যা বিশ্বের প্রাচীনতম মেগালিথ হিসেবে পরিচিত। [৩২] এটি বিমূর্ত চিত্র, চিত্রগ্রন্থ এবং পশু ভাস্কর্য ইত্যাদি দ্বারা সজ্জিত। এটি তথাকথিত নিউলিথিক বিপ্লবের আগে নির্মিত হয়েছিল, যেমনঃ ৯০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কৃষি ও পশুপালন শুরু হয়েছিলো। কিন্তু গোবেকলি তেপের নির্মাণে একটি উন্নত সংগঠন বুঝায়, যা এখন পর্যন্ত প্যালিওলিথিক, পিপিএনএ বা পিপিএনবি সমাজগুলোর সাথে সম্পর্কিত নয়। জায়গাটি প্রথম কৃষি সমাজের শুরুতে প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে যায়। জায়গাটি এখনও খনন এবং বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এভাবে এই অঞ্চলের পুরনো সম্প্রদায়ের জন্য, সেইসাথে ধর্মের সাধারণ ইতিহাসের জন্য উল্লেখযোগ্য বিষয় সম্পর্কে জানা যাবে।
ধর্মের উপকারিতা
সংগঠিত ধর্ম নিম্নলিখিত উপায়ে বৃহত্তর জনসংখ্যার সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রদানের মাধ্যম হিসাবে উত্থাপিত হয়েছেঃ
সংগঠিত ধর্ম একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষকে ন্যায্যতা প্রদান করে, যার ফলে রাষ্ট্রকে সামাজিক ও নিরাপত্তা পরিষেবা প্রদানের জন্য কর আদায় করার অধিকার লাভ করে। ভারত এবং মেসোপটেমিয়ার ধর্মশাসনে বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানগণ,রাজা, এবং সম্রাট রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে ভূমিকা পালন করতেন।[৩৩] বিশ্বব্যাপী সমস্ত রাষ্ট্রীয় সমাজে অনুরূপ রাজনৈতিক কাঠামো রয়েছে, যেখানে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ঐশ্বরিক অনুমোদন দ্বারা ন্যায্যতা পায়।
সংগঠিত ধর্ম সম্পর্কহীন ব্যক্তিদের মধ্যে শান্তি বজায় রাখার উপায় হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলো। তবে রাষ্ট্র ও দেশগুলোতে হাজার হাজার বা কোটি কোটি মানুষ পরস্পরের সাথে সাথে সম্পর্কহীন ছিলো। জারেড ডায়মন্ড যুক্তি দেখান যে, সংগঠিত ধর্ম অন্য কোনও সম্পর্কহীন ব্যক্তিদের মধ্যে বন্ধন তৈরী করে। অন্যথায় সেখানে শত্রুতার প্রবণতা প্রকাশ পাবে। কারণ হিসেবে তিনি যুক্তি দেন যে, ব্যান্ড ও উপজাতীয় সমাজের মধ্যে মৃত্যুর একটি প্রধান কারণ হত্যাকাণ্ড।
পৃথিবীতে মানুষের জীবন যাপনের দিক নির্দেশনা এবং সাম্য-মৈত্রীর বাণী নিয়ে যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্মের আগমন ঘটেছে। মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারতবর্ষ হচ্ছে ধর্মের আদিভূমি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধর্মের নামে মানুষ রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছে আবার এই ধর্মই মানুষকে করেছে সুসংহত, মানবতাবাদী। এছাড়া মানবধর্ম রয়েছে যেটা নাস্তিকরা পালন করে। তারা কোন ধর্মকেই বিশ্বাস করে না,তাদের মতে বিজ্ঞান ও আধুনিক পৃথিবী,তাদের জন্ম হয়েছে বির্বতনের মাধ্যমে এটাই তাদের বিশ্বাস।
ইব্রাহিমীয় ধর্ম বা আব্রাহামিক ধর্ম (ইংরেজি: Abrahamic Religion) বলতে একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোকে বোঝানো হয়, যাদের মধ্যে ইব্রাহিমের সাথে সম্পর্কিত ধর্মীয় উৎপত্তি[১] অথবা ধর্মীয় ইতিহাসগত ধারাবাহিকতা বিদ্যমান।[২][৩][৪] এইসব ধর্ম হযরত ইব্রাহিম অথবা তার বংশধর প্রচার করেছেন। ভারত, চীন, জাপান ইত্যাদি দেশের উপজাতীয় অঞ্চল বাদ দিয়ে সারা বিশ্বে এই মতবাদের আধিপত্য। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে যে তিনটি ধর্মগত শ্রেণীবিন্যাস পাওয়া যায়, এদের মধ্যে ইব্রাহিমীয় ধর্ম একটি শ্রেণী; অপর দুটি শ্রেণী হচ্ছে ভারতীয় ধর্ম (উদাহরণ- হিন্দু ধর্ম) এবং পূর্ব এশীয় ধর্ম।[৫]
সৌদি আরবের মক্কার কাবা শরীফ; যেখানে সারা বিশ্বের লাখো মুসলিম একতার মাধ্যমে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যতার সাথে প্রার্থনা করে থাকেন।
ইসলাম (আরবি ভাষায়: الإسلام আল্-ইসলাম্) একেশ্বরবাদী । “ইসলাম” শব্দের অর্থ “আত্মসমর্পণ”, বা একক স্রষ্টার নিকট নিজেকে সমর্পণ। কুরআন দ্বারা পরিচালিত; যা এমন এক কিতাব যাকে এর অনুসরণকারীরা [৬]( আরবি : الله আল্লাহ ) বানী বলে মনে করে এবং ইসলামের প্রধান নবী মুহাম্মাদ সঃ এর প্রদত্ত শিক্ষা পদ্ধতি,জীবনাদর্শও (বলা হয় সুন্নাহ এবং হাদিস নামে লিপিবদ্ধ রয়েছে ) এর ভিত্তি । ইসলামের অনুসরণকারীরা মুহাম্মদ সঃ কে শেষ নবী বলে মনে করে। । তিনি এই ধর্মের প্রবর্তক নন বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত সর্বশেষ ও চূড়ান্ত রাসূল (পয়গম্বর)। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে তিনি এই ধর্ম পুনঃপ্রচার করেন। কুরআন ইসলামের মূল ধর্মগ্রন্থ। এই ধর্মে বিশ্বাসীদের মুসলমান বা মুসলিম বলা হয়। কুরআন আল্লাহর বাণী এবং তাঁর দ্বারা মুহাম্মদ সঃ এর নিকট প্রেরিত বলে মুসলমানরা বিশ্বাস করেন। তাঁদের বিশ্বাস অনুসারে মুহাম্মদ শেষ নবী। হাদিসে প্রাপ্ত তার নির্দেশিত কাজ ও শিক্ষার ভিত্তিতে কুরআনকে ব্যাখ্যা করা হয়।
‘খ্রিস্ট ধর্ম (প্রাচীন গ্রিক: Χριστός খ্রিস্তোস) হচ্ছে একেশ্বরবাদী ধর্ম। নাজারাথের যিশুর জীবন ও শিক্ষাকে কেন্দ্র করে এই ধর্ম বিকশিত হয়েছে। খ্রিস্টানরা মনে করেন যিশুই মসীহ এবং তাকে যিশু খ্রিস্ট বলে ডাকেন। খ্রিস্ট ধর্মের শিক্ষা নতুন টেস্টামেন্ট বা নতুন বাইবেলে গ্রথিত হয়েছে। এই ধর্মাবলম্বীরা খ্রিস্টান পরিচিত। তারা বিশ্বাস করে যে যীশু খ্রীস্ট হচ্ছেন ঈশ্বরের পুত্র। ইসলাম ধর্মে যিশুকে ঈসা (আঃ) বলা হয়েছে। তবে ইসলামে তিনি একজন নবী।
২০০১ খ্রিস্টাব্দের তথ্য অনুযায়ী সারা বিশ্বে ২.১ বিলিয়ন খ্রিস্ট ধর্মের অনুসরণকারী আছে।[১৩][১৪][১৫][১৬] সে হিসেবে বর্তমানে এটি পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্ম।[১৭][১৮] ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, সাব-সাহারান আফ্রিকা, ফিলিপিন্স দ্বীপপুঞ্জ ও ওশেনিয়া অঞ্চলে খ্রিস্ট ধর্ম প্রধান ধর্ম হিসেবে পালিত হয়।
প্রথম শতাব্দীতে একটি ইহুদি ফেরকা হিসেবে এই ধর্মের আবির্ভাব। সঙ্গত কারণে ইহুদি ধর্মের অনেক ধর্মীয় পুস্তক ও ইতিহাসকে এই ধর্মে গ্রহণ করা হয়েছে। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তানাখ বা হিব্রু বাইবেলকে খ্রিস্টানরা পুরাতন বাইবেল বলে থাকে। ইহুদি ও ইসলাম ধর্মের ন্যায় খ্রিস্ট ধর্মও আব্রাহামীয়।
ইহুদি ধর্ম (হিব্রু:יְהוּדִים ইয়াহুদীম) অত্যন্ত প্রাচীন, একেশ্বরবাদী ধর্ম। ধারণাগত মিল থেকে ধর্মতাত্ত্বিকগণ ধারণা করেন যে, ইহুদি ধর্মের ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছে খ্রিস্ট ধর্ম, ইসলাম ধর্ম ইত্যাদি ইব্রাহিমীয় ধর্ম। এই ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ হিসেবে ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রথম পাঁচটি বইকে গণ্য করা হয়: জেনেসিস, এক্সোডাস, লেভিটিকাস, নাম্বারস এবং ডিউটেরোনমি। এই পাঁচটি বইকে একত্রে “তোরাহ”ও (Torah) বলা হয়ে থাকে। মুসলমানগণ মোজেসকে মুসা নবী হিসেবে মানেন। এবং মুসা নবীর উপর নাজিলকৃত ধর্মগ্রন্থকে তাওরাত নামে অভিহিত করেন। ইহুদি ধর্মবিশ্বাসমতে, ঈশ্বর এক, আর তাঁকে জেহোবা (Jehovah, YHWH) নামে আখ্যায়িত করা হয়। মোসেয হলেন ঈশ্বরের একজন বাণীবাহক। ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের মতোই ইহুদিগণ পূর্বতন সকল বাণীবাহককে বিশ্বাস করেন, এবং মনে করেন মোজেসই সর্বশেষ বাণীবাহক। ইহুদিগণ যিশুকে ঈশ্বরের বাণীবাহক হিসেবে অস্বীকার করলেও, খ্রিস্টানগণ ইহুদিদের সবগুলো ধর্মগ্রন্থ (ওল্ড টেস্টামেন্ট)কে নিজেদের ধর্মগ্রন্থ হিসেবে মান্য করে থাকেন। ইহুদি ধর্ম সেমেটিক ধর্ম হিসেবেও অভিহিত। ২০১২ খ্রিস্টাব্দের তথ্যমতে, পৃথিবীতে ইহুদির সংখ্যা ১৪০ লক্ষ যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ০.২ শতাংশ।[১৯]
মানব ধর্ম
বর্তমান যুগে যারা শুধু বিজ্ঞান ও বির্বতনকে বিশ্বাস করে তারা মানবধর্ম পালন করে।তারা স্বাধীন।তারা আধুনিক বিজ্ঞানকে আর্দশ মনে করে।
মানব ধর্মে বিশ্বাসীগণ নাস্তিক নামেও পরিচিত,কারণ তারা আদিমকালের কোন ধর্মই বিশ্বাস করে না, পালন করে না।৭৭১.৫০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মানবধর্মে বিশ্বাসী পুরো পৃথিবীতে ২০ কোটি প্রায়।মানব ধর্মের উল্লেখ কবি “লালন শার্হ” তার কবিতায় বলেছেন। তিনি চেয়েছেন ধর্ম,জাত,বর্ণের কোন ভেদাভেদ না রেখে সবাই মানবধর্মে মনোযোগ দেই, মানবধর্ম পালনে বিশ্বাসী হই।
দ্রুজ ( আরবী-درزي, দারজি অথবা দুরজি, বহুবচন دروز, দুরুজ; হিব্রু: דרוזים, “দ্রুজিম”) একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম এবং সামাজিক সম্প্রদায়।[২০] দ্রুজদের আবাসভূমি সিরিয়া, লেবানন, ইসরাইল, এবং জর্ডানে। দ্রুজ ধর্মকে আলাদা ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়না। কারণ এই ধর্মের ভিত্তিমূল ইসলাম। দ্রুজ ধর্ম মূলত শিয়া ইসলামের একটি শাখা। দ্রুজদের ধর্ম বিধানে ইব্রাহিমীয় ধর্মসমূহের পাশাপাশি নিওপ্লাতিনিক এবং পিথাগোরীয় মতবাদের প্রভাব লক্ষ করা যায়। দ্রুজগণ নিজেদেরকে “আহলে তাওহীদ” (একেশ্ববাদী মানুষ বা একতাবদ্ধ মানুষ) অথবা “আল মুয়াহিদুন” বলে পরিচয় দেয়। লেভান্ত বিশেষ করে লেবাননের ইতিহাস গঠনে দ্রুজদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দ্রুজদের সামাজিক রীতিনীতি মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের থেকে ভিন্ন।
ইব্রাহিমীয় বা আব্রাহামীয় ধর্ম সমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মান্দাই ধর্ম বা মেন্ডীয়বাদ। মান্দাই ধর্মাবল্বীরা একেশ্বরবাদী হলেও তাদের মধ্যে দ্বৈতনীতি লক্ষ্য করা যায়।আদম,এ্যাবেল,সেথ্,ইনোস,নোহা,সেম্, এরাম এবং জন দ্যা ব্যাপটিষ্ট এর উপর তাদের দৃঢ় বিশ্বাস লক্ষ্যনীয়।মূলত এ ধর্মের অনুশীলন বেশি লক্ষ্য করা যায় ইউফেরিথিস,টাইগ্রিস এবং সাতার আল আরবকে ঘিরে।তারা বিশ্বাস করে এক অদৃশ্য ক্ষমতাশালীকে যার মধ্য থেকে এসেছে সৃষ্টিকর্তা। তারা বিশ্বাস করে এ মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে আদিরূপ হতে।তারা আলোকে পিতা ও অন্ধকারকে মাতা হিসেবে বিশ্বাস করে।আত্মা অবিনশ্বর বলে তাদের বিশ্বাস। মৃত্যুর পর তাকে ফিরে যেতে হবে আপন ঠিকানায়। ভাগ্যের উপর গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাব রয়েছে বলে তাদের বিশ্বাস। এ ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের নাম “গীজা বা গীজা বারা”। বর্তমানে এ ধর্মের অনুসারী সংখ্যা প্রায় ৬০,০০০ হতে ৭০,০০০।
রাস্তাফারি
রাস্তাফারি হচ্ছে একটি ইব্রাহিমীয় ধর্মমত যা ১৯৩০ সালে জ্যামাইকাতে উৎপত্তি লাভ করে। রাস্তাফারি ধর্মানুসারীদের রাস্তাফারি, রাস্তাস, রাস্তাফারিয়ানস অথবা শুধু রাস নামে অভিহিত করা হয়। রাস্তাফারিরা তাদের চার্চ কর্তৃক প্রদত্ত উপাধি যেমন মুরুব্বি, বড় সাধু ইত্যাদি নামেও পরিচিত হয়। অনেকে রাস্তাফারি জীবন দর্শনকে রাস্তাফারিয়ানিজম নামে অভিহিত করে তবে অধিকাংশ রাস ইজম ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করে।ত্রুটি: কোনও পৃষ্ঠার নাম নির্দিষ্ট করা হয়নি (সাহায্য)।
হিন্দুধর্ম একাধিক ধর্মীয় ঐতিহ্যের সমন্বয়ে গঠিত। এই ধর্মের কোনো একক প্রতিষ্ঠাতা নেই। জনসংখ্যার বিচারে হিন্দুধর্ম খ্রিষ্টধর্ম ও ইসলামের পরেই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ধর্মমত। এই ধর্মের অনুগামীদের সংখ্যা ১২০ কোটিরও বেশি। এদের মধ্যে প্রায় ১১২ কোটি হিন্দুর বাস করেন ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে। অর্থাৎ বিশ্বের শতকরা ৯৪ শতাংশের বেশি হিন্দু ভারতবর্ষে বসবাস করে।[২৪][২৫] এছাড়া নেপাল (২৩,০০০,০০০), বাংলাদেশ (১৪,০০০,০০০) ও ইন্দোনেশীয় দ্বীপ বালিতে (৩,৩০০,০০০) উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় হিন্দুরা বাস করে। গরুকে এরা পবিত্র মনে করে। হিন্দুধর্মের শাস্ত্রগ্রন্থের সংখ্যা প্রচুর। হিন্দুশাস্ত্র শ্রুতি ও স্মৃতি নামে দুই ভাগে বিভক্ত। এই গ্রন্থগুলিতে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন ও পুরাণ আলোচিত হয়েছে এবং ধর্মানুশীলন সংক্রান্ত নানা তথ্য বিবৃত হয়েছে। এই গ্রন্থগুলির মধ্যে বেদ সর্বপ্রাচীন, সর্বপ্রধান ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলি হল উপনিষদ্, পুরাণ, ও ভারতীয় মহাকাব্যরামায়ণ ও মহাভারত। ভগবদ্গীতা নামে পরিচিত মহাভারতের কৃষ্ণ-কথিত একটি অংশ বিশেষ গুরুত্বসম্পন্ন ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা পেয়ে থাকে। এটি বিশ্বের সর্বপ্রাচীন ধর্ম। [২৬]
