জৈন” শব্দটি এসেছে সংস্কৃত “জিন” (অর্থাৎ, জয়ী) শব্দটি থেকে। যে মানুষ আসক্তি, আকাঙ্ক্ষা, ক্রোধ, অহংকার, লোভ ইত্যাদি আন্তরিক আবেগগুলিকে জয় করেছেন এবং সেই জয়ের মাধ্যমে পবিত্র অনন্ত জ্ঞান (কেবল জ্ঞান) লাভ করেছেন, তাঁকেই “জিন” বলা হয়। “জিন”দের আচরিত ও প্রচারিত পথের অনুগামীদের বলে “জৈন”
“জৈন” শব্দটি এসেছে সংস্কৃত “জিন” (অর্থাৎ, জয়ী) শব্দটি থেকে। যে মানুষ আসক্তি, আকাঙ্ক্ষা, ক্রোধ, অহংকার, লোভ ইত্যাদি আন্তরিক আবেগগুলিকে জয় করেছেন এবং সেই জয়ের মাধ্যমে পবিত্র অনন্ত জ্ঞান (কেবল জ্ঞান) লাভ করেছেন, তাঁকেই “জিন” বলা হয়। “জিন”দের আচরিত ও প্রচারিত পথের অনুগামীদের বলে “জৈন”।[৩][৪][৫]

Jainism
জৈনধর্ম শ্রমণ প্রথা থেকে উদ্গত ধর্মমত। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্মমতগুলির অন্যতম।[৬] জৈনরা তাঁদের ইতিহাসে চব্বিশজন তীর্থঙ্করের কথা উল্লেখ করেন। এঁদের শিক্ষাই জৈনধর্মের মূল ভিত্তি। প্রথম তীর্থঙ্করের নাম ঋষভ এবং সর্বশেষ তীর্থঙ্করের নাম মহাবীর।।[৭][৮][৯][১০][১১]
ভারতে জৈন ধর্মবলম্বীদের সংখ্যা প্রায় ১০,২০০,০০০।[১২] এছাড়া উত্তর আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ, দূরপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া ও বিশ্বের অন্যত্রও অভিবাসী জৈনদের দেখা মেলে।[১৩] ভারতের অপরাপর ধর্মমত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জৈনদের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষিত হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে বৃত্তিদানের একটি প্রাচীন প্রথা জৈনদের মধ্যে আজও বিদ্যমান; এবং ভারতে এই সম্প্রদায়ের সাক্ষরতার হার অত্যন্ত উচ্চ।[১৪][১৫] শুধু তাই নয়, জৈন গ্রন্থাগারগুলি দেশের প্রাচীনতম গ্রন্থাগারও বটে।[১৬]
অহিংসা
Jainism
মূল নিবন্ধ: জৈনধর্মে অহিংসা

হাতের তালুতে চক্রের চিহ্ন। এটি অহিংসার প্রতীক। মধ্যে ‘অহিংসা’ কথাটি লেখা আছে। চক্রটি ধর্মচক্রের প্রতীক। সত্য ও অহিংসার পথে নিরন্তর যাত্রার মাধ্যমে জন্ম-মৃত্যুর চক্রের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কথাটি এই প্রতীকের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে।
অহিংসা জৈনধর্মের প্রধান ও সর্বাধিক পরিচিত বৈশিষ্ট্য।[১৭] কোনোরকম আবেগের তাড়নায় কোনো জীবিত প্রাণীকে হত্যা করাকেই জৈনধর্মে ‘হিংসা’ বলা হয়। এই ধরনের কাজ থেকে দূরে থাকাই জৈনধর্মে ‘অহিংসা’ নামে পরিচিত।[১৮] প্রতিদিনের কাজকর্মে অহিংসার আদর্শটিকে প্রাধান্য দেওয়া জৈনধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।[১৯][২০] প্রত্যেক মানুষ নিজেদের মধ্যে বাক্যালাপ ও কোনোরকম আদানপ্রদানের সময় অহিংসার চর্চা করবে এবং কাজ, বাক্য বা চিন্তার মাধ্যমে অন্যকে আঘাত করা থেকে বিরত থাকবে – এই হল জৈনদের অহিংসা আদর্শের মূল কথা।[২১]
Jainism
