অস্থায়ী সরকার যাকে জরুরী সরকার বা ট্রানজিশনাল সরকারও বলা হয়,[১] একটি জরুরি সরকার কর্তৃপক্ষ যা সাধারণত নতুন জাতির ক্ষেত্রে বা পূর্ববর্তী শাসকের পতনের পরে রাজনৈতিক কাজ পরিচালনার জন্য গঠিত হয় । অস্থায়ী সরকার সাধারণত নাগরিক বা বিদেশীদের দ্বারা যুদ্ধের সময় অথবা পরে নিযুক্ত হয় এবং প্রায়শই উত্থিত হয়।
অস্থায়ী সরকার নিয়মিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অব্যহত রাখে যতক্ষণনা একটি নতুন সরকার নিযুক্ত হয় এবং যা সাধারণত একটি নির্বাচনের মাধ্যমে হয় ।[২] তারা পরবর্তী সরকারের জন্য আইনি কাঠামো, মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা সম্পর্কিত নির্দেশিকা, অর্থনীতির কাঠামো, সরকারী প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক সারিবদ্ধকরণ সংজ্ঞায়িত করতে জড়িত থাকতে পারে। [৩]
ইয়োসি শেইন এবং জুয়ান জে লিন্জের মতে, অস্থায়ী সরকারগুলিকে চারটি দলে শ্রেণিবদ্ধ করা যেতে পারে:[৪
কুরআন মজিদ অথবা কুরআ-ন মাজী-দ বা কোরআন (আরবি: القرآن আল্-কুর্’আন্[টী১]) ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ, যা আল্লাহর বাণী বলে মুসলমানরা বিশ্বাস করে থাকেন।[১] এটিকে আরবি শাস্ত্রীয় সাহিত্যের সর্বোৎকৃষ্ট রচনা বলে মনে করা হয়।[২][৩][৪][৫] কুরআনকে প্রথমে অধ্যায়ে (আরবিতে সূরা) ভাগ করা হয় এবং অধ্যায়গুলো (সূরা) আয়াতে বিভক্ত করা হয়েছে।
এই কিতাব আল্লাহর ফেরেশতা জিবরাইল এর মাধ্যমে ইসলামিক নবি মুহাম্মাদ এর কাছে মৌখিকভাবে ভাষণ আকারে কুরআনের আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেন,[৬][৭] দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে সম্পূর্ণ কুরআন অবতীর্ণ হয়। কুরআনের প্রথম আয়াত অবতীর্ণ হয় ৬০৯ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর যখন মুহাম্মাদের বয়স ৪০ বছর[৮] এবং অবতরণ শেষ হয় মুহাম্মাদের তিরোধানের বছর অর্থাৎ ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে।[১][৯][১০] মুসলমানরা বিশ্বাস করে থাকেন কুরআন হচ্ছে মুহাম্মদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অলৌকিক ঘটনা যা তার নবুয়তের প্রমাণস্বরূপ[১১] এবং ঐশ্বরিক বার্তা প্রেরণের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায় যা আদম থেকে শুরু হয়ে মুহাম্মাদের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। তবে সুফিবাদের অনুসারীরা বিশ্বাস করে থাকেন মুহাম্মাদের সকল কর্মকান্ড উম্মতের কাছে বোধগম্য করে তোলার জন্যই কুরআন অবতীর্ণ করা হয়। কুরআনের আয়াতসমূহে কুরআন শব্দটি ৭০ বার এসেছে।[১২]
ইসলামি ইতিহাস অনুসারে দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে খণ্ড খণ্ড অংশে এটি ইসলামের নবি মুহাম্মাদের নিকট অবতীর্ণ হয়। ইসলামের অনুসারীরা কুরআনকে একটি পুর্ণাঙ্গ জীবন বিধান বলে বিশ্বাস করে। কুরআনে সর্বমোট ১১৪টি সূরা আছে। আয়াত বা পঙ্ক্তি সংখ্যা ৬,২৩৬ টি; মতান্তরে ৬,৬৬৬ টি। এটি মূল আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়।[১৩][১৪][১৫][১৬] মুসলিম চিন্তাধারা অনুসারে কুরআন ধারাবাহিকভাবে অবতীর্ণ ধর্মীয় গ্রন্থগুলোর মধ্যে সর্বশেষ এবং গ্রন্থ অবতরণের এই ধারা ইসলামের প্রথম বাণীবাহক আদম থেকে শুরু হয়। কুরআনে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ রয়েছে যার সাথে বাইবেলসহ অন্যান্য ধর্মীয়গ্রন্থের বেশ মিল রয়েছে, অবশ্য অমিলও কম নয়। তবে কুরআনে কোনো ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা নেই। ইসলামি ভাষ্যমতে কুরআন অপরিবর্তনীয় এবং এ সম্পর্কে মুসলিমরা কুরআনের সূরা আল-হিজরের (১৫ নং সূরা), ৯ নং আয়াতের কথা উল্লেখ করে থাকে, এবং তা হল:
“
আমি স্বয়ং এ উপদেশগ্রন্থ অবতরণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।[১৭]
কুরআনে কুর’আন শব্দটি কয়েকটি অর্থে প্রায় ৭০ বার এসেছে। আর, আরবি ব্যাকরণে “কুর’আন” শব্দটি একটি “মাসদার”,যা ভাববাচক বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ৭৫:১৭,১৮ আয়াতে এটি,(قرأ) ক্বারা’আ (‘পাঠ করা’, ‘আবৃত্তি করা’ বা ‘অনুসরণ করা’) ক্রিয়ার ভাববাচক বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এই ক্রিয়াপদটিকেই কুরআন নামের মূল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।[১৮] এই শব্দটির “মাসদার” (الوزن) হচ্ছে غفران তথা “গুফরান”। এর অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত ভাব, অধ্যবসায় বা কর্ম সম্পাদনার মধ্যে একাগ্রতা। উদাহরণস্বরুপ, (غفر) নামক ক্রিয়ার অর্থ হচ্ছে “ক্ষমা করা”; কিন্তু এর আরেকটি মাসদার রয়েছে যার যা হলো (غفران), এই মাসদারটি মূল অর্থের সাথে একত্রিত করলে দাঁড়ায় ক্ষমা করার কর্মে বিশেষ একাগ্রতা বা অতি তৎপর বা অতিরিক্ত ভাব। সেদিক থেকে কুরআন অর্থ কেবল পাঠ করা বা আবৃত্তি করা নয় বরং একাগ্র ভঙ্গীতে পাঠ বা আবৃত্তি করা। কুরআনের মধ্যেও এই অর্থেই কুরআন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআনের সূরা আল-কিয়ামাহের (৭৫ নং সূরা) ১৮ নং আয়াতে এই শব্দটি উল্লেখিত আছে:”অতঃপর, আমি যখন তা পাঠ করি (ক্বুরা’নাহু), তখন আপনি সেই পাঠের (কুরআ’নাহ্) অনুসরণ করুন।”[১৯]
কুরআনে যেখানেই এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে সেখানেই এর যথার্থ বিশেষ্য বা বিশেষণ পাওয়া যায়। ক্বারা’আ ক্রিয়াপদ কুরআনে পুনঃপুনঃ ব্যবহৃত হয়েছে। ১৭:৯৩ আয়াতে এর অর্থ ‘পাঠ করা’; কিন্তু এর বহুল প্রচলিত অর্থটি হল,’আবৃত্তি করা’ (তিলাওয়াঃ),৭৫: ১৬,১৭। মুহাম্মদ এর আবৃত্তি সমন্ধেও এই শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। তিনি তাঁর নিজের উপর অবতীর্ণ ওহী আবৃত্তি করেন (৭ঃ২০৪; ১৬ঃ৯৮; ১৭ঃ৪৫; ৮৪ঃ২১; ৮৭ঃ৬)। শব্দটি মুমিনদের আবৃত্তি সমন্ধেও ব্যবহৃত হয়েছে , তারা সালাতে ওহী আবৃত্তি করেন (৭৩ঃ২০)। এ থেকে বোঝা যায়, কুরআন শব্দের অর্থ হল ‘আবৃত্তি করা’ যা মুহাম্মদ আল্লাহর নিকট হতে প্রাপ্ত হয়ে আবৃত্তি করেছেন (৭৫ঃ১৮; ৮৬ঃ৬) এবং মানুষের সম্মুখেও আবৃত্তি করেছেন। যদিও কুরআন বলতে সাধারভাবে তাঁর উপর অবতীর্ণ ওহীর সমষ্টিকে বুঝায়। তবে শব্দটি (কুরআন) তাঁর উপর অবতীর্ণ পৃথক পৃথক ওহী (১০ঃ১৫; ১২ঃ৩; ৭২ঃ১; ২ঃ১৮৫) সমন্ধে বা খন্ডে খন্ডে অবতীর্ণ (১৭ঃ১০৬; ২০ঃ১; ৭৬ঃ২৩; ২৫ঃ৩২ ; ৫৯ঃ২১) আল্লাহর ওহী সমন্ধে বলা হয়েছে যা তিঁনি আল্লাহ কতৃক পেয়েছিলেন (২৭ঃ৬; ২৮ঃ৮৫)।
আল কিতাব (ধর্ম গ্রন্থ বা পুস্তক) শব্দটি আল-কুরআনের প্রতিশব্দ হিসাবে একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। আল-কিতাব সমন্ধে বলা হয়েছে “ইহা এক কল্যানময়ী রাত্রিতে (৪৪ঃ২) অবতীর্ণ হইয়াছে” (৪০ঃ২; ৪৫ঃ২)। ১৫ঃ১ আয়াতে বলা হয়েছে, “এইগুলি আল-কুরআন এবং সুস্পষ্ট অর্থবোধক আল-কিতাবের অলৌকিক নিদর্শনসমূহ।” বিষয়বস্তু হিসেবে কুরআনকে প্রায়ই ‘যি’কর’ বলা হয়েছে। এখানে এর অর্থ উপদেশ, সাধারণ বাণী (২১ঃ২৬,৪২; ৩৮ঃ৮৭)। যি’করকে ‘অবতীর্ণ’ (২১ঃ৫০; ৩৮ঃ৮) এবং ‘মহান পবিত্র গ্রন্থ’ (৪১ঃ৪১) বলা হয়েছে। আবার ৩৬ঃ ৬৯ আয়াতে কুরআন সমন্ধে বলা হয়েছে, ” এ তো কেবল এক উপদেশ ও স্পষ্ট কুরআন মাত্র”। ২১ঃ৭ আয়াতে আহ্’লুল-কিতাবকে আহ্’লুয যি’কর বলা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে আল-হি’কমাঃ শব্দটি উল্লেখ করা যেতে পারে। ২ঃ১২১,১৫১; ৩ঃ১৬৪; ৬২ঃ২ -এ আল-কিতাবের সাথে হি্’কমাঃ উল্লেখ করা হয়েছে। ২ঃ২৩৯; ৪ঃ১১৩ -এ কুরআনের সঙ্গে হি’কমাতের অবতীর্ণ হওয়ার উল্লেখ আছে। কুরআনে, কুরআনকে “আল-ফুরকা’ন”-ও বলা হয়েছে।
“সূরা(سورة)” শব্দটি আরবী সূর (নগর প্রাচীর) হতে গৃহীত একবচনজ্ঞাপক যোগ করিয়া গঠিত। সূরার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নির্দিষ্ট অংশকে আয়াত বলা হয়। হিব্রু ‘ওত’ শব্দের ন্যায় ইহা বিশেষ অর্থে নিদর্শন, বিশ্বাসের নিদর্শন (২ঃ২৪৮; ৩ঃ৪১; ২৬ঃ১৯৭) বিশেষত আল্লাহর অস্তিত্ব ও ক্ষমতার নিদর্শন (১২ঃ১০৫; ৩৬ঃ৩৩) বুঝায়। তাই এটি দ্বারা অলৌকিক ঘটনাকে’ও (মু’জিযাঃ) বুঝায় (৩ঃ৪৯; ৪৩ঃ৪৬)। মুহাম্মদ যে আল্লাহর নবী এর প্রমাণস্বরুপ মক্কার পৌত্তলিকরা তার নিকট অলৌকিক ক্রিয়া (মু’জিযাঃ) দেখানোর দাবী করত। যেহেতু প্রেরিত ওহীগুলোই তার অন্যতম মু’জিযাঃ (৬ঃ১৫৮; ৭ঃ২০৩; ২০ঃ১৩৩; ২৯ঃ৫০) সেজন্যই এগুলোর নাম আয়াত হয়েছে। আয়াতগুলো উর্ধ-জগত হতে (২ঃ৯৯; ২৮ঃ৮৭) আল্লাহর নবীর নিকট (২ঃ২৫২; ৩ঃ৫৮; ৪৫ঃ৫) পাঠানো হত এবং পূর্ববর্তী নবীগনের ন্যায় (২৮ঃ৫৯) তিনিও উহা লোকদেরকে আবৃত্তি করে শোনাতেন (২ঃ১৫১; ৩ঃ১৬৪; ৬৫ঃ১১)।
আরও বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তাঁর আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা করেন, (২ঃ১৮৭) ; “তারা রাতের বেলায় আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে” (৩ঃ১১৩); “আর কাফিররা ছাড়া আমার আয়াতসমূহকে কেউ অস্বীকার করে না।” (২৯ঃ৪৭)। আবার কিছু যায়গায় গুরুত্ব বোঝানোর জন্য আয়াতসমূহের প্রতিই দৃষ্টি আকর্ষন করা হয়েছে। যেমন,”আর আমি এতে সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ নাযিল করেছি”(২৪ঃ১); “একটি কিতাব যাহা আমি পাঠাইয়াছি, যেন তাহারা ইহার আয়াতগুলি সমন্ধে চিন্তা করিতে পারে” (৩৮ঃ২১); “এগুলো প্রজ্ঞাপূর্ণ কিতাবের আয়াত” (১০ঃ১; ৩১ঃ১) ; “এগুলো সুস্পষ্ট কিতাবের আয়াত” (১২ঃ১; ২৬ঃ১; ২৮ঃ১) ; “এ হল কিতাব ও সুস্পষ্ট কুরআনের আয়াতসমূহ” (১৫ঃ১) ; “এইগুলি আল-কু’রআন ও স্পষ্ট বিবরণদানকারী” (কিতাব) (২৭ঃ১)। “একটি কিতাব যার আয়াতগুলি দৃড়রূপে প্রথিত “, (১১ঃ১, ১৩,১)। কিতাবে সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ এবং বিভিন্ন অর্থবোধক আয়াতসমূহ আছে (৩ঃ৭)। যেমন, “আমি যে আয়াত রহিত করি কিংবা ভুলিয়ে দেই, তার চেয়ে উত্তম কিংবা তার মত আনয়ন করি
” (২ঃ১০৬)। “যদি আমি এক আয়াত অন্য আয়াত দ্বারা বদল করি (১৬ঃ১০১)।
এইসব বিবরণ হতে মুহাম্মদ এর উপর অবতীর্ণ ওহীর বিষয়বস্তু সমন্ধে জানা যায় “উহা সুরক্ষিত ফলক বা লাওহ’ মাহ্’ফুজ’ হইতে অবতীর্ণ হইয়াছে” (৮৫ঃ২২)। ” ইহা একটি সুরক্ষিত পুস্তকে রহিয়াছে” (৫৬ঃ৭৯)। “ইহা আমার নিকট মূল কিতাবে রহিয়াছে” (৪৩ঃ৪; ৩ঃ৭)। আল-কুরআন সমন্ধে বলা হয়েছে, “ইহা একটি উপদেশ-গ্রন্থ যাহা সম্মানিত, উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন এবং পবিত্র পত্রসমূহে মহান ন্যায়নিষ্ঠ লেখকদের হস্তে লিপিবদ্ধ” (৮০; ১১-১৬)। ৫২ঃ৮২ আয়াতে বিস্তারিত পত্রে লিখিত কিতাবের শপথ করা হয়েছে এবং ৬৮ঃ১ -এ বলা হয়েছেঃ “কলম ও যাহা দ্বারা লেখা হয় তাহার শপথ” এবং ৯৬ঃ৪-৫ এ বলা হয়েছে “কলম দ্বারা তিনি মানবকে শিক্ষা দিয়েছেন যাহা সে জানিত না” তাঁকে আরও বলা হয়েছে, “তোমার রাব্ব- এর কিতাব হইতে যাহা তোমার প্রতি ওয়াহ্’য়িরূপে পাঠানো হইয়াছে তাহা পাঠ কর”। “আল্লাহর কথা কেহ পরিবর্তন করিতে পারে না ” (১৮ঃ২৭)। ৪ঃ১৬৪; ৪০ঃ৭৮ – এ বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাঁহাকে কতক নবীর কথা বলিয়াছেন এবং কতক নবীর কথা বলেন নাই।
রাসূল এর উপর অবতীর্ণ ওহী থেকেই উম্মুল কিতাব (৪৩ঃ৪) এর মূল বিষয়বস্তু ধারণা করে নেয়া যায়। সেগুলো হল, আল্লাহর সত্তা, বিশ্ব সৃষ্টি – বিশেষত মানব সৃজন, ভাল ও মন্দ আত্না-সমূহের সৃষ্টি, শেষ বিচার, জান্নাত,জাহান্নাম, পূর্ববর্তী নবী গনের অভিজ্ঞতা, আল্লাহর ইবাদত ও সামাজিক জীবন সম্বন্ধীয় যাবতীয় আইন-কানুন এবং বিশেষ বিশেষ আইন (৪ঃ১০৩, ১২৭,১৩৮; ৩৩ঃ৬)। বার মাসের উল্লেখ প্রসঙ্গে (৯ঃ৩৬) এবং ২২ঃ৪ -এ শয়তান কতৃক মানবকে প্রলুব্ধ করার প্রয়াস প্রসঙ্গে বিশ্ব সৃজন-তত্ত্বের আভাষ দেয়া হয়েছে। এমনকি, বিশ্বে যা কিছু সংঘটিত হয়েছে এবং সংঘটিত হবে তার সব কিছুই ঐ উম্মুল কিতাবে আছে (১০ঃ৬১; ২৭ঃ৭৫; ৩৪ঃ৩; ৬ঃ৩৮,৫৯; ১১ঃ৬; ২০ঃ৫১; ১৭ঃ৫৮)।
কুরআনের অনেকগুলি নামের মধ্যে বিশেষ চারটি নাম হল আল-কুরআন, আল-ফুরকান, আল-কিতাব ও আয-যিক্’র। ‘আল-কুরআন’ নামের অর্থ ‘যাহা পঠিত হয়’। এটি বহু আয়াত ও সূরার সংকলন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কুরআনের প্রথম আয়াতের প্রথম শব্দটি হল ‘ইকরা’-‘পাঠকর’। ‘আল-ফুরকান’ নামের অর্থ পার্থক্যকারী, সত্য ও মিথ্যার, আলো ও অন্ধকারের এবং ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্যকারী। ‘আল্-কিতাব’ অর্থ লিখিত গ্রন্থ যা যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ‘আয-যিক্’র’ নামের অর্থ উপদেশ যা আল্লাহ্-তা‘আলা স্বীয় বান্দাগণকে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের নিমিত্তে দিয়েছেন।
মুসলমানদের মতে এটি আল্লাহর বাণী বা বক্তব্য, যা ইসলামের নবী ও রাসূল মুহাম্মাদের উপর আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়। তাদের মতে এটি একটি মুজিজা বা অলৌকিক গ্রন্থ যা মানব জাতির পথনির্দেশক। মুসলমানদের বিশ্বাস, কুরআনে মানব জীবনের সকল সমস্যার সমাধান রয়েছে এবং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান।[২০]
ইতিহাস
নবীর যুগ
ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী, হেরা গুহায় অবস্থানকালে মুহাম্মাদের নিকট প্রথম কুরআনের বাণী প্রেরিত হয়। এরপর ২৩ বছর ধরে তার নিকট কুরআনের বাণী প্রেরিত হয়। হাদিস ও মুসলিম ইতিহাস অনুসারে, মুহাম্মাদ মদীনায় হিজরত করে একটি স্বাধীন মুসলিম সম্প্রদায় গঠন করার পর তিনি তাঁর অনেক সাহাবাকে কুরআন তেলাওয়াত ও এর শিক্ষা গ্রহণ করে ছড়িয়ে দিতে আদেশ দেন, যা নিয়মিত অবতীর্ণ হতো। বলা হয় যে, কিছু কুরাইশ যাদেরকে বদর যুদ্ধে বন্দী করা হয়েছিল, তারা কিছু মুসলিমকে তৎকালীন সরল লিখন পদ্ধতি শেখানোর পর তাদের স্বাধীনতা ফিরে পায়। এইভাবে মুসলমানদের একটি দল ধীরে ধীরে সাক্ষর হয়ে ওঠে। প্রাথমিকভাবে, খেজুরের ডাল, হাড় ইত্যাদিতে কুরআনের আয়াত লিখিত হয়। যাইহোক, ৬৩২ সালে মুহাম্মদের মৃত্যুর সময় কুরআন বইয়ের আকারে লিপিবদ্ধ ছিল না।[২১][২২][২৩] আলেমদের মধ্যে এ ব্যাপারে ঐকমত্য আছে যে মুহাম্মাদ নিজে আয়াতগুলো লেখেননি।[২৪]
সংকলন
মুহাম্মাদ এর জীবদ্দশায় তার তত্ত্বাবধানে প্রথম পূর্ণ কুরআন লিপিবদ্ধ হয়। কিন্তু এগুলো এক জায়গায় একত্রিত করা হয়নি। প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর এর যুগে দ্বাদশ হিজরি সালে ইয়ামামার যুদ্ধ সত্তর জন হাফেজে কুরআন শাহাদাত বরণ করেন।এতে হযরত ওমর উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি খলিফাআবু বকর কে বলেন,
“
“এভাবে জিহাদেহাফেজগনশহীদ হতে থাকলে কুরআনের অনেক অংশ বিলুপ্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে। অতএব, আপনি কুরআন মাজিদ একত্রে সংকলনের ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।”
”
প্রথমে আবু বকর রাজি না হলেও ওমর এর অনুরোধে রাজি হন। কুরআন সংরক্ষণের এ দ্বায়িত্ব মুহাম্মাদ এর সময়ের ওহি লেখক সাহাবি যায়েদ ইবনে সাবিত এর উপর প্রদান করা হয়।
যায়েদ ইবনে সাবিত নিজে হাফেজে কুরআন ছিলেন। তিনি কুরআন সংকলন করার ব্যাপারে দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করেন। একটি হলো-কুরআনের আয়াতটি সংশ্লিষ্ট সাহাবা মুখস্থ বলবেন, অপরটি হলো তিনি মুহাম্মাদ এর সময়ে লিখিত ঐ আয়াতটি প্রদর্শন করবেন। তিনি লিখিত ছাড়া কুরআনের আয়াত সত্যায়নের জন্য যথেষ্ট মনে করেননি। তিনি বহু যাচাই বাছাই করার পর সাহাবায়ে কেরামের নিকট রক্ষিত মুহাম্মাদ এর জীবদ্দশায় লিখিত বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি থেকে সে সময়ের আবিষ্কৃত বিশেষ কাগজে গ্রন্থাকারে কুরআন লিপিবদ্ধ (যা সউফ নামে পরিচিত[২৫]) করেন। লিপিবদ্ধ কুরআনটি হযরত আবু বকর এর তত্ত্বাবধানে রাখা হয়। তার ওফাতের পর এটি হযরত ওমর এর হেফাজতে থাকে। তার শাহাদাতের পর তারই ওসিয়ত অনুসারে কুরআনের এ প্রতিলিপিটি মুহাম্মাদ এর স্ত্রী বিবি হাফসা এর নিকট গচ্ছিত থাকে। তৃতীয় খলিফাউসমান এর যুগে ইসলামি সম্রাজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। ইসলামের এ প্রসারের ফলে বিভিন্ন জাতি ও ভাষাভাষী লোকেরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে। তাদের অনেকেই কুরআনের গঠন পদ্ধতি অনুসরণ করে কুরআনের বিশেষ শব্দ উচ্চারণ করতে পারত না। বিশেষ করে আরমেনিয়া এবং আজারবাইজান যুদ্ধে সমবেত মুসলমানদের কুরআন পাঠ পদ্ধতির বিভিন্নতা দেখে বিশিষ্ট সাহাবিহুযাইফা, খলিফাউসমান কে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করেন। তিনি অবিলম্বে এ নিয়ে নেতৃস্থানীয় সাহাবাদের সাথে পরামর্শ করে চার জন বিশিষ্ট সাহাবা সমন্বয়ে একটি বোর্ড গঠন করেন। এ চার জন সাহাবা হচ্ছেন-
হযরত উসমান এর উদ্যোগে হিজরি ২৪ সালে শেষবারের মতো কুরআন সংকলনের এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ বোর্ড হযরত হাফসা এর নিকট সংরক্ষিত মূল কপিটি সংগ্রহ করেন।[২৭][২৮] উক্ত বোর্ড পূর্বলিখিত প্রতিলিপিটি অনুসরণ করে পাঠ ও উচ্চারনের বিভিন্নতা দূর করার জন্য শুধু কুরাইশি উচ্চারণ ও ভাষায় তার আরও সাতটি প্রতিলিপি প্রস্তুত করেন। বর্ণিত আছে যে, সাতটি প্রতিলিপি তৈরি করে মক্কা, শাম, ইয়েমেন,বাহরাইন, বসরা ও কুফা প্রদেশে একটি করে প্রেরণ করা হয়। আর রাজধানী মদিনাতে একটি কপি খলিফার নিকট সংরক্ষিত রাখা হয়।[২৯] এরপর বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য বিক্ষিপ্তভাবে সংরক্ষিত প্রতিলিপিগুলো সকলের কাছ থেকে সংগ্রহ করে বিনষ্ট করে দেওয়া হয়।[৩০] এভাবে ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান রা.-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পবিত্র কুরআন সংকলিত ও বিভিন্ন প্রদেশে প্রেরিত হয় বিধায় তাকে “جمع القرآن ” বা কুরআন সংগ্রহকারী বলা হয়।
