জৈবক্ষমতা

জৈবক্ষমতা (ইংরেজি: Biopower, ফরাসী: Biopouvoir) হচ্ছে ফরাসী শিক্ষায়তনিক, ঐতিহাসিক এবং সামাজতাত্ত্বিক মিশেল ফুকো এর দেয়া একটি শব্দ। এটি আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের চর্চা এবং সেগুলোর নাগরিকের “শরীরের উপর আধিপত্য অর্জন এবং জনগণকে নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে অনেক ও বৈচিত্র্যময় উপায় এর বিষ্ফোরণ” সাথে এটি সম্পর্কিত।[১] কলেজ ডি ফ্রান্স-এ ফুকো এই শব্দটি প্রথম তার লেকচার কোর্সে উল্লেখ করেন।কলেজ ডি ফ্রান্স[২][৩] কিন্তু এই শব্দটি প্রথম ছাপানো অবস্থায় পাওয়া যায় দ্য উইল টু নলেজ গ্রন্থে, যা ফুকোর দ্য হিস্টোরি অফ সেক্সুয়ালিটি এর প্রথম খণ্ডে এসেছিল।[৪] ফুকোর কাজে এটাকে গণস্বাস্থ্য, উত্তরাধিকারসূত্র নিয়ন্ত্রণ, ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ, এবং আরও অনেক নিয়ন্ত্রণমূলক কৌশলের ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো সরাসরি শারীরিক স্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কিত। এটি আরেকটি শব্দের সাথে সম্পর্কিত যা তিনি কম পরিমাণে ব্যবহার করেছেন, কিন্তু পরবর্তী চিন্তাবিদরা স্বাধীনভাবে সেই শব্দটাকে নিয়ে নিয়েছেন, সেটা হল জৈবরাজনীতি (Biopolitics)। যে কৌশলের দ্বারা রাষ্ট্র দ্বারা জ্ঞান, ক্ষমতার উপর আধিপত্য এবং অধীনস্থ বানাবার প্রক্রিয়ার দ্বারা মানব জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে তার ক্ষেত্রে জৈবরাজনীতির ধারণাটি আরও বেশি সম্পর্কিত।

ফুকোর ধারণা

ফুকো অনুসারে, জৈবক্ষমতা হচ্ছে মানুষের বিশাল গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ক্ষমতার একটি প্রযুক্তি। এই রাজনৈতিক প্রযুক্তির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি রাষ্ট্রের সমগ্র জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা তৈরি করে। এটি মানব দেহের শারীরস্থান-রাজনীতি এর মাধ্যমে মানব দেহকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সামাজিক নিয়মানুবর্তিতামূলক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জৈবরাজনীতি এর দ্বারা জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রাথমিকভাবে এটি বাহির থেকে আরোপ করা হয় যার উৎস্য সামাজিক বিজ্ঞান এবং মানবিক বিভাগের দ্বারা গবেষণার দ্বারা সঠিকভাবে বোঝা যায় না, কেননা সেই উৎস্যগুলো ছলনাময় ও প্রতারণাপূর্ণ হয়ে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত এই বিভাগগুলো তাদের বর্তমান গবেষণা পদ্ধতি ব্যবহার করে ততক্ষণ পর্যন্ত এগুলো প্রতারণাপূর্ণ হয়ে থাকে। ফুকোর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, মানুষেরা সামাজিক অনুযায়িতার প্রত্যাশা অনুযায়ী ধীরে ধীরে সম্মত হতে থাকার ফলে, আধুনিক ক্ষমতা সামাজিক আচরণ এবং মানুষের আচরণে প্রোথিত হয়ে যায়। আধুনিক জাতিরাষ্ট্র ও পুঁজিবাদ ইত্যাদির উদ্ভবের ক্ষেত্রে এটি একটি প্রয়োজনীয় ও সার বৈশিষ্ট্য, যার ফলে এটি সম্ভব হয়েছে।[৫] জৈবক্ষমতা দ্বারা আক্ষরিক অর্থেই শরীরের উপর ক্ষমতা অর্জন বোঝানো হয়। এটি হচ্ছে “শরীরের উপর আধিপত্য অর্জন এবং জনগণকে নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে অনেক ও বৈচিত্র্যময় উপায় এর বিষ্ফোরণ”।[৬] ফুকো তার কলেজ ডি ফ্রান্সে জানুয়ারি ও এপ্রিল। ১৯৭৮ এ দেয়া সিকিউরিটি, টেরিটোরি, পপুলেশন শিরোনামের লেকচার কোর্সে এই ধারণাটিকে আরও বিস্তৃত করেন:

এর দ্বারা আমি অনেকগুলো প্রপঞ্চের কথা বোঝাচ্ছি যেগুলো আমার কাছে খুবই উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়। এগুলো হচ্ছে একাধিক কৌশলের সমাহার যার মাধ্যমে মানুষের মৌলিক জীববিজ্ঞানগত বৈশিষ্ট্যগুলোকে রাজনৈতিক কৌশল ও ক্ষমতার একটি সাধারণ কৌশলের অধীনস্থ বানানো হয়। অন্য কথায়, অষ্টাদশ শতকের শুরু থেকে আধুনিক পাশ্চাত্য সমাজগুলো কিভাবে মানুষের একটি প্রজাতি হবার মৌলিক জীববিজ্ঞানগত সত্যকে বিবেচনা করেছে সেটা দেখলেই এটা বোঝা যায়। একেই আমি জৈবক্ষমতা বলছি।[৭]

এটি জনগণের জীবনের রক্ষণাবেক্ষণ বা প্রতিপালনের জন্য সরকারের উদ্বিগ্নতার সাথে সম্পর্কিত, “মানুষের শরীরের উপর শ্রারীরস্থান-রাজনীতি হচ্ছে জীবনের সকল বৈশিষ্ট্য যেমন জন্ম, মৃত্যু, প্রজনন, রোগ ইত্যাদির উপর নিয়ন্ত্রণ।[৮] এটি একটি সাধারণীকৃত নিয়মানুবর্তি সমাজ তৈরি করে[৯] এবং জনগণের উপর আরোপিত জৈবরাজনীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।”[১০][১১][১২] তার লেকচার সোসাইটি মাস্ট বি ডিফেন্ডেড এ ফুকো জৈবরাজনৈতিক রাষ্ট্রীয় বর্ণবাদ এর কথা বলেন। এবং বলেন যে এটি নিজেদের মত পুরাণ ও ব্যাখ্যা তৈরি করে। এখানে তিনি জৈবরাজনীতি[১৩] ও শৃঙ্খলার মধ্যে এভাবে পার্থক্য দেখান:

শৃঙ্খলা হচ্ছে একটি প্রযুক্তি যা ব্যক্তিদেরকে আচরণ সেখায়, কার্যকরী ও ফলপ্রসূ শ্রমিক তৈরি করে। অন্যদিকে জৈবরাজনীতি জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রয়োগ করা হয়, যেমন একটি স্বাস্থ্যবান কর্মশক্তি নিশ্চিত করার জন্য।[১৪]

ফুকো বলেন, পূর্ববর্তী গ্রীক, রোমান ও মধ্যযুগীয় শাসনে রোমান সম্রাট, নাইটদের স্বর্গীয় অধিকার, স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র এবং পোপদের[১৫] শরীরের উপর ক্ষমতা ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ মডেল ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক যা কোন একক ব্যক্তি যেমন রাজা, পবিত্র রোমান সম্রাট, পোপ বা রোমান সম্রাটকে কেন্দ্র করেই ছিল। যাই হোক, মধ্যযুগে রূপক বডি পলিটিক এর উদ্ভব হয়, যার দ্বারা বোঝানো হয় গোটা সমাজই শাসকের সাথে আছে। এক্ষেত্রে রাজা হচ্ছেন সমাজের প্রধান, সেই সাথে তথাকথিত রাজ্যের এস্টেট এবং মধ্যযুগীয় রোমান ক্যাথলিক চার্চ রয়েছেন রাজতন্ত্রের পরেই। তাদের সাথে আবার রয়েছে বেশিরভাগ সামন্ততান্ত্রিক সার্ফ এর কৃষক সম্প্রদায়, এবং সব মিলে একটা স্তরক্রমীয় পিরামিড। উচ্চ বিশ্বাসঘাতকতা এর জন্য এই রূপক এর অর্থ মধ্যযুগীয় আইনে নথিবদ্ধ হয়, এবং যদি এর জন্য কেউ দোষী সাব্যস্ত হতেন তাহলে তাকে ফাঁসি ও অন্যান্য শাস্তি দেয়া হত।[১৬][১৭] যাই হোক, প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় রাজনৈতিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে আধুনিক রাজনৈতিক ক্ষমতার আবির্ভাবের পর এই অবস্থাটি অষ্টাদশ শতকের ইউরোপে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়। জনগণের কাছে আসে উদারপন্থী পাশ্চাত্য জগতের উদার সংসদীয় গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক দল। বিশ্বে আসে প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার, যদিও তখন পুরুষের অধিকারেই কেবল এটা ছিল। ইউরোপে পরে ১৯২৯ সাল থেকে নারীরাও ভোট দিতে শুরু করে (সুইজারল্যান্ডে পায় সবার পর ১৯৭১ সালে), আর যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬৪ সালে কুখ্যাত বর্ণবাদী জিম ক্রো আইন রদের পর কৃষ্ণাঙ্গরাও ভোট দিতে সক্ষম হন।