বৌদ্ধ ধর্ম বা ধর্ম (পালি ভাষায়ধম্ম) গৌতম বুদ্ধ কর্তৃক প্রচারিত একটি ধর্ম বিশ্বাস এবং জীবন দর্শন। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দিতে গৌতম বুদ্ধের জন্ম। বুদ্বের পরিনির্বাণের পরে ভারতীয় উপমহাদেশ সহ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার হয়। বর্তমানে বৌদ্ধ ধর্ম দুটি প্রধান মতবাদে বিভক্ত। প্রধান অংশটি হচ্ছে হীনযান বা থেরবাদ (সংস্কৃত: স্থবিরবাদ)। দ্বিতীয়টি মহাযান নামে পরিচিত। বজ্রযান বা তান্ত্রিক মতবাদটি মহাযানের একটি অংশ। বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ও কোরিয়াসহ পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে এই ধর্মবিশ্বাসের অনুসারী রয়েছে। সবচেয়ে বেশি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী বাস করেন চীনে। আক্ষরিক অর্থে “বুদ্ধ” বলতে একজন জ্ঞানপ্রাপ্ত, উদ্বোধিত, জ্ঞানী, জাগরিত মানুষকে বোঝায়। উপাসনার মাধ্যমে উদ্ভাসিত আধ্যাত্মিক উপলব্ধি এবং পরম জ্ঞানকে বোধি বলা হয় (যে অশ্বত্থ গাছের নিচে তপস্যা করতে করতে বুদ্ধদেব বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন তার নাম এখন বোধি বৃক্ষ)। সেই অর্থে যে কোনও মানুষই বোধপ্রাপ্ত, উদ্বোধিত এবং জাগরিত হতে পারে। সিদ্ধার্থ গৌতম এইকালের এমনই একজন “বুদ্ধ“। আর যে ব্যক্তি এই বোধি জ্ঞান লাভ বা ধারণ করেন তাকে বলা হয় বোধিসত্ত্ব। বোধিসত্ত্ব জন্মের সর্বশেষ জন্ম হল বুদ্ধত্ব লাভের জন্য জন্ম। জাতকে, বুদ্ধ বোধিসত্ত্ব হিসেবে ৫৪৮ (মতান্তরে ৫৪৯) বার বিভিন্ন কূলে (বংশে) জন্ম নেবার আগে উল্লেখ আছে।[২৭] তিনি তার আগের জন্মগুলোতে প্রচুর ভালো বা পুণ্যের কাজ করেছিলেন বিধায় সর্বশেষ জন্মে বুদ্ধ হবার জন্য জন্ম গ্রহণ করেন। বুদ্ধত্ব লাভের ফলে তিনি এই দুঃখময় পৃথিবীতে আর জন্ম নেবেন না, এটাই ছিলো তার শেষ জন্ম। পরবর্তী বুদ্ধ জন্ম না নেওয়া পর্যন্ত পৃথিবীতে তার শাসন চলবে।
জৈনধর্ম (সংস্কৃত: जैन धर्म) প্রাচীন ভারতে প্রবর্তিত একটি ধর্মমত। বর্তমানে বিশ্বের নানা দেশে এই ধর্মমতাবলম্বীদের দেখা যায়। জৈনধর্মের মূল বক্তব্য হল সকল জীবের প্রতি শান্তি ও অহিংসার পথ গ্রহণ। জৈন দর্শন ও ধর্মানুশীলনের মূল কথা হল দৈব চৈতন্যের আধ্যাত্মিক সোপানে স্বচেষ্টায় আত্মার উন্নতি। যে ব্যক্তি বা আত্মা অন্তরের শত্রুকে জয় করে সর্বোচ্চ অবস্থা প্রাপ্ত হন তাকে জিন (জিতেন্দ্রিয়) আখ্যা দেওয়া হয়। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলিতে জৈনধর্মকে শ্রমণ ধর্ম বা নির্গ্রন্থদের ধর্মও বলা হয়েছে। কথিত আছে, তীর্থঙ্কর নামে চব্বিশ জন মহাজ্ঞানী কৃচ্ছ্বসাধকের একটি ধারা পর্যায়ক্রমে জৈনধর্মকে পুনরুদ্ধার করেছিলেন।[২৮] এঁদের মধ্যে ত্রাবিংশ তীর্থঙ্কর ছিলেন পার্শ্বনাথ (খ্রিষ্টপূর্ব নবম শতাব্দী) ও সর্বশেষ তীর্থঙ্কর ছিলেন মহাবীর (খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী)।[২৯][৩০][৩১][৩২][৩৩] আধুনিক বিশ্বে জৈনধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম হলেও এই ধর্ম বেশ প্রভাবশালী। ভারতে জৈন ধর্মবলম্বীদের সংখ্যা প্রায় ১০,২০০,০০০।[৩৪] এছাড়া উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ, দূরপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া ও বিশ্বের অন্যত্রও অভিবাসী জৈনদের দেখা মেলে।[৩৫]
জৈনরা প্রাচীন শ্রমণ অর্থাৎ, কৃচ্ছ্বসাধনার ধর্মকে আজও বহন করে নিয়ে চলেছেন। ভারতের অপরাপর ধর্মমত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তার প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষিত হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে বৃত্তিদানের একটি প্রাচীন প্রথা জৈনদের মধ্যে আজও বিদ্যমান; এবং ভারতে এই সম্প্রদায়ের সাক্ষরতার হার অত্যন্ত উচ্চ।[৩৬][৩৭] শুধু তাই নয়, জৈন গ্রন্থাগারগুলি দেশের প্রাচীনতম গ্রন্থাগারও বটে।[৩৮]
শিখধর্ম[৩৯] একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম।[৪০] খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে পাঞ্জাব অঞ্চলে এই ধর্ম প্রবর্তিত হয়। এই ধর্মের মূল ভিত্তি গুরু নানক দেব ও তার উত্তরসূরি দশ জন শিখ গুরুর (পবিত্র ধর্মগ্রন্থ গুরু গ্রন্থ সাহিব এঁদের মধ্যে দশম জন বলে বিবেচিত হন) ধর্মোপদেশ। শিখধর্ম বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম ধর্মীয় গোষ্ঠী।[৪১] শিখ ধর্মমত ও দর্শন গুরমত (অর্থাৎ, গুরুর উপদেশ) নামেও পরিচিত। শিখধর্ম কথাটির উৎস নিহিত রয়েছে শিখ শব্দটির মধ্যে; যেটি সংস্কৃত মূলশব্দ শিষ্য বা শিক্ষা থেকে আগত।[৪২][৪৩]
শিখধর্মের প্রধান বক্তব্য হল ওয়াহেগুরু অর্থাৎ সর্বব্যাপী ঈশ্বরের প্রতীক এক ওঙ্কার-এর প্রতিভূ ওয়াহেগুরু-তে বিশ্বাস। এই ধর্ম ঈশ্বরের নাম ও বাণীর নিয়মবদ্ধ ও ব্যক্তিগত ধ্যানের মাধ্যমে মোক্ষলাভের কথা বলে। শিখধর্মের একটি বিশিষ্টতা হল এই যে, এই ধর্মে ঈশ্বরের অবতারতত্ত্ব স্বীকৃত নয়। বরং শিখেরা মনে করেন ঈশ্বরই এই ব্রহ্মাণ্ডের স্বরূপ। শিখেরা দশ জন শিখ গুরুর উপদেশ ও গুরু গ্রন্থ সাহিব নামক পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অনুশাসন মেনে চলেন। উক্ত ধর্মগ্রন্থে দশ শিখ গুরুর ছয় জনের বাণী এবং নানান আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের বক্তব্য লিপিবদ্ধ রয়েছে। গুরু গোবিন্দ সিংহ এই গ্রন্থটিকে দশম গুরু বা খালসা পন্থের সর্বশেষ গুরু বলে ঘোষণা করে যান। পাঞ্জাবের ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে শিখধর্মের ঐতিহ্য ও শিক্ষা ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। শিখধর্মের অনুগামীরা শিখ (অর্থাৎ, শিষ্য) নামে পরিচিত। সারা বিশ্বে শিখেদের সংখ্যা ২ কোটি ৬০ লক্ষের কাছাকাছি। শিখরা মূলত পাঞ্জাব ও ভারতের অন্যান্য রাজ্যে বাস করেন। অধুনা পাকিস্তানেরপাঞ্জাব প্রদেশেও ভারত বিভাগের পূর্বে লক্ষাধিক শিখ বসবাস করতেন।[৪৪]
শাক্তধর্ম (সংস্কৃত: शाक्तं, Śāktaṃ; আক্ষরিক অর্থে শক্তিবাদ) হিন্দুধর্মের একটি শাখাসম্প্রদায়। হিন্দু দিব্য মাতৃকাশক্তি বা দেবী পরম ও সর্বোচ্চ ঈশ্বর – এই মতবাদের উপর ভিত্তি করেই শাক্তধর্মের উদ্ভব। এই ধর্মমতাবলম্বীদের শাক্ত (সংস্কৃত: शक्त, Śakta) নামে অভিহিত করা হয়। হিন্দুধর্মের প্রধান তিনটি বিভাগের অন্যতম শাক্তধর্ম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অন্য দুটি বিভাগ হল বৈষ্ণবধর্ম ও শৈবধর্ম।
শাক্তধর্মমতে, দেবী হলেন পরব্রহ্ম। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। অন্য সকল দেব ও দেবী তার রূপভেদমাত্র। দর্শন ও ধর্মানুশীলনের ক্ষেত্রে শাক্তধর্মের সঙ্গে শৈবধর্মের সাদৃশ্য লক্ষিত হয়। যদিও শাক্তরা কেবলমাত্র ব্রহ্মের শক্তিস্বরূপিণী নারীমূর্তিরই পূজা করে থাকেন। এই ধর্মে ব্রহ্মের পুরুষ রূপটি হল শিব। তবে তার স্থান শক্তির পরে এবং তার পূজা সাধারণত সহায়ক অনুষ্ঠান রূপে পালিত হয়ে থাকে।[৪৫]
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই ভারতে শক্তিপূজা প্রচলিত। ২২,০০০ বছরেরও আগে ভারতের প্যালিওলিথিক জনবসতিতে প্রথম দেবীপূজার প্রমাণ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে সিন্ধু সভ্যতার যুগে এই সংস্কৃতি আরও উন্নত রূপে দেখা দেয়। বৈদিক যুগে শক্তিবাদ পূর্বমর্যাদা হারালেও পুনরায় ধ্রুপদী সংস্কৃত যুগে তার পুনরুজ্জীবন ও বিস্তার ঘটে। তাই মনে করা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই “হিন্দু ঐতিহ্যের ইতিহাস নারী পুনর্জাগরণের ইতিহাস রূপে লক্ষিত হয়”।[৪৬]
ফারাবাহার অথবা ফেরোহার, জরথুস্ত্রদের প্রাথমিক প্রতিকের একটি
জোরোয়াষ্টার (গ্রিক Ζωροάστρης, Zōroastrēs) বা জরথ্রুস্ট্রা (এভেস্টান: Zaraθuštra), অথবা জরথ্রুস্ট (ফার্সি ভাষায়: زرتشت ), ছিলেন একজন প্রাচীন পারস্যীয় ধর্ম প্রচারক এবং জরথ্রুস্ট ধর্ম মতের প্রবর্তক। জরথ্রুস্ট এমন একটি ধর্ম, যা ছিল প্রাচীন ইরানের আকামেনিদ, পার্থিয়ান এবং সাসানিয়ান সাম্রাজ্যের[৪৭] জাতীয় ধর্ম; যা মূলত বর্তমানে আধুনিক ইরানের জরথ্রুস্ট সম্প্রদায় এবং ভারতের পার্সী সম্প্রদায় কর্তৃক পালিত হয়।[৪৮]
জরথুস্ত্র ধর্ম প্রাচীন আকামেনিদ সাম্রাজ্যের পূর্ব অঞ্চলে উৎপত্তি লাভ করে। দার্শনিক জেরোয়াষ্টার প্রাচীন ইরানি ঈশ্বর তত্ব সরল ভাবে ব্যাখ্যা করা শুরু করেন।[৪৯] তিনি ঈশ্বরের দুটি রূপের কথা বর্ণনা করে।[৫০][৫১] ধর্ম প্রচারক জরথ্রুস্ট সাধারনভাবে স্বীকৃত একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, কিন্তু তার সমসাময়িক কাল সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে তেমন কিছুই জানা যায়না। অনেক পন্ডিতের মতানুসারে তিনি আনুমানিক ১২০০ খ্রীস্ট পূর্বাব্দ সময়ের একজন মানুষ, যিনি প্রাচীন ধর্মমত প্রবর্তকদের অন্যতম, যদিও অন্য অনেকের মতে তিনি ১৮০০ খ্রীস্ট পুর্বাব্দ হতে ৬ষ্ঠ খ্রীস্ট পূর্বাব্দ মধ্যবর্তী সময়ের একজন ধর্ম প্রচারক ছিলেন।[৫২]
বাহাই ধর্ম বা বাহাই বিশ্বাস হচ্ছে বাহাউল্লাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একেশ্বরবাদী একটি ধর্ম বা বিশ্বাস। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পারস্যে (বর্তমানে ইরান) এই ধর্মের উৎপত্তি। মূলত মানবজাতির আত্মিক ঐক্য হচ্ছে এই ধর্মের মূল ভিত্তি।[৫৩] বিশ্বে বর্তমানে ২০০-এর বেশি দেশ ও অঞ্চলে এই ধর্মের আনুমানিক প্রায় ৬০ লক্ষ অনুসারী রয়েছে।[৫৪][৫৫]
বাহাই বিশ্বাস অনুসারে ধর্মীয় ইতিহাস স্বর্গীয় দূতদের ধারাবাহিক আগমণের মাধ্যমে ধাপে ধাপে সম্পন্ন হয়েছে। এইসব দূতদের প্রত্যেকে তাদের সময়কার মানুষদের সামর্থ্য ও সময় অনুসারে একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই সকল স্বর্গীয় দূতদের মাঝে আছেন ইব্রাহিম, গৌতম বুদ্ধটেমপ্লেট:তথ্যসুত্র প্রয়োজন, যীশু, মুহাম্মাদ ও অন্যান্যরা। সেই সাথে খুব সাম্প্রতিককালে বাব ও বাহাউল্লাহ। বাহাই ধর্ম মতে এসকল দূতগণ প্রত্যেকেই তাদের পরবর্তী দূত আসার ব্যাপারে, ও তাদেরকে অনুসরণ করতে বলে গেছেন। এবং বাহাউল্লার জীবন ও শিক্ষার মাধ্যমে দূতগণের এই ধারা ও পূববর্তী ধর্মগ্রন্থগুলোর অঙ্গীকার সম্পূর্ণ হয়েছে। মানবতা সমষ্টিগত বিবর্তনের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে ধরা হয়েছে, এবং বৈশ্বিক মাপকাঠিতে সার্বিকভাবে শান্তি, সুবিচার ও ঐক্য প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে বর্তমান সময়ের প্রয়োজনীয়তা।[৫৬]
‘বাহাই’ (উচ্চারণ: bəˈhaɪ)[৫৭] শব্দটি একটি বিশেষণ হিসেবে বাহাই বিশ্বাস বা ধর্মকে নির্দেশ করতে বা বাহাউল্লার অনুসারীদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এটি উদ্ভূত হয়েছে আরবি বাহা’ থেকে, যার অর্থ ‘মহিমা’ বা ‘উজ্জলদীপ্তি’।[৫৮] ধর্মটিকে নির্দেশ করতে পূর্বে বাহাইজম বা বাহাইবাদ পরিভাষাটি ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে ধর্মটির সঠিক নাম বাহাই বিশ্বাস।[৫৯][৬০]
ইয়াজিদি বা এজিদি হচ্ছে একটি কুর্দি নৃ-ধর্মীয় গোষ্ঠী, যাদের রীতিনীতির সাথে জরথুস্ত্র[৬১] ধর্মমতের সাদৃশ্য রয়েছে। ইয়াজিদিগণ প্রধানত উত্তর ইরাকের নিনেভেহ প্রদেশে বসবাস করে। আমেরিকা। জর্জিয়া এবং সিরিয়াইয় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইয়াজিদিদের সাক্ষাৎ মেলে। ১৯৯০ সালের দিকে ইয়াজিদিদের একটা অংশ ইউরোপে বিশেষ করে জার্মানীতে অভিবাসিত হয়।[৬২] ইয়াজিদিগণ বিশ্বাস করেন, ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি সাতটি পবিত্র জিনিস বা ফেরেশতার মাঝে এটাকে স্থাপন করেছেন। এই সাতজনের প্রধান হচ্ছেন মেলেক তাউস, ময়ুর ফেরেশতা।
মানি ধর্ম (ইংরেজি: Manichaeism, ফার্সি ভাষায় آیین مانی আইনে মানি; চীনা: 摩尼教; pinyin: Móní Jiào) হচ্ছে পৃথিবীতে প্রচলিত অন্যতম একটি ধর্ম যা সাসানিয়ান শাসনামলে ইরানী ধর্মপ্রচারক মানি (২১৬-২৭৬ খ্রিষ্টাব্দ) প্রচার করেন। মানি ধর্মে একটি দ্বৈত মহাবিশ্বের শিক্ষা বর্ণিত হয়েছে যেখানে ভালো (আলোকময় বিশ্ব) এবং মন্দ (অন্ধকারময় পৃথিবী) এর মধ্যে সঙ্ঘাতের কথা। এখানে বলা হয়েছে পৃথিবী একসময় অন্ধকারাছন্ন হয়ে যাবে এবং পূণরায় আলোর পথে ফিরে আসবে।
