ওরিয়ন প্রকল্প

ওরিয়ন প্রকল্প হল বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে পরিচালিত একটি গবেষণা যা করা হয়েছিল কোন নভোযানের পিছনে কিছু পারমাণবিক বোমার ক্রমিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নভোযানটিকে প্রচালিত করার ধারণা (পারমাণবিক স্পন্দিত প্রচালন) নিয়ে । তখন এ ধরনের নভোযান ভূপৃষ্ঠ থেকেই উড্ডয়ন করবার জন্য নকশা করা হয়েছিল, যা করা হলে প্রচালন এর সময় উড্ডয়নস্থলের আশেপাশের পরিবেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে তেজস্ক্রিয় পারমাণবিক অবশেষ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল । অবশ্য পরবর্তীকালে এ ধরনের নভোযানের নকশা নভোযানটিকে শুধুমাত্র মহাকাশে ব্যবহারের জন্যই উপস্থাপন করা হয় ।

বিস্ফোরক দ্রব্যাদির দহনের মাধ্যমে রকেট প্রচালনের এ ধারণাটি ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম উপস্থাপন করেছিলেন রুশ বিস্ফোরণ বিশেষজ্ঞ নিকোলাই কিবালচিচ এবং বিচ্ছিন্নভাবে একই ধারণা নিয়ে ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে কাজ করেছিলেন জার্মান প্রকৌশলী হারম্যান গ্যান্সউইন্দ । পারমাণবিক প্রচালন নিয়ে ১৯৪৬ সালে সাধারণ প্রস্তাবনা করেন স্টানিস ল উলাম এবং ১৯৪৭ সালে স্টানিস ল উলাম এবং ফ্রেডরিক রেইনিস যৌথভাবে এর প্রাথমিক হিসেব নিকেশ করেন একটি লস আলামোস স্মারকপত্রে[১] । আসল প্রকল্পটি শুরু হয় ১৯৫৮ সালে, পরিচালনায় ছিলেন জেনারেল অ্যাটমিকসের টেড টেইলর এবং পদার্থবিদ ফ্রিম্যান ডাইসন যিনি টেইলরের অনুরোধে ইন্সটিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডি থেকে এক বছর কাজের অব্যাহতি নেন এই প্রকল্পটিতে কাজ করার জন্যে ।

ওরিয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে একই সাথে উচ্চ মাত্রার জ্বালানির কর্মদক্ষতার পাশাপাশি অতি উচ্চ মাত্রার প্রতিক্রিয়া বল পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় । এতে যে উচ্চ মাত্রার শক্তি প্রয়োজন, তা মিটিয়ে দেবে পারমাণবিক বিস্ফোরণ । এই বিস্ফোরণগুলোকে নভোযানের ভরের সাপেক্ষে এতটা শক্তিশালী হতে হবে যাতে করে নভোযানের ভিতরের গঠনে কোন প্রভাব না ফেলে বিস্ফোরণগুলোকে বাইরে ঘটিয়েই ফল পাওয়া যায় । তখনকার সময়ে প্রচলিত নভোযানগুলোর সাথে ওরিয়ন প্রকল্পের নভোযানের একটা বৈশিষ্ট্যমূলক তুলনা তুলে ধরা যাক । ঐ সময়ে প্রচলিত রাসায়নিক শক্তিতে চালিত রকেট সমূহ, যেমন স্যাটার্ন V (স্যাটার্ন ফাইভ) যেটা অ্যাপোলো প্রোগ্রামকে চাঁদে নিয়ে গিয়েছিল, এই ধরনের রকেটগুলির ইঞ্জিন অতি উচ্চ মাত্রার প্রতিক্রিয়া বল দিতে পারে যদিও জ্বালানির কর্মদক্ষতা অনেক কম থাকে । আবার বৈদ্যুতিক আয়ন ইঞ্জিনগুলো খুব অল্প পরিমাণ প্রতিক্রিয়া বল দিতে পারে, তবে জ্বালানির কর্মদক্ষতা এ ক্ষেত্রে পাওয়া যায় অনেক বেশি । ঐ সময়কার সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির পারমাণবিক ইঞ্জিনগুলির তুলনায় ওরিয়ন অনেক ভালো কর্মদক্ষতার ও উপযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিল । ওরিয়ন প্রকল্পের পক্ষপাতীরা মনে করতেন এই প্রকল্প দ্বারা খুব কম খরচে আন্তঃসৌরমণ্ডলীয় যাতায়াত সম্ভব হবে । যদিও এই প্রকল্পটি খুব দ্রুতই রাজনৈতিক অসম্মতির সম্মুখীন হয়, যার প্রধান কারণ প্রচালন এর সময় পরিবেশে তেজস্ক্রিয় পারমাণবিক অবশেষ ছড়িয়ে পড়ে মারাত্মক পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি ।[২]