মানুষ ছাড়াও সমস্ত জীবিত প্রাণীর প্রতিই জৈনরা অহিংসা ব্রত পালন করেন। এই আদর্শ যেহেতু বাস্তবক্ষেত্রে সম্পূর্ণ রূপে প্রয়োগ করা অসম্ভব, সেহেতু জৈনরা একটি ক্রমোচ্চ শ্রেণীশৃঙ্খলা মেনে চলেন। এই শ্রেণীশৃঙ্খলায় মানুষের পরে পশুপক্ষী, তারপর কীটপতঙ্গ ও তারপর গাছপালার স্থান রয়েছে। এই কারণেই জৈন ধর্মানুশীলনে নিরামিষ আহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ জৈন দুগ্ধজাত নিরামিষ খাবার খেয়ে থাকেন। দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনের সময় যদি পশুদের প্রতি হিংসাত্মক আচরণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে, সেক্ষেত্রে সাধারণ নিরামিষ আহারই গ্রহণ করার নিয়ম। মানুষ ও পশুপাখির পর কীটপতঙ্গরা জৈন ধর্মানুশীলনের রক্ষাকবচ পাওয়ার উপযোগী বলে বিবেচিত হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে কীটপতঙ্গদের ক্ষতি করা জৈন ধর্মানুশীলনে নিষিদ্ধ। উদাহরণ স্বরূপ, কীটপতঙ্গ মারার বদলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। জৈনধর্মে ঐচ্ছিকভাবে ক্ষতি করা ও নির্দয় হওয়াকে হিংসার চেয়েও গুরুতর অপরাধ মনে করা হয়।
মানুষ, পশুপাখি ও কীটপতঙ্গের পর জৈনরা গাছপালার প্রতি অহিংসা ব্রত পালন করেন। যতটা না করলেই নয়, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি তাঁরা গাছপালার করেন না। যদিও তাঁরা মনে করেন, খাদ্যের প্রয়োজনে গাছপালার ক্ষতি করতেই হয়। তবে মানুষের টিকে থাকার ক্ষেত্রে এটা অপরিহার্য বলে তাঁরা এতটুকু হিংসা অনুমোদন করেন। কট্টরপন্থী জৈনরা এবং জৈন সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীরা মূল-জাতীয় সবজি (যেমন আলু, পিঁয়াজ, রসুন) খান না। কারণ, কোনো গাছকে উপড়ে আনতে গেলে গাছের ছোটো ছোটো অঙ্গগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।[২২]
Jainism
জীবনের ধরন ও ও অদৃশ্য জীবন সহ জীবনের আকৃতি সম্পর্কে জৈনদের ধারণা অত্যন্ত বিস্তারিত। জৈন ধর্মমতে, হিংসার পিছনে উদ্দেশ্য ও আবেগগুলি কাজের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, যদি কেউ অযত্নের বশে কোনো জীবিত প্রাণীকে হত্যা করে এবং পরে তার জন্য অনুতাপ করে তবে, কর্মবন্ধন কমে আসে। অন্যদিকে ক্রোধ, প্রতিশোধ ইত্যাদি আবেগের বশে হত্যা করা গুরুতর অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। ‘ভাব’ অর্থাৎ আবেগগুলি কর্মবন্ধনের কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। কোনো সৈন্য আত্মরক্ষার জন্য কাউকে হত্যা করছে এবং কেউ ঘৃণা বা প্রতিশোধের বশে কাউকে হত্যা করছে – এই দুই হিংসার ধরন সম্পূর্ণ আলাদা।
জৈনধর্মে আত্মরক্ষার জন্য হিংসা বা যুদ্ধ মেনে নেওয়া হয়। তবে শান্তিপূর্ণ সমাধানসূত্র না পাওয়া গেলে তবেই এগুলি প্রয়োগের পরামর্শ দেওয়া হয়।[২৩]
মহাত্মা গান্ধী ছিলেন অহিংসা আদর্শের অন্যতম বিশিষ্ট প্রচারক ও পালনকর্তা।
অনেকান্তবাদ
Jainism
মূল নিবন্ধ: অনেকান্তবাদ
জৈনধর্মের দ্বিতীয় প্রধান আদর্শ হল ‘অনেকান্তবাদ’। জৈনদের কাছে, ‘অনেকান্তবাদ’ হল মুক্তমনস্ক হওয়া। এর মধ্যে সকল মতাদর্শ গ্রহণ ও বিভিন্ন বিশ্বাসের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা এর অঙ্গ। জৈনধর্ম এই ধর্মের অনুরাগীদের বিপরীত ও বিরুদ্ধ মতবাদগুলিকে বিবেচনা করার শিক্ষা দেয়। জৈনদের অনেকান্তবাদ ধারণাটি মহাত্মা গান্ধীর ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও অহিংসার আদর্শকে অনুপ্রাণিত করেছিল।[২৪]