মানব বিজ্ঞানের উদ্ভব ও ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতকে তার বিকাশের লক্ষ্যবস্তু ছিল প্রাথমিকভাবে আধুনিক পাশ্চাত্য মানব এবং যে সমাজে তারা বাস করে সেই সমাজ। এটি নিয়মানুবর্তী প্রতিষ্ঠান এর বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে।[১৮][১৯][২০] এবং, ফুকো এই মানব বিজ্ঞান বলতে বিশেষ করে মধ্যযুগীয় বিজ্ঞানকে বুঝিয়েছেন, যার ফলে মানব শরীরের শারীরস্থান-রাজনীতি এর উদ্ভব ঘটে, যা মানুষের জৈব ইতিহাসের একটি জৈবরাজনীতি।[২১] সমাজের একটি রূপান্তর ঘটে যার ফলে জোড় করে ইউরোপীয় রাজতন্ত্রকে সরিয়ে দিয়ে “বৈজ্ঞানিক” রাষ্ট্রযন্ত্র তৈরি করা হয়, এবং আইনগত চর্চার পূর্ণাঙ্গ মৌলবাদী পরিবর্তন ঘটানো হয়, যেখানে শাস্তিযোগ্যদের পুনরাবিষ্কার করা হয় এবং এদেরকে পৃথক করা হয়।[২২]

ক্ষমতা দখলের একটি দ্বিতীয় সংস্করণের বিকাশ ঘটে একটি নতুন প্রকরণের ক্ষমতার দ্বারা যেটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক না হয়ে সম্ভাবনার সূত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত (স্টোক্যাস্টিক) ও জনগণকেন্দ্রিক ছিল। জনগণকেন্দ্রিক বলতে ফুকো বুঝিয়েছেন এই রাষ্ট্র ব্যক্তি থেকে জনগণে পরিণত হয়েছে (“জনগণ রাষ্ট্র”),[২৩] সেই সাথে এখানে বৈজ্ঞানিক যন্ত্র এবং সরঞ্জামের আকারে সরকারী কৌশলের নতুন অতিরিক্ত প্রেরণা তৈরি হয়েছে। এই বৈজ্ঞানিক কৌশল, যাকে আমরা রাষ্ট্র নামে চিনি তা জনগণ নিয়ে কম শাসন করে এবং বহিঃস্থ যন্ত্রসমূহ পরিচালনাতেই বেশি মনোনিবেশ করে। এরপর ফুকো আমাদেরকে মনে করিয়ে দেন যে, শরীর (এবং জীবনের) এবং জনগণের এই শারীরস্থান জৈবরাজনীতি একটি নতুন আবিষ্কৃত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং আধুনিক সমাজের “নতুন” রাজনীতি এর সাথে সম্পর্কিত হয়। আর এই আধুনিক সমাজের “নতুন” রাজনীতি উদার গণতন্ত্র এর ছদ্মবেশে আমাদের সামনে হাজির হয়, যেখানে জীবন (জীববিজ্ঞানগত) নিজেই কেবল ইচ্ছাকৃত রাজনৈতিক কৌশল এর অংশ হয় না, সেই সাথে এটি গাণিতিক বিজ্ঞান এবং জীববিজ্ঞান এবং জাতিরাষ্ট্রের জন্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক সমস্যা হয়ে ওঠে।[২৪]