ইসলামী পরিভাষা অনুযায়ী, কুরআনের অলৌকিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এই বিশ্বাসকে ইজায বলা হয়। মুসলমানরা বিশ্বাস করে আল কুরআন একটি ঐশ্বিক গ্রন্থ যা কোনো মানুষের পক্ষে রচনা করা সম্ভব নয় ও যা কিয়ামতের দিন পর্যন্ত কার্যকর এবং এর মাধ্যমে এই গ্রন্থ মুহাম্মাদের নবীত্বের মর্যাদার অনুমোদনে প্রদত্ত মূল প্রমাণ। কুরআনেই অননুকরণীয়তা ধারণাটির উৎপত্তি, যেখানে পাঁচটি ভিন্ন আয়াতে এর বিরোধীদের কুরআনের মত কিছু তৈরী করতে আহ্বান করা হয়: “যদি এই কুরআনের অনুরূপ কুরআন রচনা করার জন্য মানুষ ও জ্বীন সমবেত হয় এবং তারা পরস্পরকে সাহায্য করে তবুও তারা এর অনুরূপ কুরআন রচনা করতে পারবেনা।”[৩১] নবম শতাব্দী থেকে অসংখ্য রচনা প্রকাশিত হয়েছে যাতে কুরআন ও এর শৈলী ও বিষয়বস্তু নিয়ে অনুসন্ধান করা হয়েছে। আল জুরজানি (মৃত্যু ১০৭৮) ও আল বাকিলানি (মৃত্যু ১০১৩) সহ মধ্যযুগীয় মুসলিম পণ্ডিতেরা এই বিষয়ে লিখেছেন, এর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং কুরআন অধ্যয়নের জন্য ভাষাগত পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। এছাড়াও অন্যরা বলেছেন যে কুরআনে মহৎ ধারণা আছে, অন্তর্নিহিত অর্থ আছে, এই গ্রন্থ যুগ যুগ ধরে এর সতেজতা বজায় রেখেছে এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং ইতিহাসে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। কিছু পণ্ডিত বলেন যে কুরআনে বৈজ্ঞানিক তথ্য আছে যা আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কুরআনের অলৌকিকতার মতবাদ প্রমাণে মুহাম্মাদের নিরক্ষরতার উপর আরও জোর দেওয়া হয় যেহেতু নিরক্ষর মুহাম্মাদের পক্ষে এই গ্রন্থ রচনা মোটেই সম্ভব নয়।[৩২][৩৩]
নামাজে কুরআন তেলাওয়াত
নামাজে বিশুদ্ধভাবে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করা আবশ্যক। নামাজে কিরাআত তিলাওয়াতের বিষয়াবলী জানা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য দায়িত্ব। ফরজ নামাজের প্রথম দুই রাকাআতে সুরা ফাতিহার সঙ্গে সুরা মিলানো ওয়াজিব। কমপক্ষে তিন আয়াত বা তিন আয়াতের সমপরিমাণ বড় এক আয়াত তিলাওয়াত করতে হবে।
ইসলামী শিল্পকলায়
এছাড়াও কুরআন ইসলামী শিল্প ও বিশেষ করে তথাকথিত কুরআনী চারুলিপি ও চিত্রায়নের পদ্ধতিকে অনুপ্রাণিত করেছে।[৩৪] কুরআনে কখনোই চিত্র ব্যবহার করা হয়নি তবে অনেক কুরআনে পাতার প্রান্তে, সূরার মাঝখানে বা শুরুতে বিভিন্ন ধাঁচে অলঙ্করণ করে সজ্জিত করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন স্থাপনা, মসজিদের বাতি, ধাতব বা মৃৎপাত্রে কুরআনের আয়াত মুদ্রিত হয়েছে।
কুরআনের নাযিল হওয়া প্রথম চার আয়াত; ৯৬তম সূরা আলাক
কুরআনে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের মোট ১১৪টি সূরা রয়েছে। সকল সূরা মিলিয়ে মোট আয়াতের (আয়াত আরবি শব্দ, এর সাহিত্যিক অর্থ নিদর্শন) সংখ্যা প্রায় ৬,২৩৬ (মতান্তরে ৬৩৪৮টি অথবা ৬৬৬৬টি)।[৩৫] প্রত্যেকটি সূরার একটি নাম রয়েছে। নামকরণ বিভিন্ন উপায়ে করা হয়েছে; তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সূরার অভ্যন্তরে ব্যবহৃত কোনো শব্দকেই নাম হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া এমন নামও পাওয়া যায় যা সূরার অভ্যন্তরে ব্যবহৃত হয় নি যেমন সূরা ফাতিহা। ফাতিহা শব্দটি এ সূরার কোথাও নেই। সূরাগুলোর একটি সুনির্দিষ্ট সজ্জা রয়েছে। সজ্জাকরণ তাদের অবতরণের ধারাবাহিকতা অনুসারে করা হয় নি। বরং দেখা যায় অনেকটা বড় থেকে ছোট সূরা অনুযায়ী সাজানো। অবশ্য একথাও পুরোপুরি সঠিক নয়। সজ্জার প্রকৃত কারণ কারও জানা নেই। অনেক ক্ষেত্রে বড় সূরাও ছোট সূরার পরে এসেছে। তবে একটি সূরা বা তার বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে ধারাবাহিকতার সাথেই অবতীর্ণ হয়েছিল বলে মুসলমানদের ধারণা। কুরআনের সজ্জাটি মানুষের মুখস্থকরণের সুবিধার সৃষ্টি করেছে।
হিজ্ব বা মানজিল হচ্ছে কুরআনের প্রথম সূরা (সূরা ফাতিহা) ব্যতীত অন্য সূরাগুলো নিয়ে করা একটি শ্রেণি। হিজ্ব মুফাস্সিল একটি গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করা। এতে ৭টি মানজিলের মাধ্যমে সবগুলো সূরাকে একসাথে করা হয়েছে।[৩৬] মানজিলগুলো হচ্ছে:
মানজিল ১ = ৩ টি সূরা, যথা, ২—৪
মানজিল ২ = ৫ টি সূরা, যথা, ৫—৯
মানজিল ৩ = ৭ টি সূরা, যথা, ১০—১৬
মানজিল ৪ = ৯ টি সূরা, যথা, ১৭—২৫
মানজিল ৫ = ১১ টি সূরা, যথা, ২৬—৩৬
মানজিল ৬ = ১৩ টি সূরা, যথা, ৩৭—৪৯
মানজিল ৭ = ৬৫ টি সূরা, যথা, ৫০—১১৪
কুরআনে মোট ৩০ টি পারা বা অধ্যায় রয়েছে। ১১৪টি পূর্নাঙ্গ সূরা রয়েছে। সূরাগুলো বিভিন্ন আকারের হলেও কুরআনের পারাগুলো প্রায় সমান আকারের। কুরআন মুখস্থকরণের ক্ষেত্রে সাধারণতম পারা অনুযায়ী শিক্ষা করানো হয়। যে সকল স্থানে সমগ্র কুরআন পাঠের আয়োজন করা হয় সেখানেও এই পারা অনুযায়ী করা হয়।
বিষয়বস্তু
কুরআনের বিষয়বস্তু আল্লাহর অস্তিত্ব এবং পুনরুত্থান সহ মৌলিক ইসলামী বিশ্বাসসমূহ বর্ণনা করে। পূর্বের নবিগণের বিবরণ, নৈতিক ও আইনগত বিষয়, মুহাম্মাদের সময়ের ঐতিহাসিক ঘটনা, দানশীলতা ও নামাজের কাহিনীও কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। কুরআনের আয়াতে ঠিক-বেঠিক সম্পর্কে সাধারণ উপদেশ রয়েছে এবং এতে বর্ণিত ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো সাধারণ নৈতিক পাঠের রূপরেখা প্রদান করে। প্রাকৃতিক ঘটনা সম্পর্কিত আয়াতগুলোকে মুসলিমরা কুরআন এর বার্তার সত্যতার ইঙ্গিত হিসাবে ব্যাখ্যা করে।[৩৭]
একেশ্বরবাদ
কুরআনের কেন্দ্রীয় ধারণা হলো একেশ্বরবাদ। আল্লাহ জীবন্ত, শাশ্বত, সর্বব্যাপী এবং সর্বশক্তিমান হিসেবে বর্ণিত (দেখুন কুরআন ২:২০, ২:২৯, ২:২৫৫)। আল্লাহর শক্তিমত্তা তার সৃষ্টির ক্ষমতায় সর্বোপরি আবির্ভূত হয়। তিনি নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর স্রষ্টা (দেখুন কুরআন ১৩:১৬, ২:২৫৩, ৫০:৩৮ ইত্যাদি)। কুরআন এর মতে আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ নির্ভরতার দিক দিয়ে সকল মানুষ সমান এবং এই সত্যকে স্বীকার করা ও তদনুযায়ী জীবন পরিচালনার মধ্যেই মানুষের কল্যাণ নিহিত।
কুরআনে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য বিভিন্ন আয়াতে সৃষ্টিতাত্ত্বিক যুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ,মহাবিশ্ব প্রবর্তিত হয়েছে সুতরাং এর একজন প্রবর্তক প্রয়োজন এবং যা কিছু বিদ্যমান, সবকিছুর অস্তিত্বের জন্যই একটি যথার্থ কারণ থাকতে হবে। এছাড়া, এক্ষেত্রে মহাবিশ্বের কথাও প্রায়ই উল্লেখ করা হয়েছে: “যিনি সাত আসমান স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। পরম করুণাময়ের সৃষ্টিতে তুমি কোন অসামঞ্জস্য দেখতে পাবে না। তুমি আবার দৃষ্টি ফিরাও, কোন ত্রুটি দেখতে পাও কি?”[৩৮][৩৯]
পরলোকতত্ত্ব
নবীগণ
নৈতিকতাত্ত্বিক ধারণা
বিজ্ঞানের জন্য উৎসাহ
সাহিত্যিক গঠন
ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি সাহিত্য এবং ইসলাম শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক ইসা বাউলাতা কুরআনের সাহিত্যিক গঠনপ্রণালি সম্বন্ধে নিম্ন প্রকারের মন্তব্য করেছেন।[৪০]
“
কুরআনের বার্তাগুলো বিভিন্ন সাহিত্যিক গঠনে প্রকাশিত হয়েছে, যা আরবি সাহিত্যের সবচেয়ে নিখুঁত লিখিত রচনা হিসেবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। কুরআনের ভাষার উপর ভিত্তি করেই আরবি ব্যাকরণ রচিত হয়েছে, এবং মুসলিম অলঙ্কার শাস্ত্রবিদদের বর্ণনামতে, কুরআনের বাগধারাগুলো ভীষণ সুন্দর এবং মহিমান্বিত হিসেবে বিবেচিত হয়… উপসংহারে একথা বলা যেতে পারে যে, কুরআন এর বার্তা প্রকাশ করার নিমিত্তে বিপুল প্রকার ও শ্রেণির সাহিত্যিক উপাদানের সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছে।
”
কুরআনের ব্যাখ্যা কোরআন নিজেই দেয়।
ব্যাখ্যা
কুরআনের আয়াতের অর্থ, ব্যাখ্যা এবং তাদের তাৎপর্য খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ভাষ্য প্রকাশিত হয়েছে যাকে তাফসীর বলা হয়। তাফসীর মুসলিমদের প্রাচীনতম কেতাবি কার্যক্রমগুলির একটি। কুরআন অনুসারে, মুহাম্মাদ প্রথম ব্যক্তি যিনি মুসলমানদের জন্য আয়াতের অর্থ বর্ণনা করেন।[৪১] অন্যান্য প্রারম্ভিক দৃষ্টান্তের মধ্যে কয়েকজন সাহাবা যেমন আবু বকর, উমর ইবনুল খাত্তাব, উসমান ইবন আফফান, আলী, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, উবাই ইবনে কাব, জায়েদ ইবনে সাবিত, আবু মুসা আশয়ারী এবং আবদুল্লাহ ইবনুল জুবায়ের।[৪২] সে সময় ব্যাখ্যা-পদ্ধতি, আয়াতের সাহিত্যিক দিকগুলির ব্যাখ্যা, এর শানে নুযূল এবং মাঝে মাঝে অন্য আয়াতের সাহায্যে কোনো আয়াতের ব্যাখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। যদি আয়াতটি কোন ঐতিহাসিক ঘটনা সম্বন্ধীয় হয়, তাহলে কখনও কখনও মুহাম্মাদ এর কিছু হাদিস বর্ণনা করে এর অর্থ স্পষ্ট করা হতো।[৪৩]
যেহেতু কুরআন ধ্রুপদী আরবী ভাষায় উচ্চারিত হয়, পরবর্তী ধর্মান্তরিতদের অনেকেই (অধিকাংশই অ-আরব) সবসময় কুরআন এর আরবি বুঝতো না, আরবী ভাষায় সাবলীল ব্যক্তির কাছে যেসব অভিব্যক্তি সুস্পষ্ট তা তারা বুঝতে সক্ষম ছিলো না। আরবী ভাষার ভাষ্যকাররা এই অভিব্যক্তিগুলো ব্যাখ্যা করেছেন এবং মুহাম্মাদের নবীত্বের শুরুতে কোন আয়াতগুলো প্রকাশিত হয়েছে, যা প্রাচীনতম মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য উপযুক্ত, এবং কোনগুলো পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়েছে তা চিহ্নিত করেছেন, এর ভিত্তিতে পুরাতন পাঠ্যগুলো (মানসুখ) বাতিল (নাসিখ) করা হয়েছে।[৪৪][৪৫] তবে অন্যান্য কিছু আলেমগণ মনে করেন যে কুরআনের কোন আয়াত বাতিল করা হয়নি।[৪৬]
কুরআন অনুবাদ করা সবসময়ই সমস্যাজনক এবং জটিল বলে প্রমাণিত হয়েছে। অনেকে বলেন যে কুরআনের পাঠ্য অন্য ভাষায় রূপান্তর করা সম্ভব নয়।[৪৭] উপরন্তু, প্রেক্ষাপটের উপর নির্ভর করে একটি আরবি শব্দের বিভিন্ন অর্থ থাকতে পারে, যা একটি যথাযথ অনুবাদ প্রাপ্তির সম্ভাবনাকে আরও কঠিন করে তোলে।[৪৮]
তা সত্ত্বেও, কুরআন অধিকাংশ আফ্রিকান, এশীয় এবং ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদিত হয়েছে।[৩২] ইসলামের প্রথম যুগে, সপ্তম শতাব্দীতে, সালমান আল-ফারসি সূরা ফাতিহাকে ফারসি ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে সর্বপ্রথম কুরআন অনুবাদের সূচনা করেন।[৪৯] ইতোপূর্বে মুহাম্মাদ, আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাশী বা নিগাস ও বাইজেন্টাইনের সম্রাট হিরাক্লিয়াসের নিকট পাঠানো চিঠিতে কুরআনের আংশিক অনুবাদ প্রেরণ করেন।[৪৮] হিন্দু রাজা মেহরুকের অনুরোধে আবদুল্লাহ বিন উমর বিন আব্দুল আজিজের নির্দেশে ৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে আলওয়ারে (সিন্ধু, ভারত, বর্তমানে পাকিস্তান) ভারতীয় উপমহাদেশের অধিবাসীদের জন্য কুরআনের আরেকটি অনুবাদ সম্পন্ন হয়।[৫০]
কুরআনের প্রথম সম্পূর্ণ অনুবাদ ফার্সি ভাষায় ১০ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে সম্পন্ন করা হয়। সামানি সম্রাট প্রথম মনসুরের শাসনামলে (৯৬১-৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ), তার উদ্যোগে, খোরাসানের একদল পণ্ডিত আরবী ভাষায় লিখিত তাফসির আল-তাবারী কে ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেন। পরবর্তীতে একাদশ শতাব্দীতে আবু মনসুর আব্দুল্লাহ আল-আনসারির একজন ছাত্র ফার্সি ভাষায় কুরআনের একটি সম্পূর্ণ তাফসীর লেখেন। দ্বাদশ শতাব্দীতে, নাজম আল-দীন আবু হাফস আল-নাসাফি ফার্সি ভাষায় কুরআন অনুবাদ করেন। তিনটি বইয়ের পাণ্ডুলিপিই পরবর্তীতে বেশ কয়েকবার প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৩৬ সাল পর্যন্ত ১০২ টি ভাষায় কুরআন অনুবাদিত হয়েছিল।[৪৮] বর্তমানে পৃথিবীর প্রধান ভাষাগুলোর প্রায় সবগুলোতেই কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ রয়েছে। ২০১০ সালে তেহরানে অনুষ্ঠিত ১৮তম আন্তর্জাতিক কুরআন প্রদর্শনীতে ১১২টি ভাষায় অনুবাদিত কুরআন উপস্থাপিত হয়।[৫১]
১১৪৩ খ্রিস্টাব্দে পিটার দ্য ভেনারেবল এর জন্য লাতিন ভাষায় রবার্ট কেটন এর করা কুরআন এর অনুবাদটি পাশ্চাত্য ভাষায় কুরআন এর প্রথম অনুবাদ ছিল।[৫২] ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি ভাষায় আন্দ্রে দু রায়ার এর অনুবাদটি ব্যবহার করে ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে আলেকজানডার রস্ কুরআনের প্রথম ইংরেজী অনুবাদটি সম্পন্ন করেন। ১৭৩৪ সালে জর্জ সেল কুরআনের প্রথম পাণ্ডিত্যপূর্ণ অনুবাদ ইংরেজিতে প্রকাশ করেন; আরেকটি ১৯৩৭ সালে রিচার্ড বেল কর্তৃক এবং আরও একটি ১৯৫৫ সালে আর্থার জন আর্বেরি কর্তৃক প্রকাশিত হয়। এই সকল অনুবাদকেরাই অমুসলিম ছিলেন। মুসলিমদের দ্বারাও ইংরেজিতে কুরআন অনুবাদিত হয়েছে। আধুনিক ইংরেজিতে মুসলিম অনুবাদকদের প্রকাশিত কুরআন এর মধ্যে রয়েছে দ্য অক্সফোর্ড ওয়ার্ল্ড ক্লাসিক কর্তৃক প্রকাশিত মুহাম্মাদ আবদেল হালিম এর অনুবাদ, ড. মুস্তাফা খাত্তাব এর অনুবাদ দ্য ক্লিয়ার কুরআন, সহিহ ইন্টারন্যাশনাল অনুবাদ ইত্যাদি।
পাঞ্জাবের মোগা জেলায় কুরআন এর প্রাচীনতম গুরমুখী অনুবাদ পাওয়া গিয়েছে, যা ১৯১১ সালে মুদ্রিত হয়েছিল।[৫৩]
আন্তঃরৈখিক ফার্সি অনুবাদসহ ইলখানাত যুগের আরবী কুরআন।
১৬৪৭ সালে ইউরোপীয় ভাষায় প্রথম মুদ্রিত কুরআন।
জার্মান ভাষায় কুরআন এর প্রথম অনুবাদের নামপত্র।
চীনা ভাষায় কুরআন এর অনুবাদে সূরা ইয়াসীনের আয়াত ৩৩ ও ৩৪।
কুরআনের যথাযথ তেলাওয়াত হলো তাজবিদ নামের একটি পৃথক শৃঙ্খলার বিষয় যা কীভাবে কুরআন তেলাওয়াত করা উচিত, প্রতিটি স্বতন্ত্র বর্ণনামূলক উচ্চারণ কীভাবে করা উচিত, যে স্থানে বিরতি থাকা উচিত সেখানে মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজন, উচ্চারণের ক্ষেত্রে যেখানে উচ্চারণটি দীর্ঘ বা সংক্ষিপ্ত হওয়া উচিত, যেখানে বর্ণগুলি এক সাথে শোনা উচিত এবং যেখানে সেগুলি পৃথক রাখা উচিত ইত্যাদি বিষয়গুলি বিশদভাবে নির্ধারণ করে। বলা যেতে পারে যে, এই অনুশাসনটি কুরআনের সঠিক তেলাওয়াতের আইন ও পদ্ধতিগুলি অধ্যয়ন করে এবং তিনটি মূল ক্ষেত্রকে অন্তর্ভুক্ত করে: ব্যঞ্জনধ্বনি এবং স্বরধ্বনির যথাযথ উচ্চারণ (কুরআনীয় ধ্বনির উচ্চারণ), আবৃত্তিতে বিরতি দেওয়ার নিয়ম এবং পুনরায় শুরুকরণের নিয়ম, এবং আবৃত্তির বাদ্যযন্ত্র এবং সুমধুর বৈশিষ্ট্য।[৫৪]
কুরআনের ভুল তেলাওয়াত এড়াতে, তেলাওয়াতকারীরা একজন উপযুক্ত শিক্ষকের সাথে প্রশিক্ষণের একটি প্রোগ্রাম অনুসরণ করেন। তাজবিদ বিধিগুলির জন্য উল্লেখ হিসাবে ব্যবহৃত দুটি জনপ্রিয় গ্রন্থ হলো ইবনে আল-জাজারি রচিত মাতন আল-জাজারিয়াহ[৫৫] এবং সুলায়মান আল জামজুরি রচিত তুহফাত আল-আতফাল।
মুরাত্তাল, যা ধীর গতিতে, অধ্যয়ন এবং অনুশীলনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
মুজাওয়াদ, একটি ধীর তিলাওয়াতকে বোঝায় যা প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞদের দ্বারা জনসাধারণের পরিবেশনার মতো উচ্চতর প্রযুক্তিগত শৈল্পিকতা এবং সুরেলা মড্যুলেশন স্থাপন করে।[৬০]
বৈকল্পিক পাঠ
লিখন ও মুদ্রণ
লিখন
১৯ শতকে ব্যাপকভাবে মুদ্রণ প্রচলিত হওয়ার পূর্বে, কুরআন ক্যালিগ্রাফার ও অনুলিপিকারীদের তৈরিকৃত অনুলিপির মাধ্যমেই হস্তান্তরিত হতো। প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপিগুলো হেজাজি লিপিতে লেখা হয়েছিল। হেজাজি শৈলীর পাণ্ডুলিপি অন্তত এটা নিশ্চিত করে যে লিখিতভাবে কোরআন এর প্রসার প্রাথমিক পর্যায়েই শুরু হয়েছিল। সম্ভবত নবম শতাব্দীতে, লেখাগুলোতে পুরু রেখার ব্যবহার শুরু হয়, যা ঐতিহ্যগতভাবে কুফিক লিপি নামে পরিচিত। নবম শতাব্দীর শেষের দিকে, কুরআনের অনুলিপিগুলোতে নতুন ধরণের লিপি আবির্ভূত হতে শুরু করে যা পূর্ববর্তী লিপিকে প্রতিস্থাপন করে। পূর্ববর্তী শৈলীর ব্যবহার বন্ধ করার কারণ ছিল যে, ঐ পদ্ধতিতে অনুলিপি তৈরী করতে অনেক সময় লাগতো কিন্তু সেসময় অনুলিপির চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছিল। অনুলিপিকারীরা তাই লেখার সহজ শৈলীটিই বেছে নেয়। একাদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে, ব্যবহৃত শৈলী ছিল প্রাথমিকভাবে নাসখ, মুহাক্কাক, রায়হানি এবং কিছু বিরল ক্ষেত্রে সুলুস লিপি। নাসখ খুব ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। উত্তর আফ্রিকা এবং ইবেরিয়াতে, মাগরিবি শৈলী অধিক জনপ্রিয় ছিল। আরও স্বতন্ত্র হলো বিহারী লিপি যা শুধুমাত্র ভারতের উত্তরাঞ্চলেই ব্যবহৃত হয়েছিল। নাস্তালিক শৈলী ফার্সি বিশ্বে খুব কমই ব্যবহৃত হয়।[৬১][৬২]
শুরুতে, কুরআন বিন্দু বা হরকত সহ লেখা হতো না। এই বৈশিষ্ট্য সর্বশেষ সাহাবাহদের জীবদ্দশার শেষ পর্যায়ে যোগ করা হয়। যেহেতু অধিকাংশ মুসলিমদের জন্যই পাণ্ডুলিপি কেনা খুবই ব্যয়বহুল ছিল, তাই কুরআনের কপিগুলো মসজিদে রাখা হতো যাতে তা জনগণের কাছে সুলভ হয়। উৎপাদনশীলতার দিক থেকে, উসমানীয় অনুলিপিকারীরাই সর্বোত্তম নিদর্শন তৈরী করে। এর কারণ ছিল ব্যাপক চাহিদা, মুদ্রণ পদ্ধতির অজনপ্রিয়তা এবং নান্দনিকতা।[৬৩][৬৪]