আরামীয়-সিরীয় ভাষাভাষী অঞ্চলে মানি ধর্ম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তৃতীয় থেকে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে এটি পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ধর্ম হিসেবে টিকে ছিলো। পূর্বে চীন এবং পশ্চিমে রোমান সাম্রাজ্য পর্যন্ত মানি ধর্মের প্রার্থনাগৃহ এবং ধর্মগ্রন্থ ছড়িয়ে পড়ে। পাশ্চাত্যের তুলনায় প্রাচ্যে মানি ধর্ম দীর্ঘদিন টিকে ছিলো। মানি ধর্মের মূল গ্রন্থসমূহ বিলীন হয়ে গেছে। এখন কিছু অনুবাদ এবং খন্ডিত পুঁথি পাওয়া যায়।
কনফুসীয় ধর্ম (সরলীকৃত চীনা: 儒学; প্রথাগত চীনা: 儒學; ফিনিন: Rúxué) চীনের একটি নৈতিক ও দার্শনিক বিশ্বাস ও ব্যবস্থা যা বিখ্যাত চৈনিক সাধু কনফুসিয়াসের শিক্ষার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। অর্থাৎ কনফুসিয়াস হলেন কনফুসীয় ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। এটি মূলত নৈতিকতা, সমাজ, রাজনীতি, দর্শন এবং ধর্মীয় বিশ্বাস ও চিন্তাধারাসমূহের সম্মিলনে সৃষ্ট একটি জটিল ব্যবস্থা যা একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতি ও ইতিহাসে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। অনেকের মতে এটি পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহের রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে স্বীকৃত হতে পারে। কারণ এই দেশগুলোতে এখন কনফুসীয় আদর্শের বাস্তবায়নের উপর বিশেষ জোর দেয়া হচ্ছে।[৬৩][৬৪] কনফুসিয় মতবাদ একটি নৈতিক বিশ্বাস এএটাকে ধর্ম বলা হবে কিনা এই নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মাঝে মতভেদ আছে।[৬৫] অনেক শিক্ষাবিদ কনফুসিয় মতবাদকে ধর্ম নয় বরং দর্শন হিসেবে মেনে নিয়েছেন।[৬৬] কনফুসিয় ধর্মের মূলকথা হচ্ছে মানবতাবাদ।[৬৭]
শিন্তো ধর্ম জাপান ভূমিতে প্রচলিত একটি ধর্ম।[৬৮] এটাকে আচার ধর্ম বলা হয়।[৬৯] বিভিন্ন ধর্মীয় প্রথা এবং আচারের মাধ্যমে এই ধর্ম পালিত হয় যা বর্তমান এবং অতীতের মাঝে যোগসূত্র স্থাপন করেছে।[৭০] জাপানী পুরাণ খ্রিস্টের জন্মের ৬৬০ বছর পূর্বে শিন্তো ধর্ম উৎপত্তি লাভ করে[৭১] খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে কোজিকি এবং নিহন শকি’র ঐতিহাসিক দলিলে শিন্তো আচারের কথা লিপিবদ্ধ আছে।
শিন্তো শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে দেবতার পথ। শিন্তো শব্দটি শিন্দো শব্দ থেকে এসেছে।[৭২] শিন্ডো শব্দটির মূল খুঁজে পাওয়া যায় চীনা শব্দ শেন্ডো থেকে।[৭৩] শিন্তো শব্দটি দুটি শব্দ নিয়ে গঠিত। শিন অর্থ ইংরেজি স্পিরিট বা আধ্যাত্বিক শক্তি এবং তো অর্থ পথ।[৭৩][৭৪]
শিন্তো জাপানের প্রধান ধর্ম। দেশটির ৮০% মানুষ বিভিন্ন ভাবে শিন্তো রীতিনীতি পালন করে কিন্তু জরীপে খুব অল্প সংখ্যক লোক নিজেদেরকে শিন্তো ধর্মানুসারী বলে পরিচয় দেয়।[৭৫]
তাওবাদ বা দাওবাদ চীনের একটি প্রাচীন ধর্মমত। প্রাচীন দার্শনিক কনফুসিয়াসের সমসাময়িক লাও জে এই তাও মতবাদ প্রচার করেন। তার মতবাদ কনফুসিয়াসের মতো জীবনবাদী ছিল না। তাকে আধ্যাত্মবাদী বা প্রকৃতিবাদী বলা চলে। চীনা জীবনধারায় এই মতবাদ এখনও বৌদ্ধ ও কনফুসীয়বাদের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আছে। তাও শব্দের অর্থ পথ।
জেন (আক্ষরিকভাবে “বসতিপূর্ণ ধ্যান”; জাপানীজ: 座禅 ; সরলীকৃত চীনা: 坐禅 ; ঐতিহ্যবাহী চাইনিজ: 坐禪 ; পিনয়িন: zuò chán ; ওয়েড-জাইলস: tso-ch’an , উচ্চারিত [tswô ʈʂʰǎn]) একটি ধ্যানমূলক শৃঙ্খলা যা সাধারণত জেন বৌদ্ধ ঐতিহ্যের প্রাথমিক অনুশীলন। জাজানের সুনির্দিষ্ট অর্থ এবং পদ্ধতি স্কুল থেকে স্কুলে পরিবর্তিত হয়, তবে সাধারণভাবে এটি অস্তিত্বের প্রকৃতির অন্তর্দৃষ্টি হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। জাপানি রেঞ্জজী স্কুলে, জাজেন সাধারণত কোয়ানদের অধ্যয়নের সাথে যুক্ত হয়। জাপানের সোটো স্কুল, অন্যদিকে, শুধুমাত্র খুব কমই জহেলে কোইস সংযোজন করে, এমন একটি পদ্ধতি পছন্দ করে যেখানে মনটির কোনও অবজেক্ট নেই, যা শিখানশ নামে পরিচিত।
হোয়া হাও (Hòa Hảo) হল একটি ধর্মীয় আন্দোলন যা হয় একটি সমন্বয়বাদী লোকধর্ম বা বৌদ্ধ ধর্মের একটি সম্প্রদায় হিসাবে বর্ণনা করা হয়। এটি 1939 সালে Huỳnh Phú Sổ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যাকে এর ভক্তরা একজন সাধু হিসাবে গণ্য করে।
‘ক্যাওদাই বা ক্যাও দাই মতবাদ (ভিয়েত্নামিজ: Đạo Cao Đài 道高臺, “মহা শক্তির পথ”; চীনা: 高台教; ফিনিন: Gāotáijiào) হচ্ছে একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম। ১৯২৬ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনামের তায় নিনহ শহরে এই ধর্মের আবির্ভাব হয়।[৭৬] এই ধর্মের পুরো নাম হচ্ছে দাই দাও তাম কাই ফো দো(“The Great Faith [for the] Third Universal Redemption”).[৭৬]ক্যাও দাই, আক্ষরিক অর্থে সর্বোচ্চ শাসক অথবা সর্বোচ্চ শক্তি[৭৬] হচ্ছেন উপাস্য দেবতা, যিনি এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, যাকে ক্যাও দাই অনুসারীরা উপাসনা করে। [৭৬][৭৭] ক্যাও দাই অনুসারীরা পৃথিবী স্রষ্টাকে সংক্ষেপে দুক ক্যাও দাই বলে যার পুরো নাম ক্যাও দাই তিয়েন অং দাই বো তাত মা হা তাত।[৭৮] পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত ক্যাও দাই উপাসনালয়গুলো দেখতে একই রকম। আকৃতি এবং রঙের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়।[৭৯]
অন্যান্য প্রাচীন ধর্ম
প্রাচীন মিশরীয় ধর্ম
প্রাচীন মিশরের ধর্মীয় বিশ্বাস মিশরীয় পুরাণে প্রতিফলিত হয়েছে। তিন হাজার বছরেরও কিছু বেশি সময় ধরে মিশরে পৌরানিক ধর্মীয় বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মিশর গ্রিক শাসকদের পদানত হলেও মিশরের পৌরানিক ধর্ম টিকে থাকে। পরবর্তীতে গ্রিক শাসকদের স্থানে রোমান শাসকগন এসে মিশর অধিকার করে নেন এবং সপ্তম শতক পর্যন্ত রোমানরাই মিশর শাসন করেন, এসময়ও পৌরানিক বিশ্বাস টিকে ছিল তবে গ্রিকো-রোমান ধর্মীয় বিশ্বাসের সংস্পর্ষে এসে কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়। অবশেষে ৬৪৬ সালে আরব মুসলমানদের হাতে মিশরের শাসনভার চলে গেলে পৌরানিক ধর্ম বিলুপ্তির পথ ধরে।
প্রাচীন মিশরের ইতিহাস সাধারণত প্রাচীন সাম্রাজ্য, মধ্য সাম্রাজ্য এবং নতুন সাম্রাজ্য – এই তিনটি কালে বিভক্ত করে আলোচনা করা হয়। মিশরীয় সভ্যতার তিনটি স্বর্ণযুগকে এই তিনটি কালের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। মিশরের সভ্যতা ও সংস্কৃতির পাশাপাশি তার পুরাণও বিবর্তিত হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই পৌরানিক চরিত্রগুলোকে যুগ ভেদে বিভিন্ন ভূমিকায় দেখা যায়।
প্রাচীন সাম্রাজ্যে মিশরীয় পুরাণের দেব-দেবীগন ছিলেন অনেকটা আঞ্চলিক, অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসনা চলত। সেই হিসেবে প্রাচীন সাম্রাজ্যের দেবকূলকে পাঁচটি প্রধান দলে ভাগ করা যায়।
হার্মোপোলিসের আটজন দেব-দেবী – নুনেত ও নু, আমুনেত ও আমুন, কুকেত ও কুক, হুহেত ও হুহ
এলিফ্যান্টাইনের খুম-সাতেত-আনুকেত ত্রয়ী
থিবিসের আমুন-মাত-খেনসু ত্রয়ী
মেম্ফিসের প’তাহ-সেকমেত-নেফেরতেম ত্রয়ী
সামারিতান
সামারিতান হচ্ছে বর্তমান ইসরাইলের উত্তর প্রদেশে বসবাসকারী সেমেটিক সম্প্রদায়ের একটি সাম্প্রদায়িক শাখাবিশেষ। এ মতবাদটির ইহুদিবাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিল রয়েছে। এটি বাইবেলের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা আধুনিক মতবাদ।
প্রাচীন গ্রিক ধর্ম
সবচেয়ে প্রাচীন ও শৈল্পিক ধর্ম হিসাবে ইউরোপে গ্রিক মিথ চালু ছিল । এ ধর্মের বিষয়বস্তু বর্তমানে রূপকথার গল্প হয়ে দাড়িয়েছে। বর্তমানে এর অনুসারী নেই বললেই চলে। গ্রিকদের লক্ষাধিক দেব-দেবী বিদ্যমান । তবে ধর্মটির প্রধান দেবতা হিসাবে জিউসকে ধরা হয়।
অ্যাজটেক ধর্ম একটি বিশ্বস্ত বাস্তবতা, জীবন এবং মৃত্যুর অস্তিত্বের জন্য আস্টেরিক / মেক্সিকোকে সাহায্য করে এমন একটি বিশ্বস্ত বিশ্বাস, রীতিনীতি এবং দেবদেবীর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। Aztecs একটি একাধিক-দেবতা মহাবিশ্বের বিশ্বাস, Aztec সমাজের বিভিন্ন দিকের উপর বিভিন্ন রাজত্ব উপর রাজত্ব করেন এবং Aztec নির্দিষ্ট চাহিদা সাড়া এবং বিভিন্ন দেবতাদের সঙ্গে, সঙ্গে। এই গঠন গভীরভাবে ব্যাপক মেসোআমেরিকান ঐতিহ্যের মধ্যে স্থায়ী ছিল, যেখানে মহাবিশ্ব, পৃথিবী এবং প্রকৃতির ধারণার উত্তর আমেরিকার দক্ষিণ তৃতীয় অঞ্চলে বেশিরভাগ প্রাগৈতিহাসিক সমাজে ভাগ করা হয়েছিল।
সাধারণভাবে, অ্যাজটেকরা পৃথিবীকে বিভক্ত করে বিরোধিতার একটি ধারাবাহিক বিভাজনের দ্বারা ভারসাম্য বজায় রেখেছিল, যেমন গরম ও ঠান্ডা, শুষ্ক ও ভিজা, দিন ও রাত, আলো এবং অন্ধকারের মত বাইনারি বিরোধী। মানুষের ভূমিকা যথাযথ অনুষ্ঠান এবং বলিদান অনুশীলন করে এই ভারসাম্য বজায় রাখা ছিল।আজটেকরা প্রকৃতি পূজা করতো। তাঁরা ভূমি, বৃষ্টি ও সূর্যকে দেবতা মনে করতো এবং দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে নরবলি দেয়া অপরিহার্য মনে করতো। তাঁরা বিশ্বাস করতো সূর্যকে প্রতিদিন সন্তুষ্ট করতে না পারলে পরের দিন আর সূর্য উঠবে না। সাধারণত বলি হিসেবে যুদ্ধবন্দী ও দাসদের ব্যবহার করা হতো এবং আজটেক যাজকরাই এ কাজ সম্পন্ন করতো।
জরাথুস্ট্রবাদ: বর্তমান দিনকার ইরানি জনগনের স্বদেশী নিজস্ব বিশ্বাস এবং চর্চার পৃষ্টপোষক। বর্তমান সময়ে জরাথুস্ট্রধর্ম একশিলা, সাসানিদ সময়ের সম্ভ্রান্ত ধর্মের ধারাবাহিক রূপ, প্রাচীনকালে এটার কতিপয় ভিন্নতা ছিল যা স্থান, গোত্র এবং ঐতিহাসিক কালের কিছুটা পার্থক্যের কারণে।
জুরবানিজম: হাখমানেশী কালের শেষে, জরাথুস্ট্রবাদ ও জুরবানিধর্ম (জুরবানি জরাথুস্ট্রধর্ম) হিসেবে প্রমাণিত হয়, একটি একত্বদ্বৈতবাদ যা সাসানিদ কালের শেষে অনুসরণ করা হত।
মান্দাইজম: একটি নস্টিক একত্ববাদ যা প্রায় খ্রিস্ট পূর্ব ১ম শতকে মান্দা ডি-হেয়ি – “জীবনের জ্ঞান ” হিসেবে পালিত হত। মান্দানি ভাবাদর্শ মূলত কতিপয় ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং মতবাদের চেয়ে তাদের সাধারণ ঐতিহ্যের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে।
ম্যানিকাইজম: ৩য় শতকের দ্বৈত নস্টিকধর্ম যা মান্দাইজম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। ম্যানিকানরা “মহান পিতা”য় বিশ্বাসী (Aramaic: Abbā dəRabbūṯā, Persian: pīd ī wuzurgīh) এবং তাকে সর্বোচ্চ দেবতা(আলোর) হিসেবে মান্য করে।
কিছু ধর্মবাদীরা ইসলাম ধর্ম এবং স্থানীয় জরাথুস্ট্র ধর্মের প্রথার ভিন্ন চিন্তাধারার সন্নিবেশ করেছেন।[২]
ইসলামি শাসনের প্রথম থেকেই দেখা যায় পারস্য অতীন্দ্রিবাদ এর বিকাশ, যা পারস্য-ইসলামি সূফী একেশ্বরবাদের বাস্তবিক দৃষ্টিভঙ্গি সাথে স্বত্বা, জীবন এবং ভালবাসার একটি ঐতিহ্যগত ব্যাখ্যা দেয়। আধ্যাত্মিক সত্যের (ঈশ্বর) উপলব্ধি এই বিশ্বাসের বিকাশ ঘটায়, যা স্বর্গীয় ভালবাসার ভিত্তি হিসেবে অতীন্দ্রিবাদ অনুশীলনের মাধ্যম জাগ্রত হয়।
কুররামাইটস্, ৯ম শতকের একটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আন্দোলন, যা ৮ম শতাব্দীতে সুনপাডের নীতির উপর ভিত্তি করে প্রচলিত, যারা শিয়া ইসলাম এবং জরাথুস্ট্রবাদের মধ্যে সমন্বয় প্রচেষ্টার প্রচার করে। বাবাক খোররামদিনের অধীনে, আন্দোলনটি ব্যক্তিগত সম্পদ পুনঃবিতরণ এবং ইসলামের বিলুপ্তি খুঁজে।
বিহাফারদিয়ানরা, ধর্মপ্রবক্তা বিহ্ফারের চারপাশে ৮ম শতাব্দীর একটি প্রীতি আন্দোলন। যদিও জরাথুস্ট্রবাদে আন্দোলনটির শিকড় বলে মনে করা হতো, বেহফরিদ এবং তার অনুসারীদের জরাথুস্ট্রবাদ ও ইসলাম উভয়ের ক্ষতির (জরাথুস্ট্রবাদীদের দ্বারা) অভিযোগে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
ইয়ার্সান, ইজান্দানিজমের একটি ধর্মীয় আদেশ, যা ১৬ শতকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। ইজান্দানিজম এক ঈশ্বরের সুস্পষ্ট বিশ্বাস হিসেবে একটি প্রাথমিক এবং পাঁচটি গৌণ অবতারের সাথে পবিত্র সাত গঠনের ঘোষণা দেয়।
জরাথুস্ট্রবাদ: বর্তমান দিনকার ইরানি জনগনের স্বদেশী নিজস্ব বিশ্বাস এবং চর্চার পৃষ্টপোষক। বর্তমান সময়ে জরাথুস্ট্রধর্ম একশিলা, সাসানিদ সময়ের সম্ভ্রান্ত ধর্মের ধারাবাহিক রূপ, প্রাচীনকালে এটার কতিপয় ভিন্নতা ছিল যা স্থান, গোত্র এবং ঐতিহাসিক কালের কিছুটা পার্থক্যের কারণে।
জুরবানিজম: হাখমানেশী কালের শেষে, জরাথুস্ট্রবাদ ও জুরবানিধর্ম (জুরবানি জরাথুস্ট্রধর্ম) হিসেবে প্রমাণিত হয়, একটি একত্বদ্বৈতবাদ যা সাসানিদ কালের শেষে অনুসরণ করা হত।