ওরিয়ন প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মূলত ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার আংশিক সীমিতকরণ চুক্তির কারণে । যদিও পরবর্তীকালে অনেক প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে যেগুলো প্রকৌশলগত যেকোন বিশ্লেষণকে তাপীয় শক্তি ব্যবহার করতে বিবেচনা করার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল, যেমন লংশট প্রকল্প, দেদালুস প্রকল্প এবং মিনি-ম্যাগ ওরিয়ন । এ ধরনের প্রকল্পগুলির প্রতিটিতেই বাইরে থেকে তরঙ্গ আকারে শক্তি পাঠিয়ে প্রচালন (তরঙ্গায়িত শক্তি দিয়ে প্রচালন) করার ঝামেলা এড়িয়ে উচ্চ কর্মদক্ষতাসম্পন্ন আন্তঃসৌরমণ্ডলীয় যাতায়াতকে সম্ভব করতে নবায়নযোগ্য শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্যে গুরুতর কিছু ধারণা প্রস্তাব করা হয় । প্রতিটি প্রকল্পের জন্যে প্রস্তাবিত ধারণাগুলির মধ্যে বিতর্কিত পারমাণবিক স্পন্দিত প্রচালন এর মূলনীতিটি ছিল সাধারণ । অবশ্য পরবর্তীকালে প্রস্তাবিত এই প্রকল্পগুলিতে মূলনীতিটির অনেক পরিবর্তন করা হয় । এমন সব যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যাতে ব্যবহৃত পেলেটের বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে প্রকল্পভেদে খুব কম পরিমাণে নিউক্লীয় ফিশন বা নিউক্লীয় ফিউশন হয় । কিন্তু ওরিয়ন প্রকল্পের চিত্র ছিল একেবারে বিপরীত, এতে ব্যবহৃত পারমাণবিক স্পন্দিত প্রচালন এর ইউনিট (পারমাণবিক বোমা) ছিল ঐসব প্রকল্পের থেকে অনেক বড় পরিসরের এবং সেগুলো তৈরিতে ঐসব প্রকল্পের মতো ধারনামূলক প্রযুক্তি অপেক্ষাকৃত কম ব্যবহৃত হয়েছিল ।

২০০৩ সালে এই প্রকল্প নিয়ে নির্মিত একটি বিবিসি তথ্যমূলক চলচ্চিত্র হল To Mars by A-Bomb: The Secret History of Project Orion[৩]

মূলনীতি

ওরিয়ন নভোযান – প্রধান অংশসমূহ । [৪]

সচরাচর আন্তঃসৌরমণ্ডলীয় যাতায়াতের জন্য মুক্তিবেগ দরকার পড়ে অনেক বেশি, ১৯ থেকে ৩১ কি মি/সে (১২ থেকে ১৯ মাইল/সে) । অন্যান্য নভোযান প্রচালন এর প্রযুক্তি হয় উচ্চ মুক্তিবেগ না হয় উচ্চ প্রতিক্রিয়া বল, যেকোনো একটি দিতে পারে । ওরিয়ন প্রকল্পের নিউক্লীয় পালস রকেটই (পারমাণবিক স্পন্দিত প্রচালন দ্বারা পরিচালিত রকেট) একমাত্র প্রস্তাবিত প্রযুক্তি যা উচ্চ মুক্তিবেগের সাথে অনেক মেগানিউটন প্রতিক্রিয়া বল দিয়ে উচ্চ কর্মক্ষমতার নিশ্চয়তা দেয় । (বিভিন্ন প্রচালন ব্যবস্থার সাথে পরিচিত হতে চাইলে দেখুন নভোযান প্রচালন )

জ্বালানির কর্মদক্ষতা (Isp) বলতে প্রতি একক ভরের জ্বালানি থেকে কতটুকু প্রতিক্রিয়া বল পাওয়া যাবে তা বোঝায় । এ পরিমাপটি রকেটবিদ্যার জগতে কর্মক্ষমতা প্রকাশের জন্যে একটি আদর্শ । যেকোনো রকেট প্রচালনের ক্ষেত্রে, যেহেতু গতিশক্তি বেগের বর্গের সমানুপাত হারে বাড়ে(গতিশক্তি = ½ mv2) এবং ভরবেগ ও প্রতিক্রিয়া বল বাড়ে বেগের সমানুপাতিক (ভরবেগ = mv) হারে, সেহেতু মুক্তিবেগ এবং জ্বালানির কর্মদক্ষতা যত বেশি হবে, একটি নির্দিষ্ট মাত্রার প্রতিক্রিয়া বল (অভিকর্ষজ ত্বরণ(g) এর মানের গুণিতক আকারে) অর্জন করতে তত বেশি শক্তি লাগবে(উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, প্রস্তাবিত বৈদ্যুতিক প্রচালন ব্যবস্থা যেটাতে কিনা উচ্চ জ্বালানির কর্মদক্ষতা, Isp প্রয়োজন, সে তুলনায় অনেক কম প্রতিক্রিয়া বল দেয় । কেননা তারা ব্যবহারের জন্য শক্তি পায় খুব সীমিত মাত্রায় । তাদের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া বল থাকে জ্বালানির কর্মদক্ষতার ব্যস্তানুপাতিক যদি শক্তি ব্যয়ের হার ধ্রুব হয় কিংবা যেকোনো প্রকৌশলজনিত সমস্যার কারণে তাপ আকারে শক্তি হারিয়ে যায় ) [৫] ওরিয়ন প্রকল্পের একটি নভোযান পারমাণবিক কিছু বিস্ফোরণ ঘটিয়ে যে পরিমাণ শক্তি বাইরের পরিবেশে নির্গমন করতে পারে, এই নির্গমন হার এতটাই বেশি যা তেজস্ক্রিয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে এখন পর্যন্ত জানা যত পদার্থ এবং যত রক্ষণশীল নকশা আছে যা দিয়ে একটি পারমাণবিক চুল্লীকে অভ্যন্তরীণ তেজস্ক্রিয়তা থেকে রক্ষা করা যায়, তাদের যেকোনোটির সাধ্যের বাইরে ।

ওরিয়ন নভোযানসমূহের আকার

তাত্ত্বিক প্রয়োগ

পরবর্তী সময়ে উন্নয়ন

অর্থনীতি

নভোযানসমূহের স্থাপত্য

সম্ভাব্য যত সমস্যা

যাঁরা এ প্রকল্পে কাজ করেছেন

অপারেশন প্লাম্ববব

কল্পকাহিনীতে ওরিয়ন প্রকল্প