এই অনুচ্ছেদটি খালি।আপনি এখানে যোগ করে সাহায্য করতে পারেন।
অন্যান্য ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থের সঙ্গে সম্পর্ক
রানী বিলকিসের ‘রাজা সুলাইমানের কাছে সফর’। এডওয়ার্ড পয়েন্টার, ১৮৯০। তাওরাতের মতে, সুলাইমান ছিলেন একজন রাজা, যার সাতশত স্ত্রী এবং তিনশত উপ-পত্নী তার বৃদ্ধ বয়সে পথভ্রষ্ট হয় এবং মূর্তি পূজা শুরু করে[৬৫]। তাকে কুরআনে একজন রাজা-নবী-শাসক ও জ্বিন এবং প্রকৃতির শাসক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কিছু অমুসলিম দল যেমন বাহাই এবং দ্রুজরা কোরআনকে পবিত্র মনে করে। একেশ্বর সার্বজনীনবাদীরাও কুরআন থেকে অনুপ্রেরণা চাইতে পারেন। কুরআনের সাথে ডায়াতেসারন, জেমসের প্রোটোয়েভেঞ্জেলিয়াম, ইনফ্যান্সি গসপেল অব থমাস, স্যুডো-ম্যাথিউ গসপেল এবং আরবী ইনফ্যান্সি গসপেলের সাথে কিছু আখ্যানের মিল রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।[৬৬][৬৭][৬৮] একজন পণ্ডিত পরামর্শ দিয়েছেন যে একটি গসপেল হারমনি হিসেবে ডায়াতেসারনকে ক্রিশ্চিয়ান গসপেলের একটি পাঠ্য হিসেবে ধারণা করা হয়েছে।[৬৯]
বাইবেল
“
তিনি সত্যসহ তোমার প্রতি গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন, যা পূর্ববর্তী বিষয়ের সত্যতা প্রতিপাদনকারী। এবং এর পূর্বে তাওরাত ও ইঞ্জীল অবতীর্ণ করেছিলেন।[৭০]
”
কুরআনে পূর্বের কিতাবগুলোর (তওরাত ও ইঞ্জিল) সাথে তার সম্পর্ককে তাদের অনন্য উৎপত্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে যে এগুলো সবই এক আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ হয়েছে।[৭১]
ক্রিস্টোফ লাক্সেনবার্গের (দ্য সিরো-আরামাইক রিডিং অব দ্য কোরান বইয়ে) মতে কুরআনের ভাষা সিরিয়াক ভাষার অনুরূপ ছিল। কুরআনে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের পবিত্র বই (তানাক, বাইবেল) এবং ভক্তিমূলক সাহিত্যে বর্ণিত অনেক মানুষের কাহিনী এবং ঘটনার বর্ণনা রয়েছে, যদিও এর বিস্তারিত বিবরণের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।[৭২]অ্যাডাম, এনোচ, নূহ, ইবার, শেলা, অব্রাহাম, লূত, ইসমাইল, ইস্ হাক, যাকোব, যোষেফ, জেথ্রো, দায়ূদ, শলোমন, এলিয়, ইলীশায়, যোনা, হারোণ, মোশি, জাকারিয়া, বাপ্তিস্মদাতা ও যীশুকে ঈশ্বরের নবী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বস্তুত, কুরআনে অন্য যে কোন ব্যক্তির তুলনায় মূসাকে বেশি উল্লেখ করা হয়েছে।[৭৩] ঈসাকে মুহাম্মদ (সাঃ) এর চেয়ে বেশি উল্লেখ করা হয় (মুহাম্মদ নামকে প্রায়ই “নবী” বা “রসূল” বলে উল্লেখ করা হয়), অন্যদিকে মরিয়মকে নতুন টেস্টামেন্টের চেয়ে কুরআনে বেশি উল্লেখ করা হয়েছে।[৭৪]
^[টী১] সাহিত্যিক আরবি উচ্চারণ আঞ্চলিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। প্রথম স্বরের শব্দ “ও” বা “উ” হতে পারে, আর দ্বিতীয় স্বরের শব্দ “অ্যা” বা “আ” হতে পারে। উদাহরণে : মিশরে উচ্চারণ হবে “কোর’আন” আর সংযুক্ত আরব আমিরাতে উচ্চারণ হবে “কুর’অ্যান”।
কাবা, কাবাঘর, কাবা শরীফ (আরবি: الكعبة al-Ka‘bah; আ-ধ্ব-ব: [‘kɑʕbɑ]), আরও যে নামে পরিচিত al-Kaʿbatu l-Mušarrafah (الكعبة المشرًّفة), al-Baytu l-ʿAtīq (البيت العتيق “আদিম বাড়ি”), অথবা al-Baytu l-Ḥarām (البيت الحرام “পবিত্র বাড়ি”), একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত, যা সৌদি আরবেরমক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।
ইসলাম ধর্ম মতে কাবা কে সবচেয়ে পবিত্র স্থান হিসেবে মনে করা হয়।[১] এটি মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ তারা যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে। পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ পরেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।[১]
কাবা কালো সিল্কের উপরে স্বর্ণ-খচিত ক্যালিগ্রাফি করা কাপড়ের গিলাফে আবৃত থাকে। কাপড়টি কিসওয়াহ নামে পরিচিত ; যা প্রতিবছর পরিবর্তন করা হয়।[২][৩] এ কাপড়ের মধ্যে সুতা দিয়ে কালেমা শাহাদাত লিখা হয়। এর দুই তৃতীয়াংশ স্থাণে কোরানের বাণী স্বর্ণ দিয়ে এম্রোয়ডারি করা হয়।
কিবলা
কিবলা হচ্ছে নামাজের জন্য মুসলমানদের যেদিকে মুখ করা দাঁড়াতে হয়, সেই দিকটি। অনেক ধর্মেই উপাসনার জন্য কোনো নির্দিষ্ট দিক থাকে। সেরকমই মুসলমানদের জন্য কিবলা হচ্ছে মক্কায় অবস্থিত মসজিদুল হারাম, যা কাবা শরিফ নামে বেশি পরিচিত। তবে মজার ব্যাপার হলো, প্রথমে কাবা শরিফ কিবলা ছিল না। বরং প্রথম কিবলা ছিল জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসা। মদীনায় হিজরতের ষোল মাস পর কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী কিবলা পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানের কিবলা অর্থাৎ কাবা শরীফ কিবলা হিসেবে নির্ধারিত হয়।
তাওয়াফ
তাওয়াফ হল ঘড়ির কাটার বিপরীতমুখী হয়ে কাবা ঘরের চারপাশে ৭ বার প্রদক্ষিণ করা। কাবার চারদিকে একত্রে ঘুরন্ত মুসলমানেরা এক আল্লাহ্র নামে একাত্মতা প্রকাশ করার জ্বলন্ত উদাহরণ । তাওয়াফ শুরুর পূর্বে হাজারে আসওয়াদে চুমু দেয়ার নিয়ম। তবে ভিড়ের কারণে এর কাছে যাওয়া সম্ভব না হলে হাত দিয়ে ইশারা করে তাওয়াফ শুরু করতে হয়।
হজের গুরুত্বপূর্ণ রোকন তাওয়াফ। তাছাড়া হজ নির্দিষ্ট ৫ দিনে সম্পন্ন হয়। কিন্তু হজের সফরে হাজিগণ দীর্ঘ দিন মক্কায় অবস্থান করে। এ সময়ে প্রতিনিয়ত তাঁরা তাওয়াফ করবেন।
তাওয়াফের অনেক ফজিলত রয়েছে। সে কারণেই তাওয়াফ যেন সঠিক এবং সহিহ হয়ে সে জন্য তাওয়াফের নিয়ম-কানুন জানা জরুরি। তাই ধারাবাহিকভাবে পবিত্র কাবা শরিফ তাওয়াফ করার পদ্ধতি তুলে ধরা হলো-
তাওয়াফ শুরুর স্থান পবিত্র কাবা শরিফের যে কোনায় হাজরে আসওয়াদ স্থাপিত, সেই কোনা থেকে মাতআফের (তাওয়াফের জায়গার) ওপর দিয়ে মসজিদে হারামের দিকে একটা দাগ দিয়ে চিহ্নিত করে দেয়া আছে এবং কাবা শরিফের গিলাফের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত আরবিতে ‘আল্লাহু আকবার’ শব্দের ক্যালিগ্রাফি খচিত লেখা রয়েছে। সে বরাবর দাগের ওপর দাঁড়ানো।
তাওয়াফ শুরু করার আগে হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করা অথবা স্পর্শ করা; সম্ভব না হলে দাগের ওপর দাঁড়িয়ে চলা শুরু করার সময় নামাজের নিয়ত বাঁধার মতো করে উভয় হাত কাঁধ পর্যন্ত হাত উঠিয়ে হাজরে আসওয়াদের দিকে ইশারা করে মুখে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার` বলে চক্কর দেয়া শুরু করা।
যেদিকে যাবে হাজরে আসওয়াদ থেকে পবিত্র কাবা শরিফের দরজার দিকে অগ্রসর হওয়া। এর পর হাতিমে কাবা বাহিরে দিয়ে রুকনে শামি ও ইরাকি অতিক্রম করে রুকনে ইয়ামেনি বরাবর এসে তা স্পর্শ করা। যদি সম্ভব না হয়ে তবে হাতে ইশারা করা।
রুকনে ইয়ামেনি থেকে হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত আসতে এই দোয়া পড়া-‘রাব্বানা আতিনা ফিদ দুনইয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতে হাসানাতাও ওয়া ক্বিনা আ’জাবান নার।’ অর্থাৎ ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়া এবং পরকালের কল্যাণ দান করুন এবং জাহান্নামের আগুণ থেকে মুক্তি দান করুন।’
হাজরে আসওয়াদের কোনায় এসে আগের মতো আবারো স্পর্শ বা ইশারার মাধ্যমে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে চক্কর শুরু করা। এভাবে সাত চক্করের মাধ্যমে তাওয়াফ সম্পন্ন করা।
তাওয়াফ আদায়কালে যে বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখতে হবে।
>> ইযতিবা করা যারা ইহরাম বেঁধে হজ ও ওমরার জন্য ফরজ তাওয়াফ করবেন, তাঁদেরকে তাওয়াফের সময় অবশ্যই ইযতিবা করতে হবে। আর তাহলো বীর-বাহাদুরিসূলভ চাদর পরিধান করা। চাদরের মধ্যভাগ থাকবে ডান বগলের নিচে।
আর ফরজ তাওয়াফ না হলে সাধারণ তাওয়াফের বেলায় যে কোনো পোশাকেই তাওয়াফ করা যাবে।
>> হাতিমে কাবাসহ তাওয়াফরোকনে শামি ও রোকনে ইরাকির মধ্যে অবস্থতি অর্ধবৃত্তাকার অংশটিকে হাতিমে কাবা বলা হয়। বাইতুল্লাহ তাওয়াফকালে হাতিমে কাবাকেও প্রদক্ষিণ করা।
>> হাজরে আসওয়াদ থেকে শুরু এবং শেষতাওয়াফ হাজরে আসওয়াদ থেকে শুরু হয়ে মুলতাযেম, কাবা শরিফের দরজা, হাতিমে কাবা হয়ে রুকনে শামি ও ইরাকি শেষ করে রুকনে ইয়েমেনি অতিক্রম করে আবার হাজরে আসওয়াদে এসে শেষ করা। বাইতুল্লাহ প্রদক্ষিণ করার সময় রুকনে ইয়েমেনি কর্নার অতিক্রমকালে সম্ভব হলে চুম্বন করা বা হাতে স্পর্শ করা। ভিড় থাকলে ইশারা করাই যথেষ্ট।
>>বাইতুল্লাহকে সাতবার চক্করের মাধ্যমে তাওয়াফ শেষ হয়। এ সাত চক্করের প্রথম তিন চক্করে রমল করতে হবে। প্রথম তিন চক্বরকে রমল বলে। অর্থাৎ বীর দর্পে দ্রুততার সঙ্গে তাওয়াফ করা। পরবর্তী চার চক্কর স্বাভাবিকভাবে হেটে তাওয়াফ সম্পন্ন করা
স্থাপত্য এবং অভ্যন্তর
কাবা হল একটি কিউবয়েড আকৃতির কাঠামো যা পাথর দিয়ে তৈরি।এটি প্রায় ১৩.১ মিটার (৪৩ ফুট ০ ইঞ্চি) লম্বা (কিছু দাবি করে ১২.০৩ মিটার বা ৩৯ ফুট ৫+১⁄২ ইঞ্চি), যার বাহুগুলি ১১.০৩ মি × ১২.৮৬ মিটার (৩৬ ফুট ২+১⁄২ ইঞ্চি × ৪২ ফুট ২+ ১⁄২ ইঞ্চি)।কাবার ভিতরের মেঝে মার্বেল ও চুনাপাথর দিয়ে তৈরি।অভ্যন্তরীণ দেয়াল, পরিমাপ ১৩ মি × ৯ মি (৪৩ ফু × ৩০ ফু), ছাদের অর্ধেক পথ টাইল্ড, সাদা মার্বেল দিয়ে পরিহিত, মেঝে বরাবর গাঢ় ছাঁটাই সহ।অভ্যন্তরের মেঝে প্রায় ২.২ মি (৭ ফু ৩ ইঞ্চি) দাঁড়িয়েছে স্থলভাগের উপরে যেখানে তাওয়াফ করা হয়।
কাবার প্রবেশপথের সরাসরি সংলগ্ন দেয়ালে শিলালিপি সহ ছয়টি ফলক রয়েছে এবং অন্যান্য দেয়াল বরাবর আরও বেশ কয়েকটি ফলক রয়েছে। দেয়ালের উপরের কোণে সোনার কোরানের আয়াত দিয়ে সূচিকর্ম করা একটি কালো কাপড় আছে।তত্ত্বাবধায়করা মার্বেল ক্ল্যাডিংকে একই সুগন্ধযুক্ত তেল দিয়ে অভিষেক করে যা কালো পাথরের বাইরে অভিষেক করতে ব্যবহৃত হয়।কাবার অভ্যন্তরে তিনটি স্তম্ভ (কিছু ভুলভাবে দুটি রিপোর্ট করে) আছে, একটি এবং অন্য দুটির মধ্যে একটি ছোট বেদি বা টেবিল সেট করা আছে।বাতির মতো বস্তু (সম্ভাব্য লণ্ঠন বা ক্রুসিবল সেন্সার ) সিলিং থেকে ঝুলে থাকে।সিলিং নিজেই গাঢ় রঙের, নিচের ছাঁটাইয়ের মতো রঙের।বাব উত-তওবাহ— ডান দেয়ালে (প্রবেশের ডানদিকে) একটি সিঁড়ি আছে, তার মাধ্যমে কাবার ছাদে যাওয়া যায় ।ছাদ এবং সিলিং উভয়ই (সম্মিলিতভাবে দ্বৈত স্তরযুক্ত) তৈরি স্টেইনলেস স্টীল- ক্যাপড সেগুন কাঠ দ্বারা।
কাবার একটি প্রযুক্তিগত অঙ্কন যেখানে মাত্রা এবং উপাদান দেখানো হয়েছে
রুকন আল-ইয়ামানি (ইয়েমেনি কর্নার)
নিম্নলিখিত তালিকার প্রতিটি সংখ্যাযুক্ত আইটেম ডায়াগ্রাম ছবিতে উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলির সাথে মিলে যায়।
হাজার আল-আসওয়াদ ( আরবি: الحجر الأسود, প্রতিবর্ণী. al-Hajar al-Aswad, অনুবাদ ‘The Black Stone’ : الحجر الأسود , রোমানাইজড : আল-হাজার আল-আসওয়াদ , আলোকিত । ‘কালো পাথর’), কাবার পূর্ব কোণে অবস্থিত। এটি সেই স্থান যেখানে মুসলমানরা তাদের কাবা প্রদক্ষিণ শুরু করে, যা তাওয়াফ নামে পরিচিত।
প্রবেশদ্বারে একটি দরজা ২.১৩ মি[রূপান্তর: অজানা একক] মাটির উপরে কাবার উত্তর-পূর্ব দেয়ালে, যাকে বলা হয় বাব আর-রাহমাহ ( আরবি: باب الرحمة : باب الرحمة , রোমানাইজড : বাব আর-রহমাহ , লিট । ‘রহমতের দরজা’), এটিও প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করে)।[১] ১৯৭৯ সালে, ৩০০ কেজি (৬৬০ পা) সোনা দ্বারা শিল্পী আহমদ বিন ইব্রাহিম বদর কর্তৃক তৈরি সোনার দরজা, যা ১৯৪২ সালে তার পিতা ইব্রাহিম বদরের তৈরি পুরানো রূপার দরজা প্রতিস্থাপন করে বসানো হয়। বনু শায়বার খিলান আকৃতির গেট এবং জমজম কূপের মধ্যে মসজিদে একটি কাঠের সিঁড়ি রয়েছে।প্রাচীনতম টিকে থাকা দরজাটি ১০৪৫ সালের পূর্বের। [৪]
মিজাব আল-রাহমাহ, যাকে সাধারণত মিজাব বলা হয় । এটি সোনার তৈরি একটি বৃষ্টির স্পাউট।১৬২৭ সালে যখন কাবা পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল, ১৬২৬ সালে একটি বন্যার কারণে চারটি দেয়ালের মধ্যে তিনটি ভেঙে পড়ার পরে যোগ করা হয়েছিল।
কাবার তিন দিকের এই তির্যক কাঠামোটি শাদেরওয়ান নামে পরিচিত ( আরবি: شاذروان : شاذروان ) এবং ১৬২৭ সালে মিজাব আল-রাহমাহ এর সাথে বৃষ্টির পানি থেকে ভিত্তি রক্ষা করার জন্য যুক্ত করা হয়েছিল।
হাতিম (হাতেম নামেও রোমানীকৃত ) এবং হিজর ইসমাইল নামেও পরিচিত, এটি একটি নিম্ন প্রাচীর যা মূল কাবার অংশ ছিল।এটি একটি অর্ধবৃত্তাকার দেয়াল বিপরীত দিকে, কিন্তু কাবার উত্তর-পশ্চিম দেয়ালের সাথে সংযুক্ত নয়।এটা১.৩১ মি (৪ ফু ৩ ১⁄২ ইঞ্চি) উচ্চতা এবং ১.৫ মি (৪ ফু ১১ ইঞ্চি) প্রস্থ বিশিষ্ট, এবং সাদা মার্বেল দিয়ে গঠিত।হাতিম এবং কাবার মধ্যবর্তী স্থানটি মূলত কাবার অংশ ছিল এবং তাই তাওয়াফের সময় এখানে প্রবেশ করা হয় না।
আল-মুলতাজাম, হাজরে আসওয়াদ এবং প্রবেশ দরজার মধ্যে মোটামুটি২ মি (৬ ১⁄২ ফু) জায়গা রয়েছে।একজন হাজীর জন্য কাবার এই অঞ্চলটি স্পর্শ করা বা এখানে দুআ করা অনেক আকাঙ্ক্ষিত।
( মাকামে ইব্রাহিম ) হল একটি কাঁচ এবং ধাতব ঘের যার মধ্যে ইব্রাহিম (আঃ) এর পায়ের ছাপ রয়েছে।কাবার উপরের অংশগুলি নির্মাণের সময় ইব্রাহিম(আঃ) এই পাথরের উপর দাঁড়িয়েছিলেন এবং উপরের অংশগুলির জন্য ইসমাইল(আঃ)কে তার কাঁধে তুলেছিলেন।
কালো পাথরের কোণে।এটি কাবার কেন্দ্র থেকে খুব সামান্য দক্ষিণ-পূর্ব দিকে মুখ করে।কাবার চারটি কোণ মোটামুটিভাবে কম্পাসের চারটি মূল দিক নির্দেশ করে। [১]
রুকন আল-ইয়ামানি ( আরবি: الركن اليمني, প্রতিবর্ণী. ar-Rukn al-Yamani, অনুবাদ ‘The Yemeni Corner’ : الركن اليمني , রোমানাইজড : আর-রুকন আল-ইয়ামানি , লিট । ‘ইয়েমেনি কর্নার’), যা রুকন-ই-ইয়ামানি বা রুকন-ই-ইয়েমেনি নামেও পরিচিত, কাবার কেন্দ্র থেকে সামান্য দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে মুখ করা কাবার কোণ।[১][৫]
রুকন উশ-শামি ( আরবি: الركن الشامي : الركن الشامي , রোমানাইজড : আর-রুকন আশ-শামি , লিট । ‘দ্য লেভানটাইন কর্নার’), যা রুকন-ই-শামি নামেও পরিচিত, কাবার কেন্দ্র থেকে খুব সামান্য উত্তর-পশ্চিম দিকে মুখ করা কাবার কোণ।[৫]
রুকন আল-ইরাকি ( আরবি: الركن العراقي : الركن العراقي , রোমানাইজড : আর-রুকন আল-ইরাকি , lit. ‘দ্য ইরাকি কর্নার’), হল কাবার কেন্দ্র থেকে সামান্য উত্তর-পূর্ব দিকে মুখ করা কাবার কোন।
কিসওয়াহ, এমব্রয়ডারি করা আবরণ।কিসওয়া হল একটি কালো রেশম এবং সোনার পর্দা যা প্রতি বছর হজ যাত্রার সময় প্রতিস্থাপন করা হয়। এর দুই-তৃতীয়াংশ হল হিজাম, সোনার সূচিকর্ম করা কোরানিক পাঠের একটি ব্যান্ড, শাহাদা সহ, ঈমানের ইসলামী ঘোষণা।কাবার দরজার পর্দা বিশেষভাবে অলংকৃত এবং সিতারা বা বোরকু’ নামে পরিচিত। হিজাম এবং সিতারায় সোনা ও রূপার তারে সূচিকর্ম করা শিলালিপি রয়েছে, কুরআনের আয়াত এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা সহ।
মার্বেল স্ট্রাইপ প্রতিটি প্রদক্ষিণের শুরু এবং শেষ চিহ্নিত করে।
দ্রষ্টব্য: কাবার প্রধান (দীর্ঘ) অক্ষটি ক্যানোপাস নক্ষত্রের উত্থানের সাথে সারিবদ্ধ হতে পরিলক্ষিত হয়েছে যার দিকে এর দক্ষিণ প্রাচীর নির্দেশিত হয়েছে, যখন এর ছোট অক্ষ (এর পূর্ব-পশ্চিম সম্মুখভাগ) মোটামুটি গ্রীষ্মের সূর্যোদয়ের সাথে সারিবদ্ধ। এবং শীতকালীন সূর্যাস্তের সূর্যাস্ত।
বাব আত-তওবাহ, “তাওবার দরজা”
সৌদি আরবে ৫০০-রিয়ালের (প্রায় ১৩৩ ডলার ) নোটের উল্টো দিকে একই রকম দৃশ্য ছাপা হয়েছে।
মাকামে ইব্রাহিম
মিজাব আল-রাহমাহ
পরিষ্কার
“পবিত্র কাবা পরিষ্কার” ( আরবি: تنظيف الكعبة المشرفة, প্রতিবর্ণী. Tanzif al-Ka’bat al-Musharrafah, অনুবাদ ‘Cleaning of the Sacred Cube’ : تنظيف الكعبة المشرفة , রোমানাইজড : তানযীফ আল-কাবাত আল-মুশাররাফাহ , লি . ‘কাবা পরিষ্কার করা’). অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় ইসলামিক ক্যালেন্ডারের অষ্টম মাস শা’বানের ১ তারিখে, রমজানমাস শুরু হওয়ার প্রায় ত্রিশ দিন আগে এবং প্রথম মাস মুহাররমের ১৫ তারিখে।কাবার চাবি বনি শায়বাহ ( আরবি: بني شيبة : بني شيبة) এর কাছে রয়েছে
) গোত্রের কাছে, এটি একটি সম্মান যা তাদের উপর মুহাম্মদ(স:) দ্বারা অর্পিত। পরিচ্ছন্নতার অনুষ্ঠান উপলক্ষে উপজাতির সদস্যরা কাবার অভ্যন্তরে দর্শনার্থীদের অভ্যর্থনা জানায়।
মক্কা প্রদেশের গভর্নর এবং সহকারী গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ওদ সুগন্ধি দিয়ে জমজমের পানিতে ডুবানো কাপড় ব্যবহার করে কাবার অভ্যন্তর পরিষ্কার করেন।তায়েফ গোলাপ, আউদ ও কস্তুরী সহ বেশ কিছু বিলাসবহুল পারফিউমের সাথে জমজমের পানির মিশ্রণের সাথে নির্ধারিত তারিখের একদিন আগে ধোয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়।গোলাপের সুগন্ধি মিশ্রিত জমজমের পানি মেঝেতে ছড়িয়ে খেজুর পাতা দিয়ে মুছে দেওয়া হয়।সাধারণত, পুরো প্রক্রিয়াটি দুই ঘন্টার মধ্যে সম্পন্ন হয়।
ইসলামে তাৎপর্য
কাবা হল ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র স্থান, এবং প্রায়ই বাইতুল্লাহ ( আরবি: بيت الله, প্রতিবর্ণী. Bayt Allah, অনুবাদ ‘House of Allah’ : بيت الله নামে ডাকা হয়। ‘আল্লাহর ঘর’). এবং বাইত আল্লাহ আল-হারাম (আরবি: بيت الله الحرام, প্রতিবর্ণী. বাইত আল্লাহ ইল-হারাম, অনুবাদ ‘আল্লাহর পবিত্র ঘর’’আল্লাহর পবিত্র ঘর’).