মান্দাইজম: একটি নস্টিক একত্ববাদ যা প্রায় খ্রিস্ট পূর্ব ১ম শতকে মান্দা ডি-হেয়ি – “জীবনের জ্ঞান ” হিসেবে পালিত হত। মান্দানি ভাবাদর্শ মূলত কতিপয় ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং মতবাদের চেয়ে তাদের সাধারণ ঐতিহ্যের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে।
ম্যানিকাইজম: ৩য় শতকের দ্বৈত নস্টিকধর্ম যা মান্দাইজম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। ম্যানিকানরা “মহান পিতা”য় বিশ্বাসী (Aramaic: Abbā dəRabbūṯā, Persian: pīd ī wuzurgīh) এবং তাকে সর্বোচ্চ দেবতা(আলোর) হিসেবে মান্য করে।
কিছু ধর্মবাদীরা ইসলাম ধর্ম এবং স্থানীয় জরাথুস্ট্র ধর্মের প্রথার ভিন্ন চিন্তাধারার সন্নিবেশ করেছেন।[২]
ইসলামি শাসনের প্রথম থেকেই দেখা যায় পারস্য অতীন্দ্রিবাদ এর বিকাশ, যা পারস্য-ইসলামি সূফী একেশ্বরবাদের বাস্তবিক দৃষ্টিভঙ্গি সাথে স্বত্বা, জীবন এবং ভালবাসার একটি ঐতিহ্যগত ব্যাখ্যা দেয়। আধ্যাত্মিক সত্যের (ঈশ্বর) উপলব্ধি এই বিশ্বাসের বিকাশ ঘটায়, যা স্বর্গীয় ভালবাসার ভিত্তি হিসেবে অতীন্দ্রিবাদ অনুশীলনের মাধ্যম জাগ্রত হয়।
কুররামাইটস্, ৯ম শতকের একটি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আন্দোলন, যা ৮ম শতাব্দীতে সুনপাডের নীতির উপর ভিত্তি করে প্রচলিত, যারা শিয়া ইসলাম এবং জরাথুস্ট্রবাদের মধ্যে সমন্বয় প্রচেষ্টার প্রচার করে। বাবাক খোররামদিনের অধীনে, আন্দোলনটি ব্যক্তিগত সম্পদ পুনঃবিতরণ এবং ইসলামের বিলুপ্তি খুঁজে।
বিহাফারদিয়ানরা, ধর্মপ্রবক্তা বিহ্ফারের চারপাশে ৮ম শতাব্দীর একটি প্রীতি আন্দোলন। যদিও জরাথুস্ট্রবাদে আন্দোলনটির শিকড় বলে মনে করা হতো, বেহফরিদ এবং তার অনুসারীদের জরাথুস্ট্রবাদ ও ইসলাম উভয়ের ক্ষতির (জরাথুস্ট্রবাদীদের দ্বারা) অভিযোগে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
ইয়ার্সান, ইজান্দানিজমের একটি ধর্মীয় আদেশ, যা ১৬ শতকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। ইজান্দানিজম এক ঈশ্বরের সুস্পষ্ট বিশ্বাস হিসেবে একটি প্রাথমিক এবং পাঁচটি গৌণ অবতারের সাথে পবিত্র সাত গঠনের ঘোষণা দেয়।
নবুয়ত (ইংরেজি: Prophecy, prophethood) হলো একটি প্রক্রিয়া যাতে এক বা একাধিক বার্তা একজন নবির কাছে প্রেরণ করে[১] এরপর অন্যান্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। এ ধরনের বার্তাতে সাধারণত স্বর্গীয় অনুপ্রেরণা, নির্দেশনা, অথবা আসন্ন ঘটনা সম্পর্কে (স্বর্গীয় জ্ঞানের তুলনা করে) বাণী অবতীর্ণ হয়। সমস্ত ইতিহাস জুড়ে, অতীন্দ্রিয় যোগাযোগ বা অদৃশ্য দর্শন নবুয়াতের একটি সাধারণ লক্ষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। [২] নবুয়তের দায়িত্বকে রিসালাত আর যারা এ দায়িত্ব পালন করে তাদের বলে নবি অথবা রাসুল।
নবুয়ত ইসলামের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং নবী ঐশীবাণী-সংবলিত ধর্মগ্রন্থ প্রাপ্ত হলে নবী একজন রাসূলের বা বার্তাবাহকের পদবি লাভ করেন যাকে আরবীতে রিসালাত বা বার্তাবাহকত্ব বলা হয়। ইসলাম ধর্মমত অনুসারে বিভিন্ন যুগে প্রত্যেক জাতির কাছে আল্লাহ তাআলা নবি ও রাসুল পাঠিয়েছেন।[৩]
কুরআনে বলা হয়েছে,
“আর রসূলগণকে (পাঠিয়েছি) সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, যাতে আল্লাহ্-র বিপক্ষে রাসূলদের পর মানুষের জন্য কোনো অজুহাত না থাকে। আর আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।”[কুরআন৪:১৬৫]
রাসুলদেরকে আল্লাহ তার বাণী প্রেরণ করেছেন। কুরআনে বলা হয়েছে,
“তিনিই তাঁর বান্দার প্রতি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ (সূরা) অবতীর্ণ করেন, যাতে তিনি তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনতে পারেন। আর নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু, পরম করুণাময়।”[কুরআন৫৭:৯]
ইসলাম অনুসারে সর্বশেষ নবী হলেন মুহাম্মাদ এবং তিনি মহাবিশ্ব ধ্বংস হওয়া অল্পকাল পূর্বে প্রেরিত হয়েছেন।
অন্যান্য ধর্মে
prophet
ইসলাম ধর্ম
prophet
নবুয়ত ইসলামের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং নবী ঐশীবাণী-সংবলিত ধর্মগ্রন্থ প্রাপ্ত হলে নবী একজন রাসূলের বা বার্তাবাহকের পদবি লাভ করেন যাকে আরবীতে রিসালাত বা বার্তাবাহকত্ব বলা হয়। ইসলাম ধর্মমত অনুসারে বিভিন্ন যুগে প্রত্যেক জাতির কাছে আল্লাহ তাআলা নবি ও রাসুল পাঠিয়েছেন।[৩]
কুরআনে বলা হয়েছে,
“আর রসূলগণকে (পাঠিয়েছি) সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, যাতে আল্লাহ্-র বিপক্ষে রাসূলদের পর মানুষের জন্য কোনো অজুহাত না থাকে। আর আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।”[কুরআন৪:১৬৫]
রাসুলদেরকে আল্লাহ তার বাণী প্রেরণ করেছেন। কুরআনে বলা হয়েছে,
“তিনিই তাঁর বান্দার প্রতি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ (সূরা) অবতীর্ণ করেন, যাতে তিনি তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনতে পারেন। আর নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু, পরম করুণাময়।”[কুরআন৫৭:৯]
ইসলাম অনুসারে সর্বশেষ নবী হলেন মুহাম্মাদ এবং তিনি মহাবিশ্ব ধ্বংস হওয়া অল্পকাল পূর্বে প্রেরিত হয়েছেন।
নবুয়ত ইসলামের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং নবী ঐশীবাণী-সংবলিত ধর্মগ্রন্থ প্রাপ্ত হলে নবী একজন রাসূলের বা বার্তাবাহকের পদবি লাভ করেন যাকে আরবীতে রিসালাত বা বার্তাবাহকত্ব বলা হয়। ইসলাম ধর্মমত অনুসারে বিভিন্ন যুগে প্রত্যেক জাতির কাছে আল্লাহ তাআলা নবি ও রাসুল পাঠিয়েছেন।[৩]
কুরআনে বলা হয়েছে,
“আর রসূলগণকে (পাঠিয়েছি) সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, যাতে আল্লাহ্-র বিপক্ষে রাসূলদের পর মানুষের জন্য কোনো অজুহাত না থাকে। আর আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।”[কুরআন৪:১৬৫]
রাসুলদেরকে আল্লাহ তার বাণী প্রেরণ করেছেন। কুরআনে বলা হয়েছে,
“তিনিই তাঁর বান্দার প্রতি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ (সূরা) অবতীর্ণ করেন, যাতে তিনি তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনতে পারেন। আর নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু, পরম করুণাময়।”[কুরআন৫৭:৯]
ইসলাম অনুসারে সর্বশেষ নবী হলেন মুহাম্মাদ এবং তিনি মহাবিশ্ব ধ্বংস হওয়া অল্পকাল পূর্বে প্রেরিত হয়েছেন।
নবুয়ত ইসলামের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং নবী ঐশীবাণী-সংবলিত ধর্মগ্রন্থ প্রাপ্ত হলে নবী একজন রাসূলের বা বার্তাবাহকের পদবি লাভ করেন যাকে আরবীতে রিসালাত বা বার্তাবাহকত্ব বলা হয়। ইসলাম ধর্মমত অনুসারে বিভিন্ন যুগে প্রত্যেক জাতির কাছে আল্লাহ তাআলা নবি ও রাসুল পাঠিয়েছেন।[৩]
কুরআনে বলা হয়েছে,
“আর রসূলগণকে (পাঠিয়েছি) সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, যাতে আল্লাহ্-র বিপক্ষে রাসূলদের পর মানুষের জন্য কোনো অজুহাত না থাকে। আর আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।”[কুরআন৪:১৬৫]
রাসুলদেরকে আল্লাহ তার বাণী প্রেরণ করেছেন। কুরআনে বলা হয়েছে,
“তিনিই তাঁর বান্দার প্রতি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ (সূরা) অবতীর্ণ করেন, যাতে তিনি তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনতে পারেন। আর নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু, পরম করুণাময়।”[কুরআন৫৭:৯]
ইসলাম অনুসারে সর্বশেষ নবী হলেন মুহাম্মাদ এবং তিনি মহাবিশ্ব ধ্বংস হওয়া অল্পকাল পূর্বে প্রেরিত হয়েছেন।
নবুয়ত ইসলামের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং নবী ঐশীবাণী-সংবলিত ধর্মগ্রন্থ প্রাপ্ত হলে নবী একজন রাসূলের বা বার্তাবাহকের পদবি লাভ করেন যাকে আরবীতে রিসালাত বা বার্তাবাহকত্ব বলা হয়। ইসলাম ধর্মমত অনুসারে বিভিন্ন যুগে প্রত্যেক জাতির কাছে আল্লাহ তাআলা নবি ও রাসুল পাঠিয়েছেন।[৩]
কুরআনে বলা হয়েছে,
“আর রসূলগণকে (পাঠিয়েছি) সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, যাতে আল্লাহ্-র বিপক্ষে রাসূলদের পর মানুষের জন্য কোনো অজুহাত না থাকে। আর আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।”[কুরআন৪:১৬৫]
রাসুলদেরকে আল্লাহ তার বাণী প্রেরণ করেছেন। কুরআনে বলা হয়েছে,
“তিনিই তাঁর বান্দার প্রতি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ (সূরা) অবতীর্ণ করেন, যাতে তিনি তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনতে পারেন। আর নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু, পরম করুণাময়।”[কুরআন৫৭:৯]
ইসলাম অনুসারে সর্বশেষ নবী হলেন মুহাম্মাদ এবং তিনি মহাবিশ্ব ধ্বংস হওয়া অল্পকাল পূর্বে প্রেরিত হয়েছেন।
প্রচলিত ইহুদি বোঝাপড়া মোতাবেক তোরাহ হল তানাখ নামে পরিচিত বৃহত্তর পাঠের অংশ। তানাখ ধর্মনিরপেক্ষ পণ্ডিতদের কাছে “হিব্রু বাইবেল” এবং খ্রীষ্টানদের কাছে “পুরাতন নিয়ম” নামে পরিচিত। তোরাহের সম্পূরক মৌখিক ঐতিহ্যকে মিদ্রাশ ও তালমুদের মতো পরবর্তী গ্রন্থ দ্বারা উপস্থাপন করা হয়। ইব্রীয় শব্দ তোরাহের অর্থ হতে পারে “শিক্ষা”, “আইন” বা “নির্দেশ”,[১৭] যদিও “তোরাহ” একটি সাধারণ শব্দ হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে যা মোশির মূল পাঁচটি বইয়ের সম্প্রসারণ বা বিস্তার করে এমন যেকোনো ইহুদি পাঠকে বোঝায়। ইহুদি আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের মর্মস্থলের প্রতিনিধিত্বকারী তোরাহ হল একটি পরিভাষা ও শিক্ষাবলির একটি সমুচ্চয় যা অন্তত সত্তরটি এবং সম্ভাব্য অসীম দিক ও ব্যাখ্যা সমেত স্পষ্টত স্ব-অবস্থানে রয়েছে।[১৮] ইহুদিধর্মের গ্রন্থ, ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধ খ্রীষ্টধর্ম ও ইসলাম-সহ পরবর্তী অব্রাহামীয় ধর্মগুলোকে দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত করেছে।[১৯][২০]হেলেনীয়বাদের মতো ইব্রীয়বাদওপ্রারম্ভিক খ্রীষ্টধর্মের একটি মূল পটভৌমিক উপাদান হিসাবে এর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে পশ্চিমা সভ্যতা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।[২১]
Judaism
ইহুদিধর্মের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় আন্দোলন রয়েছে যাদের বেশিরভাগই রব্বিনীয় ইহুদিধর্ম থেকে উদ্ভূত হয়েছে,[২২][২৩] যা মনে করে যে ঈশ্বর সীনয় পর্বতেমোশির কাছে তার আইন ও আদেশগুলো লিখিত এবং মৌখিক তোরাহ উভয় আকারে প্রকাশ করেছিলেন।[২৪] ঐতিহাসিকভাবে এই দাবির সমস্ত বা অংশকে বিভিন্ন গোষ্ঠীর দ্বারা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল, যেমন: দ্বিতীয় মন্দির আমলে সদ্দূকী ও হেলেনীয় ইহুদিধর্ম;[২২][২৫] প্রারম্ভিক ও বিলম্বিত মধ্যযুগে করাইট ইহুদি; এবং আধুনিক অনর্থোডক্স সম্প্রদায়ের বিভিন্ন অংশ।[২৬] ইহুদিধর্মের কিছু আধুনিক শাখা, যেমন: মানবতাবাদী ইহুদিধর্মকে ধর্মনিরপেক্ষ বা অনাস্তিক্যবাদী হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।[২৭][২৮] বর্তমানে সবচেয়ে বড় ইহুদিধর্মীয় আন্দোলন হল অর্থোডক্স ইহুদিধর্ম (হারেদি ইহুদিধর্ম ও আধুনিক অর্থোডক্স ইহুদিধর্ম), রক্ষণশীল ইহুদিধর্ম এবং সংস্কার ইহুদিধর্ম। এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে পার্থক্যের প্রধান উৎস হল হালাখা (ইহুদি আইন), রব্বিনীয় ঐতিহ্যের কর্তৃত্ব ও ইস্রায়েল রাষ্ট্রের তাৎপর্য।[৩][২৯][৩০] অর্থোডক্স ইহুদিধর্ম মনে করে যে তোরাহ ও হালাখা উৎপত্তিগতভাবে ঐশ্বরিক, চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয় এবং তাদের কঠোরভাবে অনুসরণ করা উচিত। রক্ষণশীল ও সংস্কার ইহুদিধর্ম আরও উদার। রক্ষণশীল ইহুদিধর্ম সাধারণত সংস্কার ইহুদিধর্মের চেয়ে ইহুদি ধর্মের বাধ্যবাধকতাগুলোর আরও ঐতিহ্যবাদী ব্যাখ্যাকে প্রচার করে। একটি গতানুগতিক সংস্কার অবস্থান হল যে হালখাকে সাধারণ নির্দেশিকাগুলোর একটি সমুচ্চয় হিসাবে দেখা উচিত নয় বরং বিধিনিষেধ ও বাধ্যবাধকতার একটি সমুচ্চয় রূপে দেখা উচিত যা পালন করা সকল ইহুদির জন্য বাধ্যতামূলক।[৩১] ঐতিহাসিকভাবে বিশেষ আদালত হালখা বলবৎ করত; আজও এই আদালতগুলো বিদ্যমান, কিন্তু ইহুদিধর্মের অনুশীলন বেশিরভাগই স্বেচ্ছাধীন।[৩২] ধর্মতাত্ত্বিক ও আইনি বিষয়ে কর্তৃত্ব কোনো একক ব্যক্তি বা সংস্থার উপর ন্যস্ত নয়, বরং পবিত্র গ্রন্থাবলি এবং সেগুলোর ব্যাখ্যাকারী রব্বি ও পণ্ডিতদের উপর ন্যস্ত।