অনেকান্তবাদ বহুত্ববাদকে (একাধিক মতবাদের সহাবস্থান) বিশেষ গুরুত্ব দেয়। সেই সঙ্গে মনে করে সত্য ও বাস্তবতাকে বিভিন্ন ও বৈচিত্র্যপূর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা উচিত। কারণ একটি মাত্র দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে তা সম্পূর্ণ বিচার করা যায় না।[২৫][২৬]
এই তত্ত্বটিকে জৈনরা অন্ধের হস্তীদর্শন উপাখ্যানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন। এই গল্পে এক এক জন অন্ধ এক হাতির এক একটি অঙ্গ স্পর্শ করেছিল। কেউ শুঁড়, কেউ পা, কেউ কান বা কেউ অন্য কিছু ধরেছিল। প্রত্যকে হাতির যে অঙ্গটি ধরেছিল, হাতি সেই রকম পশু বলে দাবি করে। হাতিটিকে সম্পূর্ণভাবে স্পর্শ না করতে পেরে তাদের জ্ঞানও সম্পূর্ণ হয় না।[২৭] অনেকান্তবাদের ধারণাটি পরে প্রসারিত হয় এবং স্যাদবাদ কর্তৃক ব্যাখ্যাত হয়।
অপরিগ্রহ
Jainism
মূল নিবন্ধ: অপরিগ্রহ
অপরিগ্রহ হল জৈনধর্মের তৃতীয় প্রধান আদর্শ। ‘অপরিগ্রহ’ বলতে নির্লোভ হওয়া, অপরের দ্রব্য না নেওয়া ও জাগতিক কামনাবাসনা থেকে দূরে থাকাকে বোঝায়। জৈনরা যতটুকু প্রয়োজনীয়, তার চেয়ে বেশি নেওয়ার পক্ষপাতী নন। দ্রব্যের মালিকানা স্বীকৃত। তবে দ্রব্যের প্রতি আসক্তিশূন্যতা শিক্ষা দেওয়া হয়। জৈন ধর্মাবলম্বীরা অপ্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ ও যা আছে তার প্রতি আসক্তিশূন্য হবে – এই হল জৈনধর্মের শিক্ষা। জৈনধর্ম মনে করে তা না করলে দ্রব্যের প্রতি অধিক আসক্তির বশে ব্যক্তি নিজের ও অপরের ক্ষতিসাধন করতে পারেন।
পঞ্চ মহাব্রত
Jainism
আরও দেখুন: যম (হিন্দু দর্শন) § পঞ্চ যম
ব্রতের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং তার মাধ্যমে ব্যক্তিগত চৈতন্যের বিকাশের দ্বারা আধ্যাত্মিক জাগরণের উপর জৈনধর্ম বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে।[২৮] কট্টরপন্থী অনুগামী ও সাধারণ অনুগামীদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন স্তরের ব্রতের বিধান এই ধর্মে দেওয়া হয়।[২৮] এই ধর্মের অনুগামীরা পাঁচটি প্রধান ব্রত পালন করেন:
- অহিংসা: প্রথম ব্রতটি হল জৈন ধর্মাবলম্বী কোনো জীবিত প্রাণীর ক্ষতি করবে না। এর মধ্যে অন্যান্য প্রাণীর প্রতি কার্য, বাক্য বা চিন্তার মাধ্যমে ঐচ্ছিক ও অনৈচ্ছিক ক্ষতিসাধনের শ্রেণীবিভাগ করা আছে।
- সত্য: এই ব্রতটি হল সর্বদা সত্য কথা বলার ব্রত। অহিংসাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তাই অন্যান্য আদর্শের সঙ্গে অহিংসার আদর্শের কোনো বিরোধ বাধলে, এই ব্রতের সাহায্য নেওয়া হয়। যেখানে সত্য বচন হিংসার কারণ হয়, সেখানে মৌন অবলম্বন করা হয়।[২৮]
- অস্তেয়: ‘অস্তেয়’ শব্দের অর্থ চুরি না করা। যা ইচ্ছাক্রমে দেওয়া হয়নি, জৈনরা তা গ্রহণ করেন না।[২৮] অন্যের থেকে ধনসম্পত্তি নিয়ে নেওয়া বা দুর্বলকে দুর্বলতর করাকে জৈনরা চুরি করা বলেন। তাই যা কিছু কেনা হয় বা যে পরিষেবা নেওয়া হয়, তার জন্য যথাযথ মূল্য দেওয়াই জৈনধর্মের নিয়ম।
- ব্রহ্মচর্য: গৃহস্থদের কাছে ব্রহ্মচর্য হল পবিত্রতা এবং সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের কাছে যৌনতা থেকে দূরে থাকা। যৌন ক্রিয়াকলাপ থেকে দূরে থেকে আত্মসংযমকেই ‘ব্রহ্মচর্য’ বলা হয়।[২৯]
- অপরিগ্রহ: অপরিগ্রহ হল অনাসক্তি। এর মাধ্যমে জাগতিক বন্ধন থেকে দূরে থাকা এবং দ্রব্য, স্থান বা ব্যক্তির প্রতি অনাসক্তিকে বোঝায়।[২৮] জৈন সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীরা সম্পত্তি ও সামাজিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ ত্যাগ করেন।
সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের পাঁচটি মহাব্রত পালন করতে হয়। অন্যদিকে গৃহস্থ জৈনদের এই পঞ্চ মহাব্রত এগুলির ব্যবহারিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে যথাসম্ভব পালনের পরামর্শ দেওয়া হয়।[২৮]
এছাড়াও জৈনধর্মে মনের চারটি আবেগকে চিহ্নিত করা হয়: ক্রোধ, অহং, অসদাচরণ ও লোভ। জৈন ধর্মমতে, ক্ষমার মাধ্যমে ক্রোধকে, বিনয়ের মাধ্যমে অহংকারকে, সত্যাচরণের মাধ্যমে অসদাচরণকে এবং সন্তুষ্টির মাধ্যমে লোভকে জয় করার কথা বলা হয়েছে।
ঈশ্বর
Jainism
মূল নিবন্ধ: জৈনধর্মে ঈশ্বর
প্রথম তীর্থঙ্করঋষভের মূর্তি। ইনি জৈন কালচক্রের অবসরপনি যুগে বর্তমান ছিলেন বলে জৈনদের ধারণা।
জৈনধর্ম কোনো সৃষ্টিকর্তা বা ধ্বংসকর্তা ঈশ্বরের ধারণা গ্রহণ করে না। এই ধর্মমতে জগৎ নিত্য। জৈনধর্ম মনে করে, প্রত্যেক আত্মার মধ্যেই মোক্ষলাভ ও ঈশ্বর হওয়ার উপযুক্ত উপাদান রয়েছে। এই ধর্মমতে পূর্ণাত্মা দেহধারীদের বলা হয় ‘অরিহন্ত’ (বিজয়ী) এবং দেহহীন পূর্ণাত্মাদের বলা হয় সিদ্ধ (মুক্তাত্মা)। যে সকল অরিহন্ত অন্যদের মোক্ষলাভে সাহায্য করেন তাঁদের বলা হয় ‘তীর্থঙ্কর’। জৈনধর্মে উত্তর-অস্তিবাদী ধর্মমত মনে করা হয়।[৩০] কারণ, এই ধর্ম মোক্ষলাভের জন্য কোনো সর্বোচ্চ সত্তার উপর নির্ভর করার কথা বলে না। তীর্থঙ্করেরা হলেন সহায় ও শিক্ষক, যিনি মোক্ষলাভের পথে সাহায্য করেন মাত্র। কিন্তু মোক্ষলাভের জন্য সংগ্রাম মোক্ষলাভে ইচ্ছুক ব্যক্তিকেই করতে হয়।
- অরিহন্ত (জিন): একজন মানুষ যিনি সব ধ্রনের আন্তরিক আবেগকে জয় করেছেন এবং কেবল জ্ঞান লাভ করেছেন। এঁদের ‘কেবলী’ও (সর্বজ্ঞ সত্ত্বা) বলা হয়। দুই ধরনের অরিহন্ত হন:[৩১]
- সামান্য (সাধারণ বিজয়ী) – যে কেবলীরা শুধুমাত্র নিজের মোক্ষের কথাই ভাবেন।
- তীর্থঙ্কর – ‘তীর্থঙ্কর’ শব্দের অর্থ যিনি পার করেন বা মোক্ষ শিক্ষার এক গুরু।[৩২] তাঁর জৈন ধর্মমত প্রচার ও পুনরুজ্জীবিত করেন। এঁরাই আধ্যাত্মিক জীবনের আদর্শ। তাঁরা ‘চতুর্বিধ সংঘ’ (শ্রমণ বা সন্ন্যাসী, শ্রমণী বা সন্ন্যাসিনী, শ্রাবক বা পুরুষ অনুগামী ও শ্রাবৈকা বা নারী অনুগামী) পুনর্গঠন করেন।[৩৩][৩৪] জৈনরা বিশ্বাস করেন জৈন কালচক্রের প্রত্যেক অর্ধে ২৪ জন করে তীর্থঙ্কর জন্মগ্রহণ করেন। সর্বশেষ তীর্থঙ্করের নাম মহাবীর। তাঁর পূর্ববর্তী তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ ও মহাবীর – এই দুই তীর্থঙ্করের অস্তিত্বই ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত।[৩৫] [৩৬]

সিদ্ধ বা মুক্তাত্মা। এঁরা দেহহীন হলেও জৈন মন্দিরে এঁদের এইভাবে দেখানো হয়।
- সিদ্ধ: সিদ্ধ ও অরিহন্তরা মোক্ষ অর্জন করে অনন্ত আনন্দ, অনন্ত অন্তর্দৃষ্টি, অনন্ত জ্ঞান ও অনন্ত শক্তি সহকারে সিদ্ধশীলে বসবাস করেন।
ধর্মানুশীলন
সন্ন্যাসবাদ
Jainism

ধ্যানরতা জৈন সন্ন্যাসিনী