) তীর্থযাত্রার একটি ইসলামী আচার এবং হজ এবং ওমরাহ উভয় সময়েই এটি বাধ্যতামূলক।হাজীরা কাবার (ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র স্থান ) চারপাশে সাতবার ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে যান; প্রথম তিনটি দ্রুত গতিতে মাতাফের বাইরের অংশে এবং পরেরটি চারবার অল্প গতিতে কাবার কাছাকাছি। প্রদক্ষিণটি আল্লাহর উপাসনায় বিশ্বাসীদের একতা প্রদর্শন করে বলে বিশ্বাস করা হয়, কারণ তারা কাবার চারপাশে একসাথে চলাফেরা করে, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার সময়। তাওয়াফ করার সময় ওজু অবস্থায় থাকা (অযু) বাধ্যতামূলক কারণ এটিকে একটি ইবাদত ( ‘ইবাদাহ ) বলে মনে করা হয়।
কাবার কোণের কালো পাথর থেকে তাওয়াফ শুরু হয়।সম্ভব হলে, মুসলমানরা এটিকে চুম্বন করতে বা স্পর্শ করতে পারে, কিন্তু বেশি ভিড়ের কারণে এটি প্রায়শই সম্ভব হয় না।প্রতিবার একটি প্রদক্ষিণ সম্পন্ন করার সময় তারা বাসমালা ও তাকবীর উচ্চারণ করবে।হজযাত্রীদের সাধারণত অন্তত দুবার “তাওয়াফ করার” পরামর্শ দেওয়া হয় – একবার হজের অংশ হিসেবে এবং আবার মক্কা ছাড়ার আগে।
পাঁচ প্রকার তাওয়াফ হল:
ত্বওয়াফ আল-কুদুম (আগমন তাওয়াফ) যারা পবিত্র নগরীর বহিরাগত এবং মক্কায় বসবাস করবে না তারা এ ধরনের তাওয়াফ করে।
তাওয়াফ আত-তাহিয়াহ (সালাম ত্বওয়াফ) যেকোনো সময়ে আল-মসজিদ আল-হারামে প্রবেশ করার পরে করা হয় এবং এটি মুস্তাহাব ।
ত্বওয়াফ আল- ওমরাহ (উমরাহ তাওয়াফ) বিশেষভাবে ওমরাহর জন্য করা তাওয়াফকে বোঝায়।
মক্কা ত্যাগ করার আগে তাওয়াফ আল-ওয়াদা’ (“বিদায় তাওয়াফ”) করা হয়।
তাওয়াফ আয-জিয়ারাহ (দর্শনের তাওয়াফ), তাওয়াফ আল-ইফাদ (ক্ষতিপূরণের তাওয়াফ) বা তাওয়াফ আল- হাজ (হজ তাওয়াফ) হজ শেষ করার পরে করা হয়।
নামাজের সময় যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়া হয় তাই কিবলা।[কুরআন২:১৪৩–১৪৪] নামাযের সময় প্রার্থনাকারী ব্যক্তির সাপেক্ষে যে দিকে মুখ করা হয় তা হল কাবার দিক। প্রার্থনা ছাড়াও, মুসলমানরা কেবলার দিকে মুখ করে কুরআন তেলাওয়াত করাকে ভাল শিষ্টাচারের অংশ বলে মনে করে।
•আল-বায়ত আল-হারাম (আরবি: ٱلْبَيْت ٱلْحَرَام, lit. ’পবিত্র ঘর’) ৫:৯৭ এ
•আল-বায়ত আল-আতীক (আরবি: ٱلْبَيْت ٱلْعَتِيق, lit. ’প্রাচীন বাড়ি’) ২২:২৯ এ
ঐতিহাসিক এডুয়ার্ড গ্লেসারের মতে, “কাবা” নামটি দক্ষিণ আরব বা ইথিওপিয়ান শব্দ ” মিকরাব ” এর সাথে সম্পর্কিত হতে পারে, যা একটি মন্দিরকে নির্দেশ করে। লেখিকা প্যাট্রিসিয়া ক্রোন এই ব্যুৎপত্তির বিরোধিতা করেছেন।
পটভূমি
শহরটি ইসলামের উত্থানের তিন শতাব্দী আগে লিখিত কোনো পরিচিত ভৌগোলিক বা ইতিহাস থেকে অনুপস্থিত, যদিও অনেক মুসলিম এবং শিক্ষাবিদ ঐতিহাসিক প্রাক-ইসলামী মক্কার শক্তি ও গুরুত্বের ওপর জোর দেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] তারা এটিকে একটি শহর হিসাবে চিত্রিত করেছে যা মশলা ব্যবসার আয়ের উপর সমৃদ্ধ হয়েছে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] প্যাট্রিসিয়া ক্রোন বিশ্বাস করেন যে এটি একটি অতিরঞ্জন এবং মক্কা শুধুমাত্র চামড়া, কাপড় এবং উটের মাখনের জন্য যাযাবরদের সাথে ব্যবসার জন্য একটি আউটপোস্ট ছিল। ক্রোন যুক্তি দেন যে মক্কা যদি বাণিজ্যের একটি সুপরিচিত কেন্দ্র হত, তবে এটি সম্পর্কে পরবর্তী লেখক যেমন প্রকোপিয়াস, নননোসাস, বা সিরিয়াক গির্জার ক্রনিকলাররা সিরিয়াক ভাষায় লিখতেন। [৬]এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার মতে, “ইসলামের উত্থানের আগে, এটি একটি পবিত্র অভয়ারণ্য হিসাবে সম্মানিত ছিল এবং এটি একটি তীর্থস্থান ছিল।”
ইসলামের আগে, কাবা সমগ্র আরব উপদ্বীপ জুড়ে বিভিন্ন বেদুইন উপজাতিদের জন্য একটি পবিত্র স্থান ছিল। প্রতি চান্দ্র বছরে একবার বেদুইনরা মক্কায় তীর্থযাত্রা করত। যে কোন উপজাতীয় বিবাদকে একপাশে রেখে, তারা কাবায় তাদের দেবতাদের পূজা করবে এবং শহরে একে অপরের সাথে ব্যবসা করত। কাবার অভ্যন্তরে বিভিন্ন ভাস্কর্য ও চিত্রকর্ম রাখা হয়েছিল। হুবালের একটি মূর্তি (মক্কার প্রধান মূর্তি) এবং অন্যান্য পৌত্তলিক দেব-দেবীর মূর্তি কাবার বা তার আশেপাশে স্থাপন করা হয়েছে বলে জানা যায়। দেয়ালে সাজানো মূর্তি আঁকা ছিল। ফেরেশতাদের ছবি, ‘ইব্রাহিম আঃ এর ভবিষ্যদ্বাণীর তীর ধারণকারী এবং ‘ঈসা ( যীশু ) এবং তার মা মরিয়ম ( মেরি ) এর দৃশ্যও কাবার অভ্যন্তরে অবস্থিত ছিল এবং পরে মক্কা বিজয়ের পর মুহাম্মদের নির্দেশে ধ্বংস করা হয়েছিল। [৭] অনির্ধারিত সাজসজ্জা, টাকা এবং একজোড়া মেষের শিং কাবার ভিতরে থাকার কথা রেকর্ড করা হয়েছিল। [৭] কথিত আছে যে, মেষের শিং জোড়া ইব্রাহিম কর্তৃক তার পুত্র ইসমাইলের পরিবর্তে ইসলামী ঐতিহ্য অনুসারে যে মেষ কুরবানী দেওয়া হয়েছিল, তার।[৭]
আল-আজরাকি তার পিতামহের কর্তৃত্বে নিম্নলিখিত বর্ণনা প্রদান করেছেন: [৭]
আমি শুনেছি যে আল-বাইত (কাবাকে নির্দেশ করে) একটি ছবি স্থাপন করা হয়েছিল (আরবি: تمثال, অনুবাদ ‘চিত্রণ’) মরিয়ম ও ঈসার। [‘আতা’] বললেন: “হ্যাঁ, এতে মরিয়মের একটি সুশোভিত ছবি ছিল (‘মুজাওওয়াকান’); তাঁর কোলে, তাঁর পুত্র ঈসা শোভিত হয়ে বসেছিলেন।”
কারেন আর্মস্ট্রং তার বই ইসলাম: এ শর্ট হিস্ট্রি -এ দাবি করেছেন যে কাবা আনুষ্ঠানিকভাবে হুবাল, একজন নাবাতেন দেবতাকে উত্সর্গীকৃত ছিল এবং এতে ৩৬০টি মূর্তি ছিল যা সম্ভবত বছরের দিনগুলিকে প্রতিনিধিত্ব করে। যাইহোক, মুহাম্মদ(স:) যুগে কাবাকে আল্লাহর ঘর হিসাবে উপাসনা করা হয়েছিল।বছরে একবার, আরব উপদ্বীপের চারপাশের উপজাতিরা হজযাত্রা সম্পাদনের জন্য মক্কায় একত্রিত হত, যা ব্যাপকভাবে দৃঢ় বিশ্বাসের একটি চিহ্ন ছিল যে, একেশ্বরবাদীদের দ্বারা উপাসনা করা একই দেবতা ছিলেন আল্লাহ। এই সময়ে মুসলমানরা মুহাম্মাদের নির্দেশ অনুযায়ী জেরুজালেমের দিকে মুখ করে সালাতের নামাজ আদায় করবে এবং কাবার পৌত্তলিক সংঘের দিকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। [৯] আলফ্রেড গুইলাউম তার ইবনে ইসহাকেরসিরাহের অনুবাদে বলেছেন যে কাবাকে হয়তো মেয়েলি আকারে উল্লেখ করা যেতে পারে। পূর্বে তাওয়াফ প্রায়ই পুরুষদের এবং মহিলাদের দ্বারা প্রায় নগ্ন অবস্থায় সঞ্চালিত হত। আল্লাহ ও হুবল একই উপাস্য নাকি ভিন্ন ছিল তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। উরি রুবিন এবং ক্রিশ্চিয়ান রবিনের একটি অনুমান অনুসারে, হুবাল শুধুমাত্র কুরাইশদের দ্বারাই পূজা করা হতো এবং কাবা প্রথমে আল্লাহর কাছে উৎসর্গ করা হয়েছিল, যা বিভিন্ন গোত্রের লোকদের সর্বোচ্চ দেবতা ছিল, যখন কুরাইশদের দেবতাদের প্যান্থিয়ন কাবাতে স্থাপন করা হয়েছিল। তারা মুহাম্মদের সময়ের এক শতাব্দী আগে মক্কা জয় করেছিল।
ইমোতি দাবি করেন যে, এক সময় আরবে এ ধরনের অসংখ্য কাবা অভয়ারণ্য ছিল, কিন্তু এটিই ছিল পাথরের তৈরি একমাত্র অভয়ারণ্য। অন্যদেরও কালো পাথরের প্রতিপক্ষ ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। দক্ষিণ আরবের ঘাইমান শহরের কাবাতে একটি “লাল পাথর” ছিল; এবং আল-আবালাতের কাবার “সাদা পাথর” ছিল। ধ্রুপদী ইসলামে গ্রুনবাউম উল্লেখ করেছেন যে সেই সময়ের দেবত্বের অভিজ্ঞতা প্রায়শই পাথর, পর্বত, বিশেষ শিলা গঠন বা “অদ্ভুত বৃদ্ধির গাছ” ইত্যাদির ফেটিসিজমের সাথে যুক্ত ছিল। আর্মস্ট্রং আরও বলেছেন যে কাবাকে বিশ্বের কেন্দ্রে বলে মনে করা হয়েছিল, যার সরাসরি উপরে স্বর্গের গেট রয়েছে। কাবা সেই স্থানটিকে চিহ্নিত করেছে যেখানে পবিত্র বিশ্ব অপবিত্রের সাথে ছেদ করেছে।
সারওয়ারের মতে, মুহাম্মদের জন্মের প্রায় ৪০০ বছর আগে, আমর বিন লুহায় নামক একজন ব্যক্তি, যিনি কাহতান থেকে এসেছেন এবং হিজাজের রাজা ছিলেন তিনি কাবার ছাদে হুবালের একটি মূর্তি স্থাপন করেছিলেন। এই মূর্তিটি শাসক কুরাইশ গোত্রের অন্যতম প্রধান দেবতা ছিল। মূর্তিটি লাল এগেট দিয়ে তৈরি এবং মানুষের মতো আকৃতির, কিন্তু ডান হাতটি ভেঙে সোনার হাত দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। যখন মূর্তিটি কাবার ভিতরে স্থানান্তরিত হয়েছিল, তখন এর সামনে সাতটি তীর ছিল যা ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য ব্যবহৃত হত। চিরকাল যুদ্ধরত উপজাতিদের মধ্যে শান্তি বজায় রাখার জন্য, মক্কাকে একটি অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছিল যার আয়তন ছিল কাবার ৩০ কিলোমিটার (২০ মা) এর মধ্যে। এই যুদ্ধ-মুক্ত অঞ্চলটি মক্কাকে কেবল তীর্থস্থান হিসাবেই নয়, একটি বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবেও উন্নতি করতে দেয়।
সামারিটান সাহিত্যে, সামারিটান বুক অফ দ্য সিক্রেটস অফ মোজেস ( আসাতির ) বলে যে ইসমাইল এবং তার জ্যেষ্ঠ পুত্র নেবাইওথ কাবা এবং মক্কা শহরও নির্মাণ করেছিলেন।” আসাতির বইটি সম্ভবত ১০ম শতাব্দীতে সংকলিত হয়েছিল, যদিও মোসেস গ্যাস্টার ১৯২৭ সালে প্রস্তাব করেছিলেন যে এটি খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের পরে লেখা হয়েছিল।
ইসলামী মতানুযায়ী
কাবা এবং মসজিদ আল-হারাম একটি তাবিজ শার্টে চিত্রিত, ১৬ বা১৭তম শতকের প্রথম দিকে
কোরআনে কাবার উৎপত্তি সম্পর্কে বেশ কিছু আয়াত রয়েছে। এটি বলে যে কাবা ছিল মানবজাতির জন্য প্রথম উপাসনার ঘর, এবং এটি আল্লাহর নির্দেশে ইব্রাহিম এবং ইসমাইল দ্বারা নির্মিত হয়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে, মানবজাতির জন্য নির্ধারিত প্রথম ঘর (ইবাদত) ছিল বাক্কায় (মক্কা), (যা) বরকতময় এবং মানবজাতির জন্য পথনির্দেশক।
দেখো! আমরা ইব্রাহীমকে (পবিত্র) ঘরের স্থানটি দিয়েছিলাম, (বলে) “আমার সাথে (ইবাদতে) কোন কিছুকে শরীক করো না; এবং আমার গৃহকে পবিত্র কর তাদের জন্য যারা একে প্রদক্ষিণ করে, বা দাঁড়ায়, বা রুকু বা সেজদা করে।
এবং মনে রাখবেন ইব্রাহিম ও ইসমাইল ঘরের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন (এই প্রার্থনার মাধ্যমে): “হে আমাদের প্রভু! আমাদের কাছ থেকে (এই সেবা) গ্রহণ করুন: আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।”
তাফসির ) ব্যাখ্যায় কাবার উৎপত্তি নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে দুটি ব্যাখ্যা উল্লেখ করেছেন। একটি হল, কাবা মানুষ সৃষ্টির আগে মালাইকাফেরেশতাদের উপাসনার স্থান ছিল। পরে, স্থানটিতে একটি উপাসনালয় তৈরি করা হয়েছিযাবং নূহ ( আঃ ) এর সময়ে বন্যার সময় হারিয়ে গিয়েছিল এবং অবশেষে ইব্রাহিম (আঃ) এবং ইসমাইল (আঃ) দ্বারা পুনঃনির্মাণ করা হয়েছিল যেমনটি পরে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। ইবনে সিথির এই রেওয়ায়েতটিকে দুর্বল বলে গণ্য করেছেন এবং আলী ইবনে আবি তালিবের বর্ণনার পরিবর্তে পছন্দ করেছেন যে যদিও কাবার আগে আরও কয়েকটি মন্দির থাকতে পারে, তবে এটি ছিল প্রথম বায়তুল্লাহ (“আল্লাহর ঘর”), যইব্রাহিমঁও ইসমাইল র দ্বারআল্লাহর া নিদেশে নির্র্ম এবং , সম্পূর্ণরূপে তাঁর জন্য উত্সর্গীকৃততাঁর দ্বারা পবিত্র ও আআশীর্বাদকৃতযেমনটি কুরআন ের২২:২৬-২৯ এএ লা হয়েছে। সহিহ আল-বুখারির একটি হাদিসে বলা হয়েছে যে কাবা ছিল পৃথিবীর প্রথম মসজিদ এবং দ্বিতীয়টি ছিল জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ ।
আবু জর বর্ণনা করেন: আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! পৃথিবীর পৃষ্ঠে সর্বপ্রথম কোন মসজিদ নির্মিত হয়েছিল? তিনি বললেন, আল-মসজিদ-উল-হারাম (মক্কায়)। আমি বললাম, “পরে কোনটি নির্মিত হয়েছিল?” তিনি উত্তর দিলেন “আল-আকসার মসজিদ (জেরুজালেমে)।” আমি বললাম, উভয়ের মধ্যে নির্মাণের সময়কাল কত ছিল? তিনি বললেন, চল্লিশ বছর। তিনি আরো বলেন, “যেখানে (তোমরা থাকো এবং) নামাযের ওয়াক্ত হয়ে যায়, সেখানেই নামায আদায় কর, কেননা সর্বোত্তম কাজ হল তা করা (অর্থাৎ সময়মত নামায পড়া)।”
আব্রাহাম যখন কাবা নির্মাণ করছিলেন, তখন একজন ফেরেশতা তার কাছে কালো পাথরটি নিয়ে আসেন যা তিনি কাঠামোর পূর্ব কোণে রেখেছিলেন। আরেকটি পাথর ছিল মাকাম ইব্রাহিম বা আব্রাহামের স্টেশন, যেখানে দাঁড়িয়ে ইব্রাহিম আঃ কাঠামো নির্মাণের কাজ করেছিলেন। কালো পাথর এবং মাকাম ইব্রাহীমকে মুসলমানরা আব্রাহামের তৈরি মূল কাঠামোর একমাত্র অবশিষ্টাংশ বলে বিশ্বাস করে কারণ অবশিষ্ট কাঠামোটি ইতিহাসে এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বহুবার ভেঙে ফেলা হয়েছিল এবং পুনর্নির্মাণ করতে হয়েছিল। কাবার নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর, আল্লাহ ইসমাইলের বংশধরদেরকে একটি বার্ষিক তীর্থযাত্রা করার জন্য আদেশ দেন: হজ এবং কুরবানী।কাবার আশেপাশে একটি অভয়ারণ্যও করা হয়েছিল যেখানে রক্তপাত এবং যুদ্ধ নিষিদ্ধ ছিল।[কুরআন২২:২৬–৩৩]ইসলামী ঐতিহ্য অনুসারে, ইসমাইলের মৃত্যুর পর সহস্রাব্দ বছর ধরে, তার বংশধর এবং স্থানীয় উপজাতি যারা জমজমের চারপাশে বসতি স্থাপন করেছিল তারা ধীরে ধীরে বহুশ্বরবাদ এবং মূর্তিপূজার দিকে ঝুঁকে পড়ে। কাবার মধ্যে বেশ কিছু মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল যা প্রকৃতির বিভিন্ন দিক এবং বিভিন্ন উপজাতির দেবতাদের প্রতিনিধিত্ব করে। তীর্থযাত্রায় নগ্ন প্রদক্ষিণ সহ বেশ কিছু আচার-অনুষ্ঠান গৃহীত হয়েছিল। [২১] আল-আজরাকির আখবার মক্কায় লিপিবদ্ধ বাণী অনুসারে তুব্বা’ নামে একজন রাজা প্রথম কাবার দরজা তৈরি করেন বলে মনে করা হয়।
টলেমি এবং ডিওডোরাস সিকুলাস
এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ইসলামে লেখা, ওয়েনসিঙ্ক টলেমি দ্বারা উল্লেখিত ম্যাকোরাবা নামক একটি স্থান দিয়ে মক্কাকে চিহ্নিত করেছেন। [২২] জিই ভন গ্রুনবাউম বলেছেন: ” টলেমি মক্কা উল্লেখ করেছেন। তিনি যে নামটি দিয়েছেন তা আমাদের এটিকে একটি অভয়ারণ্যের চারপাশে তৈরি একটি দক্ষিণ আরব ভিত্তি হিসাবে চিহ্নিত করতে দেয়।” মেকান ট্রেড অ্যান্ড দ্য রাইজ অফ ইসলামে, প্যাট্রিসিয়া ক্রোন যুক্তি দেন যে মক্কার সাথে মাকোরাবার পরিচয় মিথ্যা এবং ম্যাকোরাবা দক্ষিণ আরবের একটি শহর ছিল যা তখন আরাবিয়া ফেলিক্স নামে পরিচিত ছিল। একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা ম্যাকোরাবার যুক্তিগুলি পুনর্বিবেচনা করেছে এবং সেগুলিকে অসন্তোষজনক বলে মনে করেছে৷
সিনিডাসের আগাথারচাইডের পূর্ববর্তী প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে, ডিওডোরাস সিকুলাস লোহিত সাগরের উপকূলে একটি মন্দিরের কথা উল্লেখ করেছেন, “যা অত্যন্ত পবিত্র এবং সমস্ত আরববাসীদের দ্বারা অত্যন্ত সম্মানিত”। এডওয়ার্ড গিবন বিশ্বাস করতেন এটাই কাবা। যাইহোক, ইয়ান ডি. মরিস যুক্তি দেন যে গিবন উৎসটি ভুলভাবে পড়েছিলেন: ডিওডোরাস উপাসনালয়টিকে মক্কা বলে অনেক উত্তরে রেখেছেন।
খুজিস্তান ক্রনিকল
এই সংক্ষিপ্ত নেস্টোরিয়ান (খ্রিস্টান বংশোদ্ভূত) ধারাবিবরণীটি ৬৬০-এর দশকের পরে লেখা হয়েছে, যা আরব বিজয় পর্যন্ত ইতিহাসকে কভার করে এবং আরব ভূগোলের উপর একটি আকর্ষণীয় ধারণাও দেয়। ভূগোল কভার করা অংশটি আরবে মুসলিম অভয়ারণ্যের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি অনুমান দিয়ে শুরু হয়:
“ইব্রাহিমের ক্বতা (কাবা) সম্পর্কে, আমরা এটি ছাড়া আর কী তা আবিষ্কার করতে পারিনি, কারণ আশীর্বাদপুষ্ট আব্রাহাম সম্পত্তিতে সমৃদ্ধ হয়েছিলেন এবং কেনানীয়দের হিংসা থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলেন, তিনি বাস করতে বেছে নিয়েছিলেন মরুভূমির দূরবর্তী এবং প্রশস্ত অংশ। যেহেতু তিনি তাঁবুতে বাস করতেন, তাই তিনি আল্লাহর উপাসনা এবং বলিদানের জন্য সেই জায়গাটি তৈরি করেছিলেন। জায়গাটির স্মৃতি সংরক্ষিত থাকায় এটির বর্তমান নামটি পূর্বের নাম অনুসারে রাখা। আরবদের জন্য সেখানে উপাসনা করা কোন নতুন বিষয় ছিল না, কিন্তু প্রাচীনকালে ফিরে যায়, তাদের প্রথম দিকে, যেখানে তারা তাদের জনগণের প্রধান পিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে।”[২৩]
এটি খ্রিস্টান বংশোদ্ভূত রাশিদুন খিলাফতের একটি প্রাথমিক রেকর্ড যা স্পষ্টভাবে কাবার উল্লেখ করে এবং এই ধারণাটিকে নিশ্চিত করে যে কেবল আরবরা নয়, কিছু খ্রিস্টানও সপ্তম শতাব্দীতে ইব্রাহিমের সাথে স্থানটিকে যুক্ত করেছিল। এটি কাবার উল্লেখ করা দ্বিতীয় তারিখযোগ্য পাঠ্য, প্রথমটি হচ্ছে কুরআনের কিছু আয়াত।
শিলালিপি
সৌদি প্রত্নতাত্ত্বিক মোহাম্মদ আলমাগথাভি মসজিদ আল-হারাম এবং কাবার উল্লেখ করে কিছু শিলালিপি আবিষ্কার করেছেন, যা ইসলামের প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীর। তাদের মধ্যে একটি নিম্নরূপ পড়ে:
“ঈশ্বরই যথেষ্ট এবং লিখেছেন মায়সারা বিন ইব্রাহিম কাবার সেবক (খাদিম আল-কাবা)।”[২৪]
জুয়ান কোলের অভিমত যে শিলালিপিটি সম্ভবত হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীর (সি. ৭১৮ – ৮১৫ খ্রি.)।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
মুহাম্মদ(স:) এর যুগ
কালো পাথরটি কাবার একটি পোর্টালের মাধ্যমে দেখা যায়
মুহাম্মদ (স:)-এর জীবদ্দশায় (৫৭০-৬৩২ খ্রিস্টাব্দ), কাবা স্থানীয় আরবদের দ্বারা একটি পবিত্র স্থান হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। ৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বন্যার কারণে কাবার কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর মুহাম্মদ (স:) কাবার পুনর্নির্মাণে অংশ নেন। ইবনে ইসহাকেরসিরাত রাসুল আল্লাহ (মুহাম্মদ (স:)-এর জীবনীগুলির মধ্যে একটি) বর্ণনা করে যে মুহাম্মদ (স:) মক্কার বংশের মধ্যে একটি ঝগড়া মীমাংসা করেছিলেন যে কোন বংশটি কাবায় কালো পাথরটি স্থাপন করবে। ইসহাকের জীবনী অনুসারে, মুহাম্মদের সমাধান ছিল সমস্ত গোত্রের প্রবীণদের একটি চাদরের উপর ভিত্তিপ্রস্তরটি তুলে দেওয়া, যার পরে মুহাম্মদ (স:) নিজের হাতে পাথরটিকে তার চূড়ান্ত স্থানে স্থাপন করেছিলেন। ইবনে ইসহাক বলেছেন যে কাবার পুনর্নির্মাণের জন্য কাঠ একটি গ্রীক জাহাজ থেকে এসেছে যা শুয়াবায় লোহিত সাগরের উপকূলে বিধ্বস্ত হয়েছিল এবং বাকুম নামক একজন কপটিক ছুতার এ কাজটি করে। মুহাম্মদ (স:)-এর মেরাজ’-এ তাকে কাবা থেকে মসজিদ আল-আকসা এবং সেখান থেকে সপ্তম আসমানে নেওয়া হয়েছিল।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন][ উদ্ধৃতি প্রয়োজন ]
মুসলমানরা প্রাথমিকভাবে জেরুজালেমকে তাদের কিবলা বা প্রার্থনার দিক হিসাবে বিবেচনা করেছিল এবং প্রার্থনা করার সময় এটির দিকে মুখ করেছিল; যাইহোক, কাবার তীর্থযাত্রা একটি ধর্মীয় কর্তব্য হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল যদিও এর আনুষ্ঠানিকতা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। একজন নবী হিসাবে মুহাম্মদের সময়ের প্রথমার্ধে যখন তিনি মক্কায় ছিলেন, তখন তিনি এবং তার অনুসারীরা মারাত্মকভাবে নির্যাতিত হন যে কারণে শেষ পর্যন্ত ৬২২ খ্রিস্টাব্দে তারা মদিনায় হিজরত করে। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে, মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে কিবলার দিকটি মসজিদ আল-আকসা থেকে মক্কার মসজিদ আল-হারামে পরিবর্তিত হয়েছিল, সূরা ২, আয়াত ১৪৪-এর নাযিলের মাধ্যমে।[কুরআন২:১৪৪] ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে, মুহাম্মদ ওমরাহ পালনের অভিপ্রায়ে মুসলিমদের একটি দলকে মক্কার দিকে নিয়ে যান, কিন্তু কুরাইশরা তা করতে বাধা দেন। তিনি তাদের সাথে একটি শান্তি চুক্তি , হুদায়বিয়ার চুক্তি, যা মুসলমানদের পরের বছর থেকে কাবায় অবাধে তীর্থযাত্রা করার অনুমতি দেয়।