জন্মগত ইহুদি ও ধর্মান্তরিত ইহুদিসহ ইহুদিরা একটি নৃধর্মীয় গোষ্ঠী।[৩৩] ২০১৯ সালের একটি পরিসংখ্যান অনুসারে বিশ্বে ইহুদি জনসংখ্যা ১৪.৭ মিলিয়ন বা মোট বৈশ্বিক জনসংখ্যার ০.২৫%।[৩৪][৩৫] ইহুদিদের প্রায় ৪৬.৯% ইসরায়েলে এবং ৩৮.৮% যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় বসবাস করে, বাকিদের অধিকাংশ বসবাস করে ইউরোপে এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বসবাস লাতিন আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া জুড়ে।[৩৬] পৃথিবীব্যাপী ১৪.৫ থেকে ১৭.৪ মিলিয়ন অনুসারী নিয়ে[৩৭] ইহুদিধর্ম বিশ্বের দশম বৃহত্তম ধর্ম।
মৌলিকভাবে হিব্রু বাইবেল বা তানাখ হল ঈশ্বরের সঙ্গে ইস্রায়েলীয়দের সম্পর্কের একটি বিবরণ তাদের প্রাচীনতম ইতিহাস থেকে দ্বিতীয় মন্দির নির্মাণ (আনু. ৫৩৫ খ্রীষ্টপূর্বাদ) পর্যন্ত। অব্রাহামকে প্রথম ইব্রীয় এবং ইহুদি জাতির পিতা হিসেবে সমাদৃত করা হয়। এক ঈশ্বরে তার বিশ্বাসের পুরষ্কার স্বরূপ তাঁকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে তার দ্বিতীয় পুত্র ইস্হাকইস্রায়েল দেশের (তখন কনান নামে পরিচিত) উত্তরাধিকারী হবে। পরবর্তীতে ইস্হাকের পুত্র যাকোবের বংশধরদের মিসরে ক্রীতদাসে পরিণত করা হয় এবং ঈশ্বর মোশিকে মিসর থেকে যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দেন। সীনয় পর্বতে তারা মোশির পাঁচটি পুস্তক তথা তোরাহ লাভ করে। এই বইগুলো নবীঈম ও কতূবীমের সঙ্গে একত্রে তানাখ নামে পরিচিত; অন্যদিকে মৌখিক তোরাহ মিশনা ও তালমুদকে নির্দেশ করে। অবশেষে ঈশ্বর তাদের ইস্রায়েলের দেশে নিয়ে যান যেখানে ৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শিলো শহরে ঈশ্বরীয় তাম্বু স্থাপন করা হয় শত্রুদের আক্রমণের বিরুদ্ধে জাতিকে সমাবিষ্ট করার জন্য। সময়ের সাথেসাথে ইহুদি জাতির আধ্যাত্মিক স্তর এমনভাবে হ্রাস পায় যে ঈশ্বর পলেষ্টীয়দের তাম্বুটি দখল করার অনুমতি দেন। ইস্রায়েলীয়রা তখন নবী শমূয়েলকে বলে যে তাদের একজন স্থায়ী রাজার দ্বারা শাসিত হওয়া দরকার এবং শমূয়েল শৌলকে তাদের রাজা হিসাবে নিযুক্ত করেন। যখন লোকেরা শৌলকে শমূয়েলের দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য চাপ দেয়, তখন ঈশ্বর শমূয়েলকে বলেন তার জায়গায় দায়ূদকে নিয়োগ দিতে।
রাজা দায়ূদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে তিনি নবী নাথনকে বলেন যে তিনি একটি স্থায়ী মন্দির তৈরি করতে ইচ্ছুক এবং তার কর্মের পুরষ্কার হিসাবে ঈশ্বর দায়ূদকে প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি তার পুত্র শলোমনকেপ্রথম মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেবেন এবং তার সন্তানেরা কখনও সিংহাসনচ্যুত হবে না।
রব্বিনীয় ঐতিহ্য মোতাবেক আইনের বিশদ বিবরণ ও ব্যাখ্যা, যাকে মৌখিক তোরাহ বা মৌখিক আইন বলা হয়, মূলত একটি অলিখিত ঐতিহ্য ছিল যার ভিত্তি ছিল ঈশ্বর সীনয় পর্বতে মোশিকে যা বলেছিলেন। যাই হোক, যেহেতু ইহুদিদের ওপর অত্যাচার বৃদ্ধি পায় এবং বিশদ বিবরণগুলো ভুলে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে, তাই এই মৌখিক আইনগুলো রব্বি যিহূদা হানাসি (রাজকুমার যিহূদা) মিশনাতে লিপিবদ্ধ করেন, যা প্রায় ২০০ খ্রীষ্টাব্দে সংশোধিত হয়।
তালমুদ ছিল মিশনা ও গমারা উভয়েরই সংকলন, পরবর্তী তিন শতাব্দীতে রব্বিনীয় ভাষ্যগুলি সংশোধন করা হয়েছিল। গমারার উৎপত্তি ইহুদি বৃত্তির দুটি প্রধান কেন্দ্র, ফিলিস্তিন ও বাবিল।[৩৮] তদনুসারে, বিশ্লেষণের দুটি সংস্থা তৈরি হয়েছিল এবং তালমুদের দুটি রচনা তৈরি হয়েছিল। পুরনো সংকলনটিকে যিরূশালেমীয় তালমুদ বলা হয়। এটি ফিলিস্তিনে ৪র্থ শতাব্দীতে কোনো এককালে সংকলিত হয়েছিল।[৩৮]বাবিলীয় তালমুদ পণ্ডিত ১ম রব্বিনা, ২য় রব্বিনা ও রব আশি কর্তৃক ৫০০ খ্রীষ্টাব্দে অধ্যয়নগৃহসমূহে আলোচনার মাধ্যমে সংকলিত হয়েছিল, যদিও পরবর্তীতে এর সম্পাদনা অব্যাহত ছিল।
সমালোচনামূলক পণ্ডিতদের মতে তোরাহতে অসঙ্গতিপূর্ণ পাঠ্যগুলিকে একত্রে এমনভাবে সম্পাদনা করা হয়েছে যা ভিন্ন ভিন্ন বিবরণের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করে।[৩৯][পৃষ্ঠা নম্বর প্রয়োজন][৪০][৪১] এদের অনেকে, যেমন অধ্যাপক মার্টিন রোজ ও জন ব্রাইট, অভিমত দেন যে প্রথম মন্দিরের আমলে ইস্রায়েলীয়রা বিশ্বাস করত যে প্রতিটি জাতির নিজস্ব ঈশ্বর আছে, কিন্তু তাদের ঈশ্বর অন্যান্য ঈশ্বরদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।[৪২][পৃষ্ঠা নম্বর প্রয়োজন][৪৩][পৃষ্ঠা নম্বর প্রয়োজন] কারও কারও মতে কট্টর একেশ্বরবাদ বাবিলীয় নির্বাসনের সময় তৈরি হয়েছে, সম্ভবত জরথুস্ত্রীয় দ্বৈতবাদের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ।[৪৪] এই দৃষ্টিকোণ থেকে শুধুমাত্র হেলেনীয় যুগেই বেশিরভাগ ইহুদিরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে তাদের ঈশ্বরই একমাত্র ঈশ্বর এবং ইহুদিধর্মের সঙ্গে অভিন্ন ও স্পষ্টভাবে আবদ্ধ একটি ইহুদি জাতির ধারণা গড়ে উঠেছিল।[৪৫] জন ডে যুক্তি দেন যে, বাইবেলের ইয়াহওয়েহ, এল, আশেরা ও বালদেবের উৎপত্তি পূর্ববর্তী কনানীয় ধর্মে নিহিত থাকতে পারে, যা গ্রীক দেবমণ্ডলীর মতো দেবতাদের একটি মণ্ডলীর উপর কেন্দ্রীভূত ছিল।[৪৬]
সংজ্ঞায়ক বৈশিষ্ট্য ও বিশ্বাসমালা
মূলনীতি
বিশ্বাসের ১৩টি মূলনীতি:
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, সৃষ্টিকর্তা—ধন্য তার নাম—সমস্ত সৃষ্টির স্রষ্টা ও শাসক; তিনি একাই মহাবিশ্বের সবকিছু তৈরি করেছিলেন, করেন ও করবেন।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, সৃষ্টিকর্তা—ধন্য তার নাম—এক; এবং তার একত্বের মতো কোনোরূপ একত্ব নেই; এবং শুধু তিনিই আমাদের ঈশ্বর, যিনি ছিলেন, আছেন ও থাকবেন৷
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, সৃষ্টিকর্তা—ধন্য তার নাম—নিরাকার; এবং তিনি সমস্ত বস্তুগত বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত; এবং তার সঙ্গে কোনোকিছুর তুলনা হতে পারে না।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, সৃষ্টিকর্তা—ধন্য তার নাম—প্রথম ও শেষ।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, সৃষ্টিকর্তা—ধন্য তার নাম—একাই উপাসনার যোগ্য, এবং অন্য কোনো সত্তা আমাদের উপাসনার যোগ্য নয়।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আমাদের রব্বিমোশির (মুসা)—তার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক—নবুয়ত সত্য ছিল; এবং তিনি ছিলেন তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী নবীদের মধ্যে প্রধান।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, সমগ্র তোরাহ যা এখন আমাদের কাছে আছে তা অবিকৃত ও একই রয়েছে যেভাবে আমাদের রব্বি মোশির—তার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক—প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, এই তোরাহের কোনো পরিবর্তন হবে না, এবং সৃষ্টিকর্তা—ধন্য তার নাম—অন্য কোনো তোরাহ [বা নিয়ম] প্রদান করবেন না।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, সৃষ্টিকর্তা—ধন্য তার নাম—মানুষের সকল কাজ ও চিন্তাভাবনা সম্বন্ধে অবগত, যেমন বলা হয়েছে: “তিনিই দান করেন তাদের চিন্তাশক্তি, লক্ষ্য করেন তাদের সকল কার্যকলাপ (গীতসংহিতা ৩৩:১৫)।”
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, সৃষ্টিকর্তা—ধন্য তার নাম—যারা তার আদেশ পালন করে তাদের পুরস্কৃত করেন এবং যারা আদেশ লঙ্ঘন করে তাদের শাস্তি দেন।
আমি মশীহের আগমনে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি; এবং যদিও তার আসতে দেরি হতে পারে, আমি প্রতিদিন তার আগমনের প্রতীক্ষা করি।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, এক সময় মৃতদের পুনরুত্থান ঘটবে যখন সেই সময়কাল সৃষ্টিকর্তাকে—ধন্য তার নাম—খুশি করবে, এবং তার স্মরণ চিরকালের জন্য উন্নীত হবে।
জ্ঞানের ইহজাগতিকীকরণ বা ইংরেজি নাম (Universalization of knowledge) বলতে জ্ঞানকে এর ঐশ্বরিক উৎস থেকে পৃথক করার প্রক্রিয়াকে বোঝায়। প্রক্রিয়াটি আধুনিক যুগে জ্ঞানের ধারণাটি বোঝার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনকে ইঙ্গিত করে। এটি জ্ঞানের আধ্যাত্মিক-পারমার্থিক ভিত্তি রয়েছে এবং জ্ঞান পবিত্রের সাথে সম্পর্কিত এমন ধারণাকে প্রত্যাখান করে। ফরাসি দার্শনিক রনে গেনো বহু আগেই আধুনিক সভ্যতায় ‘জ্ঞানের সর্বনিম্ন স্তরে সীমাবদ্ধ’ হওয়ার বিষয়ে কথা বলেছিলেন। তার মাধ্যমে শুরু হওয়া ঐতিহ্যবাদী ধারার লেখকদের মধ্যে যদিও এটি একটি পুনরাবৃত্তিমূলক বিষয়, জ্ঞানের ইহজাগতিকীকরণের এই প্রক্রিয়াটি উল্লেখযোগ্যভাবে ইসলামী দার্শনিকসাইয়্যেদ হোসাইন নাসর ১৯৮১ সালে প্রদত্ত তার গিফোর্ড বক্তৃতামালায় সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা ও ধারণাবদ্ধ করেন যা পরবর্তীতে নলেজ এন্ড দ্য স্যাক্রেড নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
নাসরের মতে জ্ঞানের ইহজাগতিকীকরণ ইহলৌকিকতাবাদের ধারণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক। তিনি ধারণাটিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এমন এক মতবাদ হিসেবে ‘যা কেবলই মানবীয় উৎস থেকে উৎসারিত এবং যা ঊর্ধ্ব জগতের সাথে সম্পর্কহীন’। এটি মানুষ ও স্রষ্টার মাঝে এক ধরনের ‘সত্তাগত বিচ্ছেদের’ ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত।[১] নাসরের যুক্তি অনুসারে এটি একটি ‘অশুভ শক্তি’ যা বিজ্ঞান ও জ্ঞানকে কেবলমাত্র ইহলৌকিক জগতের সাথে সম্পর্কযুক্ত করে। এই প্রক্রিয়ায় একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে বিজ্ঞান জ্ঞান থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং প্রথাগত জ্ঞানের ক্ষেত্রে এদের মধ্যকার সমজাতীয় চরিত্রটি হারায়।[২] জ্ঞানের ইহজাগতিকীকরণের মূল কথা হলো আধুনিক সভ্যতা জ্ঞানের বহির্জাগতিক উৎসের সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে এবং জ্ঞানকে শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাঝে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে।[৩]
[নাসরের] মূল যুক্তি হলো যে প্রকৃত জ্ঞান তার মৌলিক গুনাবলীর কারণেই গভীরভাবে পবিত্রের ধারণার সাথে সম্পর্কিত। তার মতানুসারে, এটি হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, তাওবাদ, জরথ্রুস্টবাদ, ইহুদিধর্ম, ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম সহ প্রত্যেক সনাতন ধর্মের মৌলিক শিক্ষা। রেনেসাঁ পরবর্তী আধুনিক জগতেই কেবল জ্ঞান ও পবিত্রের মধ্যকার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।[৪]
নাসরের বিশ্লেষণে ‘জানা’ ও ‘জ্ঞান’ শব্দদুটি তাদের একমাত্রিক চরিত্র হারায়। তার মতে, পরীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ ও যৌক্তিক বিশ্লেষণ জ্ঞানের এক প্রাথমিক পর্যায় মাত্র। এই প্রক্রিয়াগুলি জ্ঞানের সর্বোচ্চ রূপ ‘সামগ্রিক জ্ঞান’ বা ‘আল মারিফায়’ পৌঁছার সিঁড়ি হিসেবে কাজ করে। একইভাবে, ‘জানা’ বলতে প্রণালীবদ্ধভাবে যুক্তির প্রয়োগ থেকে শুরু করে ধীশক্তি দ্বারা অন্তরের অনুধাবনকে বোঝায়।[৫] তার মতে, প্রকৃতিগতভাবেই জ্ঞান সত্তার সাথে সম্পর্কিত এবং পবিত্রতার ধারণার সাথে জড়িত। জ্ঞান এমন এক মানবীয় গুণ যা সহজাতভাবেই মানুষ অর্জন করতে পারে। জানা বলতে তাই সেই পরম সত্তাকে জানা বোঝায় যিনি সকল জ্ঞান ও চেতনার উৎস।[৬]মধ্যযুগ পরবর্তী লোকায়তকরণ প্রক্রিয়া এবং মানবতাবাদ শেষ পর্যন্ত সত্তার সাথে জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার সাথে পবিত্রের সংযোগ ছিন্ন করেছে।[৭]
পরম সত্তার জ্ঞান বলতে উচ্চতর আধ্যাত্মিক স্তরের অস্তিত্বের জ্ঞান, প্রকৃতিতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর মাঝে আন্তঃসম্পর্ক, তাদের মধ্যকার বিভিন্ন উপাদানের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং সর্বোপরি পরম সত্তার থেকে সবকিছুর উৎপত্তি এমন জ্ঞানকে বোঝায়। যাইহোক, নাসরের মতে পরম সত্তা সম্পর্কে ধীশক্তির এই সচেতনতা এর সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম হিসেবে এর ব্যবহার না থাকার কারণে হারিয়ে গেছে। নাসরের পুনর্গঠনে এই ধরনের বিস্মৃতি মানুষের সমগ্র চিন্তার গতিপথকে সংজ্ঞায়িত করে যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশকে জ্ঞানের চলমান ইহজাগতিকীকরণ প্রক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করা যায়।[৮]