জৈনধর্মে সন্ন্যাস প্রথাকে উৎসাহ দেওয়া হয় এবং সম্মান করা হয়। জৈন সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীরা অত্যন্ত কঠোর ও পবিত্র জীবন যাপন করেন। তাঁরা জৈনধর্মের পঞ্চ মহাব্রত সম্পূর্ণত পালন করেন। তাঁদের স্থায়ী বাসস্থান বা বিষয়সম্পত্তি কিছুই নেই। দূরত্ব যাই হোক, তাঁরা খালি পায়ে হেঁটে যাতায়াত করেন। চতুর্মাস্যের চার মাস বাদে বছরের অন্যান্য সময় তাঁরা এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ান। তাঁরা টেলিফোন বা বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন না। তাঁরা রান্না করেন না। ভিক্ষা করে খান। তাঁরা সাধারণত মুখ ঢাকার জন্য একটি কাপড়ের খণ্ড রাখেন যাতে হাওয়ায় ভাসমান জীবাণুদের ক্ষতি না হয়। তাঁদের অধিকাংশই ঝাঁটার মতো দেখতে একটি জিনিস নিয়ে ঘোরেন। রায়োহরণ নামে এই ঝাঁটার মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের সামনের রাস্তা ঝাঁট দিতে দিতে হাঁটেন। বসার আগেও তাঁরা বসার জায়গাটি ঝাঁট দিয়ে নেন, যাতে কোনো কীটপতঙ্গ তাঁদের চাপে মারা না যায়।[৩৭]
জৈনদের উৎসবে সন্ন্যাসীদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক নয়। এঁরা পুরোহিত নন। যদিও কোনো কোনো সম্প্রদায়ে এমন একজন পূজারিকে বিশেষ দৈনিক অনুষ্ঠানগুলি ও মন্দিরের অন্যান্য পৌরোহিত্যকর্মের জন্য নিযুক্ত করা হয়, যিনি নিজে জৈন নন।[৩৮]
প্রার্থনা
জৈনরা কোনো সুবিধা বা পার্থিব চাহিদা পূরণ অথবা পুরস্কারের আশায় আবেগশূন্য দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করেন না। [৩৯] তাঁরা প্রার্থনা করেন কর্মবন্ধন নাশ ও মোক্ষলাভের জন্য।[৪০] ‘বন্দেতদ্গুণলব্ধায়ে’ (সেই দেবতাদের কাছে সেই গুণাবলির কামনায় আমরা প্রার্থনা করি) – জৈনদের এই প্রার্থনা বাক্যের মাধ্যমে তাঁদের প্রার্থনার মূল কথাটি বোঝা যায়।[৪০]
নবকার মন্ত্র
নবকার মন্ত্র হল জৈনধর্মের একটি মৌলিক প্রার্থনা। এটি যে কোনো সময় পাঠ করা যায়। দেবত্ব অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক গুণগুলিকে এই মন্ত্রের দ্বারা উপাসনা করা হয়। এই মন্ত্রে কোনো ব্যক্তিবিশেষের নাম নেই। জৈনধর্মে পূজা বা প্রার্থনার উদ্দেশ্য হল জাগতিক কামনা ও বন্ধনকে ধ্বংস করা এবং আত্মার মোক্ষ অর্জন।
উপবাস
অধিকাংশই বছরের বিভিন্ন সময়ে উপবাস করেন। বিশেষত উৎসবের সময় উপবাস জৈনধর্মে একটি বিশেষ প্রথা। বিভিন্ন ভাবে উপবাস করা যায়। এটি উপবাসকর্তার সামর্থের উপর নির্ভর করে। কেউ দিনে একবার বা দুবার খান, কেউ সারাদিন শুধু জল পান করেন, কেউ সূর্যাস্তের পরে খান, কেউ রান্না করা খাবার খান না, কেউ চিনি, তেল বা নুন ছাড়া নির্মিত রান্না খান। উপবাসের উদ্দেশ্য হল আত্মসংযম অনুশীলন এবং মনকে শুদ্ধ করে প্রার্থনায় অধিকতর মানসিক শক্তি প্রয়োগ।
ধ্যান
মূল নিবন্ধ: জৈন ধ্যান
জৈনরা সাময়িকা নামে এক ধ্যানপদ্ধতি গড়ে তুলেছে। ‘সাময়িকা’ কথাটি এসেছে ‘সময়’ কথাটি থেকে। সাময়িকার উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ শান্তির অনুভূতি পাওয়া ও আত্মার অপরিবর্তনশীলতা অনুধাবন করা। এই ধরনের ধ্যানের মূল ভিত্তি বিশ্ব ও আত্মার পুনঃপুনঃ আগমনের ধারণা।[৪১] পর্যুশন উৎসবের সময় সাময়িকা ধ্যান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মনে করা হয়, ব্যক্তির আবেগগুলি নিয়ন্ত্রণ ও সামঞ্জস্যবিধানে ধ্যান বিশেষ সহকারী। মনের চিন্তাভাবনা যেহেতু ব্যবহার, কাজ ও উদ্দেশ্য লাভের পথে বিশেষ প্রভাবশালী তাই ভিতর থেকে এগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার উপর জৈনধর্মে বিশেষ জোর দেওয়া হয়।[৪২]