তার মিশনের চূড়ান্ত পর্যায়ে, ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে, কুরাইশদের মিত্র, বনু বকর, হুদায়বিয়ার চুক্তি লঙ্ঘন করার পর, মুহাম্মদ (স:) মক্কা জয় করেন । তার প্রথম কাজ ছিল কাবা থেকে মূর্তি ও ছবি অপসারণ করা। ইবনে ইসহাক এবং আল-আজরাকি দ্বারা সংগৃহীত প্রতিবেদন অনুসারে, মুহাম্মদ(স:) মেরি এবং যীশুর একটি চিত্রকর্ম এবং ইব্রাহিমের একটি ফ্রেস্কো রেখেছিলেন। [২৫]
আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবীজি যখন মক্কা বিজয়ের দিনে প্রবেশ করেন তখন কাবার চারপাশে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। নবী তার হাতে থাকা একটি লাঠি দিয়ে তাদের আঘাত করতে শুরু করলেন এবং বলছিলেন, “সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়ে গেছে…” (কোরআন ১৭:৮১)”
আল-আজরাকি আরও জানায় কিভাবে মুহাম্মদ বিজয়ের দিনে কাবাতে প্রবেশ করার পর, সমস্ত ছবি মুছে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন:
শিহাব (বলেন) যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বিজয়ের দিন কাবাতে প্রবেশ করেছিলেন এবং তাতে অন্যদের মধ্যে ফেরেশতাদের (মালাইকা) একটি ছবি ছিল এবং তিনি ইব্রাহিম (আ.)-এর একটি ছবি দেখেছিলেন এবং তিনি বলেছেন: “আল্লাহ তাদের হত্যা করুন যারা তাকে ভবিষ্যদ্বাণীতে তীর নিক্ষেপকারী শ্রদ্ধেয় বৃদ্ধ হিসাবে প্রতিনিধিত্ব করে (শাইখান ইয়াস্তাকসিম বিল-আজলাম)।”
বিজয়ের পর, মুহাম্মদ(স:) ইসলামে এর মহান মসজিদ (মসজিদ আল-হারাম) সহ মক্কার পবিত্রতাও পুনরুদ্ধার করেন। তিনি ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে হুজ্জাত উল-ওয়াদা’ (“বিদায় তীর্থযাত্রা”) নামে হজ করেন কারণ মুহাম্মদ এই হজে তার আসন্ন মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
মুহাম্মদ (সা:) মৃত্যুর পরে
১৯১০ সালে
২০১৩ সালে একটি সম্প্রসারণ পর্যায়ে কাবা
কাবা বহুবার মেরামত ও পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। উমাইয়াদের এবং আবদুল্লাহ ইবনে আল-জুবায়েরের(একজন প্রারম্ভিক মুসলিম যিনি বহু বছর ধরে মক্কা শাসন করেছিলেন, আলির মৃত্যু এবং উমাইয়াদের দ্বারা ক্ষমতার একত্রীকরণের মধ্যে)মধ্যে যুদ্ধে মক্কার প্রথম অবরোধের সময় ৩ রবিউল আউয়াল ৬৪ হিজরি বা রবিবার, ৩১ অক্টোবর ৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে অগ্নিকাণ্ডের ফলে কাঠামোটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।আব্দুল্লাহ হাতিমকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এটি পুনরায় নির্মাণ করেন। তিনি এমনটি করেছিলেন একটি ঐতিহ্যের ভিত্তিতে (বেশ কয়েকটি হাদিস সংগ্রহে পাওয়া গেছে) যে হাতিম ছিল আব্রাহামিক কাবার ভিত্তির একটি অবশিষ্টাংশ, এবং মুহাম্মদ নিজে এটিকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এটি পুনর্নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন।
৬৯২ সালে মক্কার দ্বিতীয় অবরোধের সময় উমাইয়া সেনাবাহিনী আল-হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের নেতৃত্বে কাবাকে পাথর দিয়ে বোমাবর্ষণ করা হয়েছিল। শহরটির পতন এবং আব্দুল্লাহ ইবনে আল-জুবায়েরের মৃত্যুর ফলে আবদ আল-মালিক ইবনে মারওয়ানের অধীনে উমাইয়ারা অবশেষে সমস্ত ইসলামী সম্পত্তি পুনরায় একত্রিত করে এবং দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটায়। ৬৯৩ খ্রিস্টাব্দে, ‘আব্দ আল-মালিক আল-জুবায়ের কাবার অবশিষ্টাংশগুলিকে ভেঙ্গে ফেলেন এবং কুরাইশদের দ্বারা স্থাপন করা ভিত্তির উপর এটি পুনর্নির্মাণ করেন। কাবা মুহম্মদের সময়ের ঘনক আকৃতিতে ফিরে আসে।
৯৩০ খ্রিস্টাব্দের হজের সময়, শিয়া কারমাতিয়ানরা আবু তাহির আল-জান্নাবির অধীনে মক্কা আক্রমণ করে, জমজম কূপকে তীর্থযাত্রীদের মৃতদেহ দিয়ে অপবিত্র করে এবং কালো পাথর চুরি করে, এটি আল-আহসা’ নামে পরিচিত পূর্ব আরবের মরূদ্যানে নিয়ে যায়। আব্বাসীয়রা ৯৫২ খ্রিস্টাব্দে এটির মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত এটি সেখানে ছিল। এরপর থেকে কাবার মৌলিক আকৃতি ও গঠনের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
১৬২৬ সালে ভারী বর্ষণ ও বন্যার পর কাবার দেয়াল ধসে পড়ে এবং মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একই বছর, অটোমান সম্রাট মুরাদ চতুর্থের শাসনামলে, মক্কা থেকে গ্রানাইট পাথর দিয়ে কাবা পুনর্নির্মিত হয় এবং মসজিদটি সংস্কার করা হয়।
পাঁচটি স্তম্ভ আছে [১][২]। এই পাঁচটি বিষয়ের উপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ। একই সাথে প্রথম তিনটির উপর আমল করা সকল মুসলমানের জন্য ফরজ এবং শেষ দুটি সামর্থ্য অনুযায়ী আদায় করা ফরজ বা অবশ্য পালনীয় কাজ।
ইসলামি ইতিহাস সম্পর্কে একটি অন্যতম প্রধান অনুমান হলো, পাঁচটি স্তম্ভ ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে নবির মৃত্যুর পূর্বেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। যদিও, মুসলমানদের মাঝে ক্ষুদ্র সাম্প্রদায়িকতার কারণে স্তম্ভসমূহের মধ্যে সামান্য পার্থক্য তৈরি হয়। নবি মুহাম্মাদের জীবনী ও বিশ্বাসের প্রভাব স্তম্ভসমূহের মধ্যে সর্বদাই বিদ্যমান। পাঁচটি স্তম্ভ কুরআনের মধ্যে বর্ণিত রয়েছে, এমনকি মক্কায় হজ্জ্ব (পঞ্চস্তম্ভের একটি) এর বিষয় কুরআনের মধ্যে বিশেষভাবে বর্ণিত আছে। যাইহোক, পাঁচ স্তম্ভ বিশ্বাস ও অনুশীলনের মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্যসমূহ ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ, তবে এর মানে এই নয় এই মতৈক্য মুহাম্মাদের জীবদ্দশাতেও বিদ্যমান ছিল। বিভিন্ন সূত্র হতে প্রাপ্ত প্রমাণ দেখাচ্ছে যে, স্তম্ভসমূহ সর্বদাই বর্তমান কালের মতো সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না, বরং ধ্রুপদী রূপ থেকে বর্তমান রূপে আসতে এর দীর্ঘ সময় অতিক্রম করতে হয়েছিল।[৩]
কালেমা শাহাদাত বলতে মূলত: এখানে বুঝানো হয়েছে কালেমায়ে শাহাদাত মুখে বলা (সাক্ষ্য দেওয়া) ও অন্তরে বিশ্বাস করা (বিশ্বাস)৷ এই বিশ্বাসকে বলা হয় “ঈমান“৷ [৬] কালেমা শাহাদত হলো
অনুবাদ: “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তিনি এক, তার কোন অংশীদার নেই । আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর শ্রেষ্ঠ বান্দা এবং তার প্রেরিত রাসূল।”
নামায, নামাজ বা সালাত হল ইসলাম ধর্মের প্রধান ইবাদাত বা উপাসনাকর্ম। প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য আবশ্যক বা ফরজ। নামায ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের দ্বিতীয়। ঈমান বা বিশ্বাসের পর নামাযই ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।
রোযা বা রোজা (ফার্সি روزہ রুজ়ে), সাওম (আরবি صوم স্বাউম্), বা সিয়াম ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল ভিত্তির তৃতীয়। সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার,পাপাচার, কামাচার এবং সেই সাথে যাবতীয় ভোগ-বিলাস থেকেও বিরত থাকার নাম রোযা। ইসলামী বিধান অনুসারে, প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের জন্য রমজান মাসের প্রতি দিন রোজা রাখা ফরজ, (فرض ফ়ার্দ্ব্) যার অর্থ অবশ্য পালনীয়।
উৎপত্তি
রোজা শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘বিরত থাকা’। আর আরবিতে এর নাম সাওম, বহুবচনে সিয়াম। যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে কোনো কাজ থেকে বিরত থাকা। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার,কামাচার, পাপাচার এবং সেই সাথে যাবতীয় ভোগ-বিলাস ও অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে বিরত থাকার নাম রোজা।
প্রকারভেদ
রোজা পাঁচ প্রকার।
ফরজ রোজা: যা আবার চার প্রকার-
রমজান মাসের রোজা।
কোন কারণ বশত রমজানের রোজা ভঙ্গ হয়ে গেলে তার কাযা আদায়ে রোজা।
শরিয়তে স্বীকৃত কারণ ব্যতীত রমজানের রোজা ছেড়ে দিলে কাফ্ফারা হিসেবে ৬০টি রোজা রাখা।
রোজার মান্নত করলে তা আদায় করা।
ওয়াজিব রোজা: নফল রোজা রেখে ভঙ্গ করলে পরবর্তীতে তা আদায় করা ওয়াজিব।
সুন্নত রোজা: মহরম মাসের নয় এবং দশ তারিখে রোজা রাখা।
মোস্তাহাব রোজা: প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪, এবং ১৫ তারিখে, প্রতি সাপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবারে, কোন কোন ইমামের মতে শাওয়াল মাসে পৃথক পৃথক প্রতি সপ্তাহে দুটো করে ছয়টি রোজা রাখা মোস্তাহাব। তবে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে এক সাথে হোক কিংবা পৃথক পৃথক হোক শাওয়ালের ছয়টি রোজা মুস্তাহাব।
নফল রোজা: মোস্তাহাব আর নফল খুব কাছাকাছির ইবাদত। সহজ অর্থে নফল হলো যা ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত নয় এমন ইবাদত পূণ্যের নিয়তে করা। রোজার ক্ষেত্রেও তাই।
যাকাত (আরবি: زكاة zakāt, “যা পরিশুদ্ধ করে”, আরও আরবি: زكاة ألمال, “সম্পদের যাকাত”) হলো ইসলাম ধর্মের পঞ্চস্তম্ভের একটি। প্রত্যেক স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক মুসলমান নর-নারীকে প্রতি বছর স্বীয় আয় ও সম্পত্তির একটি নির্দিষ্ট অংশ, যদি তা ইসলামী শরিয়ত নির্ধারিত সীমা (নিসাব পরিমাণ) অতিক্রম করে তবে, গরীব-দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণের নিয়মকে যাকাত বলা হয়। সাধারণত নির্ধারিত সীমার অধিক সম্পত্তি হিজরি ১ বছর ধরে থাকলে মোট সম্পত্তির ২.৫ শতাংশ (২.৫%) বা ১/৪০ অংশ বিতরণ করতে হয়। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে হজ্জ্ব এবং যাকাত শুধুমাত্র শর্তসাপেক্ষ যে, তা সম্পদশালীদের জন্য ফরয বা আবশ্যিক হয়। মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থকুরআন এ “যাকাত” শব্দের উল্লেখ এসেছে ৩২ বার। নামাজের পরে সবচেয়ে বেশি বার এটি উল্লেখ করা হয়েছে।
হজ্ব বা হজ্জ বা হজ (আরবি: حج) ইসলাম ধর্মাবলম্বী অর্থাৎ মুসলমানদের জন্য একটি আবশ্যকীয় ইবাদত বা ধর্মীয় উপাসনা। এটি ইসলাম ধর্মের পঞ্চম স্তম্ভ। শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জীবনে একবার হজ্জ্ব সম্পাদন করা ফরজ বা আবশ্যিক। আরবি জিলহজ্জ্ব মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ হজ্জ্বের জন্য নির্ধরিত সময়। হজ পালনের জন্য সৌদি আরবেরমক্কা নগরী এবং সন্নিহিত মিনা, আরাফাত, মুজদালিফা প্রভৃতি স্থানে গমন এবং অবস্থান আবশ্যক।
জিহাদকে অনেক সময় ইসলামের ষষ্ঠ স্তম্ভ হিসাবে গণ্য করা হয়। ২০১৫ সালে বিতর্কিত ফরাসি ম্যাগাজিন শার্লি এবদো একটি খবর প্রকাশ করে যে, সুইজারল্যান্ডের এক মুসলিম গবেষক তারিক রামাদান “জিহাদ”কে ইসলামের ষষ্ঠ স্তম্ভ হিসাবে ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও ইসলামের কোনো শাখাতেই ষষ্ঠ স্তম্ভ হিসাবে এর কোনো স্বীকৃৃতি নেই। জিহাদকে শুধুমাত্র ইসলামের একটি আবশ্যিক (ফরজ) ইবাদত হিসাবে গণ্য করা হয়।
ইসলাম, হ্যাঁ; ইসলামী দল, না হলো ইন্দোনেশিয়ার প্রভাবশালী মুসলিম পণ্ডিত নূরখলিশ মাজিদ প্রবর্তিত একটি স্লোগান। ১৯৭০ সালে জাকার্তার তামান মারজুকি ইসমাইলে (টিআইএম) দেওয়া এক ভাষণে তিনি এই স্লোগান প্রবর্তন করেন।[১][২] স্লোগানটি খুব দ্রুত ইন্দোনেশিয়ার জনগণের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে এবং ইসলামী দলগুলোর বিরুদ্ধে মুসলমানদের ভোট দেওয়া পাপ এমন ধারণার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে।[৩][৪]
পটভূমি
১৯৫০ এর দশকে ইন্দোনেশিয়ার ইসলামী দলগুলি এই ধারণা প্রচার করছিল যে মুসলমানদের কেবল ইসলামী দলের পক্ষেই ভোট দেওয়া উচিত। অনেক মুসলিম আলেমরাও তাদের সঙ্গে যোগ দেন এবং এমন দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করে এই ধারণা প্রচার করতে থাকেন যে মুসলমান ভোটারদের ভোট তাদের পরকালীন মুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। এই প্রেক্ষাপটে বিশিষ্ট মুসলিম পণ্ডিত নূরখলিশ মাজিদ ১৯৭০ এর দশকে “ইসলাম, হ্যাঁ; ইসলামী দল, না” নামে স্লোগানটি চালু করেছিলেন। স্লোগানটি দ্রুতই খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং মুসলমান ভোটারদের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থেকে তাদের ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করতে সহায়তা করে। ফলশ্রুতিতে ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানরা ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির পক্ষে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে বলে দেখা যায়।[৪]
তত্ত্বীয় নির্দেশনা
ইসলামী রাষ্ট্র, ইসলামী দল বা ইসলামী রাজনৈতিক মতাদর্শের মধ্যে ঐশ্বরিক কিছু নেই বলে মাজিদ মনে করতেন। মুসলমানদেরকে তাই পার্থিব এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব পোষণ বা আচরণ করার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা উচিত নয় বলে তিনি মত দেন।[৫] তিনি মানবসৃষ্ট সংগঠন অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আল্লাহর ইচ্ছার একীভূতকরণের সমালোচনা করেছেন। কারণ, রাজনৈতিক দলগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ঐশী অনুমোদনের দোহাই দিয়ে থাকে। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, আল্লাহর ইচ্ছার সাথে মানবীয় এজেন্ডার সমীকরণ তৈরি করে যে রাজনৈতিক দলগুলি ইসলামের নামকে কাজে লাগাচ্ছে তারা মূর্তিপূজার সঙ্গে জড়িত।[৬] তিনি মত দেন যে, ইসলাম ও ইসলামী দলগুলি একে অপরের সাথে তুলনীয় নয়। কারণ, ইসলামকে কেবলই একটি রাজনৈতিক মতাদর্শে পরিণত করা যায় না।[৭] মাজিদের দৃষ্টিতে ইসলাম ও ইসলামী দলগুলিকে একত্রে চিহ্নিত করা কেবল ভুলই নয়, বিপজ্জনকও। কারণ, যদি কোনদিন ইসলামী দলগুলির রাজনীতিবিদরা জঘন্য কাজ করে, যার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, তবে ধর্ম হিসাবে ইসলামকে দোষী হিসাবে দেখা হতে পারে। তেমনিভাবে যদি কোনও ইসলামী দল হেরে যায়, তবে ধর্ম হিসেবে ইসলাম হেরে গেছে বলেও মনে হতে পারে। রাজনৈতিক ব্যবস্থার ইসলামীকরণের এমন অসুবিধার কথা বিবেচনা করে মাজিদ স্লোগানটি ইসলামী দল ও তথাকথিত ইসলামী সমাজগুলোর সমালোচনার অংশ হিসাবে চালু করেছিলেন যারা ইন্দোনেশীয় জনগণের চোখে ইসলামী দলগুলিকে পবিত্র ও ঐশ্বরিক করে তুলেছিল।[৮][৯]
রাজনৈতিক প্রভাব
মাজিদ প্রবর্তিত এই স্লোগানটি কাকতালীয় ভাবে ১৯৭১ সালে অনুষ্ঠিত ইন্দোনেশিয়ার সাধারণ নির্বাচনের মুহুর্তের সাথে মিলে যায়। দৈবক্রমে বা অন্য কোন কারণে, ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ক নয়া এই দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের মনেরই যেন প্রতিধ্বনি ছিল। ১৯৭১ সালের সাধারণ নির্বাচনে জনগণের পছন্দের প্রতিচ্ছবি থেকে এটি দেখা যায়। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় যে, ইসলামী দলগুলি চূড়ান্ত পরাজয়ের শিকার। এটি ১৯৫৫ সালের পর থেকে ইসলামী দলগুলির দীর্ঘ যাত্রারও কিছুটা সমাপ্তি টেনেছিল। বিপরীতে, ইন্দোনেশিয়ায় তখন ইসলামের নবায়নও নতুনভাবে শুরু হয়।[১০] স্লোগানটি এইভাবে ইন্দোনেশীয় সমাজে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এমন সময়ে যখন রাজনৈতিক ইসলাম ইতিমধ্যে একটি ধাক্কার সম্মুখীন। এটি ইন্দোনেশীয়দের মধ্যে একটি আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক এবং বৌদ্ধিক শক্তি হিসাবে ইসলামকে পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে এক অসামান্য ভূমিকা পালন করে যা ধর্মের শুধু আনুষ্ঠানিক ও আইনগত দিক নয় বরং নৈতিক ও ব্যবহারিক নীতিসমূহের উপর জোর প্রদান করে।[১১] ইসলামী দলগুলোর বিরুদ্ধে এমন কঠোর অবস্থানের কারণে মাজিদ বেশ সমালোচিত হন। বিশেষতঃ রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে। বহু দলীয় নেতা তার বিরুদ্ধে ইসলামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার অভিযোগ আনেন।[১২]
আধুনিককালে প্রাসঙ্গিকতা
ইন্দোনেশিয়ার বিশিষ্ট মুসলিম চিন্তাবিদ দাওয়াম রাহারজো বিশ্বাস করতেন যে ১৯৭০ সালে মাজিদ যে স্লোগান প্রবর্তন করেছিলেন তা ইসলাম ও মুসলমানদের তৎকালীন উদ্ভূত সমস্যার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে করেছিলেন। কারণ তার মতে, সেই সময় রাজনৈতিক অঙ্গনে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারী ইসলামী দলগুলি তখনো ইসলামকে একটি অনুমোদিত রাজনৈতিক আন্দোলন হিসাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়নি। অন্য অনেকেই একই মতামতের প্রতিধ্বনি করেছেন যে, মাজিদ রাজনৈতিক ইসলামের বিরোধিতা করেছিলেন কারণ ইসলামী দলগুলির অবস্থা ছিল তখন খুবই নাজুক এবং ইসলামী দলগুলি তখনো ইন্দোনেশিয়ার বহুত্ববাদী সমাজে ধর্মের ভাষাকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারেনি।[১৩] তবে ইন্দোনেশিয়ার অনেক ধর্মীয় নেতা এখনও বিশ্বাস করেন যে মাজিদের চিন্তাভাবনা এবং তাঁর বিখ্যাত স্লোগান আধুনিক সময়ের পরিস্থিতির সাথে এখনো প্রাসঙ্গিক।[২]
মানবজাতিকে পথ প্রদর্শনের জন্য তিনি যুগে-যুগে অনেক নবি-রাসূল, আসমানী কিতাব এবং নিদর্শন পাঠিয়েছেন।[১৬] ইসলামে প্রধান ধর্মগ্রন্থ হলো পবিত্র কুরআন, যা স্বয়ং আল্লাহর বাণী; আর সর্বশেষ ও চূড়ান্ত নবি মুহাম্মদ (ﷺ) (২৯ আগস্ট ৫৭০- ৮ জুন ৬৩২) এর কথা, কাজ ও মৌনসম্মতিকে সুন্নাহ বলা হয় যা হাদিস নামে লিপিবদ্ধ রয়েছে। তবে সমস্ত সুন্নাহইহাদিস, কিন্তু সমস্ত হাদিসসুন্নাহ নয়।
সৌদি আরবেরমক্কারকাবা শরিফ; যেখানে সারা বিশ্বের লাখো মুসলিম একতার মাধ্যমে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যতার সাথে প্রার্থনা করে থাকেন।
ইসলামের বিশ্বাস অনুযায়ী ইসলাম শুধুমাত্র কোন নতুন ধর্মই নয়, বরং সৃষ্টির শুরু থেকেই ইসলামের উৎপত্তি। আদম ছিলেন এই পৃথিবীর প্রথম মানব এবং মানবজাতির মধ্যে ইসলামের প্রথম নবি। আর সর্বশেষ ও চূড়ান্ত নবি হলেন মুহাম্মদ, যিনি সমগ্র সৃষ্টি জগতের জন্য আবির্ভূত হয়েছেন স্রষ্টার পক্ষ থেকে।[২৭][২৮][২৯]
মুসলমানরা দুইটি প্রধান সম্প্রদায়ের অন্তর্গত, সুন্নি (৮০-৯০%) অথবা শিয়া (১০-২০%)।[৩৫] মূলত যারা শিয়া নয় তাদের সবাইকেই সুন্নি (মুসলিম) হিসেবে গণনা করা হয়। সুন্নি ইসলাম মূলত অনেকগুলো ইসলামী মতাদর্শের সমষ্টি। এছাড়াও কিছু মুসলমান নিজেদেরকে শিয়া সুন্নি কোনো দলেই ফেলেন না, তারা ইসলাম ধর্মের মধ্যে বিভাজনে বিশ্বাসী না। তারা কুরআন এবং হাদিসকে মূল ধরে এগুলোর আলোকে (ইজমা ও কিয়াস) ইসলাম পালন করে এবং নিজেকে বিশুদ্ধ মুসলমান হিসেবে গড়ার চেষ্টা করে। তবে কুরআন এবং হাদিসের স্পষ্ট নির্দেশনার ক্ষেত্রে ইজমা এবং কিয়াস গ্রহণযোগ্য নয় বলে তারা বিশ্বাস করে। আর তারা মনে করে সকল মুসলমানের উচিত ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের দ্বীন (মাযহাব) ইসলাম মনে করা এবং নিজেদেরকে মুসলিম হিসেবে পরিচয় দেওয়া।
সালাম ও সাল্.ম উভয় শব্দেরই অর্থ হল আনুগত্য, আত্নসমর্পন ও হুকুম পালন। অর্থগুলোর মধ্যে ‘পবিত্র ও দোষ- ত্রুটিমুক্ত হওয়া’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই শব্দমূল হতে (ক্রিয়াপদে/ফে’ল) (أَسْلَمَ) আসলামা, ইসলাম গ্রহণ করল ও ক্রিয়াবিশেষ্য (إِسْلَام) ইসলাম, আত্নসমর্পন এবং কতৃকারকে (مسلم) মুসলিম, ইসলাম গ্রহণকারী শব্দ তিনটির উৎপত্তি হয়েছে।[৪৪][টীকা ২]