Universalization of knowledge
নাসরের মতে, আধুনিক বিজ্ঞান বিভিন্ন স্তরের বাস্তবতাকে নিছক ‘মনো-দৈহিক স্তরে’ সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। পবিত্র দর্শন বিবর্জিত এই বিজ্ঞান একারণে শুধুমাত্র বস্তুগত জগতের পরিবর্তন নিয়ে উদ্বিগ্ন। আধুনিক বিজ্ঞান সত্তার শ্রেণীবিন্যাসের ধারণা পরিত্যাগ করার কারণে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও আবিষ্কার উচ্চতর বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত সত্যের মূল্যায়ন করতে অক্ষম। নাসরের কথায় আধুনিক বিজ্ঞান একটি ‘অসম্পূর্ণ’ বা ‘অগভীর বিজ্ঞান’ যা কেবলমাত্র বাস্তবতার কিছু অংশ নিয়ে কথা বলে এবং অন্য অংশগুলোকে অস্বীকার করে।[৯] এটি জ্ঞান অর্জনকারী সত্তা ও জ্ঞাত বস্তূর মাঝে পার্থক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। নাসর যুক্তি দেখিয়েছেন যে আধুনিক বিজ্ঞান একটি বিশুদ্ধ পরিমাণগত পদ্ধতি গ্রহণ করে জ্ঞান ও সত্যের অন্বেষণে ধীশক্তির ভূমিকাকে অস্বীকার করার কারণে এর প্রতীকী চেতনা এবং অভিজ্ঞতা ও যুক্তিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে।[১০][১১] নাসরের যুক্তিতে বাস্তবতার কাঠামো অপরিবর্তনশীল। যা পরিবর্তিত হয় তা হচ্ছে সেই বাস্তবতা সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও উপলব্ধি। কোনো ধরনের স্থায়ীত্ববোধ না থাকায় আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শন বাস্তবতাকে একটি অস্থায়ী জাগতিক প্রক্রিয়ায় পরিণত করেছে। জেন স্মিথের বিশ্লেষণে, এই ঘটনাটিকেই নাসর আধুনিক জগতে জ্ঞানের ইহজাগতিকীকরণ ও পবিত্রতাবোধ হারানোর সময় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।[১২]
ঐতিহাসিক বিকাশ
Universalization of knowledge
‘আমি চিন্তা করি, তাই আমার অস্তিত্ব আছে’ র্যনে দেকার্তের বিখ্যাত উচ্চারণের এই ‘আমি’ নাসরের মতে ঐশ্বরিক ‘আমি’ নন যিনি দেকার্তের প্রায় সাত শতাব্দী আগে মানসুর আল-হাল্লাজের মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমিই সত্য’ (আনাল হাক্ব)।[১৩]
জ্ঞানের ইহজাগতিকীকরণ প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেন হেগেল যিনি ‘জ্ঞানের পুরো প্রক্রিয়াটিকে পরিবর্তন ও হয়ে ওঠার থেকে অবিচ্ছেদ্য এক ধরনের দ্বান্দ্বিকতায় পরিণত করেন।[১৪][১৫]
Universalization of knowledge
জ্ঞানের ইহজাগতিকীকরণের প্রক্রিয়াটি প্রাচীন গ্রীকদের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল।[১৬]গ্রীক দার্শনিক ধারার যুক্তিবাদী ও সংশয়বাদীরা জ্ঞানকে যুক্তির শৃঙ্খলে সীমাবদ্ধ করে একে নেহায়েত এক মানসিক কসরতে পরিণত করার মাধ্যমে জ্ঞানের ইহজাগতিকীকরণ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।[৮] যুক্তিবৃত্তির দ্বারা ধীশক্তিকে এবং ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের দ্বারা অন্তরের আলোক উদ্ভাসনকে প্রতিস্থাপিত করার কারণে গ্রীক দার্শনিকদের জ্ঞানের ইহজাগতিকীকরণ প্রক্রিয়ার অগ্রদূত বলা যেতে পারে।[১৭] ইহজাগতিকীকরণ প্রক্রিয়ার অন্যান্য বড় ধাপগুলির মধ্যে রয়েছে রেনেসাঁ যুগের দার্শনিক ব্যবস্থার উদ্ভব ও বিকাশ যা প্রকৃতিকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ রূপে উপস্থাপন করে। তবে এই প্রক্রিয়া চরম অবস্থায় পৌঁছে র্যনে দেকার্তের চিন্তায়, যিনি ‘ব্যক্তিগত সত্তাকে বাস্তবতার কেন্দ্র ও সকল জ্ঞানের মানদণ্ড হিসেবে নির্ধারণ করেন’।[১৮] ফলস্বরুপ, দূরতম ছায়াপথে জ্ঞানের প্রতিচ্ছায়া পড়লেও তার মূল শেষ পর্যন্ত দেকার্তের কোগিটোতেই প্রোথিত থাকে।[১৯]
নাসর আধুনিক জগতে জ্ঞানের ইহজাগতিকীকরণ এবং এর ফলস্বরুপ মানব বুদ্ধিমত্তার অবক্ষয়ের চিত্র বিশ্লেষণ করেছেন। তার মতে, সংকটের মূল প্রাচীন গ্রীসের যুক্তিবাদী ও সন্দেহবাদীদের পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে রেনেসাঁকেন্দ্রিক মানবতাবাদ এবং আলোকায়নের যুগে বিকশিত যুক্তিবাদকে তিনি ইহজাগতিকীকরণ প্রক্রিয়ায় নিকট ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলে মনে করেন। রেনেসাঁকেন্দ্রিক মানবতাবাদ জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু স্রষ্টা থেকে মানুষে স্থানান্তর করে এবং মহাবিশ্বকে একটা পার্থিব ব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করে। যুক্তিবাদ অন্যদিকে মানব জ্ঞানকে কেবলই যুক্তি দ্বারা প্রতিস্থাপন করে। নাসরের মতে, দেকার্তের পর জ্ঞানতত্ত্ব সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পথ অবলম্বন করেছে যা অনুধাবন ও প্রত্যাদেশকেন্দ্রিক চিরায়ত জ্ঞানকে যুক্তিপূজা দ্বারা প্রতিস্থাপন করেছে। অধিবিদ্যাকে পরিত্যাগ করার কারণে যুক্তিবাদ এভাবে অভিজ্ঞতাবাদের দুয়ার প্রশস্ত করে। অভিজ্ঞতাবাদ পরিণামে অস্তিত্ববাদ ও বিনির্মাণবাদ সহ নানা ধরণের অযৌক্তিক মতবাদের জন্ম দেয়। আধুনিক ইতিহাস তাই জ্ঞানের ইহজাগতিকীকরণ ও অবক্ষয়ের দ্বারা সংজ্ঞায়িত এক ইতিহাস যা মানবতাকে তার বুদ্ধিমত্তা থেকে বঞ্চিত করেছে। অন্যদিকে, মহাবিশ্বকে বঞ্চিত করেছে অর্থ ও সৌন্দর্য থেকে।[৪]
নব্য-কনফুসীয় দার্শনিক লিউ শু-শেইন লিখেছেনঃ
আধুনিক ইউরোপীয় দর্শন সম্বন্ধে নাসরের সমালোচনা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে দেকার্ত যে সত্তার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন তা পরমাত্মা বা ঐশ্বরিক কোনো সত্তা নন। তিনি বরং তার ভ্রমাত্মক ব্যক্তিসত্তার প্রতি নির্দেশ করছিলেন যেটি তার চেতনা ও অভিজ্ঞতাকে সকল জ্ঞানতত্ত্ব, তত্ত্ববিদ্যা ও নিশ্চয়তার উৎস হিসেবে গ্রহণ করে। হিউমের সন্দেহবাদী দর্শনের পর কান্ট এক ধরণের অজ্ঞেয়বাদ শিক্ষা দেন বৈশিষ্টগতভাবে যা ধীশক্তির দ্বারা বিষয়বস্তুর অপরিহার্য উপাদানকে উপলব্ধি করার সম্ভাবনা খর্ব করে। পরিস্থিতির আরো অবনতি হয় হেগেলীয় ও মার্কসীয় দ্বন্দবাদে যা বাহ্য অস্থায়ী রূপের আড়ালে নিত্য বলে কিছু থাকতে পারে এমন ধারণাকে পুরোপুরী অস্বীকার করে। স্থায়িত্ববোধের এই অভাব মূলধারার পশ্চিমা দর্শনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। বিশ্লেষণাত্মক দর্শন এবং পরবর্তীতে বিকশিত অযৌক্তিক দর্শনসমূহ থেকে জ্ঞানের পবিত্র গুণটি তাই সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়।[২০]
জ্ঞানের ইহজাগতিকীকরণের ঐতিহাসিক কারণগুলির ‘শক্তিশালী এক উপকরণ’ হলো বিবর্তনবাদী তত্ত্ব[২১] যা নাসরের ভাষায় ‘একমাত্রিক জগতে অনুভূমিক, বস্তুগত কারণগুলিকে উচ্চতর বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত অস্তিত্ত্বের উল্লম্ব মাত্রাগুলির স্থলে প্রতিস্থাপন করার এক মরিয়া প্রচেষ্টা মাত্র’।[২২] ডেভিড বারেলের কথায়, ‘বিশ্বাসঘাতকতার শিকড়’ হয়তো ‘দেকার্তের অপর প্রান্তে’ মধ্যযুগীয় দর্শনেও পাওয়া যাবে যার মধ্যে টমাস একুইনাস, বোনাভেঞ্চার ও ডান্স স্কটাসের মতো ধর্মতত্ত্ববীদ ও দার্শনিকদের চিন্তাধারা অন্তর্ভুক্ত। নাসরের মতে, এসব সংশ্লেষণের চরম যুক্তিবাদী চরিত্র আধিবিদ্যক ব্যবস্থা সম্পর্কে অন্তর্জ্ঞানকে নৈয়ায়িক শ্রেণীর মাঝে অন্তর্ভুক্ত করেছে যা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দিককে প্রকাশ করার পরিবর্তে কেবল যুক্তিবাদীতাকেই প্রকাশ করে।[২৩]
প্রভাব
Universalization of knowledge
পাশ্চাত্যের ‘পতনের’ ঘটনাটি ইহজাগতিক জ্ঞানের উৎস হিসেবে প্রাচীন গ্রীসের যুক্তিবাদীদের বিশেষত এরিস্টটলীয় ধারার দর্শন গ্রহণ করার সময় থেকে চিহ্নিত করা হয়।[২৪]
জ্ঞানের ইহজাগতিকীকরণের এই প্রক্রিয়াটি আধুনিক বিশ্বের জন্ম দিয়েছে যা বৈশিষ্টগতভাবে বস্তুজগৎ-কেন্দ্রিক। এই মতবাদ যুক্তি, চিন্তা, ভাষা ও ধর্মকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে বলে মনে করা হয়। মানব প্রকৃতিও এর প্রভাবের বাইরে নয়। আধুনিক বিশ্ব যেহেতু পরম সত্তার সাথে সংযোগহীন, আভ্যন্তরীণ উপাদানের থেকে বাহ্যিক রূপের উপর গুরুত্ত্ব প্রদান সেহেতু জ্ঞান উৎপাদনের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। আধুনিক বিশ্বে পবিত্রতার ধারণা লোপ পাওয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বস্তুবাদের উত্থান। এই ধারণা অনুসারে পদার্থ এবং এর থেকে উদ্ভূত বিষয়সমূহ ছাড়া আর সবই অনস্তিত্ত্বশীল।[২৫] জ্ঞানকে যখন তার ঐশ্বরিক উৎস থেকে আলাদা করা হয়, তখন এটি তার অন্তর্নিহিত কিংবা রূপকাশ্রিত অর্থ উভয়ই হারায়। এটি তখন সেই সব বিষয়ের উপর আলোকপাত করে যা গণনা ও পরিমাপ করা যায় কিংবা যে বিষয় সম্পর্কে আগে থেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়। এই প্রক্রিয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হলো ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাবাদের উদ্ভব। এটিকে এমন এক মতবাদ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে যা ব্যক্তির থেকে অন্য কোনো কিছুকেই বড় বলে স্বীকার করে না এবং যা সভ্যতাকে শুধুমাত্র মানবীয় উপাদান দিয়ে বিচার করতে চায়। ব্যক্তির চেয়ে বড় কোনো কর্তৃত্ব স্বীকার না করায় ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাবাদ প্রকৃতিবাদ ও খাঁটি যুক্তিবাদের জন্ম দেয় এবং প্রকৃত সত্যের দিশা দেবে এমন কারো অনুপস্থিতিতে কালক্রমে এটি সবকিছুকে আপেক্ষিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করার প্রয়াস পায়।[২৬] এই প্রক্রিয়ার মধ্যে তৈরি হওয়া জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তির প্রয়োগে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে যা আধুনিক বিশ্বে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ। ঐশ্বরিক বিষয়ে অজ্ঞ বহুধা বিভক্ত এই বিজ্ঞান মানুষের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ আধ্যাত্মিক আবহকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংশ করেছে।[১১][২৭]
মূল্যায়ন
Universalization of knowledge
লিউ শু-শেইনের মতে জ্ঞানের ইহজাগতিকীকরণের এই প্রক্রিয়াটি ততটা খারাপ নয় যেমনটা নাসর ইঙ্গিত দিয়েছেন। পক্ষান্তরে, তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ নির্ভর বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে ইহজাগতিকীকরণের ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে যেহেতু নিশ্চয়তার সন্ধানকে আর উদ্দেশ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে না।[২৮]ডেভিড হার্ভের মতে, ইউরোপীয় আলোকায়নের যুগে বিকশিত চিন্তা মানুষকে তাদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য জ্ঞান ও সামাজিক সংগঠনের লোকায়তকরণ প্রত্যাশা করেছিল। ব্রিঙ্কম্যান স্বাধীনভাবে জ্ঞানের ইহজাগতিকীকরণের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে যুক্তি দেখান যে “যদি জানা একটি মানবীয় কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে, তবে এটি সবসময়ই কোনো না কোনো সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক পরিস্থিতির অনুগামী হবে।” অন্যদিকে, ডেভিড বারেল যুক্তি দেখিয়েছেন যে, উত্তরাধুনিক পৃথিবীতে পূর্বের যে কোনো সময়ের থেকে রেনেসাঁ দর্শন সম্পর্কে নাসরের সমালোচনা এখন বেশি গ্রহণযোগ্য। যারা এমন যুক্তি দেখায় যে, ‘দেকার্তের আদর্শ অনুসরণ করে যদি জ্ঞান অর্জন সম্ভব না হয়, তবে প্রকৃত অর্থেই জ্ঞানলাভ অসম্ভব’, বারেলের মতে তারা তাদের আধুনিক মতবাদই কেবল বয়ে বেরাচ্ছেন।[২৩]
জৈন” শব্দটি এসেছে সংস্কৃত “জিন” (অর্থাৎ, জয়ী) শব্দটি থেকে। যে মানুষ আসক্তি, আকাঙ্ক্ষা, ক্রোধ, অহংকার, লোভ ইত্যাদি আন্তরিক আবেগগুলিকে জয় করেছেন এবং সেই জয়ের মাধ্যমে পবিত্র অনন্ত জ্ঞান (কেবল জ্ঞান) লাভ করেছেন, তাঁকেই “জিন” বলা হয়। “জিন”দের আচরিত ও প্রচারিত পথের অনুগামীদের বলে “জৈন”
“জৈন” শব্দটি এসেছে সংস্কৃত “জিন” (অর্থাৎ, জয়ী) শব্দটি থেকে। যে মানুষ আসক্তি, আকাঙ্ক্ষা, ক্রোধ, অহংকার, লোভ ইত্যাদি আন্তরিক আবেগগুলিকে জয় করেছেন এবং সেই জয়ের মাধ্যমে পবিত্র অনন্ত জ্ঞান (কেবল জ্ঞান) লাভ করেছেন, তাঁকেই “জিন” বলা হয়। “জিন”দের আচরিত ও প্রচারিত পথের অনুগামীদের বলে “জৈন”।[৩][৪][৫]
Jainism