জৈনরা ছয়টি কর্তব্য পালন করেন। ‘আবশ্যক’ নামে পরিচিত এই কর্তব্যগুলি হল: ‘সম্যিকা’ বা (শান্তি অনুশীলন), ‘চতুর্বিংশতি’ (তীর্থঙ্কর বন্দনা), ‘বন্দন’ (গুরু ও সন্ন্যাসীদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন), প্রতিক্রমণ (অন্তর্দৃষ্টি), কায়োৎসর্গ (স্থির থাকা) ও প্রত্যখ্যন (ত্যাগ)।[৪৩]
দর্শন
মূল নিবন্ধ: জৈন দর্শন
আত্মা ও কর্ম
মূল নিবন্ধ: জৈনধর্মে কর্ম
জৈন দর্শন অনুসারে, আত্মার সহজাত গুণ হল এর পবিত্রতা। এই আত্মা অনন্ত জ্ঞান, অনন্ত অন্তর্দৃষ্টি, অনন্ত আনন্দ ও অনন্ত শক্তির সকল গুণ তার আদর্শ অবস্থায় বহন করে।[৪৪] বাস্তব ক্ষেত্রে যদিও এই গুণগুলি আত্মার সঙ্গে ‘কর্ম’ নামে এক পদার্থের যোগের ফলে বাধা প্রাপ্ত হয়।[৪৫] জৈনধর্মের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল আত্মাকে কর্মের বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে মোক্ষ লাভ করা।
আত্মা ও কর্মের সম্পর্কটি সোনার উপমার সাহায্যে বোঝানো হয়। প্রাকৃতিক অবস্থায় সোনার মধ্যেও নানান অশুদ্ধ দ্রব্য মিশ্রিত অবস্থায় থাকে। একই ভাবে আদর্শ বা আত্মার পবিত্র অবস্থাও কর্মের অশুদ্ধ অবস্থার সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় থাকে। সোনার মতোই আত্মাকেও যথাযথ পদ্ধতিতে শুদ্ধ করতে হয়।[৪৫] জৈনদের কর্মবাদ ব্যবহৃত হয় ব্যক্তিগত কাজে দায়িত্ব আরোপ করার জন্য এবং এটি অসাম্য, যন্ত্রণা ও দুঃখের ব্যাখ্যা করার জন্য প্রদর্শিত হয়।
রত্নত্রয়
Jainism
মূল নিবন্ধ: রত্নত্রয়
আত্মার মোক্ষ অর্জনের জন্য জৈনধর্মে নিম্নোক্ত রত্নত্রয়ের কথা বলা হয়েছে:[৪৬]
- সম্যক দর্শন – সঠিক অন্তর্দৃষ্টি ও সত্যের অনুসন্ধান এবং একই সঙ্গে সকল বস্তুকে স্পষ্টভাবে দেখার পথে বাধা সৃষ্টিকারী কুসংস্কারগুলিকে বর্জন।
- সম্যক জ্ঞান – জৈন আদর্শগুলি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান।
- সম্যক চরিত্র – জৈন আদর্শগুলি জীবনে প্রয়োগ।
তত্ত্ব
জৈন অধিবিদ্যার ভিত্তি সাত অথবা নয়টি মৌলিক আদর্শ। এগুলি ‘তত্ত্ব’ নামে পরিচিত। তত্ত্বগুলির মাধ্যমে মানুষের দুর্ভাগ্যের প্রকৃতি এবং জীবনের চরম লক্ষ্য আত্মার মোক্ষ লাভের জন্য উক্ত দুর্ভাগ্যের সমাধানের কথা বলা হয়েছে:[৪৭]
- জীব: জীবি সত্ত্বার সারবস্তুকে বলে ‘জীব’। এটি এমন এমন এক বস্তু যা দেহে অবস্থান করে, অথচ দেহ অপেক্ষা পৃথক। চৈতন্য, জ্ঞান ও ধারণা এর মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
- অজীব: পদার্থ, স্থান ও সময় নিয়ে গঠিত প্রাণহীন বস্তুসকল।
- অস্রব: আত্মায় কর্মের (অজীবের একটি বিশেষ রূপ) আবির্ভাবের কারণে সৃষ্ট জীব ও অজীবের সংযোগ।
- বন্ধ: কর্ম জীবকে মুখোশের আড়ালে বদ্ধ করে এবং যথাযথ জ্ঞান ও ধারণার সত্য অধিকার থেকে জীবকে বিরত রাখে।
- সংবর: সঠিক চরিত্রের দ্বারা কর্মের আবির্ভাব স্তব্ধ করা সম্ভব।
- নির্জরা: তপশ্চর্যার মাধ্যমে অস্তিত্ববান কর্মকে পরিহার করা যায়।
- মোক্ষ: যে মুক্ত আত্মা কর্মকে পরিহার করেছে এবং পবিত্রতা, যথাযথ জ্ঞান ও ধারণার স্বকীয় গুণাবলি অর্জন করেছে।
কোনো কোনো গবেষক আরও দুটি শ্রেণী যুক্ত করেছেন: ‘পুণ্য’ (স্তবনীয়) ও ‘পাপ’ (স্তবের অযোগ্যতা)। এগুলি কর্মের সঙ্গে যুক্ত ক্রিয়া।