সিল্.ম, সিলাম ও সালিম এর অর্থ কঠিন প্রস্তর, কারণ ওতে কোমলতা নাই, নরম হওয়া থেকে মুক্ত। সালাম এর আরেক অর্থ, বাবলা গাছের ন্যায় কাঁটাযুক্ত বৃক্ষ, যা কাঁটাযুক্ত হওয়ায় বিপদ-আপদ থেকে মুক্ত থাকে। আল্লাহর গুণবাচক নাম আস-সালাম শব্দটির মধ্যেও যাবতীয় দূর্বলতা থেকে মুক্ত, এমন অর্থ নিহিত রয়েছে। সাল্.ম এর যে ৪টি অর্থ দেয়া হয়েছে তার সবগুলোই ইসলাম শব্দের মাস্.দার (ক্রিয়ামূল) () এর মধ্যে নিহিত রয়েছে। সেকারণে মূল অর্থ দাঁড়ায় ‘ইবাদত, দ্বীন ও ‘আকীদাকে একমাত্র আল্লাহ তা’আলার জন্য নির্দিষ্ট করা।[৪৩]
কুরআনে ৮ জায়গায় ইসলাম শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে(৩:১৯,৮৫; ৫:৩;৬ :১২৫; ৯:৭৮; ৩৯:২২; ৪৯:১৭; ৬১:৭)। স্বরচিহ্নের তারতম্যের কারণে বিভিন্ন আকারে তবে একই অর্থে এই শব্দমূল থেকে উৎপন্ন বেশ কয়েকটি পদের ব্যবহার দেখা যায়।(৮:৬১) যুদ্ধবিরতির জন্য শান্তির প্রস্তাব, (২:১০৮) ইসলামি বিধান, (৪:৯১-৯২) যুদ্ধ পরিহারের প্রস্তাব, (১০ :২৫) শান্তি বা (৫১:২৫) শান্তি কামনামূলক মুসলিম অভিবাদন। শেষোক্ত অর্থে ২৪:২৭ আয়াতে, ইসলাম শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।[৪৪]
অর্থ
প্রধানত দুইটি অর্থ পাওয়া যায়,
এক অদ্বিতীয় আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা (২:১১২)
শান্তি স্থাপন তথা বিরোধ পরিহার করা। ২য় অর্থটির ব্যাখ্যা হলো-
আত্মসমর্পনে আল্লাহর সহিত শান্তি স্থাপিত হয় এবং তার বিরুদ্ধতা পরিত্যক্ত হয়।
আল্লাহর সৃষ্ট মানুষের সাথে একাত্মতার অনুভূতিতে, সাম্যনীতির স্বীকৃতিতে সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তার অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি হয়।
ইসলাম একটি দ্বিন (৩:১৮); পারস্পরিক ব্যবহার, লেন-দেন সবই এর অন্তর্ভুক্ত। দ্বিনের উৎস কুরআন। এটি একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। সে কারণে ইবাদত ও দার্শনিক বিষয়াবলির পাশাপাশি এটি মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে, সর্ববিষয়ে নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মাবলির প্রতিও গুরুত্ব দেয়।
“রিলিজিয়ন” বা “ধর্ম” বলতে যে আধ্যাত্মিক ও পারত্রিক জীবন-দর্শন ও ক্রিয়াকর্ম বুঝায় সেই অর্থে একে “ধর্ম” বললে কোনভাবেই এর পুরো অর্থ প্রকাশ পায় না।[৪৪]
ইসলাম মানুষের চিরন্তন ধর্ম (৩:১৮)। এর মূল কথা হল-
আল্লাহর একত্ব ও অদ্বিতীয়ত্বে বিশ্বাস,
ইয়াওমূ’ল আখির বা মৃত্যুর পর পুনরুত্থান ও বিচারান্তে অনন্ত পরজীবনে বিশ্বাস, এবং
আমাল-স.আলিহ্ বা সৎকর্মে আত্মনিয়োগ।
বিশ্বাসের পর্যায়গুলো হল
ফেরেশতাগণ,
আসমানী কিতাবমূহ
নবী-রাসূল
শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস
আল্লাহর সর্বময় নিয়ন্ত্রণে (তাকদির) বিশ্বাস ও উপরের তিনটি মৌলিক উপাদানের সাথে যুক্ত হয়।
প্রথম মানব ও নবি আদম হতে শেষ নবি মুহাম্মদ পর্যন্ত কুরআনে উল্লিখিত / অনুল্লিখিত সকল নবি-রাসূল (৪০:৭৮), পৃথিবীর বিভিন্ন গোত্র ও জাতির কাছে (১০: ৪৭, ১৩ : ৭, ৩৫ : ২৪), উপরের তিন উপাদান সংবলিত ইসলাম প্রচার করেছিলেন।
এই তিনের ভিত্তিতে কুরআন সমসাময়িক ইহুদী, খ্রিষ্টান, স.আবিই ও মাজুসি অর্থাৎ সকল ধর্মাবলম্বীকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিল (২ :৬২) এবং আহ্বানে সাড়া দিলে নিরাপত্তা ও মুক্তির নিশ্চয়তা দিয়েছিলো। এখনও সেই আহ্বান কার্যকর রয়েছে।[৪৪]
তারা আরও বিশ্বাস করেন, তাদের পবিত্র গ্রন্থ কুরআন নিখুঁত, অবিকৃত ও মানব এবং জ্বিন জাতির উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ আল্লাহর সর্বশেষ বাণী, যা পুনরুত্থান দিবস বা কেয়ামত পর্যন্ত বহাল ও কার্যকর থাকবে। তবে কিছু সম্প্রদায়, যেমনঃ আহ্মদি বা কাদিয়ানী নামক একটি সম্প্রদায় মনে করে মুহাম্মদ শেষ নবী নন; বরং যুগের চাহিদা মোতাবেক নবুওয়াতের ধারা অব্যহত থাকবে।[৪৫] এবং শিয়াদের একটি বিরাট অংশবিশেষ ইসমাঈলীয়দের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস যে, ইমাম ইসমাঈল আখেরী নবী ছিলেন। [৪৬]
ইসলামী বিশ্বাস অনুসারে, আদম হতে শুরু করে আল্লাহ্ প্রেরিত সকল পুরুষ ইসলামের বাণীই প্রচার করে গেছেন। কুরআনের সূরা ফাতিরে বলা হয়েছে,
“
“নিঃসন্দেহে আমি তোমাকে (মুহাম্মদ) পাঠিয়েছি সত্যের সাথে সুসংবাদদাতা এবং সতর্ককারীরূপে। আর এমন কোনো সম্প্রদায় নেই, যাঁদের মধ্যে একজন সতর্ককারী পাঠানো হয়নি।”৩৫:২৪[৪৭]
”
ইসলামের দৃষ্টিতে ইহুদি ও খ্রিস্টান উভয় ধর্মাবলম্বীরাই ইব্রাহিমের শিক্ষার ঐতিহ্য পরম্পরা। উভয় ধর্মাবলম্বীকে কুরআনে “আহলে কিতাব” বলে সম্বোধন করা হয়েছে । কুরআনের সূরা আলে ইমরানে আহবান করা হয়েছে,
“
“তুমি (মুহাম্মদ) বল, হে কিতাবীগণ, এসো সেই কথায় যা তোমাদের এবং আমাদের মধ্যে এক; যেন আমরা আল্লাহ ব্যতীত কারও ইবাদত না করি। কোনো কিছুকেই তাঁর শরিক না করি। এবং আমাদের কেউ কাউকে আল্লাহ ব্যতীত উপাস্য হিসেবে গ্রহণ না করি। যদি তাঁরা মূখ ফিরিয়ে নেয় তবে বল, তোমরা স্বাক্ষী থাক; অবশ্যই আমরা মুসলিম।”৩:৬৪[৪৭]
”
এই ধর্ম দুটির গ্রন্থসমূহের বিভিন্ন ঘটনা ও বিষয়ের উল্লেখ কুরআনেও রয়েছে, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রয়েছে পার্থক্য। ইসলামি বিশ্বাসানুসারে এই দুই ধর্মের পন্ডিতগণ তাদের নিকট প্রদত্ত আল্লাহ্-এর বাণীর অর্থগত ও নানাবিধ বিকৃতসাধন করেছেন। ইহুদিগণ তৌরাতকে (তোরাহ) ও খৃস্টানগণ ইনজিলকেনতুন বাইবেল বলে থাকে।
মুসলমানগণ বিশ্বজগতেরসৃষ্টিকর্তাকে ‘আল্লাহ’ বলে সম্বোধন করেন। ইসলামের মূল বিশ্বাস হলো আল্লাহর একত্ববাদ বা তৌহিদ। আল্লাহর একত্বের সাক্ষ্য দেওয়া ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের মধ্যে প্রথম, যাকে বলা হয় শাহাদাহ। এটি পাঠের মাধ্যমে একজন স্বীকার করেন যে, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোনো উপাস্য নাই এবং মুহাম্মদ [] তার প্রেরিত বাণীবাহক বা রাসূলসুরা ইখলাসে আল্লাহর বর্ণনা দেয়া হয়েছে এভাবে, [قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ. اللهُ الصَّمَدُ. لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ. لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ. وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ] {الاخلاص:১-৪}
“
“বলুন, তিনি আল্লাহ, এক, আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাঁকে জন্ম দেয়নি এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।”১১২:১-৪[৪৭]
”
এই পৃথিবীর কোন কিছু যদি সূরা ইখলাসে উল্লেখ করা এই ৪ টি শর্ত পূরণ করে তাহলে মুসলিমদের তাকে আল্লাহ বলে মেনে নিতে কোন সমস্যা থাকবে না।
আল্লাহ্ শব্দটি আল এবং ইলাহ যোগে গঠিত। আল অর্থ সুনির্দিষ্ট এবং ইলাহ অর্থ উপাস্য, যার অর্থ সুনির্দিষ্ট উপাস্য। খৃস্টানগণ খৃস্ট ধর্মকে একেশ্বরবাদী বলে দাবী করলেও মুসলিমগণ খৃস্টানদের ত্রিত্ববাদ (trinity) বা এক ঈশ্বরের মধ্যে পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার মিলন, এই বিশ্বাসকে অস্বীকার করেন। ইসলামি ধারণায় আল্লাহ সম্পূর্ণ অতুলনীয় ও পৌত্তলিকতার অসমতুল্য, যার কোনো প্রকার আবয়বিক বর্ণনা অসম্ভব। মুসলিমরা তাদের সৃষ্টিকর্তাকে বর্ণনা করেন তার বিভিন্ন গুণবাচক নাম ও গুণাবলীর মাধ্যমে। কিতাবুল ঈমানে আল্লাহর বর্ণনা এভাবে আছে :
আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়, অতুলনীয়। তার কোন অংশ বা অংশিদার বা শরিক নেই। তিনি কারো উপন নির্ভরশীল নন, বরং সকলেই তার উপর নির্ভরশীল। তার কোন কিছুর অভাব নেই। তিনিই সকলের অভাব পূরণকারী। তিনি কারো পিতা নন, পুত্র নন, তাঁর সমতুল্য কেউ নেই। একমাত্র তিনি সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা ও পালনকর্তা। কোন জ্ঞান বা চক্ষু আল্লাহ তাআলাকে আয়ত্ত করতে পারেনা।
তিনি চিরকাল আছেন এবং থাকবেন। তিনি অনাদি ও অনন্ত। আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নাই। একমাত্র তিনিই ইবাদত (উপাসনা) পাওয়ার যোগ্য। তিনি সর্বশক্তিমান। আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে ঘটমান সব কিছু দেখতে ও শুনতে পান। তাঁর কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই, তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে।
মুসলিমরা বিশ্বাস করে, আল্লাহর বর্ণনা মানুষের কল্পনা, বিজ্ঞান ও দর্শন দ্বারা জানা সম্ভব না।
ফিরিশতা বা ফেরেশতা ফারসী শব্দ। ফেরেশতা আরবী প্রতিশব্দ হলো ‘মালাইকা’। ফেরেশতায় বিশ্বাস ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসের একটি মূল নীতি। এরা অন্য সকল সৃষ্টির মতই আল্লাহর আরেক সৃষ্টি। তারা মুলত আল্লাহর দূত। তারা সর্বদা ও সর্বত্র আল্লাহর বিভিন্ন আদেশ পালনে রত এবং আল্লাহর অবাধ্য হবার কোনো ক্ষমতা তাদের নেই। ফেরেশতারা নূর তথা আলোর তৈরি। তারা খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করেন না। তারা পবিত্র স্থানে অবস্থান করেন। তারা আল্লাহর আদেশ অনুসারে যেকোনো স্থানে গমনাগমন ও আকৃতি পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখেন।
ফেরেশতাদের সংখ্যা অগণিত। ইসলামে তাদের কোনো শ্রেণীবিন্যাস করা না হলেও চারজন গুরুদায়িত্ব অর্পিত প্রধান ফেরেশতার নাম উল্লেখযোগ্য:
জিব্রাইল – ইনি আল্লাহর দূত ও সর্বশ্রেষ্ঠ ফেরেশতা। এই ফেরেশতার নাম তিনবার কুরআন শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে (সূরা ২:৯৭; ৯৮, ৬৬:৪)। সূরা ১৬:১০২ আয়াতে জিব্রাইল ফেরেশতাকে পবিত্র রূহ বা রুহুল ক্বুদুস বলা হয়েছে। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ এবং সংবাদ আদান-প্রদান যেসব ফেরেশতার দায়িত্ব, জিব্রাইল তাদের প্রধান। জিব্রাইল-ই আল্লাহর বাণী নিয়ে নবীদের কাছে গমনাগমন করেন। এই ফেরেশতাকে ইসলামের নবী মুহাম্মদ তার নিজস্ব আকৃতিতে মোট দুইবার দেখেছেন। পবিত্র কোরআনে সূরা আন নাজমে বলা হয়েছে,
“
“সে ঊর্ধ্বাকাশের উপরিভাগে। তারপর সে কাছে এলো। অতঃপর সে আরো কাছে এলো। তাঁদের মাঝে ব্যবধান থাকল দুই ধনুকের বা তাঁর চাইতেও কম। অতঃপর সে তাঁর বান্দার কাছে ওহী পৌঁছে দিল, যা তাঁর পৌঁছানোর ছিল। সে যা দেখেছে, অন্তর তা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেনি। তোমরা কী সে বিষয়ে বিতর্কে লিপ্ত হতে চাও, যা সে নিজের চোখে দেখেছে। সে তাঁকে আরও একবার দেখেছিল। সিদরাতুল মুন্তাহার কাছে।” ৫৩:৭-১৪[৪৭]
”
প্রাসঙ্গিক হাদিসসমূহ: মুসলিম শরীফ ৩২৯, ৩৩০, ৩৩২, ৩৩৩, ৩৩৪ এবং ৩৩৬[৪৮]
মিকাইল – কুরআনের ২:৯৭ আয়াতে এই ফেরেশতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ইনি বৃষ্টি ও খাদ্য উৎপাদনের দায়িত্বপ্রাপ্ত।
ইসরাফিল – এই ফেরেস্তা আল্লাহর আদেশ পাওয়া মাত্র শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়ার মাধ্যমে কিয়ামত বা বিশ্বপ্রলয় ঘটাবেন। তার কথা কুরআন শরীফে বলা না হলেও হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে।
মালাকুল-মাউত – ইনি মৃত্যুর ফেরেশতা ও সকল প্রাণীর রূহ কবচ করেন।
বিশেষ শ্রেণীর ফেরেশতা যাদেরকে কুরআনে ‘কিরামান কাতিবিন’ (অর্থ: সম্মানিত লেখকগণ) বলা হয়েছে তারা প্রতিটি মানুষের ভালো মন্দ কাজের হিসাব রাখেন। কবরে মুনকির ও নাকির নামের দুই ফেরেশতা মানুষকে তার কৃত কর্মের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। মালিক নামের ফেরেশতা নরক বা জাহান্নামের রক্ষণাবেক্ষণ করেন এবং রিদওয়ান নামের আরেক ফেরেশতা জান্নাত বা বেহেশতের দেখভাল করেন বলে বর্ণিত আছে। ইসলাম, খৃস্টান ও ইহুদী ধর্ম ছাড়া হিন্দুধর্মেও ফেরেশতা তথা স্বর্গীয় দূতদের অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে।
আসমানী কিতাবসমূহ
আসমানী কিতাব হলো মূলত আল্লাহর বাণী যা আল্লাহ তায়ালা জিব্রাইল নামক ফেরেশতার মাধ্যমে রাসূলগণের নিকট প্রেরণ করেছেন।বলা হয়, পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে সর্বমোট আসমানী কিতাব পাঠানো হয়েছে ১০৪টি। তার মধ্যে ৪টি হলো প্রধান আসমানী কিতাব ও বাকি ১০০টি সহীফা।
হাত্তাত আজিজ এফেন্দির হস্তলিখিত – কুরআনের প্রথম সুরা।
কুরআন মুসলিমদের মূল ধর্মগ্রন্থ। তাদের বিশ্বাস পবিত্র এই কুরআন স্রষ্টার অবিকৃত, হুবহু বক্তব্য। বিশ্বাস করা হয়, আল্লাহ নিজেই কুরআনের সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। এর আগে স্রষ্টা প্রত্যেক জাতিকে বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠিয়েছেন, কিন্তু সেগুলোকে বিকৃত করা হয়। কুরআনকে আরও বলা হয় “আল-কুরআন” । বাংলায় “কুরআন”-এর জায়গায় বানানভেদে “কোরআন” বা “কোরান”ও লিখতে দেখা যায়।
ইসলাম ধর্মমতে, জীব্রাইল ফেরেশতার মাধ্যমে নবী মুহাম্মদ-এর নিকট ৬১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬ই জুলাই, ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু অবধি বিভিন্ন সময়ে আল্লাহ তাঁর বাণী অবতীর্ণ করেন। এই বাণী তাঁর (মুহাম্মদের) অন্তঃস্থ ছিলো, সংরক্ষণের জন্য তাঁর অনুসারীদের দ্বারা পাথর, পাতা ও চামড়ার ওপর লিখেও রাখা হয়।
অধিকাংশ মুসলিম পবিত্র কুরআনের যেকোনো পাণ্ডুলিপিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন, স্পর্শ করার পূর্বে ওজু করে নেন। কুরআন জীর্ণ ও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়লে আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেয়া হয় না, বরং কবর দেয়ার মত করে মাটির নিচে রেখে দেয়া হয় বা পরিষ্কার স্রোতের পানিতে ডুবিয়ে দেয়া হয়।
প্রত্যেক মুসলিমই কুরআনের কিছু অংশ এর মূল ভাষা আরবিতে মুখস্থ করে থাকেন, কমপক্ষে যেটুকু আয়াত নামাজ আদায়ের জন্য পড়া হয়। সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থকারীদের হাফিজ (সংরক্ষণকারী) বলা হয়। মুসলিমরা আরবি কুরআনকেই কেবলমাত্র নিখুঁত বলে বিশ্বাস করেন। সকল অনুবাদ মানুষের কাজ বিধায় এতে ভুল-ত্রুটি থাকার সম্ভাবনা থেকে যায় এবং বিষয়বস্তুর মূল প্রেরণা ও সণেটিক উপস্থাপনা অনুবাদকর্মে অনুপস্থিত থাকতে পারে বিধায় অনুবাদসমূহকে কখনোই আরবি কুরআনের সমতুল্য ও সমান নিখুঁত গণ্য করা হয় না, বরং এগুলোকে সর্বোচ্চ ‘অর্থানুবাদ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
নবী ও রাসূলগণ
বলা হয়, আদম আঃ থেকে শুরু করে মুহাম্মাদ পর্যন্ত আল্লাহ পৃথিবীতে প্রায় ১,২৪,০০০ (আনুমানিক) নবী ও রাসূল পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আর তাদের মধ্যে আদম আঃ সর্ব প্রথম মানুষ ও আল্লাহর সর্ব প্রথম নবী এবং সর্ব শেষ ও চূড়ান্ত নবী ও রাসূল হলেন মুহাম্মাদ।
মুসলিমগণ বিশ্বাস করে যীশু (ঈসা) আল্লাহর পুত্র নন বরং তিনি আল্লাহর রাসূল। তার উপর ইঞ্জিল কিতাব নাজিল হয়েছে। তিনি কেয়ামতের আগে পৃথিবীতে আবার আসবেন এবং মুহাম্মদের অনুসারী হিসেবে মৃত্যু বরণ করবেন ।
বর্তমান সৌদি আরবের, হেজাজ অঞ্চলের, মদিনায় অবস্থিত মসজিদে নববী (নবীজীর মসজিদ) এঁর প্যানারমিক দৃশ্য। ইসলামে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ।
মুহাম্মদ ছিলেন তৎকালীন আরবের কুরাইশ বংশের একজন। নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে তার গুণের কারণে তিনি আরবে “আল-আমীন” বা “বিশ্বস্ত” উপাধিতে ভূষিত হন। স্রষ্টার নিকট হতে নবুওয়াত প্রাপ্তির পর তিনি মানুষকে ইসলাম ধর্ম এর দিকে দাওয়াত দেন। তাকে ইসলামের শ্রেষ্ঠ বাণী-বাহক (নবী) হিসেবে শ্রদ্ধা ও সম্মান করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, পূর্বের একেশ্বরবাদী ধর্ম বিভিন্ন সময় পরিবর্তিত ও বিকৃত হয়ে গিয়েছিল।
ইসলাম ধর্মমতে, তিনি চল্লিশ বছর বয়স হতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ২৩ বছরের বিভিন্ন সময়ে জিব্রাইলের মাধ্যমে ঐশী বাণী লাভ করেন। এই বাণীসমূহের একত্ররূপ হলো পবিত্র কুরআন, যা তিনি মুখস্থ করেন ও তার অনুসারীদের (সাহাবী) দিয়ে লিপিবদ্ধ করান। কারণ, তিনি নিজে লিখতে ও পড়তে জানতেন না।
কুরআনে বলা হয়েছে,
“
“তুমি তো এর আগে কোনো কিতাব পড় নি এবং স্বহস্তে কোনো কিতাব লেখনি যে অবিশ্বাসীরা সন্দেহ পোষণ করবে।”২৯:৪৮ [৪৭]
”
“
“সে যদি আমার নামে কোনো কথা রচনা করতো, তবে আমি তাঁর ডান হাত ধরে ফেলতাম, অতঃপর কেটে দিতাম তাঁর গ্রীবা। তোমাদের কেউ তাকে রক্ষা করতে পারতে না।” ৬৯:৪৪-৪৭ [৪৭]
”
মুসলিমরা বিশ্বাস করেন, ঐশ্বিক বাণী প্রচারের ক্ষেত্রে ইসলামের নবী কখনো ভুল করেননি। আরো বিশ্বাস করা হল, তার জীবনকালে তিনি সম্পূর্ণ আলৌকিকভাবে মেরাজ লাভ করেন।
মুসলিমদেরকে শেষ বাণীবাহক মুহাম্মদের নাম উচ্চারণ করার সাথে সাথে “সাল্লাল্লা-হু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম” বলতে হয়। এর অর্থ: ‘আল্লাহ তার উপর রহমত এবং শান্তি বর্ষণ করুন।’ একে বলা হয় দরুদ শরীফ। এছাড়াও আরও অনেক দরুদ হাদীসে বর্ণীত আছে। তার মধ্যে এটাই সর্বপেক্ষা ছোট। কোনো এক বৈঠকে তার নাম নিলে দরুদ একবার বলা আবশ্যকর্তব্য (ওয়াজিব)।
‘হাদীস’ (اﻠﺤﺪﻴث) আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে- কথা, বাণী, কথা-বার্তা, আলোচনা, কথিকা, সংবাদ, খবর, কাহিনী ইত্যাদি। [৪৯] ইসলামী পরিভাষায় মুহাম্মদের কথা, কাজ, অনুমোদন এবং তার দৈহিক ও চারিত্রিক যাবতীয় বৈশিষ্ট্যকে হাদীস বলে। মুহাম্মদের জীবদ্দশায় তার সাহাবীরা তার হাদীসসমূহ মুখস্থ করে সংরক্ষণ করতেন। প্রথমদিকে হাদীস লেখার অনুমতি ছিলো না। তখনকার অনুন্নত মুদ্রণব্যবস্থার কারণে কেউ লিখিত হাদিসকে ভুলক্রমে কুরআনের আয়াত মনে করতে পারে এই আশঙ্কা ছিল। পরবর্তীতে ইসলামের নবী তার কোনো কোনো সাহাবী বা সহচরকে হাদীস লেখার অনুমতি প্রদান করেন।[৫০] তার মৃত্যুর পর তার সাহাবীরা নিয়মিত তার হাদিসগুলো চর্চা করতেন ও তাদের ছাত্রদের কাছে বর্ণনা করতেন। সাহাবীদের ছাত্র তথা তাবেঈরা ওমর ইবন আব্দুল আযীযের আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হাদীস লিখিত আকারে সংরক্ষণ করেন।[৫১]
মুহাম্মদের কথা-কাজসমূহের বিবরণ এভাবে লোকপরম্পরায় সংগ্রহ ও সংকলন করে সংরক্ষণ করা হলে তার বক্তব্যসমূহ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে উন্মুক্ত হয়। মুসলিম পণ্ডিতদের সংকলিত সেসব হাদিস-সংকলন গ্রন্থগুলোর মধ্যে ছয়টি গ্রন্থ প্রসিদ্ধ হয়েছে। এগুলোকে ‘ছয়টি হাদিস গ্রন্থ’ (কুতুবুস সিত্তাহ) আখ্যা দেয়া হয়। হাদিসের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের বিভিন্ন মাপকাঠি রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো হাদীসের সনদ বা হাদিসের বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্য যাচাই।
কিয়ামতে বা শেষ বিচারের দিনে বিশ্বাস ইসলামের মূল বিশ্বাসগুলির একটি। ইসলাম ধর্মে কিয়ামত হলো সেই দিন যে দিন এই বিশ্বের সৃষ্টা (আল্লাহ) সকল মানুষ ও জ্বীন দের পুনরুত্থান করা হবে বিচারের জন্য। সকলে তার কৃতকর্মের হিসাব দেওয়ার জন্যে এবং তার কৃতকর্মের ফলাফল শেষে পুরস্কার বা শাস্তির পরিমাণ নির্ধারণ শেষে জান্নাত/বেহেশত কিংবা জাহান্নাম/দোযখ এ পাঠানো হবে। ইসলামের নবী কিয়ামতের পুর্বের ঘটনাবলি সম্পর্কে কিছু আগাম নিদর্শন বলে গেছেন। সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি হল