জৈনধর্ম শ্রমণ প্রথা থেকে উদ্গত ধর্মমত। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্মমতগুলির অন্যতম।[৬] জৈনরা তাঁদের ইতিহাসে চব্বিশজন তীর্থঙ্করের কথা উল্লেখ করেন। এঁদের শিক্ষাই জৈনধর্মের মূল ভিত্তি। প্রথম তীর্থঙ্করের নাম ঋষভ এবং সর্বশেষ তীর্থঙ্করের নাম মহাবীর।।[৭][৮][৯][১০][১১]
ভারতে জৈন ধর্মবলম্বীদের সংখ্যা প্রায় ১০,২০০,০০০।[১২] এছাড়া উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ, দূরপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া ও বিশ্বের অন্যত্রও অভিবাসী জৈনদের দেখা মেলে।[১৩] ভারতের অপরাপর ধর্মমত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জৈনদের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষিত হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে বৃত্তিদানের একটি প্রাচীন প্রথা জৈনদের মধ্যে আজও বিদ্যমান; এবং ভারতে এই সম্প্রদায়ের সাক্ষরতার হার অত্যন্ত উচ্চ।[১৪][১৫] শুধু তাই নয়, জৈন গ্রন্থাগারগুলি দেশের প্রাচীনতম গ্রন্থাগারও বটে।[১৬]
হাতের তালুতে চক্রের চিহ্ন। এটি অহিংসার প্রতীক। মধ্যে ‘অহিংসা’ কথাটি লেখা আছে। চক্রটি ধর্মচক্রের প্রতীক। সত্য ও অহিংসার পথে নিরন্তর যাত্রার মাধ্যমে জন্ম-মৃত্যুর চক্রের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কথাটি এই প্রতীকের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে।
অহিংসা জৈনধর্মের প্রধান ও সর্বাধিক পরিচিত বৈশিষ্ট্য।[১৭] কোনোরকম আবেগের তাড়নায় কোনো জীবিত প্রাণীকে হত্যা করাকেই জৈনধর্মে ‘হিংসা’ বলা হয়। এই ধরনের কাজ থেকে দূরে থাকাই জৈনধর্মে ‘অহিংসা’ নামে পরিচিত।[১৮] প্রতিদিনের কাজকর্মে অহিংসার আদর্শটিকে প্রাধান্য দেওয়া জৈনধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।[১৯][২০] প্রত্যেক মানুষ নিজেদের মধ্যে বাক্যালাপ ও কোনোরকম আদানপ্রদানের সময় অহিংসার চর্চা করবে এবং কাজ, বাক্য বা চিন্তার মাধ্যমে অন্যকে আঘাত করা থেকে বিরত থাকবে – এই হল জৈনদের অহিংসা আদর্শের মূল কথা।[২১]
মানুষ ছাড়াও সমস্ত জীবিত প্রাণীর প্রতিই জৈনরা অহিংসা ব্রত পালন করেন। এই আদর্শ যেহেতু বাস্তবক্ষেত্রে সম্পূর্ণ রূপে প্রয়োগ করা অসম্ভব, সেহেতু জৈনরা একটি ক্রমোচ্চ শ্রেণীশৃঙ্খলা মেনে চলেন। এই শ্রেণীশৃঙ্খলায় মানুষের পরে পশুপক্ষী, তারপর কীটপতঙ্গ ও তারপর গাছপালার স্থান রয়েছে। এই কারণেই জৈন ধর্মানুশীলনে নিরামিষ আহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ জৈন দুগ্ধজাত নিরামিষ খাবার খেয়ে থাকেন। দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনের সময় যদি পশুদের প্রতি হিংসাত্মক আচরণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে, সেক্ষেত্রে সাধারণ নিরামিষ আহারই গ্রহণ করার নিয়ম। মানুষ ও পশুপাখির পর কীটপতঙ্গরা জৈন ধর্মানুশীলনের রক্ষাকবচ পাওয়ার উপযোগী বলে বিবেচিত হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে কীটপতঙ্গদের ক্ষতি করা জৈন ধর্মানুশীলনে নিষিদ্ধ। উদাহরণ স্বরূপ, কীটপতঙ্গ মারার বদলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। জৈনধর্মে ঐচ্ছিকভাবে ক্ষতি করা ও নির্দয় হওয়াকে হিংসার চেয়েও গুরুতর অপরাধ মনে করা হয়।
মানুষ, পশুপাখি ও কীটপতঙ্গের পর জৈনরা গাছপালার প্রতি অহিংসা ব্রত পালন করেন। যতটা না করলেই নয়, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি তাঁরা গাছপালার করেন না। যদিও তাঁরা মনে করেন, খাদ্যের প্রয়োজনে গাছপালার ক্ষতি করতেই হয়। তবে মানুষের টিকে থাকার ক্ষেত্রে এটা অপরিহার্য বলে তাঁরা এতটুকু হিংসা অনুমোদন করেন। কট্টরপন্থী জৈনরা এবং জৈন সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীরা মূল-জাতীয় সবজি (যেমন আলু, পিঁয়াজ, রসুন) খান না। কারণ, কোনো গাছকে উপড়ে আনতে গেলে গাছের ছোটো ছোটো অঙ্গগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।[২২]
Jainism
জীবনের ধরন ও ও অদৃশ্য জীবন সহ জীবনের আকৃতি সম্পর্কে জৈনদের ধারণা অত্যন্ত বিস্তারিত। জৈন ধর্মমতে, হিংসার পিছনে উদ্দেশ্য ও আবেগগুলি কাজের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, যদি কেউ অযত্নের বশে কোনো জীবিত প্রাণীকে হত্যা করে এবং পরে তার জন্য অনুতাপ করে তবে, কর্মবন্ধন কমে আসে। অন্যদিকে ক্রোধ, প্রতিশোধ ইত্যাদি আবেগের বশে হত্যা করা গুরুতর অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। ‘ভাব’ অর্থাৎ আবেগগুলি কর্মবন্ধনের কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। কোনো সৈন্য আত্মরক্ষার জন্য কাউকে হত্যা করছে এবং কেউ ঘৃণা বা প্রতিশোধের বশে কাউকে হত্যা করছে – এই দুই হিংসার ধরন সম্পূর্ণ আলাদা।
জৈনধর্মে আত্মরক্ষার জন্য হিংসা বা যুদ্ধ মেনে নেওয়া হয়। তবে শান্তিপূর্ণ সমাধানসূত্র না পাওয়া গেলে তবেই এগুলি প্রয়োগের পরামর্শ দেওয়া হয়।[২৩]
জৈনধর্মের দ্বিতীয় প্রধান আদর্শ হল ‘অনেকান্তবাদ’। জৈনদের কাছে, ‘অনেকান্তবাদ’ হল মুক্তমনস্ক হওয়া। এর মধ্যে সকল মতাদর্শ গ্রহণ ও বিভিন্ন বিশ্বাসের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা এর অঙ্গ। জৈনধর্ম এই ধর্মের অনুরাগীদের বিপরীত ও বিরুদ্ধ মতবাদগুলিকে বিবেচনা করার শিক্ষা দেয়। জৈনদের অনেকান্তবাদ ধারণাটি মহাত্মা গান্ধীর ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও অহিংসার আদর্শকে অনুপ্রাণিত করেছিল।[২৪]
অনেকান্তবাদ বহুত্ববাদকে (একাধিক মতবাদের সহাবস্থান) বিশেষ গুরুত্ব দেয়। সেই সঙ্গে মনে করে সত্য ও বাস্তবতাকে বিভিন্ন ও বৈচিত্র্যপূর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা উচিত। কারণ একটি মাত্র দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে তা সম্পূর্ণ বিচার করা যায় না।[২৫][২৬]
এই তত্ত্বটিকে জৈনরা অন্ধের হস্তীদর্শন উপাখ্যানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন। এই গল্পে এক এক জন অন্ধ এক হাতির এক একটি অঙ্গ স্পর্শ করেছিল। কেউ শুঁড়, কেউ পা, কেউ কান বা কেউ অন্য কিছু ধরেছিল। প্রত্যকে হাতির যে অঙ্গটি ধরেছিল, হাতি সেই রকম পশু বলে দাবি করে। হাতিটিকে সম্পূর্ণভাবে স্পর্শ না করতে পেরে তাদের জ্ঞানও সম্পূর্ণ হয় না।[২৭] অনেকান্তবাদের ধারণাটি পরে প্রসারিত হয় এবং স্যাদবাদ কর্তৃক ব্যাখ্যাত হয়।
অপরিগ্রহ হল জৈনধর্মের তৃতীয় প্রধান আদর্শ। ‘অপরিগ্রহ’ বলতে নির্লোভ হওয়া, অপরের দ্রব্য না নেওয়া ও জাগতিক কামনাবাসনা থেকে দূরে থাকাকে বোঝায়। জৈনরা যতটুকু প্রয়োজনীয়, তার চেয়ে বেশি নেওয়ার পক্ষপাতী নন। দ্রব্যের মালিকানা স্বীকৃত। তবে দ্রব্যের প্রতি আসক্তিশূন্যতা শিক্ষা দেওয়া হয়। জৈন ধর্মাবলম্বীরা অপ্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ ও যা আছে তার প্রতি আসক্তিশূন্য হবে – এই হল জৈনধর্মের শিক্ষা। জৈনধর্ম মনে করে তা না করলে দ্রব্যের প্রতি অধিক আসক্তির বশে ব্যক্তি নিজের ও অপরের ক্ষতিসাধন করতে পারেন।
ব্রতের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং তার মাধ্যমে ব্যক্তিগত চৈতন্যের বিকাশের দ্বারা আধ্যাত্মিক জাগরণের উপর জৈনধর্ম বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে।[২৮] কট্টরপন্থী অনুগামী ও সাধারণ অনুগামীদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন স্তরের ব্রতের বিধান এই ধর্মে দেওয়া হয়।[২৮] এই ধর্মের অনুগামীরা পাঁচটি প্রধান ব্রত পালন করেন:
অহিংসা: প্রথম ব্রতটি হল জৈন ধর্মাবলম্বী কোনো জীবিত প্রাণীর ক্ষতি করবে না। এর মধ্যে অন্যান্য প্রাণীর প্রতি কার্য, বাক্য বা চিন্তার মাধ্যমে ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক ক্ষতিসাধনের শ্রেণীবিভাগ করা আছে।
সত্য: এই ব্রতটি হল সর্বদা সত্য কথা বলার ব্রত। অহিংসাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তাই অন্যান্য আদর্শের সঙ্গে অহিংসার আদর্শের কোনো বিরোধ বাধলে, এই ব্রতের সাহায্য নেওয়া হয়। যেখানে সত্য বচন হিংসার কারণ হয়, সেখানে মৌন অবলম্বন করা হয়।[২৮]
অস্তেয়: ‘অস্তেয়’ শব্দের অর্থ চুরি না করা। যা ইচ্ছাক্রমে দেওয়া হয়নি, জৈনরা তা গ্রহণ করেন না।[২৮] অন্যের থেকে ধনসম্পত্তি নিয়ে নেওয়া বা দুর্বলকে দুর্বলতর করাকে জৈনরা চুরি করা বলেন। তাই যা কিছু কেনা হয় বা যে পরিষেবা নেওয়া হয়, তার জন্য যথাযথ মূল্য দেওয়াই জৈনধর্মের নিয়ম।
ব্রহ্মচর্য: গৃহস্থদের কাছে ব্রহ্মচর্য হল পবিত্রতা এবং সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের কাছে যৌনতা থেকে দূরে থাকা। যৌন ক্রিয়াকলাপ থেকে দূরে থেকে আত্মসংযমকেই ‘ব্রহ্মচর্য’ বলা হয়।[২৯]
অপরিগ্রহ: অপরিগ্রহ হল অনাসক্তি। এর মাধ্যমে জাগতিক বন্ধন থেকে দূরে থাকা এবং দ্রব্য, স্থান বা ব্যক্তির প্রতি অনাসক্তিকে বোঝায়।[২৮] জৈন সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীরা সম্পত্তি ও সামাজিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ ত্যাগ করেন।
সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের পাঁচটি মহাব্রত পালন করতে হয়। অন্যদিকে গৃহস্থ জৈনদের এই পঞ্চ মহাব্রত এগুলির ব্যবহারিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে যথাসম্ভব পালনের পরামর্শ দেওয়া হয়।[২৮]
এছাড়াও জৈনধর্মে মনের চারটি আবেগকে চিহ্নিত করা হয়: ক্রোধ, অহং, অসদাচরণ ও লোভ। জৈন ধর্মমতে, ক্ষমার মাধ্যমে ক্রোধকে, বিনয়ের মাধ্যমে অহংকারকে, সত্যাচরণের মাধ্যমে অসদাচরণকে এবং সন্তুষ্টির মাধ্যমে লোভকে জয় করার কথা বলা হয়েছে।
প্রথম তীর্থঙ্করঋষভের মূর্তি। ইনি জৈন কালচক্রের অবসরপনি যুগে বর্তমান ছিলেন বলে জৈনদের ধারণা।
জৈনধর্ম কোনো সৃষ্টিকর্তা বা ধ্বংসকর্তা ঈশ্বরের ধারণা গ্রহণ করে না। এই ধর্মমতে জগৎ নিত্য। জৈনধর্ম মনে করে, প্রত্যেক আত্মার মধ্যেই মোক্ষলাভ ও ঈশ্বর হওয়ার উপযুক্ত উপাদান রয়েছে। এই ধর্মমতে পূর্ণাত্মা দেহধারীদের বলা হয় ‘অরিহন্ত’ (বিজয়ী) এবং দেহহীন পূর্ণাত্মাদের বলা হয় সিদ্ধ (মুক্তাত্মা)। যে সকল অরিহন্ত অন্যদের মোক্ষলাভে সাহায্য করেন তাঁদের বলা হয় ‘তীর্থঙ্কর’। জৈনধর্মে উত্তর-অস্তিবাদী ধর্মমত মনে করা হয়।[৩০] কারণ, এই ধর্ম মোক্ষলাভের জন্য কোনো সর্বোচ্চ সত্তার উপর নির্ভর করার কথা বলে না। তীর্থঙ্করেরা হলেন সহায় ও শিক্ষক, যিনি মোক্ষলাভের পথে সাহায্য করেন মাত্র। কিন্তু মোক্ষলাভের জন্য সংগ্রাম মোক্ষলাভে ইচ্ছুক ব্যক্তিকেই করতে হয়।
অরিহন্ত (জিন): একজন মানুষ যিনি সব ধ্রনের আন্তরিক আবেগকে জয় করেছেন এবং কেবল জ্ঞান লাভ করেছেন। এঁদের ‘কেবলী’ও (সর্বজ্ঞ সত্ত্বা) বলা হয়। দুই ধরনের অরিহন্ত হন:[৩১]
সামান্য (সাধারণ বিজয়ী) – যে কেবলীরা শুধুমাত্র নিজের মোক্ষের কথাই ভাবেন।
তীর্থঙ্কর – ‘তীর্থঙ্কর’ শব্দের অর্থ যিনি পার করেন বা মোক্ষ শিক্ষার এক গুরু।[৩২] তাঁর জৈন ধর্মমত প্রচার ও পুনরুজ্জীবিত করেন। এঁরাই আধ্যাত্মিক জীবনের আদর্শ। তাঁরা ‘চতুর্বিধ সংঘ’ (শ্রমণ বা সন্ন্যাসী, শ্রমণী বা সন্ন্যাসিনী, শ্রাবক বা পুরুষ অনুগামী ও শ্রাবৈকা বা নারী অনুগামী) পুনর্গঠন করেন।[৩৩][৩৪] জৈনরা বিশ্বাস করেন জৈন কালচক্রের প্রত্যেক অর্ধে ২৪ জন করে তীর্থঙ্কর জন্মগ্রহণ করেন। সর্বশেষ তীর্থঙ্করের নাম মহাবীর। তাঁর পূর্ববর্তী তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ ও মহাবীর – এই দুই তীর্থঙ্করের অস্তিত্বই ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত।[৩৫][৩৬]
সিদ্ধ বা মুক্তাত্মা। এঁরা দেহহীন হলেও জৈন মন্দিরে এঁদের এইভাবে দেখানো হয়।
সিদ্ধ: সিদ্ধ ও অরিহন্তরা মোক্ষ অর্জন করে অনন্ত আনন্দ, অনন্ত অন্তর্দৃষ্টি, অনন্ত জ্ঞান ও অনন্ত শক্তি সহকারে সিদ্ধশীলে বসবাস করেন।
ধর্মানুশীলন
সন্ন্যাসবাদ
Jainism
ধ্যানরতা জৈন সন্ন্যাসিনী
জৈনধর্মে সন্ন্যাস প্রথাকে উৎসাহ দেওয়া হয় এবং সম্মান করা হয়। জৈন সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীরা অত্যন্ত কঠোর ও পবিত্র জীবন যাপন করেন। তাঁরা জৈনধর্মের পঞ্চ মহাব্রত সম্পূর্ণত পালন করেন। তাঁদের স্থায়ী বাসস্থান বা বিষয়সম্পত্তি কিছুই নেই। দূরত্ব যাই হোক, তাঁরা খালি পায়ে হেঁটে যাতায়াত করেন। চতুর্মাস্যের চার মাস বাদে বছরের অন্যান্য সময় তাঁরা এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ান। তাঁরা টেলিফোন বা বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন না। তাঁরা রান্না করেন না। ভিক্ষা করে খান। তাঁরা সাধারণত মুখ ঢাকার জন্য একটি কাপড়ের খণ্ড রাখেন যাতে হাওয়ায় ভাসমান জীবাণুদের ক্ষতি না হয়। তাঁদের অধিকাংশই ঝাঁটার মতো দেখতে একটি জিনিস নিয়ে ঘোরেন। রায়োহরণ নামে এই ঝাঁটার মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের সামনের রাস্তা ঝাঁট দিতে দিতে হাঁটেন। বসার আগেও তাঁরা বসার জায়গাটি ঝাঁট দিয়ে নেন, যাতে কোনো কীটপতঙ্গ তাঁদের চাপে মারা না যায়।[৩৭]