স্যাদবাদ
Jainism

মহাবীর জৈন দার্শনিক ধারণাগুলি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিস্তারিতভাবে ‘অনেকান্তবাদ’ ব্যবহার করেছিলেন (রাজস্থানের চিত্রকলা, ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ)।
স্যাদবাদ হল অনেকান্তবাদ ধারণা থেকে উৎসারিত একটি মতবাদ। এই মতবাদে প্রতিটি শব্দবন্ধ বা অভিব্যক্তির শুরুতে ‘স্যাদ’ উপসর্গটি যুক্ত করে অনেকান্তকে ব্যাখ্যা করেছে।[৪৮] সংস্কৃত ভাষায় ‘স্যাদ্’ শব্দমূলটির অর্থ ‘হয়তো’। তবে স্যাদবাদের ক্ষেত্রে এই শব্দটির অর্থ ‘কোনো কোনো উপায়ে’ বা ‘কোনো কোনো মতে’। সত্য যেহেতু জটিল, তাই কোনো একক উপায়ে এটির পূর্ণ প্রকৃতিটিকে প্রকাশ করা যায় না। সেই কারণে একটি অনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি বোঝাতে এবং বক্তব্যের মধ্যে থেকে রক্ষণশীলতাকে বাদ দিতে প্রতিটি অভিব্যক্তিমূলক শব্দের গোড়ায় ‘স্যাৎ’ কথাটি যুক্ত করা হয়েছে।[৪৯] স্যাদবাদের সাতটি অনির্দিষ্ট ধারণা বা সপ্তভঙ্গি হল:[৫০]
- স্যাদ্-অস্তি—কোনো কোনো উপায়ে, এটি আছে;
- স্যাদ্-নাস্তি—কোনো কোনো উপায়ে, এটি নেই;
- স্যাদ্-অস্তি-নাস্তি—কোনো কোনো উপায়ে, এটি আছে এবং এটি নেই;
- স্যাদ্-অস্তি-অবক্তব্যঃ—কোনো কোনো উপায়ে এটি আছে এবং এটি বর্ণনার অতীত;
- স্যাদ্-নাস্তি-অবক্তব্যঃ—কোনো কোনো উপায়ে এটি নেই এবং এটি বর্ণনার অতীত;
- স্যাদ্-অস্তি-নাস্তি-অবক্তব্যঃ—কোনো কোনো উপায়ে এটি আছে, এটি নেই এবং এটি বর্ণনার অতীত;
- স্যাদ্-অবক্তব্যঃ—কোনো কোনো উপায়ে এটি অবক্তব্য।
সাতটি অভিব্যক্তির মাধ্যমে সময়, স্থান, বস্তু ও আকারের দৃষ্টিকোণ থেকে সত্যের জটিল ও বহুমুখী প্রকৃতিটিকে প্রকাশ করা হয়েছে।[৫০] সত্যের জটিলতাকে অস্বীকার করা হল গোঁড়ামি-প্রসূত বিপথগামিতা।[২৬]
স্যাদবাদ হল আংশিক দৃষ্টিভঙ্গির তত্ত্ব।[৫১] ‘নয়বাদ’ কথাটি দুটি সংস্কৃত শব্দ নিয়ে গঠিত: ‘নয়’ (আংশিক দৃষ্টিভঙ্গি) ও ‘বাদ’ (দর্শন মতবাদ বা বিতর্ক)। এই মতে একটি দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। প্রতিটির বস্তুর অনন্ত দিক রয়েছে। কিন্তু যখন আমরা সেটি কোনো একটি মতের দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করি, আমরা শুধুমাত্র সেই মতের সঙ্গে যুক্ত দিকগুলি নিয়েই আলোচনা করি এবং অন্যান্য দিকগুলি অগ্রাহ্য করি।[৫১] নয়বাদের মতে দার্শনিক বিবাদের উৎপত্তির কারণ দৃষ্টিভঙ্গির বিভ্রান্তি এবং আমরা সেই দৃষ্টিভঙ্গিগুলিই গ্রহণ করি যেগুলি ‘আমাদের অনুসরণের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি’। আমরা হয়তো তা বুঝতে পারি না। ভাষা ও সত্যের জটিল প্রকৃতির বোধগম্যতার সীমাবদ্ধতার মধ্যে কথা বলতে গিয়ে মহাবীর নয়বাদের ভাষা ব্যবহার করেন। নয়বাদ সত্যের একটি আংশিক অভিপ্রকাশ। এটি আমাদের সত্যকে অংশ ধরে ধরে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে।[৫২]
অনেকান্তবাদে অধিকতর পোষাকিভাবে দেখানো হয়েছে যে, বস্তু তাদের গুণাবলি ও অস্তিত্বের ধরন অনুসারে অনন্ত। মানুষের সীমাবদ্ধ ধারণাশক্তি দিয়ে তার সকল দিক ও সকল রূপের ধারণা করা যায় না। শুধুমাত্র কেবলবাদীরাই বস্তুর সকল দিক ও রূপের ধারণা করতে পারেন। অন্যরা শুধু আংশিক জ্ঞান অর্জন করতে পারে।[৫৩] এই মত অনুসারে, একজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি সর্বোচ্চ সত্যের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না।[২৫]