ইংরেজি ভাষায় ইসলাম (al-Islām) শব্দটির দশটি উচ্চারণ রয়েছে। উচ্চারণের সময় আক্ষরিকভাবে কোন ‘সিলাবলটির উপর জোর দেয়া হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে এই আলাদা আলাদা উচ্চারণগুলো প্রচলিত হয়েছে। এখানে বাংলা একাডেমি অভিধানের উচ্চারণ দুটি দেয়া হল। যুক্তরাষ্ট্র (), যুক্তরাজ্য () আরবীতে ক্রিয়ার রুপ ও ব্যবহার বাংলা/ইংরেজি ব্যাকরন হতে মৌলিকভাবে আলাদা)
আহমদীয়া; পূর্ণরূপে আহমদীয়া মুসলিম জামাত (উর্দু: احمدیہ مسلم جماعت; আরবি: الجماعة الإسلامية الأحمدية) একটি মুসলিম ধর্মীয় পুনর্জাগরণ অথবা মসিহবাদী আন্দোলন যার উদ্ভব হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ব্রিটিশ ভারতেরকাদিয়ান এলাকার মির্যা গোলাম আহমদের জীবন ও শিক্ষার ভিত্তিতে। মির্যা গোলাম আহমদ (১৮৩৫-১৯০৮) দাবী করেছিলেন যে আল্লাহ তাকে আখেরী জামানায় প্রতিশ্রুত ও মুসলমানদের প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী ও প্রতিশ্রুত মসীহ (যীশু বা ঈসা) উভয় হিসেবেই প্রেরণ করেছেন ইসলামের চূড়ান্ত বিজয় শান্তিপূর্ণভাবে সংঘটিত করতে এবং অন্যান্য ধর্মীয় মতবাদের প্রতীক্ষিত পরকালতাত্ত্বিক ব্যক্তিত্বদের মূর্ত করতে। নবী মোহাম্মদের বিকল্প নাম ‘আহমদ’ থেকে এই আন্দোলন ও সদস্যগণ (‘আহমদী মুসলিম’ বা সংক্ষেপে ‘আহমদী’) নিজেদের নামকরণ করলেও সাধারণভাবে মুসলিম বিশ্বে তাদের প্রতিষ্ঠাতার জন্মগ্রহণকারী অঞ্চলের নাম কাদিয়ান এর নামে কাদিয়ানী হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়। সর্বপ্রথম ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে আহমিদের অমুসলিম ঘোষণা করা হয়। সৌদি আরবে পুরো দেশে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাদের কেউ সেখানে গোপনে হজ পালন করতে গেলে তাকে আটক করা হয়।[২]
আহমদীরা বিশ্বাস করে যে মির্যা গোলাম আহমদ ইসলামকে তার আসল প্রথমযুগীয় অবস্থায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী কেতাবে উল্লেখিত যীশু বা ঈসার গুণবিশিষ্ট ইমাম মাহদী হয়ে এসেছেন ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করতে ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তির লক্ষ্যে এর নৈতিক ব্যবস্থা চলমান করতে। তারা আরও বিশ্বাস করে যে মির্যা গোলাম আহমদ ইসলামের শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ(সা.) এর প্রদর্শিত পথে পাঠানো একজন “উম্মতী নবী”। তাদের মতে নবুয়াত খাতামান্নাবিঈন এর অর্থ নবুয়াত এর সমাপ্তি নয় বরং খাতামান্নাবিঈন মানে “নবীগনের মোহর” বা নবীগনের সত্যায়নকারী। তাদের মতে নবী মোহাম্মদ এর প্রকৃত অনুসরনে নতুন নবী আসতে পারবেন তবে তিনি হবেন ‘উম্মতী নবী’ ও তিনি কোনো নতুন শরীয়ত আনবেন না।[৩]আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত বা সুন্নীদের মতে, এই ‘উম্মতী নবীর’ ধারণা কুরআন ও হাদীস দ্বারা সমর্থিত নয় এবং তারা তাদেরকে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত মানে না।[৪][৫] আহমদীয়াদের মতে যেহেতু তারা কালিমা তৈয়বা ‘লা ইলাহা ইলাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ মনে প্রাণে বিশ্বাস করে বলে তাদের ‘অমুসলিম’ ঘোষণা করার অধিকার কারো নেই।[৬] আহমদীয়া মুসলিম জামাতের কার্যক্রম ক্রমবর্ধমান। পৃথিবীর ২১৩ দেশে আহমদীয়াদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এই সংগঠনের বর্তমান কেন্দ্র লন্ডনে অবস্থিত। গোলাম আহমদের মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা খিলাফত প্রবর্তন করে এবং তাদের নির্বাচিত ৫ম খলিফা মির্যা মাসরুর আহমেদ লন্ডন থেকে এই সংগঠনের কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন।[৭] আহমদী বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডকে ‘আহ্মদীয়াত’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়।[৮]
১৮৮৯ সালে পাঞ্জাব অঞ্চলে আহমদীয়া আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা হলেও ‘আহমদীয়া’ নামটি রাখা হয় আরও এক দশক পর। ১৯০০ সালের ৪ নভেম্বরের একটি ইস্তেহারে গোলাম আহমদের ভাষ্যে নামটি নিজের নাম ‘আহমদ’-কে ইঙ্গিত করছে। ‘আহমদ’ নামটি নবীজির মক্কী জীবনকালে তার খোতবার সৌন্দর্য, শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ এবং উদ্যম ও ধৈর্য বহন করে এবং ‘মোহাম্মদ’ ও ‘আহমদ’-এর মধ্যে দ্বিতীয়টি বেশি মনোযোগ দখল করে। উপরন্তু তিনি বলেন বাইবেলেরপুরাতন নিয়মেমোশির (নবী মুসার) মত নবী বলে নবী মোহাম্মদের আগমনের উল্লেখ আছে এবং কোরআনে নবী ঈসা সেই নবীর ব্যাপারে ইঙ্গিত করেন ‘আহমদ’ নামটি দ্বারা। তাই ‘মোহাম্মদ’ নামটিকে নবী মুসার জুলুমের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামী কর্মকাণ্ড এবং ‘আহমদ’-কে নবী ঈসার শান্তিপূর্ণ ধর্মোপদেশ কার্যের সঙ্গে তিনি যুক্ত করেন এবং মুসলিম বিশ্বে অন্যান্য আন্দোলন থেকে আলাদা করতে তিনি ‘আহমদীয়া’ নামটি বেছে নেনঃ
“যে নামটি এই আন্দোলনের সবচেয়ে উপযোগী এবং আমার ও আমার জামাতের জন্যে আমি পছন্দ করি তা হল ‘আহমদীয়া বর্গের মুসলমানগণ’। তবে এটি ‘আহমদী মাজহাবের মুসলমানগণ’ হিসেবে উল্লেখ হলেও তা গ্রহণযোগ্য।” (মাজমু’আ ইশ্তেহারাত, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৬৪)
২৩ মার্চ ১৮৮৯ তারিখে পঞ্জাবের লুধিয়ানায় তার বাড়িতে মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তার সহচারী অনুসারীদের কাছ থেকে (মুসলমানদের নেতা মাহদী হিসেবে) ইমামত বা খেলাফতের বায়াত (আনুগত্যের শপথ) গ্রহণ করেন। এর পূর্ব তিনি সুত্র অনুযায়ী তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ওহী বা আপ্তবাক্য পেতে শুরু করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে তিনি নিজেকে মোজাদ্দেদ (মুসলিম বিশ্বে প্রতি একশত বছর পর আগত ইসলামের পুনরুদ্ধারকারী), রূপক অর্থে মসীহের পুনরাগমন এবং মুসলমানদের প্রতীক্ষিত মাহদী হিসেবে দাবি করেন এবং ব্রিটিশ ভারতের যুক্তপ্রদেশ (বর্তমানে উত্তরাখণ্ড ও উত্তর প্রদেশ), পঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অনুসারী লাভ করেন। তিনি ও তার অনুসারীরা দাবি করে যে নবী মোহাম্মদসহ বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ তার আগমনের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছে।
ঊনবিংশ শতকে ভারতবর্ষে ব্যাপক খ্রিষ্টান ও আর্য সমাজবাদী ধর্মপ্রচারের জবাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত একটি আন্দোলন হিসেবেই গড়ে ওঠে আহমদীয়া। কিন্তু পরবর্তীতে এটি ইংরেজ সরকারের পক্ষে অনেক গ্রন্থ রচনা করে এবং জিহাদকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১৯১৩ সনের দিকেই আহমদীয়া জামাত বিদেশে তাদের প্রচার কর্ম শুরু করে (যেমন লন্ডনে ফজল মসজিদ নির্মাণ)। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে আহমদীয়া আমেরিকায় ‘সিভিল রাইটস মুভমেন্ট’ বা নাগরিক অধিকার আন্দোলনের অগ্রদূত। এটি ১৯৫০ পর্যন্ত “আফ্রিকান-আমেরিকান ইসলামে তর্কসাপেক্ষে সবচেয়ে প্রভাবশালী সম্প্রদায়” হিসেবে বিবেচিত এবং বিশেষ করে আফ্রিকা মহাদেশে বিপুল একটি ধর্মমত।
বর্তমান অবস্থা
মুসলমানদের প্রচলিত বিশ্বাসের সাথে আহমদীদের মতবাদের ভিন্নতা থাকায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মূলধারার মুসলমানগণ প্রথম থেকেই আহমদীয়ার বিরোধিতা করে আসছে। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান সরকার আহমদীদের অমুসলিম ঘোষণা করে। পাকিস্তানের মত বাংলাদেশের বিভিন্ন ইসলামী দলগুলোর পক্ষ থেকে আহমদীদের অমুসলিম ঘোষণা করার জন্য আন্দোলন হতে থাকে। বিভিন্ন সময়ে আহমদী মুসলমানরা বিভিন্ন সহিংসতার শিকার হয়ে থাকেন।
বিশ্বাস
আহমদীরা বিশ্বাস করে যে আল্লাহ্ মসীহকে সশরীরে (জীবন্ত অবস্থায়) আসমানে (সপ্ত স্বর্গের একটি) তুলে নিয়ে যান নি। তিনি এই পৃথিবীতেই (মাজার কাশ্মীরেরশ্রীনগরে একটি এলাকায়) স্বাভাবিকভাবে মৃত্যবরণ করেছেন এবং মৃত্যুর পর বেহেশতে চলে গেছেন। যীশুর পুনরাগমন হবে এবং তা হবে মোহাম্মদের উম্মতদের মধ্য থেকে। তাদের যুক্তি হল যদি ইসলামকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে বেহেশত থেকে যীশুকেই পাঠাতে হয় তাহলে সেটা খাতামান্নাবিয়ীন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা:) এর মর্যাদার পরিপন্থী। তাছাড়া কোরআনে যিশুকে [ ঈসা (আ:) কে] বনী ইসরাঈল জাতির নবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে [সুরা সাফফ]। কাজেই তিনিই যদি আগমন করেন তবে তিনি কোরআনের নিয়মের বাহিরে গিয়ে মুসলমান জাতির জন্য নবী হতে পারেন না। যীশুর দায়িত্ব পালন করার জন্য তাই মুসলমানদের মধ্য থেকে উঠে আসবেন কেউ যিনি ইসলামের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবেন। আর ইনি হলেন মির্যা গোলাম আহমদ।
মির্যা গোলাম আহমদ নিজে আহমদীদের বিশ্বাসের ব্যাপারে বলেছেন,
“আমরা ঈমান রাখি, খোদা তা‘লা ব্যতীত কোন মা‘বুদ নাই এবং সৈয়্যদানা মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলায়হে ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্র রসূল এবং খাতামুল আম্বিয়া। আমরা ঈমান রাখি, কুরআন শরীফে আল্লাহ্ তা‘আলা যা বলেছেন এবং আমাদের নবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে যা বর্ণিত হয়েছে উল্লিখিত বর্ণনানুসারে তা সবই সত্য। আমরা এ-ও ঈমান রাখি, যে ব্যক্তি এই ইসলামী শরীয়ত থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হয় অথবা যে বিষয়গুলি আবশ্যকরণীয় বলে নির্ধারিত তা পরিত্যাগ করে এবং অবৈধ বস্তুকে বৈধকরণের ভিত্তি স্থাপন করে, সে ব্যক্তি বে-ঈমান এবং ইসলাম বিরোধী। আমি আমার জামা‘তকে উপদেশ দিচ্ছি, তারা যেন বিশুদ্ধ অন্তরে পবিত্র কলেমা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্’-এর উপর ঈমান রাখে এবং এই ঈমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করে। কুরআন শরীফ হতে যাদের সত্যতা প্রমাণিত, এমন সকল নবী (আলাইহিমুস সালাম) এবং কিতাবের প্রতি ঈমান আনবে। নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাত এবং এতদ্ব্যতীত খোদা তা‘লা এবং তাঁর রসূল (সা.) কর্তৃক নির্ধারিত কর্তব্যসমূকে প্রকৃতপক্ষে অবশ্য-করণীয় মনে করে যাবতীয় নিষিদ্ধ বিষয়সমূহকে নিষিদ্ধ মনে করে সঠিকভাবে ইসলাম ধর্ম পালন করবে। মোট কথা, যে সমস্ত বিষয়ে আকিদা ও আমল হিসেবে পূর্ববর্তী বুজুর্গানের ‘ইজমা’ অর্থাৎ সর্ববাদী-সম্মত মত ছিল এবং যে সমস্ত বিষয়কে আহলে সুন্নত জামা’তের সর্বাদি-সম্মত মতে ইসলাম নাম দেয়া হয়েছে, তা সর্বতোভাবে মান্য করা অবশ্য কর্তব্য। যে ব্যক্তি উপর্যুক্ত ধর্মমতের বিরুদ্ধে কোন দোষ আমাদের প্রতি আরোপ করে, সে তাকওয়া বা খোদা-ভীতি এবং সততা বিসর্জন দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রটনা করে। কিয়ামতের দিন তার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগ থাকবে, কবে সে আমাদের বুক চিরে দেখেছিল, আমাদের এই অঙ্গীকার সত্বেও অন্তরে আমরা এসবের বিরুদ্ধে ছিলাম”?[৯]
সমালোচনা
দাবি করা হয়, মির্যা গোলাম আহমদ একসময় নিজেকে অন্য নবীদের মতই নবী দাবি করেছিলেন যা সূরা আহযাবের ৪০ নং আয়াতের পরীপন্থী।
সূরা আন-নিসার ১৫৭-১৫৮ আয়াত অনুসারে, ইসলামের নবী হযরত ঈসা (আ.)-কে হত্যা করা হয় নি বরং আল্লাহ্ তাকে তার কাছে তুলে নিয়েছেন। সূরা আন-নিসার সেই আয়াত দু’টি হল:
আয়াত ১৫৭: “আর তাদের একথা বলার কারণে যে, আমরা মরিয়ম পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি যিনি ছিলেন আল্লাহর রসূল। অথচ তারা না তাঁকে হত্যা করেছে, আর না শুলীতে চড়িয়েছে, বরং তারা এরূপ ধাঁধায় পতিত হয়েছিল। বস্তুতঃ তারা এ ব্যাপারে নানা রকম কথা বলে, তারা এক্ষেত্রে সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে, শুধুমাত্র অনুমান করা ছাড়া তারা এ বিষয়ে কোন খবরই রাখে না। আর নিশ্চয়ই তাঁকে তারা হত্যা করেনি।”[১০]
আয়াত ১৫৮: “বরং তাঁকে উঠিয়ে নিয়েছেন আল্লাহ তা’আলা নিজের কাছে। আর আল্লাহ হচ্ছেন মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।”[১১]
হাদিস অনুসারে নবী ঈসা (আ.) আসমান থেকে সরাসরি দামেস্কের পূর্ব দিকে মসজিদের সাদা মিনারের পাশে অবতরণ করবেন। তিনি এসে আল-মাহদীর (যিনি ইসলামের শেষ নবীর (সা.) মেয়ে ফাতিমার বংশের হবেন) নেতৃত্বে সালাত আদায় করবেন। তিনি দাজ্জালকে হত্যা করবেন, ক্রুশ ভেঙ্গে ফেলবেন, শুকর নিধন করবেন, জিযিয়া রহিত করবেন।[১২] ইমাম মাহদী ও মসীহ দুইজন আলাদা ব্যক্তি হবেন। এই বিষয়গুলো মির্যা গোলাম আহমদের দাবির বিপরীত হওয়ায় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত আহমদীয়াদের অমুসলিম (কাফির) বলা হয়। কেননা মুসলিম হতে হলে সর্বপ্রথম কুরআনের প্রতিটি বাক্যে বিশ্বাস রাখতে হবে। কিন্তু তারা সূরা আন-নিসার ১৫৭-১৫৮ নম্বর আয়াতে বর্ণিত ঈসা (আ.) কে আকাশে তুলে নেয়ার বিষয়টি বিশ্বাস করে না। অন্যদিকে ইমাম মাহদী এবং মসীহ ভিন্ন ব্যক্তি হবেন, সেটাও বিশ্বাস করে না। সেজন্য তারা ইসলামিক বিশ্বাস অনুযায়ী কাফির হবে বলে বিশ্বের ওলামায়ে কেরাম তাদেরকে কাফির বলে ফতওয়া দিয়েছেন।
বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ক্ষুদ্র পরিসরে আহমদীয়া জামাতের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে সারা দেশে ১০৩টি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৪২৫টি স্থানে আহমদীদের বসবাস বা কার্যক্রম রয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুন্দরবন, আহমদনগর-শালসিঁড়ি, রাজশাহী, কুমিল্লা এবং জামালপুর-ময়মনসিংহ অঞ্চলে আহ্মদীদের সংখ্যা উল্ল্যেখযোগ্য। জামাতের সাংগঠিক কার্যক্রম স্বেচ্ছাসেবকদের দ্বারা পরিচালিত হয়। জামাতের ৬৫জন মোবাল্লেগ রয়েছে যারা জামাতের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। এই জামা’ত ১৯২০ সন থেকে বাংলাদেশের প্রাচীনতম পাক্ষিক পত্রিকা ‘আহ্মদী’ নিয়মিতভাবে বের করে আসছে। অঙ্গসংগঠনসমূহের নিজস্ব ম্যাগাজিন/বুলেটিন রয়েছে। [৮]
আহলুল হাদীস (আরবি: أهل الحديث) হল কুরআন ও সহিহ হাদিসকে আইনের ক্ষেত্রে একমাত্র উৎস হিসেবে বিবেচনা করে ইসলামি যুগের দ্বিতীয় / তৃতীয় শতাব্দীতে সংগঠিত হাদীস পণ্ডিতদের একটি আন্দোলন।[১]
ইতিহাস
আনুমানিক ইসলাম আগমনের তৃতীয় শতাব্দীর দিকে সমসাময়িক আইনশাস্ত্রের আলেমদের মতামত অপেক্ষা মুহাম্মাদ এর মতাদর্শ বা হাদিসের উপর অধিক জোর প্রদানের মাধ্যমে এই মতবাদের সূচনা হয়।[২] ৩য় শতাব্দীতে আহমদ ইবনে হাম্বলের নেতৃত্বে মুতাজিলা মতবাদের বিরোধিতার মাধ্যমে এই মতবাদের উদ্ভব ঘটে।[৩] কেভিন জাকুয়েসের মতে, আহলে হাদিসগণ খলিফা ইয়াজিদ কর্তৃক সঙ্ঘটিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া হিসেবে একটি ধর্মীয় ইতিবাচক ব্যাখ্যার উন্মেষ ঘটিয়েছেন।[৪] অধ্যাপক ‘সেরিল গ্লাসি’ ইবনে হাজমকে আহলে হাদিস মতবাদের সবচেয়ে বড় দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক বলে মনে করেন।[৫]ইবনে তাইমিয়া[৬], আল জাহাবি[৭], আহমদ ইবনে হাম্বল, ইবনে কাইয়িম আল জাওয়াজিয়া[৮], মুহাম্মাদ আল বুখারি, ইবনে হাজার আস্কালানি[৯], ইমাম কাজী আবুল ফযল ইয়াযসহ আরও অনেকেই এই মতবাদকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন ও সহযোগিতা করেছেন। এই মতবাদের অনুসারীগণ নিজেদের রাশিদুন খলিফার মতবাদের অনুসারী বলে মনে করেন।
আস-সালামু আলাইকুম (আরবি: ٱلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ) আরবি ভাষায় একটি অভিবাদনসূচক বাক্যাংশ, যার অর্থ “আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক”। সাধারণত মুসলিমরা ধর্মীয় অভিবাদনসূচক বাক্য হিসেবে এই বাক্যটি ব্যবহার করে থাকে।[১] এছাড়া অন্যান্য ধর্মের আরবি ভাষাভাষীরাও (যেমন: আরব খ্রিষ্টান[২]) এটি ব্যবহার করে থাকে। কথোপকথনে, প্রায়ই এই বাক্যাংশের প্রথম অংশ (অর্থাৎ সালাম অনু. ’শান্তি’) একজন ব্যক্তিকে অভিবাদন জানাতে ব্যবহৃত হয়। শুভেচ্ছার সাধারণ প্রতিক্রিয়া হলো “ওয়া ‘আলাইকুমুস সালাম” (وَعَلَيْكُمُ ٱلسَّلَامُ অনু. ’আপনার উপরও শান্তি বর্ষিত হোক’)। সম্পূর্ণ বাক্যাংশটি হলো “আস-সালামু ‘আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারকাতুহু” (ٱلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ ٱللَّٰهِ وَبَرَكَاتُهُ)।
এটি উল্লেখ্য যে, ‘আস্-সালাম’ (ٱلسَّلَامُ) আল্লাহরসুন্দর নামসমূহের মধ্যে একটি অন্যতম নাম এবং জান্নাতের নাম সমূহের মধ্যে একটি জান্নাতের নাম।
অভিব্যক্তিটি সাধারণত দ্বিতীয় পুরুষের বহুবচন পুংলিঙ্গ ব্যবহার করে, এমনকি যখন একজন ব্যক্তিকে সম্বোধন করতে ব্যবহৃত হয়। এটিকে উপযুক্ত এনক্লিটিক সর্বনাম বেছে নেওয়ার মাধ্যমে সংশোধন করা যেতে পারে পুরুষ এবং স্ত্রীলিঙ্গ একবচন, দ্বৈত রূপ, বা স্ত্রীলিঙ্গ বহুবচনে একজন ব্যক্তিকে সম্বোধন করার জন্য। সংযোজনগুলি নিম্নরূপ (দ্রষ্টব্য: কুরআনীয় আরবি বা শাস্ত্রীয় আরবি-এর প্রমিত উচ্চারণ নিয়ম অনুসারে, প্রতিটি শব্দের শেষ সংক্ষিপ্ত স্বরবর্ণটি পৌসা বা বিরতিতে উচ্চারিত হয় না):
একটি তৃতীয়-পুরুষ প্রকরণ, ʿআলাইহি আস-সালাম, “তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক”, এটি প্রায়শই মুহাম্মাদ এবং অন্যান্য পবিত্র ব্যক্তিত্ব ছাড়া অন্য নবীদের জন্য মুসলমানদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়, যেমন ফেরেশতা।
আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করে বলেন, যাও ফেরেশতাদের দলকে সালাম দাও এবং তোমার সালামের কি উত্তর দেয় মন দিয়ে শুন। এটিই হবে তোমার আর তোমার সন্তানদের জন্য সালাম। সে অনুযায়ী আদম গিয়ে বলেন, “আস্সালামু আলাইকুম” (অৰ্থ: আপনাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক)। ফেরেশতারা উত্তর দেন, “ওয়া-আলাইকুমুস সালাম ওয়া-রহমাতুল্লাহি” (অৰ্থ: আপনাদের উপর শান্তি এবং আল্লাহর দয়া বর্ষিত হোক)। এক্ষেত্রে ফেরেশতারা রাহমাতুল্লাহ শব্দটি বৃদ্ধি করেন।[৩]
অন্যান্য নবিদের জীবনে সালামের প্রচলন ছিল। ইব্রাহিম (আঃ) এর ক্ষেত্রে, কুরআনে বলা হয়েছে:
এবং অবশ্যই আমার ফেরেশতারা সুসংবাদ নিয়ে ইব্রাহীমের নিকট এসেছিল। তারা সালাম জানায়। তিনিও ‘সালাম’ দেন।[৪]
নির্দেশনা
সালাম দেয়া সুন্নাত। কুরআনে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন যে,
হে বিশ্বাসীগণ, তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্য গৃহে প্রবেশ করো না, যে পর্যন্ত আলাপ পরিচয় না কর এবং গৃহবাসীদেরকে সালাম না কর। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম। যাতে তোমরা স্মরণ রাখো।[৫]
হাদিসে অন্যের গৃহে গিয়ে তিনবার সালাম দিতে বলা হয়েছে এবং অনুমতি প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে। অনুমতি নাদিলে চলে আসতে বলা হয়েছে।[৬]
কোনো গৃহে প্রবেশের সময় সালাম দেওয়া সুন্নাহ। আল্লাহ্ কুরআনে উল্লেখ করেন,
অনুবাদ: তবে তোমরা যখন কোনো গৃহে প্রবেশ করবে তখন তোমরা নিজদের উপর সালাম করবে, আল্লাহর পক্ষ থেকে কৃপাপূর্ণ ও পবিত্র অভিবাদনস্বরূপ।[৭]
আনাস হতে বর্ণিত, মুহাম্মাদ বলেন,
«يا بني إذا دخلت على أهلك فسلم يكن بركة عليك وعلى أهلك» رواه الترمذي، وقال حديث حسن.