জৈনদের উৎসবে সন্ন্যাসীদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক নয়। এঁরা পুরোহিত নন। যদিও কোনো কোনো সম্প্রদায়ে এমন একজন পূজারিকে বিশেষ দৈনিক অনুষ্ঠানগুলি ও মন্দিরের অন্যান্য পৌরোহিত্যকর্মের জন্য নিযুক্ত করা হয়, যিনি নিজে জৈন নন।[৩৮]
প্রার্থনা
জৈনরা কোনো সুবিধা বা পার্থিব চাহিদা পূরণ অথবা পুরস্কারের আশায় আবেগশূন্য দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করেন না। [৩৯] তাঁরা প্রার্থনা করেন কর্মবন্ধন নাশ ও মোক্ষলাভের জন্য।[৪০] ‘বন্দেতদ্গুণলব্ধায়ে’ (সেই দেবতাদের কাছে সেই গুণাবলির কামনায় আমরা প্রার্থনা করি) – জৈনদের এই প্রার্থনা বাক্যের মাধ্যমে তাঁদের প্রার্থনার মূল কথাটি বোঝা যায়।[৪০]
নবকার মন্ত্র
নবকার মন্ত্র হল জৈনধর্মের একটি মৌলিক প্রার্থনা। এটি যে কোনো সময় পাঠ করা যায়। দেবত্ব অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক গুণগুলিকে এই মন্ত্রের দ্বারা উপাসনা করা হয়। এই মন্ত্রে কোনো ব্যক্তিবিশেষের নাম নেই। জৈনধর্মে পূজা বা প্রার্থনার উদ্দেশ্য হল জাগতিক কামনা ও বন্ধনকে ধ্বংস করা এবং আত্মার মোক্ষ অর্জন।
উপবাস
অধিকাংশই বছরের বিভিন্ন সময়ে উপবাস করেন। বিশেষত উৎসবের সময় উপবাস জৈনধর্মে একটি বিশেষ প্রথা। বিভিন্ন ভাবে উপবাস করা যায়। এটি উপবাসকর্তার সামর্থের উপর নির্ভর করে। কেউ দিনে একবার বা দুবার খান, কেউ সারাদিন শুধু জল পান করেন, কেউ সূর্যাস্তের পরে খান, কেউ রান্না করা খাবার খান না, কেউ চিনি, তেল বা নুন ছাড়া নির্মিত রান্না খান। উপবাসের উদ্দেশ্য হল আত্মসংযম অনুশীলন এবং মনকে শুদ্ধ করে প্রার্থনায় অধিকতর মানসিক শক্তি প্রয়োগ।
জৈনরা সাময়িকা নামে এক ধ্যানপদ্ধতি গড়ে তুলেছে। ‘সাময়িকা’ কথাটি এসেছে ‘সময়’ কথাটি থেকে। সাময়িকার উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ শান্তির অনুভূতি পাওয়া ও আত্মার অপরিবর্তনশীলতা অনুধাবন করা। এই ধরনের ধ্যানের মূল ভিত্তি বিশ্ব ও আত্মার পুনঃপুনঃ আগমনের ধারণা।[৪১]পর্যুশন উৎসবের সময় সাময়িকা ধ্যান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মনে করা হয়, ব্যক্তির আবেগগুলি নিয়ন্ত্রণ ও সামঞ্জস্যবিধানে ধ্যান বিশেষ সহকারী। মনের চিন্তাভাবনা যেহেতু ব্যবহার, কাজ ও উদ্দেশ্য লাভের পথে বিশেষ প্রভাবশালী তাই ভিতর থেকে এগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার উপর জৈনধর্মে বিশেষ জোর দেওয়া হয়।[৪২]
জৈনরা ছয়টি কর্তব্য পালন করেন। ‘আবশ্যক’ নামে পরিচিত এই কর্তব্যগুলি হল: ‘সম্যিকা’ বা (শান্তি অনুশীলন), ‘চতুর্বিংশতি’ (তীর্থঙ্কর বন্দনা), ‘বন্দন’ (গুরু ও সন্ন্যাসীদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন), প্রতিক্রমণ (অন্তর্দৃষ্টি), কায়োৎসর্গ (স্থির থাকা) ও প্রত্যখ্যন (ত্যাগ)।[৪৩]
জৈন দর্শন অনুসারে, আত্মার সহজাত গুণ হল এর পবিত্রতা। এই আত্মা অনন্ত জ্ঞান, অনন্ত অন্তর্দৃষ্টি, অনন্ত আনন্দ ও অনন্ত শক্তির সকল গুণ তার আদর্শ অবস্থায় বহন করে।[৪৪] বাস্তব ক্ষেত্রে যদিও এই গুণগুলি আত্মার সঙ্গে ‘কর্ম’ নামে এক পদার্থের যোগের ফলে বাধা প্রাপ্ত হয়।[৪৫] জৈনধর্মের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল আত্মাকে কর্মের বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে মোক্ষ লাভ করা।
আত্মা ও কর্মের সম্পর্কটি সোনার উপমার সাহায্যে বোঝানো হয়। প্রাকৃতিক অবস্থায় সোনার মধ্যেও নানান অশুদ্ধ দ্রব্য মিশ্রিত অবস্থায় থাকে। একই ভাবে আদর্শ বা আত্মার পবিত্র অবস্থাও কর্মের অশুদ্ধ অবস্থার সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় থাকে। সোনার মতোই আত্মাকেও যথাযথ পদ্ধতিতে শুদ্ধ করতে হয়।[৪৫] জৈনদের কর্মবাদ ব্যবহৃত হয় ব্যক্তিগত কাজে দায়িত্ব আরোপ করার জন্য এবং এটি অসাম্য, যন্ত্রণা ও দুঃখের ব্যাখ্যা করার জন্য প্রদর্শিত হয়।
আত্মার মোক্ষ অর্জনের জন্য জৈনধর্মে নিম্নোক্ত রত্নত্রয়ের কথা বলা হয়েছে:[৪৬]
সম্যক দর্শন – সঠিক অন্তর্দৃষ্টি ও সত্যের অনুসন্ধান এবং একই সঙ্গে সকল বস্তুকে স্পষ্টভাবে দেখার পথে বাধা সৃষ্টিকারী কুসংস্কারগুলিকে বর্জন।
সম্যক জ্ঞান – জৈন আদর্শগুলি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান।
সম্যক চরিত্র – জৈন আদর্শগুলি জীবনে প্রয়োগ।
তত্ত্ব
জৈন অধিবিদ্যার ভিত্তি সাত অথবা নয়টি মৌলিক আদর্শ। এগুলি ‘তত্ত্ব’ নামে পরিচিত। তত্ত্বগুলির মাধ্যমে মানুষের দুর্ভাগ্যের প্রকৃতি এবং জীবনের চরম লক্ষ্য আত্মার মোক্ষ লাভের জন্য উক্ত দুর্ভাগ্যের সমাধানের কথা বলা হয়েছে:[৪৭]
জীব: জীবি সত্ত্বার সারবস্তুকে বলে ‘জীব’। এটি এমন এমন এক বস্তু যা দেহে অবস্থান করে, অথচ দেহ অপেক্ষা পৃথক। চৈতন্য, জ্ঞান ও ধারণা এর মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
অজীব: পদার্থ, স্থান ও সময় নিয়ে গঠিত প্রাণহীন বস্তুসকল।
অস্রব: আত্মায় কর্মের (অজীবের একটি বিশেষ রূপ) আবির্ভাবের কারণে সৃষ্ট জীব ও অজীবের সংযোগ।
বন্ধ: কর্ম জীবকে মুখোশের আড়ালে বদ্ধ করে এবং যথাযথ জ্ঞান ও ধারণার সত্য অধিকার থেকে জীবকে বিরত রাখে।
সংবর: সঠিক চরিত্রের দ্বারা কর্মের আবির্ভাব স্তব্ধ করা সম্ভব।
নির্জরা: তপশ্চর্যার মাধ্যমে অস্তিত্ববান কর্মকে পরিহার করা যায়।
মোক্ষ: যে মুক্ত আত্মা কর্মকে পরিহার করেছে এবং পবিত্রতা, যথাযথ জ্ঞান ও ধারণার স্বকীয় গুণাবলি অর্জন করেছে।
কোনো কোনো গবেষক আরও দুটি শ্রেণী যুক্ত করেছেন: ‘পুণ্য’ (স্তবনীয়) ও ‘পাপ’ (স্তবের অযোগ্যতা)। এগুলি কর্মের সঙ্গে যুক্ত ক্রিয়া।
স্যাদবাদ
Jainism
মহাবীর জৈন দার্শনিক ধারণাগুলি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিস্তারিতভাবে ‘অনেকান্তবাদ’ ব্যবহার করেছিলেন (রাজস্থানের চিত্রকলা, ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ)।
স্যাদবাদ হল অনেকান্তবাদ ধারণা থেকে উৎসারিত একটি মতবাদ। এই মতবাদে প্রতিটি শব্দবন্ধ বা অভিব্যক্তির শুরুতে ‘স্যাদ’ উপসর্গটি যুক্ত করে অনেকান্তকে ব্যাখ্যা করেছে।[৪৮] সংস্কৃত ভাষায় ‘স্যাদ্’ শব্দমূলটির অর্থ ‘হয়তো’। তবে স্যাদবাদের ক্ষেত্রে এই শব্দটির অর্থ ‘কোনো কোনো উপায়ে’ বা ‘কোনো কোনো মতে’। সত্য যেহেতু জটিল, তাই কোনো একক উপায়ে এটির পূর্ণ প্রকৃতিটিকে প্রকাশ করা যায় না। সেই কারণে একটি অনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি বোঝাতে এবং বক্তব্যের মধ্যে থেকে রক্ষণশীলতাকে বাদ দিতে প্রতিটি অভিব্যক্তিমূলক শব্দের গোড়ায় ‘স্যাৎ’ কথাটি যুক্ত করা হয়েছে।[৪৯] স্যাদবাদের সাতটি অনির্দিষ্ট ধারণা বা সপ্তভঙ্গি হল:[৫০]
স্যাদ্-অস্তি—কোনো কোনো উপায়ে, এটি আছে;
স্যাদ্-নাস্তি—কোনো কোনো উপায়ে, এটি নেই;
স্যাদ্-অস্তি-নাস্তি—কোনো কোনো উপায়ে, এটি আছে এবং এটি নেই;
স্যাদ্-অস্তি-অবক্তব্যঃ—কোনো কোনো উপায়ে এটি আছে এবং এটি বর্ণনার অতীত;
স্যাদ্-নাস্তি-অবক্তব্যঃ—কোনো কোনো উপায়ে এটি নেই এবং এটি বর্ণনার অতীত;
স্যাদ্-অস্তি-নাস্তি-অবক্তব্যঃ—কোনো কোনো উপায়ে এটি আছে, এটি নেই এবং এটি বর্ণনার অতীত;
স্যাদ্-অবক্তব্যঃ—কোনো কোনো উপায়ে এটি অবক্তব্য।
সাতটি অভিব্যক্তির মাধ্যমে সময়, স্থান, বস্তু ও আকারের দৃষ্টিকোণ থেকে সত্যের জটিল ও বহুমুখী প্রকৃতিটিকে প্রকাশ করা হয়েছে।[৫০] সত্যের জটিলতাকে অস্বীকার করা হল গোঁড়ামি-প্রসূত বিপথগামিতা।[২৬]
স্যাদবাদ হল আংশিক দৃষ্টিভঙ্গির তত্ত্ব।[৫১] ‘নয়বাদ’ কথাটি দুটি সংস্কৃত শব্দ নিয়ে গঠিত: ‘নয়’ (আংশিক দৃষ্টিভঙ্গি) ও ‘বাদ’ (দর্শন মতবাদ বা বিতর্ক)। এই মতে একটি দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। প্রতিটির বস্তুর অনন্ত দিক রয়েছে। কিন্তু যখন আমরা সেটি কোনো একটি মতের দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করি, আমরা শুধুমাত্র সেই মতের সঙ্গে যুক্ত দিকগুলি নিয়েই আলোচনা করি এবং অন্যান্য দিকগুলি অগ্রাহ্য করি।[৫১] নয়বাদের মতে দার্শনিক বিবাদের উৎপত্তির কারণ দৃষ্টিভঙ্গির বিভ্রান্তি এবং আমরা সেই দৃষ্টিভঙ্গিগুলিই গ্রহণ করি যেগুলি ‘আমাদের অনুসরণের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি’। আমরা হয়তো তা বুঝতে পারি না। ভাষা ও সত্যের জটিল প্রকৃতির বোধগম্যতার সীমাবদ্ধতার মধ্যে কথা বলতে গিয়ে মহাবীর নয়বাদের ভাষা ব্যবহার করেন। নয়বাদ সত্যের একটি আংশিক অভিপ্রকাশ। এটি আমাদের সত্যকে অংশ ধরে ধরে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে।[৫২]
অনেকান্তবাদে অধিকতর পোষাকিভাবে দেখানো হয়েছে যে, বস্তু তাদের গুণাবলি ও অস্তিত্বের ধরন অনুসারে অনন্ত। মানুষের সীমাবদ্ধ ধারণাশক্তি দিয়ে তার সকল দিক ও সকল রূপের ধারণা করা যায় না। শুধুমাত্র কেবলবাদীরাই বস্তুর সকল দিক ও রূপের ধারণা করতে পারেন। অন্যরা শুধু আংশিক জ্ঞান অর্জন করতে পারে।[৫৩] এই মত অনুসারে, একজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি সর্বোচ্চ সত্যের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না।[২৫]
জৈনধর্মের উৎস অজ্ঞাত।[৬][৫৪] জৈনধর্ম হল একটি অনন্তকালীন দর্শন।[৫৫]জৈন কালচক্র অনুসারে, কালচক্রের প্রত্যেক অর্ধে চব্বিশ জন বিশিষ্ট মানুষ তীর্থঙ্করের পর্যায়ে উন্নীত হন এবং মানুষকে মোক্ষের পথ প্রদর্শন করেন। তাই এঁদের বলা হয় মানুষের আধ্যাত্মিক সহায়ক।[৫৬] মহাবীরের পূর্বসূরী তথা ২৩তম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ ছিলেন একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব।[৩৬][৫৭] তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৯ম-৭ম শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে জীবিত ছিলেন।[৫৮][৫৯][৬০][৬১] আনুশাসনিক ধর্মগ্রন্থগুলিতে পার্শ্বনাথের অনুগামীদের উল্লেখ আছে। উত্তরাধ্যয়ন সূত্রের একটি কিংবদন্তিতে পার্শ্বনাথের শিষ্যদের সঙ্গে মহাবীরের শিষ্যদের সাক্ষাতের কথা আছে। এই সাক্ষাতের ফলে পুরনো ও নতুন জৈন শিক্ষাদর্শের মিলন ঘটেছিল।[৬২]
খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে বর্ধমান মহাবীর জৈনধর্মের সবচেয়ে প্রভাবশালী শিক্ষকে পরিণত হন। জৈনরা তাঁকে ২৪তম এবং এই কালচক্রের সর্বশেষ তীর্থঙ্কর রূপে শ্রদ্ধা করেন। জৈন বিশ্বাস অনুযায়ী, তিনি এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি শুরু থেকেই বহু প্রাচীনকালে প্রতিষ্ঠিত একটি ধর্মের অনুগামী।[৬২]
কিংবদন্তিমূলক ইতিহাস
Jainism
জৈন কিংবদন্তি অনুসারে, সকলপুরুষ নামে তেষট্টি জন বিশিষ্ট সত্ত্বা এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন।[৬৩] জৈন কিংবদন্তিমূলক ইতিহাস এই সত্ত্বাদের কর্মকাণ্ডের সংকলন।[৬৪] সকলপুরুষদের মধ্যে চব্বিশ জন তীর্থঙ্কর, বারো জন চক্রবর্তী, নয় জন বলদেব, নয় জন বাসুদেব ও নয় জন প্রতিবাসুদেব রয়েছেন।[৬৩]
চক্রবর্তীরা হলেন বিশ্বের সম্রাট ও জাগতিক রাজ্যের প্রভু।[৬৩] তাঁর জাগতিক ক্ষমতা প্রচুর। তাও বিশ্বের বিশালতার তুলনায় তাঁর আকাঙ্ক্ষাগুলিকে তিনি খাটো হিসেবে দেখেন। জৈন পুরাণগুলিতে বারো জন চক্রবর্তীর তালিকা পাওয়া যায়। তাঁদের গায়ের রং সোনালি।[৬৫] জৈন ধর্মশাস্ত্রে উল্লিখিত একজন শ্রেষ্ঠ চক্রবর্তী হলেন ভরত। কিংবদন্তি অনুসারে, তাঁর নামেই দেশের নাম হয়েছে ‘ভারতবর্ষ’।[৬৬]
নয় জন করে বলদেব, বাসুদেব ও প্রতিবাসুদেব রয়েছেন। কোনো কোনো দিগম্বর ধর্মগ্রন্থে তাঁদের যথাক্রমে বলদেব, নারায়ণ ও প্রতিনারায়ণ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। ভদ্রবাহুরজিনচরিত (খ্রিস্টপূর্ব ৩য়-৪র্থ অব্দ) গ্রন্থে এই ভ্রাতৃমণ্ডলীর উৎসের কথা বলা হয়েছে।[৬৭] বলদেবরা হলেন অহিংস যোদ্ধা। বাসুদেবরা সহিংস যোদ্ধা এবং প্রতিবাসুদেবরা হলেন মূলত খলনায়ক।কিংবদন্তি অনুসারে, বাসুদেবরা প্রতিবাসুদেবদের শেষ পর্যন্ত হত্যা করেছেন। নয় জন বলদেবের মধ্যে আট জন মোক্ষ লাভ করেছেন এবং সর্বশেষ জন স্বর্গে গিয়েছেন। বাসুদেবরা তাঁদের হিংসাত্মক কার্যকলাপের জন্য নরকে গিয়েছেন। সত্যের জন্য কাজ করতে চেয়েও শুধুমাত্র সহিংসতা অবলম্বনের জন্য তাঁদের এই শাস্তি হয়েছে।[৬৮]