গুণস্থান
ইতিহাস
মূল নিবন্ধ: জৈনধর্মের ইতিহাস
উৎস
আরও দেখুন: জৈনধর্মের কালরেখা
জৈনধর্মের উৎস অজ্ঞাত।[৬][৫৪] জৈনধর্ম হল একটি অনন্তকালীন দর্শন।[৫৫] জৈন কালচক্র অনুসারে, কালচক্রের প্রত্যেক অর্ধে চব্বিশ জন বিশিষ্ট মানুষ তীর্থঙ্করের পর্যায়ে উন্নীত হন এবং মানুষকে মোক্ষের পথ প্রদর্শন করেন। তাই এঁদের বলা হয় মানুষের আধ্যাত্মিক সহায়ক।[৫৬] মহাবীরের পূর্বসূরী তথা ২৩তম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ ছিলেন একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব।[৩৬][৫৭] তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৯ম-৭ম শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে জীবিত ছিলেন।[৫৮][৫৯][৬০][৬১] আনুশাসনিক ধর্মগ্রন্থগুলিতে পার্শ্বনাথের অনুগামীদের উল্লেখ আছে। উত্তরাধ্যয়ন সূত্রের একটি কিংবদন্তিতে পার্শ্বনাথের শিষ্যদের সঙ্গে মহাবীরের শিষ্যদের সাক্ষাতের কথা আছে। এই সাক্ষাতের ফলে পুরনো ও নতুন জৈন শিক্ষাদর্শের মিলন ঘটেছিল।[৬২]
খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে বর্ধমান মহাবীর জৈনধর্মের সবচেয়ে প্রভাবশালী শিক্ষকে পরিণত হন। জৈনরা তাঁকে ২৪তম এবং এই কালচক্রের সর্বশেষ তীর্থঙ্কর রূপে শ্রদ্ধা করেন। জৈন বিশ্বাস অনুযায়ী, তিনি এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি শুরু থেকেই বহু প্রাচীনকালে প্রতিষ্ঠিত একটি ধর্মের অনুগামী।[৬২]
কিংবদন্তিমূলক ইতিহাস
Jainism
জৈন কিংবদন্তি অনুসারে, সকলপুরুষ নামে তেষট্টি জন বিশিষ্ট সত্ত্বা এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন।[৬৩] জৈন কিংবদন্তিমূলক ইতিহাস এই সত্ত্বাদের কর্মকাণ্ডের সংকলন।[৬৪] সকলপুরুষদের মধ্যে চব্বিশ জন তীর্থঙ্কর, বারো জন চক্রবর্তী, নয় জন বলদেব, নয় জন বাসুদেব ও নয় জন প্রতিবাসুদেব রয়েছেন।[৬৩]
চক্রবর্তীরা হলেন বিশ্বের সম্রাট ও জাগতিক রাজ্যের প্রভু।[৬৩] তাঁর জাগতিক ক্ষমতা প্রচুর। তাও বিশ্বের বিশালতার তুলনায় তাঁর আকাঙ্ক্ষাগুলিকে তিনি খাটো হিসেবে দেখেন। জৈন পুরাণগুলিতে বারো জন চক্রবর্তীর তালিকা পাওয়া যায়। তাঁদের গায়ের রং সোনালি।[৬৫] জৈন ধর্মশাস্ত্রে উল্লিখিত একজন শ্রেষ্ঠ চক্রবর্তী হলেন ভরত। কিংবদন্তি অনুসারে, তাঁর নামেই দেশের নাম হয়েছে ‘ভারতবর্ষ’।[৬৬]
নয় জন করে বলদেব, বাসুদেব ও প্রতিবাসুদেব রয়েছেন। কোনো কোনো দিগম্বর ধর্মগ্রন্থে তাঁদের যথাক্রমে বলদেব, নারায়ণ ও প্রতিনারায়ণ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। ভদ্রবাহুর জিনচরিত (খ্রিস্টপূর্ব ৩য়-৪র্থ অব্দ) গ্রন্থে এই ভ্রাতৃমণ্ডলীর উৎসের কথা বলা হয়েছে।[৬৭] বলদেবরা হলেন অহিংস যোদ্ধা। বাসুদেবরা সহিংস যোদ্ধা এবং প্রতিবাসুদেবরা হলেন মূলত খলনায়ক।কিংবদন্তি অনুসারে, বাসুদেবরা প্রতিবাসুদেবদের শেষ পর্যন্ত হত্যা করেছেন। নয় জন বলদেবের মধ্যে আট জন মোক্ষ লাভ করেছেন এবং সর্বশেষ জন স্বর্গে গিয়েছেন। বাসুদেবরা তাঁদের হিংসাত্মক কার্যকলাপের জন্য নরকে গিয়েছেন। সত্যের জন্য কাজ করতে চেয়েও শুধুমাত্র সহিংসতা অবলম্বনের জন্য তাঁদের এই শাস্তি হয়েছে।[৬৮]