অনুবাদ: হে বৎস! তুমি যখন গৃহে প্রবেশ করবে, তখন সালাম দাও। তা তোমার জন্য ও তোমার পরিবার পরিজনের জন্য বরকত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।[৮]
আনাস হতে আরো বর্ণিত, মুহাম্মাদ বলেন,
«إذا خرج الرجل من بيته فقال بسم الله توكلت على الله لا حول ولا قوة إلا بالله يقال له هديت وكفيت ووقيت وتنحى عنه الشيطان» رواه الترمذي، و حسنه والنسائي وابن حبان في صحيحه.
بسم الله توكلت على الله لا حول ولا قوة إلا بالله
অনুবাদ: যখন কোনো ব্যক্তি গৃহ থেকে বের হওয়ার সময় এ দোআ পাঠ করে, তাকে বলা হয়, তোমাকে হেদায়েত দেয়া হয়েছে, তোমাকে বাঁচানো হয়েছে। আর শয়তান তার থেকে দূর হয়ে যায়।[৯]
আবু মালিক আল-আশআরী হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেন,
«إذا ولج الرجل بيته فليقل: اللهم إني أسألك خير المولج وخير المخرج بسم الله ولجنا وبسم الله خرجنا وعلى الله ربنا توكلنا ثم ليسلم على أهله» حديث حسن.
«اللهم إني أسألك خير المولج وخير المخرج بسم الله ولجنا وبسم الله خرجنا وعلى الله ربنا توكلنا»
অনুবাদ: যখন কোনো ব্যক্তি গৃহে প্রবেশ করে, সে যেন এ দোআ পাঠ করে- হে আল্লাহ! তোমার নিকট উত্তম বাসস্থান চাই এবং উত্তম বের হওয়া চাই। হে আল্লাহ! আমরা আল্লাহর নামে প্রবেশ করলাম এবং আল্লাহর নামে বের হলাম। হে আমাদের রব আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করলাম। তারপর সে তার পরিবার-পরিজনকে সালাম দেবে।[১০]
আবু হুরাইরা হতে বর্ণিত, মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেন,
«لا تدخلوا الجنة حتى تؤمنوا ولا تؤمنوا حتى تحابوا أو لا أدلكم على شيء إذا فعلتموه تحاببتم؟ أفشوا السلام بينكم» رواه مسلم.
অনুবাদ: তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা পরিপূর্ণ “ঈমানদার” হতে পারবে না। আর ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা পরিপূর্ণ “ঈমানদার” হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি তোমরা একে অপরকে ভালবাসবে না, আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি জিনিস বাতলে দেব, যা করলে তোমরা পরস্পর পরস্পরকে ভালো বাসবে? তোমারা বেশি বেশি করে সালামকে প্রসার কর।[১১]
কোনো জমায়েতকে সালাম দেয়ার ক্ষেত্রে সালাম শব্দটি “মারেফা” (السلام) বা “নাকিরা” (سلام) উভয় প্রকারে ব্যবহার করা যাবে। কারণ, হাদিসে উভয় প্রকারের ব্যবহার প্রমাণিত আছে। আল্লামা ইবনুল বান্না বলেন, সম্ভাষণের সালাম নাকিরা হবে, আর বিদায়ী সালাম মারেফা হবে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
সভা থেকে ফিরে যাওয়ার সময়, সালাম দেয়া মুস্তাহাব। কারণ আবু হুরাইরা হতে বর্ণিত, মুহাম্মাদ বলেন,
«إذا انتهى أحدكم إلى المجلس فليسلم فإذا أراد أن يقوم فليسلم فليست الأولى بأحق من الآخرة»
অনুবাদ: যখন তোমরা কোনো সভায় গিয়ে পৌছবে তখন তুমি সালাম দেবে। আর যখন তুমি সভা শেষ করে মজলিস থেকে উঠে দাঁড়াবে, তখনও সালাম দেবে। প্রথম সালাম শেষের সালাম থেকে অধিক গুরুত্ব বহন করে না।[১২]
জমায়েতের মধ্য হতে যে কোনো একজনের সালাম দেয়া দ্বারা সুন্নাহ আদায় হয়ে যাবে। উত্তম হলো জামাতের সবাইকে সালাম দেয়া। কারণ, হাদিসে বলা হয়েছে
«أفشوا السلام بينكم»
অনুবাদ: তোমরা তোমাদের পরস্পরের মধ্যে সালামকে প্রসার কর।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
আর যে সব ক্ষেত্রে সালাম দেয়া মাকরু, সে সব ক্ষেত্রগুলোকে আল্লামা গাজ্জি উল্লেখ করেন-
যাদের সালাম দেয়া মাকরুহ নিম্নে তাদের আলোচনা করা হল, এরা ছাড়া বাকী যাদের সাথে তোমার দেখা হবে, তাদের সালাম দেয়া সুন্নাহ ও বৈধ। সালাতরত ব্যক্তি, কুরআন পাঠকারী, আল্লাহকে স্বরণকারী, হাদিস পাঠদানকারী, খুতবাদানকারী এবং যারা খুতবা শুনায় মগ্ন [তাদের সালাম দেয়া মাকরুহ]। ফিকহ (আইনশাস্ত্র) নিয়ে আলোচনাকারী, বিচারক যিনি বিচার কার্যে ব্যস্ত [তাকেও সালাম দেয়া মাকরুহ]। আর যারা ফিকহ নিয়ে গবেষণা করছে তাদেরও তোমরা সালাম দেয়া হতে বিরত থাক, যাতে তারা উপকৃত হয়। মুয়াজ্জিন, একামত দানকারি ও পাঠদানকারীদের সালাম দেয়া মাকরুহ। অনুরূপভাবে অপরিচিত যুবতী নারী, [যাদের সালাম দেয়াতে অশান্তির আশঙ্কা থাকে] তাদের সালাম দেয়া কোনো ক্রমেই উচিত নয়(হারাম)। যারা দাবা খেলায় মগ্ন তাদের ও তাদের মত লোকদের সালাম দেয়া মাকরুহ। আর যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর সাথে খেল-তামাশায় মগ্ন [তাদের সালাম দেয়া যাবে না]। অমুসলিম ও নগ্ন লোককে সালাম দেবে না, মল-মুত্র লিপ্তদের সালাম দেয়া হতে বিরত থাকবে। অনুরূপভাবে খাওয়ায় ব্যস্ত [লোককে সালাম দেবে না], তবে যদি তুমি ক্ষুধার্ত হও এবং জান যে লোকটি তোমাকে ফিরিয়ে দেবে না। অনুরূপভাবে শিক্ষক যিনি পাঠদানে দেয়ায় ব্যস্ত। মনে রাখবে এই হল, শেষ ব্যক্তি বাকীদের সালাম দেয়াতে তুমি উপকার লাভ করবে।[১৩]
আগে সালাম দেয়া সুন্নাহ। কারণ, আবু উমামাহ হতে হাদিস বর্ণিত তিনি বলেন, মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেন,
«إن أولى الناس بالله من بدأهم بالسلام»
অনুবাদ: নিশ্চয় আল্লাহর নিকট উত্তম ব্যক্তি সে যে মানুষকে আগে সালাম দেয়।[১৪]
বাচ্চাদের সালাম দেয়া মুস্তাহাব। আনাস হতে বর্ণিত,
عن أنس أنه مر على صبيان فسلم عليهم وقال: «كان رسول الله يفعله» متفق عليه
অনুবাদ: আমি বাচ্চাদের নিকট দিয়ে অতিক্রম করি এবং তাদের সালাম দেই। মুহাম্মাদ (সাঃ)-ও অনুরূপ করতেন।[১৫]
যখন কোনো এক দল লোক কোনো বসা ব্যক্তি বা বসা লোকদের সভা উপস্হবে, তখন সে প্রথমে তাদের সালাম দেবে। কারণ মুহাম্মাদ বলেন,
«والمار على القاعد»
অনুবাদ: আর যখন কোনো ব্যক্তি দেয়ালের ওপাশ থেকে সালাম দেয়, তখন তার নিকট সালাম পৌছার পর, উত্তর দেয়া ওয়াজিব।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
নারীদের সালাম দেয়া পুরুষদের পরস্পরের সালামের মতই কোনো পার্থক্য নাই। একজন পুরুষ অপর পুরুষের সাথে মুসাফাহা করা মুস্তাহাব, অনুরূপভাবে একজন নারী অপর নারীর সাথে মুসাফাহা করা মুস্তাহাব। আবু খাত্তাব বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন,
“قلت لأنس: أكانت المصافحة في أصحاب رسول الله قال: نعم”
অনুবাদ: আমি আনাস (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলাম রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর যুগে মুসাফাহা করার প্রচলন ছিল কিনা? উত্তরে তিনি বলেন, জ্বি, ছিল।[১৬]
বারা ইবনে আজিব হতে বর্ণিত, মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেন,
«ما من مسلمين يلتقيان فيتصافحان إلا غفر لهما قبل أن يفترقا» رواه أبو داود.
অনুবাদ: যখন দুইজন মুসলিম একত্র হবে এবং একে অপরের সাথে মুসাফাহা করে তখন তারা উভয় বিচ্ছিন্ন হওয়ার পূর্বে আল্লাহ্ তাদের উভয়কে ক্ষমা করে দেন।[১৭]
পদ্ধতি
যে ব্যক্তি আগে সালাম দেবে, তার জন্য মুস্তাহাব হলে, সে বলবে- «ٱلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ ٱللَّٰهِ وَبَرَكَاتُهُ» (আসসালামু আলাইকুম)। সালাম দেয়ার ক্ষেত্রে বহুবচন শব্দ ব্যবহার করবে। যদিও উপস্থিত ব্যক্তি একজন হয়। আর সালামের উত্তর দাতা এ বলে উত্তর দেবে: وَعَلَيْكُمُ ٱلسَّلَامُ وَرَحْمَةُ ٱللَّٰهِ وَبَرَكَاتُهُ، (ওয়া-আলাইকুমুস সালাম ওয়া-রাহমাতুল্লাহি ওয়া-বারাকাতুহ) সালামের উত্তরে واو العطف উল্লেখ করবে। আর মনে রাখবে, সালাম দেয়ার সময় কেউ যদি ٱلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ (আসসালামু আলাইকুম) এবং উত্তর দেয়ার সময় শুধু وَعَلَيْكُمُ ٱلسَّلَامُ. (ওয়া-আলাইকুমুস সালাম) বলে, তাতে সালাম আদায় হয়ে যাবে। যখন কোনো একজন মুসলিমকে সালাম দেয়া হল, তারপর তার সাথে যতবার দেখা হবে, ততবার সালাম দেবে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] কারণ, হাদিসে সালামকে প্রসার করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেন,
যখন দুই সাক্ষাতকারী পরস্পর সালাম দেয় এবং পরস্পরের সালাম শুনতে পায়, তখন উভয়ের উপরই সালামের উত্তর দেয়া ওয়াজিব হয়ে যায়। আবু হুরাইরা বলেন,
«إذا لقي أحدكم أخاه فليسلم عليه، فإن حالت بينهما شجرة أو جدار أو حجر ثم لقيه فليسلم عليه» رواه أبو داود، وحديث المسيء وتقدم.
অনুবাদ: যখন তোমরা তোমাদের কোন ভাইয়ের সাথে সাক্ষাত কর, তাকে সালাম দাও। যদি তোমাদের উভয়ের মাঝে কোন গাছ কিংবা পাথর বা দেয়াল বিচ্ছিন্নতা ঘটায়, তারপর আবার দেখা হয়, তাহলে আবারও সালাম দাও।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
সালামের উত্তর
সালামের উত্তর দেয়া ফরযে কিফায়াহ। যদি উপস্থিত লোক একজন হয়, তবে তাকেই সালামের উত্তর দিতে হবে। কারণ, আল্লাহ্ বলেন,
«يجزي عن الجماعة: إذا مروا أن يسلم أحدهم ويجري عن الجلوس أن يرد أحدهم» رواه أبو داود.
অনুবাদ: যখন কোনো জমায়েত অতিক্রম করে, তখন তাদের থেকে যে কোন একজনের সালাম যথেষ্ট হবে এবং কোন সভা হতে যে কোন একজন সালামের উত্তর দিলে তা সকলের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে।[২০]
আর যখন কোনো ব্যক্তি দূর থেকে চিঠির মাধ্যমে অথবা দূতের মাধ্যমে কাউকে সালাম দেয়, তখন তার নিকট সালাম পৌছার পর সালামের উত্তর দেয়া ওয়াজিব। তবে মুস্তাহাব হল, দূতকেও সালাম দেয়া এবং এ কথা বলা, وعليك وعليه السلام (তোমার উপর ও তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক)। কারণ, হাদিসে বর্ণিত, নবি মুহাম্মাদ (সাঃ) এর নিকট একজন ব্যক্তি এসে বলল,
أبي يقرؤك السلام فقال: «عليك وعلى أبيك السلام».
অনুবাদ: আমার পিতা আপনাকে “সালাম” দিয়েছে। এ কথা শোনে মুহাম্মাদ বললেন, আপনার এবং আপনার পিতার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
যদি কোনো ব্যক্তি বধিরকে সালাম দেয়, তখন মুখে বলবে এবং হাতে ইশারা করবে। আর বোবা ব্যক্তির সালাম দেয়া ও উত্তর দেয়া উভয়টি ইশারা দ্বারা হবে। কারণ, তার ইশারা কথার স্থলাভিষিক্ত।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
অ-আরব বক্তাদের দ্বারা ব্যবহার
ইরান, আফগানিস্তান, আজারবাইজান ও তাজিকিস্তানেসালামো আলেইকোম (Salam-o aleykom) শব্দটির ব্যবহার অনিয়মিত, তবে শুধু সালাম (ফার্সি: سلام, প্রতিবর্ণী. Salâm) শব্দটি ঘন ঘন ব্যবহার করা হয়। খুদা হাফেজ (ফার্সি: خدا حافظ, প্রতিবর্ণী. Khudâ hâfez, অর্থ: সঙ্গে আল্লাহর সুরক্ষা) শব্দটি বিদায় জানানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে বেহ্ সালামাৎ (ফার্সি: به سلامت, প্রতিবর্ণী. Beh salâmat, অর্থ: শান্তির সঙ্গে) শব্দটির ব্যবহার অনিয়মিত।
আলবেনিয়া ও কসোভোতে আলবেনীয় ভাষায় আসসালামু আলাইকুমের সংকুচিত রূপ সেলামুন আলেজকেম বা সেলামুন আলেজক্বুম এর ব্যবহার বিরল। এখানে “ক্ব” একটি অঘোষ তালব্য ধ্বনি, যা সাধারণত বলকান তুর্কি ও থ্রাকীয় তুর্কির ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য।[২১]
আমহারীয় ভাষায়তাদিয়া এর স্থানের ক্ষেত্রে স্থানীয় আমহারীয় শব্দ সেলাম ব্যবহার করা হয়, যার অর্থ “কি খবর!” শব্দদ্বয়ের সমতুল্য।
তুরস্ক, কাজাখস্তান ও কিরগিস্তানে অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষ সাক্ষাৎকারে “আসসালামু আলাইকুম” কথাটি ব্যবহার করেন এবং একে অপরের সঙ্গে করমর্দন করেন, যা সাধারণত বিদায় জানানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে কিছু ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মহীন মানুষ অভিবাদনকালে শুধু “সেলাম” শব্দটি ব্যবহার করেন। তবে অনেক তুর্কিরাই শব্দটি “সেলামুন আলেইকুম” বলে অনেকটা ভিন্নভাবে উচ্চারণ করেন।
পাকিস্তানে ডান হাতে করমর্দন এবং কখনো কখনো কোলাকুলির মাধ্যমেও অভিবাদন জানানো হয় (শুধু মাত্র একই লিঙ্গের মানুষের মাঝে)। কিছু স্থানে লোকেরা একহাত বুকের উপর রেখে অপর হাত দিয়ে করমর্দন করে অভিবাদন জানায়। এছাড়াও দীর্ঘ শুভেচ্ছা (আসসালামু আলাইকুম)’র পরিবর্তে সংক্ষেপে “সালাম” বলে অভিবাদনের রীতিও রয়েছে। বিদায় জানানোর ক্ষেত্রে “খুদা হাফিজ” (নিরপেক্ষ/প্রথাগত; সাধারণত পরিচিতদের ক্ষেত্রে) অথবা “আল্লাহ হাফিজ” (সল্প নিরপেক্ষ/প্রথাগত; সাধারণত অপরিচিতদের ক্ষেত্রে) ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যার উভয়ের অর্থ “আল্লাহ আপনাকে/তোমাকে নিরাপদে রাখুক”।
ভারতে বেশিরভাগ মুসলমানদের মাঝে সাধারণ করমর্দন ও কোলাকুলির মাধ্যমে অথবা আসসালামু আলাইকুম বা অনানুষ্ঠানিকভাবে সংক্ষেপে “সালাম” বলে অভিবাদন জানানো হয়। বিদায় জানানোর ক্ষেত্রে “খুদা হাফিজ” (নিরপেক্ষ/প্রথাগত; সাধারণত পরিচিতদের ক্ষেত্রে) অথবা “আল্লাহ হাফিজ” (সল্প নিরপেক্ষ/প্রথাগত; সাধারণত অপরিচিতদের ক্ষেত্রে) ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যার উভয়ের অর্থ “আল্লাহ আপনাকে/তোমাকে নিরাপদে রাখুক”।
বাংলাদেশের মুসলমানদের মাঝে “আসসালামু আলাইকুম” সবচেয়ে সাধারণ ও জনপ্রিয় অভিবাদন পদ্ধতি।[২২] কেউ কেউ ডান হাত কপালে তুলে “আসসালামু আলাইকুম” বলে প্রবীণ ব্যক্তিদের অভিবাদন জানান।[২৩]
আল-কাওয়াকিব আল-দারারি ফী শারহি সহীহ আল-বুখারী: এটি মুহাম্মদ বিন ইউসুফ বিন আলী বিন সাঈদ শামসুদ্দীন কিরমানি (মৃত্যু: ৭৮৬ হিজরি) দ্বারা রচিত একটি বই, খণ্ড সংখ্যা ২৫।
এতে সহীহ আল-বুখারির উপর একটি চমৎকার ব্যাখ্যা রয়েছে। লেখক হাদিস ও এর মধ্যে যে অর্থ আসতে পারে সেসব ও বর্ণনাকারীদের নাম ব্যাখ্যা করেছেন। অনেক ব্যাকরণগত ও অলঙ্কারিক বিষয় বইটিকে ভাষার ক্ষেত্রেও একটি উল্লেখ করে তোলে।[১]